| 24 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প ধারাবাহিক সাহিত্য

চোরাকাঁটা (পর্ব-৭)

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

অনিকদের বিশাল জমিদার বাড়িটা ওর বন্ধুবান্ধবদের কাছে পরম বিস্ময় আর আনন্দের একটা জায়গা ছিল। প্রায়ই বন্ধুরা মিলে সময় সুযোগ পেলেই ওদের বাড়িতে গিয়ে দিন কতক কাটিয়ে আসতো।

বন্ধু বলতে ক্যাডেট কলেজের বন্ধুদেরকেই বোঝে অনিক। ইউনিভার্সিটিতেও বেশ কিছু নতুন বন্ধু বান্ধব জুটে গিয়েছিল তার।কিন্তু ক্যাডেট কলেজের বন্ধুরা সব সময়ই স্পেশাল। সেই ছোট্ট বয়স থেকে একসাথে খেলাধুলা, লেখাপড়া, খাওয়া, ঘুমানো, আড্ডা…এমনকি স্যার ম্যাডামদের বকাঝকা স্নেহ কিংবা সিনিয়রদের র‍্যাগিং হজম করা সব কিছুই একসাথে করতে করতে কখন যেন গাঢ় একটা সম্পর্ক জন্মে গিয়েছিল প্রত্যেকের সাথে। আজ এই বত্রিশ বছর বয়স অব্দি সেই সম্পর্কটাকেই সযত্নে লালন করে চলেছে ওরা। এখনো দেখা হলে আগের মতোই হৈ হুল্লোড়, খুনসুটি, এ ওর পেছনে লাগা…এসব চলতে থাকে। অনিকের জীবনে সুমনার আগমন ঘটেছে ঠিকই। কিন্তু ওদের সম্পর্কটা সেই আগের মতোই আছে।

সুমনা সহজেই নিজেকে সব পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। ওর মধ্যে আশ্চর্য রকমের একটা সহজ ব্যাপার আছে। হয়ত জন্মগত ভাবেই এটা ওর সাথে আছে কিংবা সময়ের সাথে আয়ত্ত করে ফেলেছে নিজের মধ্যে। সেজন্যই হয়ত অনিকের বন্ধুরাও সুমনার কাছে এসে আড়ষ্ঠ হয়ে পড়ে না।

স্কুল থেকে কলেজ পর্যন্ত দশ বারোজনের একটা ক্লোজ গ্রুপ ছিল অনিকদের। ওদের সকলের সামাজিক অবস্থাটা একরকম ছিল না। ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণিতে বড় হয়ে ওঠা কিশোরদের মাঝে সেই বয়সে শ্রেণি-বিভেদের ব্যাপারটা কাজ করতো না। তাই সহজেই বন্ধুত্বটা জমে গিয়েছিল। হয়ত এখন হলে এত সহজে ওরা আমেদুধে মিশে যেতে পারতো না। শ্রেণি-বিভেদ কোনো না কোনো ভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতোই।

সোহেল, শিহাব, দিনার, রিয়াজ আর রাজন বেশ অবস্থাপন্ন পরিবার থেকেই এসেছে।ওদের পাঁচজনের বাবারই নানা রকম ব্যবসাপাতি ছিল ঢাকায়। শিহাবের বাবা তো ঢাকার একজন বিশিষ্ট বিজনেস ম্যাগনেট। দিনার আর রাজনের বাবার ইমপোর্ট এক্সপোর্টের ব্যবসা। ওদের ব্যবহার্য সব জিনিসপাতিই ইমপোর্টেড। আর রিয়াজের বাবা দেশের বেশ নামী একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক। বড় বড় কনস্ট্রাকশন কাজগুলোতে ওর বাবার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম জড়িত থাকে। বিশাল সব রাঘব বোয়ালদের সাথে ওঠা বসা ওর বাবার। যদিও এতসব ভারী ভারী বিষয় নিয়ে সেই বয়সে ওরা মাথা ঘামাতো না, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই খুঁটির জোরগুলোও ওদের সম্পর্কে  আলাদা রঙ ধরাতে শুরু করেছে।

দেশের টপ তিনটা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নাম বলতে গেলে রিয়াজের বাবার ‘রিয়াজ কনস্ট্রাকশন্স’ এর নাম উঠে আসে। সেই রিয়াজ কনস্ট্রাকশন্স এর রিয়াজ বাপের প্রভাবের গরমেই হয়তোবা ছোটবেলা থেকে একটু বেশিই ডাকাবুকো ধরনের ছিল। বয়সের সাথে সাথে সেই ডাকাবুকোপনায় নতুন নতুন মাত্রা যোগ হয়ে গিয়েছে শুধু। অশ্লীল জোক, আজেবাজে চটি বইয়ের সমাদর রিয়াজের মতো আর কেউ করতে পারতো না। দু’একজনকে সে দলে ভিড়াতে পারলেও অন্যরা কেউ তেমন একটা আগ্রহ দেখাতো না। এছাড়াও অন্য গ্রুপের ছেলেপিলের সাথে মারপিট, রেষারেষি, হাঙ্গামা আর দলাদলিতেও রিয়াজ পিছিয়ে থাকতো না। নিয়ম ভাঙার অমোঘ নিয়মের প্রতি সে বরাবরই শ্রদ্ধাশীল ছিল। অনিকদের গ্রুপে রিয়াজের অবস্থানটা প্রথম থেকেই তাই একটু বেমানান ছিল। রিয়াজ যেন গায়ের জোরেই এতদিন ধরে টিকে আছে ওদের সাথে। অনিকরা নানাভাবে ওকে পাত্তা না দিয়ে থাকারও চেষ্টা করেছে। বিশেষ ফল হয়নি। রিয়াজ গলাবাজি করেই দলে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করে নিয়েছে।

শান্ত, শোভন, ফরহাদ, ইকবাল আর কবির মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। এদের মধ্যে ফরহাদ আর শান্ত একেবারেই সাধারণ পরিবার থেকে এসেছে। দুজনেই গ্রামের স্কুলে পড়ালেখা করতো। ছাত্র ভালো ছিল, সঙ্গে ছিল অধ্যবসায়। ক্যাডেট কলেজে চান্স পেয়ে আজকের এই অবস্থানে উঠে আসা। মাঝখানের পথটা কষ্টসাধ্য ছিল ওদের জন্য, সন্দেহ নেই। অন্তত অন্য বন্ধুদের মতো এত সহজ তো ছিল না মোটেও। ইকবাল, শোভন আর কবিরের বাবা সরকারী চাকুরিজীবী। সেই বয়সে হয়ত আদর্শ, শিষ্টাচার, নীতিবোধ, পরিমিতিবোধ, মিতব্যয়িতা…এই শব্দগুলো খুব বেশি ভারী ভারী শোনাতো। কিন্তু এই বন্ধুদের মাঝে এমন কিছু জিনিসের যে অন্যরকম এক সংমিশ্রণ ছিল, এটা সেই বয়সেও মনে হয়েছে ওদের। ধনী বাবার ছেলেদের মতো ওরা সবকিছু ফেলেছেড়ে ব্যবহার করতো না। অব্যবহৃত অংশটুকু সুন্দরভাবে মুড়িয়ে রেখে দিত পরের দিনের জন্য। সম্পর্কের সুক্ষ্ণদাগগুলোও আর সবার চেয়ে ওরাই বেশি যত্নের সাথে অনুভব করতে পারতো। হয়ত ওদের জীবনটা নানা দাগের আঁচড়ে ভরা থাকতো বলেই এই আশ্চর্যরকম পারদর্শীতা।

অনিকদের বিশাল বাড়িতে এলে এরা কেমন যেন একটু চুপসে যেত। বাড়ি ভর্তি চাকরবাকর, ডেকচি ভরা হরেক পদের রান্নাবান্না, ফাই-ফরমাশ, শখ, বিলাসিতা…এসবে ওরা অভ্যস্ত ছিল না। প্রথমদিকে দু’একদিন চুপচাপ কেটে যেত। হয়ত অনভ্যস্ততা আর অনভ্যাসের পর্দাটা সরতে সময় লাগতো। পরে অনিকের বাবা-মা’র সহজ আর আন্তরিক আচরণে ওরাও স্বাভাবিক হয়ে যেত এক সময়। অনিকের মা ওদের খাওয়ার সময়ে নিজে দাঁড়িয়ে থাকতেন। চাকর বাকরদের বেশি বেশি খাবার তুলে দিতে বলতেন প্রত্যেকের পাতে। অনিকের বাবা ফজলুল আহমেদের তুমুল মাছ ধরার নেশা ছিল। অনিকের বন্ধু বান্ধবেরা ওদের বাসায় বেড়াতে গেলে প্রতিদিন পুকুরে জাল ফেলা হতো। বেশ কয়েকটা পুকুর ছিল ওদের বিশাল বাড়ির চারপাশে। বড় বড় ফল ফলাদির গাছপালায় ঝোপালো সেই জায়গা জুড়ে বিস্তৃত পুকুরগুলো দেখে কেমন যেন গা ছমছম করে উঠতো। মনে হতো, কিছু একটা রহস্যের মায়াজাল যেন জড়িয়ে আছে পুরোটা জায়গা জুড়ে। শতাব্দী পুরনো কোনো চাপা পড়ে যাওয়া অতীত ইতিহাস বুঝি গুমড়ে ফিরছে জায়গাটার চারপাশে।

অনিকের দাদার দাদা ছিলেন জমিদার। অর্থাৎ জমিদারের বংশধর অনিক। কথায় বলে, জাত গোখরার লেজেও বিষ। জমিদারী শেষ হয়েছে আজ অনেকদিন। পড়ে আছে ভগ্নস্তুপ। কিন্তু জমিদারীর রক্ত তো আর শরীর থেকে মুছে যায়নি! সেই জাত রক্তের অন্যরকম এক গন্ধ আছে। বন্ধু-বান্ধবরাও সেই রক্তের আলাদা তেজ টের পেত। তবে ছোটবেলা থেকেই অনিক মিশুকে আর দিলখোলা স্বভাবের। ঠাট্টাতামাশা করতে ভালোবাসতো। বন্ধুদের কাছে উদার হিসেবেও সুখ্যাতি ছিল অনিকের। কাউকে টাকাপয়সা ধার দিলে বেমালুম ভুলে যেত। যাদের ইচ্ছে করতো, ফিরে এসে ধারের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সেই টাকা ফেরত দিত। আর যাদের সেই ইচ্ছেটা করতো না, তারাও টাকা ফেরত দেওয়ার কথা অনিকের মতোই ভুলে যেত।

হয়ত এই দিলখোলা স্বভাবটাও জমিদারী পরম্পরারই অন্তর্গত। বন্ধুবান্ধবেরা বেড়াতে এলে অনিক একেবারে রাজকীয় সুখ সুবিধা ভোগ করাতে চাইতো বন্ধুদের। এই ব্যাপারে অনিকের বাবা-মারও পুরো সমর্থন থাকতো। ছেলে কিছু ইচ্ছে করবে আর তারা সেটা পূরণ করবেন না, এটা কিছুতেই হতে পারে না। বিশেষ করে প্রতি সন্ধ্যায় গানের আসরটা এখনো মনে আছে অনিকের বন্ধুদের। পাড়া গাঁয়ের গায়েন, বাদকদের খবর দিয়ে আনিয়ে জমিদার বাড়িতেই তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হতো। তারপর অনিকের বন্ধুরা যতদিন ওদের বাড়িতে থাকতো, টানা প্রতি সন্ধ্যায় চলতো সেই গানের আসর। অনিকের বাবা উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। শহরে পড়াশুনা করেছেন। কিন্তু তিনিও এই জমিদারীর আয়েশভরা জীবন ছেড়ে শহরে ফিরে যেতে চাননি। পরে গিয়েছেন যদিও, সেও খানিকটা বাধ্য হয়েই।

বিশাল তিনতলা বাড়ির সবচেয়ে ওপরের তলাটা কয়েকদিন ধরে ঝাড়মোছ করে রাখতো অনিকদের বাড়ির চাকরবাকরেরা। অনিকের বন্ধু বান্ধবেরা বেড়াতে এলে সেই ওপরের তলাতেই থাকতো। যতদিন বন্ধুরা অনিকদের বাড়িতে থাকতো, ততদিন কারোরই তিন তলায় প্রবেশের অনুমতি ছিল না। অনিকের বাবাই এটা কড়া ভাবে সবাইকে বলে রেখেছিলেন। এমনিতে উনি দিলখোলা হাসিখুশি মেজাজের মানুষ ছিলেন। কিন্তু তার কথার এতটুকু নড়চড়ও কেউ কখনো করার সাহস পেত না।

তাই তিন তলাটা থাকতো বাইরের জগত থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন। কোনোকিছুর প্রয়োজন পড়ার আগেই সেটা জায়গামত হাজির থাকতো। অফুরন্ত খাবার-দাবার, খেলাধুলার বন্দোবস্ত সবকিছুই দেদার মজুত থাকতো ওদের জন্য। বন্ধুদের আনন্দের সীমা ছিল না। মাঝরাত পর্যন্ত আড্ডাবাজি, হৈচৈ, নাচগান… আসর একেবারে জমে যেত। রিয়াজ আর দিনারের সেই বয়সেই সিগারেটের নেশা হয়ে গিয়েছিল। দিনার কিছুটা রাখঢাক করার চেষ্টা করলেও রিয়াজের ওসবের বালাই ছিল না। মাঝে মাঝে বাইরে গিয়েও ফুঁকে আসতো ইচ্ছেমত।

তিন তলার বিশাল ঘরগুলোতে হাতে আঁকা বড় বড় পেইন্টিং ছিল। পেইন্টিংগুলো অনিকের পূর্বপুরুষদের। ছবিগুলো দেখেই বোঝা যেত, মোটা টাকা খরচ করে দিনের পর দিন সিটিং দিয়ে সেগুলো আঁকা হয়েছে। অনিকের বন্ধুদের সেই ছবিগুলোর প্রতি ছিল তুমুল আগ্রহ। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ঘরের বন্ধুরা জাদুঘরে রাখা জিনিসের মতোই পেইন্টিংগুলোর গায়ে হাত বুলাতো। একবার তো শোভন বলেই ফেলেছিল,

‘আচ্ছা অনিক, এই পেইন্টিং গুলোর কত দাম হতে পারে রে? ম্যালা দাম, তাই না? তোরা এগুলো মিউজিয়ামে দিচ্ছিস না কেন বলতো? আমাদের হলে তো কবেই দিয়ে দিতাম! সরকারী মিউজিয়ামে গেলে অনেক টাকাও পাওয়া যেত!’

রিয়াজ মুখচোখ বেঁকিয়ে ভয়াবহ অবজ্ঞার সুরে বলেছিল,

‘সেজন্যই তো ওগুলো তোদের বাড়িতে না জন্মে এখানে জন্মেছে। শালা, যা দেখিস তাতেই টাকার গন্ধ খুঁজিস তাই না? ফকিরের বা…’

‘এই রিয়াজ…একদম মুখ খারাপ করবি না! খবরদার!’ পাশ থেকে অনিক অনেকটা শাসনের সুরেই বলে উঠেছিল। রিয়াজের মুখ খারাপ। এটা ওরা সকলেই জানতো। সেই স্কুল জীবনের অল্প বয়সেই রিয়াজ যে সমস্ত খিস্তিখেউর করতো তা শুনে ওরা অবাক হয়ে যেত রীতিমত। তবুও রিয়াজকে দল থেকে সরাতে পারতো না। প্রথমদিকে সে অনেকটা গায়ে পড়েই কতৃত্ব দেখাতো। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে অনেককিছুই বদলে যেতে থাকে। কী কারণে যেন অনিকই একসময় রিয়াজকে দলে রাখতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। হয়ত নিজের ক্ষমতার বলয় দেখিয়ে অনিককে কিছু একটা ভয় দেখিয়েছিল রিয়াজ। বন্ধু মহলে ওরা একাত্মা হলেও রিয়াজ একেবারেই অন্যরকম, আগাগোড়াই।

জমিদারীর সেই বিশাল বাড়িঘর ছেড়ে পুরোপুরি পাততাড়ি গুটিয়ে অনিকদের যখন শহরে আস্তানা গাঁড়তে হলো, তখন সবকিছু বদলে যেতে সময় লাগলো না। কাজেই রিয়াজের মতো ফালতু একটা ছেলে সেই সময়ে এটা সেটা বলে ওকে ভয় দেখাতেই পারে! কিংবা ক্ষমতার দাপটও দেখাতে পারে। দুর্বলের ওপরে জোর খাটানো সহজ।

অনিকের মতো খানদানী পরিবারের ছেলেকেও দুর্বলের তালিকায় নাম লেখাতে হয়েছিল। হয়ত এটাই বিধাতার নিয়ম। মানুষকে এক জীবনেই মূদ্রার এপিঠ ওপিঠ দেখিয়ে দেন তিনি।

কফি শপের বিশাল কাঁচের দেওয়াল ঘেঁষা এক প্রান্তে বসে সেই ছোটবেলার দিনগুলোর কথা ভাবছিল শান্ত। অনিকদের পরিবারের সাথে কাটানো সেই সুন্দর দিনগুলো ঘুরেফিরে উঠে আসছিল মনে। নানাদিক দিয়ে জীবন আজ অনেক অন্যরকম হয়ে গেছে। তবু সেই নিখাঁদ বন্ধুত্বের বাঁধনটা আজো তেমনই অটুট আছে। বন্ধুর বিপদে তাই মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকা যায় না। যদিও এটা অনিকের পরিবারের একান্ত ব্যক্তিগত সমস্যা। তবুও বন্ধুত্বের দাবীতেই এগিয়ে এসেছে শান্ত। আজ অনিকের সাথে তার একান্তে কথা বলা প্রয়োজন। রিয়াজকে নিয়ে। অনিক আর সুমনা আজ যে বিপদে পড়েছে, এই বিপদে ওরা বন্ধুরা যদি এগিয়ে না আসে তাহলে আর কারা আসবে?

ওরা যখন এইচ এস সি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন থেকেই অনিকদের পরিবারে দুর্যোগ নেমে আসে। বিশাল বাড়ি, প্রচুর জায়গা জোড়া বড় বড় সব পুকুর, ফলপাকুরের গাছপালা…এসবকিছু নাকি তখন বিক্রি করার চিন্তা ভাবনা করছিলেন অনিকের বাবা। শান্তরা অবাক হয়ে শুনেছিল অনিকের মুখে। এই তো কিছুদিন আগেও ওরা এইচএসসি’র টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে দলেবলে ঘুরে এসেছে ওদের বাড়ি থেকে। সেই আগের মতোই সবকিছু পরিপাটি, ছিমছাম। একইরকম আনন্দ আর হৈ হুল্লোড়ে কেটে গেছে কয়েকটা দিন। সকাল বিকেল পুকুরে মাছ ধরা, প্রশস্ত ছাদে ঘুড়ি ওড়ানো, ডাব কলা আর এটা সেটা ফলের গাছের মুড়ো ভেঙ্গে সব ফল পেড়ে ফেলা, সন্ধ্যেবেলায় গানের আসর! কোনো কিছুতেই তো কোনো মন খারাপের খবর ছিল না! তাহলে হুট করে সব বিক্রি করে ফেলার কথা আসছে কেন?

শান্ত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল,

‘আর তোদের পূর্বপুরুষদের ঐ ছবিগুলো? ওগুলোও বিক্রি করে দিবে সব? নাকি মিউজিয়ামে…’

পাশ থেকে রিয়াজ আবার ফোঁড়ন কেটেছিল,

‘ঐ যে, টিপিকাল মিডলক্লাসদের মাথাতে খালি সেই একই চিন্তা!’

অনিক এবারে আর রিয়াজকে বাধা দিয়ে কিছু বলেনি। শুধু মুখ কালো করে বিষণ্ন গলায় বলেছিল,

‘জানি না কী করবে ছবিগুলো। মিউজিয়ামে দিয়ে দিতে পারে। তাতে যদি কিছু টাকাপয়সা হাতে আসে! বাবার এখন অনেক টাকার প্রয়োজন। জানি না কেন, সব জমিজমা বিক্রি করে দিচ্ছে। দেশের বাড়িটা অন্তত রাখতে পারতো! সেটাও…!’

রিয়াজের যথারীতি মাঝপথে বাগড়া,

‘আগে টাকা কামিয়েছে, এখন টাকা গচ্চা যাচ্ছে! এটাতে এত আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? হয়ত কোনো ঝামেলা বেঁধেছে, তাই টাকার ওপর দিয়ে বাঁশ যাচ্ছে…!’

রিয়াজ হয়ত আরো কিছু বলতো। কিন্তু রিয়াজের দিকে নিক্ষেপ করা অনিকের কাতর চাহনী কারো নজর এড়ালো না। ভেতরে ভেতরে অনেক প্রশ্ন জাগছিল ওদের মনে। কিন্তু পারিবারিক ঝক্কি ঝামেলার গল্প কেউ কাউকে বলতে আগ্রহী না হলে আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করা যায় না। এটা এই বয়সেও ওরা বুঝে গিয়েছিল।

আর একটা বিষয় আবিষ্কার করেও ওরা খুব অবাক হয়েছিল। ওদের সেবারের সেই ট্যুর থেকে ফিরে আসার পর  সবাই লক্ষ করেছিল, অনিক কেমন যেন ভয় পাচ্ছে রিয়াজকে। সব কথাই চুপচাপ মেনে নিচ্ছে। হয়ত মন থেকে পুরোটা মানতে পারছে না। চুপ করে থাকছে। নয়তো মাথা নীচু করে বসে থাকছে। কিন্তু কোনো প্রতিবাদ কিংবা ধমকাধমকি কিছুই আর করছে না রিয়াজকে। অথচ ওদের বন্ধুদের মধ্যে অনিকই রিয়াজকে কিছুটা দাবিয়ে রাখতে পারতো!

অনিকের কথাগুলো শুনে ওরা বন্ধুরা অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। সবাই একযোগে। কেমন যেন অসহায় দুর্বল মানুষের মুখ। ওদের প্রত্যেকের মধ্যে রাজ্যের কৌতুহল আর বিস্ময় ছিল। কষ্টও হচ্ছিলো কেমন যেন। কতদিনের কত স্মৃতি অনিকদের সেই বিশাল বাড়িকে ঘিরে! রিয়াজের বিশেষ ভাবান্তর নেই। সে ভ্রু কুঁচকে পেন্সিল চিবুচ্ছিল। একে একে শোভন, কবির, ফরহাদ সবাই এটা সেটা নানারকম প্রশ্ন করে যাচ্ছিলো,

‘তোদের ঐ বিশাল বাড়িটাতে কত কত পুরনো ফার্নিচার, এণ্টিক সব জিনিসপাতি! এগুলো বেচে দিলে তো ম্যালা টাকা পাওয়া যাবে। কিন্তু বাড়িটা বেচে দিবে কেন রে? কত বড় বাড়ি! কী বিশাল জায়গা জুড়ে! গাছপালা, পুকুর…এগুলো বেচে দিয়ে আংকেল আন্টি ঢাকায় এসে থাকবেন? যাহ্‌! তাই হয় নাকি?’

অনিকের মুখে ম্লান হাসি। গলার বিষণ্নতা কারো কান এড়ায় না। তবু হাসিমুখেই বলে,

‘কেন হয় না? জমিদারীর আঁটি চুষে আর হবে কী? আসল জিনিসই তো বেরিয়ে গেছে! ওসব ফার্নিচারের বেশিরভাগই বন্ধক পড়েছিল…জানিস কিছু? এখন পাওনাদারেরা আসবে তাদের পাওনা মিটিয়ে নিতে। বন্ধক ছুটানো তো আর বাবার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই জিনিসপাতি সবকিছুই বিনা ঝঞ্ঝাটেই পাওনাদারেরা নিয়ে যেতে পারবে। নতুন কিছু আর আমদানী হবে না তা থেকে। আর ওসব ছবির মূল্য আমাদের কাছে থাকতে পারে। অন্যদের কাছে ওগুলোর আর আলাদা এমন কী দাম? দিয়ে দিক মিউজিয়ামে। তাতে যদি কিছু আসে, আসলো!’

ওদের মুখে ভাষা সরেনি। এটা জিজ্ঞেস করার জন্য প্রাণটা একেবারে আইঢাই করছিল, ‘এত দেনা কীভাবে হলো তোর বাবার?’ কিন্তু এতটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা যায় না। দু’পক্ষেরই সম্মানে লাগে।

তবু যথারীতি সেই রিয়াজই আবার তার আলটপকা মুখ খুলে ফেললো। ভাষাটা আরেকটু সংযত হলে এমন কিছু ক্ষতি ছিল না। কিন্তু ঐ যে কথায় বলে, ইল্লত যায় না ধুলে খাসলত যায় না ম’লে! রিয়াজ নোংরা ভাবভঙ্গি করে হাসতে হাসতেই বলেছিল,

‘কেন রে অনিক, তোর বাবা কি জুয়াটুয়া খেলতো নাকি রে? মানে খেলে নাকি? নইলে এত দেনা তো এমনি এমনি হওয়ার কথা নয়! নাকি কোনো বান্ধা কিছু আছে…যার পেছনে মাসে মাসে টাকা ঢালতে হয়…তেমন কিছু থাকলে বলিস…ছুটানোর ব্যবস্থা করা যাবে! হেহ হে হে…’

রিয়াজের অশ্লীল ভাব আর ভাষা শুনেও অনিক সেদিন বেশিকিছু বলেনি তাকে। ওরা বন্ধুরা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল অনিকের দিকে। আগুনের মতো তেজ এত দ্রুত কীভাবে ফুরিয়ে গেলে অনিকের? সত্যিই কি ওর বাবার তেমন কোনো ভয়াবহ কিছু আছে নাকি? আর রিয়াজকে এত ভয় করছে কেন অনিক? রিয়াজ কি কোনোভাবে এসবে তার কলকাঠি নাড়িয়েছে? কিন্তু তাতে রিয়াজের কীসের সবার্থ?

যদিও বয়সটা তেমন কিছু বেশি নয় ওদের তখন, সবে আঠার উনিশ। কিন্তু বিগড়ানোর জন্য এই বয়সটা একেবারে পারফেক্ট। আর তাছাড়া পেটে শয়তানী থাকলে এই বয়সে অনেক রকম বুদ্ধির দরজাও সপাট খুলে যায়। কাজেই রিয়াজের মাথায় কী ঘুরছে আর অনিকও বা কেন তাকে এত ভয় করছে এই রহস্য ওদের কাছে রহস্যই থেকে যায়।

অনিকের এই পরিবর্তনটা কারো কাছে অজানা থাকে না। হয়ত পারিবারিক সমস্যা অনিকের ভেতরে তীব্র কোনো সঙ্কট তৈরি করেছে। আর সেটা থেকেই এই ব্যাপক পরিবর্তন। সেবার অনিকদের বাসা থেকে ফেরার সময়ে ট্রেনেই ব্যাপারটা প্রথম নজরে আসে ওদের বন্ধুদের।

(ক্রমশ)

 

 

আগের পর্ব ও লেখকের অন্যসব লেখা পড়তে ক্লিক করুন।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত