| 28 মার্চ 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ইরাবতী সাহিত্য গল্প: জবানের সুর । প্রতিভা সরকার

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

এই কইলকাতা শহর কী আশ্চয্যি জায়গা মাগো, তার বুকের মদ্দিখানে বড় পাকা রাস্তার পাশে বেশ্যাপাড়া, ঐপাশে গেরস্ত বাড়ি। অতো দূরেও যাইতে হইবে না, একই গলির মদ্দে পাশাপাশি গেরস্ত বাড়ি আর রান্ডি বাড়ির গেট, এমুনও আছে। 

পাছে মাতাল খরিদ্দার বদলি গেট দিয়া ঢুইকা পড়ে তাই কলকাত্তাইয়া-গিন্নিমায়ের- বাঙাল-স্বামী-গেরস্ত-বাড়ির-কত্তা সাদা চুণ দিয়া টিনের দরজায় লেইখা রাখে, “গেরস্থ বাড়ি। বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ।” ভুইলা গিয়া জানালা খুইলা রাখলে নয় ক্লাসে পড়া মাইয়াডারে টাইনা থাপ্পড় লাগায়,”উলুক ঝুলুক করস কিয়ের লাইগা? বান্দরি কোহানকারে!”

ফেইলা আসা তোর্সাপাড়ের মতো কথা কওয়ার ধরন শুইনা রম্ভা আর ম্যানকা চাওয়াচাওয়ি করে। কত্তদিন পরে তাদের জবানে কেউ কিছু কয় আর তাই কানে আসে ! মধু রে মধু ! দুই বুইনের দুই জোড়া চক্ষু আনন্দে চকচকায়! 

কিন্তু তাতে কী আটকান যায়! মাল পেটে ঢুইকলে, গা মাথা গরম হইতে থাইকলে কী আর চুনের লিখা পড়ন যায়! ‘প্রবেশ নিষেধ’-রে কপালের-উপরে-উঠা-চক্ষুতে মাতাল পড়ে, ‘আসেন নাগর, ঢুইকা পড়েন।’ ফলে যা হইবার তাই হয়, টিনের দরজায় বিরাট শব্দ, থাপ্পড়ের ধপাধপ, কইলকাত্তাইয়া গিন্নি মায়ের সরু গলায় চিৎকার, ‘কোন ড্যাকরামুখো একেনে মরতে এয়েচে রে,’ সঙ্গে কেলাস নাইনের ফোঁপানি, ‘মা, বাবাকে বল না বাড়িটা চেঞ্জ করতে প্লিজ,’ এইসবে হাওয়া এক্কেরে গরম হইয়া উঠে। 

রম্ভার পিঠের ঘামাচিগুলা সেই জন্যিই য্যান চিড়বিড়াইয়া উঠে, ব্লাউজের সেফটিপিন পটপট খুইলা উদলা পিঠে মেনকারে কয়, ‘এই ম্যানকা, এইহানে এট্টু চুলকাইয়া দে তো, না না, ঐহানে না, আরও বাঁয়ে নাইমা আয়, আট্টু নিচে আট্টু, অহহহহহ, কী আরাম, কী আরাম!’ 

ম্যানকা তার খ্যাদড়া ব্যাদড়া নখগুলারে রম্ভার পিঠে বসাইয়া দিলে আরামে তার বুকের ভিতর থিকা পাঁচিলে বইসা থাকা বিড়ালিটার প্যাটের ভিতরের মতো ঘররররর শব্দ উঠতে থাকে। ছুরি চালানোর মতো ম্যানকার নখ চলে, সাদা সাদা খড়ি পড়া পিঠ ছুইলা গিয়া লম্বা লম্বা দাগ পইড়া যায়, তবু রম্ভা খালি কইতেই থাকে, ‘আঃ আঃ আঃ, আট্টু দে বুন, আট্টু দে!’

হঠাৎ ম্যানকা বলে, ‘দিদি, মসজিদ বাড়ি স্ট্রিটের মোড়ে কী হচ্ছে রে?  স্টেজ বেঁধেছে, গান শুনি, মাইকে আং সাং কী যেন কয়!’

ম্যানকা এ পাড়ায় বাসা নিয়াই কইলকাতার জবান কন্ঠে তুইলা লইছে, তবে অহনও মাঝে মইদ্দে তোর্সাপাড়ের কথা ভাইসা ভাইসা তার ঠোঁটের ডগায় আইসা যায়। সে বাতাবি লেবুরে কয় জাম্বুরা, শুঁয়াপোকাকে ছ্যাঙ্গা। মাইনষের জবানের সুর যে কতো রকম! পুরা কোঠাবাড়িতে যারে কয় ঘুঁটে, রম্ভা ম্যানকা, দুইজনেই তারে কয় ঘসি!  

তা সেইদিন কলেজে পড়া সুন্দর মতো পোলাটা নাকি তার কানের লতিতে নাক ঠেকাইয়া কইছে, ‘আহ মেনকা, তোমার মুখের মেশানো ভাষা আমার খুব মিষ্টি লাগে। কেমন যেন লেবুপাতার গন্ধ পাই। নাকি ভেজা মাটির!’

এই নিয়া সারাদিন হাসাহাসিও কিসু কম হয় নাই। আশেপাশের ঘরের মাইয়াগুলা সবাই ম্যানকার গালে নাক ঠেকায় আর কয়, ‘আহ আহ নেবুপাতার গন্ধ পাচ্ছি যেন, উরিব্বাস রে, নাকি ভেজা মাটি ! আরে, এর যে দেখি ঠ্যাকারে মাটিতে পা পড়ে না!’

শ্যাসম্যাস ম্যানকা রাইগা গিয়া গাইল দিতে থাকে। তবু হাসি বন্ধ হয় না দেইখা দুম কইরা দরজা বন্ধ কইরা দিলে তবে সেইসব থামে। পুতুল মাসি অবশ্য তার মদ্দেই খিস্তি খেউড় চালাইয়া গেল পাক্কা এক ঘন্টা। আর কুনো ছচকা না পাইয়া রম্ভা ম্যানকা দুই বুইনের ভাষা নিয়া সে কী খাইস্টামার্কা কথাবাত্তা ! অহনও মনে করলে রাগে রম্ভার গায়ের লোম খাড়া হইয়া যায়!  

তোর পাটকাঠির লাহান মাইডারে কেউ পোঁছে না, সেইডা তো আর তাদের দুই বুইনের কারও দোষ না। খারাখখারা তাদের গালাগালি কইরা কী হইবে! 

কিন্তু মাসি তো তেমন বোঝনদার মেয়েছেলা না। আউজগা তার ধানাইপানাই শুরু হইছে কলপাড় খালি করা নিয়া- ‘ক্যানো রে তোরা দু বোনই বেলা বারোটা অব্দি কাপড় কেচে যাবি নাকি রে!  কতো নোংরা করেছিস ওগুলো ! আমরা ঘরের কাজকাম সেরে কি এট্টু ঘুমোতে পারব নেকো! রাত্তিরে খাটুনি খাটব কী করে তাহলে! হায় মা সন্তোষী, এই মফস্বলি গাঁইয়া মেয়েগুলো কোথা থেকে ভাসতে ভাসতে এই ঘাটে এসে লাগে, যেন স্রোতের মাথায় নাচতে নাচতে আসা গুয়ের দলা। তারপর এদের মুখের ভাষা শোন না, মুখের কতা বেরুচ্ছে না পোঁদের গু, বোঝা দায়। ছ্যা ছ্যা।’ 

মাসির গলা যত সপ্তগ্রামে উইঠা যাইবে, ততই তার মুখের ভাষা খারাপ হইতে থাকবে। ঐ দিক থিকা মন ঘুরাইবার জন্য রম্ভা মাইকের কথাগুলি শুননের চেষ্টা করে, কী কয় পোলাপানগুলা, তার কানে ছড়ানো ছিটানো কথা যা ভাইসা আসে তার কতকটার সে মানে বোঝে, কতকটা বোঝে না – আজ ভাষা দিবসে প্রত্যেকের মাতৃভাষাকে সম্মান করুন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন, মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধের মতো পুষ্টিকর। মায়ের দুধ না খেলে যেমন শিশু স্বাস্থবান হয় না, মাতৃভাষায় কথা বলতে না দিলে,পড়াশোনা না শেখালে তেমনি…

ম্যানকারে সে জিগায়, ‘তাইলে যে আমাগো গ্রামে সিদ্দ চালের ভাত রইদে শুকায়া খটখটা কইরা উরুন গাইনে ফ্যালায়া মিহি গুড়া করত, তাপ্পরে সেই গুড়া ভাত জলে গুলায়া ঝিনুক বাটিতে কইরা বাচ্চারে খাওয়াইতো, তার বেলা?’  

রম্ভা হাত উপরে তোলে যেন অদৃশ্য উরুন মাথার উপর থিকা আইনা গাইনের গর্তে ফেলায়। যেমন ঢেঁকিতে পাড় দিবার সময় হয়, তার শরীলের সামনের দিকটা, তার ভারী বুক ঝুইকা ঝুইকা পড়ে অল্পস্বল্প। দিদিরে দ্যাখতে দ্যাখতে ম্যানকা বিশাল হাই তুলে, এদেশি মাইয়াদের দেখাদেখি মুখের সামনে তুড়ি বাজায়, তারপর ঘোলাইট্টা চক্ষু মেইলা রম্ভারে কয়, ‘রোদে শুকোনো ভাতের গুঁড়ো? সে তো বাচ্চা বড় হবার পর। গেঁদা বাচ্চারা তো শুধুই মাই টানে। আর গরীবের আবার মাত্তিদুগ্ধ!  দেখিসনি বৌগুলিকে, কী অবস্থা সব। দুগ্ধই নাই, তার আবার মাত্তিদুগ্ধ! ‘

তারপর বোতল থিকা জল খায় ঢকাঢক, রম্ভাকে বলে, ‘দিদি তুই এবার নিজের ঘরে যা। আমি এট্টউ ঘুমিয়ে নি।’  


আরো পড়ুন: তেভাগু । প্রতিভা সরকার


আঁচলাটারে মাটিতে বিছাইয়া এক মিনিটের মদ্দেই ঘুমাইয়া পড়ে রম্ভার ছোটু বুইন। রম্ভার আর নিজের ঘরে ফিরা যাইতে ইচ্ছা করে না। ম্যানকার পাশেই শুইয়া পইরা সে য্যান জাগন্ত অবস্থাতেই কেমুন সব স্বপ্ন দ্যাখতে শুরু করে। তোর্সার বন্যায় ঘরবাড়ি সব কাদা কাদা, বৃষ্টি পরতাসে তো পরতাসেই, থামার লক্ষণ নাই, ব্যাঙের ডাকের সঙ্গে বাজ পড়ার গুমগুম আর তোর্সার পাড় ভাইঙা পড়ার শব্দ। মস্ত মস্ত মাটির চাঙড় ধপাস কইরা জলের মদ্দে গিয়া পড়তাসে। শুনলেই তারস লাগে গো! যেন এই নিশীত অন্ধকারে কুন একটা বিকট রাক্ষস হাঁ মুখ লইয়া দরজার বাইরে খাড়ায়া আছে, যা পাইবে, গাছপালা, ঘরবাড়ি, মানুষজন, সবকিছুরে কপাৎ কইরা গিলা ফ্যালাইবে। চ্যাং, শোল, বোয়াল, খইলসা, সগগল মাছে তারে ডাকাডাকি করে দেইখা হীরা বিষ্টির মদ্দেই কোচা নিয়া বাইর হইয়া গেল। মৎস হইলগা মালক্ষ্মী, পীর বাবার আশিব্বাদ, তার ডাক, ‘আয় আমারে কোচার আগায় গাইথা ফ্যাল’ একদম অবহেলা কইরতে নাই।

তুমুল বিষ্টির মইদ্দে রম্ভা, থুড়ি, তখন তারে সবাই সুন্দরী বইলা ডাকত, আর তার বোনেরে ডাকত সাজি, ঘরে একা বইসা ছিল অনেকক্ষণ । একটু বোধহয় ঘুমায়া পড়সিল সে, হঠাৎ দেখে চেংড়া পোলাগুলা যেমন জ্যাকেট পড়ে, অমুন একটা ঘোমটাওয়ালা জ্যাকেট পইরা তার শরীরের দুইধারে দুইটা হাত গাঁইথা একদিষ্টে তাকাইয়া কে য্যান বইসা আছে। মুখের জায়গাটা পুরা অন্ধকার, মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাইলে মুখের জায়গাটা আবছা দ্যাখা যায়, য্যান আরও বেশি কালো একটা অন্ধকারের টুকরা। নাক নাই, চক্ষু, ওষ্ঠ, কিসসু না। 

সুন্দরী  তার শরীল নাড়াইতে যায়, পারে না, যেন এইটা তার নিজের শরীল না, নড়াচড়ার কুনো শক্তি নাই। কিন্তু বুঝে সবকিছু। জ্যাকেটের ঘোমটার ভিতরে অন্ধকার দিয়া বানানো মুখটা অল্প হাঁ করে, সে চমকাইয়া উইঠা ফাল পাড়তে যায়, তারে চুমা দিবে নাকি! অসাড় শরীলেও ভয়ে কাঁটা ওঠে, টের পায় সুন্দরী । 

কিন্তু না, চুমা টুমায় কিছু শ্যাষ হয় না। সব ফুরাইলে জ্যাকেটের ঘোমটার মধ্য থিকা ঝুরঝুর কইরা তোর্সার বালি সরু সুতার মতো ঝইরা পইরা সুন্দরীর লাল লাল ফুলা ফুলা ঠোঁটের মধ্যে ঢুইকা পড়তে থাকে। সাদা সোনালি রঙ মেশানো মোটা দানার বালি। পাহাড়ের বোল্ডার থ্যাতরা ব্যাতরা কইরা নিজের সাথে সাথে তোর্সা সবসময় যা নিয়া আসতেছে। বালিতে তার পেটের ভিতরের ফাঁপা অংশখান প্রথমে ভইরা ওঠে, নিচের দিকে নাইমা গিয়া তলপেট, জরায়ু, দুই ঠ্যাং, তাপ্পর উপরে উইঠা বুকের খাঁচা, মাথা আর বুকের মদ্দিখানে রাজহংসের লাহান গলা, পূর্ণ চন্দ্রের লাহান স্তন, সব বালিতে ভইরা যায়। এমুন ভরা ভরে, সুন্দরীর মনে হয় আর কুনদিন তার ক্ষিদা পাইবে না। খাওয়ার বাসনা তার চিরতরে ঘুইচা গেল।  

সেইবার স্বপন শ্যাষ হইয়া সুন্দরী জাইগা উঠলেও হীরা আর ফিরে নাই। বাজ পইরা মরল, না মাছ ধরতে গিয়া তোর্সার ঘোলা জলে পা পিছলাইয়া, তা কেউ কইতে পারে নাই। পারবে কী কইরা, দেহটাই তো মিলে নাই। অনেক কান্ডের পরে স্বপন সত্যি হইল, আপাদমস্তক বালিতে ভইরা গিয়া সুন্দরী রম্ভা আর তার ছুটো বুইন সাজি ম্যানকা নাম পাইলে পরে, দুই অপ্সরা এই পাড়ায় থিতু হইলেন। তাদের ক্ষুধা তৃষ্ণা নাই, তাদের বেবাকই বালিতে ভরা। শুধু যখন মুখ ছুটে, সেই বালি ভরভরাইয়া প্যাটের ভিতর থিকা বাইর হইয়া আসে। 

এখন পুতুল মাসির চিলের মতো চিকখুরে রম্ভার ঘুম চইট্টা যায়। তার চক্ষু দুইটা অল্প অল্প ঘোরে, যেন সে ঠাহর করতে পারতেসে না, এইডা তোর্সা পাড়ে তাদের মাটির ঘর, না কোঠাবাড়ি। বালি খাওনের স্বপনটা সে কখুন দ্যাখলো, আইজ না যেইদিন তোর্সার জল বাঁধ ভাইঙ্গা তাদের ঘরে ঢুইকা পড়সিলো, তাও সে ঠিকমতো বুঝে না। তার মদ্দেই কানে আসতে থাকে মাসির অকইথ্য গালাগালি, দুই বুইনের দুই বালতি না সরাইলে সে জল নিতে পারতেসে না। 

রম্ভা ঘুম চক্ষে দরজা খুইলা দৌড়াইতে গিয়া উস্টা খায়, মাসি হাততালি দিয়া হাসিতে ফাইট্টা পড়ে, ‘মর মাগি, এমনিতে তো মরবি না, হাজার বছরের পরমাই নিয়ে জন্মেছিস, হোঁচট খেয়ে পড়ে মর।’

রম্ভার নাড়িভুঁড়ির ভিতরের সমস্ত বালি ঘুইরা ঘুইরা কন্ঠার উপরে উঠতে চায়। য্যান চৈত মাসের বাতাসে মাঠে পাক খাওয়া শুকনা পাতা! সে দেখাইয়া দিবে মাসিরে, সেও খিস্তিখেউড়ে কম যায় না। কমরে আঁচল জড়াইয়া বিরাট এক চিকখুরে ফাইটা পড়তে যাবে, এমন সময় রম্ভার কানে আসে কে য্যান মসজিদ বাড়ি স্ট্রিটের মাইকে গান গায়, কেমন য্যান তাদের গ্রামের সারি জারি গম্ভীরা কেত্তন সব মিশানো একটা সুর! গলাটা জোয়ান পোলার না, কিন্তু খুব বুড়া বুড়াও না! কীসব যেন কয়, ‘আমি বাংলায় কথা কই… বাংলায় ভাসি, বাংলায় হাসি, বাংলায় জেগে রই!’ 

মানে জবানের কথা হইতেছে আর কী! রম্ভা মাতব্বরের মতো হাসি ওষ্ঠে ঝুলায়া রাখে। সবই বোঝন যাইতেছে। কওয়া-বলা তো বটেই, তার লাহান জাইগা জাইগা স্বপন দ্যাখার ভাষাও বাংলা, তার নিজের জবান, তার নিজের মাত্তিভাষা!   

চিরকালই রম্ভা গান শুনলেই কান খাড়া কইরা দেয়, আইজ এই মরা বিকালের আলোয়, এই সুরটা তারে লইয়া ধপাস কইরা ফেইলা দিল তোর্সার চরে… লোক নাই, জন নাই, শুধু সবুজ টলটলা জলের নিচে সাদা বালি দেখা যায়… ঠান্ডা বাতাস আইসা রম্ভার কোঁকড়া চুল লইয়া খেলা করে… জলের নিচে রঙিন নুড়ির পাশে সবুজ শ্যাওলা গাছ মাথা নাড়ায়…আয় আয় কইরা মাথা ঝুকাইয়া তারে ডাকে! 

ভুতে পাইছে যেন তারে, এইভাবে রম্ভা আগাইয়া যাইতে নেয়, পুতুলমাসি পিছন থিকা তার বেণি ধইরা টানতে থাকে। যন্ত্রণায় রম্ভা যতো চিকখুর দিতে থাকে, মাসি ততই মুখ খারাপ করে, ‘বেবুশ্যে মাগি, বমি করে বালি ওগরাচ্ছে দ্যাকো।’

সত্যি, ঐ গানের সুর আর তালের সাথে সাথে রম্ভা তার পেটের ভিতরের জইমা থাকা বালি বমি কইরা বাইর করতে থাকে, ওয়াক ওয়াক ওয়াক। বালি জইমা জইমা পাহাড়ের মতো উঁচু হইয়া গেলে রম্ভার খুব খিদা পায়, সে কাতর হইয়া বলে, ও ম্যানকা দুইটা খাইতে দে, আমার যে খুব ক্ষুধা পায়! 

কিন্তু ম্যানকা কিছু দিয়া উঠার আগেই রম্ভার খিদা-লাগা প্যাটের ভিতরে ঢুইকা পড়তে থাকে বাইরের থিকা ভাইসা আসা সুর, ‘আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে / করি বাংলায় হাহাকার / আমি সব দেখেশুনে খেপে গিয়ে/ করি বাংলায় চিৎকার…’ 

কিন্তু উল্টাটা হয়, সুর শুইনা রম্ভার চিকখুর পাড়ার ইচ্ছা মইরা যায়, ঝিম লাইগা আসে, সে বিড়বিড়ায়, আইজ জুবানরে আইঠা করতে নাই। জুবানরে আইজ শুদ্ধ রাখুম। স্বপনের মদ্দেই ম্যানকা ঢুইকা তারে শুধরাইয়া দেয়, ‘দিদি, তুই কিছু শিখলিনে। আইঠা নয়, বল ভাষাকে এঁটো করতে নেই, নোংরা করতে নেই ।’

করোনার সময় কাস্টমার নাই কইলেই হয়, তাই বিকাল হইয়া গেলেও উঠতে ইচ্ছা না করায় ম্যানকাও ঘুম ভাইঙা টালুরটুলুর করতেছিল, হঠাত দ্যাখে তার দিদি ঘুমের মধ্যে বিড়বিড়াইতে শুরু করল। ও বিটি এইরকমই, ম্যানকা ভাবে। গানের সুরটা তারও কানে ঢুকতেছিল, কিন্তু রম্ভার বিড়বিড়ানির ঠেলায় কথাগুলি ঠিক বোঝন যায় না, তাই বিরক্ত হইয়া সে দিদিরে ঠ্যালা দেয়, ‘কী হয়েছে, আজ আবার কেউ এসে বালি ভরে দিল নাকি!’

রম্ভার অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপন দেখার কথা তার ছুটো বুইনে জানবে না, তাই আবার হয় ! খোঁচা খাইয়া রম্ভার এতক্ষণের তন্দ্রা বেবাক ভাইঙা যায়, অনেকক্ষণ ফ্যালফ্যালাইয়া তাকাইয়া থাইকা সে কয়, ‘চল বুন গান শুইনা আসি, বড় রাস্তার পাশে বইসা থাকব, গান শুননের কালে কেউ আইসা ডাকলে ঘরে ঢুকায়া নিমু নে। করোনার গুতায় সেই চান্স কমেরও কম। তাই মনে লয়, আইজ খালি গান শুনাটাই হইব’অনে !’ 

ম্যানকা বেশি স্যায়ানা, সে হিসাব কইরা দ্যাখে তাদের পাড়ার এনজিও দুর্বার মহিলা সমণ্বয় সমিতি থাইকা যে র‍্যাশন দিয়া গেছে তা দিয়া কমসে কম দুইদিন চইলা যাবে। দুইদিন তাগোর জীবনে অনেক সময়। তাছাড়া খালি ভাতে হয় নাকি, ভাত কামাইয়ের জইন্য তো শরীলটা আছে, কিন্তু মানুষের জবানেও যে কত্তো রকম সুর! মাঝেমইদ্দে কান পাইতা তা না শুইনলে, কপকপাইয়া হেই সুর জিভ দিয়া চাইট্টা চাইট্টা না খাইলে মাইনষের জেবনই বৃথা, হইলই বা বেশ্যার জেবন! তারাও তো মানুষ! 

তাই নিশ্চিন্তে পুরু কইরা লিপস্টিক মাইখা রথ দ্যাখা কলা বেচার লাহান দুই বুইনে হাত ধরাধরি কইরা মসজিদ বাড়ি স্ট্রিটের দিকে যাইতেছিল ভাষা দিবস মানানোর লাইগা। 

সাচাই কই, তাগোর মনের মধ্যে নিজেদের জবানে সুর ভইরা নিবার ইচ্ছা যত ছিল, খদ্দের ধইরা ঘরে ঢুকাইবার ইচ্ছা তত ছিল না! 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত