শিশুতোষ গল্প: ক্যাবলাকান্ত । লীলা মজুমদার
ক্যাবলাদের বাড়ির পুকুরে কোথায় এক গোপন জায়গায় সেই লাল-নীল মাছটা ডিম দিয়েছিল। জানত শুধু লাল-নীল মাছ আর শংকর মালী। ব্যাঙেরা তাকে খুঁজে পায়নি। হাঁসরা তাকে খুঁজে পায়নি। ক্যাবলা যেদিন শংকর মালীর কাছে খবর পেল সেই দিনই পুকুরপাড়ে ছুটে গিয়েছিল কিন্তু সেও খুঁজে পায়নি। দেখল ব্যাঙরা ডিম খুঁজে খুঁজে পুকুরের নীল জল ছুঁটে ঘোলাটে করে দিয়েছে, হাঁসরা পদ্ম ফুলের মধ্যে প্যাতপেতে চামড়াওয়ালা ঠ্যাং চালিয়ে শেকড়-বাকল পর্যন্ত তুলে এনেছে, কিন্তু ডিমের কোনো পাত্তাই নেই।
বুড়ো হাঁসখুড়ো বলেছিলেন– চোখ রাখিস, তা দেবার সময়ে কাঁক করে ধরিস। কিন্তু সকাল-সন্ধ্যে লাল-নীল মাছটাকে গোমড়া মুখে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেল, তা দেবার নামটি করলে না। সারা দুপুর মাছটা এখানে এক কামড় শেকড়, ওখানে দুটো কীসের দানা খেয়ে বেড়াল, তা দেবার গরজই নেই!
হাঁসরা তো রেগে কাই! আরে মশাই, আমরা ডিম দিলে ভর-সন্ধে তার ওপর চেপে বসে থাকি। ত্রিসীমানায় কেউ এলে খ্যাক খ্যাক করে তেড়ে যাই, আর এ দেখি দিব্যি আছে!
ব্যাঙরা তাগ করে থেকে থেকে শেষটা ঝিমিয়ে এল। হাঁসরা ম্যাদা মেরে গেল, ক্যাবলাও দু-তিন দিন ঘুরে গেল।
শংকর মালীকে অনেক পেড়াপীড়ি করাতে সে বললে– অ রাম-অ! সে বলিবাকু বারণ-অ অচ্ছি!
ক্যাবলা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, লাল-নীল মাছটা ছোটো ছোটো ডানি-ওয়ালা পোকা ধরে ধরে কপাকপ গিলছে দেখল। কী মোটকা মাছ বাবা। পাঁজরের একটা হাড় গোনা যায় না।
ক্যাবলার একটু দুঃখও হল, পগারের মধ্যিখানে কে জানে কোথায় ডিম ফেলে লোকটা দিব্যি মাকড়গুলো মেরে খাচ্ছে। কাল হোক, পরশু হোক, যেদিনই হোক, মেজোমামার মস্ত ছিপটা এনে এটাকে ধরবেই ধরবে। বামুনদিদিকে দিয়ে দেবে, ঝোল বেঁধে খাবে, কাঁটাগুলো বিল্লিকে খাওয়াবে।
.
এ তো গেল ক্যাবলার কথা। এদিকে লাল-নীল মাছটার ভাবগতিক দেখে পুকুরের আর সবার গা জ্বলছে। শংকর মালী ভাত দিলেই ও তেড়েমেড়ে আগেভাগে গিয়ে সব সাফাই করে দেয়। হাঁসরা সময়মতো উপস্থিতই হতে পারে না, ব্যাঙরা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গলা ভেঙে ফেললে, তবু সে গ্রাহ্যই। করে না।
শেষটা একদিন চাঁদনি রাতে লাল-নীল মাছের ডিম ফুটে ছোটো একটা ছানা বেরুল। শংকরমালী জানত তাই দেখতে পেল কিন্তু কাউকে কিছু বলল না। আর ক্যাবলা তো ছিপই পায় না, মেজোমামা সেটাকে ডাল-কুত্তোর মতন পাহারা দেন।
ছোটো ছোটো দাঁতের দাগ কারো চোখেই পড়ল না। ব্যাঙাচিগুলোকে কে যে একা পেলেই ভয় দেখায়, ব্যাঙাচি বেচারাদের বোল ফোটেনি, তারা বলতে পারল না, তারা কেবল দিন দিন ভয়ের চোটে আমসির মতন শুকিয়ে যেতে লাগল। তাদের ল্যাজগুলো খসে যাবার অনেক আগেই নারকোল-দড়ি হয়ে গেল।
.
এমনি করে আরও কদিন গেল। তারপর বিকেল বেলায় ক্যাবলা ছিপ ছাড়াই পুকুর পাড়ে চলল। পথে দেখল ওদের তাল গাছ থেকে সর সর করে কী একটা যেন নামছে, তার ঠ্যাং দুটো দড়ি দিয়ে একসঙ্গে বাঁধা, পাঁচু ধোপার গাধার মতন, তার কোমরে দুটো হাঁড়ি ঝোলানো। ক্যাবলা ভাবছিল লোকটাকে দেখে সুবিধের মনে হচ্ছে না,সকান দেবে কিনা ভাবছে, এমন সময় লোকটা তাকে ডাকল।
ক্যাবলা দেখল হাঁড়ির ভিতর সাদা ফেনা, তার গন্ধের চোটে ভূত ভাগে। লোকটা ক্যাবলার সঙ্গে অনেক কথা বললে, লাল-নীল মাছের কথা শুনে, কেমন যেন ভাবুক ভাবুক হয়ে গেল। বললে ছপের কী দরকার? ছোটোবেলায় তারা নাকি কাপড় দিয়ে কচি কচি মাছ ধরত। এখনও ছুটির দিনে সাঁওতালরা দল বেঁধে কোপাই নদীতে মাছ ধরে। তাদের ছিপ নেই, মাঝখানে ফুটো ধামার মতন জনিস দিয়ে গপাগপা চাপা দিয়ে ধরে। কাছাড়ের কাছে কোথায় পাহাড়ি নদীতে রাত্রে নাকি জাল বেঁধে রাখে এপার থেকে ওপার, সকালে দেখে তাতে কত মাছ, ছোটোগুলো ছেড়ে দেয় আর বড়োগুলো ধরে নিয়ে যায়।
লোকটা এমনি কত কী বলল। যাবার সময়ে বলে গেল হাঁড়ির কথা যেন কাউকে না বলে।
সে চলে গেলে ক্যাবলা কাপড়ের খুঁট বাগিয়ে ঘটম্যাক ঘটম্যাক করে জলের দিকে চলল। আজ মাছ ব্যাটাকে কে রক্ষা করে?
এমন সময় টুপ করে জল থেকে মাছের ছানা মুণ্ডু বের করে বিষম এক ভেংচি কাটল।ওরে– বাবারে, সে কী মেছো ভেংচি! ক্যাবলা তো শাঁই শাঁই ছুট লাগাল, আর হাঁসেরা ব্যাঙেরা কে যে কোথায় ভাগল তার পাত্তাই নেই!
সন্ধ্যে বেলা শংকর মালী যখন ওদের জন্য ভাত আনল, দেখল কেউ কোথাও নেই, খালি লাল-নীল মাছ আর সবুজ ছানা পাশাপাশি বসে ফ্যাচফ্যাচ করে হাসছে।

লীলা মজুমদার (ফেব্রুয়ারি ২৬, ১৯০৮ – এপ্রিল ৫, ২০০৭) ছিলেন বিশিষ্ট লেখিকা। তিনি কলকাতার রায় পরিবারের প্রমদারঞ্জন রায় ও সুরমাদেবীর সন্তান। তাঁর জন্ম রায় পরিবারের গড়পাড় রোডের বাড়িতে। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (যাঁর পৈতৃক নাম ছিল কামদারঞ্জন) ছিলেন প্রমদারঞ্জনের ভাই এবং লীলার কাকা। সেই সূত্রে লীলা হলেন সুকুমার রায়ের খুড়তুতো বোন এবং সত্যজিৎ রায়ের পিসি।
লীলার বাল্যজীবন কাটে শিলঙে। যেখানকার লরেটো কনভেন্টে তিনি পড়াশোনা করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজি পরীক্ষায় তিনি ইংরাজিতে সর্বোচ্চ নম্বর অর্জন করেন। পারিবারিক ধারার সঙ্গে মিশে ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গেও তার পরিচয়টা ছিল গভীর। তার স্বামীর নাম ছিল ডা. সুধীর কুমার মজুমদার। লীলা মজুমদার ও সুধীর কুমার মজুমদারের ছিল দুই ছেলেমেয়ে। স্বামী, ছেলেমেয়ে, সংসার, কর্মজীবন সবকিছু ছাপিয়ে লীলা মজুমদার ছিলেন লেখিকা। যিনি অকাতরে দিয়েছেন কিশোর সাহিত্যকে। ভূতের গল্পে যার জুড়ি মেলা ভার। যিনি রচনা করতেন অদ্ভূতুড়ে সব স্বপ্ন। যে স্বপ্ন কেবল ছোটরাই দেখে। ভীষণ দ্যুতিময় তার গল্প বলার ঢঙ। তার কল্পনা আকাশ ছুঁয়ে যায়।
তিনি বহু বাংলা গল্প, প্রবন্ধ ও উপন্যাস রচনা করে অনেক পুরস্কার ও সম্মান লাভ করেন। তিনি অনেক শিক্ষামূলক রচনা ও রম্যরচনা ইংরাজি থেকে বাংলায় অনুবাদও করেন। তাঁর প্রথম গল্প লক্ষ্মীছাড়া ১৯২২ সালে সন্দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৬১ সালে সত্যজিৎ রায় সন্দেশ পত্রিকা পুনর্জীবিত করলে তিনি ১৯৬৩ থেকে ১৯৯৪ অবধি সাম্মানিক সহ সম্পাদক হিসাবে পত্রিকাটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন; ১৯৯৪-এ স্বাস্থ্যের অবনতির জন্য অবসর নেন।