ফুল, অশ্রু, প্রেম – ৩১ নারীর কবিতা (পর্ব – ৩) । মুম রহমান
ক্রিস্টিনা জর্জিনা রোসেটি (১৮৩০-১৮৯৪) ইংরেজি সাহিত্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নারী কবি। ঊনিশ শতকের গুরুত্বপূর্ণ ইংরেজ নারী কবি ক্রিস্টিয়ানা রোসেটি প্রেমের কবিতা লিখেছেন অনেক, লিখেছেন শিশুতোষ ছড়া, গীতিকবিতা, গান এবং ধর্মীয় গাথাও লিখেছেন। তার ‘গবলিন মার্কেট’ ও ‘রিমেম্বার’ ইংরেজি ভাষার অন্যতম জনপ্রিয় কবিতাগুলোর মধ্যে ঠাঁই পেয়েছে। বিখ্যাত ইংরেজ চিত্রকর ও কবি দান্তে গ্যাব্রিয়েল রোসিটির বোন তিনি। তার দাদার ছাপাখানা থেকে এলেন আলিয়েনে ছদ্মনামে তার প্রথম কাব্য সংকলন প্রকাশিত হয়েছিলো। পরবর্তীতে নিজ নামেই তিনি কবিতা ও গদ্য লিখতে থাকেন। রোসিটি তার কবিতায় ব্যক্তিগত, গভীর আবেগেরে জন্যে স্বাতন্ত্র অর্জন করেছেন। জীবিতকালে তাকে তেমন না-চিনলেও আজ বিশ্ব সাহিত্যে ক্রিস্টিয়ানা জর্জিনা রোসেটি এক গুরুত্বপূর্ণ কবি। বিশেষ করে তার ‘আমাকে মনে রেখো’ কবিতা আর ‘যখন আমি মৃত’ গানখানি ভীষণ জনপ্রিয়।
মনে রেখো মনে রেখো আমাকে যখন আমি চলে যাবো দূরে, চলে যাবো অনেক দূরে নিরব ভূমিতে চিরতরে; যখন আর তুমি পারবে না আমার হাত রাখতে ধরে, কিংবা আমিও ঘুরে দাঁড়াবো না, এমনকি বাঁক থেকে সরে। মনে রেখো যখন আর দিনের পরে দিন ঘুরে ফিরে তুমি বলবে না আমাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা আর কেবল মনে রেখো; তুমি পেরেছিলে বুঝতে তখন বড় দেরি হয়ে যাবে মতামত কিংবা প্রার্থনার ক্ষণ। তারপরও যদি তুমি আমাকে ভুলে যাও ক্ষণিকের তরে আর তবু মনে রেখো আমায়, করো না বিলাপ যদি অন্ধকার আর পচন রেখে যাই শুধু যে সব ভাবনাগুলি ছিলো তার সামান্য চিহ্নও থাকে যদি, বরং শেষতক তোমার উচিত আমাকে ভুলে যাওয়া এবং হাসা আমাকে মনে রাখা আর ব্যথিত হওয়ার চেয়ে সেই ভালো। একটি জন্মদিন আমার হৃদয় যেন এক গানের পাখি যার বাসা রয়েছে জলাভূমির কিনারায়; আমার হৃদয় যেন এক আপেল-বৃক্ষ যার শাখা নুয়ে আছে ফলের ভারে আমার হৃদয় যেন এক রঙধনু-ঝিনুক যা দাঁড় বায় সমুদ্রে এক বিশাল মাছরাঙার মতো; আমার হৃদয় এইসব কিছুর চেয়ে আনন্দিত কেননা আমার ভালোবাসা আমার কাছে এসেছে। আমাকে বেদি সাজিয়ে দাও পশমের ঝালর ঝুলিয়ে দাও দামী কাঠবেড়ালির পশম আর মূল্যবান বেগুনি আভায়; খোদাই করে দাও সেখানে ঘুঘু আর ডালিমের চিহ্ন, আর শত চোখঅলা ময়ূরও একে দাও; খোদাই করে দাও সোনা আর রূপার আঙুরের ছাপ, ফরাসী লিলি পাতা আঁকো রূপার পাতে, কারণ আমার পরানের জন্মদিন এসেছে, আমার ভালোবাসা এসেছে আমার কাছে।*
* জন্মদিন নিয়ে বিশ্বের সেরা কবিতাগুলোর একটি এই কবিতাটি। একটু টীকা ব্যবহার না-করলে এই কবিতার রসাস্বাদন কঠিন হয়ে যাবে। আপাত সরল এই সনেটে ক্রিস্টিয়ানা রোসেটি প্রচুর প্রতীকের ব্যবহার করেছেন। এই জন্মদিন তার প্রেমিকের নাকি যিশুর পুনরুত্থানের নাকি বসন্তের আগমণের বার্তা তা সুনিশ্চিত নয়। রঙ-ধনুক ঝিনুক এমন এক ঝিনুক যা শান্ত সমুদ্রে ভাসে। এই ঝিনুক, রঙধনু, বেগুনি রঙ ইত্যাদি এক শান্তির প্রতীক। অন্যদিকে ‘হালকিয়ন’ পাখির কথা বলা হয়েছে যা আদতে গ্রীক পুরাণ অনুযায়ী একটি মাছরাঙা বিশেষ, যে পাখি শীতকালে প্রজনন করে এবং তার বাসা সমুদ্রে ভাসে। পুরাণ অনুযায়ী এই বিশেষ মাছরাঙা পাখি সমুদ্রের বাতাস ও ঢেউকে শান্ত করে। যে বেদির কথা বলছেন তিনি তা যেন চার্চের বেদিকেই মনে করিয়ে দেয়। এই বেদির উপর তিনি ‘vair’ নামের পশম চান, যে পশম তেরশ-চোদ্দশ শতকে ব্যবহৃত হতো। এই মূল্যবান পশম তৈরি হতো কাঠবেড়ালির ধুসর পিঠ আর সাদা পেটের পশম থেকে। আবার এই বেদি রাজকীয় বেদির কথাও বলে। এখানে ব্যবহৃত দামী বেগুণি রঙ (যা রাজকীয় রঙ), ফরাসী লিলি ফুলের রাজকীয় নকশা (fleurs-de-lys), সোনা-রূপার কারুকাজ, আঙুর পাতা, ডালিম ইত্যাদি একটা রাজ দরবারের কথা মনে করিয়ে দেয়। মোদ্দা কথায় প্রিয়তম আসছেন তার জন্মদিনে, তার জন্যে পবিত্র আর রাজকীয় সাজের প্রস্তুতি নিতে বলছেন কবি।

জন্ম ২৭ মার্চ, ময়মনসিংহ। এমফিল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। পেশা লেখালেখি।