বাঁক
ভালোমণি যখন ভাবতে বসে তার জীবনটা কেমন, থই পায় না। একে গরিব তার ওপর মেয়ে, লেখাপড়া শেখার প্রশ্নই নেই। এক- করে পাম তেলে কিভাবে আলু বা অন্য সবজি ভাজতে হয়, সেটাই আয়ত্ত করেছে কচি বয়েস থেকে। এক ঘর ভাইদের মধ্যে ভালোমণি একাই ছিল বোন। তাই তার খাটুনিও ছিল বেশি। ভাইয়েরা বাইরের কাজ করতে যেত আর তাদের দেখভালের দায়িত্ব ছিল ভালোমণি আর তার মায়ের ওপর।
ভাইয়েরা কী কাজ করত তা বুঝতেই পারত না ভালোমণি। পাঁচ পাঁচটা ছেলে যে সংসারে, তারা যদি সকলে অল্পবিস্তর কাজকম্ম করে, তাহলে তো সংসারে অভাব থাকার কথা নয়। দু-বেলা দু মুঠো ভাত তো জোটার কথা! কিন্তু কই! সেই তো এদিক ওদিক থেকে তুলে আনা শাকপাতা, মেটে আলু আর গেঁড়িগুগলি দিয়েই চলছে সংসার। এই ধাঁধাটার সমাধান ভালোমণি কোনোকালেই করে উঠতে পারেনি।
বাপটা ছিল জাঁদরেল। রোজই নেশা করে ফিরে মাকে পেটাত। এটাই যেন নিয়ম। সূয্যি ডুব মারলেই তাই ভয় লাগত ভালোমণির। এইবার বাপটা ফিরবে আর মা মার খাবে। কিন্তু মা কেন প্রতিবাদ করে না? নির্বিকার হয়ে মার খেয়ে যায়? জিগ্যেস করেছিল মাকে। মা বলেছিল, ‘সত্যিকারের পুরুষ যারা তারা একটু এমন করে। পুরুষ মানুষের রাগ না থাকলে চলে?’ এই কথাটারও জট ছাড়াতে পারেনি ভালোমণি।
ভালোমণির যখন চোদ্দ বছর বয়েস তখন ওর বিয়ে হয়ে গেল নরেন টুডুর সঙ্গে। নরেন টুডু ডোম। তাও স্বভাবে ভালোমণির বাপের চেয়ে ঢের ভালো। একটু আধটু নেশা করলেও চণ্ডালে রাগ নেই। ‘সারাদিন মড়া ঘাঁটাঘাঁটি করি কিনা তাই একটু খাই, বুঝলি ভালো। নাকে না হলে মড়ার গন্ধ যেন সেঁটে থাকে।’ বলেই আদর করে বউকে।
ভালোমণি ভাবে, ভাগ্যিস বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল বাড়ি থেকে। এখানে ঢের ভালো আছে ও। সকলের মতো ভালোমণিরও বিশ্বাস, ঈশ্বর আকাশে থাকেন। তাই দু-হাত জড়ো করে উঁচুতে তুলে কৃতজ্ঞতা জানায় তাঁকে। মা যখন মার খেত, তখনো এভাবেই ঈশ্বরকে ডাকত ভালোমণি। তাই তো ঈশ্বর তাকে সরিয়ে দিয়েছেন ওই পরিবেশ থেকে।
এদিকের ছবিটা অদ্ভুতভাবে পাল্টে গেছে। ভালোমণি চলে আসার পর, ওর বাপের বাড়ির অবস্থার উন্নতি ঘটেছে। তিন ভাই কিছু রোজগারপাতি করছে। ওর বাবাও কিছুটা শান্ত হয়েছে। কেমন করে যেন অপয়া আখ্যা পেয়েছে ভালোমণি। যদিও তা জানে না সে।
ভালোমণির ছেলে হল। সবাই খুব খুশি। সবাই মানে নরেন, তার মা আর দিদি। তার এক বছর বাদের মেয়ে হল। যেহেতু ছেলে আছে তাই মেয়ে হবার গঞ্জনা খেতে হল না ভালোমণির। আবারো দু-হাত জড়ো করে আকাশের বাসিন্দাকে কৃতজ্ঞতা, প্রণাম জানালো ভালোমণি। তারপর কী যে হল, ভালোমণির জীবনটা আবার একটা গভীর বাঁক খেল, পাহাড়ি রাস্তার মতো।
ভালোমণির সতেরো বছরের ছেলে গণেশের ছিল পাখি শিকারের নেশা। প্রায়ই জঙ্গলে ঢুকত পাখি মারতে। বারণ করলে শুনত না। সাপে কামড়াল। হয়ত বেঁচে যেত সময়মতো হাসপাতালে গেলে। কিন্তু এই বিপদের খবর পেতে দেরি হয়ে গেল বিস্তর। তাই, গণেশ চলে গেল। ইতিমধ্যে ভালোমণির অপয়া খেতাব কীভাবে যেন বাতাসে ভেসে ভেসে চলে এসেছে ওর শ্বশুরবাড়ির গ্রামে। গণেশ চলে যাওয়াতে কথাটা একটু একটু বিশ্বাস করতে শুরু করেছে নরেন।
ভালোমণির মানসিক অবস্থা অবর্ণনীয়। তাজা জোয়ান ছেলের এভাবে চলে যাওয়া যেকোনো মায়ের পক্ষেই মেনে নেওয়া কঠিন। দু-বছর কাটতে না কাটতে মেয়ে লক্ষ্মী ভালোবাসায় ফেল করে গলায় দড়ি দিল। ভালোমণি যে ডাইনি সেটাতে আর সন্দেহ রইল না কারো। নরেন তাড়িয়ে দিল ভালোমণিকে। সেই গ্রামেরই পরিত্যক্ত টোলে গিয়ে আশ্রয় নিল ভালোমণি। দরজা জানলা ভাঙা একটা ঘর, মাথার চাল খাবলানো। আর যাবেই বা কোথায় সে?
জীবনের জট খুলতে অসফল ভালোমণির মাথাটাই গেল জট পাকিয়ে। যত আক্রোশ গিয়ে পড়ল নিজের হৃদপিণ্ডের ওপর। দিনরাত চলে কেন এটা? থামতে জানে না?রাতদিন বলতে শুরু করল, ‘বন্ধ হ, বন্ধ হ’। যেটুকু সময় ঘুমতো সেটুকু বাদে শুধু এই দুটো শব্দ জপের মতো বলতে থাকল সে।টোলের উল্টোদিকে রাখাল বাগদির বাড়ি। বাবা মারা যেতে মাছের ব্যবসাটার দায়িত্ব নিয়েছে সে। সাইকেল নিয়ে টোলের পাশ দিয়ে যাবার সময় ইদানিং শুনতে পায় কে বলে চলেছে ‘বন্ধ হ, বন্ধ হ…।’
মন্দা যাচ্ছে মাছের ব্যবসায়। কী এক রোগ এসেছে দেশে। তার জন্য গাড়িটাড়ি সব বন্ধ। মাছের চালান নেই। খদ্দেরও কমে গেছে। সংসার চালনোই দায়। চিন্তায় পড়ে যায় রাখাল। আচ্ছা, ওই বুড়িটা যে বলে ‘বন্ধ হ ‘, সে কি ওর ব্যবসা বন্ধ হবার কথা বলে? গ্রাম দেশে অনেক রকমের কালা জাদু হয়। এ বুড়ি সেরকম কিছু করে না তো? কোত্থেকে এসে জুটেছে উটকো এক বুড়ি। কাল সকালে গিয়ে দেখতে হবে কে এই বুড়ি, এলোই বা কোত্থেকে আর কেন!
গাছের একটা ছোট ডাল নিয়ে টোলে যায় রাখাল, উটকো বুড়িটাকে শায়েস্তা করতে। ওটা ডাইনি। টোলের ভাঙাচোরা মেঝেতে তখন শান্তির ঘুমে তলিয়ে গেছে ভালোমণির সাতদিনের অভুক্ত শরীর। হাত দুটো মাথার ওপর জড়ো করা। ওপরওয়ালা মঞ্জুর করেছেন তার হৃদপিণ্ড বন্ধ হবার আর্জি।
গল্পকার ও “কিশোর ভারতী” পত্রিকার সহ সম্পাদক।