| 13 ডিসেম্বর 2024
Categories
প্রবন্ধ ফিচার্ড পোস্ট

চার্চের ভূমিকা ও রোমান সাম্রাজ্যে মারী । নাজমুল হাসান পলক

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

গত শতকের তিরিশের দশকের প্রথমপাদ চলছে, উনিশশ বত্রিশ সালের এপ্রিল মাস, বেরিলির কারাপ্রকোষ্ঠ থেকে এক পত্রে, কন্যা ইন্দিরার উদ্দেশে জওহরলাল নেহরু লিখলেন—‘রোম সাম্রাজ্যের ইতিহাস লেখা সহজ ব্যাপার নয়। আমি একটু মুশকিলেই পড়েছি। কত বইয়ে কত কথা পড়েছি, হরেক রকমের তথ্য ও কাহিনীতে আমার মন এলোপাতাড়ি বোঝাই হয়ে আছে; বেছে বেছে কোনটা লিখব আর কোনটা লিখব না, ঠাওর করতে পারছি না।’ রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস সম্পর্কে পণ্ডিত নেহেরুর এ অবস্থা বা মূল্যায়নের সঙ্গে, আজকের দিনেও দ্বিমত হওয়ার অবকাশ নেই। যে ইতিহাস নিয়ে চর্চা করতে বসলে, কখনো কখনো নিজের অজান্তেই, সন্তর্পণে মুখ থেকে একটি বড় কথা নিঃসৃত হয়—মহাকাব্যিক! যুদ্ধ, বিগ্রহ, রক্ত, স্বেদ, জয়, পরাজয়ের সমান্তরালে রোমান সাম্র্রাজ্যের এই ইতিহাসের খানিকটা জুড়ে রয়েছে প্রাণহারক মহামারী, প্লেগের একাধিক উপাখ্যান। লাখ লাখ মানুষের মৃতদেহে পরিণত হওয়া, ফিরে ফিরে জীবন ও সভ্যতা স্থির হয়ে যাওয়া। আরেকটি ব্যক্ত করার কথা হলো—দাস থেকে সম্রাট, এই উপাখ্যানের চরিত্র, নির্বিশেষে সবাই। কারণ, মহামারীর দণ্ড স্বভাবতই শ্রেণীহীন ও নির্দয়। রোমান সাম্রাজ্যে প্লেগজনিত মহামারী প্রসঙ্গে আলোচনা আরম্ভ করতে হলে প্রথমেই দৃষ্টি ফেরাতে হবে ‘দ্য প্লেগ অব এথেন্সে’র প্রতি। ৪৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কথা, তখন স্পার্টানদের সঙ্গে গ্রিকদের ‘পেলোপনেসিয়ান যুদ্ধ’ চলছে এই প্লেগকে সঙ্গী করেই। ‘প্লেগ অব এথেন্স’ সংহার করেছিল নগর-জনপদের প্রায় ২০ শতাংশ মানুষের প্রাণ। ঐতিহাসিক ও সমরবিদ থুকিদিদিস ‘হিস্ট্রি অব দ্য পেলোপনেসিয়ান ওয়ার’ গ্রন্থে এই প্লেগকে মূল্যায়ন করেছিলেন এভাবে—‘বিপর্যয়ে পুরুষগণ এইরূপ অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিল যে—ইহার উত্তরকালে কী ঘটিবে, তাহা কেহই জানিত না। তাহারা ধর্ম এবং আইনের তাবৎ নিয়মাবলির প্রতি উদাসীন হইয়া পড়িয়াছিল।’ থুকিদিদিসের এই বিবরণের মাধ্যমে, জনজীবনে প্লেগ-মহামারীর ভয়ানক প্রভাব, প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে প্রারম্ভেই আমরা একপ্রস্থ সন্দিহান হতে পারি।

১৮০ খ্রিস্টাব্দে এসেছিল ‘আন্তোনাইন প্লেগ’, যেটিকে অনেকেই অভিহিত করে থাকেন গালেন প্লেগ নামেও। সেই সময়ের রোমান ঐতিহাসিক ক্যাসিয়াস ডিয়োর মতে, এই প্লেগটি প্রতিদিন প্রায় বিশ হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। ২৪৯ খ্রিস্টাব্দে রোমান সাম্রাজ্যে দেখা মেলে আরেকটি প্লেগ-মহামারীর, ‘প্লেগ অব সাইপ্রিয়ান’। এই প্লেগের স্থায়িত্ব ছিল বেশ কয়েক বছর, যাতে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ শবে পরিণত হতো। তবে এখানেই শেষ নয়। বরং, জাস্টিনিয়ান, বিউবনিকসহ রোমান সাম্রাজ্য মধ্যযুগের অন্ত অবধি ধারণ করে রয়েছে একাধিক প্লেগের কালসাক্ষ্য। ‘আন্তোনাইন প্লেগ’ ও ‘প্লেগ অব সাইপ্রিয়ান’—এই দুটি মহামারী চলাকালে অমানবিক, অসহ্য, দুর্বহ রোগযন্ত্রণা ও মৃত্যুর সার্বক্ষণিক শঙ্কা, পৌত্তলিকতার প্রতি রোমান সমাজের আস্থাকে চরমভাবে নিম্নগামী করতে সক্ষম হয়েছিল। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল যে এই কালখণ্ডে অনেক চিকিৎসকও নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর অভিপ্রায়ে আক্রান্ত এলাকা পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, এই দুটি মহামারী চলাকালে, রোমান সাম্রাজ্যে চার্চের সংখ্যার ব্যাপক পরিবৃদ্ধি ঘটেছিল। এর প্রধান কারণ হলো, মহামারীর সময়ে চার্চগুলো ছিল আক্রান্ত মানুষদের সেবা পাওয়ার অন্যতম, কিংবা একমাত্র আশ্রয়স্থল। চারদিকে, জনমণ্ডলীজুড়ে মৃত্যুর নৈমিত্তিক ভিড়ে, ত্রাসের রাজত্বে খ্রিস্টান ধর্মযাজকেরা মানুষের মাঝে বুনন করতে সক্ষম হয়েছিলেন আশা ও নবজীবনের সম্ভাবনাময় স্বপ্নজাল।ফলে রোমানরা পৌত্তলিকতার পরিবর্তে চার্চ ও খ্রিস্টধর্মের প্রতি অনুরক্ত হয়ে উঠেছিল। অবশ্য, আমাদের আলোচ্য কোনো ধর্মের মাহাত্ম্য বিশ্লেষণ, বর্ণনা নয়; বরং আমরা ফিরে দেখতে চাই মহামারীর কালখণ্ডে রোম সাম্রাজ্যে চার্চগুলোর ভূমিকাকে। যার অবলম্বন, স্বভাবতই চার্চের ধর্মযাজকদের বিভিন্ন রচনা, চিঠিপত্র ও দলিল-দস্তাবেজ।

.

ইতিহাসে প্রত্যক্ষ করা যায়, ‘আন্তোনাইন প্লেগে’র সময়খণ্ডে প্রখ্যাত শাস্ত্রীয় চিকিৎসক গালেন রোমে পলায়ন করেছিলেন ও রোগের সম্ভাবনা নিম্নগামী না হওয়া পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেছিলেন। গালেনের তুল্য বিশিষ্ট একজন চিকিৎসকের প্রস্থান প্রসঙ্গটি উপস্থাপনের উদ্দেশ্য এখানেই নিহিত যে এর মাধ্যমে আমরা এথেন্সের সমাজের সাধারণ মানুষের মহামারীকালীন মানসপ্রবণতাও উপলব্ধি করতে সক্ষম হই। এ সময় অপরাপর মহামারীর তুল্যই সমাজে বহুবিধ ভীতি ও সংস্কার জন্ম নিয়েছিল। যে ভীতি ও সংস্কার থেকে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সবাই পরিত্যাগ করত, তাদের নিক্ষেপ করা হতো নগরের রাস্তায়। ‘আন্তোনাইন প্লেগ’ চলাকালে, চার্চের একটি চিঠিতে আলেকজান্দ্রিয়ার বিশপ ডায়োনিসিয়াসের বর্ণনায় আমরা প্রত্যক্ষ করি চার্চ ও খ্রিস্টধর্মের অনুসারীরা কীভাবে আক্রান্ত মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছিল, তাদের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিল—‘আমাদিগের অধিকাংশ খ্রিস্টান ভ্রাতা অন্তহীন প্রেম ও আনুগত্য প্রদর্শন করিয়াছিল। তাহারা আপনাকে বাঁচাইবার কোন প্রচেষ্টা করে নাই। একে অপরের শ্রেয়চিন্তা হইতেও নিরত ছিল। তাহারা কেবলমাত্র ব্যাধিগ্রস্ত, আক্রান্তদিগের ভার আপনার স্কন্ধে লইয়াছিল। আত্মনিয়োগ করিয়াছিল তাহাদিগের তাবৎ চাহিদা নিবারণে। এমনকি, বহুসংখ্যক ভ্রাতা আক্রান্তদিগকে সেবা প্রদানকালে, আপনার প্রাণ অবধি বিসর্জন দিয়াছিল।’ কার্থেজের বিশপ সেন্ট সাইপ্রিয়ানের জীবনীকার আমাদের জানিয়েছেন, মহামারী চলাকালে, সাইপ্রিয়ান কীভাবে মানুষকে উৎসাহিত করেছিলেন সেবারকাজে আত্মনিয়োগ করার জন্য—‘কেবলমাত্র আমাদিগের আপনার মানুষের প্রেম, একাগ্রতা সহযোগে প্রতিপালন করিবার অভ্যন্তরে কিছুই নাই। তথাপি, যে মানুষ সিদ্ধ হইতে ইচ্ছুক, তাহার উচিৎ অপর জাতির বা পুরুষদিগের হইতে অধিক কর্ম সম্পাদন করা, করুণাময় ঈশ্বরের চর্চা, বন্দনা করা। তাহার আপনার শত্রুদিগের প্রতিও প্রেমপূর্ণ হওয়া উচিৎ।’ সেন্ট সাইপ্রিয়ানের এই মানবিক আহ্বান কাজে দিয়েছিল বৈকি! এমনকি, চার্চগুলো রোগীর সেবাকার্য, অনেক পৌত্তলিককেও সার্বিকভাবে শিক্ষাদান করতে সক্ষম হয়েছিল। মহামারীর সময়খণ্ডে চার্চের সেবামূলক ভূমিকা এতটাই উদার ছিল ও মানুষের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছিল যে, সম্রাট জুলিয়ান যখন পৌত্তলিকতা পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন; তখন তিনি পৌত্তলিক পুরোহিতদের আহ্বান করেছিলেন, চার্চের সঙ্গে দাতব্য কর্ম সম্পাদনের প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে।

এটি ব্যক্ত করা মোটেই অত্যুক্তি হবে না যে এই দুটি প্লেগ-মহামারীর কালখণ্ডে চার্চের ভূমিকা কেবল আক্রান্ত মানুষদের সেবামূলক কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, এসব প্রাচীন রোগের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য আবিষ্কারের জন্যও, চার্চের বিভিন্ন দলিল ও ধর্মযাজকদের রচনা মূল্যবান সম্পদ, উপাত্ত হয়ে রয়েছে। আমরা প্রত্যক্ষ করি, ‘আন্তোনাইন প্লেগে’র কালে রোমান পৌত্তলিকদের ভূমিকা ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বলতে গিয়ে, মহামারীর সংক্রামক চরিত্রও খানিকটা উন্মোচিত করেছিলেন আলেকজান্দ্রিয়ার বিশপ—‘ব্যাধির প্রারম্ভেই তাহারা আক্রান্তদিগকে দূরে সরাইয়া দিয়াছিল এবং প্রিয়তমদিগ হইতে পলায়ন করিয়াছিল। মৃত্যু ঘটিবার পূর্বেই তাহাদিগকে পথে নিক্ষেপ করিয়াছিল, গণ্য করিয়াছিল আবর্জনারূপে। ইহা হইতে আশা করিয়াছিল, ব্যাধির বিস্তার ও সংক্রমণ হইতে আত্মরক্ষা করিবার।’ সেন্ট সাইপ্রিয়ানের নামে অভিহিত ‘প্লেগ অব সাইপ্রিয়ানে’র কালখণ্ড ২৪৯ থেকে ২৬২ খ্রিস্টাব্দ। ঐতিহাসিক ও রোগবিশারদরা এই প্লেগ সম্পর্কে জানার অভিপ্রায়ে বিভিন্ন শিলালিপি, মৃতদেহের অবশেষ ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অবলম্বন করেছিলেন। এর সমান্তরালে চার্চ ও খ্রিস্টীয় বিভিন্ন দলিল থেকেও এ প্লেগের চরিত্র সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়, রোগ হিসেবে তার অবস্থান নির্ণয় সম্ভবপর হয়। আমরা প্রত্যক্ষ করি, এই মহামরী চলাকালে সেন্ট সাইপ্রিয়ানের ‘অন মরালিটি’ গ্রন্থে রোগটির বৈশিষ্ট্য চমত্কারভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে। রোগবিশারদরা যেখান থেকে, আক্রান্ত রোগীর ডায়েরিয়া, অনর্গল বমি করা, প্রচণ্ড জ্বর, বধিরতা, অন্ধত্ব, পা ও পায়ের পাতা সারশূন্য হয়ে যাওয়া, গলা ফোলা ও রক্তাক্ত চোখ-মুখের তুল্য উপসর্গ আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন। কাইল হার্পার তার ‘প্যানাডেমিকস অ্যান্ড প্যাসেজ টু লেট এন্টিকুইটি’তে এই হেমোরেজিক জ্বরকে, যথাসম্ভব ইবোলা বলে অনুমান করেছেন। সেটিও সেন্ট সাইপ্রিয়ানের বিবরণের ওপর নির্ভর করেই।

আবার, সেন্ট সাইপ্রিয়ানের জীবনীকারের বিবরণ থেকেও, আমরা এই প্লেগের সংক্রামক চরিত্রের পরিচয় লাভ করতে সক্ষম হই। তিনি লিখেছেন, ‘ইহার উত্তরকালে এক ভয়াবহ মহামারী বিস্তার লাভ করিল। হঠাৎ, দিবসে দিবসে ব্যাধি সংক্রমণহীন বহুসংখ্যক ব্যক্তির সমান্তরালে, প্রত্যেকে আপনার গৃহ হইতে যাত্রারম্ভ করিল। সকলেই কম্পন করিতেছিল, পলায়ন করিতেছিল, তাহারা ছুটিতেছিল, আপনার আক্রান্ত বন্ধুর নাম উচ্চারণ করিতেছিল ছদ্মবেশে, যাহার মাধ্যমে তাহাকে পরিত্যাগ করা সম্ভবপর হয়। সম্পূর্ণ নগর জুড়িয়া প্রাণবান মনুষ্যশরীর নিরুপস্থিত, কেবলই ছিল মৃতদেহ।’ প্লেগের সংক্রমণ ও অসুস্থতার প্রসঙ্গ, সেন্ট সাইপ্রিয়ানের অনুরক্ত আরেক খ্রিস্টানজনের কাছেও জানা যায়, প্রশ্নের আদলে উত্তর সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হয়েই যিনি লিখেছিলেন, ‘আমরা কি প্রত্যহ মৃত্যুর আচার প্রত্যক্ষ করিতেছি না? আমরা কি অদ্ভুত মৃত্যুর রূপ প্রত্যক্ষ করিতেছি না? আমরা কি অগ্নি ও দীর্ঘ চলমান ব্যাধির কারণে, অজ্ঞাত প্রকারের প্লেগ হইতে বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করিতেছি না? এবং, এ সকল নষ্ট নগরসমূহের গণহত্যা প্রত্যক্ষ করিতেছি না?’ ‘প্লেগ অব সাইপ্রিয়ান’ মূলত ছিল একটি বহিরাগত মহামারী। যা আলেকজান্দ্রিয়া থেকে, অন্যান্য বৃহৎ উপকূলীয় কেন্দ্রগুলোতে, দুই-তিন বছরের ব্যবধানে ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম হয়েছিল।এই প্লেগ তার শ্রেণীহীন চরিত্রের তুল্য, সব বয়সী মানুষকেই সমানভাবে আক্রান্ত করেছিল। এমনকি একটি বাড়িও এই প্লেগের হাত থেকে নিস্তার পায়নি। মৃতের সংখ্যা ছিল বিপুল, যা তৈরি করেছিল জনশূন্যতা। আলেকজান্দ্রিয়ার বিশপের একটি প্রতিবেদনে যার প্রমাণ মেলে—‘অদ্য এই সুবিশাল নগরীতে, শিশু হইতে আরম্ভ করিয়া বৃদ্ধের তুল্য বিপুলসংখ্যক নাগরিক অনুপস্থিত।…যদাপী আমরা, চতুর্দশ হইতে অশীতি বৎসরকালের ব্যক্তিদিগকে খাদ্য রেশনের অধিকারী বলিয়া বিবেচিত করিয়াছি। এবং, যাহারা অল্পবয়স্ক দেখিতে, তাহারা এখন আমাদিগের পূর্ব-প্রজন্মের প্রবীণ ব্যক্তিদিগের নিকটে বয়স্ক বলিয়া বিবেচিত হইতেছে।’ উত্তরকালে গবেষকরা দাবি করেছেন, ‘প্লেগ অব সাইপ্রিয়ান’ শহরটির ষাট শতাংশেরও অধিক জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করেছিল। এই প্রতিবেদন থেকে তারই প্রমাণ লাভ সম্ভবপর হয়।

.

‘আন্তোনাইন প্লেগ’ ও ‘প্লেগ অব সাইপ্রিয়ান’ চলাকালে চার্চগুলোর দুই ধরনের ভূমিকা আমরা প্রত্যক্ষ করি।যার এক প্রান্তে রয়েছে, আক্রান্ত মানুষদের সেবা করা, তাদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা। সভ্যতার ইতিহাসে মানুষের মনোজীবনের প্রতি দৃষ্টি দিলে, প্রত্যক্ষ করা যায়—প্রাচীন কাল থেকে আধুনিক কাল অবধি, সংস্কারে আচ্ছন্ন মানুষ বিভিন্ন ব্যাধি ও মহামারীকে বিবেচনা করেছে নিজেদের পাপের ফল হিসেবে; কল্পিত স্রষ্টার কোপন কিংবা অভিশাপ হিসেবে। কয়েক মাস আগে ‘ক্যাথলিক হেরাল্ড’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘দ্য বেস্ট সেইন্টস টু প্রে ডিউরিং এ প্যানডেমিক’ শিরোনামের এক বিশেষ, আগ্রহ জাগানিয়া নিবন্ধ। যেখানে দেখানো হয়েছে প্লেগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে নামজাদা, নির্ভরযোগ্য ও আরাধ্য সাধু হলেন সেন্ট সেবাস্টিয়ান। তৃতীয় শতাব্দীর এই সাধুকে প্লেগের মহামারী থেকে পরিত্রাণের প্রয়োজনে উদ্ধারকর্তা বলে বিবেচনা, বন্দনা করা হতো। এমন চারিত্রগুণসম্পন্ন আরেকজন সাধু ছিলেন ইতালির সেন্ট রোস। এমনকি নারী সাধুরাও সংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের এই আরাধ্য তালিকা থেকে বঞ্চিত ছিলেন না, এক্ষেত্রে সেন্ট রোজালিয়ার নাম উল্লিখিত হতে পারে। অবশ্য, কেবল খ্রিস্টধর্মই নয়, অপরাপর ধর্মের মানুষেরাও এমন বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত নয়।

প্রাচীন রোমান সমাজের মানুষেরাও যার ব্যতিক্রম ছিল না। আর, এই সুযোগটিকেই কাজে লাগিয়েছিল চার্চগুলো। তারা মানুষকে সেবার মাধ্যমে, ভালো আচরণের মাধ্যমে, আশ্রয়ের মাধ্যমে নিজেদের প্রতি, খ্রিস্টধর্মের প্রতি আস্থাশীল করে তুলেছিল; বিকাশ ঘটিয়েছিল খ্রিস্টধর্মের। রোমান সাম্রাজ্যে চার্চগুলোর ভূমিকার অপর প্রান্তে রয়েছে, মহামারীর কালখণ্ডের জনজীবন ও ব্যাধি বৈশিষ্ট্যের বহুবিধ দলিল, দস্তাবেজ ভবিষ্যৎ কালের জন্য রেখে যাওয়া। এই দ্বিতীয় প্রান্তটিই মৌলত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করি। যার অনুপস্থিতি আজও আমাদের প্লেগ ও মহামারী সম্পর্কে খানিকটা অন্ধকারে নিমজ্জিত রাখত। কেবল তা-ই নয়; বরং, চিকিৎসাশাস্ত্রের নানাবিধ অগ্রগতিও স্থির হয়ে থাকত এগুলোর অভাবে। সুতরাং, আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতেই পারি যে—মানুষের সেবা থেকে আরম্ভ করে, ইতিহাসের তথ্য-উপাত্ত; সব দিক থেকেই ‘আন্তোনাইন প্লেগ’ ও ‘প্লেগ অব সাইপ্রিয়ান’-এর কালখণ্ডে চার্চগুলো নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। উত্তরকালে, বহু দিক থেকেই যা যুগান্তকারী বলে বিবেচিত হয়েছে, এবং হবে।

সহায়ক নিবন্ধ:

কাইলি হার্পার, চার্চস রেকর্ডস ফ্রম দ্য থার্ড সেঞ্চুরি কুড হেল্প আইডেন্টিফাই দ্য ডিজিজ দ্যাট নেয়ারলি কিলড দ্য এম্পায়ার।

উইলিয়াম ডোইনো জুনিয়র, দ্য বেস্ট সেইন্টস টু প্রে ডিউরিং এ প্যানডেমিক।

দ্য চার্চ অ্যান্ড দ্য প্লেগ: দ্য আরলি সেঞ্চুরিস।

শন এফ এভারটন, প্লেগ, পেইগানস অ্যান্ড ক্রিশ্চিয়ানস: ডিফারেন্সিয়াল সারভাইভাল, সোস্যাল নেটওয়ার্কস, অ্যান্ড দ্য রাইজ অব ক্রিশ্চিয়ানিটি।

কৃতজ্ঞতা সিল্করুট

নাজমুল হাসান পলক: লেখক

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত