বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ
।রাকিবুল হাসান।
১৮৯৫ সালে চলচ্চিত্রের সুচনার ১০ বছরের মধ্যেই আমাদের এই উপমহাদেশে প্রথম যে চলচ্চিত্র নির্মিত হয় তা ছিল রাজনৈতিক চলচ্চিত্র। ১৯০৫-এর ২২শে সেপ্টেম্বর কলকাতার টাউন হলে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের একটি প্রতিবাদ সভা হয়েছিল, এ ছবিতে তাকেই ক্যামেরাবদ্ধ করেন মানিকগঞ্জ জেলার বগজুরি গ্রামের হীরালাল সেন। “বন্দে মাতরম” গেয়ে শেষ করা ছবিটির বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিলো, “আমাদের নিজেদের স্বার্থে খাঁটি স্বদেশী সিনেমা”
বায়ান্নর রক্তাক্ত ঘটনার পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে কিছু শিক্ষিত সচেতন সংস্কৃতিসেবী ও বুদ্ধিজীবী পূর্ববঙ্গে চলচ্চিত্র শিল্প স্থাপন ও নির্মাণের ব্যাপারে সচেতন হন। ১৯৫৬ সালে তৈরি হয় পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’। চলচ্চিত্র নির্মাণে জড়িত হন ভাষা সংগ্রামী জহির রায়হান, পরিবেশনা ও প্রযোজনায় জড়িত হন ভাষা সংগ্রামী মোশাররফ হোসেন চৌধুরী, অভিনয়ে জড়িত হন ভাষা সংগ্রামী জহরত আরা, অভিনয় ও সঙ্গীতে জড়িত হন আলতাফ মাহমুদ। জহির রায়হান ফেব্রুয়ারি মাসে একটি ছবি নির্মাণের উদ্যোগ নেন। কিন্তু সরকার তাঁকে সে ছবি নির্মাণের অনুমতি দেয়নি।
১৯৬৮-’৬৯ সালের গণআন্দোলনের পটভূমিকায় ১৯৭০ সালে জহির রায়হান নির্মাণ করেন ‘জীবন থেকে নেয়া’। এ ছবিতে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরি ও মিছিল, শহীদ মিনার এবং ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি প্রথমবারের মতো ছবিতে ব্যবহার করা হয়। ২১শে ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক আমতলা সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। ভাষা আন্দোলন তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল, যার ছাপ দেখতে পাওয়া যায় তার বিখ্যাত চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেওয়াতে। বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্খার সূত্রগুলোকে স্পষ্টভাবে ভাষা দেখা যায় এই চলচ্চিত্রে। এ ছবিতে একগোছা চাবির মধ্য দিয়ে সিম্বলিকভাবে শাসনক্ষমতা বোঝানো হয়। ১৯৭০ সালে নির্মিত ফখরুল আলম পরিচালিত ‘জয়বাংলা’ নামের ছবিটি পাকিস্তাানি সেন্সর বোর্ড আটকে রাখে। ১৯৭২ সালে এটি মুক্তি পায়।
বাঙালির সবচেয়ে বড় অর্জন মহান মুক্তিযুদ্ধ। একাত্তর সালে ঘটে যাওয়া রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ যে বাঙালির সমগ্র জনজীবনে গভীর ছাপ রেখে যায়। শিল্পমাধ্যম হিসাবে চলচ্চিত্রের ওপর এর প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। সুতরাং স্বাধীনতার অব্যবহিত উত্তর কালে বাংলাদেশে নির্মিত চলচ্চিত্রে যে মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব পড়াটাও ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। আমাদের দেশের অনেক গুণী নির্মাতা এই গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধকে তাদের চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরতে চেয়েছেন।
২৫শে মার্চ রাতের গণহত্যার ছবি তুলেছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নূরুল্লাহ। হত্যাযজ্ঞ শুরু হওয়ার পর জীবনের ঝুকি নিয়ে তার বাসায় পড়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নিচুমানের ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে গণহত্যার দৃশ্য ধারণ করেছিলেন।
জাহির রায়হান ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রথম চলচ্চিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ -এর নির্মাতা।
মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর আবদুল জব্বার খানকে পরিচালক করে একটি চলচ্চিত্র বিভাগ খোলা হলেও মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রথম সিরিয়াস প্রচেষ্টা হয় বেসরকারি উদ্যোগে ‘বাংলাদেশ লিবারেশ কাউন্সিল অব দি ইনটেলিজেনশিয়া’ এবং ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী কলাকুশলী সহায়ক সমিতি’র যৌথ উদ্যোগ ও আর্থিক সহায়তায়। নভেম্বর মাসের মধ্যেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চারটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়। এগুলো হল জহির রায়হান পরিচালিত ‘স্টপ জেনোসাইড’ ও ‘এ স্টেইট ইজ বর্ণ’, আলমগীর কবির পরিচালিত ‘লিবারেশন ফাইটার্স’ এবং বাবুল চৌধুরীর পরিচালনায় ‘ইনোসেন্ট মিলিয়নস’।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই জহির রায়হান মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক পূর্নদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ধীরে বহে মেঘনা’ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার দেড় মাসের মধ্যেই জহির রায়হান নিখোঁজ হন। পরবর্তীতে আলমগীর কবির এই সিনেমাটি নির্মাণ করেন।
স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন চাষী নজরুল ইসলাম। ১৯৭১ সালে ১১জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে গঠিত গেরিলা দলের পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান এবং দেশ স্বাধীন নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রটির নাম ‘ওরা এগারোজন’ । এই এগারোজনের দশজনই বাস্তবের মুক্তিযোদ্ধা; যারা পেশাদার শিল্পী ছিলেন না। এরা হলেন খসরু, মঞ্জু, হেলাল, ওলীন, আবু, আতা, নান্টু, বেবী, আলতাফ, মুরাদ ও ফিরোজ। ১১ দফার ছাত্র আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরকে মাথায় রেখে প্রতীকী অর্থে এ চলচ্চিত্রের নামকরণ করা হয় ‘ওরা ১১ জন’।
চলচ্চিত্রের শুরুতে টাইটেলে ছয়টি কামানের গোলার শব্দ শোনা যায়। নির্মাতার মতে, এ ছয়টি শব্দ হচ্ছে ছয়দফা দাবির প্রতীকী শব্দ। এই চলচ্চিত্রে যে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ব্যবহার হয়েছিল সবই ছিল সত্যিকারের। ১১ই আগস্ট ১৯৭২ এ মুক্তি পায় এই চলচ্চিত্রটি। ‘ওরা ১১ জন’ চলচ্চিত্রে ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’ এবং ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলা স্বাধীনতা আনলে যাঁরা’ গানগুলো ব্যবহার করা হয়েছিলো।
পরবর্তীকালে ‘ওরা ১১ জন’ ছবির সিক্যুয়েল হিসাবে ১৯৭৩ সালে খান আতাউর রহমান-এর পরিচালনায় নির্মিত ‘আবার তোরা মানুষ হ’। এই চলচ্চিত্রটিতে মুক্তিযোদ্ধাদের কিছুটা নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখানোর কারণে ব্যাপক সমালোচিত হয়।
১৯৭২ সালের ৮ই নভেম্বর মুক্তি পায় সুভাষ দত্তের পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’। কুসুমপুর গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাকান্ড, নির্যাতন, নারী ধর্ষণ এবং প্রতিবাদে বাঙালিদের মুক্তি সংগ্রামকে কেন্দ্র করে এই চলচ্চিত্র নির্মিত। যুদ্ধ শিশুর মত বিষয় বেশ গুরুত্বের সাথে ফুটে উঠেছে এই চলচ্চিত্রে।
ছবিটির শ্লোগান ছিল-‘লাঞ্চিত নারীত্বের মর্যাদা দাও, নিষ্পাপ সন্তানদের বরণ কর……’
১৯৭২ সালে আলমগীর কবির ‘ডায়েরিজ অব বাংলাদেশ’ নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠান চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর তৈরী করে ‘দেশে আগমন’।
১৫ই ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে মুক্তি পায় মমতাজ আলীর পরিচালনায় ‘রক্তাক্ত বাংলা’ এবং আনন্দ-র পরিচালনায় ‘বাঘা বাঙালী’। ছবিদুটো ধর্ষণ দৃশ্য ও অ্যাকশন দৃশ্যের সমন্বয়ের মাধ্যমে মুনাফা অর্জনের প্রচেষ্টার কারনে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে।
১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় আলমগীর কবির পরিচালিত ‘ধীরে বহে মেঘনা’, আলমগীর কুমকুম পরিচালিত ‘আমার জন্মভূমি’ এবং খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘আবার তোরা মানুষ হ’। ধীরে বহে মেঘনায় মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে যুদ্ধপরবর্তী জীবন উপজীব্য হলেও মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ঘটনাবলিও দৃশ্যায়িত হয়েছে।
১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় চাষী নজরুল ইসলামের ‘সংগ্রাম’, আনন্দের ‘কার হাসি কে হাসে’ এবং নারায়ন ঘোষ মিতার ‘আলোর মিছিল’। ‘আলোর মিছিল’ অভিনেতা ফারুক-এর এটি প্রথম ছবি এবং এই ছবিতে অভিনয় করেই ববিতা প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা তৈরীর যে জোয়ার লক্ষ্য করা যায় তা ভাটায় রূপ নেয় তার মৃত্যুর সাথে সাথেই। পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ‘শেখ মুজিব’, ‘পাকিস্তানি হানাদার’ ইত্যাদি প্রসঙ্গ বিভিন্ন সময়ের সরকারগুলোর কাছে ছিল খুবই অপছন্দের। ফলে সেন্সরের নানা বাধার আশঙ্কায় মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মাণ স্থিমিত হয়ে পড়েছিল। এরই মাঝে ১৯৭৬ সালে হারুনুর রশিদ নির্মাণ করেন- ‘মেঘের অনেক রং’। এ চলচ্চিত্রের পুরো কাহিনী উঠে এসেছে একটি শিশুর দৃষ্টিকোণ থেকে। সদ্যবোধসম্পন্ন যে ছেলেটি তার মাকে খুঁজে বেড়ায়। এরই ফাঁকে চলে আসে যুদ্ধের কথা। যুদ্ধে তার মা পাক বাহিনীর লাঞ্ছনার শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
১৯৮১ সালে শহীদুল হক খান নির্মাণ করেন ‘কলমীলতা’। এতে মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পাকসেনার বিরুদ্ধে দুঃসাহসিক অভিযানের গল্প উঠে এসেছে।
১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালে সৈয়দ শামসুল হকের পরিচালনায় সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ-র নামে একটি করে মোট ৭টি তথ্যচিত্র তৈরী হয়। এই সময়কালে শুরু হয় স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আন্দোলন। ১৯৮৪ সালে মোরশেদুল ইসলাম তৈরি করেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘আগামী’।
আলমগীর কবীর-১৯৮৫ সালে তৈরি করেন ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’। ১৯৮৮ সালে মোরশেদুল ইসলাম তৈরি করেন ‘সূচনা’। আবু সায়ীদ ‘ধূসরযাত্রা’ তৈরি করেন ১৯৯২ সালে।
১৯৯৩ সালে শাহরিয়ার কবির-এর উপন্যাস ‘একাত্তরের যীশু ‘অবলম্বনে একটি ছবি পরিচালনা করেন নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। এতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ সব পেশা ও শ্রেণির মানুষের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের চিত্রের পাশাপাশি বাঙালি জাতির ওপর পাক বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের চিত্র মর্মস্পর্শী রূপে ফুটে উঠেছে। পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করার পথ বেছে নেয়। তাই গল্পকার ক্রুশবিদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের যীশুর সঙ্গে তুলনা করে চলচ্চিত্রের নামকরণ করেছেন ‘৭১-এর যীশু’।
এই সময় সরকারি অনুদানে, বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর উদ্যোগেও মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্যরে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তার মধ্যে হারুনুর রশিদ পরিচালিত ‘আমরা তোমাদের ভুলব না’ (১৯৯৩), রফিকুল বারী চৌধুরী পরিচালিত ‘বাংলা মায়ের দামাল ছেলে’ (১৯৯৭) এবং বাদল রহমান পরিচালিত ‘ছানা ও মুক্তিযুদ্ধ’ (২০০৮)-এর কথা উল্লেখযোগ্য।
১৯৯৪ সালে হুমায়ূন আহমেদ নির্মাণ করেন তার পরিচালিত প্রথম ছবি ‘আগুনের পরশমনি’। মুক্তিযুদ্ধে এক তরুণীর আত্মত্যাগের ঘটনাসহ যুদ্ধকালীন নানাদিক উঠে এসেছে এই চলচ্চিত্রে।
১৯৯৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভিন্ন ধারার প্রামাণ্যচিত্র ‘মুক্তির গান’ নির্মাণ করেন তারেক মাসুদ ও ক্যাথেরিন মাসুদ। আমেরিকান সাংবাদিক লিয়ার লেভিনের তোলা মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন ছবি নিয়ে নির্মিত হয় ‘মুক্তির গান’। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশী শিল্পীরা বিভিন্ন শরণার্থী শিবির ও রণাঙ্গনে গান গেয়ে মানুষকে উজ্জীবিত করার যে বিশাল ভূমিকা পালন করেছিলেন তা উঠে এসেছে এই প্রামাণ্যচিত্রে। পরবর্তীতে তারেক মাসুদ ও ক্যাথেরিন মাসুদ এই ছবির সিক্যুয়েল হিসেবে নির্মাণ করেছিলেন ‘মুক্তির কথা’(১৯৯৮) এবং ‘নারীর কথা’ (২০০০)।
১৯৯৬ সালে তানভির মোকাম্মেল নির্মাণ করেন ‘নদীর নাম মধুমতি’।
১৯৯৭ সালে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের গল্প অবলম্বনে চাষী নজরুল ইসলাম নির্মাণ করেন ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’। মুক্তিযুদ্ধের সময় এক স্নেহময়ী মা মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষা করতে গিয়ে তার প্রতিবন্ধী পুত্রকে তুলে দেন পাক সেনাদের হাতে। তারা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। মা নিজের পুত্রের চেয়েও দেশকে বড় করে দেখেছিলেন। এমন মর্মস্পর্শী ত্যাগের গল্পের এই চলচ্চিত্রটি।
একই বছর খান আতাউর রহমান নির্মাণ করেন ‘এখনো অনেক রাত’।
১৯৯৭ সালে নির্মিত হয় তথ্যচিত্র মানজারে হাসীনের ‘চারুকলায় মুক্তিযুদ্ধ’।
১৯৯৮ সালে নির্মিত হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় ছবি ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’-এ ‘মুক্তিযুদ্ধ’ প্রসঙ্গ এসেছে। ছবিটিতে একজন ‘রাজাকার’-কে ‘নিষ্পাপ’ হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু তার বিপুল জনপ্রিয়তার কারণেই হয়তো বিষয়টি অনেকের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে।
২০০০ সালে মোরশেদুল ইসলাম-নির্মাণ করেন ‘শরৎ’৭১
তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ নির্মিত হয় ২০০২ সালে। এটাই বাংলাদেশের প্রথম অস্কারের জন্য মনোনীত কোনো চলচ্চিত্র। এতে মুক্তিযুদ্ধ উঠে এসেছে ভিন্ন আঙ্গিকে।
২০০২ সালে মুক্তি পায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক তিনটি চলচ্চিত্র; হুমায়ূন আহমেদ-এর ‘শ্যামল ছায়া’, তৌকির আহমেদ-এর ‘জয়যাত্রা’ এবং কথা সাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের উপন্যাস অবলম্বনে চাষী নজরুল ইসলাম তৈরি করেন ‘মেঘের পরে মেঘ’।
২০০৬ সালেও চাষী নজরুল ইসলাম তৈরি করেন আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চলচ্চিত্র ‘ধ্রুবতারা’ এবং একই বছর ‘খেলাঘর’ তৈরি করেন মোরশেদুল ইসলাম। ‘খেলাঘর’ মূলত মাহমুদুল হকের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক কাহিনী ‘খেলাঘর’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চিরন্তন প্রেমের ছবি। এতে একবারের জন্যও মুক্তিযুদ্ধকে সরাসরি দেখানো হয়নি, তবুও যুদ্ধের অনুভুতি ছিল প্রতি মুহূর্তে।
২০১০ সালে তারেক মাসুদের ‘নরসুন্দর’ এবং তানভীর মোকাম্মেল-এর ‘রাবেয়া’ মুক্তি পায়। তবে, রাবেয়া চলচ্চিত্র যে মঞ্চ নাটকের স্কিপ্ট থেকে করা হয়েছে তা ছিল স্পষ্ট; ফলে সেটা ছবি না হয়ে হয়েছে নাটকের চিত্ররূপ। মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানের কিছুটা ফুটে উঠেছে ‘রাবেয়া’-তে।
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘নিষিদ্ধ লোবান’ অবলম্বনে ২০১১ সালে মুক্তি পেয়েছে নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু-র ‘গেরিলা’। ছবিটিতে অভিনয় করেছেন সহ¯্রাধিক শিল্পী। সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত এ ছবির জন্য শুল্ক মওকুফের সিদ্ধান্তও নেয়া হয়েছে দর্শক বাড়ানোর জন্য।
একই বছর সরকারি অনুদানে মুহম্মদ জাফর ইকবাল-এর জনপ্রিয় একটি শিশুতোষ উপন্যাস অবলম্বনে ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ ছবিটি নির্মাণ করেছেন মোরশেদুল ইসলাম। ১৯৭১ সালে মফস্বল শহরের কয়েকজন কিশোর কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে, তারই কিছু চিত্র ফুঁটে উঠেছে গল্পে।
১৯৭২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত মমতাজ আলী’র ‘রক্তাক্ত বাংলা’ এবং আনন্দ’র ‘বাঘা বাঙালী’-র মতো বিতর্ক সৃষ্টি করে এই বছর মুক্তি পাওয়া আরেকটি ছবি রুবাইয়াত হোসেন-এর ‘মেহেরজান’। ছবিটিতে মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষিতা নারীদের অনুভুতিতে আঘাত করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠে। ছবির গল্পে- ‘একজন বাঙালি কিশোরী এক পর্যায়ে একজন পলাতক আহত পাকিস্তানি সৈন্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। পাকিস্তানিদের নজরে পড়ে ধর্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরী হলে ঐ পাকিস্তানী সৈন্য কিশোরী মেহেরকে বাঁচানোর ঘটনায় মেহের তার প্রতি কৃতজ্ঞ এবং পরবর্তীতে তার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। ছবির নামকরনে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য আছে টের পাওয়া যায়, কারণ নিজের ভালোবাসার মর্মোদ্ধার ছাড়া আর কোথাও এই গল্পে কিশোরী মেহের প্রধান চরিত্র হয়ে উঠেনা। এই সিনেমায় মূলতঃ একজন পুরুষ সামন্তপ্রভূর চোখ দিয়ে দর্শকদের তার পারিপার্শ্বকে দেখানোর চেষ্টা করে।’
২০১২ সালে শাহজাহান চোধুরী-র ‘আত্মদান’- পর সর্বশেষ এ বছরের ১২ ডিসেম্বর মুক্তি পেয়েছে জাহিদুর রাহিম অঞ্জন-এর চলচ্চিত্র ‘মেঘমল্লার’। সাম্প্রতিক আলোচনায় এ যাবতকালের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে এগিয়ে আছে ‘মেঘমল্লার’ ছবিটি।
এই সময়টাতে বেশ কিছু তথ্যচিত্র নির্মিত হয়। তার মধ্যে কাওসার চৌধুরীর ‘সেই রাতের কথা বলতে এসেছি’(২০০২), তানভীর মোকাম্মেল-এর ‘স্মৃতি ৭১'(২০০৪)। ‘তাজউদ্দীন: নিঃসঙ্গ সারথি’(২০০৭), ‘১৯৭১’ (২০১১), অশোক কর্মকার ও মানজারে হাসীন-এর ‘কালরাত্রি’ (২০০৭) উল্লেখযোগ্য।
২০১৪ সালে ভারতে তৈরি এবং মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্র ‘গুন্ডে’ ব্যাপক নিন্দা কুঁড়ায়। আলী আব্বাস জাফর পরিচালিত এই ছবির কাহিনীরেখা ও অনেক সংলাপ রীতিমত আপত্তিকর বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে। ছবির কাহিনীতে দেখা যায়, দুজন ছেলে যারা একাত্তরে বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী হয়ে ভারতে গিয়ে আর ফেরেনি এবং দুষ্কৃতিতে পরিণত হয়ে নানান কুকীর্তি করে বেড়ায়। সংলাপে বলা হয়, ১৯৭১ এর যুদ্ধটি ছিল পাকিস্তান বনাম ভারতের যুদ্ধ এবং সে যুদ্ধে ভারত জেতে আর এর ফলে বাংলাদেশ নামের দেশটির জন্ম হয়।
এ ধরণের ঘটনা ইতোপূর্বেও হয়েছে মুম্বাইতে। ১৯৭১ ও ১৯৭২ সালে। আইএস জোহর, দারা মোহাম্মদ প্রভৃতি নির্মাতা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে বিকৃত রুচির ছবি তৈরি করেছেন সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে। আইএস জোহরের ‘জয় বাংলা’ ছবিতে বাংলাদেশের যুদ্ধকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়। এ ছবিতে প্রধান একটি চরিত্রে বাংলাদেশের অভিনেত্রী কবরীকে কুৎসিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। ভারত জুড়ে বিতর্কের শেষে এবং বাংলাদেশের আপত্তির মুখে ছবিটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। এছাড়া আরো কিছু হিন্দি, বাংলা ছবিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ আনা হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের ভূমিকাকে পাশে সরিয়ে রেখে ভারতীয় ভূমিকাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে ভারতীয়দের দেখানো হয় ত্রাণকর্তা রূপে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সবচেয়ে ভালো প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন ভারতের এস. সুকদেব। ‘নাইন মানথ্স টু ফ্রিডম’ নামের এই প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটি এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র যার বিভিন্ন ফুটেজ নানাভাবে আজও ব্যবহার করা হয়।
২০১৪ সালে ভারতের আরেকটি ছবি একযোগে ভারত-বাংলাদেশে মুক্তি পায়। ছবিটির হিন্দি ভার্সনের নাম ‘চিলড্রেন অফ ওয়ার’ এবং বাংলা ভার্সনের নাম ‘যুদ্ধশিশু’।
মনসুর আলী নামে ইংল্যান্ড প্রবাসী পরিচালক এ বছর ‘সংগ্রাম’ নামে একটা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ছবিটি বাংলাদেশে মুক্তি পেয়েছিল।
সামগ্রিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রায় সবগুলো ছবি নির্মিত হয়েছে প্রধানত মধ্যবিত্ত জীবনের দৃষ্টিকোণ থেকে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বাস করলেও এবং মুক্তিযুদ্ধে তাদের অংশগ্রহণের আকাঙ্খার কারণ ও প্রেরণার সূত্র থাকলেও তার যথেষ্ট প্রতিনিধিত্ব মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে নেই। তাছাড়া মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলো মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করছে। তবে, এখনো অনেক মুক্তিযোদ্ধা এবং গণহত্যার প্রত্যক্ষ সাক্ষী জীবিত রয়েছেন। তাঁদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এখনও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস নির্মাণ করা সম্ভব। এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারবে।
লেনিন বলেছিলেন, ‘সব শিল্পকলার মধ্যে চলচ্চিত্রই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’। এই গুরুত্বপূর্ণ’ শিল্পকে হতে হবে এমন, যা মানুষের ভাবনাকে উজ্জীবিত করবে, বোধকে আরো বেশি করে জাগ্রত করবে।
তবে একথা অনস্বীকার্য তৃতীয় বিশ্বের একটি দরিদ্র দেশে মুক্তিযুদ্ধের মতো একটা বিশাল ক্যানভাসের চলচ্চিত্র নির্মাণ করা খুবই কঠিন কাজ। তা সত্বেও আগামী প্রজন্মের কাছে সবচেয়ে গৌরব, গর্ব আর বেদনাগাথা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পালন করে যাচ্ছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। সত্যিই এটি আশা ও অহঙ্কারের বিষয়।