Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,classical-music irabotee gitaranga special issue

ইতিহাস কি মনে রেখেছে সঙ্গীতের এই দিওয়ানিদের কথা । রূপসা রায়

Reading Time: 3 minutes

কোঠা। তওয়ায়েফের কোঠা। শুনেছেন নিশ্চয়ই শব্দ দুটো!

এই দুই শব্দের সঙ্গে মিলেমিশে রয়েছে বহু দিনের সংস্কার। নিষেধের গন্ডি আর নিষিদ্ধ কৌতূহল। রাজপথ থেকে যার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকানো যায়, যার গন্ধ মেহসুস করা যায়। কখনও পুরোনো লখনৌয়ের রাস্তায়, কখনও পুরোনো বোম্বের অলিগলিতে। অথচ কে না জানে, এই কোঠেওয়ালিরা নিজেরাই কখনও সঙ্গীতের রানি, কখনও বা সঙ্গীতের রাজা-বাদশাহদের নিত্য সহচরী। ভাব বিনিময়ের আধার।

এক খণ্ড ভূমি। কোনও রাস্তা বা গলি, সারি সারি কোঠা, বারান্দা থেকে মুখ বার করা মেয়েরা, এই যে জায়গা, একটা স্থান; এটার যদি কোনও গন্ডি থাকে, যার উল্টো দিকে শহুরে গেরস্থদের ঘর। যদি ধরে নেওয়া যায়, এর মধ্যে ভেদ আছে কোনও ঘর আর বারের ‘বারবধূ’ থুড়ি তওয়ায়েফদের ‘স্পেস’! তা হলে এই দু’টির মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে সঙ্গীত। একমাত্র সঙ্গীত।

কারণ হাওয়ার তো গণ্ডি থাকে না। হাওয়ায় ভেসে সুর আসে গৃহস্থের ঘরে। অথবা যদি অতটা জোর নাও থাকে হাওয়ার, তা হলেও কথা তো ভাসে! মেহফিল থেকে বাড়ির বৈঠকখানা থেকে শোওয়ার ঘরে। সুরের ছোঁয়া গায়ে লাগে ওই কথায় কথায়। আর যদি বা চকিতে দেখা যায় তাদের মুখ, কাজলকালো চোখ আর নাকের পাটায় থাকা হিরের নাকছাবি থেকে ছিটকে আসা রহস্যে ভরা আলো।

হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সে আলোর আত্মা।

হিন্দুস্তানি রাগ সঙ্গীত বা রাগাশ্রিত সঙ্গীত সাধারণ মানুষের দরবারে হাজির হয়েছিল আসলে রেডিয়োর হাত ধরে। মানে সকলের জন্য হিন্দুস্তানি রাগ সঙ্গীত, যাঁরা মেহফিল বা জলসায় পা রাখেননি কখনও। এই ভাবেই তৈরি হয়েছে রুচি। আর সেখান থেকে ভালোওবেসে ফেলেছেন সাধারণ মানুষ, এই সঙ্গীতকে, সঙ্গীতশিল্পীকে। তাঁদের কাছে যাওয়ার জন্য আকুল হচ্ছে প্রাণ। এবং চলেও যাচ্ছেন কেউ কেউ— আর এই ভাবেই পা রাখছেন তওয়ায়েফের কোঠায়।

 

 

ধরুন না কেন ওস্তাদ আমির খানের কথাই। তখন রেডিয়োতে গাইছেন তিনি। আবার পুরোনো বোম্বের মেহফিলেও দেখা যাচ্ছে তাঁকে। সেই মেহফিল তো সমঝদারদের জন্য। রেডিয়োর সর্বজনীনতা সেখানে নেই। কিন্তু ওই যে রেডিয়োতে শুনেই ইচ্ছে হল, দেখা করতে হবে শিল্পীর সঙ্গে, তাঁরা চলে গেলেন আমির খানের সঙ্গে দেখা করতে। তাঁর নিভৃত আশ্রয়টিতে। কোথায় সেটি? গঙ্গাবাঈয়ের কোঠা। সেখানেই থাকতেন যে ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের বাদশাহ। এই ভাবেই কোনও না কোনও ভাবে পরিচয় ঘটেই যেত ‘অন্য’ জগৎটার সঙ্গে। কেউ হয়ে উঠতেন সমঝদার শ্রোতা, কেউ হয়ে উঠতেন ওস্তাদ শিল্পী।

এমনই একটি গল্প বলেছেন ওস্তাদ মুরলী মনোহর শুক্লা। ছোট থেকেই সঙ্গীতের টানে চলে যেতেন মুম্বইয়ের এনবি কম্পাউন্ডে। আমির খানের সঙ্গে দেখা করতে। বলছেন তিনি, ‘ম্যায়ঁ ছোটা থা না, ঘুসনে কি আদত থি- চুহে কি তরহা। তো মুঝে সব জাগাহ অ্যাকসেপ্ট করতে থে’। তার পর, একদিন বেলা ১০ টায় তিনি ঢুকে পড়েছেন আমির খানের ঘরে। তখন সবে দাঁত মাজছেন ওস্তাদ। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সুবাহ সুবাহ কাঁহা আ গয়া?’ অদ্ভুত সারল্যে বলে ফেললেন মুরলী মনোহর, ‘বেলা দশটা সকাল?’

আসলে এই ঘরগুলোতেই যে ওস্তাদকে পাওয়া যেত অন্তরঙ্গ ভাবে, নিজস্ব যাপনে।

আবার সব সময়ে যে যাওয়াটা সহজ হত, তা নয়। অনেক সময়ে ঘরোয়া সঙ্গীতজ্ঞদের ‘কালচারাল শক’ও হত। তেমনই গল্প বলছেন ওস্তাদ নিখিল ঘোষের ছেলে নয়ন ঘোষ। নিখিলবাবুর গুরু ছিলেন আমির হুসেইন খান। তিনিও যেতেন তওয়ায়েফের কোঠায়। সকল সঙ্গীতসাধকরা জড়ো হতেন সেখানে। তওয়ায়েফদের আতিথ্যেই জলসা, মেহফিল। এক দিন নিখিলকে বলেছেন তাঁর গুরু, ‘চলো আজ মেরে সাথ ওহাঁ।… বাঈকে ঘর মেঁ’। গেছেন তিনি, গুরুর সাথে। গোটা পরিবেশ দেখে থ। আর সেই পরিবেশেই কি না তাঁদের নমস্য সঙ্গীতগুরুরা! আর ওই জলসার মধ্যে শেখাও হত।

আদবটা ছিল এ রকম। তরুণ শিল্পীরা আগে গাইতেন, বাজাতেন। সেটাই আদব। তাঁদের মধ্যে যদি কেউ একটু ভুল-চুক করতেন; ওস্তাদরা মাঝে মধ্যে থামিয়ে দিয়ে বলতেন, ‘রুকো বেটা, ইয়ে ফির সে বাজাও’। আর সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসত প্রশ্ন- ‘কওন হ্যায়ঁ, তুমহারা ওস্তাদ কওন হ্যায়ঁ’? ধরা যাক, সেই ওস্তাদ বসে আছেন মেহফিলের কোনও এক কোণে, তাঁকে অনুরোধ করা হত, যাতে সংশোধন করে দেন ছাত্রের ভুলটুকু। তার পর সংশোধন করে নিয়ে ফের শুরু করতেন ছাত্র। অনেক সময়ে আবার বিতর্কও তৈরি হত। পরস্পরকে চ্যালেঞ্জ করে বসতেন কেউ কেউ। কখনও কখনও বিতর্ক ঝগড়া-বিসংবাদে গড়াত। গান শুনতে শুনতে কেউ যদি বলে উঠতেন, ‘ইসকা জোড়া নহি হ্যায়’ তখনই অন্য কেউ বলে উঠতেন, ‘অগলে জুম্মে কো ম্যায় জোড়া লে আতা হুঁ’। অর্থাৎ, যেটা গাইছেন বা বাজাচ্ছেন কেউ, তার জুড়ি হতে পারে এমন সঙ্গীত তৈরি করে নিয়ে আসবেন তিনি।

আর এই গোটা প্রক্রিয়াটার মধ্যে তওয়ায়েফরা পাঠিয়ে দিতেন খাবার, পানীয় আড়াল থেকে। বেতের পর্দার আড়ালে বসে থাকতেন তাঁরা। বিকেল ৪টে থেকে শুরু হত মেহফিল। শেষ হতে হতে রাত ১২টা-১টা। তাঁদের কোঠায় তৈরি হত সঙ্গীত।

অথচ পরিহাস হল, হিন্দুস্তানি রাগসঙ্গীতের পৃষ্ঠপোষক বলতে রাজারাজড়া, নবাব-বাদশাহদের নামই বলা হয়। তওয়ায়েফদের কথা কেউ ভাবেনও না। অথচ সঙ্গীত সরস্বতী হয়ে তাঁরাই বাঁচিয়ে রেখেছেন ভারতীয় সঙ্গীতকে। আর সে জন্যেই হয়তো একটু বড় হওয়ার পর যখন তওয়ায়েফের কোঠায় নয়নকে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর বাবা, বলেছিলেন প্রণাম করতে তাঁদের। পা ছুঁয়ে সে দিন এই মেয়েদের প্রণাম করেছিলেন নয়ন। আসলে এটাই তো ছিল আদব আর আদত। প্রশ্ন জাগে, মহিলা সুরসাধক, যাঁরা গৃহী, তাঁরা কি কখনও পৌঁছতে পারতেন এই ‘নিষিদ্ধ’ ভূমিতে? না। নাম খারাপ হওয়ার ভয়। শুধুি তো মেয়েটির নয়, পরিবারের, পাড়ার। আক্ষেপ আছে অনেকেরই। অথচ সঙ্গীতের জন্য দিওয়ানাপন তো তাঁদেরও ছিল!

ইতিহাস কি মনে রেখেছে সঙ্গীতের এই দিওয়ানিদের কথা?

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>