Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com, Conch art in mythology Nusrat Jahan

লোকসংস্কৃতি: পুরাণে-ঐতিহ্যে শঙ্খশিল্প । নুসরাত জাহান

Reading Time: 4 minutes
শঙ্খশিল্প অত্যন্ত প্রাচীন একটি লোকশিল্প। পণ্ডিতদের মতে, প্রায় দু’ হাজার বছর আগে দক্ষিণ ভারতে শঙ্খশিল্পের উদ্ভব ঘটে। হিন্দু ধর্মের বিয়ে থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যাবতীয় কাজকর্ম শঙ্খ দিয়ে আবৃত। পূজা-অর্চনার কাজে গঙ্গাজল পাওয়া না গেলে শঙ্খধোয়া জল ব্যবহার করা হয়। হিন্দুশাস্ত্রে শঙ্খ এতটাই গুরুত্বপূর্ণ! যারা শঙ্খের জিনিস তৈরি করে তাদের শঙ্খকার বা শাঁখারি বলে। শঙ্খ ও শঙ্খ দিয়ে তৈরি জিনিস ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে এদের জীবিকা সীমাবদ্ধ। শঙ্খ সামুদ্রিক শামুক গোত্রের প্রাণী। দক্ষিণ ভারতের উড়িষ্যা, পুরী,কর্নাটকের সমুদ্রসৈকত এলাকায় জীবন্ত শামুক ধরা হয়। তারপর সেদ্ধ করে এর নরম শরীরটা ফেলে দিয়ে রোদে শুকিয়ে নেয়া হয়। এরপর বিভিন্ন জায়গায় কাঁচামাল হিসেবে পাঠানো হয়। এর মধ্যে শঙ্খধ্বনি দেয়ার জন্য বিশেষ প্রজাতির শামুক ধরা হয়, যা হিন্দু ধর্মের নানা পূজা-অর্চনায় ব্যবহার করা হয়।
শঙ্খ অলংকারের ইতিহাসও অতি প্রাচীন স্মৃতি বহন করে। শাঁখা-সিঁদুর সনাতন হিন্দু ধর্মের চিহ্ন। হিন্দু সধবা মেয়ের জন্য হাতের শাঁখা অপরিহার্য। বিয়ের সময় গায়ে হলুদের দিন ধান-দূর্বা ও সিঁদুর দিয়ে একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শঙ্খের বালা নবপরিণীতাকে পরানো হয়। স্বামীর মৃত্যুতে এ শাঁখা ভেঙ্গে ফেলা হয়। 
শাঁখা বা শঙ্খের অলংকার তৈরির জন্য বিশেষ কয়েকটি প্রজাতির শঙ্খ ব্যবহৃত হয়। এ প্রজাতিগুলো হলো – তিতপুটী, রামেশ্বরী, ঝাঁজি, দোয়ানী, মতি-সালামাত, গারবেশী, কাচ্চাম্বর, ধলা, জাডকি, কেলাকর, জামাইপাটী, এলপাকারপাটী, গড়বাকী, সুরতী, খগা ইত্যাদি। একটি বড় শঙ্খে ৮/১০ টি শাঁখা তৈরি হয়। শঙ্খের ছোট ছোট টুকরা দিয়ে কানের দুল, মালা, আংটি, ক্লিপ, খোপার কাঁটা, ব্রেসলেট, সেফটিপিন, বোতাম, পুঁতি ইত্যাদি তৈরি করা হয়। শাঁখের গুঁড়া গুটি বসন্তের দাগ ওঠানোর জন্য পাউডার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। হাতের শাঁখার নানা ধরনের নাম পাওয়া যায়। যেমন- টালী, লাইনসোড, চিত্তরঞ্জন, পানবোট, সোনা বাঁধানো, সতীলক্ষ্মী, হাঁইসাদার, দানাদার, ভেড়াশঙ্খ, লতাবালা, ধানছড়ি, চৌমুক্ষি, জয়শঙ্খ, পাথুরহাটা, গোলাপফুল, মুড়িদার, আঙ্গুরপাতা, বেণী, নাগরী বালা ইত্যাদি। 
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শঙ্খশিল্পের কেন্দ্র রয়েছে। পুরান ঢাকার শাঁখারি বাজার শঙ্খশিল্পের প্রধান কেন্দ্র। এছাড়া বরিশাল, ঝালকাঠি, খুলনা, গৌরনদী, চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল, রংপুরসহ আরো বেশ কিছু অঞ্চলে শঙ্খশিল্পীদের কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। একজোড়া শাঁখার দাম নির্ভর করে এর গঠনশৈলীর ওপর।  যত সূক্ষ্ম কাজ, তত দাম বেশি। সৌন্দর্য বৃদ্ধি এবং মজবুত করার জন্য শাঁখা সোনা বা রূপা দিয়ে বাঁধানো হয়। সোনা ও রূপা ছাড়াও মূল্যবান পাথরও শাঁখায় সংযোজন করা যায়।
শঙ্খশিল্প উদ্ভবের কারণ হিসেবে বেশ কিছু পৌরাণিক কাহিনী পাওয়া যায়। তবে শাঁখা কেন সধবা হিন্দু নারীর আবশ্যক অলংকার হলো সে কাহিনীটি বেশ চমত্‍কার। একবার দেবসভায় এক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে শিব-পার্বতীও আমন্ত্রিত হন। কিন্তু অনুষ্ঠানে যোগ পরার মতো কোনো অলংকার তার ছিল না। তিনি পড়লেন মহাসংকটে। স্বর্গলোকের সকল দেবীর দেহে যেখানে অলংকার শোভা পাবে, সেখানে তিনি নিরাভরণ বেশে যান কেমন করে? বিব্রত শিব বিশ্বকর্মার কাছে সহায়তা চাইলেন। কিন্তু বিশ্বকর্মা শিবকে জানালেন যে, পৃথিবীর সব রত্ন আগেই আহৃত হয়েছে এবং সেসব রত্নের অলংকার পরেই দেবীরা স্বর্গলোকের অনুষ্ঠানে যাবেন। একমাত্র সিন্ধুতলের শঙ্খই অবশিষ্ট আছে, যা দিয়ে তিনি পার্বতীর জন্য উত্‍কৃষ্ট অলংকার তৈরি করে দিতে পারবেন। অগত্যা শিব তাতেই রাজি হলেন। পার্বতী যখন শঙ্খ-অলংকার পরে দেবসভায় গেলেন, তখন শঙ্খের উজ্জ্বল শুভ্র আলোয় দেবীদের রাশি রাশি মণিমাণিক্য ম্লান হয়ে গেল। তখন থেকেই বিবাহিতা হিন্দু নারীর শ্রেষ্ঠ অলংকার হলো একজোড়া শাঁখা।
আরেকটি পৌরাণিক কাহিনী থেকে জানা যায় শঙ্খচূড় ছিল মারাত্মক বিষাক্ত নাগ বা সাপ। শঙ্খচূড় ব্রহ্মার কাছ থেকে বর হিসেবে অমরত্ব লাভ করে। স্বর্গের দেবতারা এতে ভীত হয়ে তার অমরত্ব নষ্ট করার জন্য দেবতা বিষ্ণুর শরণাপন্ন হন। বিষ্ণু দেবতাদের মান রক্ষার জন্য উপায়ন্তর খুঁজতে থাকেন। বিষ্ণু শঙ্খচূড়ের অমরত্ব নষ্ট করার একটি সুযোগ খুঁজে পায়। বিষ্ণু বুঝতে পারে শঙ্খচূড়ের স্ত্রী তুলসীর সতীত্ব নষ্ট করা গেলে শঙ্খচূড়ের অমরত্ব আর থাকবে না। শঙ্খচূড় যুদ্ধের ময়দানে ব্যস্ত থাকলে বিষ্ণু তুলসীর সতীত্ব হরণের সুযোগ খুঁজে পায়। চরম হটকারীতার পরিচয় দিয়ে বিষ্ণু শঙ্খচূড়ের রূপ ধারণ করে তুলসীর ঘরে এসে তার সঙ্গে দৈহিকভাবে মিলিত হন। শঙ্খচূড়ের রূপ ধারণ করলেও তুলসী বিষ্ণুর মধ্যে কিছু অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করে তাকে ধরে ফেলেন। দৈহিক মিলন শেষে তুলসী পথ আগলে দাঁড়িয়ে বিষ্ণুকে স্বমূর্তি ধারণে বাধ্য করে। বিষ্ণু নিজ রূপ ধারণ করলে ক্ষিপ্ত তুলসী তাকে অভিশাপ দিলে আতঙ্কিত বিষ্ণু তুলসী ও শঙ্খচূড়কে এটি বর দেয়। এর বর থেকে তুলসী পৃথিবীর মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবে তুলসী গাছ হয়ে, যার পাতা ছাড়া পূজা হবে না। অন্যদিকে শঙ্খচূড় সমুদ্রের তলায় শঙ্খ হয়ে বেঁচে থাকবে বছরের পর বছর। এরপর থেকেই শঙ্খ কেটে তৈরি শাঁখা হিন্দু রমণীর সতীত্বের প্রতীক।
শঙ্খশিল্প নিয়ে আরো একটি পৌরাণিক গল্প হলো কৃষ্ণ একবার সমুদ্রের তলদেশে বসবাসকারী এক অসুরকে হত্যা করে। এই অসুরের নাম ছিল পঞ্চজন যে মৃত্যুর পূর্বে কৃষ্ণের কাছে বর চায়। তার প্রার্থনাকৃত বর ছিল যে হাতে তার মৃত্যু হয়েছে সেই হাত যেন সে যুগের পর যুগ অনুভব করতে পারে। কৃষ্ণ তখন পঞ্চজনের হাড় দিয়ে বিশেষ ধরনের শঙ্খ নির্মাণ করেন। এরপর তাকে আরেকবার বর চাওয়ার সুযোগ দেয়া হয়। তখনকার বর হিসেবে কৃষ্ণ বলেন, যে বাড়িতে প্রতিদিন সন্ধ্যা বেলায় শঙ্খধ্বনি বেজে উঠবে সে বাড়িতে লক্ষ্মী নারায়ণের অবস্থান স্থিতিশীল হবে। এর পাশাপাশি পূজা-অর্চনাসহ বিবিধ পবিত্রকাজে গঙ্গাজলের অভাব দেখা দিলে শঙ্খে রাখা জল থেকে সেই কাজ করা যাবে। 
অন্যদিকে পটশিল্প অঙ্কনকারী পটুয়া শিল্পীরা তাদের আঁকা ছবি প্রদর্শনের পাশাপাশি একটি কবিতা গানের মতো সুর করে পরিবেশন করে থাকেন। তাদের এই কবিতার ভাবার্থ হচ্ছে,- একবার পার্বতী শিবের কাছে একজোড়া শাঁখার জন্য অনুরোধ করলে শিব পার্বতীকে শাঁখাজোড়া কিনে দিতে অপারগ হন। এতে মন খারাপ করে পার্বতী তার বাবার বাড়িতে চলে যান। অনেক দিন পার হয়ে গেলেও পার্বতী যখন তার স্বামীর কাছে প্রত্যাবর্তন করছেন না তখন শিব দুশ্চিন্তা অনুভব করেন। তিনি তখন শাঁখারির ছদ্মবেশ ধরে পার্বতীর কাছে শাঁখা বিক্রি করতে যান। হাতে পরতে গিয়ে পার্বতীর শাঁখা ভেঙে যায়। তখন ছদ্মবেশী শিব এ ঘটনার জন্য পার্বতীর পতি ভক্তিহীনতার কথা বললে পার্বতী অনেক রাগান্বিত হন। এরপর পার্বতী শাঁখারির দিকে এখন অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করেন যে, তার পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ছদ্মবেশী শিবের কিছু না হওয়াতে পার্বতীর কাছে তার ছদ্মবেশ স্পষ্ট হয়ে যায়। স্বামীর কাছ থেকে শাঁখা উপহার পেয়ে খুশি মনে পার্বতী স্বামীর ঘরে ফিরে যান। এরপর থেকে বিবাহিত হিন্দু নারীদের শঙ্খ পরিধানের বিষয়টি প্রচলিত হয়। 
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানের বিবরণ মতে বিশ্বকর্মার ঔরসে গোপকন্যাবেশী ঘৃতাচীর গর্বে নয়জন পুত্র সন্তান জন্ম লাভ করেন। তারা হচ্ছেন মালাকার, কর্মকার, শঙ্খকার, কুর্ন্দিবক, কুম্ভকার, কাংস্যকার, সূত্রধর, চিত্রকার ও স্বর্ণকার সসম্প্রদায়ের আদি পুরুষ। এই পুরাণের বিবরণ মতে শাঁখারিরাই একমাত্র শ্রেণি যারা শঙ্খবলয় পরার সময় মাপ দেয়ার জন্য উঁচু নিচু সকল শ্রেণির হিন্দুনারীর অঙ্গস্পর্শ করতে পারে। তাদেরকে সম্মান করে কখনো কখনো শাঁখারি বাওয়ান বা ব্রাহ্মণ কিংবা শাঁখারি ঠাকুর বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>