| 19 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

নিরস্ত্র জন্মযাপন ও ব্যাধির কর্কট সরণী- প্রসঙ্গ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ছোটগল্প

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

 

 

জীবন চলেছে শূন্যতার পথে। অনন্ত অনিকেত যাত্রা। ‘আত্ম’ ‘অপরে’র সংযোগহীন সেতুতে অনায়াস চলাচল তার। সম্পর্কের শ্বাসরুদ্ধ হত্যা কিংবা আত্মহত্যাই প্রাত্যহিকতা। ইচ্ছে-অনিচ্ছে আর প্রচল প্রবাহের সাঁড়াশি আক্রমণে ছিন্ন ভিন্ন সত্তা। টিকে থাকা ও টিকিয়ে রাখার এক অলিখিত দায়বদ্ধতা। ভিক্ষা সংস্কৃতিতে পণ্যায়িত প্রেম ও যৌনতা। আত্ম ও শরীরের বিকট বিচ্ছিন্নতা। মৃত্যু উপত্যকায় এ এক বিচিত্র বৃশ্চিক লড়াই। বিপন্ন বিষণ্ণতার এই কফিনস্রোত থেকে রেহাই পায়নি ছোটগল্পও। বরং তার key hole-এ চোখ রেখে সময়ের অন্তর্ঘাত ও অসহায় আত্মহননকে যেন আরও বেশি করে চেনা যায়। পাশাপাশি, আত্ম-প্রত্যক্ষণও উঠে আসে অনিবার্য কথন মালায়।

অস্ত্রহীন জন্ম, নিরস্ত্র যাপন। দাবার ছকে জীবনের লড়াই। বিশ্বজোড়া সময়ের এই ব্যাধি সাম্প্রতিক ছোটগল্পেও তার রক্তমাখা দাগ ছোপটুকু রেখে দিয়েছে। কেবল বাংলাদেশের গল্পে নয়, সর্বত্রই চলেছে এই অঙ্গার প্রবাহ। আলোচ্য নিবন্ধে অবশ্য শুধু মাত্র বাংলাদেশের কিছু সাম্প্রতিক গল্পই রাখা হয়েছে। সন্ধানী আলো ফেলে তাদের শিকড়ে ঘুনের মতো লীন হয়ে থাকা কর্কট সরণীটিকে চিহ্নিত করা এবং তার নিরিখে আত্ম-অপর নির্বিশেষে চিহ্নিত হওয়াও লিখনটির মূল উদ্দেশ্য।

আমাদের সত্তা, আমাদের অস্তিত্ত্বের ছোট বড় খণ্ডগুলো কখন, কোথায় কীভাবে যে ‘দ’-এ পড়ে-জানি না। জানতে পারি না।নিজের তৈরি করা ঘরের মেঝে কখন যে এত গর্তে ছেয়ে যায়, টের পাওয়া যায় না। কার্পেট বিছাতে হয়। ওপরে চকচকে কার্পেট, মন পড়ে থাকে বিবরে- ‘বিবর অথবা অন্য কিছু’তে (নাসরীন জাহান, ‘অন্যদিন’, ঈদসংখ্যা, ২০১৮)। ধূলোর মতো মানস কণা বা mental prattle গুলো অজান্তে পাক খেতে খেতে ঢুকে যায় কোনও অন্ধ বিবরে। তারপর আর কিছুতেই বের হতে পারে না। চাওয়া আবার জোর করে না চাওয়ার যৌথ তীরন্দাজিতে শেষমেষ গলগলিয়ে উঠে আসে নিখাদ negativity। আসলে বিবরের প্রাচীরের পিচ্ছিলতা এতটাই বেশি যে কিছুতেই সেখান থেকে বের হওয়া যায় না।আত্ম এবং অপরকে গালি দিয়ে গ্লানি বাড়ে কেবল। মনে মনে অনন্ত কথকতার ডায়েরি লেখা হয়। আগ্রাসী ইর্ষা আর উদার ক্ষমার বিচিত্র সহবাসে অবিরাম পুড়তে থাকে লেখকের মন। বাইরের দুর্ঘটনা-যন্ত্রণায় নীল হয়ে যাওয়া-সহ্য করতে না পেরে নিষিদ্ধ ইঞ্জেকসন নেওয়া-এসমস্তই তার রক্তাক্ত মুখ থুবড়ে পড়া মুমূর্ষু মানস অবস্থাকেই নগ্ন করে। রেজওয়ানের দ্বিতীয় বিয়ে ও সাবালক সন্তানকে সে সম্বন্ধে অন্ধকারে রাখার অনুমতি চাওয়া, তাকে বাস্তবিকই হতবাক করে দেয়। এ যেন অনুমতি নিয়ে অনুমোদিত হত্যা! ঘাতক এখানে দোষমুক্ত। নিহতের অনুমতি আছে যে! এর থেকে বড় শংসাপত্র আর কী হতে পারে! ঘাতক তো না হয় আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিয়ে রূপের বন্যায় ভেসে গেল। কিন্তু নিহত সত্তা যে ‘মৃতের স্ট্যাম্প’ নিয়েও শ্বাস প্রশ্বাস চালিয়ে যাচ্ছে! সম্পর্কের পৃথিবীতে এ এক বিচিত্র কোলাবরেসন! জীবন আর মৃত্যুর উদ্দাম সহবাস! ক্ষমা আর ঔদাসীন্যের মুখোসটা পড়তে হয় বলেই (নিজের কাছে নিজের কথা রাখার তাগিদে) ভিতরের হিংস্রতাটা তীব্র আগ্রাসী হয়ে ওঠে। বিবরের ভিতরে ঘুমিয়ে থাকা সরীসৃপ যেন। আত্মরক্ষার আত্যন্তিক তাগিদে সে এখন ক্ষমাহীন। অপেক্ষা কেবল সময় আর সুযোগের। মালয়েশিয়া থেকে আসুক একবার সন্তান। সমস্ত ফর্দাফাঁই করে দেবে ফ্যাতাড়ু। অসীম নৃশংসতা বিবরের অতল আঁধার থেকে তীক্ষ্ণ ফণা তোলে। ছোবলের জন্য উদ্যত অপেক্ষা।

আসলে মৃত্যু, হত্যা, আত্মহত্যার এক শেওলাধরা পিছল পৃথিবীর বহু পোড়োবাড়িতে একই সঙ্গে একই সময়ে বসবাস করি আমরা। হরেক কিসিমের এবড়ো খেবড়ো বাস্তবতা কিংবা অবাস্তবতা কিংবা নিছকই স্বপ্ন কল্পনা অথবা দুঃস্বপ্ন অদ্ভুত জাদু মন্ত্রে মিলেমিশে গেছে ‘গল্প হত্যার লঘু গুরু’ (মামুন হুসাইন, ‘কালি ও কলম’, ফেব্রুয়ারি, ২০১৪) গল্পে। বৃশ্চিক সত্তা আর কর্কট মৃত্যু দ্বিধা ভয় ও নিঃসঙ্গতার জটিল আলপনা এঁকে চলে অনবরত। মধ্যবিত্তের মেধা জুড়ে কেবল কথার প্রবাহ, বিষের স্রোত। কখনও স্মৃতির মৃত্যু, স্বপ্নের ভেতরে মৃত্যু, আবার কখনও সত্যের মৃত্যু অথবা রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রে হত্যার পাঁক আর্তনাদ করে ওঠে চেতন কিংবা অর্ধচেতনের আবছা চরাচরে। কৃষকের আত্মহত্যা, রাজনৈতিক ব্যক্তির হত্যা, ছাপোষা জনগণের মারণব্যাধি-ন্যায়পাল- হাবলাদার-লেখক-সম্পাদক সব যেন একই বিপন্নতার হরেক মলাট।

ছিন্নমস্তা! ছিন্নমস্তা! রোবট বসতবাসা! অদৃশ্য শহরতলি!
কঙ্কাল কোষাগার! অন্ধ রাজধানী শহর! দানব কলকারখানা!
ছায়াশরীর দেশ-রাষ্ট্র! অভেদ্য উন্মাদাশ্রম! গ্র্যানিট শিশ্ন!
রাক্ষস বোমাবারুদ!

রাষ্ট্রযন্ত্রের যাঁতাকলে মানুষ নিজেও অনুশীলিত হতে হতে রাষ্ট্রেরই এক সংস্করণ হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রের তকমা আঁটা হিংস্রতায় রক্তমাখা নিরীহ বেড়াল মার্সি কিলিং-এর আবেদন জানায়। গৃহপালিত জন্তুও ইউথ্যানাসিয়ার কথা ভাবে। এসব কিছু সত্ত্বেও রাষ্ট্র ধীর, স্থির, অনুত্তেজিত, বিচক্ষণ ও কৌশলী হওয়ার আবেদন জানায়। এর বিপরীতে বিশেষ উল্লেখ্য, আত্মরক্ষার জন্য প্রশাসনিক ব্যক্তিদের হাতে তুলে দেওয়া হয় আগ্নেয়াস্ত্র। তছনছ করে ফেলা হয় গোবেচারা ঘাতকের ডায়েরি। জেরায় জেরায় মৃতপ্রায় ঘাতকসত্তা। মাতৃহীন ঘুমন্ত কন্যার ঘুমও কেমন মৃত্যুর মতো নিস্তব্ধতা আনে। দেওয়ালে চুনকাম করা সাদা রঙও যেন মৃত্যুগন্ধী। কবরস্থানের ছায়ায় মানস পরিভ্রমণ করতে করতে মগজের ভেতর জমতে থাকা বিষাক্ত বিষাক্ত গল্পগুলোও মরতে থাকে নির্বিচারে। কথক নিজেও যেন বেশভূষা পড়ে রঙচঙ মেখে মৃতের ভূমিকায় নেমে পড়ে। কফিনের স্রোতে তন্দ্রাচ্ছন্নতায়, ঘোরে-বেঘোরে কেবলই মৃত্যু পাক খায়। মরে যায় কিংবা আত্মহত্যা করে গল্পের নটেগাছ।

প্রকৃতপক্ষে সব-ই সম্ভাব্য আর প্রশ্নমালা। ‘শেষ ট্রেন’ (বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, ‘কালি ও কলম’, মে-জুন ২০১৮,ছোটগল্প সংখ্যা) গল্পেও কেবল অনিঃশেষ প্রশ্ন। উত্তরমালা স্বাভাবিক ভাবেই অমুদ্রিত। বাস্তবিকই শূন্যতা ও গন্তব্যহীন যাত্রা আদৌ কি কোনও অর্থের জন্ম দেয়? নাকি এ কেবলই আত্মহনন? ভালোবাসা কি আদৌ কোনও সেতু? হিংসা, আকুতি, তিক্ততা যাতেই রূপান্তরিত করা হোক না কেন! আদৌ কি ‘অপর’ নামক কোনও অস্তিত্ত্বের সঙ্গে এই বোধটির কোনও সম্পর্ক আছে? নাকি এ কেবলই আত্ম-কে ঘিরে পাক খাওয়া! আর নানা বস্তু চিহ্নকে স্মারক করে বিষণ্ণতার উদগীরণ।

গল্প জুড়ে কেবল শূন্যের মধ্যে ঘর খুঁজে চলা। টবরমারি আসলে হয়তো তেলেনাপোতার মতোই কোনও কিছু। ট্রেন চলেছে বিষণ্ণতার দিকে। প্রতিটা জন্ম, প্রতিটা মৃত্যুর অভিমুখ আসলে কালেক্টিভ ডেথের দিকে। যৌথ নির্জ্ঞানে যৌথ মৃত্যু অভিযান। সময় শব্দ সব একাকার সেখানে, মানুষের শব্দ
মৃত্যুর কন্যা
আমরা নশ্বর
তাই আমরা কথা বলি
শব্দেরা চিহ্ন নয়, শব্দেরা বৎসর, খণ্ড-সময়।

                              ২

অন্যদিকে, ‘আনন্দর বিষণ্ণতা পর্ব’ (মুস্তাফিজ শফি, ‘দৈনিক ইত্তেফাক’, ঈদ সংখ্যা, ২০১৫) গল্পে সম্পর্কের আলো আঁধারি, বাঁচা মরা, খাবি খেতে খেতেও টিকে যাওয়া জ্যান্ত হয়ে উঠেছে আনন্দ ও বিষণ্ণতার সাক্ষাৎকারে। জিওল মাছের জীবনীশক্তি আর অপরিমিত স্থিতিস্থাপকতা টিকিয়ে দেয় কোনও কোনও সম্পর্ককে। সম্ভবত পুরোপুরি মরে না কিছুই। কোনও না কোনও ভাবে তার টুকরো টাকরা অংশ থেকেই যায়। তারপর কখন যেন সময় সেটাকে কখনও জোড়াতাপ্পি দিয়ে গোটা করার চেষ্টা করে, কখনও বা হিম-নিরেট করে রেখে দেয়। অথবা অন্যকিছু আকৃতি পায় তার তরলতা আর space অনুসারে। আসলে সম্পর্কে জড়িত থেকে সম্পর্কেরই আততায়ী হওয়া কঠিন। উল্টো অন্তর্ঘাত ঘটে যেতেই পারে। ঠিক যেমনটা হয়েছিল লেখক আনন্দের ক্ষেত্রে। প্রথম প্রেম নীলের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হলে বিষণ্ণতাকে দিয়ে শূন্যতা পূরণের চেষ্টা চালায় আনন্দ। আসলে কোনও কিছুর বিকল্প খুঁজে চলা মানে তো তাকেই আরো বেশি করে প্রাধান্য দেওয়া, আরো বেশি করে জীবন্ত করে তোলা। মৃত্যু ভয়ে ভীত মানুষ যেমন মৃত্যুকে অস্বীকার করতে গিয়ে, সাহসী হতে গিয়ে বারবার মৃত্যুরই কথা বলে। এ-ও ঠিক তেমন। নীলের সেই নাছোড় ছায়াই বিষণ্ণতা ও আনন্দের সম্ভাব্য সম্পর্কটাকে বিষাক্ত করে ফেলে। আনন্দ নষ্ট করে দেয় সম্পর্কটাকে। আর সেই নষ্টনীড়ের শীলমোহর লাগাতে তড়িঘড়ি একটা বিয়েও করে ফেলে। এ-ও আরেক বিকল্প। বিষন্নতাও আত্মহত্যা প্রবণতা থেকে সামলে উঠে বিকল্পের খোঁজে দেশ পালটায়, মানুষ পালটায়। কিন্তু, ‘বিকল্প’ শব্দটাই যে অর্থহীন। তাই আবার ফিরতে হয়। সংসারের প্রথাগত কাঠামো অক্ষুণ্ণ রেখে চলতে থাকে পরস্পরের নিঃশব্দ বিকল্প বেঁচে থাকা। একে অপরকে না দেখেও আঁকড়ে ধরে থাকা। আনন্দর কবিতাতেও নীল ও বিষণ্ণতার সহ-বাস। আসলে এভাবেই বেঁচে থাকা। এভাবেই টিকে থাকা। সম্পর্ক আর সম্পর্কের খোলস বদলে বদলে। অবশেষে আঠারো বছরের ব্যবধানে মুখোমুখি আনন্দ-বিষন্নতা। মরিয়া বিষণ্ণতা এই দীর্ঘ বঞ্চনা আর নিঃসঙ্গতার একটা কিছু বিনিময় চায়। একটা কিছু স্মারক চায় তাদের ভালোবাসার। একটা জীবন্ত স্মারক! সন্তানের বীজ। বিষন্নতার সঙ্গে মিশে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না বিমূঢ় বিপন্ন আনন্দের।

আবার, ‘বনপুষ্পীর অন্তর্ধান’ (বিপ্রদাশ বড়ুয়া, ‘কালি ও কলম’ মে- জুন ২০১৮, ছোটগল্প সংখ্যা) গল্পে বনপুষ্পী সম্ভবত আমাদেরই ‘অপর’ কোনও সত্তা। দৈনন্দিন যাপনে তার মুখোমুখি হওয়া যায় না। ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’- আমাদেরই কাঙ্ক্ষিত কোনও ‘অপর’ যার কাল্পনিক লিঙ্গগত ভিন্নতা আমাদের আকাঙ্ক্ষাকে আরো উদগ্র করে তোলে। নিজের মতো, অথবা আরো বেশি করে নিজের স্বপ্নের মতো স্ব বিশেষত বিপরীত লিঙ্গের মানবায়ন- ভাবাই যায় না! আর তার সঙ্গে বসবাস কিংবা সহবাস- সে তো একান্ত নিবিড় কামনার জায়গা। দিন দিন প্রতিদিন কাঠামোর প্রতি মেকি আনুগত্য নয়, মাঝে মাঝে এমন অধরা স্বপ্নগুলো যদি সত্যিই দেহ আর ইন্দ্রিয়ের পথ ধরে প্রত্যক্ষে এসে দাঁড়ায়, তাহলে প্রাত্যহিক সম্পর্কগুলোকে যে অনেক সময়ই বিলুপ্তির পথে হাঁটতে হবে। এ নিয়ে কোনও দ্বিধা নেই। আর হয়তো মানসিক ভাবে সর্বত্র সমান্তরাল হাজিরা দেওয়া সম্ভব নয় বলেই, কথকের স্ত্রীকে সাময়িক ভাবে লুপ্ত হতে হয়। নাহলে বনপুষ্পী জায়গা পাবে কীভাবে? বনপুষ্পীর আচরণ, তার রূপ-বর্ণ-গন্ধ সমস্ত কিছু যেন একান্ত চেনা। তাই সহজেই তার সঙ্গে নিবিড় হতে সাধ হয়। কামনার সলতেতে যেন সহজিয়া আগুন লেগে যায়। কিন্তু সময় দিয়ে বনপুষ্পীকে সীমাবদ্ধ না করলে তা সমস্ত মানসিক সময়কে চূড়ান্ত আগ্রাসনে গিলে ফেলবে। তাই, কষ্ট হয়, যন্ত্রণা হয়, তবুও সময় দিয়ে ঘেরা তার ক্ষণিকতা।
অস্বীকার করা যায় না লিঙ্গগত বিপন্নতাকেও। প্রত্যেক লিঙ্গেরই নিজস্ব কিছু বিপন্নতা থাকে। ‘চিত্রাঙ্গদা নয় কেউ’ গল্পে (পূরবী বসু, ‘কালি ও কলম’ মে- জুন ২০১৮, ছোটগল্প সংখ্যা) লিঙ্গান্তর ঘটানো মুকুল সেই দুই প্রথাগত লিঙ্গ আর মধ্যিখানের ধূসর space- এই তিনটেরই অবস্থান ও তার বিপন্ন লিপিমালাগুলোকে পড়তে পারে। বলা ভালো, পড়তে হয় তাকে। লিঙ্গীয় পরিচয় সমস্যায় ভুগতে ভুগতে- আত্ম ও শরীরের ক্রমিক বিচ্ছিন্নতাকে মানতে না পেরে পালটে ফেলে শরীরকে। লিঙ্গের জৈবিক পরিচিতিকে ছেঁটে কেটে বাদ দিয়ে জন্মান্তরে সুখী হতে চায়। নারীত্বের শারীরিক চিহ্নগুলোকে ছিন্ন করে শরীরে এঁকে দিতে চায় পুরুষের চিহ্নমালা। কিন্তু এখানেও সেই সমগ্র আর খণ্ডের গল্প। সে কি তার নারী অস্তিত্ত্বের সমস্তটুকুই পুরুষায়ন করতে পেরেছিল? নাকি কিছু টুকরো, কিছু খণ্ড শরীরে মনে থেকে গিয়েছিল? সম্ভবত সমগ্রের রূপান্তর সম্ভব হয়নি। হওয়া সম্ভবও নয়। দাগ ছাপ চিহ্নের খণ্ডগুলো বারবার তাকে নিরুপায় আত্মিক ফাঁদে ফেলে দেয়।
অন্যদিকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আত্মিক শূন্যতা, আর সেই শূন্যতাকে কেন্দ্র করে আত্মের মিছিমিছি চরকিপাক ক্রমে প্রকট হয়ে ওঠে ‘লজ্জাবতী বানর’ ( শাহদুজ্জামান, ‘প্রথম আলো’, ঈদ সংখ্যা, ২০১৭) গল্পে। লুইস বুনুয়েলের ‘L’Age d’Or’ চলচ্চিত্রে পরাবাস্তববাদী প্রয়োগে তথাকথিত আধুনিক বুর্জোয়াদের এই বিপর্যস্ত বিশৃঙ্খল দশা , নিষ্ঠুর আত্মপরতা নির্মম ভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ‘দূর্গের’ চূড়া থেকে এই পতন তো অনেক আগেই শুরু হয়েছে। মুখোস কিংবা মেকাপের পলেস্তারা কবেই খসতে শুরু করেছে! আত্মকে (?) প্রতিষ্ঠা করার জন্য (কোথায়? কীভাবে?) এই নির্লজ্জ লড়াই এখন আর বিস্ময় তৈরি করে না। নিখুঁত চৌর্যবৃত্তি আর নিপাট কাঠিবাজিতে লজ্জাও লজ্জা পায় এখন। আর ভাবনা চুরি? সে তো কবেই জলভাত! তবুও এখনও পলাশের মতো মানুষেরা অবাক হয়। ‘লজ্জাবতী বানর’-এর তকমাটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দিতে সাধ হয়। কর্পোরেট সেক্টরের সিঁড়ি ভাঙা অঙ্কের খেলায় তার ধারণা যখন তারই ঊর্ধতন কর্মীটি নিজের দস্তখত করে চালিয়ে দেয়, তখন শালিখের হলুদ পা ভারি হয়ে চেপে বসে বুকের উপর। সহমর্মী আলাপচারিতাটাও যে সুযোগের সন্ধানে ব্যবহৃত হবে, তা সে ভাবতেও পারে নি। এসব বদখচ বাজারি লেনদেন হজম করার জন্য তার পাকযন্ত্র তখনও তৈরি হয়নি। হয়তো হয়ে যাবে কোনও এক সময়। উঁহু, তার দিন গেছে। ওসব আগেকার দিনের ব্যাপারস্যাপার। অন্য কালের। অন্য জায়গার। ম্যামথায়িত হয়েছে।

                           

সময়ের আবর্ত ও অন্তর্ঘাত ‘বৈকালিক ভ্রমণ’ (শাহীন আখতার, ‘কালি ও কলম’ মে-জুন ২০১৮, ছোটগল্প সংখ্যা) গল্পেও। আজতেক সভ্যতার সময়পঞ্জি, শুক্র গ্রহের আবর্তন, সূরা আস্-স্বাফ্ফাত- সবই কেমন সময়ের সুতোয় বাঁধা। সাবালক ইসমাইলের প্রতি ইব্রাহিমের সংলাপও যেন সময়ের প্রবাহের প্রতিই এক অদ্ভুত দায়বদ্ধতা। ধর্মের আবরণটা যদি আলতো করে সরিয়ে রাখি, তা হলে সময় তো বারবার আমাদের উৎসের দিকে (একটু এধার ওধার হতেই পারে) আছড়ে মারে। রৈখিক কিংবা বৃত্তীয় যাই হোক না কেন, সময়ের আবর্তনে আমরা উপাদান মাত্র। ব্যক্তির মত ও গন্তব্য সেখানে নিছক খড়কুটো। অতীত ও বর্তমানের চক্রান্তে কিংবা চক্রাকার ঘোরা ফেরায় ভবিষ্যৎ হয়ে ওঠে বিপন্ন ইতিহাস। ওহী নাজেল করার মুহূর্ত কেবল অতীত নয়, বর্তমানেও হানা দেয়।

মৃত পিতার জীবিতকালে পুত্রসন্তানটি বারবার আপথে কুপথে যায়। স্বস্তি পান নি মরহুম পিতা। পুত্রের সঙ্গও পান নি। পিতার জানাজায় আসতে পারেনি মাদকাসক্তি ছাড়ানো রিহ্যাব থেকে পালানো সন্তান। কিন্তু ফিরতে তো হয়ই। সময়ই কখনও শিকারী বানায় আর কখনও শিকার বানায়। অয়দিপাউসের মতো তাকেও সময়ের দায় চোকাতেই হয়। হত্যায় নিহত শরীরের বিনিময়ে খণ্ড সময় মিশে যায় মহাসময়ের সঙ্গে। অথবা খণ্ডাকাশ মহাকাশ সব কিছুই লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। বর্তমানের চেহারায় অতীতের হানাদারি আক্রমণে প্রাণহীন হয়ে যায় ভবিষ্যৎ। পড়ে থাকে তার নিথর দেহ অনিবার্য হননের প্রবল থাবায়।

মহাসময়ের বুকে গর্ত, মহাকাশের দেহে ক্ষত আর খণ্ড চাঁদ উঠে এসেছে ‘মৃত্যুযাত্রা’ (জাকির তালুকদার, ‘কালি ও কলম’ মে-জুন ২০১৮, ছোটগল্প সংখ্যা) গল্পে। বিচ্ছিন্ন খণ্ড সময় একাকী যাপন করতে চায় ছিন্নমূল চাঁদ (‘Un Chien Andalou’ সিনেমার ছুরি দিয়ে কাটা গড়িয়ে পড়া চাঁদের মতো)। কিন্তু সেই একাকিত্বও হারিয়ে যায় বিনাশের অতল গহ্বরে। মৃত্যুর আঁধার চরাচরে। পিছুটান হয়তো থাকে। তবুও ‘চাঁদের অমাবস্যা’য় মৃত্যুযাত্রাই অনিবার্য গন্তব্য হয়ে ওঠে।
অন্যদিকে, ‘জীবনের ঘরে মৃত্যতে’ (সুশান্ত মজুমদার, ‘কালি ও কলম’ মে-জুন ২০১৮, ছোটগল্প সংখ্যা) মৃত্যুর দৃষ্টি দিয়ে জীবন অথবা জীবনের দৃষ্টি দিয়ে মৃত্যু। দৃষ্টির প্রত্যক্ষণ অথবা প্রত্যক্ষণের দৃষ্টি। যৌথ আত্মহত্যা আর একজোড়া মৃত শরীর কথোপকথন চালিয়ে যায় গল্পের আদ্যন্ত জুড়ে। সংলাপ নিজেদের মধ্যে, সংলাপ জীবিতদের সঙ্গে। প্রান্তিকের মৃত্যু প্রান্তেই আটকে থাকে না। তার উপর আত্মহনন বলে কথা।শহর তো তার বিষাক্ততাকে চালান করে দেয় মফস্বল ও গ্রামের শরীরে। ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার স্বাভাবিক নিয়মেই গ্রামের চোঁয়া ঢেকুরের নেতিবাচক আওয়াজটাও সহ্য করতেই হবে তাকে।

গ্রামের হতদরিদ্র যুবক আবদুল ও তার রুপসী যুবতী স্ত্রী অথবা স্ত্রীর মতো নারীটির যুগপৎ আত্মহনন যেন একটা key hole। ওই key hole দিয়ে জীবনের এক অন্যরূপ ধরা পড়ে। সময়ের অন্তর্ঘাতে জীবনই হয়ে যায় ঘাতক। দারিদ্র্যকে গোর দিতে দায়বদ্ধ পল্লীব্যাঙ্কের হত্তাকত্তাই হয়ে যায় গরীবের জীবন ও যৌনতার নিয়ন্ত্রক। এবং হত্যাকারীও বটে। সংবাদ- প্রশাসন- বিচার গোটা system টাই হয়ে যায় রাষ্ট্রীয় প্রহসন with happy smily। অর্থ আর যৌনতার বাধ্যতামুলক লেনদেনে অসহায় আত্মহননে পা বাড়ায় প্রান্তিক দম্পতি অথবা অদম্পতি।
আবার, ‘ভিখারিদের শহর’ (কবীর রাণা, ‘চিহ্নমেলা’, চিরায়ত বাঙলা ২০১৯) গল্পে দেখি, ‘আমি তবে ভিক্ষা হয়ে ভিক্ষার পাত্রে’। শিক্ষা, ধর্ম, দর্শন, যৌনতা সবই যখন ভিক্ষা ও ভিখারির সংলাপ মাত্র, তখন তো ভিক্ষাই একমাত্র সংস্কৃতি। ভিক্ষা সংস্কৃতিতে পণ্যায়িত হয়ে যায় আমাদের প্রত্যেকটা খণ্ড আমাদের স্কুল, কলেজ, চাকরি, প্রেম, বিবাহ, নারী, পোশাক সমস্ত কিছু। নিজের শরীরও আলাদা করে স্ব-প্রত্যক্ষণে ধরা পড়ছে না। ভিক্ষার দৌলতে, ভিক্ষার গর্জনে সমস্ত কিছুই খসে পড়ছে। নগ্ন হয়ে পড়ছে। নগ্নতা থেকে কিছুতেই আটকানো যাচ্ছে না জননেন্দ্রিয়কে। এমনকি ভয়, আনন্দ, তা-ও নগ্নতায় বিপন্ন। সবই গোরস্থানে দৌড়চ্ছে আসন্ন মৃত্যুর উদ্দেশে।

শেষপর্যন্ত যে লক্ষ্যটা নিয়ে এগোবার চেষ্টা চলছিল, প্রথম থেকে, তা হল সন্তানের কাছে পৌঁছানো। লজ্জা গ্রাস করছিল। ভিক্ষার গ্লানিতে গলগলিয়ে নেমে আসছিল অশ্রুবিন্দু, তবুও আপ্রাণ চেষ্টা উত্তরাধিকারীর কাছে পৌঁছানোর। একসময় বহু জ্যাম পার হয়ে, ভিক্ষার জ্যাম পেরিয়ে পৌঁছানো গেল বহু দূরের স্কুলে, যেখানে তার ছেলে পড়ে। কিন্তু সেখানেও সব শূন্য। কারণ তারাই বেরিয়েছে শহরে ভিক্ষা জ্যাম নির্মাণের মহৎ উদ্দেশে। ফলে কোথাও আর পৌঁছানো হল না। কেবল ভিক্ষায় শূন্য হয়ে যাওয়া এক অস্তিত্ত্ব পৌঁছালো আরেক শূন্য ভবিষ্যতে।

নির্জন এই পর্যটনের শেষে বলা যায়, এরকম বেশ কিছু সাম্প্রতিক ছোটগল্প যেন এক তীক্ষ্ণ সার্চ লাইট ফেলে আমাদের উপর। খসে পড়ে মুখ-মুখোসের বহুরূপী খেলা। থেমে যায় আরোপিত উল্লাস আর শীৎকার। পুরনো চটের মতো সশব্দে ছিঁড়ে যায় জীবন ও যাপনের যাবতীয় কৃৎ-কৌশল। কর্কট সরণির কর্কশ বাঁকে মুখোমুখি দাঁড়ায় গল্পকার ও পাঠক, আত্ম ও অপর অথবা আমাদেরই বিকল্প নির্বিকল্প সব সত্তা। বিনাশ ও বিলাসের এ এক অভিনব সাক্ষাৎকার। সময়ের ভাঁজ ভেঙে হাততালি দিয়ে ওঠে নষ্ট আত্মার মৃতদেহ। দর্শক আমরা, স্রষ্টা আমরা, ঘাতক আমরা, নিহত আমরাই। সময়ের দায় মেনে সাম্প্রতিক গল্পের এ-ও এক অনিবার্য প্রবাহ। হাজার কিসিমের আরোপিত সাজসজ্জাতেও অন্তর্লীন চোরা স্রোতটিকে অস্বীকার করা যায় না কিছুতেই। প্রথাগত গল্পচাষের বাইরে এ এক অন্যতর ফসল। কীটে দ্রষ্ট নয়, বরং বিষাক্ত দংশন আত্তীকরণ করেই অদ্ভুত এক বিচিত্র নীল ধারা। অনিরুদ্ধ আবদ্ধতায় তার জন্ম। বিষণ্ণ বিচ্ছিন্নতায় তার পথচলা। আর মৃত্যুর আর্তি গায়ে মেখে বিপন্ন তার শূন্যযাত্রা।

 

তথ্যসূত্র:
১। গিন্সবার্গ , অ্যালেন। অ্যালেন গিন্সবার্গের কবিতা।সম্পাদিত ভট্টাচার্য উৎপল। কোলকাতাঃ কবিতীর্থ, ২০১৬। ২২। মুদ্রিত।
২। পাজ, ওক্তাভিও। ওক্তাভিও পাজ প্রজ্ঞায় ও প্রতিবাদে। সম্পাদিত রায় শুক্তি, মুখোপাধ্যায় অর্পিতা, সরকার কিংশুক, ব্রহ্ম বিদুষী। কোলকাতাঃ অনুষা। ২০১৯। ২০৩। মুদ্রিত।
৩। জিঙ্ক, রুই। ভয়। অনূদিত রায় ঋতা। কোলকাতাঃ মনফকিরা, ২০১৭। ১২৪। মুদ্রিত।

গ্রন্থঋণ –
আকর গ্রন্থ
১। গিন্সবার্গ, অ্যালেন, “অ্যালেন গিন্সবার্গের কবিতা”, সম্পাদিত ভট্টাচার্য উৎপল, কবিতীর্থ, ২০১৬। মুদ্রিত।
২। জিঙ্ক, রুই। “ভয়”, অনূদিত রায় ঋতা। মনফকিরা, ২০১৭। মুদ্রিত।
৩। পাজ, ওক্তাভিও। “ওক্তাভিও পাজ প্রজ্ঞায় ও প্রতিবাদে”, সম্পাদিত রায় শুক্তি, মুখোপাধ্যায় অর্পিতা, সরকার কিংশুক, ব্রহ্ম বিদুষী। অনুষা। ২০১৯।মুদ্রিত।

পত্রিকা
১। ‘অন্যদিন’ (ঈদসংখ্যা) মাসুম রহমান (সম্পা), ঢাকা, ২০১৮। মুদ্রিত।
২। ‘কালি ও কলম’ ( ১৫তম বর্ষ ৪-৫ম সংখ্যা ছোটগল্প সংখ্যা), আবুল হাসনাত (সম্পা.), ঢাকা, ২০১৮।মুদ্রিত।
৩। ‘কালি ও কলম’ (১১তম বর্ষ ১ম সংখ্যা )আবুল হাসনাত(সম্পা.), ঢাকা, ২০১৪ ।মুদ্রিত।
৪। ‘চিহ্ন’ (৩৭ তম সংখ্যা), শহীদ ইকবাল(সম্পা.), রাজশাহী, ২০১৯। মুদ্রিত।
৫। ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ (আষাঢ়, ঈদ সংখ্যা), তাসমিমা হোসেন (সম্পা), ঢাকা, ২০১৫ । মুদ্রিত।
৬। ‘প্রথম আলো’(জৈষ্ঠ্য- আষাঢ়, ঈদসংখ্যা), মতিউর রহমান (সম্পা.), ঢাকা, ২০১৭। মুদ্রিত

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত