পদসঞ্চার (পর্ব-১৩)
৫ এপ্রিল । রবিবার । রাত ৯-৩০
একটু আগে রাত ঠিক ৯ টা্য় এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখা হল।
অন্ধকার ঘর থেকে ধীরবিলম্বিত লয়ে হাতে প্রদীপ নিয়ে বেরিয়ে আসছেন এক প্রৌঢ়। তাঁর গলায় উত্তরীয়। তিনি এগিয়ে এসে প্রদীপদানের প্রদীপগুলিকে আলোকিত করে দিলেন। পেছন থেকে ভেসে আসছিল সংস্কৃত স্তোত্র। গম্ভীর পরিবেশ।
এই মানুষটি আমাদের প্রধানমন্ত্রী। ইনি আগেই ডাক দিয়েছিলেন দেশবাসীকে। বলেছিলেন ৫ তারিখে রাত ঠিক ৯ টায় ৯ মিনিট ধরে ঘরের ইলেকট্রিক বাতি নিভিয়ে জ্বালবেন প্রদীপ বা মোমবাতি। এসব না থাকলে মোবাইল ফোনের আলো ফেলবেন। দেখলাম আমাদের আশপাশের অনেক বাড়িতে ৯ টার সময় ইলেকট্রিক আলো নিভে গেল। জ্বলে উঠল মোমবাতির আলো। আমাদের সামনের পূর্বাশা ফ্ল্যাটের রেলের বড় অফিসার নন্দীবাবু তাঁর স্ত্রী, পুত্র ও পুত্রবধূকে নিয়ে বারান্দা্য় দাঁড়িয়ে মোবাইলের আলো ফেলতে লাগলেন। রাত ৯টা ৯ মিনিটের পরে শুরু হল শব্দবাজির ধূম। যেন ফিরে এল দেওয়ালির রাত।
করোনা যে অন্ধকার ডেকে এনেছে, তাকে বিতাড়িত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী মোমবাতি জ্বালাবার ডাক দিয়েছেন। এ ব্যাপারে বিশ্বের ইতিহাসে লেখা থাকবে তাঁর নাম । এরকম অভিনব পরিকল্পনা পৃথিবীর আর কোন প্রধানমনত্রীর মাথায় আসে নি। আমার স্ত্রী প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত হবার সুযোগ পায় নি। অনুপ যখন তাকে মোমবাতি জ্বালানোর কথা বলল, তখন সে বলল, ‘এতে কি হবে?’ আমার মনে হল, নন্দীবাবু বা তাঁর মতো শিক্ষিত মানুষদের মনে কেন জাগল না এই প্রশ্ন? মোমবাতি জ্বালানোর পরে বাজি-পটকার উপযোগিতা নিয়ে কেন সন্দেহ জাগল না তাঁদের ? কেন কর্তার ইচ্ছায় কর্ম করার দাসত্ব থেকে মুক্তি পেলাম না আমরা?
আমার মনে পড়ে গেল রবীন্দ্রনাথের ‘সত্যের আহ্বান’ প্রবন্ধটার কথা। গান্ধিজির প্রতি অমেয় শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও তাঁর ‘চরকা কাটো, সুতা গোন’ আহ্বানকে রবীন্দ্রনাথ মেনে নিতে পারেননি, যেমন পারেননি বস্ত্রবর্জনের আহ্বানকে মেনে নিতে। রবীন্দ্রনাথ যুক্তি-বুদ্ধির উপর আস্থা রেখেই প্রশ্ন তুলেছিলেন ‘ ইহা কি মন্ত্রবলে সন্ন্যাসীর সোনা ফলাইবার ব্যাপার?’
কিন্তু ঠিক ৯টায় কেন আলো জ্বালানো ? আর ঠিক ৯ মিনিটই বা কেন জ্বলবে আলো?
আমার বন্ধু পার্থপ্রতিম ঘোষ বলল প্রধানমন্ত্রী প্রকারান্তরে দেশবাসীকে দিয়ে বি জে পির জন্মদিন পালন করিয়ে নিলেন। প্রধানমন্ত্রীর এই উদাত্ত আহ্বানকে সমালোচনা করেছেন অনেকে। আবার তাঁর দলের অনেক নেতা-সমর্থকরা এই আহ্বানের ইতিবাচক দিক দেখতে পেয়েছেন। সেগুলি খুবই কৌতূহলোদ্দীপক । যেমন একজন বলেছেন : ৫ এপ্রিল বামনদ্বাদশীতে পৃথিবী সবচেয়ে বেশি সূর্যালোক পায়, তাতে ভাইরাস সক্রিয় হয়, আলো ছুঁড়ে মারলে খতম হয় ভাইরাস। তাই প্রধানমন্ত্রী বড় আলো নিভিয়ে ফোকাসড আলোর কথা বলেছেন। সেই আলোয় করোনাভাইরাসের হৃদপিন্ড ভেঙে পড়বে । আর একজন বলেছেন, করোনাভাইরাস হঠাৎ-অন্ধকার আর হঠাৎ-আলোর ঝলকানির সঙ্গে এঁটে উঠতে অপারগ। তাই ৫ তারিখে হঠাৎ-আঁধারে প্রথম ধাক্কাটা খাবে করোনাভাইরাস, পরক্ষণেই আচমকা আলোকের ঝরনাধারায় তাদের রেটিনা নার্ভ বিপন্ন হবে এবং করোনা নিশ্চিহ্ন হবে যাবে। আর একজন প্রাজ্ঞ সমর্থক বলেছেন, করোনাভাইরাস বেশি তাপমাত্রায় বাঁচতে পারে না ; ১৩০ কোটি মোমবাতি একসঙ্গে জ্বালালে তাপমাত্রা ৯ ডিগ্রি বেড়ে যেতে পারে, ফলে করোনাভাইরাস নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
৯-৯এর খেলা এখন থাক। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা শুনে বিদ্যুৎকর্তাদের ঘুম ছুটেছে। তাঁদের প্রশ্ন প্রচণ্ড গতিতে চলতে থাকা গাড়িতে ব্রেক কষলে যেমন হয় তেমন হবে না তো ! এর ফলে গ্রিড বিপর্যয় হবে না তো! অন্ধকারে ঢেকে যাবে না তো সারা দেশ!
কিন্তু যে মানুষটি করোনার অন্ধকার থেকে দেশবাসীকে আলোয় নিয়ে যেতে চান, তিনি এর আগে কি কি পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা দেখা যাক।
ভারতে প্রথম করোনা আক্রান্তের তারিখ ৩০ জানুয়ারি। সরকারের কোন উচ্চবাচ্য নেই। ১২ ফেব্রুয়ারি কংগ্রেসনেতা রাহুল গান্ধি সরকারকে সতর্ক করলেন। এরকম সতর্কতা বোধহয় এ দেশে প্রথম। রাহুল বললেন, ‘ The Coronavirus is an extremely serious threat to our people and our economy . My sense is the Govt. is not taking this threat seriously . Timely action is critical’ . সরকার করোনার ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না, এটাই রাহুলের অভিযোগ। অভিযোগটা যে সঠিক তা সময়ই বলে দিয়েছে।
উহানের সংক্রমণের ঘটনাটি অনেক দেরিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে জানিয়ে যে ভুল করেছিল চিন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সংক্রমণের গুরুত্ব সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে অনেক দেরিতে সতর্ক করে যে ভুল করেছিল, ইতালি-স্পেন-ফ্রান্স-আমেরিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সতর্কতাবার্তাকে গুরুত্ব না দিয়ে যে ভুল করেছিল, সেই একই ভুল করলেন আমাদের সরকার। রাহুল যখন সংসদে সরকারকে সতর্ক করছেন, তখন তাকে বালসুলভ চাপল্য বলে মনে করেছেন অনেকে। এমন কি সরকার পক্ষের একজন পরিহাস করে রাহুলকে নাকি বলেছিলেন, ‘ রাহুলবাবা, তুমি তোমার মামার বাড়ির ( ইতালি) কথাই চিন্তা করো, ভারতের কথা ভাবতে হবে না।’
সংসদের অধিবেশনে করোনা প্রসঙ্গ উঠেছে। রাজ্যসভায় ২৭ টি ও লোকসভায় ২৩ টি প্রশ্ন করা হয়েছে। কিন্তু সেসব প্রশ্নকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। শিবসেনা বলেছে প্রধানমন্ত্রী একদিকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলছেন, অন্যদিকে সংসদ চালু রাখছেন। তৃণমূল কংগ্রেস ১২ মার্চ থেকে সংসদ বন্ধ রাখতে বলেছে, অবশেষে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ২২ মার্চ থেকে তাঁদের সাংসদরা চলে আসবেন দিল্লি থেকে।
এরই মধ্যে মধ্যপ্রদেশে চলেছে সরকার ভেঙে সরকার গড়ার খেলা। এ নিয়ে মামলা হয়েছে। বি জে পি সরকার মামলার রায়ের জন্য অপেক্ষা করেছেন। ইতিমধ্যে করোনা যে তার থাবা বসাতে শুরু করে দিয়েছে, তা দেখেও দেখেন নি। ২৩ মার্চ তাঁদের মনোনীত প্রার্থীকে মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পদে বসিয়ে সেদিন রাতে প্রধানমন্ত্রী লকডাউন ঘোষণা করলেন।
করোনা যে বিদেশ থেকে এরোপ্লেনে উড়ে উড়ে ভারতে আসছে সেটা কি জানতেন না তাঁরা? ১৯ মার্চ সরকার অস্ট্রেলিয়া, বুলগেরিয়া, ক্রোয়েশিয়া, সাইপ্রাস, চেক রিপাবলিক, ডেনমার্ক, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, আইসল্যান্ড, হাঙ্গেরি, আর্য়াল্যান্ড, ইতালি, লাটভিয়া, লিচস্টেনটিন, লিথুয়ানিয়া, লুক্সেমবুর্গ, মাল্টা, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, ইংল্যান্ড- এসব দেশ থাকে বিমানযাত্রীদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন।
কিন্তু ততদিনে যা সর্বনাশ হবার হয়ে গেছে। রক্তপায়ী ড্রাকুলা যেমন কফিনবাহিত হয়ে পেনসিলভেনিয়া থাকে জাহাজে ইংল্যান্ড পৌঁছে গিয়াছিল, তেমনি করোনা পনেরো লক্ষ যাত্রীর শরীরাভ্যন্তরে লুক্কায়িত থেকে ঢুকে পড়েছে ভারতবর্ষে। ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের দুই সপ্তাহে ভারতে ঢুকে পড়েছেন ১৫ লক্ষ বিমানযাত্রী। তাঁদের সবার শরীরে যে করোনা ছিল, তা নয়, কিন্তু অনেকেরই ছিল।
তারপরে আরেক কান্ড।
দিল্লির নিজানুদ্দিনের তবলিগি জামাতের জমায়েত। লকডাউনের আগে থেকে জমায়েত হচ্ছিল। বহু বিদেশি সে জমায়েতে অংশগ্রহণ করেন। ছিলেন মায়নামার, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, তাইল্যান্ডের প্রতিনিধি। যাঁরা জমায়েতে ছিলেন তাঁদের অনেকেরই করোনা টেস্ট পজিটিভ ধরা পড়েছে, কেউ কেউ মারাও গিয়েছেন। এঁরা আমাদের দেশের ও বিদেশের যেসব মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করেছেন, তাঁদের অনেকে করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন । আমাদের দেশের যেসব রাজ্য থেকে এই জমায়েতে মানুষ গিয়েছিলেন তার হিসেব এইরকম : দিল্লি= ২৩৬১, তেলেঙ্গানা= ১০০০, উত্তরপ্রদেশ= ৫৬৯, হরিয়ানা= ৫০৩, মহারাষ্ট্র= ২৫২, অসম= ৪১৩, কর্নাটক= ৩৪২, কেরল= ২৭৭, তামিলনাড়ু= ১৫০০, মধ্যপ্রদেশ= ১০৭, ছত্তীসগড়= ১০১, গুজরাট= ১৫০০, বিহার= ৮১, জম্মু-কাশ্মীর=৩০০, উত্তরাখন্ড= ৪৮, মণিপুর= ৮৫, মেঘালয়=৭, অরুণাচল= ১, ওড়িশা= ২১, পশ্চিমবঙ্গ= ৭১। কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেট জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত ৩০০ জন তবলিগি প্রতিনিধি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ২জন বিদেশি প্রতিনিধি মারা গেছেন। আরও ২১ জনের দেহে সংক্রমণ ধরা পড়েছে। দেশীয় প্রতিনিধিদের মধ্যে মারা গেছেন ৯ জন ; ১০৬ জনের লালারসের নমুনার রিপোর্ট পজিটিভ। এখনও দেশের বহু প্রতিনিধিকে সনাক্ত করা যায় নি । তাঁদের দ্বারা আরও কতজন সংক্রমিত হবেন কে জানে! এই প্রসঙ্গে জহর সরকার একটি সঙ্গত প্রশ্ন তুলেছেন, ‘ আমরা যখন তবলিঘি কর্তাদের বেপরোয়া আচরণের নিঃসন্দেহে ধিক্কার জানাচ্ছি, তখন কেউ কিন্তু একবারও প্রশ্ন তুলছি না , ঠিক ওই সম্মেলনের সময় সারা দেশে অন্যান্য ধর্মের সভা বা উৎসব বহাল তবিয়তে চলার ব্যাপার ।’ অন্যান্য ধর্মের উৎসবের কয়েকটি বিবরণ দিয়েছেন তিনি : ১. হিন্দু মহাসভার নেতা ও সদস্যরা কয়েকটি জায়গায় লোক জড় করে গোমুত্র পানের কর্মসূচি পালন করা, ২. উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর রামলালার মূর্তি স্থাপনের সভায় অযোধ্যায় মানুষের জমায়েত, ৩. পঞ্জাবের নওয়ান শহরে শিখদের বিশাল ধর্মমেলা।
প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন লকডাউন। দেশের মানুষকে প্রস্তুতির সময় দেওয়া হল না। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস মানুষ কিভাবে পাবেন, তার কোন নির্দেশিকা নেই। এক রাজ্যের শ্রমিক কাজ করেন আর এক রাজ্যে, তাঁরা ফিরবেন কি করে, না ফিরতে পারলে তাঁদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা কি হবে, তাঁদের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলি নেবে কিনা,- এসব প্রশ্নের সদুত্তর প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে ছিল না । তারপরে আমরা দেখলাম অভুক্ত, অসহায় শ্রমিকদের ঘরে ফেরার আকুলতা ও উদ্বেগ, বাস টার্মিনাসে ভিড়, সংক্রমণের প্রগাঢ় সম্ভাবনা।
[ক্রমশ]
আগের সবগুলো পর্ব ও লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে ক্লিক করুন।

গবেষক