| 20 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক সময়ের ডায়েরি

পদসঞ্চার (পর্ব-২০)

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

২৮  এপ্রিল । মঙ্গলবার

নমো হে নমো, নমো হে নমো। নমো হলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। মাঝে মাঝে তিনি অমৃতবাণী বর্ষণ করে থাকেন। দেশের অনুগত জনতা উৎসাহিত হয়। কাল তিনি বলেছেন, ‘সভ্য জীবনের অঙ্গ হবে মাস্ক’। বাইরে বেরুলেই পরে নিতে হবে সেটা। জাপানিদের মতো। মাস্কও একধরনের মুখোশ। রাজনীতিবিদরা সর্বদাই এই মুখোশ পরে থাকেন। এবার আমজনতাও পরবে মুখোশ। লকডাউনেতো পরবেই। এমন কি লকডাউন উঠলেও পরে থাকবে। মাস্ক না থাকলে ক্ষতি নেই। গামছা বা তোয়ালে্ হলেও চলবে।

এর থেকে বোঝা যাচ্ছে করোনা ভাইরাস কমলির মতো। সে ছোড়েগা নেহি। সহজে রেহাই দেবে না মনুষ্য প্রজাতিকে। প্রতিষেধক তৈরি হলে তাকে ছাড়ানো যেত। কিন্তু প্রতিষেধক বিশ বাঁও জলে। দেখতে দেখতে আমাদের দেশেও করোনা জাঁকিয়ে বসছে । মোট আক্রান্ত ২১৭০০ , মৃত ৬৮৬, সুস্থ ৪৩২৪। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত যে সব রাজ্যে তাদের আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা এইরকম = মহারাষ্ট্র- ৫৬৫২ +২৬৯, গুজরাট- ২৪০৭ + ১০৩, দিল্লি- ২২৪৮ +৪৮, রাজস্থান- ১৮৯০ +২৭, তামিলনাড়ু-১৬২৯ +১৮, উত্তরপ্রদেশ-১৫০৯ + ২১, তেলেঙ্গানা- ৯৬০ + ২৪, অন্ধ্রপ্রদেশ-৮৯৫ + ২৭, পশ্চিমবঙ্গ- ৪৫৬ + ১৫।

সারা পৃথিবীতে করোনার প্রতিষেধক তৈরির কাজ চলছে। এরজন্য প্রায় ১৫০ টি প্রকল্প চালু। এদের মধ্যে আবার পাঁচটি প্রকল্পে মানব দেহে প্রতিষেধক প্রয়োগের কাজ চলছে। এগিয়ে রয়েছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। গত ২৩ এপ্রিল তাঁরা ১৮ থেকে ৫৫ বছরের ৫১০ জন স্বেচ্ছাসেবকের দেহে এই প্রতিষেধক প্রয়োগ  করেছেন প্রথম ডোজ। এই প্রকল্পের রিসার্চ ডিরেক্টর সারা গিলবার্ট প্রতিষেধক সম্পর্কে খুব আশাবাদী।

গত ১৬ মার্চ চিনের আ্যাকাডেমি অফ মিলিটারি মেডিকেল সায়েন্স হংকং-এর একটি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে হাত মিলিয়ে সে দেশের মানব শরীরে করোনা প্রতিষেধক প্রয়োগ করেছিল। ওই একই দিনে আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সও মানব শরীরে প্রতিষেধক প্রয়োগ করে। তার কিছু দিন পরে, ৬ এপ্রিল,  আমেরিকার সান ডিয়েগোর এক বেসরকারি গবেষণা সংস্থাও মানব দেহে প্রতিষেধক প্রয়োগ করে। ভারতেও সে প্রচেষ্টা চলছে। করোনার ভ্যাকসিন তৈরির উদ্দেশ্যে জৈব প্রযুক্তি দফতরে ৫০০ প্রস্তাব জমা পড়ে। তার মধ্যে ১৬ টি সংস্থাকে বেছে নিয়েছেন সরকার । তাদের গবেষণার জন্য অর্থ সাহায্য মঞ্জুর করবেন। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চের বিজ্ঞানী জানিয়েছেন, ভারতে পাওয়া গেছে তিন ধরনের নোভেল করোনাভাইরাস। যে ভাইরাসের স্ট্রেনটি ভারতে বেশি পাওয়া যাবে, তার ভিত্তিতে তৈরি হবে প্রতিষেধক।

কিন্তু যে কোন প্রতিষেধককেই কার্যকারিতা বুঝতে ন্যূনতম সময় দরকার। তাড়াহুড়ো করে লাভ নেই। সার্স ও মার্সের প্রতিষেধকের কথা আমাদের মনে আছে। সার্সের সংক্রমণ দেখা দিয়েছিল ২০০২ সালে। আর মার্সের সংক্রমণ দেখা দিয়েছিল ২০১২ সালে। এই দুই রোগের প্রতিষেধক এখনও রয়েছে গবেষণার স্তরে। তাহলে এত তাড়াতাড়ি কি করে কোভিদ-১৯ এর প্রতিষেধক তৈরি হয়ে যাবে! তার জন্য অতিক্রম করতে হবে অনেক ব্যর্থতার স্তর। এই যেমন রেমডেসিভিয়ারের ব্যর্থতা।

রেমডেসিভিয়ার নিয়ে ব্যর্থ হয়েছে চিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটে কিছুক্ষণের জন্য ভেসে উঠেছিল চিনের গবেষণা ব্যর্থ হওয়ার একটি রিপোর্ট। তারপরে তড়িঘড়ি তা ওয়েবসাইট থেকে মুছে ফেলা হল। চিনের ব্যর্থতা কি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশ্যে আনতে চান না? কেন? তাহলে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে এই সংস্থাকে চিন-ঘেঁষা বলেন, তা কি সত্য?

মুছে-ফেলা সেই রিপোর্টটি দেখা যাক। চিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালটিতে ২৩৭ জন রোগী যুক্ত ছিলেন। ১৫৮ জনের উপর প্রয়োগ করা হয় রেমডেসিভিয়ার। ৭৯ জন ছিলেন কন্ট্রোল গ্রুপে। প্রথম ১৮ জনকে রেমডেসিভিয়ার দেওয়ার পরে তাঁদের শরীরে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। কিছুদিন পরে দেখা যায়, রেমডেসিভিয়ার দেওয়া হয়েছিল এমন রোগীদের ১৩.৯% জনের মৃত্যু হয়েছে।

আমেরিকায় করোনা মৃত্যুর সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এমন অবস্থায় সেখানকার প্রেসিডেন্ট একটু বেপরোয়া হয়ে  উঠেছেন। এর আগে তিনি আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন গরম পড়লেই ভাইরাসবাবাজি রণেভঙ্গ দেবে । তারপরে দেখা গেল গরম বা আদ্রতার সঙ্গে করোনার কোন লেনাদেনা নেই। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, তাইল্যান্ড, ভারতে তার বাড়-বাড়ন্ত তার প্রমাণ। তখন ট্রাম্প বলে বসলেন, ‘ শরীরে জীবাণুনাশক ইনজেক্ট করে ফুসফুস সাফ করে দিলেই হবে। জোরালো আলো শরীরে ঢুকিয়েও তো করোনা সাফ করা যায়’। যখন ট্রাম্প দেখলেন তাঁর বক্তব্য নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে তখন তিনি জানালেন যে তিনি একটু মজা করছিলেন। সময় বটে মজা করবার!

এখনও পর্যন্ত ভাইরাসটির ১১ টি টাইপ জানা গিয়েছে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ বায়োমেডিক্যাল জেনোমিক্সের দুই বাঙালি বিজ্ঞানী নিধানকুমার বিশ্বাস ও পার্থপ্রতিম মজুমদার ১১টি টাইপের মধ্যে সবচেয়ে সংক্রামক টাইপটিকে সনাক্ত করতে পেরেছেন। সার্স –কোভ-২ হল আরএনএ ভাইরাস। এই জিনোমের গঠনে সামান্য অদল-বদল ঘটে গিয়েই ভাইরাসটি সংক্রমণের ভিন্ন চেহেরা নিচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে তার সংক্রমণের ক্ষমতা। নিজেদের টিকে থাকার জন্যই তাদের এই লড়াই।

দুই বাঙালি বিজ্ঞানী গোটা পৃথিবী থেকে পাওয়া ভাইরাসটির আরএনএ সিকোয়েন্সের উপর নজর রাখছিলেন তীক্ষ্ণভাবে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের ৬ এপ্রিল পর্যন্ত বিশ্বের ৫৫ টি দেশের ৩৬৩৬ জন করোনাআক্রান্ত রোগীর দেহ থেকে ভাইরাস নমুনার আরএনএ সিকোয়েন্স নিয়ে গবেষণা করেন তাঁরা ল তাঁরা দেখতে পান, অন্যান্য ভাইরাসের মতো এই ভাইরাসও বদলেছে নিজের চেহেরা। এখনও পর্যন্ত যে ১১ ধরনের ভাইরাসের সন্ধান পাওয়া গেছে তা হল : ‘ও’, ‘এ২’, ‘এ২এ’, ‘এথ্রি’, ‘বি’, ‘বি১’ ইত্যাদি । চিনে প্রথম সংক্রমণ ঘটেছিল। সেও সংক্রমণ ঘটিয়েছিল ‘ও’ ভাইরাস। সেটিকে মূল ভাইরাস বলা যায়। রসিকতা করে বাবা-ভাইরাসও বলা যায়।

পার্থপ্রতিম মজুমদার বলেছেন, “ অবাক করা বিষয়, বেশির ভাগ ভৌগোলিক এলাকাতেই দেখা যাচ্ছে দখল নিয়েছে নোভেল করোনাভাইরাসের ‘এ২এ’ । ‘এ২এ’ –এর অস্তিত্ব প্রথম ধরা পড়ে ২৪ জানুয়ারি। মার্চ মাসের শেষের মধ্যে মোটামুটি অন্য সবাইকে সরিয়ে দিয়ে এরাই ৬০% দেশে সংক্রমণ ছড়িয়েছে।”

ইউরোপ-আমেরিকায় সব চেয়ে বেশি দেখা যায় এই ‘এ২এ’ কে। ভারতে এটি ইউরোপ-আমেরিকা থেকে এসেছে। চিন থেকে এসেছে ‘ও’, আর ইরান থেকে এসেছে ‘এথ্রি’। ‘ও’-এর চেয়ে ‘এ২এ’ বেশি শক্তিশালী, তার প্রমাণ ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, আমেরিকায় তার ধ্বংসলীলা।

সার্স-কোভ-২ তার চরিত্র অনুষায়ী মানুষের ফুসফুসে ঢুকে সংক্রমণ ছড়ায়। ভাইরাসটির স্পাইকে থাকা প্রোটিন মানুষের ফুসফুসে থাকা ‘এসিই২’ প্রোটিনকে কাজে লাগিয়ে কোষের উপরিভাগে জুড়ে যায় । এরপরে ফুসফুসে উপস্থিত অন্য একটি প্রোটিন তাকে কোষের ভিতরে প্রবেশের ছাড়পত্র দেয়। ‘এ২এ’-এর ক্ষেত্রে তার স্পাইকে থাকা আ্যমিনো আ্যাসিডটি ‘আ্যসপারটিক আ্যাসিড’ থেকে বদলে পরিণত হব ‘গ্লাইসিনে’। ফলে ভাইরাসের সংক্রমণ ক্ষমতা আরও বেড়ে যায়।

এইরকম অবস্থায়, ভাইরাসের এত পরিবর্তনের ফলে ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধক তৈরি করা খুবই কষ্টকর। তবে মৃত্যুর পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যাচ্ছে যে সেক্ষেত্রে ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে আফ্রিকা ও দঃ এশিয়ার দেশগুলির পার্থক্য আছে। তার মানে ইউরোপ বা আমেরিকায় কোভিদ-১৯ যেপথে চলেছে, আফ্রিকা ও দঃ এশিয়ার দেশগুলি সেই কক্ষপথের প্রারম্ভিক বিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে।

প্রতি এক কোটিতে আমেরিকা ও ইউরোপে মৃত্যুর হার এইরকম: স্পেনে ৪৯৬০, ইতালিতে ৪৪১০, ব্রিটেনে ৩০৫০, সুইডেনে ২১৭০, আমেরিকায় ১৬৭০ আফ্রিকা ও দঃ এশিয়ায় সে ছবি এরকম : ভারতে ৬, বাংলাদেশে ৯, শ্রীলঙ্কায় ৩, পাকিস্তানে ১০, কেনিয়ায় ৩, তানজানিয়ায় ২, নাইজেরিয়ায় ২ , ইথিওপিয়ায় ০.৩।

অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বলেছেন : ইতিহাস আমাদের একটা কথা শিখিয়েছে- যুদ্ধ বা অতিমারির মতো বিপর্যয়ে বহুদেশেরই অর্থনৈতিক গতিপথ সম্পূর্ণ পাল্টে যেতে পারে। এতদিন যারা জিতছিল, তারা চলে যেতে পারে পরাজিতের দলে। আবার, হেরোরা হয়ে উঠতে পারে নতুন বিজেতা। এই অনিশ্চয়তা আছেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে ; অর্থনীতি যাতে যতদূর সম্ভব ঠিকঠাক চলে তা নিশ্চিত করতে হবে; দেখতে হবে সাধারণ মানুষ যেন অনাবশ্যক কষ্ট না পায়। এই মুহুর্তে প্রধানতম সমস্যাগুলোর মধ্যে একটা হল, ভাইরাসের সংক্রমণরোধের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ এবং অর্থনীতিকে চালু রাখার মধ্যে একটা ভারসাম্য বজায় রাখতে পারা। ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বোঝা কিছুতেই দেশের গরিব মানুষ, শ্রমিক ও অভিবাসী কর্মীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। তার মানে ভাইরাসের বিরুদ্ধে যেমন যুদ্ধ চালাতে হবে, তার সংক্রমণকে যেমন প্রতিরোধ করতে হবে, তেমনি দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে হবে ধ্বংস থেকে। শ্রীবসু চমৎকার করে বলেছেন, ‘তর্কটা আসলে জীবন বনাম অর্থনীতির নয়, তর্কটা হল জীবন বনাম জীবনের।’

 

 

 

 

 

[ক্রমশ]

 

 

আগের সবগুলো পর্ব ও লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে ক্লিক করুন।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত