পদসঞ্চার (পর্ব-২৩)
৮ মে, শুক্রবার
আজ পঁচিশে বৈশাখ। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন। রবীন্দ্রের জন্মদিনকে বাঙালি বারোমাসের তেরো পার্বণ করে নিয়েছে। এই দিনে কত অনুষ্ঠান, কত গান, কত নাটক, কত নৃত্য, কত ভাষণ। এবার সেসব বন্ধ। দু-চারটি জায়গায় ‘ভার্চুয়াল’ অনুষ্ঠান হচ্ছে বটে, তবে সেসব জমছে না। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার নির্দেশ আছে। অস্তিত্বরক্ষার জন্য সে নির্দেশ না মেনে উপায় নেই। তা না হলে অদৃশ্য এক অণুজীব টুক করে ঢুকে পড়বে আমাদের নাক ও মুখের ছিদ্র দিয়ে।
এ হল এক ভাইরাস। সার্স-কোভ-২।
আজ পঁচিশে বৈশাখে ভাইরাসের কথা কেন! তথাকথিত রবীন্দ্রভক্তরা আমার কথা শুনে মুখ বেঁকাবেন নিশ্চয়ই। তাঁদের কাছে রবীন্দ্রনাথ ‘দাড়িওয়ালা সাধু’, ‘গুরুদেব’ ইত্যাদি। গুরুবাদী এই দেশে ভক্তের অত্যুক্তি বড় বিভ্রান্তি ঘটায়। রবীন্দ্রনাথও সেটা জানতেন। পূজার ছলে মানুষটিকে ভুলে থাকার কথা। আমি তেমন রবীন্দ্রভক্ত নই। তাই রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে আমি ভাবছি সেই ভাইরাসের কথা যে কিনা ‘সভ্যতার সংকট’ সৃষ্টি করেছে। সংকট থেকে মুক্তির কোন সূত্র কি রবীন্দ্রনাথের কোন লেখায় আছে? আমি আজ খুঁজে বেড়াচ্ছি সেই সূত্র।
আজকের হিসেবে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে পৃথিবীর ৩৮৮৭৯৪০ জন মানুষ। মৃত্যু হয়েছে ২৬৯০০২ জনের। ভারতে আক্রান্ত ৫২৯৫২ জন, মৃত ১৭৮৩ জন।
মানুষের জন্মের আগেই পৃথিবীতে এসেছে ভাইরাস। বোধহয় ৫০ লক্ষ বছর আগে। আজও পৃথিবীতে বহাল তবিয়তে আছে ১০০০-এর বেশি প্রকৃতির ভাইরাস। প্রকৃতিদত্ত প্রতিরোধ শক্তি দিয়ে মানুষ তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এসেছে। তবে গত শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে মারণ ভাইরাসের লীলাখেলা বেড়েছে। আজকের করোনা ভাইরাস তাদেরই জাতভাই। মেঘনাদ ইন্দ্রজিতের মতো আড়ালে থেকে সে বিস্ময় বিমূঢ় করে তুলেছে বিদ্যাদিগগজ মানুষকে। ক্ষণে ক্ষণে বদলে ফেলছে তার রূপ। চিনে একরকম তো ইতালিতে আরেক রকম। এ দেশে আবার তার ভেক বদল।
যদি মেনেও নিই যে চিনের উহানের গবেষণাগারে মানুষের হাতে জন্ম হয়নি এই ভাইরাসের, তবু বলতে হবে এর উদ্ভব ও বিস্তৃতির জন্য দায়ী মানুষই। নির্বিচারে বন ও গাছ কেটে ফেলে মানুষ বিপন্ন করে তুলেছে বন্য প্রাণীদের। মানুষের সঙ্গে তাদের স্বাভাবিক দূরত্বের সীমারেখা যাচ্ছে মুছে। বন্য প্রাণীর শরীরের ভাইরাস ঢুকে যাচ্ছে মানুষের শরীরে। যাকে বলে জুনোটিক সংক্রমণ। জিকা, ইবোলা, মার্স ও সার্স ভাইরাসের ক্ষেত্রে এমনটাই হয়েছে।
প্রকৃতি-বিযুক্ত ও প্রকৃতি-বিরুদ্ধ এই মনোভাব আহ্বান করে এনেছে মানুষের নানা দুর্যোগ ও বিপর্যয়। এই মনোভাব প্রাচ্যের নয়, পাশ্চাত্যের। বাইবেলের জেনেসিসে মানুষকে প্রভু ও প্রকৃতিকে দাস বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মধ্যযুগে টমাস আ্যকুইনিসের মতো দার্শনিক এই ভাবনাকে আরও দৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপন করেন। খ্রিস্টধর্মের প্রচারক ও দার্শনিকরা এই ভাবনাকে ইউরোপীয় ঐতিহ্যের মধ্যে সংশ্লিষ্ট করে দিয়েছিলেন। কান্ট ও হেগেলের মতো দার্শনিকরাও তার প্রভাব অতিক্রম করতে পারেন নি। প্রকৃতির উপর মানুষের আধিপত্য ও প্রভুত্ব, তাঁদের মতে, ঈশ্বরের অভিপ্রেত। ষোড়শ শতকে দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকনও প্রকৃতি সম্পর্কে এই দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও সমৃদ্ধ করেন। এর ফলে জন্মেছে ভোগবাদী জীবন দর্শন। মানুষের লোভ ও ভোগকে তৃপ্ত করার জন্য প্রকৃতিকে নির্বিচারে ধর্ষণ ও শোষণ করেছে উনিশ ও বিশ শতকের ধনতান্ত্রিক সভ্যতা।
প্রাচীন ভারতে কিন্তু প্রকৃতি সম্পর্কে একটা holistic বা সর্বাত্মক দৃষ্টি ছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘তপোবন’ প্রবন্ধে এই ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করে লিখেছেন: ‘ যেখানে প্রাচীন আর্য ঋষিরা বাস করতেন, সেখানে বিশ্বব্যাপী বিরাট জীবনের সঙ্গে তাঁদের জীবনের অবারিত যোগ ছিল। তাঁদের প্রতিদিনের কর্ম, অবকাশ ও প্রয়োজনের সঙ্গে প্রকৃতির আদানপ্রদানের জীবনময় সম্পর্ক ছিল। এই উপায়েই নিজের জীবনকে তাঁরা চারিদিকের একটি বড় জীবনের সঙ্গে যুক্ত জানতে পেরেছিলেন। চতুর্দিককে তাঁরা শূন্য নির্জীব বলে জানতেন না। বিশ্বপ্রকৃতির ভিতর দিয়ে আলোক বাতাস অন্নজল প্রভৃতি যে সব দান তাঁরা গ্রহণ করেছিলেন, সেই দানগুলি যে মাটির দান নয়, শূন্য আকাশের দান নয়—একটি চৈতন্যময় অনন্ত আকাশের মধ্যেই তার মূল প্রস্রবণ, এইটিই তাঁরা একটি সহজ অনুভবের দ্বারা জানতে পেরেছিলেন।’
প্রাকৃতিক উপাদান- পঞ্চভূত থেকে প্রাণের উৎপত্তি, তাতেই প্রাণের বিলয়। সুতরাং প্রকৃতির সঙ্গে জননান্তরাণি সৌহৃদানি বিজ্ঞানসম্মত। রবীন্দ্রনাথ্ নিজেও সেটা অনুভব করতেন। এটা নিছক কবি-কল্পনা নয়। এ তাঁর উপলব্ধি, এ তাঁর প্রত্যয়। ‘ছিন্নপত্রে’র ৭০ নম্বর পত্রে লিখছেন : ‘ এক সময়ে যখন আমি পৃথিবীর সঙ্গে এক হয়ে ছিলুম, যখন আমার উপর সবুজ ঘাস উঠত, শরতের আলো পড়ত, সূর্যকিরণে আমার সুদূরবিস্তৃত শ্যামল অঙ্গের প্রত্যেক রোমকূপ থেকে যৌবনের সুগন্ধি উত্তাপ উথ্থিত হতে থাকত, আমি কত দূর দূরান্তর কত দেশ দেশান্তরের জল স্থল পর্বত ব্যাপ্ত করে উজ্জ্বল আকাশের নিচে নিস্তব্ধভাবে শুয়ে পড়ে থাকতুম, তখন শরৎ-সূর্যালোকে আমার বৃহৎ সর্বাঙ্গে যে একটি আনন্দরস একটি জীবনীশক্তি অত্যন্ত অব্যক্ত অর্ধচেতনভাবে এবং অত্যন্ত প্রকান্ড বৃহৎভাবে সঞ্চারিত হতে থাকত, তাই যেন খানিকটা মনে পড়ে।’
‘সমুদ্রের প্রতি’, ‘বসুন্ধরা’ প্রভৃতি কবিতা রবীন্দ্রনাথের সেই উপলব্ধিরই কাব্যরূপ। আলঙ্কারিক প্রকৃতিপ্রেম প্রকাশের জন্য লেখা হয় নি এসব। বৈজ্ঞানিক বন্ধু জগদীশচন্দ্র গাছের প্রাণরহস্যের আবিষ্কার করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে সমস্ত প্রকৃতিই ছিল সজীব, প্রাণময়। অনন্ত শক্তির ধারয়িত্রী প্রকৃতিকে ঈশ্বরও বুঝি বলা যায়। সেই ঈশ্বরের উপর রবীন্দ্রনাথের পরম ভরসা। তিনি যে জীবধাত্রী।
শিল্পবিপ্লবোত্তর পাশ্চাত্য জগৎ যেভাবে নগরায়ণের জন্য মত্ত হয়ে উঠেছিল, যেভাবে নির্বিচারে বন কেটে বসত গড়া হচ্ছিল, যেভাবে যন্ত্রনির্ভর হয়ে উঠছিল, ক্রমবর্ধমান কল-কারখানা যেভাবে বিষিয়ে দিচ্ছিল পরিবেশকে,- তা রবীন্দ্রনাথ বড় উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেছিলেন। তাঁর বহু প্রবন্ধ ও নাটকে সেই উদ্বেগ প্রতিফলিত হয়েছে। পুঁজিবাদী সভ্যতার সঙ্গে প্রকৃতি ও পরিবেশের বৈরীমূলক সম্পর্ক- antagonistic contradiction–ধরা পড়েছিল তাঁর চেতনায়। প্রকৃতির প্রতিশোধের রূপটি আমরা দেখি তাঁর ‘মুক্তধারা’ নাটকে।
কার্ল মার্কসের অভিন্নহৃদয় বন্ধু ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস ১৮৭৬ সালে তাঁর ‘বানর থেকে মানুষে বিবর্তনে শ্রমের ভূমিকা’ বইতে মানুষকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন উপনিবেশবাদীরা যেমন অন্য দেশ জয় করে, তেমনি মানুষ যদি ভাবে প্রকৃতিকে জয় করে পদানত করবে, তাহলে মস্ত ভুল করবে। কারণ সে ভুল করলে একদিন প্রকৃতিও গ্রহণ করবে প্রতিশোধ। কমিউনিস্ট দেশ বলে পরিচিত দেশগুলি কিন্তু সে কথা মনে রাখে নি। তারাও লাভ ও লোভের নেশায় মেতে ধ্বংস করে যাচ্ছে প্রকৃতিকে। চিনের যে উহান আজ বিতর্কের কেন্দ্রভূমি, সে তো প্রকৃতিসম্পর্কবিরহিত নিছক এক যন্ত্রনির্ভর বাণিজ্যনগরী।
রবীন্দ্রনাথ শুধু প্রকৃতি ও মানুষের অন্তরঙ্গ সম্পর্কের কথাই ভাবেন নি। তাকে বাস্তবে রূপ দেবার চেষ্টাও করেছিলেন। সেভাবেই গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন শান্তিনিকেতন। গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন বৃক্ষশোভিত আশ্রম বিদ্যালয়। আয়োজন করেছিলেন বনমহোৎসবের। আয়োজন করেছিলেন ঋতুরঙ্গের। প্রকৃতির সঙ্গে ছাত্রদের নিবিড় পরিচয় করিয়ে দেবার ভার নি্যেছিলেন অজিত চক্রবর্তী, নন্দলাল বসু প্রমুখ তাঁর সময়কার বিবিধ বিভাগের শিক্ষকেরা।
আজ করোনাকবলিত পঁচিশে বৈশাখে বুঝতে পারছি ফিরতেই হবে প্রকৃতির কাছে। ফিরতে হবে নতজানু হয়ে। প্রকৃতির নয়নাভিরাম শোভা নিয়ে কবিত্ব করার জন্য নয়; আমাদের আশ্রয়ের জন্য, আমাদের অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য। আমরা শুধু প্রকৃতির ভেতরকার নিয়ম আবিষ্কার করে প্রাণীকুলের মঙ্গলের জন্য তাকে প্রয়োগ করতে পারি; তার সঙ্গে যুদ্ধ করার, তাকে পদানত করার দুরভিসন্ধি যেন আমাদের না হয় কখনো।
[ক্রমশ]
আগের সবগুলো পর্ব ও লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে ক্লিক করুন।
গবেষক