| 29 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক সাহিত্য

করোনাকালে ইন্দু বিন্দু (পর্ব-২)

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

করোনা শুরুর দিকে শেষ হয়েছিলো তারপর দুইমাস কয়েকদিনের বিরতি, পাঠকদের অনুরোধে আবারো শুরু হল ইরাবতীর পাতায় করোনাকালে ইন্দু বিন্দু। আজ রইলো করোনাকালে ইন্দু বিন্দু পর্ব-২।


 

করোনাকালের সহজপাঠ- ঙ্গ 

আজ করোনাকালের দ্বাদশতম মঙ্গলবার। ওদিকে পঙ্গপালের দঙ্গলের দাপট ভয়াবহ। তাদের শুঙ্গ তবুও ড্রোণের মাধ্যমে ন্যায়দম খাচ্ছে কিছুটা সেটাই স্বস্তির। ওদিকে আমপানের তাণ্ডবে গাছ পড়ে জঙ্গলাকীর্ণ কলকাতার রাস্তাঘাট। এয়ারটেল ডঙ্গল কাজ করতে করতে থামছে। ইন্টারনেট ছিলনা বঙ্গে। কতই রঙ্গ দেখাল এই আমপান। ততক্ষণে করোনার লেখচিত্র তুঙ্গে। এদিকে সর্বাঙ্গে ঘাম মেখে আমি কেবল রান্নাঘরে। এর চেয়ে কলিঙ্গ, কঙ্গো অথবা হাঙ্গেরী পালানো ভালো ছিল। এখন কেউ যাবেও  না আমার সঙ্গে।  মোঙ্গোলিয়া থেকে সিঙ্গাপুর, মাঙ্গালোর, বেঙ্গালুরু থেকে, তেলেঙ্গানা সর্বত্র এক দুরবস্থা। কোভিড তরঙ্গের উত্ত্যুঙ্গ ত্রাসে কম্পমান সারাবিশ্ব।  

সারা বিশ্ব তথা বেঙ্গলের সব রেস্তোরাঁ যদি চালু থাকত তবে উপবাস ভঙ্গ করতাম জয় মঙ্গলবারের। গাঙ্গেয় বঙ্গ ছেড়ে যেতাম না কোনোখানে।  চাঙ্গা হত শরীর। করোনার হাঙ্গামায় সব কেমন হয়ে গেল। ছাঙ্গু লেক কিম্বা জঙ্গীপুর নিদেন দেগঙ্গায় লঙ ড্রাইভেও যাওয়া যাবে না আর। সেখানেও ঢুকেছে। টাঙ্গা চড়ে আগ্রা বেড়ানোও নয়। ঠ্যাঙ্গানি দেবে করোনা। এ যেন জলে কুমীর, ড্যাঙ্গায় বাঘ। উরঙ্গের চেয়েও খলতর এহেন করোনা সঙ্গী ছিল । তার মাঝে আমপান ঝড় এসে আবার দাঙ্গা বাঁধালো। এদ্দিন মা বাইরে বেরুনো দেখলেই বলত ধিঙ্গিপনা। এখন মা রণে ভঙ্গ দিয়েছে। কিন্তু না বেরিয়ে নিজেও পঙ্গু হয়ে পড়ছে সেটাও চিন্তার। আমার সাঙ্গোপাঙ্গরা সব দূরে দূরে। কত তরুণীর লেহেঙ্গাগুলো সব বাক্স বন্দী। ছেলেদের চুঙ্গি পাতলুনও । ওদিকে বাবার লুঙ্গী কিনতে হবে। উপায় নেই। এখনও খোলেনি দোকানপাট। একরত্তি করোণার একই অঙ্গে এত রূপ! জঙ্গী হামলার চেয়েও মারাত্মক। লকডাউন ওঠাটা কতটা ন্যায়সঙ্গত সেই নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলছে ।মাঝখান থেকে আমাদের সবার আর একসঙ্গে থাকা হল না।

 

আমাদের রঙ্গনার থিয়েটার ছিল। গ্রামাফোনে গাঙ্গুবাঈ হাঙ্গলের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত কিম্বা হেমাঙ্গ বিশ্বাস ছিল। শিবাঙ্গীর সঙ্গে নাচতে নাচতে হাতিবাগানের অঙ্গশ্রী তে ব্লাউজ বানাতে দেওয়া ছিল। অঙ্গশোভা বিউটি পার্লারে আইব্রাও ট্রিম করে  হাতিবাগানি চ্যাঙ্গারীর মধ্যে গরম সিঙ্গারা কিম্বা ঠোঙ্গাভরে ঘটিগরম চানাচুর ছিল। কোনোদিন কলেজ ফেরত সাঙ্গুভ্যালির কবিরাজি কাটলেট অথবা বাবার সঙ্গে চাঙ্গুয়ার গোল্ডেন ফ্রায়েড প্রণ ছিল।আমাদের ক্রিকেটের আঙ্গিনা আমোদিত ছিল বেঙ্গসরকারে। আর পরে গাঙ্গুলিতে। অঙ্গভঙ্গি করে স্যারেদের ক্যারিকেচার ছিল। বন্ধুদের কথায় কথায় পাঙ্গা নেওয়াও ছিল। ব্যাঙ্গাত্মক উক্তির ধারে সেল্ফ ইগো খান খান হয়ে ভেঙ্গে যাওয়া ছিল। এই তো সেদিন কঙ্গনার অভিনয় দেখে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে মাল্টিপ্লেক্স থেকে বেরিয়েই হিম শীতল ম্যাঙ্গোশেকে চুমুক দিলাম। কুড়মুড়ে বিঙ্গো চিপসে মুখ চালানোও দিব্য চলছিল। ট্যাঙ্গি স্যসের টেস্টি চাইনিজও ছিল। যে কোনো অ্যাঙ্গেল থেকে অবারিত সেলফি তোলা ছিল। কোত্থেকে কি যে সব হয়ে গেল আমাদের! অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রইল শুধু করোনা।  

আমার মঙ্গলাকাঙ্খী মায়ের হাতে অড়হর ডালে হিঙ্গস্ফোটনের গন্ধে মাতাল হওয়া ছিল ছোটবেলায়। ব্যাকরণের পদ বা লিঙ্গ পরিবর্তন মুখস্থ করতে করতে মনে পড়ে যেত ভূগোলের গিরিশৃঙ্গ এর উচ্চতা, সপ্তর্ষিমন্ডলের সাত ঋষির নামের মধ্যে অঙ্গীরার নামটাই ভুলে যাওয়া। এমন মঙ্গলবার গুলোতেই ইস্কুল থেকে ফিরলে মাথায় মা মাখিয়ে দিত ভৃঙ্গরাজ পাতা বাটা। আমরা দিব্যাঙ্গনাদের ইঙ্গুদী তেল দেখিনি। তাই ভৃঙ্গরাজই সই। আরামে লেপটে যেত সর্বাঙ্গের ক্লান্তি। মা তেল মাখাতে মাখাতে শোনাত অঙ্গদেশের ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি ও বালির পুত্র অঙ্গদের গল্প। কোনোদিন গঙ্গারিডি জাতির কথা। তার মধ্যেও ছিল আমাদের রবীন্দ্রজয়ন্তীর ওরে বিহঙ্গ মোর অথবা নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ আবৃত্তির অনুশীলন। ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী ছিল আরও ছোটো বেলায়। সুড়ঙ্গপথে রূপকথার রঙীন স্বপ্নের গতায়ত ছিল। এই করতে করতে সাহিত্যের পাতায় আমি তখন মঙ্গলকাব্যে ডুবে রয়েছি। কখনো ধর্মমঙ্গল বা মনসামঙ্গলে। অথবা চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের আনাচে-কানাচে। কখনো আবার শীতলামঙ্গল কিম্বা গোঁসানিমঙ্গলের পাতায় পাতায় হারিয়ে গিয়েছি। বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ উঁচিয়েছি বাঙ্গলাভাষায় প্রচুর নম্বর পেয়ে।বেশ তো চলছিল জীবন আমাদের! কোথা থেকে এক মারণ রোগের হাঙ্গামায় সব ছারখার হয়ে গেল!  

অকাদেমি রঙ্গমঞ্চে উরুভঙ্গম্ নাটক নেই। সঙ্গীতানুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র নেই। নৃত্যানুষ্ঠানের মঙ্গলাচারণ কিম্বা রাধাকৃষ্ণের শৃঙ্গার ভৃঙ্গার দেখে অভিভূত হওয়া নেই। বাদ্যকারের মৃদঙ্গে বোল ওঠা নেই। আত্মীয়ের সঙ্গে আলিঙ্গন নেই। এমন কি সংক্রমণের ভয়ে হাতের অঙ্গুরীয় পরিধানের বিলাসিতাও নেই। অঙ্গরাগে ভ্রূক্ষেপ নেই। চুলোয় গেল অঙ্গনা দের অঙ্গসাজ। তাদের চিন্তা শুধু কিভাবে নিজ নিজ অঙ্গনকে সুরক্ষিত রাখা যায় । কে জানে এরই মধ্যে বারাঙ্গনারা কেমন ছিল সব? তাদের ব্যাবসাপাতিও লাটে।
এ যাবত ঘরমুখী হতে হতে সবার অঙ্গপ্রত্যঙ্গে উপাঙ্গে জঙ ধরে গেল। অষ্টাঙ্গযোগ, ষড়াঙ্গযোগ নাহয় বাদই দিলাম। সাদামাটা সর্বাঙ্গাসন, ভুজঙ্গাসন করে কি আর সে জঙের মরচে সারাই হয়? তুঙ্গভদ্রার তীরে কিম্বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বইয়ের পাতায় একআধবার অথবা ইউটিউবে গঙ্গা ছায়াছবির গান শুনতে শুনতেও আর ভালো লাগছে না। নদীর কথা মনে পড়তেই নদীর মঙ্গল চাইতে গেলাম। মনে পড়ল উত্তরবঙ্গের রঙ্গীত, দক্ষিণবঙ্গের রায়মঙ্গলের কথা, জলঙ্গীর কথা। এরা সব কেমন আছে কে জানে? কে জানে কেমন আছে দেশের নদী সঙ্গমগুলি? ত্রিবেণী থেকে প্রয়াগ। কতদিনে আবার নদীর জল ছুঁতে পারব আমরা? কবে আবারো যেতে পারব গঙ্গোত্রী থেকে তুঙ্গনাথ? ঠিক কতদিন বাদে ছুঁয়ে দেখতে পারব আত্মজদের? আমূল বদলে গেল সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী।  তাই না? দূরত্ব বজায় রাখাটাই জীবনের একমাত্র অঙ্গ হয়ে দাঁড়ালো তবে।

ভোরে উঠে আমার মঙ্গলময়ী ঠাম্মার গঙ্গোদক ছিটিয়ে গীতার পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিং শ্লোক উচ্চারণ ছিল। শয়নে স্বপনে জাগরণে তাঁর ছিলেন ত্রিভঙ্গ মুরারী।আমার কেউ নেই। কেমন বেরঙ্গীন হয়ে গেল আমার জীবন! অথচ এই আমারই ছোটবেলায় ছিল ঘুঙ্গট দিয়ে ঘুঙ্গুর পায়ে ঠমকি নাচ। সন্ধেবেলা বাবা কোনোদিন বাবা রঙ্গমঞ্চের অন্যতম শিল্পী সবিতাব্রত দত্তর ছেড়ে দাও রেশমি চুড়ি বঙ্গনারী, কভু হাতে আর পোরোনা গাইছেন উদাত্ত কণ্ঠে অথবা চারণকবি মুকুন্দ দাসের সেই কালজয়ী সঙ্গীতে গলা মেলাতে বলছেন। মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে বলে গগনভেদী চীতকার করতেন।সেদিন হয়ত আমার স্বরভঙ্গ তবুও গাইতে গাইতে সর্বাঙ্গে রোমাঞ্চিত আমি। শিবাঙ্গী কতদিন অ্যাঙ্গলোইন্ডিয়ানদের অন্তরঙ্গ বঙ্গবন্ধু বৃত্তে রঙ্গব্যঙ্গ নেই। ইঙ্গবঙ্গ সমাজে জাতি, লিঙ্গভেদ ভুলে পাত থেকে তুলে এঁটো খাওয়া নেই। প্রাসঙ্গিক শুধুই  দূরত্বে সঙ্গোপন আর আভাসে ইঙ্গিতে আছে মাস্ক পরার বার্তা। দধিমঙ্গলে মঙ্গলশঙ্খ ধ্বনি নেই। মঙ্গলঘটে আমপাতা নেই। মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান নেই। সত্‌সঙ্গে স্বর্গবাস নেই। বরং করোনার অসৎসঙ্গে সর্বনাশ আছে। আর করোনাকালের অনুষঙ্গে আছে কেবল মাস্ক-স্যানিটাইজারের কড়চা। উলঙ্গ শিশুর জন্য আছে লঙ্গরখানার লপসি। নাকের ফুটোয় সজাগ মারণ ভাইরাসের টাঙ্গি অথবা ঠোঁটের ওপর জাগ্রত তার ড্যাঙ্গস। প্রকৃতির সঙ্গে মধুর যাপন আছে কীটপতঙ্গের। মাছরাঙ্গার অবাধে মাছ খাওয়া আছে। ফিঙ্গে-ফ্লেমিঙ্গো সবার সুখের ভ্রমণ আছে। কিন্তু আমাদের নেই পর্বতের উৎসঙ্গে বসে মনের আরাম কিম্বা ঐতিহাসিক কঙ্গুরায় দাঁড়িয়ে রোমাঞ্চিত হবার সুখ। ডিঙিনৌকায় মাছ ধরা থাকলেও এখন হ্যাঙ্গারে ঘুমিয়ে লাখ লাখ বিমান। জাহাজ বাঁধা নোঙ্গর করে। তাই মনের সুখে সাগর সাঁতরে হাঙ্গর। রঙ্গন, নাগলিঙ্গম, শারঙ্গের প্রস্ফুটিত রূপে ছয়লাপ চারিদিক । কিন্তু আমাদের? গাছ থেকে কামরাঙ্গা পাড়ার সুখ নেই। বরং রাঙ্গালু, আঙ্গুর সাবানজলে ধুয়ে খাওয়া আছে। ওদিকে জ্বলেপুড়ে সব অঙ্গার হল অর্থনীতি। শুধু এই একরত্তি ফঙ্গবেনে জীবাণুর জন্য। স্ফুলিঙ্গের চেয়েও জোরালো যার জীবন। এর নামই কি ছন্দভঙ্গ? জঙ্গীর চেয়েও জোরালো ক্ষমতায় যে ছত্রভঙ্গ করতে পারে মানুষ কে। আজ স্থাবর জঙ্গম সবকিছুই ভঙ্গুর অনায়াসে তার উৎপাতে। জাঙ্গিয়া থেকে আঙ্গিয়া সবকিছুই তুচ্ছ হল তার কাছে।

তালের ডোঙার শালতি চড়ে ছেলেপুলের জলে ভাসাও কি শেষ তবে? পড়ে রইল শুধু আশপাশের লোকজনকে অপাঙ্গে দেখা। প্রকৃতির সবুজ আর সজীবের শরীরি বিভঙ্গে বহু প্রতীক্ষিত নতুন ছন্দ এসেছে সেটাই আনন্দের। আমাদের সবার সুস্থ সবল অঙ্গ থেকেও মনেপ্রাণে সবাই কেমন অনঙ্গ আজ। 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত