করোনা শুরুর দিকে শেষ হয়েছিলো তারপর দুইমাস কয়েকদিনের বিরতি, পাঠকদের অনুরোধে আবারো শুরু হল ইরাবতীর পাতায় করোনাকালে ইন্দু বিন্দু। আজ রইলো করোনাকালে ইন্দু বিন্দু পর্ব-৫।
এপ্রিলের কাল বৈশাখ
একটা জিনিষ খুঁজতে গিয়ে আজ আলমারি খুলেছিলাম অনেকদিন বাদে। কেমন সুগন্ধী আবেশে যেন আবিষ্ট হয়ে গেলাম মূহুর্তের মধ্যে। প্রিয় শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে কিসের যেন মাদকতা! পরতে পরতে চেনা চেনা সব গন্ধ। সাহিত্য আড্ডা থেকে শপিংমল, বিয়েবাড়ি থেকে মাল্টিপ্লেক্স, পিকনিক থেকে আউটিং…সর্বত্র মাড়িয়ে আসা, আমাকে আদরে লেপটে জড়িয়ে রাখা শাড়িগন্ধ আমায় কেমন যেন এক মূহুর্তের জন্য আনমনা করে দিল। আমার জীবন্মৃত আত্মার ভেতর থেকে কেউ যেন বলে উঠল, এমনটা কি ভেবেছিলে কোনোদিনো? জীবনে অনেকবার নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছি কিন্তু দিন দশেকের মধ্যে বাড়ি ফিরে আলমারি খুলে মনে হত আমি বেঁচে আছি। আজ হঠাত মনে হল, কি হবে এমন বেঁচে থেকে? শাড়িগুলো, ম্যাচিং ব্লাউজগুলো আর হরেক কিসিমের হ্যান্ডব্যাগ, পার্স, ক্লাচ সব যেন গিলে খাচ্ছে মনে হল। ওরা কেন এমন কটমট করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে? সত্যিই তো নশ্বর আমাদের এই তুচ্ছ জীবনটা। শেষসময়ে শুধুই পড়ে থাকবে একমুঠো ছাই। তার জন্য এত্ত আয়োজন আমাদের্? বেশ তো চলছে এই গত মাস থেকেই। আমাদের চাহিদার লেখচিত্র হঠাত করেই নিম্নমুখী তাই নয় কি? আমরা শাড়ি-জামা-কাপড়-বেডশিট-পর্দা আরো আরো কতকিছু থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখেছি। এখন শুধুই চোখ যাচ্ছে চালের কৌটো, ডালের ডাব্বার দিকে। ফ্রিজে ক’টা ডিম বা দুধের প্যাকেট পড়ে আছে, আলু-পিঁয়াজের ঝুড়িতে ক’টা আরো আনতে হবে কিম্বা আদা-কাঁচালংকা? নাহ্! এতেই চালিয়ে নেব এই সপ্তাহটা। অথবা হঠাত করে ফ্রিজের কোণায় কুঁকড়ে, অবহেলায় পড়ে থাকা এক প্যাকেট খেঁজুর কিম্বা একটা স্যুপের প্যাকেট মনটা কে খুশিতে ভরিয়ে দিচ্ছে। এখনো, মানে এই যুদ্ধের ঠিক একমাস আগেও যেমনটি দিচ্ছিল। এই একমাসে কোনোকিছুর পট পরিবর্তন হয়নি আমাদের। শুধু কয়েকটা মৃত্যু ছাড়া। নতুন সংক্রমণ? না কি গোষ্ঠীতে ছড়ালো ফাইনালি? চোখ এখন সেইদিকে শুধু সীমাবদ্ধ।কি হয়, কি হয়!
পশুপাখিদের জীবনটাই বেশ। আহার, নিদ্রা, মৈথুন ছাড়া অন্য কোনও চিন্তা নেই তাদের। তাদের অতীত স্মৃতি নেই। ভবিষ্যতের চিন্তা নেই । আছে শুধুই বর্তমান। কিন্তু মানুষ তো আমি। তাই বুঝি আলমারি আজ বন্ধ না করে পাখা চালিয়ে হাওয়া খাওয়ালাম বেশ করে। আমার তো ভবিষ্যৎ আছে না কি! এবার এপ্রিল ফুলের ঠাট্টা, লোক ঠকানো নেই। এই কাল বৈশাখে পয়লা বৈশাখের কোনও আবাহন, বিসর্জন কিছুই হল না। লক্ষ্মী গণেশ, হালখাতা সব শিকেয় তোলা রইল। বইপাড়া হল ম্লান। নববর্ষের খাওয়াদাওয়ায় পড়ল ভাটা।
তারমধ্যে এই লকডাউনের দুঃসময়ে বারেবারে সংবাদপত্রের খবরে আমাদের পন্ডিতিয়া । আর আমরা আবারো সেই ত্রাসের খপ্পরে যেন। আমাদের ডে ওয়ান থেকেই ধর ধর ঠেকা ঠেকা অবস্থা। সেই ছোটো বাচ্ছা প্রথম হাঁটতে শিখলে যেমন হয় আর কি। এই পড়ে গেল। মাথায় চোট লাগল। কোকিয়ে উঠল কেঁদে। হটস্পট হয়ে গেল যেদিন থেকে। কে জানে বাপু? কি হবে তবে? নীলের পুজো ছিল সেই সপ্তাহেই? বেল যে চাই-ই। পাঁচটা অথবা তিনটে ফল যে দিতেই হয়। আর আকন্দফুল মাস্ট যে! মিস্টি? নিদেন বাতাসা? তক্ষুনি মনে হল, উচিত তর্পণে গাঙ শুকোচ্ছে আর আমি কিনা পাঁচ ফল, তিনফল আর আকন্দফুলে পড়ে আসি। যত্তসব! নিকুচি করেছে নীলষষ্ঠীর পুজো। সবটাই তো মনে। এই হটস্পট না হলেই তো ভোরবেলায় ছুটতাম বাজারে। কোথায় বেল, কোথায় ফুটি, কোথায় ক্যাঁটালি কলা…সব্বো উপাচার চাই । সারদা মায়ের কথা মনে পড়ল। যখন যেমন, তখন তেমন। মিষ্টির দোকান? আমি বাপু টোটালি বয়কট করেছি তাদের। আর ফুল? হ্যাঁ তাকেও। মানবো তো ভালো করে মানবো নয়ত বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ব। জানেন? আজ সকালে বাসি ঘর ঝাঁটপোঁছ করে, নেয়েথুয়ে দুধের প্যাকেট কেটে দুধ (মানে যেটায় আমার সকালের চা হবে সেটার থেকেই)নিয়ে, তার মধ্যেই ঘরে পাতা টক দৈ (মানে যেটা আমরা খাব সেটার থেকেই), মধু( মানে যেটা আমার কাশি হলে খাই, সেটাই), ঘি (মানে যেটা আমরা খাই বা রান্নায় দিই) আমার নীলের পুজো করেছি। বাগানে যা ফুল ছিল তাই দিয়ে। বেলপাতা নেই, তো কি করব! একে মা, ভাত দেয়না তায় আবার তপ্তা আর পান্তা! নীলকন্ঠ কে বলেছি, তুমি যেমন করেছ, তেমনি আয়োজন। নো এঁটোকাঁটার বাছবিচার বস!। মুয়ে খেঁদির বে হয়না, তার চার পায়ে আলতা! হ্যাঁ, ছিল শুধু আসল জিনিষ। বোতল থেকে ঢেলে নিয়েছি। না, না ইথাইল নেই এই বাজারে। কৈলাস-মানস সরোবরের জল, গঙ্গোত্রী থেকে গঙ্গাসাগর সব গঙ্গার জল ঢেলে বলেছি পরেরবার বৃষোতসর্গ করব করোনার, যদি বেঁচে থাকি। কাল হটস্পট ঘোষণার আগেই ভোরবেলায় সেফ ডিসট্যান্স মেনে যা হোক করে বেল, কলার জোগাড় করেছি। লেবু দিতে গিয়ে বারেবারে সেই থুতুর ভিডিও মনে পড়েছে। শিব কে বলেছি, সাবান জলে ধোয়া, আবার সাদা জলে ধোয়া, তারপর রোদে ফেলে রাখা, এবার তোমার যদি করোনা হয় তখন বুঝবো আপদ বিদেয় হল।
সেদিনই দুধ-ডিম-আলু-পিঁয়াজ পাঁউরুটি, নুডলস, চিঁড়ে সব পাড়ার দোকান থেকে নিয়ে স্যানিটাইজ করে, রোদ খাইয়ে ঘরে তুলে পরাণ আঁটুপাটু। রান্না করব না ঘর পরিষ্কার, ওয়াশিং মেশিনের কাপড় মেলবো না ঘরে দৈ পাতব? রাতের তরকারি, ডালের সঙ্গে ভাজা…এসব করতে না করতেই পুলিশী লালবাত্তির হুংকার। বাজারে যাবেন না। পন্ডিতিয়া সিলড হচ্ছে। টিভিতে হাওড়ার ভিডিও। ব্যারিকেড পড়ছে। ঘরের মধ্যে থাকুন। বুকের মধ্যে ধড়পড় শুরু হল। নীচ থেকে লোকাল মুদী মুন্নীর ফোন, ভাবিজী, আউর কুছ লে লিজিয়ে, কাল নেহি আনে দেঙ্গে ও লোগ। মানে? কি চাই কি চাই? আবার ভাবনা। এই করে আবারো ফোন ঘোরাই। বাদাবন হারভেস্টিং, কেভেন্টর…আছে মশাই? দেবেন আজ বিকেলের মধ্যে? সবাই এরা খুব ভালো। কি প্রচন্ড সহযোগিতা করলেন পন্ডিতিয়াবাসীর সঙ্গে তা বলার কথা নয়। আমি কেঁদে ফেলেছি গতকাল বড়, ছোট, মেজো, সব ব্যাবসায়ীদের কথা ভেবে। বলতে না বলতেই আবার বাদাবনের মেসেজ। দিদি, বারুইপুরের ফল আছে। জিরো পেস্টিসাইড, জিরো কার্বাইড। লাগবে? হাঁসের ডিম আছে। সুন্দরবনের মধুও আছে। হরিণা চিংড়িও আছে দিদি। জ্যান্ত কাতলাও। দিন কয়েক বাদে দিশী মুরগীও পাবেন। বলেন তো আবারো যেতে পারি।
মনে মনে বলে উঠি, কি ভালো আপনারা ভাই! কে বলে বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী চলে গেচে বাংলা থেকে? বাঙালী জাগো। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের আদর্শে মন দাও দিকিনি। তবে ই কমার্স ই হল দেশের ভবিষ্যৎ। ভাবতে ভাবতে আবারো পুলিশের গাড়ীর টহল আমাদের রাস্তায়… ঘরে বসে বাচ্চাদের নিয়ে ইনডোর গেম খেলুন। বাড়ির সবার সঙ্গে চা খেতে খেতে আড্ডা দিন। তাস খেলুন। বই পড়ুন, টিভি দেখুন, ছাদে হাঁটুন। বাইরে নয়। সঙ্গে সঙ্গেই শিকাগো থেকে ছেলের ডুয়ো ভিডিও কল। জেগে আছিস এখনও? হ্যাঁ, মাঝরাতেই গ্রসারীর স্লট পাওয়া যায়। কিন্তু আজ আর এখানে আর কোনও অনলাইন গ্রসারি অর্ডার নিচ্ছেনা…কি করব তবে?
একটু বাদেই তার ছোট্ট বৌটা পাশ থেকে বলে উঠল… ইয়ে! নিয়েছে ফাইনালি অর্ডার। কাছের একটা স্টোর… বড় ই-কমারস সাপ্লাই দিয়ে উঠতে পারছেনা তাই নিচ্ছেনা… মানে? আমাদের লোকাল গ্রসার মুন্নীর মত সেখানেও চুনো পুঁটি ই-কমার্স সামাল দিচ্ছে? বৌ ছেলের ওপর একহাত নেয়। তুমি কেন সব কথা মামামাম কে জানিয়ে আগেভাগে টেনশন বাড়িয়ে দাও, বুঝিনা… ম্যাচিওরড মেয়েটা আমার… ভালো থকিস তোরা দুটিতে… ঘর বন্দী হয়ে।তোদের জন্য সবসময় প্রার্থনা করছি রে।
এই তো আমার করোনার কাল যাপনের চিত্র।
অভিশপ্ত বসন্ত পেরিয়ে চৈত্রের প্রখর রৌদ্রে আমাদের নিভৃতবাস গালভরা ইংরেজী নাম কোয়ারেন্টিন। রবিঠাকুরের অমল নাকি বিদ্যাসাগরের সীতার বন্দীদশা অথবা কালিদাসের যক্ষের রামগিরি পর্বতের অভিশপ্ত নির্বাসন? এ আমাদের এক ভয়ংকর জীবন দুনিয়া জুড়ে। তফাত শুধু একটাই সীতা বা যক্ষের ছিল একাকী নিভৃতযাপন আর আমাদের পারিবারিক গৃহবন্দী দশা। তাদের ছিলনা সোশ্যালমিডিয়া আর আমাদের বন্দীদশায় সেই খুপরিটুকুনি এক পশলা সুবাতাস। শারীরিক দূরত্বে আমরা একটু বেশীই সামাজিক হয়ে পড়ছি বরং। পৃথিবী তথা দেশ তথা রাজ্য জুড়ে করোনার জন্য আমাদের সমবেত অশৌচপালন এই লকডাউন। হাম-বসন্তের জন্য শীতলার জন্য মানতের পুজো তুলে রাখতে হল কারোর। যারা চলে গেলেন তাদের শ্মশানযাত্রায় কেউ সামিল হলেন না। এমন কি ফুলের একটি পাপড়িও জুটলনা তাঁদের। একটা সর্বগ্রাসী চিন্তা সারাক্ষণ কুরেকুরে খেল মানুষকে। তার মধ্যেও শিক্ষিত মানুষদের আচরণ অবাক করে দিল আমাদের। ততক্ষণে মহামারী অতিমারীতে পরিণত হল। সীমিত শস্য, সীমিত খাদ্যদ্রব্য তবুও আমাদের ঘরভর্তি করার এক অদম্য তাড়না তৈরী হল। আর যারা পেলনা? তাদের কথা ভুলে গেলাম না তো আমরা? স্বার্থপর মানুষ এর এই বাজারেও পঞ্চব্যঞ্জন চাইই চাই। ভাতের পরে রুটি, রুটির পরে দুধ, দুধের পরে আবার ভাত, এভাবেই চলবে তবে? আসুন যে যার সাধ্যমত ত্রাণ নিয়ে জমা করি তাদের জন্য।
শরীরে, মনে খুব ক্লান্তি রয়েছে। অ-সুখ এমন অবস্থাকেও বলে বুঝি। আক্ষরিক অর্থে ব্যাধি নেই তবে আধি আছে যা ব্যাধির চেয়েও মারাত্মক। সংবাদের স্রোত নজরে আসতেই দুপুরের সোহাগী বিশ্রাম আপাত নিদ্রা কেড়ে নিচ্ছে। রাতে তাড়াতাড়ি বিছানায় গেলেও তন্দ্রা ও নিদ্রার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে হাত-পা আপাত জিরেন নিচ্ছে বটে কিন্তু স্বপ্নের ভেলায় ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে দোদুল্যমান জীবনের অজানা ঘূর্ণিপাকে।
আমরা স্বার্থসর্বস্ব মানুষ যাদের সরকারী নির্দেশিকা মেনে বিধিসম্মতভাবে হোম আইসোলেশনে থাকার কথা তারাও কি ঠিকঠাক পালন করলাম? যাদের বিদেশ থেকে ফিরে ঘরবন্দী থাকার কথা ছিল তারা? যারা এর মধ্যেই বিয়েবাড়ি গিয়ে সংক্রমিত হয়ে আবারো দূর থেকে দূরে, ছড়িয়ে দিলেন সংক্রমণ, ধর্মীয় সম্মেলনে একে অপরকে দূর থেকে দূরান্তের মানুষকে আক্রান্ত করলেন। কেউ কেউ প্রাণও দিলেন এই মারণ ভাইরাসের প্রকোপে তাঁদের দেখেও সচেতন হবনা? রোগ চেপে রাখব? আড়াল করব নিজেকে? তারপর এক্সপোজড হলে সেই মুখ দেখাতে পারবো তো সমাজে? কেউ দেখলাম খুব নোংরা রাজনীতি করছেন। এটা কি সেই সময়? একেই তো এখন আমরা সবাই আমাদের গৃহ পরিচারিকাদের অনির্দ্দিষ্টকালের জন্য ছুটি দিয়েছি। নিজেদের কাজ নিজের হাতে করার অভ্যেস শহরের মানুষদের নেই তার মধ্যেও অনেকে কাজের লোক ছাড়া বাঁচতে পারছেন না। এবার ভাবুন সেই কাজের লোকটি রোজ তার ঘরে ফিরে যাচ্ছে। সে কার স্অঙ্গে মিশছে কোথায় যাচ্ছে আমাদের তা অজানা। এবার সেই এসে আমাদের দিতেই পারে সেই রোগ। আমরা হয়ত বুঝলাম না। সে ছিল নীরব এক বাহক। যাকে দেখে বোঝা যাবেনা। নিজের চাহিদা, ইচ্ছেগুলো সীমিত রাখা এই মূহুর্তে খুব জরুরী। সে খাবারদাবারেই হোক আর কাজের লোকের ব্যাপারেই হোক। আরো কত ঘটনা দেখছি। এই সংকটজনক পরিস্থিতিতে সারাক্ষণের কাজের লোকের শরীরখারাপ হলে তাকে বাড়ির বাইরে বের করে দেবার মত অমানবিক ঘটনা। সে কোথায় যাবে? পরিবহন নেই। তাকে ডাক্তার দেখিয়ে ব্যাবস্থা করুন তবে। করোনা অনেক কিছু শেখাচ্ছে প্রতিমূহুর্তে। আমরা একদিকে অমানবিক আচরণ করে ফেলছি আবার চূড়ান্তভাবে মানবিক হয়ে গৃহ পরিচারিকার খোঁজ নিচ্ছি। সে ত্রাণ পাচ্ছে কিনা। সে ঠিক আছে কিনা। নিজেদের একাহাতে সব কাজকর্ম করতে হচ্ছে বলে হাড়েহাড়ে বুঝছি তাদের কদর। কথায় বলে দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বোঝা যায় না। ঠিক তেমনি ব্যাপার । আমরা সামান্য ডাল ভাত, সেদ্ধ ভাত, খিচুড়ি, ডিম ভাতে দিনের পর দিন অভ্যস্ত হচ্ছি। ঘরের বাচ্ছারাও সোনা হেন মুখ করে খেয়ে নিচ্ছে তা। মা ঠাকুমার পুরনো, অত সাদামাটা কেজো রান্নাবান্না কে মান্যতা দিয়ে ঝালিয়ে নেবার সুযোগ দিল এই লকডাউন। এই ফাস্টফুডের্, ট্রান্সফ্যাটের রমরমায় সেটাও কম কথা নয়। হঠাত করেই প্রকৃতি দেখছি। ঘর থেকে দু’ পা না ফেলেই চোখ রাখছি নীল আকাশে,পাখীর ডাকে, সবুজে, ফুলের রঙে। পরিবেশের দূষণমাত্রা ঝাঁ করে একধাক্কায় নেমে গেছে অনেকটাই। সারা বিশ্বজুড়েই। আমরা শিখলাম যে ধর্মের কলও বাতাসে নড়ে। আমরা শিখলাম when resources are limited unlimited creativity দিয়ে সংসার করতে হয়। পরিবারের সবার জন্য খাদ্যবন্টন করতে হয়।
খুব ক্লান্তি রয়েছে। অ-সুখ এমন অবস্থাকেও বলে বুঝি। আক্ষরিক অর্থে ব্যাধি নেই তবে আধি আছে যা ব্যাধির চেয়েও মারাত্মক। সংবাদের স্রোত নজরে আসতেই দুপুরের সোহাগী বিশ্রাম আপাত নিদ্রা কেড়ে নিচ্ছে। রাতে তাড়াতাড়ি বিছানায় গেলেও তন্দ্রা ও নিদ্রার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে হাত-পা আপাত জিরেন নিচ্ছে বটে কিন্তু স্বপ্নের ভেলায় ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে দোদুল্যমান জীবনের অজানা ঘূর্ণিপাকে।
কাল বহুক্ষণ ছিলাম এমনি এক স্বপ্নের ঘোরে। মামারবাড়ির পুরনো রান্নার মাসী অরুণা দিকে দেখলাম স্বপ্নে। বাল্যবিধবা তিন ছেলে নিয়ে ইঞ্চিপাড় সাদা থান পরে থাকতেন। কথায় পূর্ববাংলার টান। কপালে চন্দনের ফোঁটা। ছোট্টখাট্টো লক্ষ্মীমন্ত মানুষটি সবার আবদার, ওজর আপত্তি মানিয়ে নিত দিনের পর দিন। বাংলার তথা সারা দেশের গিন্নীদেরও বলিহারি যাই বাপু! নিজেরা নড়ে বসতে পারেনা। কাজের লোকেদের কি ফরমায়েশের ঘটা। অরুণা দি সব হুকুম মুখ বুঁজে তামিল করবে। সেই অরুণাদি যখন দেশে যাবে তখন দিদিমার মেজাজ সপ্তমে। ওড়িয়া ঠাকুর এনে রান্না শিখিয়ে চারবেলার রান্না হবে। কারণ অরুণা দি একবার দেশে গেলে কমপক্ষে মাসখানেক। দিদিমার এমন দুরবস্থা দেখে আমার মায়ের ধনুকভাঙ্গা পণ। জীবনেও রান্নার লোক রাখেনি তাই । খুব মনের জোর আর রাঁধবার অভ্যেসের কারণে বুক বাঁধতে দেখেছি মা’কে। সেই মা কে বরং আমি বলে বলে মা ৬৫ পেরুতেই রাঁধুনি রাখতে বাধ্য করেছি মায়ের শারীরিক কারণে।
তা যা বলছিলাম । গতকাল রাতে অরুণা দি ছাড়াও দেখা হল মালকোঁচা দিয়ে ধুতি পরা মামার বাড়ির ঠাকুর গোলক কে। আমার শ্বশুরবাড়ির রান্নার মাসী পারুল কে। আমার বিয়েতে গায়েহলুদের তত্ত্ব নিয়ে গেছিল সে। পারুলের ব্রেস্ট অপারেশন, চোখের ছানি কাটানো সব করিয়ে সে বুড়ো হতে তাকে বাড়ি চলে যেতে বলা হল। টুকটাক ভুল করত বুড়িটা। বেদম বকুনিও জুটত কপালে। তারপর এসেছে জ্যোত্স্না, জবার মা, পুতুল, উত্তরা, চন্দনা এমন কত কত মেয়ে।
এখন রোজ নিজে কেটে, বেটে রান্না করছি বলেই এদের সবার মুখগুলো খুব মনে পড়ছিল খুব। একে একে আসছিল স্মৃতির সরণী বেয়ে, পরত খুলে খুলে। মনোবিদ্যায় একে বলে “ল অফ এসোসিয়েশন”। এর কারণেই স্বপ্নে দেখলাম সবকটা পরিচিত মুখকে অনেকদিন পর। করোনা না এলে এ জীবনে আর বুঝি তাদের কথা মনেও পড়ত না আমার। রান্নাঘরের জাহাজভাঙা হাতল ছাড়া তয়ীতে একটু ময়লা থাকলে দুই মা কি চীত্কার করতেন! গ্যাস বাড়িয়ে ভাজা বসালেই গিয়ে টুক করে গ্যাসটা সিম করে দিতেন। তরকারী কাটাকুটি করার সময় ভুল এদের হতেই পারে। তায় আবার অপুষ্টির কারণে স্মৃতির ঘাটতি আশ্চর্যের কিছুই নয়। একেক বাড়িতে একেক রকমের রান্না। সেই নিয়ে সব একহাত নিতেন। রোজ রোজ সকালবেলায় এই কাটা আর বাটা নিয়ে নিত্যি কথা কাটাকাটি দেখেছি। কতবার বলেছি ঝোলের আলু আর চচ্চড়ির আলু এক নয়। বেগুণভাজা ফালাফালা আর তরকারিতে ডুমোডুমো। সর্ষেটা একবাটা কোরো কিন্তু নয়ত ঝালের সোয়াদ হবেনা। কিম্বা ভাতটা আজো গলিয়ে ফেলেছ? এত দামী জুঁইফুলের মত চাল! আজ খাওয়াটাই মাটি! কিম্বা আজ আবার দুধ উথলে গেল? খেয়াল রাখতে পারোনা? জানো কত দাম এই দুধের? রুটিগুলো কাল বড্ড মোটা মোটা হয়েছিল। হ্যাঁগো! কাল রাত্তিরের তারকারিটার কি তলা লেগে গেছিল? পোড়া গন্ধ পেলুম যে। মনে রাখতে পারোনা? নাহ! সত্যি পারেনা এরা।
মা, শাশুড়িদের প্রথম দিকে বোঝাতে চেষ্টা করেছি বহুবার কিন্তু ভবি ভোলার নয়। তবে সংসারের হাল ধরতে গিয়ে আমি কিন্তু নিজের অগোচরে নিজেও তাঁদের মত এমন ভয়ানক গিন্নী হয়ে উঠেছি যে সেই লেগাসি বহন না করলে যেন বাড়ির যোগ্য গৃহিণী হওয়া যায় না। গত কয়েকদিন নিজে একাহাতে রান্না করতে করতে, তয়ী ধুতে ধুতে এসব মনে হচ্ছিল কেবলই। তাই বুঝি স্বপ্ন দেখেছি।
দুপুরে একটু তন্দ্রা আসছে আজকাল। কায়িক পরিশ্রম বোধহয় এর কারণ। অথচ রাতে ঘুম আসছেনা। খুব ভোরে অ্যালারম ছাড়াই ঘুম ভেঙে যেতেই মনে হচ্ছে একটা বিস্তারিত স্বপ্নের ঘোরে ছিলাম। সন্ধের অন্ধকার ঘনিয়ে এলেই মনে হচ্ছে আবার কি দুঃসংবাদ আসবে। ছাদে বা বারান্দায় একটু চৈতি হাওয়া গায়ে মাখলেই মনে হচ্ছে ঠান্ডা অনুভূতি। জ্বর এল নাকি? কিম্বা কপালের রগদুটো কনকন করে উঠল কি? ভাবতে না ভাবতেই বাড়ির কেউ হয়ত হেঁচে ফেললেন। ৮৩ বছরের শাশুড়িমা দুবার কেশে উঠলেই শিরদাঁড়ায় কিসের যেন চোরাস্রোত ওঠানামা করে উঠছে। ভোরে উঠে এখনো দেখছি চরাচর জুড়ে গোলাপী কুয়াশা মাখা হিমেল আবহাওয়া। এমন হয় কি প্রতিবারের চৈত্রশেষে? তার মধ্যেও ছাদের আলসের ধারে বসন্তের অন্তিম নিঃশ্বাস মেখে ভুঁইচাঁপা তার উদ্ধত স্টক ফুঁড়ে মাটি ঠেলে বেরিয়ে এসে বলে ওঠে, আমায় দেখো একটু। কত রঙীন তার দেহ মন। ঠিক আসমুদ্রহিমাচল জুড়ে আমাদেরো সবার যেমন ছিল। ফুলেল রক্তকরবী কে দেখে মনে হল তার সেই আত্মপ্রত্যয়েও যেন এবার কিছুটা হলেও ঘাটতি এবারের চৈত্রে। বসন্তের ফুল তুলে মালা গাঁথব বলেই না আমারা অনেকেই কোথাও না কোথাও পৌঁছে গেছিলাম হাজিরা দিতে। কেউ মিটিং এ, কেউ মিছিলে, কেউ সামাজিক দায়বদ্ধতায়। সেই সব তারিখগুলো মাথার ওপর এখন খাঁড়া হয়ে ঝুলছে। কেউ জানিনা। এতদিনে বুঝলাম মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা কি জিনিষ!
উত্তর কলকাতায় জন্ম। রসায়নে মাস্টার্স রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে। বিবাহ সূত্রে বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। আদ্যোপান্ত হোমমেকার। এক দশকের বেশী তাঁর লেখক জীবন। বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়েও সাহিত্য চর্চায় নিমগ্ন। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায়। প্রথম উপন্যাস সানন্দা পুজোসংখ্যায়। এছাড়াও সব নামীদামী বাণিজ্যিক পত্রিকায় লিখে চলেছেন ভ্রমণকাহিনী, রম্যরচনা, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ এবং ফিচার। প্রিন্ট এবং ডিজিটাল উভয়েই লেখেন। এ যাবত প্রকাশিত উপন্যাস ৫ টি। প্রকাশিত গদ্যের বই ৭ টি। উল্লেখযোগ্য হল উপন্যাস কলাবতী কথা ( আনন্দ পাবলিশার্স) উপন্যাস ত্রিধারা ( ধানসিড়ি) কিশোর গল্প সংকলন চিন্তামণির থটশপ ( ধানসিড়ি) রম্যরচনা – স্বর্গীয় রমণীয় ( একুশ শতক) ভ্রমণকাহিনী – চরৈবেতি ( সৃষ্টিসুখ) ২০২০ তে প্রকাশিত দুটি নভেলা- কসমিক পুরাণ – (রবিপ্রকাশ) এবং কিংবদন্তীর হেঁশেল- (ধানসিড়ি)।অবসর যাপনের আরও একটি ঠেক হল গান এবং রান্নাবাটি ।