করোনা শুরুর দিকে শেষ হয়েছিলো তারপর দুইমাস কয়েকদিনের বিরতি, পাঠকদের অনুরোধে আবারো শুরু হল ইরাবতীর পাতায় করোনাকালে ইন্দু বিন্দু। আজ রইলো করোনাকালে ইন্দু বিন্দু পর্ব-৬।
সারা দেশের মানুষের অন্তরীন জীবন এখন সম্পূর্ণরূপে অন্দরমুখী আর সেইসঙ্গে অন্তরমুখীও বটে। তবে তাই বলে অন্যের জন্যও ভাবছি আমরা সবাই মিলে। যেন সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।
মার্চ থেকে এপ্রিল গিয়ে সেই লকডাউনেই একে একে এসে পড়ল এবছরের মে দিবস, অক্ষয় তৃতীয়া। আমাদের অবাঙালী অধ্যুষিত আবাসনে বাঙালীরা রীতিমতোই সংখ্যালঘু। কমিউনিটি প্লেসে অবাঙালীরা আমিষ রাঁধতে দেয়না। এখানে সেই মার্চ মাস থেকে সিকিউরিটি, লিফটম্যান, মালি, হাউজকিপিং স্টাফ সহ জনা তিরিশেক কর্মী তাদের ঘর যেতে পারেনি। ওদের খাওয়াদাওয়ার ব্যাবস্থা করছি আমরাই আমাদের সোশ্যাইটির থেকে। খোলা হয়েছে এক লঙ্গরখানা। সুফল বাংলার সবজী আসছে। একজন ব্যাবসায়ীর বড়বাজারের গুদাম থেকে চাল ডাল মশলাপাতি এনে রাখা হয়েছিল তাদের খাওয়ানোর জন্য। মে দিবস আর অক্ষয় তৃতীয়ার দু’ দিন আমার শাশুড়ি মা ওদের ডিম সেদ্ধ আর কলা খাওয়ালেন। পাড়ার মুদী মুনিকে বলে দিলেই হয় ফোন মারফত। তারপর টাকা ট্রান্সফার। ওরাই কাঠকুটো জ্বেলে এক কোণায় ডিম সেদ্ধ করে নেয়। এর মধ্যেই আবার আমার শাশুড়ি মায়ের জন্মদিন পড়ল। সেই উপলক্ষে ওদের সবাই কে খাওয়ালাম মুরগীর ঝোল ভাত। খুব শান্তি পেলাম যেন এটুকুনি করতে পেরে।
আবাসনের উল্টোদিকের ফুটপাথে পন্ডিতিয়া বস্তি সংলগ্ন পাড়ার গ্রোসার মুন্নি কা দুকানে ডিম, দুধের প্যাকেট, বিস্কিট, নুডলস, মুড়ি, চিঁড়ে সব মেলে। সেইই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে প্রথম দিন থেকে। তারপর যা পাইনি তা পৌঁছে দিয়েছে ই কমার্স। সুফল বাংলা তো পরে এল। একদিন হঠাত মুন্নির ছেলে শচিন বলে ওঠে, আন্টি আমার জন্য কি আছে? আমাদের পুরনো পাঁউরুটি ওয়ালা রোজ গেটের বাইরে স্যানিটাইজ করে ফ্রেশ ব্রেড দিয়ে যায়। হঠাত মনে পড়ে ওসমান আলি তো কেক ও বানায়। জিগেস করতে বলে অর্ডার দিলে বানিয়ে দিচ্ছে এখন। শচিনকে কেক খাইয়ে ওর ঠোঁটের কোণার হাসিটা ভুলতে পারিনা। মনে হয় লকডাউন কত কি করিয়ে নিল আজ। পাড়ার মুদি পুঁচকে শচিনের ডেঁপোমি কে না জানে। মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে মোটরসাইকেল থেকে দামী মোবাইল সব বাগিয়ে বসে আছে সে। হোয়াটস্যাপে গ্রসারি অর্ডার করলে দিব্যি রেডি রাখে। তবে ঢের বেশি দাম নিয়ে নেয়। মানে ফুলক্রিমের দামে টোনড মিল্ক দেয়। ডিম প্রতি একটাকা, কলা প্রতি দুটাকা বেশি নেয়। তবুও সে এখন আমার দামী মুদিখানা। তাই এহেন শচীন কে কেক না খাওয়ালে চলে? তবে এই শচীন কে জীবনে কেক খাওয়াব ভাবিনি জীবনেও। সবই করোনার কৃপা।
সকালে গরম বেড়ে যাবার আগেভাগেই রান্নাবাড়ার পার্ট চুকিয়ে, রান্নাঘর ঘষেমেজে টকটকে করে সাবান জলে কিচেন সিংক টইটুম্বুর করে রাখছি। গ্রসারির প্যাকেট, দুধের প্যাকেট, ডিম চুবিয়ে রেখে বাকী কাজ সেরে সেগুলি আবার জলে ধুয়ে শুকিয়ে নিচ্ছি। ফলসবজী ধুয়ে ফেলছি বেকিং পাউডারের জলে। এইসব কাজগুলো বড় বেড়ে যাওয়ায় ক্লান্তিতে সব শক্তি যেন ক্ষয় তবুও বুক বেঁধে আছি এই মারণ ভাইরাসের চেইন ব্রেক করব বলে। কেমন বদলে গেছে আমাদের দিনযাপনের রোজনামচা এই লকডাউনে। ছোটবেলায় ঠাম্মার বারণ না শুনেই স্কুল শ্যু পরেই দৌড়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়তাম। এখন সচেতন হলাম। ইশকুলে হাতের নখ মুখ দিয়ে কেউ কাটলে বা ক্লাসে কেউ নাক খুঁটলে তার শাস্তি হত। কেউ কারোর পাশে বসে হাঁচলে বা কাশলে দিদিমণি কটমট করে তাকিয়ে, চশমা নামিয়ে বলতেন, রুমাল কোথায় তোমার? আমাদের সেসময় প্রাইমারি ক্লাসে স্বাস্থ্য বই বাধ্যতামূলক ছিল। সেখানেই এসব লেখা থাকত। তবুও এখন কত শিক্ষিত মানুষজন কে দেখি থুতু দিয়ে নোট গুনতে বা বইয়ের পাতা ওলটাতে। আশা করি এবার তাদের সম্বিত ফিরবে। আমরাই বা কাকে বলছি? এই সেদিন অবধিও ফল সবজী বাজারের প্যাকেট শুদ্ধই তো পুরে দিতাম ফ্রিজে। ভাবিনি সেগুলোকে ধুয়ে মুছে, রোদে ফেলে রেখে তুলতে হবে। কতকিছু শিখছি এই লকডাউনে।
আমার মত শহুরে পটের বিবিরা আজ বেশ পটু হয়ে গেছে ঘরকন্নায়।সংসার বেঁধে ফেলেছে তাদের আষ্টেপিষ্টে।সকাল সন্ধে খাটুনি তো কম হচ্ছেনা তাদের।সেইসঙ্গে মনোরঞ্জনের খামতি তো আছেই। এই কথায় কথায় সেজেগুজে বেরিয়ে যাওয়া। ছুতোয়নাতায় নিদেনপক্ষে গড়িয়াহাট কিম্বা শপিংমল। মানে দিদিমা ঠাকুমারা যাদের বলতেন সংসারে মন বসেনা, ঢেউচালানে। তারাও বুক বেঁধে, মন দিয়ে নিত্যনতুন রান্নাবাড়া করে সংসারের সবার মন ভোলাচ্ছেন।
বুড়ো বাবা মায়েরা দিন পনেরো হয়ে গেলেই অস্থির হতেন, কবে আসবি, কখন আসবি করে মাথা খেতেন কিম্বা এটা দিয়ে যা, সেটা এনে দে করে। তারাও এখন মাথা খাচ্ছেন না। কপচাচ্ছেন না।
অহোরাত্র সিরিয়াল প্রেমীরা? কোথায় গেল তাদের নেশা? আগে জিগাইলে কইতেন, ও বাবা! ঐ টাইমে আমি কারোর নই। ঐ এপিসোড মিস হলেই যেন জীবন শেষ তার। তাঁরা এখন বই পড়ছেন, খবর শুনছেন।রান্না করছেন। সংসার বিগলিত পরাণ তাদেরও এখন।
কথায় কথায় চিকেন মাটন প্রেমীরা? বেশ তো পারছেন বাপু দিনের পর দিন ননভেজাসক্তি পরিত্যাগ করে।শুধু ডিম নিয়েই জীবন কাটাতে।
গেলাসপ্রেমীরা? কথায় কথায় বোতল খুলে বসেন যারা? তাঁরাও তো বেশ ছিলেন এদ্দিন ঘুমিয়ে, ভুঁড়ির ওপর হাত বুলিয়ে?তারমধ্যেই কেউ কেউ শুনলাম সরকারী গাড়ীর তকমা এঁটে দিব্য মদের হোম ডেলিভারিও করে নিয়েছেন। আজব দেশ আমাদের! বজ্র আঁটুনির গেরো মাঝেমাঝেই আলগা করতে জানতে হয় এখানে।
আর ছোটোরা? তাদের নিয়ে তো মায়েদের জ্বালার শেষ ছিলনা এদ্দিন। তারাও তো দিব্য সোনা হেন মুখে ডাল ভাত তরকারি যা দিচ্ছে গিলে নিচ্ছে।ইউনিফর্ম পরে মন দিয়ে অনলাইন ক্লাস করছে। বেজার মুখে কিম্বা খুশিতে।
এদ্দিন যাদের বলতাম হাতে ক্যাশ মাইনে দেবনা। তারা বলত মরে যাব।মাইনের টাকা নাকি হাতে করে নিতেই হয়। তারা দূর থেকে এখন দিব্যি ফোনের মধ্যেই টাকা পাঠিয়ে দিতে বলছে।অথচ তাদের কাজে জয়েন করার জন্য বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই। কুণ্ঠিতও নয় তারা। যেন আমরা বাধ্য তাদের পাওনা মেটাতে।আর কত দয়া দেখাবো আমরা বলতে পারো তোমরা?
আর এই যে “জুম” অ্যাপে ভিডিও কোরোনা বলে বলে থকে যাওয়া পাবলিকরা? তাদের কথাও সেই ধর্মের কল বাতাসে নড়ার মত সত্যি হয়ে ফিরে এসেছে টিভির পর্দায়।এখন দিব্যি জীবন “জুম-বিহীন”হয়ে গেছে তাদের। অভ্যেস আর শিক্ষেয় কি না হয়। এই যে অশিক্ষে আর কুশিক্ষেয় দীক্ষিতরা আজ একবার পুলিশকে পেটায় তো একবার ডাক্তারবাবুদের পেটায় তারা তো জীবনেও মানুষ হবেই না।যারা ঘুরে ঘুরে বাজার করতে ভালোবাসে তারাও ঠিক এমনি। মদের দোকান চালু হতেই যারা লাইন দিল সোশ্যাল ডিস্টেনসিং না মেনে? তারা কি ধরণের মানুষ? তখন মনে হল বেশ হয়েছে, এভাবেই তবে আমাদের জীবন নিক করোনা।
কিন্তু আমরা? আমাদের দোষ কোথায়? মানে যারা পোড় খেতে খেতে, ঘষটে ঘষটে এদ্দূর জীবনটাকে কচলালাম মানে যারা কাছেপিঠে বেড়াতে গেলেও ওডোমস কিম্বা মশার ধূপ সঙ্গে রাখি? কলেরা, জন্ডিস বা আন্ত্রিকের ভয়ে মিনারেল ওয়াটার ছাড়া ফুচকা খাইনা কক্ষনো, অথবা আজন্মকাল ম্যালেরিয়ার ভয়ে আটতলার ওপরেও মশারী টাঙিয়ে শুই?
সত্যিসত্যি করোনার অশৌচকালে অনেক কিছু লেসেন নিলাম যেগুলি মনে রাখবার মত। তবে যারা শুনবেনা তারা অন্য ধাঁচের, ভবি ভোলার নয়।
তবে মে মাসের লকডাউন মোনোটনি ঘুচল রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বলে। এত রবীন্দ্র চর্চা জীবনেও করিনি। কত কত গ্রুপের আমন্ত্রণে বেশ লিখে পড়ে, গেয়ে নিজের ভিডিও নিজে তুলে মেইল করলাম। বেশ একঘেয়েমি ঘুচলো। ছোটোদের গ্রীষ্মছুটির একঘেয়েমি কাটাতে তাদের নিয়ে লাইভ গল্পপাঠের আয়োজন হল ঘরে বসে। এই বুঝি ছিল আমাদের ভবিতব্য। আমজনতা এমন কি আবাল বৃদ্ধ বনিতা যেন রাতারাতি ডিজিটাইজ করে ফেলেছে নিজেদের। এবার তারা বুঝেছে কাছে থেকে দূর রচিবার আনন্দ। প্রযুক্তির মজা। কথায় বলে না? ধর্মের কল বাতাসে নড়ে? প্রতি মূহুর্তে সেই প্রবাদের সার্থকতা অনুভূত হচ্ছে।
এই মে মাসেই শ্বশুরমশাই চলে গিয়েছিলেন। এবার একটা ফুলের মালা কিনেও দিতে পারলাম না তাঁর ছবিতে। তার বদলে আবারো আবাসনের সব অক্লান্ত সিকিউরিটি, হাউজকিপিং স্টাফদের দুটো মাছের ঝোল ভাত খাওয়াতে পারলাম। আমার বাংলায় শাক সবজী, মাছের অভাব নেই। হ্যাটস অফ! শুনলাম মহারাষ্ট্রের আবাসনে সীমিত সবজীতে চালাতে হচ্ছে। ডিম ও পাওয়া যাচ্ছে না সেখানে। কিন্তু মনের কোণায় একটু মনখারাপ থেকেই গেল পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য আর ঠিক পরিমাপে রেশন না পাওয়া মানুষদের জন্য।পথেই মৃত্যু হল দূর দূরান্ত থেকে আসা কত কত পরিযায়ী শ্রমিকের!
এসবের মধ্যেই করোনা বেড়ে গেছে আবারো কুলকুল করে।
আশ্চর্যের কথা হল মে মাসের গোড়ায় আমরা যে তিমিরে ছিলাম সেখান থেকেও হৈ হৈ করে বেড়ে গিয়েছে কভিড সংক্রমণ। জুলাইতেও আমরা আরও আরও খারাপ হয়েছি। রিস্ক কমেনি একটুও। আবারো রাজ্যের কিছু জায়গা লকডাউনে চলে গেল তার মধ্যে।
উত্তর কলকাতায় জন্ম। রসায়নে মাস্টার্স রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে। বিবাহ সূত্রে বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। আদ্যোপান্ত হোমমেকার। এক দশকের বেশী তাঁর লেখক জীবন। বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়েও সাহিত্য চর্চায় নিমগ্ন। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায়। প্রথম উপন্যাস সানন্দা পুজোসংখ্যায়। এছাড়াও সব নামীদামী বাণিজ্যিক পত্রিকায় লিখে চলেছেন ভ্রমণকাহিনী, রম্যরচনা, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ এবং ফিচার। প্রিন্ট এবং ডিজিটাল উভয়েই লেখেন। এ যাবত প্রকাশিত উপন্যাস ৫ টি। প্রকাশিত গদ্যের বই ৭ টি। উল্লেখযোগ্য হল উপন্যাস কলাবতী কথা ( আনন্দ পাবলিশার্স) উপন্যাস ত্রিধারা ( ধানসিড়ি) কিশোর গল্প সংকলন চিন্তামণির থটশপ ( ধানসিড়ি) রম্যরচনা – স্বর্গীয় রমণীয় ( একুশ শতক) ভ্রমণকাহিনী – চরৈবেতি ( সৃষ্টিসুখ) ২০২০ তে প্রকাশিত দুটি নভেলা- কসমিক পুরাণ – (রবিপ্রকাশ) এবং কিংবদন্তীর হেঁশেল- (ধানসিড়ি)।অবসর যাপনের আরও একটি ঠেক হল গান এবং রান্নাবাটি ।