আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিটমা মারা যাবার পর আমি খাঁচা বানাতে শুরু করলাম। প্রথমে বাড়ির মেন কাঠের দরজার বাইরে কোলাপসিবল দেওয়া হল। একইসাথে বাথরুমের ফ্যানলাইটের জানলার বাইরে লোহার গ্রিলের খাঁচা লাগালো হল। সিঁড়ির দরজার বাইরে ছাদের দিকে গ্যারেজের সাটারের খাঁচা আর এ সি মেশিনের খাঁচা অর্ডার দিলাম গ্রীষ্মের ছুটি পরার আগে।
খাঁচা বানানো হল মিটার বক্সের। রান্নাঘরের চিমণির খাঁচা বসালো চিমণি কোম্পানির লোক। ঘর আর বারান্দার জানলা দরজার কাঁচের শার্সির বাইরে জাল বসানো, বাথরুমের নালির জালি বসানো, এসব লেগেই রইল।
প্রতিটা বড় ছুটির আগে আমি খাঁচার অর্ডার দিই আর খাঁচা এসে গেলে মিস্ত্রি তা জায়গামতো বসিয়ে দেয়। কোন কোনবার খাঁচাগুলো রঙ করার জন্য রঙের মিস্ত্রী আসে।
খাঁচার পর্ব কিন্তু এতেও শেষ হয় না। মা বেঁচে থাকাকালীন পাশের বাড়ির প্রতিবেশীরা আমাদের আর তাদের কমন প্লেসে কোন দেওয়াল দেয় নি। তারাই মা মারা যাবার পর জানালো আমি যেন পাঁচিল তুলে দিই। কম খরচে কিভাবে দেওয়াল তোলা যায় ভাবতে গিয়ে দেখলাম, লোহার গ্রিলের খাঁচা করে পার্টিশান তোলা সবচেয়ে সুবিধাজনক। সেবার পুজোর ছুটিতে প্রতিবেশীর বাড়ির সঙ্গে আমার বাড়ির কমন প্লেস খাঁচা দিয়ে ভাগ করা হল।
মা মারা যাবার পর মায়েরবাড়ি খাঁচা বসিয়ে সুরক্ষিত করছিলাম বলে আত্মীয়স্বজনরা অনেকেই চোখ টাটালো। বাড়ি বিক্রি না করে খাঁচা বসাচ্ছি শুনে অনেকেই ভাবলো বাড়িতে কোন গুপ্তধন আছে। একবার বাড়িতে চোরও ঢুকল। কিন্তু খাঁচার দৌলতে একরাতের মধ্যে খাঁচা ভেঙে বাড়ির জিনিষ চুরি করে পালাতে না পেরে কিছু তালা ভেঙে, বাইরে দিয়ে নিজেদের তালা লাগিয়ে চলে গেল। আমি তখন তালাগুলো সুরক্ষিত করতে তালার খাঁচা কিভাবে বানানো যায় তার নক্সা বানালাম। এ ঘটনা রাষ্ট্র হতে দেরী হল না। তাই পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন আমার কাছে আসতে লাগল বাড়ির সুরক্ষায় খাঁচা বিষয়ক পরামর্শ নিতে ও আমার খাঁচা দিয়ে সুরক্ষিত বাড়ি পরিদর্শন করতে।
আমিও বাড়ির বাইরে ‘খাঁচা বিষয়ক পরামর্শ দেওয়া হয়’ বলে একটা সাইন বোর্ড ঝোলালাম। সাইনবোর্ড দেখে পাখি পোষে এমন কিছু ব্যক্তিও আসলো পাখি যাতে খাঁচা কেটে না পালায় তেমন খাঁচার খোঁজে। এবং নিরাশ হয়ে ফিরে গেল।
আমার খাঁচার যত সুনাম ছড়িয়ে পড়ল তত লোহার গ্রিলের দোকানের, তালা কোম্পানির, খাঁচা বসায় এমন মিস্ত্রীদের চাহিদা এলাকায় বাড়তে লাগল।
এসমস্ত দোকানের ও কোম্পানির মালিক ও মিস্ত্রীরা আমাকে বিভিন্ন অফারের বিনিময়ে অর্ডার চাইতে লাগল।
খাঁচা বিষয়ক পরামর্শ দেওয়া শুরু করার আগে আমি গুগুলের সাহায্য নিলাম। আধুনিক খাঁচার খবর, আধুনিক তালা কোম্পানির খবর, চাবি ছাড়া তালার খবর, ডিজিটাল তালার খবর, ইন্টারলকের খবরে আমার নোট বুক ভরে গেল।
খাঁচার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আমি বহু মঞ্চে বক্তৃতা দিতে লাগলাম ও বহু পত্রিকায় লিখতে শুরু করলাম। এবং ক্রমে আমি খাঁচা বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিতদের কাছে সমাদৃত হতে লাগলাম।
ততদিনে আমার পরামর্শে বহু বাড়ি সুরক্ষিত হয়েছে খাঁচার দৌলতে। আমি সেইসব বাড়িতে গুরুদেবেরমতো পূজিত হতে লাগলাম কোন মন্ত্র না দিয়েও। তবে আমার পরামর্শ মতো খাঁচা বসিয়ে প্রত্যেকটা মানুষের যে লাভ হল তা কিন্তু নয়। একবার একটি পরিবারের সকলে বয়স্কা মাকে বাড়িতে রেখে মাস কয়েকের জন্য বিদেশ ভ্রমণে বেড়িয়েছিল। বয়স্কা মহিলাটি স্মৃতি বিভ্রমের স্বীকার হওয়ায় একদিন চাবি গুলিয়ে ফেলল। আর চাবি বাইরে রেখে নিজেই নিজের ঘরে ঢুকে ইনটার লক লাগিয়ে ফেলায় সেই লক খুলে আর বেরোতে পারল না। বাড়ির বাকিরা বিদেশ ভ্রমণ থেকে ফিরে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে ঘর থেকে মায়ের পচাগলা মৃতদেহ পেল। এ ব্যাপারে অবশ্য আমাকে যে সকলে দোষারোপ করেছিল তা নয়। বয়স্কা মাকে বাড়িতে রেখে বেড়াতে যাবার কথা রটে গেলে ছেলে বৌমার আক্কেল নিয়ে চারিদিকে ঢিঁঢিঁ পড়েগেছিল।
এছাড়াও বাড়ির চাবি হারানোর জন্য দরজা ও খাঁচা ভাঙার ঘটনাও এলাকায় লেগেই রইল। ফলে শুধু তালা বা খাঁচা লাগানোর মিস্ত্রীই নয় তালা, দরজা, গ্রিলের খাঁচা ভাঙার লোকেদেরও কাজ বাড়ছিল এলাকায়।
আমি কানাঘুঁষো জানতে পারলাম চোর ডাকাতদের ইউনিয়নগুলো আমাকে টার্গেট করেছে। আমি তখন রাস্তায় ঘাটে চোর ডাকাতদের আক্রমণ থেকে নিজেকে সুরক্ষিত করতে প্রথমে চারচাকা গাড়ি কিনলাম, তারপর নিজের আর্মড বডিগার্ড রাখলাম। তারওপর একদিন শপিংমলে অল্পের জন্য ডাকাতদের আক্রমণ থেকে বেঁচে গিয়ে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট কিনলাম। সভা সমিতিগুলোতে মাথায় হেলমেট ব্যবহার করতে লাগলাম।
একদিন ফোনে চোর ডাকাতদের গোষ্ঠী থেকে আমার প্রাণনাশের হুমকি এলে আমি বাড়ি থেকে বেড়োনোই প্রায় বন্ধ করে দিলাম নিজের সুরক্ষার তাগিদে। ধীরে ধীরে সুরক্ষার জন্য আমি কাজের লোক, রান্নার লোক, ড্রাইভার ছাড়িয়ে দিলাম। শেষে চাকরি ছেড়ে নিজের তৈরি খাঁচায় সুরক্ষিত মায়ের বাড়িতে অন্তরীন দশা কাটাতে লাগলাম।
এখন লকডাউনের সময় আমি রোজ সকালে ঘুম ভেঙে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবি, ভাগ্যিস নিজেকে খাঁচায় বন্দি জীবনে অভ্যস্ত করে তুলেছিলাম, তাই গোটা পৃথিবী যখন করোনা, কোয়ারেন্টাইন, কন্টাইনমেন্ট এ সমস্ত কথায় ক্রমশ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠছে আমি ফেবুতে ইউ টিউব চ্যানেল লঞ্চ করে তখন কিভাবে নিজেকে সহজেই খাঁচায় অভ্যস্ত করা যায় তার টিপ্স দিয়ে ইউ টিউবার হয়ে গেলাম। আর কমেন্ট বক্স ভরিয়ে ফেললাম ফিফটন কে, সিক্সটিন কে লাইকে। এখন আমার খাঁচার মধ্যে গোটা পৃথিবীটা ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ছে।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী। ‘সাইন্যাপস পত্রিকা’ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিনের যুগ্ম সম্পাদক। ‘জ্বলদর্চি’ নামক লিটিল ম্যাগাজিনের ‘ছোটোবেলা’ ওয়েব সংস্করণের বিভাগীয় সম্পাদক। ‘মৌসুমী যে অণুগল্পগুলি লিখেছিল’ নামে অণুগল্পের বই ও ‘সোনালি খড়ের বোঝা’ ও ‘জাঙ্গুলিক’ নামে ছোটগল্পের দুটি বই। ‘যেসব গল্পের কোনো মানে হয় না’ নামক যুগ্ম গল্পের বইএর লেখিকা। ‘বহুস্বর’ পত্রিকা আয়োজিত ‘অনন্ত কুমার সরকার স্মৃতি, ২০১৭’ ছোটগল্প প্রতিযোগিতায় প্রথম, ‘আমি বাংলায় কথা কই’ গ্রুপ আয়োজিত স্বাধীনতা দিবসের (২০২১) ছোটগল্প প্রতিযোগিতায় প্রথম। ‘গল্পসল্প’র আটচালা’ আয়োজিত ‘উৎপল গঙ্গোপাধ্যায় স্মৃতি ২০১৯ অণুগল্প প্রতিযোগিতায় প্রথম, চক্রবর্তী-চ্যাটার্জী ও ‘দেব সাহিত্য পরিষদ’ আয়োজিত ‘উত্তরাধিকার কাদের হাতে’ অণুগল্প প্রতিযোগিতা ২০২১ দ্বিতীয়, ‘পথের আলাপ’ আয়োজিত ছোটগল্প প্রতিযোগিতা ২০২০ অন্যতম সেরা দশে স্থান লাভ। ‘বইসই’ আয়োজিত অনলাইন অণুগল্প প্রতিযোগিতা, ২০২৩ সেরা দশে স্থান পায়। সানন্দা, কিশোরভারতী, আজকাল রবিবাসিরীয়, দৈনিক স্টেটসম্যান, সুখবর, তথ্যকেন্দ্র, আরম্ভ, দ্য ওয়াল পত্রিকায় নিয়মিত ছোটগল্প প্রকাশ।
Related