কিন্তু, সম্প্রদায়গত ভাবে মড়ক প্রতিরোধের দৃষ্টান্ত প্রাক-ঔপনিবেশিক বাংলায় ছিল না, এমন নয়। শীতলা বা ওলাইচণ্ডী বা ওলাবিবির উপাসনা সেই সম্প্রদায়গত মড়ক-প্রতিরোধ কামনারই কথা বলে। বাংলা সাহিত্যের সেই কালে এই সব লৌকিক দেবীর কাল্টের উদ্ভবের সুবাদে তৈরি হয় দেবী-মহিমা কীর্তনকারী কাহিনি, পাঁচালি, ব্রতোপাখ্যান। সেই সব সাহিত্যও ‘আধুনিক’ নয়। তা হলে কি ধরে নেব যে বাংলা আধুনিক সাহিত্যের প্রথম পুরুষের হাতেই রচিত হয় মড়কের প্রথম বর্ণনা?
ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কালেই নাকি সাধক কবি রামপ্রসাদ তাঁর বিখ্যাত ‘অন্ন দে গো মা অন্নদা’ রচনা করেছিলেন। হতে পারে। কিন্তু এই গানে বর্ণিত ‘অন্ন’ আক্ষরিক অর্থে ‘ভাত’ নয়, তার অন্য আধ্যাত্মিক তাৎপর্য রয়েছে। তবু এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, বাস্তবের অন্নাভাব থেকেই কবির কলমে রূপক হিসবে উঠে এসেছিল ‘অন্ন’।
কলকাতা শহরের প্রাথমিক পর্বে মড়ক ছিল এক অতি কমন ব্যাপার। সদ্য এ দেশে পা দিয়ে এখানকার জলবায়ু সহ্য করতে না পেরে যে দলে দলে সাহেব মারা গিয়েছেন, তা এই শহরের পুরনো গোরস্থান ভিজিট করলেই মালুম হয়। এ ছাড়াও প্রচুর ডায়েরি, জার্নাল, স্মৃতিকথায় ঔপনিবেশিকতার সূত্রে আগত শ্বেতাঙ্গরা সেই সব মারির ভয়াবহতা লিখে রেখেছেন। তবে এ নিয়ে দিশি মানুষের কোনও অ্যাকাউন্ট নেই। আর থাকবেই বা কেন? মড়ককে খুব স্বাভাবিক ভাবেই দেখতেন শীতলা বা ওলাবিবি উপাসনাকারী বঙ্গজন। সাহেবরা যে সব রোগে মারা পড়ত, বাঙালির সেগুলো হলেও মারা যাওয়ার মতো কিছু ঘটত বলে মনে হয় না। কারণ, এখানকার জলবায়ুতে এখানকার বাসিন্দাদের ইমিউনিটি তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
মহামারির প্রথম ধাক্কা যদি বলতে হয়, সেটা ছিল ইংরেজি ১৮৯৮ সালের প্লেগ। এই প্লেগ মহামারির কালেই স্বামী বিবেকানন্দ ও তাঁর সহ-সন্ন্যাসীরা সেবা করেছিলেন। ভগিনী নিবেদিতা মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। প্লেগ বোম্বাই প্রদেশে প্রথম দেখা দিলেও তা অচিরেই কলকাতা পৌঁছয়। এবং মহামারির আকার নেয়। এই মহামারির বর্ণনা বিশদ লিপিবদ্ধ করেছিলেন প্রেমাঙ্কুর আতর্থী তাঁর ‘মহাস্থবির জাতক’-এ। লেখক এই সময়ে বালক মাত্র। কিন্তু স্মৃতি থেকে তিনি যে বর্ণনা লিখেছিলেন, তা ভয়াবহ। ‘মহাস্থবির’-এর ভাষ্য অনুযায়ী কর্পোরেশন থেকে প্লেগের টিকা দিতে চাইলে সহজে লোকে তা নিতে চায়নি। গুজব ছড়ায়, এই টিকা নিলে অচিরেই মৃত্যু ঘটবে। এর ফলে যা ঘটার তা-ই ঘটে, অচিরেই রোগ ছড়ায়। শহরের মানুষদের মধ্যে ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বীরাই প্রথম টিকা নিতে এগিয়ে আসেন। কিন্তু ‘চতুরঙ্গ’-এ প্লেগে তো জ্যাঠামশাইয়ের মৃত্যুর কথাও লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। শহর কলকাতার বোধহয় সেই প্রথম মহামারির ঝাঁকিদর্শন। ‘নাস্তিক’ জ্যাঠামশাই বাড়িতেই প্রাইভেট হাসপাতাল খুলে গরিব মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু তিনিও আক্রান্ত হলেন এই রোগে। প্রসঙ্গত, এই প্লেগেই মারা যান শরৎচন্দ্রের স্ত্রী ও শিশুপুত্র। এই মহামারি প্রবেশ করে ঠাকুরবাড়িতেও। অবনীন্দ্রনাথের শিশুকন্যা মারা যায় প্লেগে। শান্তিনিকেতনে ফ্লু বা অন্য মহামারি প্রবেশ করেনি, এর কারণ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন তা ‘পঞ্চতিক্ত পাচন’-এর গুণ। নিম, গুলঞ্চ, বাসক, পলতা, কন্টিকারি দিয়ে এই পাচন তৈরি হত। ১৯১৯ সালের জানুয়ারি মাসের গোড়ায় কবি তাঁর একটি চিঠিতে লিখছেন, ‘‘বৌমার খুব কঠিন রকম নুমোনিয়া হয়েছিল। অনেক দিন লড়াই ক’রে কাল থেকে ভাল বোধ হচ্চে। সম্পূর্ণ সুস্থ হতে বোধ হয় অনেক দিন লাগবে। হেমলতা এবং সুকেশী এখনো ভুগচেন। তার মধ্যে হেমলতা প্রায় সেরে উঠেচেন— কিন্তু সুকেশীর জন্যে ভাবনার কারণ আছে। কিন্তু ছেলেদের মধ্যে একটিরও ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়নি। আমার বিশ্বাস, তার কারণ, আমি ওদের বরাবর পঞ্চতিক্ত পাচন খাইয়ে আসচি।” (‘চিঠিপত্র’, ষষ্ঠ খণ্ড)
দেখার বিষয় এটাই যে, মড়ক যতটা দরিদ্র ও তথাকথিত নিম্নবর্গীয়দের মধ্যে ছড়াতে দেখা গিয়েছে, উচ্চবর্গীয় সমাজে ততটা নয়। এর থেকেই কি পাবলিক হাইজিনের ধারণার জন্ম? দারিদ্র আর অপরিচ্ছন্নতা হাত ধরাধরি করে চলে, আধুনিক রাষ্ট্রের এই বয়ান ঔপনিবেশিক ভারতেও লাগু হয়েছিল। বাংলা সাহিত্য ছানভিন করতে বসলে দেখা যায়, নিম্নবর্গের সমাজে মহামারির প্রকোপ সাংঘাতিক। এর উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’-এ। শুয়োরমারি বস্তিতে কলেরা মহামারির যে মর্মান্তিক বিবরণ বিভূতিভূষণ রেখেছেন, তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে রয়েছে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের দারিদ্র। সেই ভয়ঙ্কর দারিদ্রের সঙ্গে কলেরা মহামারির ভয়াবহতা মিশে যা তৈরি করেছে, তা বাংলা সাহিত্যেই নজিরবিহীন। কয়েক মুঠো ভাতের প্রতি এক কিশোরী বধূর যে আর্তিকে বিভূতিভূষণ তুলে এনেছিলেন, তা ‘আরণ্যক’-এর পাঠক মাত্রেই জানেন। মৃত্যু সেখানে নৈমিত্তিক। চিকিৎসকহীন, শুশ্রুষাহীন মানব সমাজের চিরঅন্ধকারকে বিভূতিভূষণ লিখতে পেরেছিলেন। এ এক অসাধ্য সাধন।
১৯১৮-য় ভারতে দেখা দেয় ভয়াবহ ফ্লু মহামারি। দেশের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ তাতে উজাড় হয়ে যায়। শিমলা থেকে বিহার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে মৃত্যু-মিছিল। হিন্দি কবি সূর্যকান্ত ত্রিপাঠী, যিনি ‘নিরালা’ ছদ্মনামেই সমাধিক পরিচিত, লিখে গিয়েছেন এই মহামারির মর্মস্পর্শী বিবরণ। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে উঁকি দেয়নি ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ নামে পরিচিত এই অতিমারি। কারণ? সম্ভবত বাংলায় এর তেমন প্রাদুর্ভাব ছিল না বলেই কি এই অনুপস্থিতি? বাংলা সাহিত্য কি নিজের ঘর পোড়েনি বলে বিপর্যয়কে লিখতে চায়নি সে দিন? কে জানে! আজ এত দিন পর প্রশ্নগুলো জাগেই।