ছোটগল্প: অভিশপ্ত বাড়ি । ভার্জিনিয়া উলফ
অনুবাদক: রেশমী নন্দী
এ্যাডেলাইন ভার্জিনিয়া উলফ, যাকে বিশ্ব চেনে ভার্জিনিয়া উলফ নামে, ঊনিশ শতকের অন্যতম নারীবাদী সাহিত্যিক। জন্ম ১৮৪২ সালে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়কালে তিনি ছিলেন লন্ডন লিটারেসি সোসাইটি-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। ১৯২৯ সালে প্রকাশিত ভার্জিনিয়া উলফের “A room of one’s own” নারীবাদী আলোচনায় অসাধারণ এক সংযোজন। ১৯২১ সালে তাঁর ছোট গল্পের সংকলন ” Monday Or Tuesday” প্রকাশিত হয়। এ সংকলনেরই একটি গল্প “A haunted house” এর ভাবানুবাদ “অভিশপ্ত বাড়ি”। অনুবাদ করেছেন রেশমী নন্দী।
রাতের যে সময়টাতেই ঘুম ভাঙুক না কেন, দেখতে পাবো, কোন একটা দরজা বন্ধ হচ্ছে। অশরীরী এক যুগল যেন এ ঘর থেকে ও ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, হাতে হাত রেখে। এটা তুলছে, ওটা খুলছে-যেন কিছু একটা খুঁজছে।
“এখানেই রেখে গিয়েছিলাম” অন্যজন যোগ করে, “হুম, এখানেও”। নারী কন্ঠ ফিসফিস করে উঠে, “উপরেও আছে”। পুরুষ কন্ঠ যোগ করে, “বাগানেও”। “আস্তে, সবাই জেগে যাবে।” কিন্তু তোমরা আমায় জাগাওনি।
বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে কেউ একজন বললো,” ওই যে পর্দা টেনে দিয়ে ওরা খুঁজছে কিছু একটা।” লিখতে লিখতে কলম থামিয়ে কেউ হয়তো বললো, “ওরা কিছু খুঁজে পেয়েছে।” অথচ উঠে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকালেই দেখে, সারা বাড়ি খালি পড়ে আছে, দরজাটা হাট করে খোলা। কেবল শোনা যাচ্ছে বনকপোতের বকবকম আর কারখানা থেকে ভেসে আসা যন্ত্রের শব্দ।
“আমি কেন এখানে এসেছিলাম? কি খুঁজতে? আমার হাত তো খালিই ছিল।”
“হয়তো ওটা উপরে?” আপেলগুলো জমানো আছে, বাগানেও কোন বদলের ছাপ নেই, কেবল ঘাসের উপর একটা বই পড়ে আছে।
অবশেষে বসার ঘরে খুঁজে পাওয়া গেলো সেটা। সবার চোখের আড়ালে পরে থাকা সেই ধন। জানালার শার্সীতে ছায়া পড়েছে আপেলের, গোলাপের, ছায়া পড়েছে সবুজ পাতাদের। যদিও ঘরের ভিতর দৃশ্যমান কেবল হলদেটে আপেল। কয়েক মুহূর্ত পরেই, দরজাটা খোলার সাথে সাথে ঘরের মেঝে ভেসে যায়, দেয়াল জুড়ে থাকে, দুলতে থাকে ছাদ ছুঁয়ে। কি? আমার হাতে কিছুই ছিল না।
কার্পেটে ছায়া ফেলে শূণ্যতার গভীর খাদ থেকে বনকপোতের বাকবাকুম ধ্বনি ভেসে আসে। বাড়ির ধুঁকপুক স্পন্দনে ধ্বনিত হয়,”আছে, আছে, নিরাপদে গচ্ছিত আছে ধন।” স্পন্দন মিলিয়ে যায়। ওহ, তাহলে ওরা গুপ্তধন খুঁজছে?
এক মহূর্ত পরেই আবছা হয়ে আসে আলো। তবে কি ওটা বাগানে? গাছের ছায়ায় নেমে আসা অন্ধকার ঘুচিয়ে দিচ্ছে পরিব্রাজক সুর্যরশ্মি। কাঁচের ওপারে পুড়িয়ে দেয়া রশ্মি কি অসাধারণ, কি বিরল নমনীয়তায় শুষে নিচ্ছে মাটি। মৃত্যু লেগে আছে কাঁচের গায়ে। দুজনের মধ্যে মৃত্যু প্রথম ছুঁয়েছিল সঙ্গীনিকে। এরপর, শত শত বছর আগে, ঘর অন্ধকার করে চলে গেছে প্রেমিক। ছেড়ে গেছে অমূল্য নিধি, ফেলে গেছে প্রিয়তমাকে। এরপর এবার উত্তরে, একবার পূর্বে -ঘুরতে ঘুরতে কোন একসময় তারাদের ইশারায় অমূল্য সে ধন খুঁজতে ফিরে আসে পুরোনো বাড়িতে। সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজতে খুঁজতে একসময় শোনা যায় বাড়ির আনন্দিত স্পন্দন, “অক্ষত আছে, নিরাপদে আছে তোমার সম্পদ।”
বাতাসের গর্জন শোনা যায়। রাস্তার গাছগুলো বেঁকেচুরে একবার এদিকে পড়ছে, আরেকবার ওদিকে। বৃষ্টির তোড় যেন ফালা ফালা করছে চাঁদের কিরণকে। জানালায় মোমবাতির স্থির আলো দেখা যায়,জ্বলছে একটানা। সারা বাড়ি ঘুরতে থাকে ওরা। আমাদের ঘুম না ভাঙাতে ফিসফিসিয়ে কথা বলতে বলতে অশরীরি যুগল খুঁজতে থাকে গুপ্তধন।
“এইখানে আমরা ঘুমাতাম”। স্বামীর কন্ঠ যোগ করে, “সেই সব অসংখ্য চুমু, সকালে জেগে উঠে–,গাছের ফাঁকে রূপালী ছায়ায়–,উপর তলায়–, বাগানের মধ্যে–,যখন গ্রীষ্ম আসতো–,শীতকালে বরফ পড়ার সময়–”।
ধীরে ধীরে কাছে আসে ওরা। বাতাসের তোড় কমে গেছে, বৃষ্টির জল চুঁইয়ে পড়ছে কাঁচ বেয়ে। আমরা দেখতে পাই না কিছুই, আশেপাশে শোনা যায় না কারো পদধ্বনি। প্রদীপের আলো আড়াল করে রেখে পুরুষ কন্ঠ ফিসফিস করে, “দেখো, কেমন গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে ওরা। ঠোঁটের কোণে লেগে আছে ভালবাসা।”
আমাদের দিকে ঝুঁকে আসে অশরীরী আত্মারা, প্রদীপের আলোয় গভীরভাবে দেখে আমাদের – অ-নে-ক-ক্ষ-ণ। বাতাসের ছোঁয়ায় প্রদীপের শিখা নড়ে চড়ে। মেঝে, দেয়াল ভাসিয়ে চাঁদের আলো পড়ে ঝুঁকে পড়া মুখগুলোর উপর। গভীরভাবে কিছু একটা ভাবছে অশরীরী এই যুগল, ঘুমন্ত মুখগুলোতে ছায়া পড়েছে তাদেরই লুকানো আনন্দের।
ওদিকে সারা বাড়ি ঘোষণা করছে সগর্বে, “নিরাপদে আছে, অক্ষত আছে সব।”
“কত বছর পরে” দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সঙ্গী বলে, “আবার তুমি খুঁজে পেয়েছ আমায়”। সঙ্গীনি ফিসফিসিয়ে বলতে থাকে, “এখানে বেঁচে ছিলাম আমরা। ঘুমিয়েছি, বাগানে সময় কাটিয়েছি, হেসেছি, আপেল কুড়িয়েছি। এখানেই রেখে গেছি আমাদের সম্পদ–”। ততক্ষণে চোখ খুলি আমি। বাড়ির হৃদস্পন্দন তীব্র থেকে তীব্রতরভাবে বলে চলেছে, “নিরাপদে আছে, অক্ষত আছে সব”। আমি কেঁদে উঠি, “ভালবাসাই তবে তোমাদের গুপ্তধন?”