| 29 মার্চ 2024
Categories
ইতিহাস জীবন যাপন লোকসংস্কৃতি

মিথলজিক্যাল ফিচার: রাশিচক্রের প্রতীক-কাহিনী । নুসরাত জাহান

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট
রাশিশাস্ত্র নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। কম বেশি সবারই আগ্রহ রয়েছে নিজের ভবিষ্যত জানার জন্য। বিশেষ করে বছরের শুরুর সময়টাতে যেন ধুম পড়ে যায় রাশিফলের বই কেনার জন্য! এই সুযোগে কিছু পত্রিকাও প্রকাশ করে ফেলে নতুন বছরের রাশিফল নিয়ে বিশেষ সংখ্যা। রাশিচক্রে রাশির যে চিহ্নগুলো প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়, সেগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে বেশ কিছু প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনী। এসব কাহিনীতেই রূপকভাবে বর্ণিত রয়েছে বারোটি রাশির জাতক-জাতিকার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, গুণাগুণ ও জীবনে শুভাশুভ ঘটনার রহস্য। পৌরাণিক কাহিনীর বিভিন্ন বর্ণনায় দেব-দেবী, দৈত্য-দানব, ড্রাগন ও অতিপ্রাকৃতজনের যে বীরত্বগাথা বা ঘটনার বিবরণ দেয়া আছে, জ্যোতিষশাস্ত্রের তত্ত্ব ও ব্যাখ্যামতে তা বাস্তব জীবনধারার প্রতীকী ইঙ্গিত বহন করে। রাশি নির্ধারণের নানান পদ্ধতির একটি হলো ‘সংখ্যা-জ্যোতিষ’ বা ‘নিউমারলজি’ পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে জন্মতারিখ অনুসারে জাতক বা জাতিকার রাশি নির্ধারণ হয়। ২১ মার্চ থেকে ২০ এপ্রিলে জন্মগ্রহণকারীরা হলেন মেষ রাশির জাতক বা জাতিকা। ২১ এপ্রিল থেকে ২১ মে পর্যন্ত যারা জন্মগ্রহণ করেছেন তারা বৃষ রাশির জাতক বা জাতিকা। আবার যারা ২২ মে থেকে ২১ জুন এর মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছেন, তারা মিথুন রাশির জাতক-জাতিকা। যারা ২২ জুন থেকে ২২ জুলাইয়ের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছেন, তারা কর্কট রাশির জাতক-জাতিকা। আর যারা ২৩ জুলাই থেকে ২৩ আগস্টের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছেন, তারা সিংহ রাশির জাতক-জাতিকা, ২৪ আগস্ট থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর এর মধ্যে যারা জন্মগ্রহণ করেছেন তারা হলেন কন্যা রাশির জাতক-জাতিকা। আবার যারা ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ২৩ অক্টোবরের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছেন, তারা তুলা রাশির জাতক-জাতিকা। বৃশ্চিক রাশির জাতক-জাতিকা হলেন যারা ২৪ অক্টোবর থেকে ২২ নভেম্বরের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছেন। ২৩ নভেম্বর থেকে ২১ ডিসেম্বরে জন্মগ্রহণকারীরা ধনু রাশির জাতক-জাতিকা। আর মকর রাশিরা হলেন ২২ ডিসেম্বর থেকে ২০ জানুয়ারির মধ্যে জন্মগ্রহণকারীরা। কুম্ভ রাশি ২১ জানুয়ারি থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি এবং মীন রাশি ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০ মার্চের মধ্যে জন্মগ্রহণকারীরা।
মেষ রাশি  (২১ মার্চ-২০ এপ্রিল) 
দেবতারাজ জিউস একবার মেঘপুঞ্জ থেকে হেরা দেবীর মতো দেখতে এক মেঘনারীর সৃষ্টি করেন এবং নাম দেন নেফিলি। দেবী হেরার নির্দেশে থিবিসের রাজা আথামাস (Athamas) নেফিলিকে বিয়ে করে। আথামাসের ঔরসে নেফিলির গর্ভে ফ্রিক্সাস (Phrixaus) নামে এক পুত্র ও হেলি (Helle) নামে এক কন্যার জন্ম হয়। জিউসের সৃষ্টি হওয়ায় মেঘনারী নেফিলি নিজেকে সব সময় দেবকন্যা ভাবত। ফলে সে আথামাসকে কখনো সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেনি নেফিলির ভালবাসা না পেয়ে অনেকটা বাধ্য হয়েই ক্যাডমাস কন্যা ইনো (Ino) কে বিয়ে করে আথামাস। নেফিলির গর্ভজাত সন্তান ফ্রিক্সাস ও হেলি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিমাতা ইনো তাদের প্রতি ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ে এবং তাদেরকে মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করে হত্যার চক্রান্ত করে। দেবী হেরার সহযোগিতায় দুই ভাইবোন কোনোমতে প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হয়। হেরার নির্দেশে দেবতা হার্মিস (Harmes) তাদেরকে একটি ডানাওয়ালা স্বর্ণমেষ দেয়। এই স্বর্ণমেষের পিঠে চড়ে তারা থিবিস থেকে পালিয়ে যায়। কিন্তু সমুদ্রের উপর দিয়ে উড়ে যাবার সময় স্থির থাকতে না পেরে হেলি হঠাত্‍ সমুদ্রে পড়ে যায়। এরপর ফ্রিক্সাস একা কলচিসে গিয়ে পৌঁছালে সেখানকার রাজা তাকে সাদরে গ্রহণ করে। ফ্রিক্সাসকে বহনকারী স্বর্ণমেষের অনুরোধে স্বর্ণমেষকে দেবতারাজ জিউসের নামে বলি দেয়া হয়। দেবতা জিউস এই স্বর্ণমেষকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তাকে নক্ষত্রমণ্ডলীতে রূপান্তরিত করে আকাশে স্থান করে দেন। নক্ষত্রলোকে স্থাপিত স্বর্ণমেষের প্রতিকৃতিই রাশিচক্রের মেষ রাশির প্রতীক।
বৃষ রাশি  (২১ এপ্রিল-২১ মে) 
স্বর্গ, মর্ত্য, আকাশ ও বায়ুমন্ডলের একচ্ছত্র অধিপতি দেবতা জিউস। সুযোগ পেলেই দেবতা জিউস বিভিন্ন দেবী এবং মানবীর সাথে প্রেমলীলায় মত্ত হতেন। স্ত্রী হেরার ভয়ে বিচিত্র ছদ্মবেশ ধারণ করে গোপন প্রণয়ে লিপ্ত হতেন দেবতারাজ। টায়ারের রাজা এজিনবের কন্যা এবং ক্যাডমাসের বোন ইউরোপা (Europa) ছিল জিউসের মানবী প্রণয়িনীদের মধ্যে অন্যতম। যার নামে নামকরণ হয়েছে ইউরোপ মহাদেশের। কোনো এক বসন্তের সকালে দেবতা জিউসের নজর পড়ে ইউরোপার ওপর। ইউরোপার প্রণয়াকাঙ্ক্ষী হয়ে ওঠেন জিউস। ইউরোপা যখন সমুদ্রতীরে সহচরীদের সাথে খেলা করছিল, তখন দেবতা জিউস এক অপরূপ শ্বেতবৃষের রূপ ধরে চলে আসেন সেখানে। শ্বেতবৃষটিকে দেখে খেলাচ্ছলে ইউরোপা ওটার পিঠে চড়ে বসে। তখন বৃষরূপী দেবতা জিউস ইউরোপাকে পিঠে নিয়ে হঠাত্‍ সমুদ্রের গভীরে চলে যেতে থাকেন এবং নির্জন ক্রীটদ্বীপে এসে উপস্থিত হন। এই ক্রীটদ্বীপেই ইউরোপার সাথে দেবতা জিউস মিলিত হন এবং তাকে সেখানেই রেখে দেন। ইউরোপার সুবিধার্থে তিনি ক্রীটদ্বীপে জনবসতি স্থাপনের ব্যবস্থা করেন। এই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য দেবতারাজ জিউস তার ছদ্মবেশী রূপ শ্বেতবৃষকে নক্ষত্রমন্ডলীতে রূপান্তরিত করে আকাশে স্থাপন করেন। নক্ষত্রলোকের বৃষ প্রতিকৃতিই রাশিচক্রের বৃষ রাশির প্রতীক।
মিথুন রাশি  (২২ মে- ২২ জুলাই) 
গ্রীসের ভুবনমোহিনী রূপসী হেলেন (Helen)-এর দুই সহোদর ক্যাস্টর ও পোলাক্স। এই দুই ভাইকে একত্রে ডায়োস্কিউরি (Dioscuri) বা জিউসপুত্র নামে অভিহিত করা হয়। স্পার্টার রাজা টিন্ডারিউস পত্নী লীডার গর্ভে তাদের জন্ম। ক্যাস্টর ও পোলাক্সের পিতৃপরিচয় নিয়ে মতভেদ রয়েছে। এক কাহিনীতে আছে, ক্যাস্টর ও পোলাক্স দেবতা জিউস ও মর্ত্যসুন্দরী লীডার যমজ সন্তান। অন্য কাহিনীতে আছে, লীডা এবং লীডার স্বামী টিন্ডারিউসেরই যমজ সন্তান তারা। আবার ভিন্ন এক কাহিনীতে আছে, ক্যাস্টর হলো লীডা আর টিন্ডারিউসের সন্তান এবং পোলাক্স হলো লীডা ও দেবতা জিউসের সন্তান। এ কারণে দুই ভাইয়ের মধ্যে শুধু পোলাক্স দেবতা জিউসের কাছ থেকে অমরত্ব লাভ করেছিল। এই দুই বাই জানত তাদের মধ্যে কেউ একজন অমর, কে যে অমর- তা তারা কেউই জানত না। দুই ভাইয়ের মধ্যে অত্যন্ত সদ্ভাব ছিল। দু’জন পরস্পরকে এত ভালবাসতো যে কেউ কারো মৃত্যুশোক সহ্য করার কথা ভাবতেও পারত না।
ক্যাসাটর ও পোলাক্সের দুই চাচাত ভাই ছিল। তাদের নাম আইডাস ও লেনসিউস। এরা দু’জনও ছিল যমজ সহোদর। এদের সঙ্গে লিউসিপাস নামের এক ব্যক্তির দুই কন্যা ফোবি ও হিলাইবা’র বাগদান সম্পন্ন হয়। এই বাগদানের কথা জানা সত্ত্বেও ক্যাস্টর ও পোলাক্স দুই বোনকে অপহরণ করে। ফলে দুই জোড়া যমজের পরস্পরের সঙ্গে ভয়ংকর লড়াই শুরু হয়ে যায়। লড়াইয়ে ক্যাস্টর মারা যায় এবং মরণশীল মানুষ হিসেবে তার আত্মা মৃত্যুপুরী হেডিজে চলে যায়।
এদিকে ভাই ক্যাস্টরের মৃত্যুশোক কিছুতেই ভুলতে পারলো না পোলাক্স। পিতা দেবতা জিউসের কাছে পোলাক্স অনুরোধ করলো যে, ভাইকে মৃত্যুপুরীতে রেখে সে স্বর্গে বা মর্ত্যে অমরত্বের সুখ ভোগ করতে চায় না। পোলাক্সের ভাতৃপ্রীতিতে অত্যন্ত মুগ্ধ হন দেবতা জিউস। তখন জিউস ঠিক করে দেন, যেহেতু মানবসন্তান হিসেবে ক্যাস্টরের চিরকাল স্বর্গে থাকা সম্ভব নয়, সেজন্য পালাক্রমে একদিন করে স্বর্গে এবং পাতালে থাকতে হবে। পরবর্তীতে দেবতা জিউস ক্যাস্টর ও পোলাক্স যমজ দুই ভাইকে অবিস্মরণীয় করার জন্য নক্ষত্রমণ্ডলীতে রূপান্তরিত করে স্থান দেয় নক্ষত্রলোকে। নক্ষত্রলোকে যমজের প্রতিকৃতিই মিথুন রাশির প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত।
তবে মিথুন রাশির প্রতীক নিয়ে একাধিক মতামত রয়েছে। রোমানদের মতে, এরা দু’জন হচ্ছে বীর হারকিউলিস ও অ্যাপোলো। এই মতের পক্ষে দাবী হচ্ছে, দেবতা জিউস এই দুই ভাইকে আকাশে স্থাপন করেছে বিশ্বস্ততা এবং ভাতৃপ্রেমের নিদর্শনস্বরূপ। ভিন্ন আরেক মতে, এই দু’জনের একজন হলো ভাই, অন্যজন হলো বোন। খ্রিষ্টীয় মতে, এদের একজন আদম, অন্যজন ইভ।
কর্কট রাশি  (২২ জুন- ৩৩ জুলাই) 
গ্রীক ও রোমান পুরাণে বীর হারকিউলিসের বারোটি শ্রম বা অ্যাডভেঞ্চারের কথা বিখ্যাত হয়ে আছে। পুরাণে উল্লিখিত বারোটি শ্রমের মধ্য দ্বিতীয় শ্রমটি ছিল লার্নার অরণ্যবেষ্টিত বিশাল জলাভূমিতে বসবাসকারী ভয়ংকর দানব হাইড্রাকে হত্যা করা। হাইড্রার ছিল একদেহে নয়টি মাথা এবং সাপের মতো শরীর। তার একটি মাথা কেটে ফেললে সেখান থেকে একসাথে দুটি মাথা গজাতো। মাঝখানের মাথাটি ছিল অমর। হাইড্রাকে হত্যা করার সংকল্প নিয়ে লার্নার বিশাল জলাভূমিতে গিয়ে পৌঁছাল বীর হারকিউলিস। দানব হাইড্রা ও হারকিউলিসের মধ্যে শুরু হলো মরণপণ লড়াই। হাইড্রা দানব হলেও বেশ কয়েকজন দেবীর প্রিয়ভাজন ছিল। এদের মধ্যে স্বর্গের দেবী এবং হারকিউলিসের বিমাতা হেরাও একজন। এই লড়াইয়ে হাইড্রার অবস্থা শোচনীয় বুঝতে পেরে দেবী হেরা বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি হাইড্রাকে সাহায্য করতে একটি কাঁকড়াকে পাঠিয়ে দিলেন। কাঁকড়াটি নিজের চরম পরিণতির কথা জেনেও হারকিউলিসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হাইড্রাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে গেল। হারকিউলিসের পায়ের গোড়ালিতে কামড় বসিয়ে উদ্যত হতেই মুহূর্তের মধ্যে হারকিউলিস তার পায়ের নিচে ফেলে কাঁকড়াটিকে পিষে মেরে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। এদিকে ক্রমাগত আক্রমণ করে হাইড্রাকে ধরাশয়ী করে ফেলে হারকিউলিস। এরপর দানবটিকে হত্যা করে সে। দানব হাইড্রা ও বীর হারকিউলিসের লড়াইয়ে ক্ষুদ্র প্রাণী কাঁকড়ার বীরত্বপূর্ণ সাহসিকতার জন্য দেবী হেরা তাকে অমর করে রাখতে স্থান দেন আকাশে। নক্ষত্রলোকে স্থাপিত হারকিউলিসের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া কাঁকড়ার প্রতিকৃতিই হলো রাশিচক্রের কর্কট রাশির প্রতীক।

আরো পড়ুন: ইতিহাসের কিছু ভয়ঙ্কর নারী


সিংহ রাশি  (২৩ জুলাই- ২৩ আগস্ট) 
দেবতা জিউসের ঔরসজাত মানবসন্তান হারকিউলিসকে ঘৃণা ও ঈর্ষা করত জিউসের স্ত্রী দেবী হেরা। হেরা সবসময়ই সুযোগ খুঁজতো, কীভাবে হারকিউলিসকে বিপদে ফেলা যায়। ডেলফির মন্দিরের দৈববাণীর নির্দেশে বারো বছরের জন্য চাচাত ভাই রাজা ইউরেস্থিউসের আদেশ পালনে নিযুক্ত হতে হয় সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রীক বীর হারকিউলিসকে। দেবী হেরার প্ররোচনায় ইউরেস্থিউস প্রথম কাজের দায়িত্ব হিসেবে হানকিউলিসকে আদেশ করলো নিমিয়ার অরণ্যের একটি সিংহকে বধ করার জন্য। এটি কোনো সাধারণ সিংহ নয়। সর্পসাদৃশ্য শত মাথা এবং নাক-মুখ থেকে অগ্নিশিখা নির্গমনকারী ড্রাগন দানব টাইফনের রক্ত থেকে জন্ম হয় সিংহটির। সিংহটি ছিল প্রচন্ড হিংস্র এবং রাক্ষুসে। শুধু সাধারণ জনগণই নয়, দেবতারাও তটস্থ থাকত সিংহটার ভয়ে। বহু চেষ্টা করেও মারা যায়নি সিংহটাকে। কারণ কোনো অস্ত্রই বিদ্ধ হতো না তার শরীরে। বরং যে-ই মারতে গেছে, সে-ই উদরস্থ হয়েছে সিংহটার।
নিমিয়ার অরণ্য প্রদেশে গিয়ে বীর হারকিউলিস দু’বার তীর ছুঁড়লো সিংহটাকে। কিন্তু তীর সিংহের শক্ত চামড়া ভেদ করতে ব্যর্থ হয়। তখন হারকিউলিস অলিভ গাছের বিশাল গদা দিয়ে প্রচন্ড আঘাত করতে থাকলে সিংহটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সাথে সাথে হারকিউলিস সিংহটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দুই হাত দিয়ে প্রচন্ড শক্তিতে গলা টিপে ধরে। সে সিংহটার শ্বাসনালী টেনে ছিঁড়ে ফেলে সঙ্গে সঙ্গে মাথা কেটে মৃত্যু নিশ্চিত করে। তারপর সিংহের চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে গায়ে জড়িয়ে এবং সিংহের মাথাটাকে হেলমেটের মতে পরে অ্দ্ভুত বেশে হারকিউলিস মাইসিনী নগরীতে ফিরে আসে। হারকিউলিসের শেষ জীবন পর্যন্ত মাথা দিয়ে তৈরি শিরণাস্ত্রসহ সিংহচর্মটিই ছিল তার প্রিয় যুদ্ধপোশাক।
এই ঘটনাটিকে অমর করে রাখার জন্য দেবতা জিউস নিমিয়ার সিংহটাকে নক্ষত্রমণ্ডলীতে রূপান্তরিত করে আকাশে স্থাপন করে। নক্ষত্রলোকে স্থাপিত নিমিয়ার সিংহের প্রতিকৃতিই রাশিচক্রের সিংহ রাশির প্রতীক।
কন্যা  (২৪ আগস্ট- ২৩ সেপ্টেম্বর) 
সুন্দরী মর্ত্যমানবী করোনিস (Coronis) হচ্ছে ল্যাপিথির রাজকন্যা এবং অলিম্পিয়াসের সবচেয়ে সুদর্শন দেবতা অ্যাপোলোর প্রিয়তমা প্রেমিকা। দেবতা অ্যাপোলো অমর আর মানবী করোনিস মরণশীল। তাই করোনিসের ভাবনা যে, সে যখন বৃদ্ধ হবে, রূপ-যৌবন হারিয়ে যাবে তখন দেবতা অ্যাপোলো নিশ্চয়ই তাকে আর ভালবাসবে না এবং অবহেলার দৃষ্টিতে দেখবে! এ চিন্তাধারার কারণে কুমারী করোনিস তারই মতো একজন মানবসন্তানের সাথে ভালবাসা স্থাপনে আগ্রহী হয়। কারণ তাহলে তার ভালবাসার পাত্র তার সাথে সাথেই বৃদ্ধ, যৌবন হারাবে। ফলে তাকে হীনমন্যতায় ভুগতে হবে না এবং মর্মজ্বালাও সইতে হবে না! তাই করোনিস দেবতা অ্যাপোলোকে উপেক্ষা করে ইলেটাস নামে এক ব্যক্তির সাথে গোপনে সম্পর্কে লিপ্ত হয়। অ্যাপোলো করোনিসের উপর নজর রাখার জন্য একটি কাককে নিযুক্ত করেছিল। সেই কাক অ্যাপোলোকে করোনিসের গোপন প্রণয়ের কথা জানিয়ে দেয়। এই সংবাদ শুনে দারুণ ক্ষিপ্ত হয়ে অ্যাপোলো তার সংবাদবাহক কাককেই অভিশাপ দিয়ে বসে! কাকটির রং ছিল সাদা। দেবতা অ্যাপোলোর অভিশাপে কাকটির রং হয়ে গেল কালো। তখন থেকেই সকল কাক কালো, নোংরা পাখিতে পরিণত হলো। এরপর দেবতা অ্যাপোলো তার নিজ প্রেমিকা করোনিসকে ইলেটাসের প্রণয়ে আসক্ত হবার অপরাধে দেবী আর্টেমিসের দ্বারা হত্যা করায়। করোনিসের মৃতদেহ দেখার পর তার খুব অনুশোচনা জাগে। কারণ সেসময় দৈবশক্তি বলে অ্যাপোলো জানতে পারে যে তার আগেকার প্রণয়লীলার পরিণতিতে করোনিসের গর্ভে তারই ঔরসজাত সন্তান বেড়ে উঠছিল। শোকার্ত চিত্তে দেবতা অ্যাপোলো তখন দেবতা হার্মিসকে নির্দেশ দিলো গর্ভস্থ সন্তানকে বের করে আনার জন্য। করোনিসের গর্ভের সন্তান তখনো জীবিত ছিল। দেবতা অ্যাপোলো সন্তানটির নাম রাখল এসক্লেপিয়াস। এই ঘটনাকে অমর করে রাখার মানসে দেবতা অ্যাপোলো কুমারীমাতা করোনিসকে নক্ষত্রমণ্ডলীতে রূপান্তরিত করে আকাশে স্থাপন করে। নক্ষত্রলোকে স্থাপিত কুমারী করোনিসের প্রতিকৃতিই হলো রাশিচক্রের কন্যা রাশির প্রতীক।
তুলা রাশি  (২৪ সেপ্টেম্বর- ২৩ অক্টোবর) 
শিয়ালমুখো দেবতা আনুবিস (Anubis) মৃত দেহ সমাহিত হওয়ার পর মৃত ব্যক্তির আত্মা মাপার জন্য এক পাল্লায় আত্মা রেখে অন্য পাল্লায় একটি পালক রেখে মাপের কাজটি সম্পন্ন করে। অন্য পাল্লায় রাখা এই পালকটি হলো সত্য বা পূণ্যের প্রতীক। মাপন প্রক্রিয়া শেষ হবার পর আনুবিস মৃত ব্যক্তির আত্মা দেবতা ওসিরিসের সভায় বিচারের জন্য নিয়ে যায়। মিশরীয় পুরাণে অন্যতম একজন দেবতা ওসিরিস (Osiris) পৃথিবী দেবতা গেব ও আকাশদেবী নুটের পুত্র।
দ্য হল অব ডাবল জাস্টিস (the hall of double justice)- এর সভাকক্ষে দেব-দেবীর উপস্থিতিতে ওসিরিসের সভাপতিত্বে মৃতের আত্মা মাপার আনুষ্ঠানিক কাজ সম্পন্ন হয়। মাপন প্রক্রিয়ার ফলাফল লিপিবদ্ধ করে দেবতা থত (Thoth)। ফলাফল সন্তোষজনক হলে ওসিরিস মৃত আত্মাকে অনন্ত জীবনে প্রবেশ করার অনুমতি দেয়। আর ফলাফল সন্তোষজনক না হলে মৃতের আত্মাকে ডিভাওরার (devourer) নামক বিভৎস জন্তু দ্বারা ভক্ষণ করানো হয়। অনন্তকাল ধরে এই মৃত আত্মার জন্ম-জন্মান্তরের চলাচল এবং মানবজীবনে ন্যায়বিচার, সাম্য ও সমঝোতার তুলাদন্ডের ভূমিকাকে অবিস্মরণীয় করে রাখার জন্য এর প্রতিকৃতি নক্ষত্রলোকে স্থাপন করা হয়। নক্ষত্রলোকে তুলাদন্ডের প্রতিকৃতিই রাশিচক্রের তুলা রাশির প্রতীক।
বৃশ্চিক রাশি (২৪ অক্টোবর- ২২ নভেম্বর)
অরিয়ন (Orion) ছিল মর্ত্যমানবদের মধ্যে সবচেয়ে সুদর্শন। সমুদ্র দেবতা পোসাইডনের ঔরসে ইউরেলির গর্ভে তার জন্ম। অরিয়ন একজন সুদক্ষ শিকারী। অরণ্যচারী চিরকুমারী চন্দ্রদেবী আর্টেমিস বা ডায়ানার সাথে গভীর প্রণয় ছিল অরিয়নের। এই অরিয়নের মৃত্যুকাহিনীর সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত বৃশ্চিক রাশির প্রতীকের কাহিনী। অরিয়নের মৃত্যু নিয়ে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে। এক কাহিনীতে আছে, অ্যাটলাস কন্যা প্লিয়াডিজের পিছু করায় ক্ষুব্ধ দেবতারা অরিয়নকে হত্যা করে। অন্য কাহিনীতে আছে, চন্দ্রদেবী আর্টেমিসের সঙ্গে প্রেমে জড়ালে ক্ষিপ্ত দেবতা অ্যাপোলোর চক্রান্তে অরিয়ন দেবী আর্টেমিসের হাতেই তীরের আঘাতে নিহত হয়। আরেক কাহিনীতে আছে, ঊষা দেবী ইওস (Eos) অরিয়নের প্রেমে পড়লে অরিয়ন আর্টিমিসকে এড়িয়ে চলতে থাকে। সে কারণে আর্টেমিসকে দংশন করার জন্য দেবী আর্টেমিস বৃশ্চিক পাঠায়। অন্য এক গল্পে বর্ণিত, অরিয়ন গর্ব করে বলতো, ধরণীর বুকে যত বন-জঙ্গল আছে, তার সমস্ত জন্তু-জানোয়ারদের সে বধ করবে এবং সে ক্ষমতা তার আছে। দেবতা অ্যাপোলো ধরিত্রী মাতাকে জানালো যে, অরিয়ন ধরিত্রীর বুক থেকে সব জন্তু-জানোয়ার বধ করবে বলে আস্ফালন করে বেড়াচ্ছে। এবং সেই সাথে এও বললো, অবিলম্বে অরিয়নকে বধ করা দরকার। ধরিত্রী মাতা তখন এই অহংকারী ঘোষণার কথা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে এক বৃশ্চিককে অরিয়নের পেছনে লেলিয়ে দেয়। বৃশ্চিকের দংশনে অরিয়নের মৃত্যু হয়। অরিয়নের মৃত্যুর পর চন্দ্রদেবী আর্টেমিস এই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য অরিয়নকে নক্ষত্রমণ্ডলীতে রূপান্তরিত করে আকাশে স্থাপন করে। পুরাণে কথিত আছে, নক্ষত্রলোকে আজও অরিয়নকে এক বিরাট বৃশ্চিক তাড়া করে বেড়াচ্ছে। নক্ষত্রলোকে বৃশ্চিকের প্রতিকৃতিই রাশিচক্রে বৃশ্চিক রাশির প্রতীক।
ধনু রাশি (২৩ নভেম্বর- ২১ ডিসেম্বর) 
অদ্ভুত দেহবিশিষ্ট শংকর প্রাণী সেন্টুর (Centaur)। সেন্টুরদের বুক থেকে মাথা পর্যন্ত মানুষের মতো আর বাকি অংশটুকু অশ্বাকৃতির। এই সেন্টুরদের মধ্যে একজন মহাজ্ঞানী কাইরন (Chiron)। দেবতা অ্যাপোলো ও চন্দ্রদেবী আর্টেমিসের কাছে কাইরন বিদ্যার্জন করে। কাইরনের খ্যাতি দেশ-বিদেশ ও দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। শুধু সাধারণ মানুষই নয়, রাজা-রাজন্যবর্গ, বীর-মহারথীরাও নীতি উপদেশ ও বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে আসতো কাইরনের কাছে। অনেকেই এই মহাজ্ঞানী, অভিজ্ঞ কাইরনের কাছে তাদের ছেলেদের রেখে আসতো মানুষের মতো মানুষ হবার জন্য। সুতরাং যেসব রাজপুত্র, যুবক কাইরনের প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে থাকতো, তারা সত্যিই ভাগ্যবান। তাদের শরীর, মন, বিদ্যা শিক্ষা এবং চরিত্র একই সাথে সুগঠিত ও সমৃদ্ধ হয়ে উঠতো। জ্যাসন, হারকিউলিস, অরিয়ন, এসক্লেপিয়াস, এক্কিলিস প্রমুখ বীরপুরুষরা কাইরনেরই ছাত্র ছিল।
মহাজ্ঞানী কাইরনের জীবনের অবসান ঘটেছিল খুবই মর্মান্তিক ভাবে। একদিন পান ভোজনের অনুষ্ঠানে দুর্ঘটনাবশত দানব হাইড্রার বিষাক্ত রক্তমাখা হারকিউলিসের একটি তীর কাইরনের শরীরে বিদ্ধ হয়ে যায়। এই বিষক্ষত কোনো ওষুধেই নিরাময় হয়নি। বিষক্রিয়ার ফলে কাইরনের জীবন অসহনীয় ওঠে। হাইড্রার বিষাক্ত রক্তমাখা তীর বিদ্ধ হলে কেউ বাঁচতে পারতো না। কিন্তু কাইরনের মৃত্যু হচ্ছিল না, কারণ সে দৈববলে অমর ছিল। এই অমরত্ব কাইরনকে উভয় সংকটে ফেলে দেয়। এখন না সে তার চিরস্থায়ী ক্ষত নিরাময় করে বেদনার উপশম ঘটাতে পারে, না সেচ্ছামৃত্যু চাইতে পারে! শেষ পর্যন্ত এই সমস্যার সমাধান হয়। স্বর্গ থেকে মানুষের কল্যাণে আগুন চুরি করে পৃথিবীতে আনার অপরাধে প্রমিথিউসকে পাতালে নির্বাসন দেয়া হয়েছিল। শর্ত ছিল, কেউ তার শাস্তি গ্রহণ করলে প্রমিথিউস মুক্তি পাবে। কাইরন প্রমিথিউসের সাথে স্থান বদল করে মৃত্যুকে গ্রহণ করে। দেবতা জিউস এই মহাজ্ঞানী কাইরনকে নক্ষত্রমণ্ডলীতে রূপান্তরিত করে আকাশে স্থাপন করে। নক্ষত্রলোকে কাইরনের অর্ধমানব এবং অর্ধঅশ্বের প্রতিকৃতি রাশিচক্রে ধনুরাশির প্রতীক।
মকর রাশি (২২ ডিসেম্বর- ২০ জানুয়ারি) 
প্যান (Pan) ছিল কিম্ভূত কিমাকার চেহারার এক দেবতা। প্যানের মাথাটা ছিল পশুর মতো শিংওয়ালা এবং দেহের নিচের অংশটুকু ছিল ছাগলের মতো। কোনো কোনো পুরাণমতে প্যান ছিল দেবরাজ জিউসের পুত্র। আবার কোনো কোনো পুরাণে উল্লেখ আছে, প্যান দেবতা হার্মিসের ঔরসজাত। কিন্তু প্যানের মা কে, এ নিয়ে মতভেদ আছে প্রচুর। প্যানের মা যে-ই হোক না কেন, প্যান ভূমিষ্ট হওয়ার পর তার বীভত্‍স চেহারা দেখে তাকে ত্যাগ করে। অলিম্পিয়াস স্বর্গরাজ্যে দেবতা প্যান স্থান পায়নি কখনো। সারাজীবন তাকে আর্কেডিয়াতেই কাটাতে হয়। প্যানকে তুচ্ছ করলেও তার শক্তি ও প্রতিভাকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করতো দেবতারা। ভবিষ্যত বলার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল প্যানের। তার কাছ থেকে এই বিদ্যা তাকে ভুলিয়ে শিখে নেয় দেবতা অ্যাপোলো। নলখাগড়া থেকে প্যান তার বিখ্যাত প্যানপাইপ বা সাইরিনিক্স বাঁশি তৈরি করতো। দেবতা হার্মিস তার কাছ থেকে শিখে নেয় বাঁশি তৈরির করার কৌশল।
গ্রীক পুরাণে পৃথিবীর সবচেয়ে কুখ্যাত, ভয়ংকর অত্যাচারী দানব হচ্ছে শত মাথাবিশিষ্ট দানব টাইফন (Typhon)। তার প্রতিটি মুখ থেকেই অগ্নিশিখা বের হয়। মানুষ তো বটেই, দেবতারাও টাইফনের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল। টাইফনের শক্তির কাছে মানুষ, দেবতা কেউ-ই পেরে উঠছিল না বলে আত্মরক্ষার খাতিরেই সবাই আপোস করে দিন কাটাচ্ছিল। তারপরও টাইফনের সামনে হঠাত্‍ করে পড়ে গেলে খুব কম দেবতাই পালাতে সক্ষম হতো। কারণ টাইফনের ক্ষীপ্র গতির সাথে পেরে ওঠা ছিল খুবই কঠিন ব্যাপার। একদিন ঘটনাক্রমে হঠাত্‍ প্যান পড়ে যায় দানব টাইফনের সামনে। প্যান অনেকটা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে আজ তার আর রক্ষা নেই! তবু শেষ চেষ্টা হিসেবা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে। টাইফনও পিছু নেয় প্যানের। টাইফনের সাথে গতিতে পেরে উঠছিল না প্যান। যখন প্রায় ধরা পড়ে যাবে যাবে অবস্থা, সেই মুহূর্তে প্যান তার শরীরের নিচের অংশকে মাছের লেজে রূপান্তরিত করে দ্রুত বেগে সাঁতার কেটে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। মাছের মতো গতির সাঁতারে প্যানকে ধরতে ব্যর্থ হয় দানব টাইফন। রক্ষা পায় দেবতা প্যান। অভূতপূর্ব এই ঘটনার স্মৃতি অমর করতে প্যানকে নক্ষত্রমণ্ডলীতে রূপান্তরিত করে স্থান দেয়া হয় আকাশে। নক্ষত্রলোকে স্থাপিত প্যানের এই ঊর্ধ্বাংশ ছাগল ও নিম্নাংশ মত্‍স্যলেজ আকৃতির প্রতিকৃতিই রাশিচক্রের মকর রাশির প্রতীক।
কুম্ভ রাশি (২১ জানুয়ারি- ১৮ ফেব্রুয়ারি) 
গ্রীক পুরাণে কুম্ভ রাশির প্রতীকের নেপথ্য কাহিনী হিসেবে দুটি আলাদা ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। এক কাহিনীতে, ট্রয় নগরীর প্রতিষ্ঠাতা ট্রসের পুত্র গ্যানিমেড (Ganymede) অতুলনীয় রূপের অধিকারী ছিল। গ্যানিমেডের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ঊষা দেবী ইওস (Eos) অপহরণ করে নিয়ে যায় তাকে। পরে ইওসের কাছ থেকে গ্যানিমেডকে দেবতা জিউস নিয়ে যায় এবং নিজ কন্যা হীবি (Hebe)-এর স্থলাভিষিক্ত করে মদ ও অমৃত পরিবেশনকারী হিসেবে নিযুক্ত করে। এই ঘটনাতে জিউসের স্ত্রী দেবী হেরা প্রতিহিংসাপরায়ণ ও ক্রুদ্ধ হয়। দেবী হেরার চক্রান্তেই শেষ পর্যন্ত গ্যানিমেডের মৃত্যু হয়। গ্যানিমেডের মৃত্যুতে দেবতা জিউস বিশেষভাবে ক্রুদ্ধ হন এবং পরে কুম্ভবহনরত গ্যানিমেডের প্রতিকৃতি নক্ষত্রলোকে স্থাপন করে। নক্ষত্রলোকে কুম্ভবহনরত গ্যানিমেডের প্রতিকৃতিই রাশিচক্রের কুম্ভ রাশির প্রতীক।
অন্য আর এক কাহিনীতে আছে, বহুকাল আগে মর্ত্যলোকে কোনো বৃষ্টি হচ্ছিল না। পৃথিবীতে পানির অভাবে প্রাণের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন। সবার দৃষ্টি আকাশের দিকে। প্রতিটি প্রাণী স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছে পানির জন্য। স্বর্গলোকের দেবতারা মর্ত্যমানবদের এই দুর্ভোগের কথা ভেবে মৃত্‍কলসী ভর্তি পানি ধরণীর বুকে ঢালতে শুরু করলো। ধরণী আবার প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠলো। এই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার উদ্দেশ্যে দেবতারা নক্ষত্রলোকে কুম্ভবহনরত প্রতিকৃতি স্থাপন করলো। রাশিচক্রে কুম্ভবহনরত প্রতিকৃতিই কুম্ভ রাশির প্রতীক।
মীন রাশি (১৯ ফেব্রুয়ারি- ২০ মার্চ) 
গ্রীক পুরাণ অনুযায়ী পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহদাকার ও কুখ্যাত দানব টাইফন (Typhon)। টাইফন একশত মাথাবিশিষ্ট ড্রাগন আকৃতির দানব। তার প্রতিটি মুখ থেকে অগ্নিশিখা বের হয়। এই দানবটি মানুষের জন্য যেমন ভয়ংকর ছিল, তেমনি ছিল দেবতাদের জন্যেও। টাইফন সব সময় ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়াতো। কারো সুখ-সমৃদ্ধি, শান্তি সে সহ্য করতে পারতো না।
একবার টাইফন সিদ্ধান্ত নিলো যে, সে দেবতাদের তাড়িয়ে দিয়ে নিজের রাজত্ব কায়েম করবে স্বর্গরাজ্য অলিম্পাসে। ফলে একদিন হঠাত্‍ দেবতাদের আবাসস্থল মাউন্ট অলিম্পাসে হামলা চালালো টাইফন। দেবতারা পালানোর কোনো সুযোগ না পেয়ে প্রত্যেকে কোনো না কোনো জন্তুতে রূপান্তরিত হয়ে পালিয়ে রক্ষা পেল। দেবতা জিউসও নিজেকে বাঁচাতে ভেড়ার রূপ ধারণ করেছিল। প্রেমের দেবী আফ্রোদিতি এবং তার পুত্র এরস (কিউপিড) এক জোড়া মত্‍স্যের রূপ ধারণ করে ইউফ্রেতিস নদীতে নেমে পালিয়ে যায়। দেবী অ্যাথেনা (মিনার্ভা) এই ঘটনাকে স্মরণীয় করার জন্য এক জোড়া মত্‍স্যকে নক্ষত্রমণ্ডলীতে রূপান্তরিত করে আকাশে স্থাপন করে। নক্ষত্রলোকে একজোড়া মত্‍স্যের প্রতিকৃতিই রাশিচক্রের মীন রাশির প্রতীক।
সভ্যতার অগ্রযাত্রা, ধর্মচর্চা, পুরাণের কালজয়ী জীবনভিত্তিক বর্ণনা, শিল্পকলা এবং নিরন্তর বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন – এ সব কিছু মানুষের কল্যাণের জন্যই। তবে প্রাচীন রাশিশাস্ত্রকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কখনোই গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এমনকি, মিথ-পুরাণের সাথে যে জ্যোতিষবিদ্যার সম্পর্ক আছে – এ বিষয়টিকেও গুরুত্বের সাথে নেয়া হয়নি। কিন্তু বর্তমানে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির উদারতার কারণে রাশিশাস্ত্রে পৌরাণিক কাহিনীর ভূমিকা এখন প্রায় সর্বজনবিদিত।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত