আজ ১৪ই আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস – ভাবছেন আমি দেশদ্রোহী! যেখানে আগামীকাল আমাদের স্বাধীনতা দিবস সেখানে হঠাৎ পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস নিয়ে পড়লাম কেন? আসলে এই দুটো ঘটনা যে একে অপরের সাথে ভীষণ ভাবে জড়িয়ে আছে, একথা আমাদের মানতেই হবে। শুধু তাই নয় এর সাথেই জড়িয়ে আছে ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায় : দেশভাগ আর দাঙ্গা।


অবিভক্ত ভারত


তারপর ৭৩ বছর হয়ে গেলেও স্বাধীনতার এত বছর পরেও হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা,মন্দির মসজিদ নিয়ে রাজনীতি আজও ভারতবর্ষের পিছু ছাড়েনি। তবে এই সমস্যা কেবলমাত্র স্বাধীনতার পরে বা স্বাধীনতার সমসাময়িক কালেই যে সীমাবদ্ধ থেকেছে তা নয়। বহু যুগ থেকেই ভারতবর্ষে হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক বারবার প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়েছে – সে মধ্যযুগেই হোক বা ইংরেজ সমসাময়িক যুগেই হোক। যদিও অমর্ত্য সেন তাঁর ‘তর্কপ্রিয় ভারতীয়’ গ্রন্থে এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন যে মধ্যযুগে ধীরে ধীরে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের উন্নতি হয়েছিল। তবে অন্যত্র রমেশচন্দ্র মজুমদার এবং সৈয়দ মুজতবা আলীর বক্তব্য থেকে এই ভাবনা উঠে আসে যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের কোনো উন্নতি মধ্যযুগে ঘটে নি। এর পাশাপাশি আবার বলা চলে রবীন্দ্রনাথ, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখেরা মনে করেছিলেন যে দেশের অভ্যন্তরীণ ধর্মসম্প্রদায় গুলির সম্পর্কের অবনতির পিছনে শাসকের প্রভাব ছিল অনস্বীকার্য। সেই কারণেই তাঁদের মতে, হিন্দু মুসলমান সম্পর্কের অবনতির কারণের পিছনে পরবর্তীকালে শাসক হিসাবে ইংরেজদের গুরুত্ব ও প্রভাব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।


Tryst with Destiny, ভাষণরত স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু, ১৫ ই আগস্ট ১৯৪৭


তবে যদিও হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা বলতে গেলেই আমরা প্রথমেই স্বাধীনতা সমসাময়িক দেশভাগ ও দাঙ্গার কথা উল্লেখ করে থাকি। কিন্তু এই দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িক বিভাজন ১৯৪৭-এর বহু আগে থেকেই ভারতীয় সমাজে এক সুদূর প্রসারী প্রভাব ফেলেছিল। আঠারো শতকে শুরুর দিকেই; ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় মুসলমানদের পক্ষ থেকে একটি শুদ্ধিকরণ প্রন্থা অবলম্বন করা হয়েছিল বলে শোনা যায়। এরপরেও ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মহামেডান এসোসিয়েশন’ এবং এর কিছু পরেই আনুমানিক ১০ বছরের মধ্যে হিন্দুদের পক্ষ থেকেও ‘হিন্দু মেলা’ নামক একটি সংগঠন গড়ে তোলা হয়। প্রাথমিক ভাবে এই সংগঠনগুলি ধর্মীয় বিভাজনের পৃষ্ঠপোষকতা না করলেও, এই পদক্ষেপ গুলির মধ্যে দিয়ে ভবিষ্যতের সাম্প্রদায়িকতার বীজ রোপিত হয়েছিল। পরে এই ছিদ্রপথেই আলিগড় আন্দোলনের পথ ধরে সৈয়দ আহমেদ খান প্রথম মুসলমানদের জন্য দ্বিজাতিতত্ত্বের উল্লেখ করেন। যদিও কংগ্রেস পার্টি সেই সময় থেকে সুদূর ভবিষ্যৎ পর্যন্ত সর্বভারতীয় অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হিসাবে সবসময়ই হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের বিপক্ষে কাজ করেছে। এমনকি কংগ্রেস পার্টি তে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী কালে বহু বিশিষ্ট পদে মুসলমান নেতারা অধিষ্ঠিত ছিলেন।

সে যাই হোক ফিরে আসা যাক দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রসঙ্গে, এই ভাবনার হাত ধরেই ১৯৩৩ সালে রহমত আলি’র বক্তব্যে প্রথম ‘পাকিস্তান’ শব্দটি প্রকাশিত হয়। এখানেই শেষ নয় অবশেষে ১৯৪০সালের মুসলিম লীগের লাহোর  অধিবেশনে মহম্মদ আলি জিন্না ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ ঘোষণা করেন – ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ এই স্লোগানে ভারতীয় রাজনীতি এক নতুন দিকে মোড় নেয়।
তবে এর আগেও বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ঘটেছিল।


পাকিস্তানের জন্ম, ভাষণরত পাকিস্তানের ‘কায়েদ-ই-আজম’ মহম্মদ আলি জিন্না, ১৪ই আগস্ট ১৯৪৭


যেগুলির উল্লেখ না করলে ইতিহাসের প্রতি তথা সত্যের প্রতি অন্যায় করা হবে। মুসলিম লীগের নেতাদের ভাবনায় পাকিস্তান ধারণা জন্ম নেওয়ার বহু আগে থেকেই ভারতে হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল। ১৯২৬ সালে ভারতবর্ষে ১১৫ টি দাঙ্গা হয় বলে জানা গিয়েছে। এরপর ১৯৩০ সালে ঢাকা শহর এক ভয়াবহ দাঙ্গার সাক্ষী থেকেছে। এছাড়াও এই বছরেই ঘটেছিল ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ – আমরা ইতিহাসের বই থেকে এই ঘটনাকে যতটা জানি তারপরেও কিছু গল্প বা বলা ভালো কিছু সত্য ঘটনা বাকি থেকে যায়। ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল এই চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন। কিন্তু এটি ঘটার পর চট্টগ্রাম অঞ্চলে মুসলমানদের কাছ থেকে ভীষণ রকম বিরূপতা পেয়েছিলেন এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বিপ্লবীরা। এই একই বছরেই মহম্মদ ইকবাল ‘মুসলিম ফেডারেশনে’র প্রস্তাবও এনেছিলেন। এরপর আসি ১৯৩৫ সালের ‘ভারত শাসন আইন’ প্রবর্তনের প্রসঙ্গে – যখন এই আইন প্রবর্তিত ও প্রচলিত হয় তখন মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল মুসলমানদের সংরক্ষিত ভোটাধিকারের কথা এবং পরবর্তীকালে ১৯৩৭ সালে তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে যে সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল, তাতে এই সংরক্ষিত ভোটাধিকারের মাধ্যমেও মুসলিম লীগ জিততে পারেনি। এমনকি কংগ্রেস সেই নির্বাচনে পরাজিত হয়। অপরদিকে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন ‘কৃষক প্রজা পার্টি’ জয় যুক্ত হয়েছিল। কিন্তু এই প্রসঙ্গে এ কথাও উল্লেখ করতে হবে যে, ফজলুল হক কংগ্রেস পার্টি কে জোট গঠন করার আহ্বান জানালেও সেই মুহূর্তে কংগ্রেস জোট গঠনে অস্বীকৃত হয়। এই ঘটনা সেই সময়ে দাঁড়িয়ে ভারতীয় রাজনীতিতে একটি ঐতিহাসিক ভুল ছিল। কারণ এই পথ ধরেই মুসলিম লীগ আরও ব্যাপক ভাবে প্রসার লাভ করেছিল।


গান্ধী ও জিন্না


অবশেষে আজাদ হিন্দ বাহিনীর কার্যকলাপের পরিসমাপ্তি, নেতাজির অন্তর্ধান এবং মৃত্যু রহস্য, ভারত ছাড়ো আন্দোলন, ‘৪৬-এ নৌ বিদ্রোহ এইসব কিছুর পর যখন ভারতীয়রা কিছুটা হলেও অনুমান করেছিল যে স্বাধীনতার বুঝি আর দেরী নেই -তখনই ১৯৪৫-‘৪৬ সাল নাগাদ সরাসরি পাকিস্তানের দাবিতে মুসলিম শক্তি সঙ্ঘবদ্ধ হতে থাকে। তারই ফলে মানিকতলার কাছাকাছি কারবালা ট্যাংক লেনে ভয়াবহ দাঙ্গার সূত্রপাত হয়।এই প্রসঙ্গে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছেন যে, এই দাঙ্গায় হিন্দু মুসলিম উভয় পক্ষের ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপক আকার ধারণ করে। এই দাঙ্গা গ্রেট “ক্যালকাটা কিলিং” নামে কুখ্যাত হয়‌। সরকারি ভাবে এই দাঙ্গায় মারা গিয়েছিল ৫০০০জন মানুষ বেসরকারিভাবে সংখ্যাটি প্রায় ১০,০০০। এরপর কলকাতার এই দাঙ্গার প্রতিশোধ হিসাবে নোয়াখালিতে শুরু হয় আর এক ভয়াবহ দাঙ্গা। যেখানে মারা গিয়েছিল হাজার হাজার মানুষ। জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয় ২০০০ হিন্দুকে। অবশেষে স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী নোয়াখালিতে যান এবং তাঁর অনুরোধেই এই দাঙ্গা কিছুটা হলেও প্রশমিত হয়েছিল।দাঙ্গার প্রতিশোধ এবং আবার দাঙ্গা – এই পরিস্থিতি তখন প্রায় আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ছে। তাই নোয়াখালির পর বিহারের শাহাবাগ অঞ্চলে দাঙ্গার আগুন বিস্ফারিত হয়।


নোয়াখালি


বাস্তবের মাটিতে তখন সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন।আর তারই পাশাপাশি চলছিল ঠান্ডা ঘরের ঠান্ডা মাথার রাজনীতি। যেখানে জিন্না ও নেহেরু নিজেদের ক্ষমতা ভাগ বাটোয়ারার এক ঘৃন্য নেশায় মেতেছিলেন।
স্বাধীনতার একবছর আগে ‘৪৬ সাল থেকেই দাঙ্গার আকার এত ভয়াবহ হতে থাকে। গোটা দেশজুড়ে মৃত্যু মিছিল, অবশেষে কংগ্রেসের উচ্চ স্তরের নেতারা গান্ধীজিকে দেশভাগ মেনে নেওয়ার অনুরোধ জানান। যদিও প্রথম থেকেই গান্ধীজি দেশভাগের বিপক্ষে ছিলেন। শোনা যায় সেই সময়কার ভারতের পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখেই এক প্রকার বাধ্য হয়েই গান্ধীজি কে মেনে নিতে হয়েছিল দেশভাগ। কিন্তু তিনি বলেছিলেন যে সুভাষচন্দ্র থাকলে হয়তো এই দেশভাগ আটকানো যেত।


মহাত্মা ও নেতাজি


যাই হোক, বহু তর্ক-বিতর্কের পর শেষ পর্যন্ত দেশভাগ আটকানো যায়নি! আমাদের স্বাধীনতার আনন্দের সাথে সাথেই ভারতীয় উপমহাদেশের বুকে এক গভীর ক্ষত হয়ে নেমে এসেছিল দেশভাগের অভিশাপ।
তবে রাজনৈতিক চক্রান্ত যে তখন কেবল কংগ্রেস নেতাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়।সেই অস্থির পরিস্থিতিতে ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে গিয়েছিল সেই সময়কার বাংলার আঞ্চলিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাও । সেই সময়ের বাংলার প্রধান শাসক ছিলেন সুরহাবর্দী – তিনি চেয়েছিলেন ‘স্বাধীন বঙ্গ’ গঠিত হোক।শরৎ বোস’ও প্রাথমিক ভাবে তা সমর্থন করেছিলেন। যদিও এক্ষেত্রে ভীষণভাবে আপত্তি তোলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, মেঘনাথ সাহা সহ অন্যান্য বিশিষ্টজনেরা। কারণ, দেশভাগ অনিবার্য ছিল।


জওহরলাল নেহেরু ও মহাত্মা গান্ধী


আর সেই জন্যই ইংল্যান্ড থেকে আনা হলো র‍্যাডক্লিফ সাহেবকে। যিনি দিল্লিতে বসে বানালেন দ্বিখণ্ডিত ভারতের মানচিত্র। আমার আপনার মত বহু মানুষের উঠোন, আমবাগান, তালসারি, নারকেল গাছ, রান্নাঘরের,স্নানঘর,পায়খানার উপর দিয়ে চলে গেল সেই মানচিত্রের সীমারেখা। দেশভাগ হয়ে গেল। শুধু দেশ নয়, ভারতের  দুটি প্রদেশ উত্তর-পশ্চিমে পাঞ্জাব ও পূর্বে বাংলা কেও দু ভাগ করে দেওয়া হল। এরই ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই সমগ্র দেশে দাঙ্গা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। একে উদ্বাস্তু সমস্যা, তার উপরে দাঙ্গা!সেই সময় গোটা দেশে উৎখাত হয়েছিলেন এক কোটি মানুষ। মারা গেলেন ৬ লক্ষেরও বেশি। অগণিত মহিলা ধর্ষিত হলেন।

এই হল স্বাধীন ভারতবর্ষের প্রথম চিত্র। যে স্বাধীনতা নিয়ে আজ আমরা উৎসব করি, রক্তদান শিবির করি! সেই স্বাধীনতার শুরুটা কিন্তু এমনই ছিল সেদিন। কলকাতায় চলছে ভয়াবহ দাঙ্গা। পাশাপাশি পাঞ্জাবে চলছে নৃশংস শিখ নিধন। দিল্লিতে হত্যা করা হচ্ছে হাজার হাজার মুসলমানকে।
কিন্তু তারপর!


” কেন চেয়ে আছ গো মা ?” – ১৯৪৭ এর দেশভাগের পরের দাঙ্গা


স্বাধীনতার অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলেও, ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং সমস্যা কোনটাই দূর হয়নি। কোনো সরকারই এ বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল করেছে অতিরিক্ত সংখ্যালঘু তোষণ, আর নয়তো কেউ হিন্দুত্ববাদকেই পরিপুষ্ট করেছে। কিন্তু এইসব এর মাঝে পড়ে আসলে বারবার রক্তাক্ত হয়েছে আমার আপনার ভারত – ৭৩ বছরের স্বাধীন ভারতবর্ষ। যে ভারতবর্ষে আজও আমরা যতই হিন্দু মুসলিম কে ভাই ভাই বলি না কেন; আমাদেরই মনের গভীরে অন্ধকার জমে আছে। তাই আমরা ভুলে গেছি যে এই দেশে আকবর যেমন ছিলেন তেমনি ছিলেন সমুদ্র গুপ্ত বা হর্ষবর্ধন। সেই কারণেই হয়তো দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বারবার দাঙ্গায় রক্তাক্ত হয়েছে আমার আপনার মাতৃভূমি। ১৯৬৮ থেকে ‘৮২ পর্যন্ত সর্বনিম্ন দাঙ্গার ঘটনা সংখ্যা ১৬৯ আর সর্বোচ্চ ৫২১। এরপর ‘৮৩তে ঘটে অসমের ভয়াবহ নেইলীর দাঙ্গা। যে দাঙ্গায় মারা গিয়েছিল ৪০০০ মানুষ। তারপর ১৯৮৪ সালে ঘটে এক মর্মান্তিক ঘটনা – ভারতীয় রাজনীতিতে ঘাটে ইন্দ্রপতন; ইন্দিরা গান্ধী নিহত হন তাঁরই নিজস্ব শিখ দেহরক্ষীর হাতে। এর ফলে শুধুমাত্র দিল্লিতেই মারা যায় ৩৫০০ শিখ। এছাড়াও সমগ্র দেশের ৪০টি শহরে  ১৭০০০ শিখকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।


১৯৮৪ এর শিখ দাঙ্গা


এখানেই শেষ নয় ‘৮৬-‘৮৭ সালে দেশে দাঙ্গার ঘটনার সংখ্যা ৬১২। এর পরের ধাপে অর্থাৎ ‘৯০- ‘৯২ সালে ‘অযোধ্যা কান্ড’ কে কেন্দ্র করে সমগ্র দেশব্যাপী এক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি তৈরি হয়। এই ঘটনা পরিপ্রেক্ষিতেই ভারতবর্ষের বুকে চিরস্থায়ী ক্ষত হিসাবে ২০০২ সালে ঘটে যায় ভারতবর্ষের সাম্প্রতিকতম শেষ ভয়াবহ দাঙ্গা – যেটি ‘গুজরাট দাঙ্গা’ নামে কুখ্যাত। এই দাঙ্গায় সরকারি হিসাবে মারা গিয়েছিল ১০০০জন মানুষ, বেসরকারি হিসাবে ২০০০ জন। এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দিল্লিতে ঘটে যাওয়া দাঙ্গার ঘটনা আমরা সবাই জানি।


২০০২ এর গুজরাট দাঙ্গা


ফেব্রুয়ারি ২০২০, দিল্লি।


এইভাবে ভারতের স্বাধীনতার বহু আগে থেকে আজ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক সমস্যা ও দাঙ্গা ঘনীভূত ‌হয়েছে এবং ঘটছে। কারণ কোথাও না কোথাও আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে হিন্দু-মুসলমানের বিভাজন রেখাটি সূক্ষ্মভাবে হলেও রয়ে গেছে। তাই আজও আমাদের দেশে তথা রাজ্যে সর্বোপরি আমাদের এই শহর কলকাতাতেও একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে মুসলমানদের জোট বদ্ধ বসবাস লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও মানুষের মনে এখনো পরধর্মের প্রতি বিদ্বেষ কাজ করে। তাই আজ আমরা যতই সাংবিধানিকভাবে আমাদের ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ বলি না কেন, সবার আগে প্রয়োজন একক ব্যক্তির ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাব। তবেই আমরা সকল মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক কুপ্রভাবের হাত থেকে আমাদের দেশকে রক্ষা করতে পারবো। না হলে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সার্বভৌমত্ব – এইসব শব্দগুলি সংবিধানের বইতেই থেকে যাবে। আর আমাদের দেশের ঐতিহ্য এবং ঐক্যবোধ –  বারবার ভূলুণ্ঠিত হবে।আর ভোট ব্যাংকের কারণে রাজনৈতিক দলগুলি এই সাম্প্রদায়িক সমস্যাকে চিরকাল জিইয়ে রাখবে  নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যই। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে মৌলনা আবুল কালাম আজাদ কে মনে রাখতে হবে খান আবদুল গাফ্ফার খানকে  বা রেজাউল করিম কেও ভুললে চলবে না। কারণ এদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাতেই আজ আমরা স্বাধীন।আর তার সঙ্গে একথাও স্মরণে রাখতে হবে যে হিন্দু ও মুসলমান কোনো সম্প্রদায় কে বাদ দিয়েই ভারতের ইতিহাস বর্তমান বা ভবিষ্যৎ কোনোটাই সম্ভব নয়। স্বাধীন রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসাবে স্বাধীনতা সেই আদর্শকেই পালন ও লালন ‌করা আমাদের একান্ত কর্তব্য হওয়া উচিত।আর সেটাই হবে যথার্থ দেশপ্রেমের পরিচয়।


ঘোর তিমিরঘন নিবিড় নিশীথে, পীড়িত মু্র্ছিত দেশে, জাগ্রত ছিল তব অবিচল মঙ্গল, নতনয়নে, অনিমেষে।


ঋণ স্বীকার :

‘সভ্যতার সংকট’ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ,’তর্কপ্রিয় ভারতীয়’ – অমর্ত্য সেন, রবীন্দ্র জীবনী(৩য় খন্ড) – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়,’দাঙ্গার ইতিহাস’ – শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়,’ History of the Freedom Movement in India’ – R.C.Majumdar