| 18 এপ্রিল 2024
Categories
অমর মিত্র সংখ্যা

অমর মিত্রের দশমী দিবসে : নির্বাসিতের আখ্যান । পুরুষোত্তম সিংহ

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

                 

কালের অন্তহীন প্রবাহে এগিয়ে চলে সময়। সময়ের সাথে সাথে পাল্টে যায় সমাজ, পাল্টে যায় সাহিত্য ও সাহিত্যের আঙ্গিক। সময় ও পরিসর নিয়েই তো সাহিত্য। সে সাহিত্য কালের কথা বলে, সময়ের কথা বলে, সমাজের কথা বলে, সামগ্রিক ভাবে বলে মানুষের কথা। কালের যাত্রার আবহন ধ্বনি বহন করে চলে উপন্যাস। বাংলা উপন্যাসের ইতিহাস ইতিমধ্যেই দেড়শো বছর (১৮৬৫-২০১৫) অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। যে ‘দুর্গেশনন্দিনী’ দিয়ে বাংলা উপন্যাসের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল পঞ্চাশ বছরের দোরগোড়ায় এসে প্রকাশ পেল ‘ঘরে বাইরে’, ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাস-যেখানে আঙ্গিকের ব্যাপক বদল ঘটল আর একশো বছরের প্রবর্তনে লেখা হল ‘বিবর’। আর দেড়শো বছরের দোরগোড়ায় লেখা হল অমর মিত্রের ‘দশমী দিবসে’ (২০১৪) উপন্যাস। বাংলা উপন্যাসের পালাবদলের ইতিহাস শুধুমাত্র এই পাঁচটি উপন্যাসের মধ্য দিয়েই স্পষ্ট হয়ে যাবে, অন্য উপন্যাসের কথা ছেড়েই দিলাম। বাংলা উপন্যাসের যে ইতিহাস সেখানে এক ব্যতিক্রমী উপন্যাস ‘দশমী দিবসে’-যার জন্য পাঠক মহল অবশ্যই মনে রাখবে অমর মিত্রকে।

বর্তমান কথাসাহিত্যে অন্যতম নাম অমর মিত্র। অমর বাবু আগেই সাড়া জাগিয়েছিলেন ‘ধ্রুবপুত্র’, ‘অশ্বচরিত’ ও ‘ধনপতির চর’ উপন্যাস লিখে। তবে অমর মিত্রের পথ চলা কিন্তু ছোটোগল্প দিয়ে। প্রথম গল্প সংকলন ‘মেলার দিকে ঘর’ প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে। উপন্যাসে যাত্রা সেই দশকেই। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে লেখা শুরু করেন ‘নদী মানুষ’ যা প্রকাশিত হয় ‘অমৃত’ পত্রিকার বিনোদন সংখ্যায়। তবে প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘আলোকবর্ষ’। ধীরে ধীরে ‘পাহাড়ের মতো মানুষ’, ‘সুবর্ণরেখা’, ‘ভি.আই.পি.রোড’ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হন ‘ধ্রুবপুত্র’ বা ‘অশ্বচরিত’ উপন্যাসে। ‘ধ্রুবপুত্র’ বাংলা উপন্যাসের ইতিহাসে এক মাইলস্টোন-সম্পূর্ণ নতুন আখ্যান নিয়ে এলেন অমর বাবু এ উপন্যাসে। আর ‘দশমী দিবসে’ প্রমাণ করলেন অমর মিত্র ভিন্ন পথের যাত্রী, যে যাত্রা অন্তহীন প্রবাহের দিকে।

দেশভাগের এক আশ্চর্য রূপকার অমর মিত্র। একালে বসেও যে দেশভাগের আখ্যান লেখা যায় তা বোধহয় অমর বাবুই জানেন। অমর মিত্র জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে পূর্ববাংলার সাতক্ষীরা জেলায়। এমনকি পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যেই দেশত্যাগ করেন। বাবা যেহেতু ছিল চাকুরিজীবী সে অর্থে দেশত্যাগের যন্ত্রণা উপলব্ধি করেননি। দেশভাগের গল্প লেখক শুনেছিলেন মায়ের মুখে। জাতির জীবনে ঘটে যাওয়া এক মর্মান্তিক ঘটনায় সাহিত্য সেদিন নীরব হয়ে গিয়েছিল। যে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন দেবেশ রায় ‘রক্তমণির হার’ গ্রন্থের ভূমিকায় বা অশ্রুকুমার সিকদার ‘ভাঙা বাংলা: বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থে-তা অত্যন্ত সংগত। সে অভাব পূরণ করতেই কি অমর মিত্র দেশভাগের আখ্যান লেখেন? সাহিত্য তো অনুভব উপলব্ধির বিষয়। অমর বাবু নিজেই বলেছেন দেশভাগ তাঁর কাছে এক নিরন্তর অনুভবের বিষয়। এমনকি দেশভাগের ক্ষত এখনও শুকোয়নি বলে আক্ষেপ করেন। আবার কখনও শুনতে হয়েছে ‘অমর তুমি বড্ড ওপার ওপার করো, কেন করো, এটাই তোমার দেশ, এই দেশের খাও পড়ো।’’ (ভাসিয়ে দিয়েছি কপোতাক্ষ জলে, দে’জ, দ্বিতীয় সংস্করণ ২০১৬, পৃ. ১৭৩)  আসলে অনুভবে উঠে আসে দেশভাগের যন্ত্রণার কথা, ঘর ছাড়া বিপন্ন মানুষের কথা। ‘দশমী দিবসে’ মধুসূদনের জীবন যন্ত্রণা, বিদায় ঘাট, দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধ-সব মিলিয়ে এক আশ্চর্য কাহিনি এঁকেছেন অমর বাবু-যার দোসর বাংলা উপন্যাসে নেই। দেশভাগের অনুভব অমর বাবু আগেই প্রকাশ করেছেন ‘কাঁটাতার’, ‘ধুলোগ্রাম’ উপন্যাসে। ‘দেশভাগ : হারানো দেশ হারানো মানুষ’ (সোপান) গ্রন্থে দেশভাগ কেন্দ্রিক বারোটি গল্প স্থান পেয়েছে –যে গল্পগুলি দেশভাগের অসামান্য দলিল। দেশভাগের আখ্যান যে কত ভয়ংকর হতে পারে তা এ গল্পগুলি পড়লেই বোঝা যায়।

‘দশমী দিবসে’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে। তবে এর আখ্যান পাওয়া যাবে ২০১১ খ্রিস্টাব্দে লেখা ‘ভালোবাসিয়াছিল’ গল্পে। গল্পটিকে উপন্যাসের বীজ বলা যেতে পারে। সে কাহিনিকেই মহাকাব্যিক ব্যাপ্তি দিলেন বাষট্টি পরিচ্ছেদে সমাপ্ত ‘দশমী দিবসে’ উপন্যাসে। এমনকি এ উপন্যাসের নয়-দশ-এগারো পরিচ্ছেদ মিলে ‘দেশের কথা গায়ের কথা’ নামে একটি গল্প ‘দেশভাগ: হারানো দেশ হারানো মানুষ’ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। মধুসূদনের জীবন যন্ত্রণাকে দেশভাগের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন এ উপন্যাসে। এ উপন্যাস সম্পর্কে লেখক নিজেই বলেছেন –

‘’এই উপন্যাসের কথা ভেবেছিলাম বহু বছর বাদে ২০০০ সালে আমার জন্মভূমি বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখে, যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামের কপোতাক্ষকূলে বসে বিদায়ঘাটের কথা শুনে। কবি মধুসূদন, মা জাহ্নবীকে নিয়ে যে বিদায় ঘাটের কাহিনি শুনেছিলাম আমি সেই বিদায়ঘাটই আমাকে প্ররোচিত করে এই উপন্যাস লিখনে। আর মেঘনাদবধ কাব্য, মেঘনাদের মৃত্যু, রাবণের হাহাকার, মধুর জীবন। দেশভাগে সমস্ত দেশই হয়ে ওঠে বিদায়ঘাট। আর সেই কথা এই উপন্যাসে বলে বেড়ায় বীরাঙ্গনা দাসী। সে যেন চারণ কবির মতো। দেশভাগে সে সব ফেলে এসেছে, নিয়ে এসেছে শুধু মধুর কথা। কবির কথা মধুর কথা। এই উপন্যাস যাত্রা করেছে সময় থেকে সময়ান্তরে।‘’ (দশমী দিবসে, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, নয়াদিল্লি ৭০, আরম্ভের আগে)

সেই মধুকবির জীবনযন্ত্রণা কবিকে বিষাদগ্রস্ত করে। লেখকের রচনায় বারবার ফিরে আসে কপোতাক্ষের কথা, বেত্রবতীর কথা। কপোতাক্ষ যেমন মধুসূদনের প্রাণের নদী, তেমনি অমরবাবুরও প্রাণের প্রবাহ। মধুসূদনের মতো সয়নে স্বপনে জন্মভূমির কথা না ভাবতে পারলেও অমরবাবু কিন্তু জন্মভূমির প্রতি দায়বদ্ধতা স্বীকার করেছেন। সে দায়বদ্ধতারই ফল এপারে বসেও উপন্যাসে জন্মভূমির স্মৃতিচারণা করে যাওয়া। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র বীরাঙ্গনা দাসী। কিন্তু কে এই বীরাঙ্গনা দাসী? জেনে নেওয়া যাক ‘ভাসিয়ে দিয়েছি কপোতাক্ষা জলে’ গ্রন্থে লেখকের বয়ান থেকে –

‘’আমার বউদির যিনি দিদিমা, দেশভাগের পর সেই বিধবা বৃদ্ধা মেয়ে আর ছেলের বাড়ি যাতায়ত করে কাটাবেন। মেয়ে থাকত দিল্লি। তিনি একা একা আপার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসে চেপে দিল্লি যেতেন। আবার দিল্লি থেকে ফিরে বসিরহাটে ছেলের কাছে। মাঝে ক’দিন আমাদের বেলগাছিয়ার ফ্ল্যাটে। তাঁর জামাই ছিলেন আমার বাবার অতি ঘনিষ্ট বন্ধু।‘’ (ভাসিয়ে দিয়েছি কপোতাক্ষ জলে, তদেব, পৃ. ১৪৩ )

এই বৃদ্ধার কাছ থেকেই লেখক মধুসূদনের গল্প শুনতেন। এ মহিলা চারণ কবির মতো বলে যেতেন মধুর জীবন কথা –‘’মাইকেল মধুসূদন দত্ত এইভাবে তাঁর জীবনের দেশভাগ জনিত বিষাদ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর স্মৃতিতে মাইকেল মধুসূদন দত্ত অবিকল ধরা ছিল। একের পর এক সনেট বলে যেতেন। আমাদের শোনাতেন মানকুমারী বসুর কবিতাও।‘’ (তদেব, পৃ. ১৪৫) আমরা সবাই জানি ‘মেঘনাদবধ কাব্য’এর প্রকাশকাল ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’এর দেড়শো বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০১১ খ্রিস্টাব্দে অমর বাবু যে ‘ভালোবাসিয়াছিল’ গল্পটি লেখেন, পরে সেটিকেই বৃহৎরূপ দিলেন। বলা যেতে পারে তখন থেকেই তিনি একটু একটু করে উপন্যাসের প্রস্তুতি নিয়ে চলেছিলেন। এ উপন্যাস যেমন মধুসূদনের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধার নিদর্শন, তেমনি মধুসূদনের মতো তিনিও তো স্বদেশ হারানো এক ব্যক্তি, যে এখন চাইলেও আর কপোতাক্ষের তীরে ফিরে যেতে পারে না। আসলে কপোতাক্ষও তো মধুকবির বিরহ ব্যথায় শুকিয়ে গেছে।

                                  ( ২ )

‘’সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে।

সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে ;

সতত (যেমতি লোক নিশার স্বপনে

শোনে মায়া-যন্ত্রধ্বনি ) তব কলকলে

জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে !-‘’                    

     -‘কপোতাক্ষ নদ’/মাইকেল মধুসূদন দত্ত

উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র বীরাঙ্গনা দাসী। যে দেশভাগের পর এপারে চলে এসেছে, সঙ্গে নিয়ে এসেছে দেশভাগ, মধুসূদনের স্মৃতি ও কপোতাক্ষের কথা। বীরাঙ্গনা কলকাতায় থাকুক আর দিল্লিতে যান সমস্ত জায়গাতেই মধুকবির কথা বলে চলে চারণ কবির মতো। বীরাঙ্গনার পুত্র কানাই বসিরহাটে থাকে, কানাইয়ের বন্ধু অভিরাম। অভিরামের স্ত্রী প্রভাময়ী ও পুত্র খোকনের সঙ্গে বীরাঙ্গনা দেশভাগের কথা ও মধুকবির কথা বলে। খোকনের মা খোকনের কাছে গল্প করে তাঁর দাদা-দিদিরা দেশভাগের সময় মারা গেছে। আবার হাবলু এসেছে মামা অভিরামের কাছে দেশভাগের পরে-‘’এটা নতুন দেশ, মা বাবাদের আনতে হবে ওপার থেকে’’। (দশমী দিবসে, তদেব, পৃ. ৬) দেশভাগে কেউ হারিয়েছে ভূমিমাটি, কেউ স্বজন আবার কেউ হারিয়েছে নিজের নাম। যেমন ‘অন্নদাবাবুর বাড়ি’ গল্পে হাসি হারিয়ে ফেলেছে নিজের নাম, সে জানে না তাঁর আসল নাম। হাবলু ভাবে হয়তো একদিন দেশভাগ মুছে যাবে। এপার-ওপার সব মিলে যাবে। আসলে দেশভাগ তখনও সাধারণ মানুষ মেনে নিতে পারেনি। হাবলুরও দৃঢ় বিশ্বাস দেশভাগ মুছে যাবে –

‘’হাবলু ভাবে, এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখবে সব বদলে গেছে। খারাপ মানুষগুলো ভালো হয়ে গেছে ধর্মাধর্ম। সমস্ত সীমান্তের রেখা মুছে গেছে। দেখবে দেশভাগ বাতিল, হিন্দুস্থান, পাকিস্তান ভুলে গেছে সবাই। মানুষ পেয়েছে পাখির স্বাধীনতা।‘’ (তদেব, পৃ. ৮)

বীরাঙ্গনা দাসী শুধু মধুকবির কথাই বলে না, বলে ওপার বাংলার কথা, দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধের কথা, এ শতাব্দীর সন্ত্রাসবাদের কথা, গান্ধীজি-নেতাজির কথা। বীরাঙ্গনা দাসী ওপার বাংলার যশোরের মানুষ, সে খোঁজ রাখে নেতাজির কথা। নেতাজির অন্তর্ধান রহস্যেও বীরাঙ্গনা দেখে মধুসূদনের ছাপ। মধুসূদন যেমন আর স্বদেশ ফিরে যায়নি, নেতাজিও কি তেমনি আর স্বদেশে ফিরে আসবে না- এ প্রশ্ন তোলে বীরাঙ্গনা। এসে লাভই বা কী, সে স্বদেশ তো আর নেই, সেই ভারতভূমির বুকে এখন কাঁটাতার উঠে গেছে। এই বিমর্ষ ছবি হয়তো নেতাজিও সহ্য করতে পারবেন না, তাই হয়তো সে ফিরে আসবে না-‘’তিনি কোথায় ফিরবেন, এপারে না ওপারে, ইন্ডিয়া না পাকিস্তান, দুটোই তো শূন্য লঙ্কাপুরী হয়ে গেছে, মেঘনাদের মরণে রাবণ রাজার যা হয়েছিল তা।‘’ (তদেব, পৃ. ৯) আসলে লেখক নিজেও দেশভাগ মেনে নিতে পারেননি, যে প্রেরণা তাঁকে একবিংশ শতাব্দীতে বসে দেশভাগের যন্ত্রণার কথা স্মরণ করায়। কাঁটাতার দিয়ে একটি ভূখণ্ড বিভেদ করে দিলেই কি মানুষ পৃথক হয়ে যায়-আমাদের মেনে নিতে হয়েছে এই সত্যকে। কাল ছিল যারা প্রতিবেশী মানুষ আজ তারা হয়ে গেছে অন্য রাষ্ট্রের মানুষ-এই নির্মম সত্যকে মেনে নিতে হয়েছে আমাদের। সাহিত্য তো জীবনসত্যের কথা বলে-যে সত্য নিরন্তর মানুষের জীবনের রহস্য সন্ধানে নিয়োজিত। ‘কাঁটাতার’ উপন্যাসে হাবলুও দেশভাগের কথা বিশ্বাস করে না-সে হিন্দুস্থান পাকিস্তানের বিভেদ মানে না। দেশভাগের বারো বছর হয়ে গেছে, ওপার থেকে লোক এপারে এসেই চলেছে। আবার সুধন্য মণ্ডল ওপারে ফিরে গেছে কেননা এপারে তাঁর ভালো লাগেনি। এভাবেই মানুষের যাওয়া আসার যন্ত্রণা কাতরতার এক ইতিহাস এ উপন্যাস।

                                 ( ৩ )

‘’কিন্তু সবাই বলল সেদিন, হা কাপুরুষ হদ্দ কাঙাল

চোরের মতো ছাড়লি নিজের জন্মভূমি!

জন্মভূমি ? কোথায় আমার জন্মভূমি খুঁজতে খুঁজতে জীবন গেল।

দিন কেটেছে চোরের মতো দিনভিখারির ঘোরের মতো

পথবিপথে, জন্মভূমির পায়ের কাছে ভোরের মতো ‘’

                           -‘মন্ত্রীমশাই’/শঙ্খ ঘোষ।

চরিত্র তো লেখকের মানস সন্তান। চরিত্রের মুখে বলা বক্তব্য তো ঔপন্যাসিকের জীবনদর্শন। রাষ্ট্রের নিয়মে হয়তো লেখককেও দেশভাগ মেনে নিতে হয়েছে। তবে পাখির যেমন দেশ নেই তেমনি সাহিত্যেরও তো কোনো দেশ-রাষ্ট্র নেই। যে হিন্দু-মুসলমানের ভিত্তিতে দেশভাগ হয়েছিল সে প্রসঙ্গে হাবলু বলে-‘জীবজন্তুর হিন্দু মোছলমান আছে?’ যে স্বার্থের ভিত্তিতে দেশভাগ-সেখানে সাধারণ মানুষ ছিল নিঃস্ব। সাধারণ মানুষের তো কোনো স্বার্থই ছিল না, তবুও দেশভাগ মেনে নিতে হল। বীরাঙ্গনা দাসীর কথায় এসব প্রসঙ্গ বারবার উঠে এসে এসেছে। উপন্যাসের নয়-দশ-এগারো পরিচ্ছেদে দেশভাগের প্রসঙ্গ পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা বারবার উঠে এসেছে। দেশভাগ যেমন বহু মানুষকে দূরে ঠেলে দিয়েছে তেমনি কত অজানা মানুষকে সামনে এনে দিয়েছে। ওপারের মানুষ ফণিভূষণের সঙ্গে দেখা হয় বীরাঙ্গনার। সে বলে চলে মধুকবির স্বদেশ ত্যাগের কথা। সেই প্রসঙ্গে কখনও আসে মন্বন্তরের প্রসঙ্গ, কখনও মানকুমারী দেবীর কথা –‘’পিসির তবু দেখে যেতি হয়নি পার্টিশান, হিন্দুস্তান, পাকিস্তান, তার আগে খুলনায় চোখ বুঁজল পিসি।‘’ (দশমী দিবসে, পৃ. ৫৫) ফণিভূষণকে এপারে এসে সংগ্রাম করতে হয়েছে, ওপারে তাঁর স্বচ্ছল পরিবার ছিল, তাই সে ক্রোধ প্রকাশ করে যারা মানচিত্র ভাগ করেছে তাদের ওপর।   দেশভাগের সময় হাবলুর বয়স ছিল দশ, এখন কুড়ি। হাবলুকে সকলে পাগল মনে করে কেননা সে দেশভাগ মানে না। কখনও বলে বিড়ালের কি হিন্দু-মুসলমান আছে? আবার বীরাঙ্গনা কখনও ভাবে ধর্মের কথা। যে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হল অথচ দেশভাগের পর হারিয়ে গেল দরিদ্র মানুষের ধর্ম। তাই বীরাঙ্গনা বলে-‘’যে ধর্ম নিয়ে এত সব হল, ম্যাপে দু’ভাগ করে দিয়ে দুটি দেশ করে দিল। সেই ধর্ম বড় সহজ কি ?’’ (তদেব, পৃ. ১০৮) ওপারে যারা ছিল উচ্চবিত্ত সম্প্রদায়ের মানুষ, এপারে এসে তাদের কেউ ভিখারিতে পরিণত হয়েছে। ফণিভুষণের বাবা-মা এই ভয়ে এপারে আসতে চায় না। তবে বহু মানুষই তো আসতে বাধ্য হয়েছিল। সেইসব মানুষদের দেখে বড়ো দুঃখ হয় ফণিভূষণের। এমন একজন মানুষের সাথে দেখা হয় যে এপারে এসে ভিখারীতে পরিণত হয়েছে, লজ্জায় মুখ ঢেকে ভিক্ষা চায় কিন্তু মুখের ভাষায় স্পষ্ট ধরা পড়ে যায় পূর্ববাংলার উচ্চারণ। সুরেন্দ্র-ফণিভূষণের কথায় যেমন বস্তু সংকটের প্রসঙ্গ এসেছে তেমনি দালালদের স্বার্থসিদ্ধির কথাও এসেছে। বীরাঙ্গনা আক্ষেপ করে ছেলে কানাই তাঁর মতো বা স্বামীর মতো হয়নি। দেশভাগে যে পরিমাণ হিন্দু ওপার থেকে এপারে এসেছিল তার সামান্য পরিমাণ মুসলমানও এপার থেকে ওপারে যায়নি। ওপারের বহু হিন্দু স্বদেশ ত্যাগ করতে ইচ্ছুক নয় তবুও এপারে জমি কিনে রেখেছে, যদি অত্যাচারিত হয়ে চলে আসবে। আসলে দেশভাগে বঙ্গদেশের মানুষকেই সবচেয়ে বেশি অত্যাচারিত হতে হয়েছিল, ফণিভূষণের কথায় উঠে আসে সে প্রসঙ্গ –

‘’বাঙালির যা হয়েছে, পূর্ববঙ্গ পশ্চিমবঙ্গে যা হয়েছে ভারতের আর কোথাও তা হয়নি। দেশভাগ হয়েছে কিন্তু তার আগে দুর্ভিক্ষ, প্রলয় ঝড়, কাপড়ের অভাব-এসব তো হয়নি। রায়ট হয়েছে অবশ্য নানা জায়গায়, এই পূর্ব সীমান্তের মতো পশ্চিমেও, কিন্তু বাকিটা তো দ্যাখে নি তারা।‘’ (তদেব, পৃ. ১৬১)

উপন্যাসের এক অদ্ভুত চরিত্র হাবলু। সে দেশভাগ মানে না। বারবার সে বলে পাখির কোনো দেশ নেই, মেঘের কোনো দেশ নেই, নদীর কোনো দেশ নেই। প্রসঙ্গত বলি অমর বাবু বর্তমানে যে উপন্যাসটি লিখছেন তা হল ‘কুমারী মেঘের দেশ চাই’। ছিটমহলের সমস্যা এর প্রধান বিষয় হলেও দেশভাগ অতিক্রম করে তিনি পৌঁছে যান ওপার বাংলায়। আসলে অমর বাবু নিজেও তো দেশভাগ ভোলেননি। অমর বাবুর গল্প উপন্যাসে যশোর, খুলনা, বেত্রবতী, কপোতাক্ষ ও সাতক্ষীরের কথা এতো পরিমাণে এসেছে যে এটিই একটি গবেষণার বিষয় হয়ে উঠতে পারে। টিয়ার খুব ভালো লাগে হাবলুকে, কেননা হাবলুর তো কোনো দেশ নেই, সে তো কোনো দেশের মানুষ বলে পরিচয় দেয় না। এপারে এসে হিন্দুদের যে বিপর্যয়ে পড়তে হয়েছিল ওপারে গিয়ে কিন্তু মুসলিমদের সে বিপর্যয়ে পড়তে হয়নি –‘’সফিউদ্দিন বলল আমার মামা খুব গরিব, ভাত জুটত না, এখন সে পাকা দালান পর্যন্ত পেয়েছে, বলেছে পার্টিশান হয়ে এটা হল।‘’ (তদেব, পৃ. ১৭০) আশ্চর্য লেখকের লেখনী, দেশভাগকে মধুকবির জীবন যন্ত্রণার সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন। দেশভাগের এমন আখ্যান বোধহয় অমর বাবুর পক্ষেই লেখা সম্ভব-সেদিক থেকে বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি বিরলতম ঔপন্যাসিক। লেখক নিজেই বলেছেন এ উপন্যাস পৌঁছেছে সময় থেকে সময়ান্তরে। তাই সন্ত্রাসবাদের কথা যেমন উঠে আসে তেমনি উঠে আসে জার্মানির ভাগ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু জার্মানির বিভেদ তো উঠে গেছে তবে ভারতবিভাগও কি উঠে যাবে? হয়তো না। কিন্তু সে আশাতেই দিন গুনছে হাবলু। সফিউদ্দিন জানে ওপারে উর্দু না শিখলে চাকরি হবে না, তেমনি বীরাঙ্গনা দাসীর কথায় উঠে এসেছে ইতিহাসের প্রসঙ্গ –‘’পার্টিশনের আগে যশোর জেলায় ছিল বনগাঁ, পরেও তিনদিন ছিল যশোরে, তিনদিন বাদে আঠেরো তারিখে এখানে ইন্ডিয়ার ফ্লাগ ওঠে।“ (তদেব, পৃ. ১৮৭) আসলে দেশভাগ হাবলু বা বীরাঙ্গনা দাসী না মানলেও মেনে নিয়েছে ফণিভূষণ বা অভিরামের মতো মানুষেরা। এটাই তো বাস্তব সত্য-তাই দোকানে আলোচনা হয় পাকিস্তান উঠে গেলেও মানুষ আর ওপারে যাবে না।

   মধুসূদন নিজে স্বদেশ ত্যাগ করেছিল, কিন্তু কাব্যের নায়ক রাবণ তো স্বদেশ রক্ষা করতে সদা সচেষ্ট, তাহলে সেই মধুকবির দেশভাগ হবে কেন এ প্রশ্ন তোলে বীরাঙ্গনা। বাংলা ভাগ তো আগেও হয়েছিল ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে, তখন আবার বঙ্গভঙ্গ রদও হয়েছিল, হিন্দু-মুসলমানের সম্মেলিত প্রচেষ্টায় গর্জে উঠেছিল বাঙালি। তাই হাবলুর প্রশ্ন দেশভাগ রদ হবে না কেন ? আসলে বঙ্গভঙ্গের সময় তো রবীন্দ্রনাথ বেঁচেছিলেন। রজনীকান্ত গেয়ে চলেছিলেন –‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়/মাথায় তুলে নে রে ভাই/দীনদুঃখিনী মা যে তোদের/তার বেশি আর সাধ্য নাই।‘ কিন্তু দেশভাগ রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি, চিত্তরঞ্জন কেউ দেখেনি। আর নজরুল থাকলেও কথা বলার সমর্থ হারিয়ে ফেলেছেন। হিন্দু-মুসলমানকে একত্রিত করার কোনো সুদক্ষ স্বদেশনেতার জন্ম দিতে পারেনি তখনো ভারতমাতা, ফলে দেশভাগ মেনে নিতেই হল ভারতবাসীকে –‘’ওপার থেকে চলে এয়েছি, ওটা অন্যদেশ, আর আমরা ওপারে যাব না, কলকাতা অনেক ভালো, পার্টিশান রদ হবে না, হবে না।‘’ (তদেব, পৃ. ২১৭) টিয়া ভালোবেসে ফেলেছে হাবলুকে। হাবলু ওপারে যেতে চায় কিন্তু টিয়া বাঁধা দেয় কেননা দেশ আলাদা হলে ভালোবাসাও যে ভেঙে যাবে। যেমন ভেঙে গিয়েছিল ‘অপাপবৃদ্ধা’ গল্পে হাবিবের। সে বাংলাদেশের ছিটের বাসিন্দা বলে তাঁর হাতে কন্যা তুলে দেয়নি মদনাকুড়ির ছিটমহলের বাসিন্দা হেরাতুন। রাজার ইচ্ছা পূরণ করতে গড়ে উঠেছিল ছিটমহল, আর ইংরেজি কোম্পানি দেশকে লুণ্ঠন করতে এসে বুনে দিয়ে গেল সাম্প্রদায়িকতার বীজ। সেই জীবনযন্ত্রণার কথা, মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’র সঙ্গে অসাধারণ ভাবে মিলিয়ে দিয়েছেন লেখক। কতবড়ো লেখক হলে এমন তুলনা করা যায় তা ভবিষ্যতের পাঠক অবশ্যই বিচার করবে—

‘’ভিটে ছাড়া করতে যেমন স্বাধীনতা এল দাঙ্গার রক্ত মেখে। ইংরেজ ভাগাভাগি করে দিল দেশটাকে। ইংরেজ জানত এই দেশের মানুষের সঙ্গে বীরত্ব, সাহসে পেরে উঠবে না। এ দেশ সোনার। লুটেরা কোম্পানি বুদ্ধি করে হিন্দু মুসলমান বিরোধ লাগিয়ে দেশ লুট নিয়ে ভাগাভাগি করে দিয়ে চিরকালের মতো হিংসার বীজ পুতে দিয়ে গেল। দেশের মানুষ হল নিরস্ত্র মেঘনাদ। সারা দেশটায় বীর ইন্দ্রজিতের চিতা জ্বলতে লাগল। বুক চাপড়ে ঘরে ফিরতে লাগল সন্তানহারা রাবন।‘’ (তদেব, পৃ. ২৫২)

বীরাঙ্গনা কোনদিনই ভাবেনি যুক্তবঙ্গ আবার ভঙ্গবঙ্গ হবে। সমস্ত ছেড়ে পাড়ি দিতে হবে অন্য একটি দেশের উদ্দেশ্যে। সে দেশে বীরাঙ্গনা খুঁজে পায় না মাতৃভূমিকে। মধুসূদনের অপমানের কথা সে যেমন সহ্য করতে পারে না তেমনি বিদায়ঘাটের প্রসঙ্গ আসলেই কান্নায় ভেঙে পরে। আবার হাবলুর মা সরমার কাছে মধুকবির সঙ্গে রেবেকার বিচ্ছেদ যেন এপার-ওপারের বিচ্ছেদ। পাকিস্তানের সরকারি উর্দু সে কথা মেনে নেয়নি বহু মানুষ ফলে শুরু হল ভাষা আন্দোলন, আবার একটি ভূখণ্ডের ভাগ ঘটলো।

লেখক নিজেই বলেছেন এ উপন্যাস সময় থেকে সময়ান্তরে পৌঁছেছে। বঙ্গভঙ্গ, মন্বন্তর, দাঙ্গা, দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, এ শতাব্দীর সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে মধুসূদনের জীবনযন্ত্রণা, স্বদেশ হারানোর বেদনা, সন্তান হারানোর জন্য মাতা জাহ্নবীর হাহাকার সব মিলিয়ে এক ক্লাসিকাল পর্যায়ে পৌঁছেছে এ উপন্যাস। এজন্যই হয়তো এ উপন্যাসের প্রকাশক ‘ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট’। বাংলা উপন্যাসের ইতিহাসে একমাত্র ঔপন্যাসিক অমর মিত্র যিনি মধুকবির জীবন যন্ত্রণাকে দেশভাগের সঙ্গে মিলিয়ে নতুন ধরনের উপন্যাসের খোঁজে বেরিয়েছেন, এমনকি সে পদক্ষেপে তিনি পুরোপুরি সফল একথা বলা যায় নিঃসন্দেহে। মধুসূদনকে তিনি এখানে নতুন ভাবে তুলে ধরলেন, এমনকি বীরাঙ্গনা দাসী ও হাবলুর মুখে যে সব কথাগুলি বসালেন তাতে রাষ্ট্র-সমাজ-সংস্কার সব একাকার হয়ে গেল- এখানেই অমর মিত্রের স্বতন্ত্রতা। পরিশেষে বলা যায় বাংলা দেশভাগকেন্দ্রিক উপন্যাসে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধরনের উপন্যাস ‘দশমী দিবসে’— এ উপন্যাস মধুসূদনের জীবনভাষ্য, কথাসাহিত্যিক অমর মিত্রের জীবনভাষ্য, যন্ত্রণার ইতিবৃত্ত ও নির্বাসিতের আখ্যান।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত