ডাউন বনগাঁ লোকাল

Reading Time: 3 minutes

।।ঐন্দ্রিল ভৌমিক।।

মানুষের মন বড় বিচিত্র। বাইরে থেকে দেখে তা বুঝবার উপায় নেই। এই যেমন আমি। ভিড়ে ঠাসা ডাউন বনগাঁ লোকালে জানলার পাশের সিটে আরাম করে বসে আছি। কোলের উপর একটা ছোট ব্যাগ। চোখ দুটো বোজা। যে কেউ দেখলেই ভাববে অফিসের নিত্য যাত্রী। কেউ সুদুর কল্পনাতেও ভাবতে পারবে না, আমার মনের মধ্যে এখন কী চিন্তা ঘুরছে।

আমি একটা খুন করতে চাই। আমার সবচেয়ে প্রিয় নারীটিকে আমি খুন করতে চাই। একটা সন্দেহ আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। কিছুতেই তার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছি না। রাতের ঘুম উবে গেছে। সারাক্ষণ অস্থিরতা। অবশেষে আমি সিদ্ধান্তে এসেছি যে করেই হোক তাকে পৃথিবী থেকে সরাতে হবে। কিন্তু এমন ভাবে, যাতে কেউ আমাকে সন্দেহ না করে। একেবারে নিখুঁত হত্যা। কোনও সূত্র না রেখে।

সেটাই সমস্যা। ভেবে চলেছি গত দুই তিন দিন ধরে। বাড়ির বাইরে যাইনি। একটি নিখুঁত অথচ নৃশংস খুনের ব্লু প্রিন্ট আমাকে তৈরি করতে চাই, কিন্তু এখনও কোনও পরিকল্পনাই মনে ধরেনি।

আজ তাই বেরিয়ে পড়েছি, ভিড়ভাট্টায় ঘুরে যদি হঠাৎ কোনও প্ল্যান ঝলসে ওঠে!

গেটের কাছে চরম হইহট্টগোল। ট্রেন হাবরায় ঢুকেছে। প্লাটফর্ম ভিড়ে থিক থিক। সকলেই ট্রেনে উঠবার জন্য মরিয়া। যেন এটাই পৃথিবীর শেষ ট্রেন।

আমার পাশের সিটে একটি মেয়ে বসে আছে। মুখ ওড়নায় ঢাকা। এই গরমেও। শুধু চোখ আর নাক দেখা যাচ্ছে। বয়সটাও তাই ঠিকঠাক বোঝা যাচ্ছে না, শরীরের গঠন বলছে তিরিশের নিচেই। আমার এই মানসিক পরিস্থিতিতেও একটি মেয়ের প্রতি আগ্রহ হচ্ছে বুঝতে পেরে নিশ্চিন্ত হলাম। যাক তাহলে আমি এখনও স্বাভাবিক আছি।

আমার উল্টোদিকের কমবয়েসি ছেলেটি একমনে মোবাইলে কিছু ছবি দেখছে। সেদিকে তাকালাম। ছবিতে একটি মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় ছেলেটি। নিশ্চয় প্রেমিকা। ছেলেটি ছবিটা বড় করল। তার নিজের মুখ এখন স্ক্রিন জুড়ে। প্রেমিকা বাদ পড়ে গেছে। ছেলেটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজের ছবি দেখছে। তার মুখে এক রহস্যময় হাসি ফুটে উঠছে। মানুষ যে আসলে নিজেকেই সবচেয়ে ভালবাসে, তা আমার চাইতে ভাল কে জানে! নিজেকে ভাল রাখার জন্য সে প্রেম করতে পারে, আবার নিজের প্রেমিকাকে খুনও করতে পারে।

দুটি সিটের মাঝের গলিতে দুটি বাচ্চা কোলে নিয়ে এক দম্পতি।বাচ্চা দুটি সম্ভবত যমজ। বাচ্চা কোলে নিয়ে দুর্বল শরীরে দাঁড়িয়ে থাকতে তার খুবই কষ্ট হচ্ছে। ভদ্রতার খাতিরে আমার সিট ছেড়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু এই ভিড়ের মধ্যে ঘামতে ঘামতে হত্যাকাণ্ডের মতো একটা গভীর ব্যাপার নিয়ে চিন্তাভাবনা সম্ভব নয়। চোখ বুজে জানলা দিয়ে আসা হাওয়া খেতে খেতে আমি ভিড় থেকে নিজেকে আলাদা করতে চাইলাম।

একসময় চোখ বন্ধ অবস্থাতেই বুঝতে পারলাম পাশের মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়েছে। আর বাচ্চা কোলে বউটি সেখানে বসেছে। ব্যাস, এবার বাচ্চাটি আমার জামার হাতা ধরে টানবে, মাথা দিয়ে গুঁতো দেবে, ব্যাগের হ্যান্ডেল ধরার জন্য ছটফট করবে। এই অবস্থায় নিখুঁত খুনের পরিকল্পনা করা অসম্ভব।

অগত্যা আমিও উঠে দাঁড়ালাম। বউটির স্বামীকে বললাম, ‘আপনি বসুন।’ সে বিনা বাক্যব্যয়ে দ্বিতীয় বাচ্চাটিকে নিয়ে আমার সিটে বসে পড়ল।

বসে থেকেও ঘুম আসেনি, কিন্তু এবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাজ্যের ঘুম আমাকে চেপে ধরল। এই ক’দিন প্রতিহিংসার চিন্তায় ঠিকঠাক ঘুমাতে পারিনি।

পাশের মেয়েটি আমাকে যেন কিছু বলল। বুঝতে পারলাম না। বললাম, ‘কিছু বলছেন?’

‘আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো? ’

এরকম প্রশ্নে আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম। প্রথমেই মনে হল মেয়েটি আমার চিন্তাভাবনা জেনে যায়নি তো! কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। আমি একটু বিলম্বে উত্তর দিলাম, ‘আমি আপনাকে চিনতে পারছি না। তাছাড়া আপনার মুখ ওড়নায় ঢাকা।’

মেয়েটি বলল, ‘আমার দিকে ভাল করে তাকান, তাহলেই বুঝবেন।’

মেয়েটির মুখের দিকে তাকালাম। দু’জনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছি। ওড়নার ফাঁক দিয়ে মুখের অনেকটাই দেখা যাচ্ছে। মেয়েটির মুখের বাঁ-পাশ জুড়ে পোড়া দাগ।

আমি গলাটা যতটা সম্ভব করুণ করে বললাম, ‘কী করে পুড়ল?’

‘পোড়া, তবে আগুনে পোড়া নয়। অ্যাসিড বার্ন। একজন পুরুষ, যে আমাকে ভালোবাসে বলে দাবি করত তার মহৎ কীর্তি।’

আমি কৌতূহলী হলাম। আমিও এরকম কিছু একটা করতে চাই। বললাম, ‘আপনি কি ইয়ে… মানে… তাকে ভালবাসতেন না?’

‘আমি তখন ক্লাস ইলেভেনে পড়তাম। ভালবাসা মন্দবাসা এসবের চাইতেও তখন বড় চিন্তা ছিল পড়াশুনো করে নিজের পায়ে দাঁড়ানো। আমার পরে আরও দু’জন বোন। বাবা অটোরিকশা চালান। টিউশানি করে পড়াশুনো চালাতাম। ভালবাসা বাসির মতো সময় আমার ছিল না। তাছাড়া আমার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল ছেলেটির আদৌ ভালবাসার ক্ষমতা আছে কিনা।’

কিছুক্ষণ দু’জনে চুপচাপ। তারপর মেয়েটি বলল, ‘তবে সে ছেলে আমার অনেক উপকার করে গেছে। আগে আমি পুরুষদের ভয় পেতাম। এখন পুরুষরা আমাকে ভয় পায়।’

মেয়েটির কথা শুনতে শুনতে হৃদয়পুর চলে এল। মেয়েটি বলল, ‘আমি এগোই। মধ্যমগ্রামে নামব। এখানে এক বালিকা বিদ্যালয়ে আমি ইংরাজির শিক্ষিকা। আর হ্যাঁ, আমি কিন্তু ক্লাসে মুখ ঢেকে পড়াই না।’

একটু থেমে বলল, ‘আমি প্রথমেই আপনাকে দেখে চিনেছি। আপনি বিখ্যাত লেখক শ্যামল সমাজপতি। আমি আপনার লেখার ভক্ত। পারবেন আমাকে নিয়ে একটা গল্প লিখতে?’

আমার পরবর্তী প্রতিহিংসা ও অপরাধমূলক গল্পটির প্লটকে ছিন্নভিন্ন করে মেয়েটি মধ্যমগ্রামে নেমে গেল।

 

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>