| 19 এপ্রিল 2024
Categories
এই দিনে বিনোদন

কেরানি থেকে গায়ক

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

১৯১১ সালের ২২ আগষ্ট বরিশালে একটি ছোট্ট ফুটফুটে বাচ্চার জন্ম হয়েছিল। কে জানত তাঁর গলায় ভগবান সুরের বৃষ্টি ঢেলে দিয়েছেন। সে ছেলেটি নিজেও জানত না। সে কোনও দিন গান গাইবে, সেটাও ছিল তাঁর ভাবনার অতীত। সে তাঁর মায়ের গলায় গান শুনে শুনে অনায়াসে ছোট্ট বেলাতেই গেয়ে ফেলত গান। গান যেন তাঁর মস্তিস্কে ও মনে গাথা ছিল। আর তাই জন্যই পরবর্তীকালে সে সবার প্রিয় জর্জ বিশ্বাস হয়ে উঠেছিলেন। আজ এই অসামান্য শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসের জন্মদিন। প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে নতুন নতুন গান নতুন শিল্প। তবুও আজও বাঙালি কিন্তু ভুলতে পারেননি তাঁদের প্রিয় দেবব্রত বিশ্বাস বা জর্জদাকে। তিনি রবীন্দ্রনাথকে বুঝতেন। ভালবাসতেন। আর তাই তাঁর মতো করে রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে চর্চা আর কেউ করে উঠতে পারেননি। তাঁর মতো করে রবি ঠাকুরের গান কেউ ভাঙতেও পারেননি। এ নিয়ে বিতর্ক তিনি বেঁচে থাকতেও ছিল। আজও আছে। অনেকেই আছেন যাঁরা জর্জ বিশ্বাসের গানকে গানই মনে করেন না। তবে তাতে তো আর শিল্পীর অতুলনীয় শিল্প বা গলার সুর তো হারিয়ে যেতে পারে না।

কেরানি থেকে গায়ক হওয়ার গল্প:

তবে জানেন কি এই শিল্পী গায়ক হবেন তা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। আর সে কথা তিনি নিজে লিখে গিয়েছেন তাঁর লেখা বই ‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত’-এ। এই বইতে নিজের কথা মন খুলে লিখেছেন তিনি। সেখানেই দেবব্রত বলেছেন, ‘গায়ক হব, এ কথা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।’ তিনি ১৯৩৩ সালে অর্থনীতিশাস্ত্রে এম.এ করেন। ১৯৩৪ সালে তিনি বিনা মাইনেতে হিন্দুস্থান ইনসিওরেন্স কোম্পানিতে কাজ শুরু করেন। তার ঠিক এক বছর পর তাঁর নাম সরকারি খাতায় ওঠে এবং তিনি মাত্র ৫০টাকায় কেরানি জীবন শুরু করেছিলেন। কোথায় তখন গান? কোথায় কি? সেই সময় জর্জদা থাকতেন ভবানীপুর থানার উল্টোদিকের একটি মেস বাড়িতে। এই সময় তাঁর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরে ভাইয়ের ছেলে সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তিনিও আগে ওই জীবনবিমা কোম্পানির কর্তাব্যক্তি ছিলেন। তিনি মাঝে মধ্যে আসতেন এই অফিসে। তাঁর জন্য আলাদা একটা ঘর রাখা ছিল। এখান থেকেই জর্জকে পছন্দ হয় তাঁর। এবং তিনিই জর্জকে নিয়ে যান ইন্দিরা দেবীচৌধুরানীর কাছে। সেখানে তিনি দেবব্রত বিশ্বাসের গলা শুনে অবাক হয়ে যান। এবং তাঁকে গান শেখাতে শুরু করেন। ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে’-গানটি তিনি পাশ্চাত্য কায়দায় হারমোনাইজ করে তিনি গান শেখালেন তাঁকে। এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাইতে পাঠাতে লাগলেন। পার্কসার্কাসে ‘সঙ্গীত সম্মিলনী’ নামে মিসেস বি এল চৌধুরি প্রতিষ্ঠিত একটি সংগীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। সেখানে নানা ধরণের গান শেখানো হত। জর্জ সেখানে যেতে শুরু করলেন। তখন তিনি এটাও জানতেন না ‘স্বরবিতান’ নামের কোনো স্বরলিপি বই আছে। স্বরলিপি কী তা তিনি বুঝতেনও না। তার পর পয়সা জমিয়ে তিনি চারখন্ডের জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘স্বরলিপি-গীতমালা’ কেনেন। এইবার এই বই দেখে দেখেই তিনি গান শেখার চেষ্টা করতেন। সেই থেকেই তিনি রবি ঠাকুরের গানে নিজেকে বাঁধতে শুরু করেন। তবে তিনি সবটাই করতেন খালি গলায়। সুর তাঁর গলায় নিজে থেকেই ছিল। এর পর তিনি শান্তিনিকতনে গিয়ে দেখাও করেছেন রবি ঠাকুরের সঙ্গে। রবি ঠাকুরকে দেখে তাঁর পায়ে মাথা নত হয়ে এসেছিল দেবব্রত বিশ্বাসের। তিনি লিখেছেন, ” ঠাকুরকে ওইভাবে শান্তিনিকেতনে দেখে মনে হয়েছিল ইনিই স্রষ্টা। তাঁর পায়ে নিজেকে বিলিন করে দিতে পারলেই বোধহয় শান্তি। জীবনে অনেক গান রেকর্ড করেছেন তিনি। নজরুলের গানও গেয়েছেন দেবব্রত। তা নিজেই উল্ল্যেখ করেছেন তাঁর লেখা বইতে। তাই তাঁর জীবনে উথ্থান পতন ছিল চোখে পড়ার মতো।

শেষ জীবনের একটি মজার ঘটনা:

শেষ জীবনে খুন একা ছিলেন জর্জ। তিনি একবার এক বিদেশি বান্ধবীকে লিখেছিলেন, “আমার শরীরটায় এক অদ্ভূত রোগের উৎপাত হয়েছে। তাই আমি ভাল নেই। চিকিৎসাও করাতে পারছি না। কবে দেখা হবে জানি না।” ওই বিদেশিনি বার বার দেখা করতে চেয়েছিলেন জর্জের সঙ্গে। তাই একথা লিখেছিলেন তিনি। এরপর ওই বিদেশিনি ভারতের গভর্নরকে চিঠি লেখেন, তাতে জানান জর্জের অবস্থার কথা। সেই চিঠি পেয়ে সরকার এসএসকেএম হাসপাতালকে জর্জের সব দায়িত্ব নিতে বলেন। কিন্তু জর্জ চিঠি লিখে না করে দেন। এরপর হঅসপাতালের আরএমও তাঁর বাড়ি চলে আসেন। তখন জর্জ বলেন,” এই বিষয়টা নিয়ে যে এত বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে বুঝিনি।” তারপর তিনি গোটা বিষয়টা তাঁকে বলেন। এ কথা শুনে সেই ডাক্তার হাসতে হাসতে চলে যান। তবে সত্যিই খুব শ্বাসকষ্টে ভুগতেন জর্জ। আর তা ছিল তাঁর জন্ম থেকেই সঙ্গি। আজ তাঁর জন্মদিন। তাঁকে নিয়ে লেখার তো কোনও শেষ নেই। তবে তাঁর গান চিরস্মরণীয় হয়ে থেকে যাবে বাঙালির মনে। সে বিতর্ক তাঁর গান নিয়ে যতই থাকুক।

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত