কতকগুলি শব্দ কেন যেন মনে লেগে থাকে। এটা আন্দাজ করা যায় কে কাকে কী নামে ডাকে তা দিয়ে। এমন শিশু কি কেউ থাকে যার একটি মাত্র ডাকনাম। কোনো-কোনো ডাকনাম ডাক থেকে ঝরে যায়—ডাকার লোক থাকে না। আমারই এখন সেই দশা চলছে। সে-কথা শুনে এখনকার বিখ্যাত সাংবাদিক সেমন্তী ঘোষ হঠাৎ তার বাল্যস্মৃতি হাতড়ে আমার লুপ্ত ডাকনামটা উদ্ধার করে আমাকে সেই নামে ডাকে। এমন ঘটলে বেঁচে থাকায় যেন অকাল হাওয়া বয়ে যায়। আমি একজন আশি-উত্তীর্ণাকে তাঁর স্বামী ‘কনক’ বলে ডাকছেন শুনেছি। তার চাইতেও সেই ডাকটা শুনে সেই বৃদ্ধাকে লজ্জা পেতেও দেখেছি।
কিন্তু ডাকার জন্য না হয়েও শুধু ধ্বনির জন্য কত শব্দ আমাদের প্রিয় হয়ে থাকে। আমার এমন একটি শব্দ ‘বৃষ্টিচ্ছায়’। খুব যে ব্যবহার করি তা নয়। কিন্তু বৃ#ষ্টি#চ্ছা#য়# শব্দটা অকারণে মনে এলেও একটা বিরল নিসর্গ ছেয়ে ফেলে মন। বেশিক্ষণ যে সেই ছেয়ে থাকা থাকে তা নয়। কিন্তু যেটুকু সময় থাকে, তাতে শব্দটির রণন যেন আর-একটু ছড়িয়ে পড়ে, যেন কোনো অবুঝ শিশু খেলতে খেলতে কোনো সুরবাঁধা তানপুরার সবগুলো তারের ওপর দিয়ে তার আঙুল চালিয়ে দেয়ায় যে ধ্বনি-কল্লোল উঠল তার উৎস কি তারই আঙুলগুলো, সেটা বুঝতে নিজেরই আঙুলের দিকে তাকিয়ে থাকে।
আমার মনে হয় না এমন কোনো শৈশব বিস্ময় ‘বৃষ্টিচ্ছায়’ শব্দটি আমার রণনস্মৃতিতে ভেসে ওঠে। এর অন্য কারণ আছে। আমি ছ-সাত বছর বয়সে পাবনা জিলার এক সম্পন্ন গ্রাম থেকে জলপাইগুড়িতে চলে আসি। আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে যে-নদী বইত তার নাম যমুনা। যমুনা ভাঙনের নদী। ভাঙনের নদীর পারের মানুষজনের ভিতর একটা অপেক্ষা থাকে—হয়তো তাদের পাড় দিয়ে ভাঙনটা আর সে-বছর এগবে না। হয়ও তাই। আমার বাল্যেরও অনেক আগে সারা বর্ষাঋতুতে তেমন অপেক্ষা আমি বুঝতে পারতাম। নদীর পাড়ের মানুষ কী করে যেন নদীর স্রোতের গতি বুঝতে পারে। ভাঙনের নদীর পাড়ের মানুষজন তাই বিপদে পড়ার আগেই বাড়ি ভেঙে সরে যেতে পারে। আমি যখন ১৯৭১-এর পরে বাংলাদেশে যাচ্ছি মা বলে দিয়েছিলেন—দেখে আসিস তো তোদের গ্রামটা ‘উঠেছে’ কীনা। সেই আমার প্রথম জানা যে ভাঙনের নদী যা ভাঙে তা আবার ফিরিয়েও দেয়। কৌতূহলটা রহস্যময় হয়ে ছিল। মিত্র-ঘোষের ভানুবাবুর দৌলতে ফরিদপুরের পদ্মা নিয়ে লেখা উপন্যাসটি পড়ে ও তারও পরে কাকলির ঠাকুমার পিতৃগৃহ দেখতে গিয়ে বুঝতে পারি।
হুমায়ুন কবীরের উপন্যাসটি আর পাওয়াও যায় না, পড়াও হয় না কেন সে বাংলা পাঠকদের এক রহস্য। ফরিদপুরের পদ্মা বা আমাদের গ্রামের যমুনা একটা নদীখাত দিয়ে বওয়া নদী নয়। একটা জায়গা নদীর জায়গা। সেখানে নদী কার্যকারণহীন ভাবে বয়ে যায়। বয়েও যায় আবার চরও ফেলে যায়। ফরিদপুরে-চর নাম দিয়ে পুবে ও দক্ষিণে সারি দিয়ে গ্রাম আছে। সবারই নাম, চর দিয়ে। হুমায়ুন কবিরের উপন্যাসটিতে আছে এমন নতুন-ওঠা চরের দখল দিয়ে দুই মুসলমান পরিবারের খুনোখুনি। যুক্তিটা হচ্ছে দুই পরিবারেরই দাবি চরটা তদের প্রাক্তন গ্রামের পুনরুত্থান।
নদী নিয়ে বাংলায় অনেক উপন্যাস আছে কিন্তু যত থাকা উচিত ছিল তত নয়। বাংলায় প্রধানত মানুষের জীবনের সঙ্গে নদীর বিনিময় প্রধান বিষয়। নদীর সঙ্গে জীবনমৃত্যুর লড়াই তুলনায় কম। হুমায়ুন কবীরের উপন্যাসটিতে সেই নদী ও সেই মানুষ আছে। এই নিয়ে কথা বলতে গেলে তারাশঙ্করের ‘তারিণী মাঝি’র কথা মনে না পড়ে পারে না। তবু এই একটু তফাৎ আছে—তারিণী মাঝি একজন বিশেষ মানুষের সঙ্গে নদীর সম্পর্কের অবিনশ্বর গল্প। আমি বলছিলাম—নদীর সঙ্গে একটা মানবসমাজের সম্পর্কের গল্পের কথা—সে-সম্পর্ক নিয়তির মত দুর্বোধ্য। বাংলার মত আর কোনো ভূখণ্ড কি আছে যেখানে এত মানুষের বসবাস। তার কারণ—তার ফলনশীল মাটি আর তার অসংখ্য-অসংখ্য নদী, উপনদী, খাল, বিল, হাঙর, জোলা, প্রাকৃতিক দিঘি, খোঁড়া পুকুর ও বন্যা ও সেই বন্যার ফলেই নিমজ্জিত মাটির পুনজম্ম। যেন এই সম্পর্ক একটা আবর্তন—এর শেষ নেই। নদী পাড় ভাঙছে, নদী আবার নতুন পাড় গড়ে দিচ্ছে।
কিন্তু কথাটা তো শুরু হয়েছিল মানুষের ডাকনাম দিয়ে, সেটা একটু সরে গিয়ে হল মানুষের অকারণ ভাল লাগা শব্দ। আমার ভাল লাগা এমন একটা শব্দ কী করে আমার রণন-স্মৃতিতে গেঁথে গেল তার রূপকথা খুঁজতে নদীর কথা এল। আমি শুরু করেছিলাম শব্দ কেন প্রিয় হয়। তার রহস্য বুঝতে এলাম ‘বৃষ্টিচ্ছায়’-শব্দটিতে। সেটা তো আমার বেশ একটু বয়সের পর ভাললাগা নিজের শব্দ।
কেন এমন ভালবাসা ঘটে যায় সেটা বলতে গিয়ে আমার মনে ছিল: খুব বড় এক বিস্তারের ওপর দিয়ে মেঘভাঙা বৃষ্টির ক্রমে ছুটে আসা। সে-কথা ভাবতেই মনে এল ছবি, আমার সেই আদি গ্রামের যমুনা নদীর ওপর থেকে বা উজান থেকে বৃষ্টির নদী ছেয়ে ফেলা। এর পর আসবে বোধহয় সেই অবুঝ শৈশবের অচেতন থেকে বৃষ্টির কত সাবালক স্মৃতি। এটাই তো লেখার আনন্দ। এক কথা থেকে আনকথা। ‘বৃষ্টিচ্ছায়’-এ কবে পৌঁছাব! দেখি।
১৯৪৭ সালের দেশভাগ আরও বহু কিছুর মতো বাঙালির সাহিত্যকেও দ্বিখণ্ড করেছিল। বাঙালির ইতিহাস নতুন পথে বাঁক নেওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের বাংলা কথাসাহিত্যের ভার যাঁরা হাতে তুলে নিয়েছিলেন, দেবেশ রায় ছিলেন সেই নবীনদের দলে। নবীনদের মধ্যে তিনি ছিলেন বটে, তবে ঠিক দলের ছিলেন না — না ভাবনায়, না লেখায়, না সাহিত্যে তাঁর অনুসন্ধানে। ক্রমশ পাকা হয়ে ওঠা কথাসাহিত্যের রাজপথ ছেড়ে আস্তে আস্তে তিনি সরে আসেন নিজের গড়ে তোলা এক আলপথে। এবং বিশিষ্ট হয়ে ওঠেন। দেবেশ রায়ের জন্ম পাবনা জেলার বাগমারা গ্রামে, ১৭ ডিসেম্বর ১৯৩৬ সালে। তাঁর শৈশবের কয়েকটি বছর কাটে উত্তাল যমুনার পারে। দেশভাগের কিছু আগে, ১৯৪৩ সালে, তিনি তাঁর পরিবারের সঙ্গে পূর্ববঙ্গ ছেড়ে জলপাইগুড়ি চলে যান।
‘যযাতি’ দিয়ে দেবেশ রায়ের উপন্যাসের সূচনা। কিন্তু ভারতের রাজনীতি যখন নকশালবাড়ি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থায় টালমাটাল, বাংলা সাহিত্যে তাঁর নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চারের সূচনা ঘটে সেই ১৯৭০ দশকে। মানুষ খুন করে কেন, মফস্বলী বৃত্তান্ত, সময় অসময়ের বৃত্তান্ত – একের পর এক উপন্যাসের অফুরন্ত প্রবাহ তাঁর শৈশবের নদী যমুনার মতো পাঠকের অভিজ্ঞতা ভেঙেচুরে একাকার করে দেয়। এ অভিজ্ঞতা তুঙ্গে পৌঁছয় তাঁর তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত-এ। রূপায়িত ইতিহাস আর মানুষের অচরিতার্থ স্বপ্নের চিরন্তন দ্বন্দ্বের এক মনুষ্যপ্রতিমা তাঁর এ উপন্যাসের চরিত্র বাঘারু। উপন্যাসটির জন্য ১৯৯০ সালে তিনি অকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত হন।
বাংলা ভাষা ও কথাসাহিত্য নিয়ে বহু মৌলিক প্রস্তাবও দেবেশ রায় তুলেছেন তাঁর উপন্যাস নিয়ে, উপন্যাসের নতুন ধরনের খোঁজে, উপনিবেশের সমাজ ও বাংলা সাংবাদিক গদ্য বইগুলোতে। বাংলা সাহিত্যে উপনিবেশের প্রভাব ও বাংলা ভাষার নিজস্ব প্রতিভা তাঁর অনুসন্ধানের বিষয়।
গত দেড় দশক ধরে দেবেশ রায়ের অন্যতম কৌতূহল বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জনজীবন। তাঁর বীক্ষণের মূল্য এই যে বিরাজমান গতবাঁধা দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি বাংলাদেশের সাহিত্যের পিঠ চাপড়াতে বসে যান না। পূর্ববঙ্গের পথরেখার তাৎপর্য তিনি বুঝতে চান এখানকার মানুষের সংগ্রামের নিজস্ব ইতিহাস থেকে। বাংলাদেশের নির্মীয়মাণ নাগরিকতা ও বাংলা ভাষার আঞ্চলিক রূপের ঐশ্বর্য — এই দুইয়ের মধ্যে দেখতে পান এ দেশের সাহিত্যের এক উর্বর জমি।
মৃত্যু ১৫ মে,২০২০