আজ ২৭ জুন কবি,কথাসাহিত্যিক ও সম্পাদক দীপশিখা পোদ্দারের জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার কবিকে জানায় শুভেচ্ছা ও শুভকামনা।
ইরাবতীর পাঠকদের জন্য রইলো তাঁর পাঁচটি কবিতা।
রামধনু মেয়েটির গান
এবার বোশেখ মাসে সেরকম বিয়ে হয়নি কারও।
বর যায়নি হু হু করে যে রকম প্রতিবার যায়।
এবার বোশেখ মাসে ঠাঠা রোদ একা একা পুড়ে যাচ্ছে
আর কাঁঠাল পাতার গায়ে চাঁদমাখা সন্ধেগুলো
জলেপড়া বেড়ালের মতো একছুটে চলে যাচ্ছে …
ধাক্কা খাচ্ছে কার্নিশে… জানালায়…
কিন্তু পড়ছে না। অন্যবার হলে পড়ে যেত। আর খুকখুক
কাশতে কাশতে সেগুলো কুড়িয়ে নিয়ে হাসিমুখে ঘরে ফিরত বাবা।
এবার বোশেখ মাসে বাবা নেই। ঠাঠা রোদ্দুরে
বিষণ্ণ বাঁশের খুঁটি বুকে করে তেমনই দাঁড়িয়ে আছে ঘর।
চিলতে বারান্দা আছে কোল ঘেঁষে। শুধু বাবা নেই আর।
নন্দীগ্রামের পথে পথে আজও ধুলো আছে। রোদ আছে। ছায়া আছে। এখনও চতুর্দিকে লাঠি আছে।
বারুদ বন্দুক আছে ওৎ পেতে।
স্বদেশী ও ভিনদেশী শেয়াল কুকুর আছে প্রস্তুত।
ইশারা অপেক্ষা মাত্র।
মানুষের প্রাণের ওপরে তারা নির্বিকার পুঁতে দেবে যার যার
দলীয় পতাকা……
নন্দীগ্রামের পথে কালবোশেখির মতো মুখ কালো করে আজ একা একা ঘরে ফিরছে মেয়ে।
লোকে তাকে যত না সুশ্রী বলে, তার চেয়ে ঢের বেশি
বয়স্থা বলেছে। কেননা সে শুনতে পাচ্ছে
সংঘর্ষে মৃত্যুর পরে তার বাবার শরীরে নাকি রং লেগেছিল।
রং ? কী রং ? কেমন রং সেটা ?
গাছের পাতার থেকে সবুজ কুড়িয়ে এনে মেয়ে বলে,
দ্যাখো তো , এই রং ?
নিহত বাবার রক্ত দু’হাতে কাচিয়ে এনে বলে,
দ্যাখো, ভাল করে দ্যাখো, এই রং ?
ফিসফিস বাতাস নিরুত্তর ফিরে ফিরে যায় …..
মেয়েটি অবাক হয়ে দ্যাখে তার ফেলে আসা বিবর্ণ শৈশব।
বাবার লুঙ্গির কোনও রং ছিল নাকি ? তপ্ত বোশেখে
পান্তাভাতের ঝোলে যে নুন ছড়িয়ে দিত মা,
খিদে ছাড়া তাতে কোনও রং ছিল নাতো !
তবু লোকে বলে,
জবরদস্তি লোকে রং ঢেলে দেয় নিহতের মুখের ওপরে….
আর তার ‘পরে দিন চলে যায় …
ফি বছর অন্ধকারে ফিরে ফিরে আসে সরু চাঁদ
দেবদারু পাতার পিছনে….
সেই অদ্ভুত আঁধারে,
শত শত সিঙুরে ও নন্দীগ্রামে বসে মেয়েটি বয়স্থা হতে হতে
জীবন বলতে আজও স্বপ্ন দেখে একপেট ভাত।
সে কখনো পড়েওনি, কোনদিন পড়বে কি
প্রিয়তম রবীন্দ্রনাথ ?
রোগা রোগা অ-আ
হয়তো এখনো এই শহরেই স্বপ্ন দেখছে কেউ কেউ
প্রতিষ্ঠিত ব্যাঘ্রের পশ্চাদে এখন ঘুরছে অনেক ফেউ
নন্দন চত্বরে কেমন জনসমুদ্র অবিশ্রান্ত ঢেউ..
স্বল্প দৈর্ঘ্য। স্মরনযোগ্য নির্দেশনায় তৈরি নতুন সিনেমা
বিষয়বস্তু হাতড়ে দেখি-
তুলতুলে পাখিদের খাদ্য রাত্তিরে ও দিনে মার
ভয় পেয়ে পালিয়ে বেড়াই নিজের ঘরে,বীজের ঘরে-
নাহ্ এখনো কারো দৃষ্টি থীম-না।
এমন অলীক সন্ধেবেলায় আমার বন্ধু একটি মাত্র ছায়া।
সেটাও আমার। তার খুব কাছে আশ্চর্য স্বপ্নের প্রতি মায়ায়
গত রাত্তিরে রাস্তার ধারে তুলতে দেখেছি মাকে-
অনুতাপহীন শায়া…
‘আলো’
যোনির ভিতর ধর্ম-কর্ম
যোনির ভিতর বাড়ি
যোনির ভিতর সম্পর্ক
উত্তরাধিকারী !
ইহুদি পার্সি হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ইসলাম
সব ধর্মেই কাম
নারীকে নিয়েছে রাতের কালোয়
প্রাচীরে প্রাচীরে বলেছে আলোয় :
‘নারী নরকের দ্বার’।
তবু
পৃথিবীর সব আলোপথ সব ছায়াপথ থেকে দূরে
জননী দিয়েছে যোনিপথ মেলে ধর্মের কুলে কুলে…
সেই ধর্মেই মন্দির মঠ
কোরান আবেস্তা গীতা ত্রিপিটক— তোমার আমার বাড়ি
নারীর জন্য কামকাঞ্চন উত্তরাধিকারী !
আলোকবর্ষ পার হয়ে এসে দাঁড়িয়েছি
দ্যাখো দাঁড়িয়ে রয়েছি একা
আমি শরৎ আকাশে মেঘের মতন
অনিকেত এক নারী।
ঘর নেই। কোনও চর নেই বলে দুঃখ করি না।
দু-কুল ছাপানো স্বপ্নে মাতাল শরীর দিয়েছি খুলে
এক ভুল থেকে ভেসে যাই আমি
মনের মতন অন্য আরেক ভুলে…
আমি ধর্মের সাথে সঙ্গম করি
স্রেফ করি সহবাস
ধর্মকে আমি চুষে ফেলে দিই
মানুষের গায়ে লিখে রাখি শুধু মানুষের ইতিহাস।
শতবর্ষের ধুলো উড়ে যায়…
দ্যাখো মেয়েটির চোখ স্বপ্নে কাজল কালো
সনাতন মেঘ ছিঁড়ে ফেলেছে ও
যোনিপথে ওর ঝর্ণার মতো আলো।
মহাপৃথিবী
মহানগরে এখন আর নেই একটিও দাঁড়কাক ।
অন্য জাতের কাকেরা যদিও আছে — তা থাক ।
আমাদের রাত বিবিধ আঁধারে ভোর হওয়া নিয়ে কথা,
পোশাক পরেছি আমরা নতুন গতানুগতিকতার।
এবং গোপন শরীরে দেখ কী বিচিত্র সব রোঁয়া !
গীতবিদ্যার সাথে শেখাচ্ছে নানান রকম শোওয়া…
অঙ্গে অঙ্গে সংকর সেরে দন্ডায়মান বিবিধ মতের ধর্মে
বাপকে স্বপ্নে শরীর দিয়েছে কী আশ্চর্যকর মেয়ে !
পাখিটাকে আজ কী নামে ডাকবে ! দু’দিনের মহাপৃথিবীর
মঞ্চে পড়ছে নতুন কবিতা আধুনিকতম তরুণ বুদ্ধিজীবী ।
আকাশ ভরা সূর্য তারা
ফাঁকের ভেতর অবাক ফোকর— কে কার দোসর? বলছ না।
বুকভর্তি দুগ্ধে নিঝুম হাত ডোবাচ্ছে রোমাঞ্চিত গো-চোনা।
সাক্ষী কে কার? শেষ দুপুরের রেলিংঘেরা কলেজ স্কোয়ার
রং বেরঙের সারমেয়দের চাকরি নতুন নতুন শোওয়ার
কিন্তু আমার ক্ষুদ্র আলাপ, মনখারাপ ও গত জন্মের জোলাপ
ঘুম ভাঙাচ্ছে, জিন্সের জিপ খুব সাবধানে ফোলা
ট্রাম-বাস ধরে এগোনো কষ্ট, সব স্বপ্নের চতুর্দিকে কাদা
মাথার উপরে বন্ধু ও মেঘ, সম্পর্করা আকাশ ভরা ধাঁধা…
তাদের ঘুম ঘুম নখ, স্বপ্ন পেলেই লেহনের শখ গর্তে ঢোকার আগে
মুখবন্ধ তৈরি করা দেখছে কবি খিদের মুখে বৃষ এবং ছাগের
দেখতে দেখতে প্রতিষ্ঠিত শরীর কি আর এমন করে পূর্বে
ঘুম চেয়েছে ? পথের কুকুর উদাস দুপুর পাখনা খুলছে উড়বে …
তুমুল উড়তে দিও, বিশেষ ভাবে সম্মানীয় ঘুম পেয়েছে যাদের
তাদের জন্য শয্যা পাতা রইল আমার তিরিশোর্ধ কার্নিশে ও ছাদে ।