ইরাবতী,ইরাবতী.কম,বিতস্তা ঘোষাল,irabotee.com,bitasta ghoshal,copy righted by irabotee.com

দিল্লির ডায়েরি (শেষ পর্ব)

Reading Time: 3 minutes

ফিরে এসেছি দিল্লি। এই তিনদিনের মধ্যেই কোটলা মুবারকপুর সেজে উঠেছে আলোয় আর নানান ফুলের মালায়। চেনা অঞ্চল হঠাৎ করেই অচেনা লাগছে। এই পাড়াটা ভীষণ ঘিঞ্জি। দুদিকে অজস্র দোকান। কী নেই সেখানে! একদিকে কাঁচা সবজির বিশাল বাজার, একদিকে সারি বেঁধে মুদিখানা, বাঁদিকের গলি জুড়ে স্টিলের বাসনের দোকান, শাড়ির বিপনী, কসমেটিক্স, জুটো, বাটা পর্যন্ত রয়ে়ছে, আর রয়েছে মিষ্টি, মোবাইল, ওষুধের শপ। লেপ, তোষক, বিছানা, বালিশের এত সম্ভার না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। এক কথায় এই বাজারে আলপিন থেকে এলিফ্যান্ট সবই পাওয়া যায়।
দুপা এগিয়ে গুরুদ্বুয়ার। সকালে লুচি হালুয়া প্রসাদ পাওয়া যায় সেখানে। মাঝেমধ্যে সেখান থেকে প্রসাদ নিয়ে আসে দর্শনা। বড় বড় দুধের ক্যান নিয়ে মিল্কভ্যান, সাইকেলও দাঁড়িয়ে পথ জুড়ে। আর রয়েছে অজস্র গরু, ষাঁড়, যত রাত বাড়ে তত এদের প্রভাব বাড়ে। চার মোড়ের মাথায় অটো, রিকশা, টোটো, ট্যাক্সি সার বেঁধে দাঁড়িয়ে। তার সামনেই মোমোর স্টল, সেখানে মোমোর পাশাপাশি ফ্রেঞ্চ ফ্রাইও বিক্রি করছে নেপালি তিনটে ছেলে। সব মিলিয়ে জায়গাটা সবসময় লোকে লোকারণ্য।

অনেক সময় এমন হয়েছে রান্না চাপিয়ে আমি দৌড়ে গিয়ে কিছু হয়তো ন্য়ে এসেছি নিচের দোকান থেকে। অথচ এই জায়গাটাই রাত সাড়ে এগারোটার পর ফাঁকা হয়ে যায়। তখন পুরো পাড়াটার দখল নেয় গরু, ষাঁড় আর কুকুরের দল। ভোরাই ঘরে ঢুকেই বলল, মা আজ কুতুবমিনার আর সরোজিনী মার্কেট যাব। আমি ঘড়ি দেখে বুঝলাম যেকোনো একটা জায়গাই যাওয়া যেতে পারে।মুখে বললাম, চলো তাহলে প্রথম কুতুবমিনার যাই।সেখান থেকে সরোজিনী চলে যাব।

ভোরাই দিল্লির ম্যাপ খুলে নিল মোবাইলে ।বলল, মা যে কোন একটাই চুজ করতে হবে।চলো কুতুবমিনারই যাই। অটো নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ।
বিশ্বের সর্বোচ্চ ইটনির্মিত মিনার এই কুতুব মিনার কুতুব কমপ্লেক্সের মধ্যে অবস্থিত, অনেকে মনে করেন, প্রাচীন হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের পাথর দিয়ে কুতুব কমপ্লেক্স এবং মিনারটি তৈরি করা ভারতের প্রথম মুসলমান শাসক কুতুবুদ্দিন আইবকের আদেশে কুতুব মিনারের নির্মাণকাজ শুরু হয় ১১৯৩ খ্রিষ্টাব্দে, তবে মিনারের উপরের তলাগুলোর কাজ সম্পূর্ণ করেন ফিরোজ শাহ তুঘলক ১৩৮৬ খ্রিষ্টাব্দে। ভারতীয়-মুসলিম স্থাপত্যকীর্তির গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে কুতুব মিনার গুরত্বপূর্ণ।
এর আশে-পাশে আরও বেশ কিছু প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় স্থাপনা এবং ধ্বংসাবশেষ রয়েছে, যা একত্রে কুতুব কমপ্লেক্স হিসেবে পরিচিত। এই কমপ্লেক্সটি ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান হিসেবে তালিকাবদ্ধ হয়েছে ।
কুতুব মিনার বিভিন্ন নলাকার শ্যাফট দিয়ে গঠিত যা বারান্দা দ্বারা পৃথকীকৃত। মিনার লাল বেলেপাথর দিয়ে তৈরি যার গায়ে পবিত্র কোরানের আয়াত খোদাই করা রয়েছে। ভূমিকম্প এবং বজ্রপাত এর দরুন মিনারটি একাধিকবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিন্তু সেটি পরবর্তী শাসকগণ মেরামত করেন। ফিরোজ শাহ-এর শাসনকালে মিনার-এর দুই শীর্ষ তলা বজ্রপাতে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তিনি তা মেরামত করেন। ১৫০৫ সালে একটি ভূমিকম্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত সিকান্দার লোদী তা মেরামত করেন। কুতুব মিনার-এর দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে ২৫ ইঞ্চি একটি ঢাল আছে যা “নিরাপদ সীমা” হিসেবে বিবেচিত হয়।
আমরা যখন পৌঁছলাম তখন সূর্য ডুবে গেছে। পর্যটকরা একে একে বেরিয়ে আসছে প্রাঙ্গণ থেকে।সামনে বেলুন, বাবলস, প্যাটিস, ফুচকা বা পানিপুরী, জলের বোতল ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছে ।ভোরাই সেদিকে তাকিয়ে বলল, উবের বুক করছি।সরোজিনী মার্কেট যাব। কুতুবমিনার দেখা হয়ে গেল?
অন্ধকার হয়ে গেছে ।আর এখানে না থাকাই ভালো।
অগত্যা চললাম সরোজিনী । রাস্তা গুলো সেজে উঠেছে আলোর মালায়।লাল নীল হলুদ সবুজ আলোর স্রোত সমস্ত রাজপথ জুড়ে ।এবার দিল্লিতে একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, প্রায় সব অটোর গায়েই লেখা , এই অটো মহিলাদের জন্য নিরাপদ, আমরা মহিলাদের শ্রদ্ধা করি, মহিলারাই সমাজের মূল কান্ডারী, তাদের রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য ইত্যাদি ।অটো রিফিউজটাও কমেছে দেখলাম।
প্রচন্ড জ্যাম কাটিয়ে পৌঁছলাম মার্কেটে ।ভোরাই বেশ কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনল।সেখান থেকে ফিরে এলাম বাড়ি।

এবার কলকাতা ফেরার পালা । ভাবি সকাল বেলায় আলুর পরোটা বানিয়ে দিল।আমাদের ফ্লাইট দুপুর ১১ টা ৫০মিনিটে। একটা লাল ওড়না দিয়ে ভাবি বলল, মেয়েকে খালি হাতে যেতে দিতে নেই।সত্যি তখন মনটা কেঁদে উঠলো ।কোনো আত্মীয় তো নন, তিনি, তবু যেন অনেক আত্মীয়র থেকে পরম আপন।আত্মার সঙ্গে যার জোট সেই তো আত্মীয় ।চোখে জল এল।মুছে নিচে নেমে এলাম।
দিল্লির আকাশ আজ রোদে মোড়া।সাদা মেঘ চোখ ঝলসে দিচ্ছে। এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে বসে আছি ।ফ্লাইট ৩ ঘন্টা দেরিতে ছাড়বে এসে জানতে পারলাম ।বসে বসে ভাবছি , একদিকে ঘরে ফেরার তাড়া ।প্রিয় মুখগুলো অপেক্ষায় ।অন্যদিকে মনটা পিছু টানে।এবারও ফিরে যাচ্ছি নানান ঘটনা মনের কুঠুরিতে বন্দী করে।হয়তো কোনো একদিন সেগুলো প্রকাশ পাবে।
দিল্লি আমার দ্বিতীয় বাড়ি।এখানে যখন আসি মন মেতে থাকে আনন্দে। কোনো কারণ না থাকলেও বারবার চলে আসি।কারণে অকারণে। ঘুরে বেরাই পুরোনো রাজপথ থেকে ব্যস্ত শহরের অলিগলি।কখনো পৌঁছে যাই পুরোনো মিনা বাজারে, চাঁদনিচকে, কুতুবমিনারের রাস্তায়। শুনি এক্কাগাড়ির টুংটাং ।খুঁজি ইতিহাস ।সামনে এসে দাঁড়ায় একের পর এক রাজপুরুষ, সম্রাট, বাদশা, সুলতান। কখনো বা জনপথ, লাজপত নগরের ভিড়ে সস্তায় কিনে নিই যা পছন্দ হয়।

এই শহরটায় একধরনের রূক্ষতা যেমন আছে তেমনি আছে অনুচ্চারিত ভালোবাসা ।এই শহর আমাকে দিয়েছে অনেক।ভালো লাগে অচেনা অটো ওয়ালাদের সঙ্গে গল্প, নির্দিষ্ট রাস্তায় না পৌঁছে অন্য রাস্তায় চলে যাওয়া , আর অনেক রাতে ঘরে ফিরে ঘুমের মাঝে সেই অটোওয়ালার জীবনের গল্প মনের মধ্যে গল্পের প্লট বুনে যায় ।উঠে পরি ।লিখতে বসি।উঠে আসে এক দর্শন ।ভালো থাকার জীবন বোধের দর্শন ।আবার কখনো অচেনা গাড়ি হঠাৎ থেমে যায় ব্রেক কষে ।চিৎকার করে ওঠে তার চালক, অন্ধ হায় কেয়া! ধমক দিয়ে জেনে নেয় গন্তব্য। বাঙালির হিন্দি শুনে চেনা ভাষায় বলে ওঠে চলুন, আপনার মতো পাগলীকেকে একা ছাড়া ঠিক হবে না। তারপর কখন যেন গড়ে ওঠে সম্পর্ক, বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। অসমবয়সী দুই মানুষের গল্প চলে, গল্প চলে. . তৈরি হয় ছাতিম ফুলের গন্ধে কিংবা হিম কুহূর গল্প।ছবি মুক্তি পায় আর আমি নতুন করে ভালবাসি এই শহরটাকে।
আর খানিকক্ষণ, তারপরেই উড়ে যাব অন্য এক শহরে, যা আমার জন্মস্থান, আমার বেঁচে থাকার শহর।আবার সেই দৈনন্দিন জীবনে ঢুকে যাব।আর বসে বসে ভাবব, এই তো জীবন ।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>