শুদ্ধসত্ত্ব ভট্টাচার্য রংপুর লায়ন্স স্কুল এন্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। বইপড়া, ভ্রমণ করা, তবলা বাজানোর পাশাপাশি লেখালেখি তার সখ। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয় তার ভ্রমণ কাহিনী ‘পাহাড়ে জঙ্গলে’।
আমি ২০০৯ সালের পূজোর সময় প্রথম ভারতে যাই। তারপর থেকে প্রায় প্রতিবছর এক দুইবার করে ভারতে যাই। ২০০৯ সালের পর এবারও আমরা পূজোর সময়ই ভারতে যাচ্ছি। ভারতের শিলিগুড়িতে আমার বড় মামা থাকেন। সেখানে আমার অসুস্থ দাদু (মায়ের বাবা) এবং দিদা (মায়ের মা) রয়েছেন। দাদুকে দেখতেই আমাদের এবারের যাওয়া। ২০১৯ সালের অক্টোবর মাস। যাবার দিন ঠিক করা ছিল ৩ অক্টোবর ২০১৯ কিন্তু এবার আমাদের যাওয়া দুপুরে। আমরা মানে আমি, মা এবং বাবা। মা রংপুরের লায়ন্স স্কুল এন্ড কলেজে চাকরি করে। আমিও লায়ন্স স্কুল এন্ড কলেজের ৭ম শ্রেণিতে পড়ি। সেদিন আমাদের স্কুলের হাফ ছুটি হয় এবং বাবার কলেজেরও হাফ ছুটি। বাবা কাউনিয়া কলেজের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। সেদিন ছিল আমাদের স্কুলের পাঠ উন্নয়ন পরীক্ষা-২ এর ফলাফল ঘোষণার দিন। কিন্তু এরমধ্যে আমাদের স্কুলের গভর্ণিংবডির সাবেক চেয়ারম্যান রংপুরের একজন বিশিষ্ট ডাক্তার অনিমেষ মজুমদার মারা যান। একারণেই আমাদের স্কুলের সকল কার্যক্রম সেদিনের মত বন্ধ করে ছুটি ঘোষণা করা হয়। ডাক্তার অনিমেষ মজুমদার বাবারও অনেকদিনের পরিচিত। তাই বাবা ও মা দু’জনেই সেখানে গেছিল। এসব নিয়ে কিছুটা ব্যস্ততার কারণে আমাদের যাবার সময়টা দুপুর ১টা থেকে দুপুর ২টা হয়ে যায়। আমরা মানিক নামের একজন ড্রাইভারের গাড়ি ভাড়া নেই কোথাও দূরে যাবার সময়। কিন্তু তার গাড়ি নষ্ট থাকায় তিনি আরেকটা গাড়ি পাঠিয়ে দেন। গাড়িটা এল ১৫ মিনিট দেরি করে। ড্রাইভারের নাম আব্দুস সামাদ। বয়স ২৫ থেকে ৩০ এর মধ্যে। এই সমস্ত দেরির কারণে আমরা যখন রওনা দেই তখন ঘড়িতে দুপুর ২টা৩০মিনিট।
এদিকে সদ্য প্রয়াত রংপুরের সংসদ সদস্য বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হোসেইন মো. এরশাদের মৃত্যুতে রংপুরের শূণ্য আসনের উপনির্বাচনের তারিখ ধার্য হয়েছে ৫-ই অক্টোবর। নির্বাচনে ব্যবহারের জন্য পুলিশ থেকে গাড়ি রিকুজিশন করে নেয়া হচ্ছে। আমাদের এই গাড়িটা রিকুজিশন করাই ছিল। সেদিন রাত বারোটা থেকে গাড়িটা পুলিশের হাতে চলে যাবে।
রংপুর থেকে বুড়িমারী স্থলবন্দর ১০৩ কিলোমিটার। যেতে সময় লাগে আড়াই ঘন্টার মতো। আমরা ঠিক করলাম পথে কোথাও যাত্রা বিরতি দেওয়া হবে না অন্যবার গুলোর মতো। প্রতিবারের মতো এবারও আমি ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছি, কারণ ওটা আমার অনেক পছন্দের জায়গা। ওখানে বসলে যেমন সামনের সবকিছু ভালো দেখা যায় আবার গাড়ি চালানোটাও ভলো করে দেখা যায়, যা আমার খুব পছন্দের বিষয়। কিছুটা যাওয়ার পর গাড়িতে তেল ভরতে একটু সময় লাগল। এখন গাড়ি আরও জোরে চলল। রংপুর থেকে বুড়িমারী যাবার দুটি রাস্তা। একটি জলঢাকা দিয়ে আর অন্যটি হাতীবান্ধা দিয়ে। রাস্তা দুটি কিন্তু দুই রাস্তা দিয়েই বুড়িমাড়ী পৌঁছানোর ক্ষেত্রে দূরত্ব একই। জলঢাকার রাস্তাটা বড় এবং রাস্তায় একটি মাত্র রেলগেট। তাই আমরা জলঢাকার রাস্তা দিয়েই চললাম। আমাদের গাড়ির ড্রাইভারকে বলাই ছিল আমাদের তাড়া আছে তাই সে জোড়েই গাড়ি চালাচ্ছে। বাবা-মা মাঝেমাঝে সাবধান করছে জোড়ে হলেও যেন সাবধানে চালায়। জলঢাকা পৌঁছাতে আমাদের সময় লাগল ১ঘন্টা ৩০মিনিটের মতো। সেখান থেকে গাড়ি আরও জোড়ে চলল। ড্রাইভার কাকু আমাকে বলল, “তিস্তা ব্যারেজের কাছাকাছি পুলিশ আমাদের গাড়ি চেক করতে পারে। ব্যাগে নতুন জিনিস আছে?” আমি বললাম, “বাবাকে দেখিয়ে বলবেন উনি পূজার সময় যাচ্ছেন পরিবার নিয়ে আত্মীয় বাড়ি। তাই নতুন জামাকাপড় কিনেছেন।” কিন্তু ব্যারেজের আশেপাশে পুলিশের চেহারা দেখা গেল না। ব্যারেজ থেকে বুড়িমারীর দূরত্ব কম এজন্য ৩৫ মিনিট মতো লাগল বুড়িমারী স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছাতে। আমি তো মনে মনে ভাবছি আর বেশিক্ষণ না বর্ডার চলে আসবে! কিন্তু সেখানে পাথর বোঝাই ট্রাকের জ্যাম। গাড়ি একটুও এগোচ্ছে না। কারণটা কিছুই না একটা ট্রাক রাস্তার মাঝখানে দাঁড়ানো। ট্রাকে ড্রাইভার নেই। এদিকে সময় পার হচ্ছে। আমরা ঘড়ি দেখতে ভয় পাচ্ছি, দেখছি বাবার মুখের দিকে। বাবার মুখ গম্ভীর, কপালে চিন্তার ভাঁজ। কারণ বর্ডার বন্ধ হওয়ারও নির্দিষ্ট সময় থাকে যা হতে আর বেশিক্ষণ বাকি নেই। বর্ডারে আমাদের পাসপোর্টের কাজ করে খতিবর নামক একজন। বাবা তাকে ফোন করায় ১০ মিনিটে সে চলে এলো ঘটনার জায়গায়। আমাদের গাড়ি একঠা ট্রাক আর একটা ট্রাক্টরের মাঝখানে দাঁড়ানো। আমাদের ড্রাইভার কাকু গাড়িটা বেশ কেরামতি করে ঘুড়িয়ে রাস্তার অন্য পাশে নিয়ে এলো।
আমরা এবার চললাম একটা কাঁচা রাস্তা দিয়ে। আমি তো রংপুর থেকেই সামনের সিটে বসে এসেছি। তাই এখন মা-বাবার সাথে খতিবর কাকু পেছনে বসল। এ রাস্তা আমাদের সবার অচেনা শুধু খতিবর কাকু ছাড়া। সেজন্য সেই আমাদের পথ প্রদর্শক। আমাদের এই ড্রাইভারটির বয়স কম এবং অভিজ্ঞতাও কম। রাস্তাটা চিকন। কিছুদূর এগোনোর পর আমরা দেখলাম রাস্তার দুই পাশে দুটো বড় কাঁঠাল গাছ। গাড়ির বাইরের দুইদিকের আয়না দুটো ঘুড়িয়ে দেবার ফলে গাড়িটা দুই গাছের ফাঁক দিয়ে বেড়িয়ে যেতে পারল আর আমরা আবার কিছুটা আস্বস্ত হলাম। গাড়ি এবার অনেকটা জোরে চলছে। ছ’টা প্রায় বাজে বাজে। বর্ডার বন্ধ হয় সাড়ে ছ’টায়। এবার আর এক বিপদ, রাস্তার মাঝখানে পাশের এক বাড়ির কাপড় মেলার দড়ি বাঁধা এক খুঁটি। জ্যামে গাড়িটা ঘোড়ানোর সময় থেকেই ড্রাইভার কাকুর মাথা গরম। যতটুকু গরম হওয়া বাকি ছিল তা এই খুঁটিটা দেখেই হয়ে গেল। এবার ড্রাইভার কাকু আর খতিবর কাকু যৌথভাবে খুঁটিটা উপড়ে পাশের ধান ক্ষেতের মধ্যে ফেলে দিল। গাড়ি আবার চলল। খুঁটিটা যে বাড়ির ছিল সেই বাড়ির একজন মহিলা অনেক বকা দিতে দিতে আমাদের গাড়ির পেছনে দৌড়ে দৌড়ে আসা শুরু করেছিল কিন্তু গাড়ির গতি বেশি হওয়ায় সে সুবিধা করতে পারেনি। অবশেষে আমরা আবার মূল রাস্তায় এসে উঠলাম। কিছুদূর ভালই এগোনোর পর আমরা আবার জ্যামে আটকে গেলাম। এই জ্যাম থেকে বেড় হওয়ার আর কোনো উপায় নেই। খতিবর কাকুর বুদ্ধিতে আমরা এবার গাড়ি থেকে নেমে প্রায় দৌড়ে একটা ভ্যান রিক্সায় উঠলাম। ভ্যান রিক্সাটা ছিল জ্যামের এলাকার পরে। ভ্যান রিক্সায় উঠে এবার আমরা চললাম বুড়িমারী পুলিশ ইমিগ্রেশনের দিকে। গাড়িটা জ্যামে বসে থাকল কারণ যদি আমরা সময়ের মধ্যে বর্ডার পার না হতে পাড়ি তাহলে গাড়ির দরকার পরবে। খতিবর কাকু আমাদের পাসপোর্টগুলো আগেই নিয়ে নিয়েছে। ইমিগ্রেশনে পৌঁছানোর পর আমি চললাম খতিবর কাকুর পেছনে পেছনে। এদিকে বর্ডার বন্ধ হতে আর ১৫ মিনিট মত বাকি। তখনও বেশ কিছু মানুষ পাসপোর্টের কাজের অপেক্ষায়। আমি ভয় পেয়ে চুপ করে আছি, আর বুঝি আজকে যাওয়া হয়না! খতিবর কাকু এরমধ্যে ইমিগ্রেশন কাউন্টারের লোকটিকে বাবার অনেক পরিচয় দিচ্ছে। এরমধ্যেই আবার বাবাকে পিছন ঘুরে বলল, স্যার গাড়িটা ছেড়ে দেন কাজ হয়ে যাচ্ছে। বাবা-মা বিস্ময় নিয়ে খতিবর কাকুর মুখের দিকে তাকালেও ওখানে কিছু বলল না। আর আমার মনে আশা দৃঢ় হচ্ছে, তাহলে আমরা আজই যেতে পারছি। বাবা মানিক কাকুকে ফোন করে বলল, ‘সামাদ যেন ফিরে যায়।’ রংপুরে আমাদের একজন পরিচিত কাকুকে বাবা বলে দিল গাড়ির টাকাটা দিয়ে দিতে। আবার বাবা মানিক কাকুকে ফোন করে ওই কাকুর ঠিকানা দিয়ে বলল ওখান থেকে টাকাটা নিয়ে নিতে। এমন কাজও এবারই প্রথম হল আমাদের। পাসপোর্টের কাজ খতিবর কাকু যেন যাদুমন্ত্রবলে করে আমাদের নিয়ে ছুটল সীমান্তের দিকে। পথে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের ঘাঁটি। কিন্তু সেখানে কাউকে দেখলাম না। বলে রাখি, এই প্রথম আমরা তিনজন সন্ধ্যার পরের বর্ডার দেখলাম।
আমরা ছুটছি খতিবর কাকুর পিছনে পিছনে। সীমান্তে পৌঁছে দেখলাম ৬.২৫ বাজে। অর্থাৎ বর্ডার বন্ধ হতে আর ৫ মিনিট বাকি। বাংলাদেশ কাস্টমস্ আমাদের পাসপোর্ট দেখে ছেড়ে দিল কিন্তু ব্যাগ দেখল না। খতিবর কাকুর কাজ শেষ। কাকু তার টাকা নিয়ে আমাদের বিদায় জানিয়ে চলে গেল।
এপারের খতিবর কাকুর মত ভারতে বাবার পরিচিত স্বপন দাম কাকুর লোক কিরণ কাকু এসে ওপারে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। ভারতের কাস্টমসও আমাদের পাসপোর্ট দেখেই ছেড়ে দিল। কিরণ কাকু আমাদের পাসপোর্ট নিয়ে চলল ইমিগ্রেশনের দিকে, আমরা তার পিছনে চললাম। খুব দ্রুত আমাদের ফরম পূরণ আর ছবি তোলা হয়ে গেল। এপারে বুড়িমারী আর ওপারে চ্যাংড়াবান্ধা। কিরণ কাকুকে বলে বাবা একটা গাড়ি ঠিক করিয়ে রেখেছিল কারণ সন্ধ্যার মুখে গাড়ি পাওয়া মুশকিল হবে। আর এখন তো সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে।
আমরা কাজ শেষে স্বপন দাম কাকুর কাউন্টারে এসে বসলাম। স্বপন কাকু কাউন্টারেই ছিলেন, ওই সময় উনি থাকেন না। বাবার ফোনের কারণে ছিলেন। স্বপন দাম কাকুর কাউন্টার থেকেই আমরা প্রতিবার টাকা ভাঙিয়ে নিই। সেদিন বাংলাদেশি ১০০ টাকা দিলে ভারতীয় ৮২ টাকা পাওয়া যাচ্ছিল। অনেক সময় এটি পরিবর্তন হয়।
আমাকে বাড়িতে পড়ান লতিফ স্যার। রংপুর থেকে রওনা দেবার সময় লতিফ স্যার ফোন করে বলেছিলেন আমরা বর্ডারে পৌঁছে আমি যেন তাঁকে জানাই। স্বপন দাম কাকুর কাউন্টার থেকে বাংলাদেশের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। আমি স্যারকে ফোন করে জানিয়ে দিলাম যে আমরা বর্ডার পার হয়েছি। টাকা ভাঙিয়ে নেবার পর স্বপন দাম কাকুর সাথে আমরা চললাম চ্যাংড়াবান্ধা বাজারে চা খেতে। আমরা চললাম গাড়িতে আর স্বপন দাম কাকু চললেন তাঁর মোটরসাইকেলে। চ্যাংড়াবান্ধা বাজারে চা খেয়ে এবার আমরা চললাম শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে।
এই গাড়ির ড্রাইভারটির নাম বিরাজ রায়। যদিও স্বপন দাম কাকুরা তাকে ‘পারো’ বলে ডাকছিল। কারণ জিজ্ঞাসা করায় সে বলল তার স্কুলের এক বান্ধবীর নাম ছিল ‘পারো’। পারোর সাথে তার একটু খাতির ছিল জন্য সবাই এখন তাকেই পারো বলে ডাকছে। প্রতিবার এই রাস্তা দিয়ে আমরা বিকেলবেলা যাই কিন্তু আজ রাতে যাচ্ছি। আগামীকাল মহাষষ্ঠী তাই রাস্তায় পূজোর প্যান্ডেল একটু পরপরই দেখা যাচ্ছে। রাস্তার ধারে ধারে চা বাগান কিন্তু রাতের অন্ধকারে সেসব দেখা যাচ্ছে না।
আমরা জলপাইগুড়ি পার হবার পর মন্থনি নামক একটি যায়গায় যাত্রাবিরতি দিলাম। মন্থনিতে উত্তরা লের বিদ্রোহী জমিদার জয়দূর্গা দেবী চৌধুরানীর মন্দির আছে। কিন্তু এই সময় মন্দিরটি বন্ধ থাকার কারণে আমরা মন্দিরটিতে ঢুকতে পারলাম না। মন্থনিতে গোবিন্দ হোটেল নামক একটি হোটেল আছে। সেখানকার মোমো খুব ভাল। আমরা সেখানে মোমো এবং চা খেলাম। গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে…।
জন্ম ২০০৭ খ্রিস্টাব্দের ১৮ মে রংপুরে। লায়ন্স স্কুল এন্ড কলেজ রংপুরের দ্বাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। বইপড়া, তবলা বাজানো, কবিতা আবৃত্তি, ভিডিও এডিটিং ও ভ্রমন শখ। প্রিয় চরিত্র সত্যজিৎ রায়ের প্রদোষচন্দ্র মিত্র ওরফে ফেলুদা ও সত্যজিৎ রায়ের আরেক চরিত্র প্রফেসর শঙ্কু। প্রিয় মানুষ বাবা ও মা। লক্ষ অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া। প্রকাশিত বই আইডিয়া প্রকাশন থেকে একুশে বইমেলা ২০১৯-এ প্রকাশিত পাহাড়ে জঙ্গলে।