Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

দেখা

Reading Time: 7 minutes

লম্বায় পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি, গায়ের রঙ শ্যামলা, হালকা পাতলা গড়ন, একটু লম্বাটে ধাঁচের মুখ, বড় বড় চোখ, পিঠময় ছড়ানো বারগেন্ডি রঙের স্ট্রেইট চুল… ধুর! এটা কোনো বর্ণনা হলো! এই বর্ণনা আজকালকার বেশিরভাগ সাতাশ-আটাশ বছরের মেয়ের সঙ্গেই মিলে যাবে। এমনকী চুলের রঙটা বাদ দিলে এমন দেখতে মেয়ে অন্তত আমার পরিচিত গণ্ডিতেই দশ বারোজন খুঁজে পাওয়া যাবে। আমি এবার বিরক্ত হয়ে বলি-

আচ্ছা, আপনি এমন করে বললে এনাকে তো খুঁজে পাওয়া যাবে না!

আরে, যাবে যাবে! মোবাইলে ভেসে আসা ভরাট কণ্ঠে এবার কৌতুকের আভাস পাওয়া যায়- এই মেয়েকে খুঁজে পাওয়া নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। এই মেয়ের একটা ইউনিক বৈশিষ্ট্য আছে।

ইউনিক বৈশিষ্ট্য? আমি এবার কান খাড়া করে শুনি। রুকাইয়া আহমেদের ইউনিক বৈশিষ্ট্যই আমার সবচেয়ে ভালোভাবে জানা দরকার।

আচ্ছা শোনেন, এক সপ্তাহ পরে আমি একবার কল করব আপনাকে। এই নম্বর বন্ধ রাখবেন না।

ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা শেষ করে আমি ইয়ারফোন খুলে ফেলি কান থেকে। বাহ্! মেয়েটার রুচি আছে বলতে হবে। যে বৈশিষ্ট্যের কথা শুনলাম তা আসলেই অনন্য, অন্তত পুরোটা অন্য কারও সাথে মিলে যাবার একটুও সম্ভাবনা নেই। সুতরাং ধরে নেয়া যায় বিয়েবাড়ির আমন্ত্রিত অনেক অনেক অতিথির ভিড়েও তাকে খুঁজে পাওয়াটা একদম সহজই হবে আমার জন্য।

নকিয়ার পুরনো পিচ্চি ফোনটা থেকে ইয়ারফোন খুলে নিয়ে এবার সেটার সুইচ অফ করি আমি। আপাতত এই ফোনের কাজ ফুরিয়েছে। আবার এটা অন হবে এক সপ্তাহ পর, সময়টা এখনও জানি না। আমার অ্যান্ড্রয়েড ফোনটায় হেদায়েত কনফার্ম করলেই কেবল এই ফোনটা চালু হয়। ফোনটা চালান করে দিই খাটের নিচে সংযুক্ত ড্রয়ারে। কাজ ফুরালে ওখানেই পড়ে থাকে ওটা।

পাশে পাতা ভাঁজ করে রাখা ‘রেড ড্রাগন’টা খুলি আবার। আজ সকালেই শুরু করেছি বইটা। আশ্চর্য নেশা ধরে গেছে এই কয়েক ঘণ্টায়। আটলান্টার লিডস পরিবারের হত্যাকাণ্ডের সূত্র ধরে একের পর এক ভয়াবহ সিরিয়াল কিলিংয়ের তদন্ত করতে নাকানি চুবানি খেয়ে যাচ্ছে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের বাঘা বাঘা অফিসাররা। আহ্! এই না হলে কিলার! আমি তো মনে হচ্ছে রীতিমতো প্রেমেই পড়ে গেছি চরিত্রটার।

পড়তে পড়তে রীতিমতো বুঁদ হয়ে গিয়েছিলাম। মোবাইল ফোনটা বিপ করে ওঠে হঠাৎ। সেই শব্দে সম্বিত ফেরে। ফোন হাতে নিয়ে দেখি সুপারশপের মেসেজ। বালছাল! আজকাল মোবাইল কোম্পানি আর এইসব ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মেসেজের জ্বালায় জরুরি মেসেজ খুঁজে পাওয়া দায়। মাঝখান থেকে আমার মনোযোগটা দিল নষ্ট করে! বিরক্ত হয়ে আমি ফোন রাখতে যাবো, দেখি আড়াইটা বাজে প্রায়। ইশশ রে! সারাটা দিন শুয়েই কাটালাম! পেটে দানাপানি কিছু পড়েনি সকাল থেকে। বইটা রেখে আমি উঠে পড়ি এবার। সত্যি সত্যি কিছু খাওয়া দরকার।

বিছানা ছেড়ে ব্রাশ করে নিই ঝটপট। তারপর গোসলে ঢুকে যাই। গোসল আমার সবচেয়ে প্রিয় কাজগুলোর একটা। আজও প্রায় আধাঘণ্টা ধরে শাওয়ারের নিচে মাথা পেতে রাখতে ভালো লাগে। জলের ধারা কেমন আদর করে করে আমার গা বেয়ে নেমে যায়, এই অনুভূতিটাই অসাধারণ। আজকাল আমাকে আদর করার, ভালবাসার লোকের বড্ড অভাব। জলের এই আদরটুকু তাই আমি মনেপ্রাণে উপভোগ করি।

দুটো ডিম পোচ, গরম করে নেয়া এক স্লাইস ব্রেড আর একটা অ্যাভোকাডোতে আমার সারাদিনের খাওয়া শেষ করি। আজ বোধহয় বুয়ার রুটিন কামাই। কালকের জমানো থালাবাটি সব পড়ে আছে সিংকের ওপর। থাকুক। কাল এসে ধোবে তেমন হলে। মাঝেমধ্যে কোনো কাজেই হাত লাগাতে ইচ্ছে করে না। আজ তেমন একটা দিন। আমি এসে চুপচাপ শুয়ে পড়ি।

চিলেকোঠার এই ছোট বাসাটা আজ তিন বছর ধরে আমার ঠিকানা। তার আগের একটা বছর এখানে ওখানে ঘুরে বেড়িয়েছি ঠিকানাবিহীন। বন্ধুরা কেউই তাড়িয়ে দেয়নি সে সময়, ভালবেসেই কাছে রেখেছিল। ওদের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই আসলে।

‘নিসর্গ’ নামের নতুন গড়ে ওঠা সুন্দর আবাসিক এলাকার ভেতরে বলে এ বাসায় যানবাহনের শব্দ কিংবা ধুলোবালি তেমন নেই। আর চিলেকোঠা হলেও গরম অনেকটাই কমে গেছে পশ্চিমদিকের আট তলাটার জন্য। বিকেলের রোদ সব সেটার ওপর দিয়ে চলে যায়। আমার মতো একজনের জন্য বাসাটা সবদিক দিয়ে পারফেক্ট। আর ছাদটা! গভীর অন্ধকারের রাতে একলা গিটার বাজানোর এমন জায়গা আর কোথায় খুঁজে পেতাম আমি?

বাসাটা খুঁজে দিয়েছিল মোয়াজ্জেম। আজ মোয়াজ্জেম নেই। গত বছর মিরপুর বেড়িবাঁধের ওপর ক্রসফায়ারে মরে পড়ে রইলো অমন তরতাজা হাসিখুশি ছেলেটা! মোয়াজ্জেমের কথা ভাবলেই আমার বুকের ভেতর কষ্ট হয়। আমার দুঃসময়ে ছেলেটা পাশে ছিল। বড় ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়ও সেই করিয়ে দিয়েছিল। নাহলে আজ আমি কোথায় ভেসে যেতাম তার কোনো ঠিক নেই।

বড় ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়নি বহুদিন। আসলে আজকাল বাইরে যাওয়া, আড্ডাবাজি সব কমিয়ে দিয়েছি। এমনিতেই এখন বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগও নেই বলতে গেলে। তার চেয়ে সময় পেলেই পড়ি- ক্রাইম আর সাইকো থ্রিলার বর্তমানে আমার পছন্দের জনরা। এই ক’বছরে এমন কত বই যে পড়লাম! সুযোগ পেলে ল্যাপটপে এই সিরিয়ালগুলোই দেখি। ভালো সময় কেটে যায়। তবু আজ অনেকদিন বাদে বড় ভাইয়ের সঙ্গে একটু দেখা করার ইচ্ছে হয় আমার। এই লোকটার ওপর কত ভরসা করতাম এককালে!

বড় ভাই কোনোদিন আমার ওপর জোর করেনি। বোধহয় আমি ভালো ছাত্র ছিলাম বলে আমার ওপর একটা সস্নেহ প্রশ্রয়ও ছিল তার। কে জানে। এমনকী আমি যখন তার কাছ থেকে নিজের মতো চলে আসতে চেয়েছি তখনও বড় ভাই বাধা দেয়নি। শুধু তার গমগমে গলায় জানিয়ে দিয়েছিল-

নিজের মতোন কাম করবি তো যা। কিন্তু বেইমানিটা কোনোদিন করিস না ইমইন্যা। জানিস তো এই লাইনে বেইমানি সহ্য করা হয় না।

না না। সেই বেইমানি আমি করব না কোনোদিন। অতটা নেমকহারাম বোধহয় হতে পারিনি এখনও।

রেড ড্রাগন পড়া শুরু করব বলে সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়েছিলাম। এখন বেজায় ঘুম পেয়েছে। আমি মোবাইলে ঠিক সাড়ে পাঁচটায় এ্যালার্ম সেট করে দিই। বড় ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাবো সন্ধ্যায়।

দুই

ধনী পরিবারের কারও বিয়ের আবহই অন্যরকম হয়। জমকালো কমিউনিটি সেন্টার বা নামিদামি হোটেলের ধরন থেকে শুরু করে আমন্ত্রিত অতিথিদের সাজপোশাকও তার সাক্ষ্য দেয় পদে পদে। অনেকদিন পর এমন একটা বিয়েবাড়িতে এসে পড়ে প্রথম প্রথম কিছুটা অস্বস্তি শুরু হয়েছিল বটে তবে এখন সামলে নিয়েছি। ব্যুফে টেবিল থেকে একটা অরেঞ্জ জ্যুসের গ্লাস তুলে নিয়ে আমি ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকি চারপাশ। খাওয়া দাওয়া শুরু হতে আরও কিছুটা দেরি আছে তবে এখন চাইলে হরেক রকম জ্যুস চেখে দেখতে পারে যে কেউ।

খুলনার সবচেয়ে নামি হোটেল এই হোম ইন্টারন্যাশনাল। নিউমার্কেটের পাশে অনেকখানি জায়গাজুড়ে সাত তলা হোটেলটা দেখতে সত্যি ভীষণ সুন্দর। নিচতলার এই হলরুমটা যেমন বিশাল তেমনি সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো। বাইরে থেকে ঢোকার জন্য তিনটা বড় দরজা আছে, সবচেয়ে বাঁ পাশেরটার একটু পরেই রিসেপশন, তার পরের ফাঁকা জায়গাটুকু পেরিয়ে গেলেই এন্ট্রান্স। কাকতালীয়ভাবে ওই দরজার পাশ থেকে বর-কনের স্টেজটাও খুবই চমৎকার দেখা যায়। আমি আমার কাজের জন্য ওখানেই জায়গা বেছে নিয়েছি।

ঢাকা থেকে এসে আমি উঠেছি বাসস্ট্যান্ডের কাছের প্যারাডাইস হোটেলে, বেনামে । ওই ধরনের হোটেলগুলো থাকার জন্য অতটা সুবিধাজনক না হলেও ঝামেলা কম, আইডি কার্ডও লাগেনা চেক ইন করতে। এমন হোটেলেই আমার জন্য ভালো। আসার পর ফ্রেশ হয়ে শহরটা ঘুরে দেখতে বেরিয়েছিলাম কাল। তখনই একবার হোমের সামনে থেকে একটা চক্করও দিয়ে গিয়েছিলাম। ভেতরে আসিনি অবশ্য। অকারণে নিজের চেহারা সবখানে না দেখানো ভালো। আজ কাজ শেষে হোটেলে ফিরে ব্যাগটা নিয়েই বেরিয়ে পড়বো। বাসের অপেক্ষায় থাকা চলবে না। একটা রেন্ট-এ-কার বলা আছে, মাওয়া ঘাট পর্যন্ত যাব সেটায় করে। সবকিছুর ছক আগে থেকে কাটা না থাকলে এ লাইনে চলে না, সে আমি খুব ভালো করে জানি।

খুব কম কম চুমুক দিচ্ছি জ্যুসে। তাড়াহুড়োর কোনো কারণ নেই। এখনও সব অতিথি এসে পৌঁছায়নি মনে হয়। যারা এসেছে তারা পরিচিতদের সঙ্গে গল্পগুজব করে চলেছে। কথায় কথায় হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে অনেকেই। তবে একটা জিনিস সব জায়গায় এক। আজকালকার মেয়েদের সাজগোজের কারণে সব কয়জনকে একরকম দেখায়। এখানেও জটলা করা সবগুলো মেয়েকে আমার একই রকম লাগছে।

এই বিয়েবাড়িতে একজনও আমার পরিচিত নয়। তবু কারও চোখাচোখি হয়ে গেলে ভদ্রতার হাসি দিতে হচ্ছে। যাকে খুঁজছি তাকে এখনও চোখে পড়েনি। তাকে না চিনলেও নামটা জানি। তবে নামের চেয়েও আজ কাজে দেবে তার সেই ‘ইউনিক বৈশিষ্ট্য’। আরেকটু পর আসবে বোধহয়। কিংবা এসেছে, অন্য কোথাও আছে। আমার মন বলছে তার সঙ্গে দেখা হবার জন্য খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না আর।

হাঁটতে হাঁটতে আমি দোতলায় যাবার ঘোরানো সিঁড়িটার কাছে আসি। আরে ওই তো সেই! সাদা রঙের চমৎকার জামদানি শাড়ি, চুল উঁচু করে বাঁধা খোপার ভদ্রমহিলাকে দেখতে পেয়েছি। একপাশে ঝুঁকে পাশের আরেকজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে নামছে বলে মুখটা দেখতে পাচ্ছি না। এপাশ থেকে দেখা যাচ্ছে, বাম কানে, ঐ তো রূপা আর মুক্তার কাজ করা ঝোলানো দুল। সবকিছু একদম ঠিক ঠিক মিলে গেছে। ভদ্রলোক ঠিক এই সাজের কথাটাই বলেছিলেন আমাকে। যাক বাবা। আমার অপেক্ষার ফল পেয়েছি এতক্ষণে। খুশিতে বাকি জ্যুসটুকু এক চুমুকে শেষ করে দিই।

ওরা প্রায় নেমে এসেছে। ওয়েটারের হাতে গ্লাসটা ফিরিয়ে দিয়ে আমি সরে গিয়ে কয়েকজনের পেছনে দাঁড়াই। আমাকে দেখতে পায়নি ওই দু’জনের কেউ। সাদা জামদানি পরা রুকাইয়া আহমেদ এবার হাসিমুখে সামনের দিকে তাকায়। আর আমি যেন স্তব্ধ হয়ে যাই, আমার সমস্ত শরীর স্থির হয়ে যেতে চায় এখানে- কারণ চোখের সামনে এবার যাকে পুরোপুরি দেখতে পেয়েছি, সে আর কেউ নয়, সে সায়র!

সায়র! সায়র! সায়র! আমার বুকের ভেতর প্রবল অবিশ্বাসের জোয়ার ভাঙতে চায়। কিন্তু আমি অবিশ্বাস করতে পারি না। সত্যি সত্যিই সায়র হেসে হেসে কথা বলছে অন্যান্য অতিথিদের সঙ্গে। আর ওকে দেখতে কী সুন্দর লাগছে! অবিকল চার বছর আগের চেহারায় ও আমার সামনে দাঁড়িয়ে। আমার বিশ্বাস হতে চায় না গত একটা মাস আমি ওর জন্যই পরিকল্পনা সাজিয়েছি একের পর এক, ওর জন্যই কাল ঢাকা থেকে খুলনা এসেছি আর এই মুহূর্তে এই জমকালো বিয়েবাড়ির একজন আমন্ত্রিত অতিথির মতোই দাঁড়িয়ে আছি অন্যদের সঙ্গে!

আমি আরও ভালো করে আড়াল নেবার চেষ্টা করি। সায়র যেন কিছুতেই আমাকে দেখতে না পায়। প্রথম ডিসেম্বরের শীতেও আমি জ্যাকেটের ভেতর ঘামতে থাকি দরদর করে। সায়রের সঙ্গে আমার শেষ কথাটা মনে পড়ে স্পষ্ট।

ইমন, তুমি চলে এসো প্লিজ। আজ রাতে আমার বিয়ে। আমি কিছুতেই এ বিয়েটা করব না। তুমি ন’টার সময় শ্যামলী সিনেমা হলের সামনে থেকো। আমি আসব!

ফোনের অন্যপাশ থেকে কেমন মরিয়া হয়ে বলেছিল সায়র সেদিন! সদ্য অনার্স পরীক্ষা দেয়া আমার সাহসে কুলায়নি সায়রকে নিয়ে পালানো। ওকে নিয়ে কোথায় যাব, কী করব, মা কীভাবে নেবে সবকিছু ভাবতে ভাবতে আমি সেদিন পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলাম। মোবাইল ফোন বন্ধ করে পালিয়ে গিয়েছিলাম হল থেকে। সায়র নিশ্চয়ই অনেকবার ফোন করেছিল আমাকে। পায়নি। এরপর আর কোনোদিনই পায়নি কারণ আমি ফোনের নম্বরটাই বদলে ফেলেছিলাম। সায়র সেদিন আমার অপেক্ষায় শ্যামলী হলের সামনে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল তা আমার জানা হয়নি আর। এ জীবনে আর ওর সামনে দাঁড়ানোর সাহস আমার কোনোদিন হয়নি।

সেদিনের পর আমি সারাটা জীবন ওর থেকে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছি। তারপর পড়ালেখাটাও আর হলো না। সায়রের সঙ্গে দেখা হবার ভয়েই ক্যাম্পাস যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলাম। তার আরও নানা কিছুর সঙ্গে সঙ্গে জুটলো ইয়াবা আসক্তি। ডিপার্টমেন্টের জুনিয়র মোয়াজ্জেম ঐ সময়ে আমাকে খুব সাপোর্ট দিয়েছে। তারপর তো জ্বলন্ত আগুনে ঘৃতাহুতির মতো সেই মাদকের মামলা। জেল থেকে যখন বের হলাম, ততদিনে বদলে গেছে অনেক কিছু। সে সময় মোয়াজ্জেম আমাকে বড় ভাইয়ের কাছে না নিয়ে সত্যি আজ আমি কোথাও ভেসে যেতাম।

আমার সব স্মৃতি একদম জীবন্ত হয়ে চোখের সামনে ভাসে। সেই যে যেবার আমার হাম হলো, সায়র সারাদিন পড়ে থাকত মেসে! ওর খোলা চুলের ঘ্রাণ আমার যন্ত্রণা কমিয়ে দিত। আশ্চর্য! এখন এই পরিবেশেও আমার সায়রের চুলের ঘ্রাণ নিতে ইচ্ছে করে, ওর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে আর খুব জানতে ইচ্ছে করে ও আমাকে মনে রেখেছে কি না! পাগল! নিজেকে ধমকাই আমি! এখন! এই অবস্থায়! অসম্ভব! ধমকাই বটে কিন্তু মন সত্যি মানতে চায় না। মনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে আমি ভুলে যেতে বসি আমি কী কাজে এখানে এসেছি।

জীবনে কখনও সায়র আমার টার্গেট হবে এ আমি দূরতম দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। ভাবলে হয়ত আজকের এই দিনটা দেখতে হতো না। বিয়ের পর রুকাইয়া সায়র যে অন্যদের কাছে রুকাইয়া আহমেদ হয়ে উঠবে; যে নামটা আমার অতি আপন, সেই সায়র নামটাই হারিয়ে আর দশজনের মতো অপরিচিত হয়ে উঠবে এ আমি কখনও কল্পনাও করিনি। আমার মাথার ভেতরের সমস্ত কিছু এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে। আমি, ইমন শাহরিয়ার গত চার বছরে এই প্রথমবার নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্বের ভার নিয়ে অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে থাকি।

“এক্সকিউজ মি”- একটা ভরাট কণ্ঠস্বরে আমি চমকে উঠে সরে আসি। এই কণ্ঠস্বর আমার খুব পরিচিত ঠেকে কিন্তু আমি মনে করতে পারি না ঠিক কোথায় শুনেছি। চমৎকার কালো স্যুটপরা এক স্মার্ট তরুণ আমার পাশ কেটে এগিয়ে যায়। সোজা গিয়ে থামে সায়রের পাশে। ওর গলার আওয়াজ আমার কাছে পৌঁছে যায়- রুকাইয়া, চলো, আমরা কয়েকটা স্ন্যাপ নিয়ে আসি পলাশদের সাথে।

সায়র সেই তরুণের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে তার প্রস্তাবে মাথা নেড়ে সায় দেয়। আর তখনই আচমকা আমার মনে পড়ে যায় এই কণ্ঠস্বর আমি কোথায় শুনেছি। এই তরুণই আমাকে ফোন করেছিল, কন্ট্র্যাক্টটা দিয়েছিল সায়রকে খুনের। এই তরুণ সায়রের বর! লোকটার সঙ্গে প্রথম দিনের কথাগুলো মনে পড়ে আমার। মোবাইলে এই মানুষটাই বলেছিল-

হ্যালো, মিস্টার, আমার স্ত্রীকে খুন করতে হবে আপনার। সে সুন্দরী, শিক্ষিতা, স্মার্ট আর তার গুণেরও কোনো শেষ নেই। কিন্তু স্রেফ তাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই না আমি। বুঝেছেন?

সায়র তার পাশের বাচ্চা ছেলেটাকে কী যেন বলছে। এরপরেই ওরা হয়ত স্টেজে উঠে যাবে বর-কনের সঙ্গে ছবি তুলতে। প্ল্যান অনুযায়ী সেটাই আমার মোক্ষম সময়। বাঁ হাতটা সরিয়ে হাতঘড়ি দেখি। আটটা বেজে পনের। বাহ্! একেবারে পারফেক্ট টাইমিং। ভদ্রলোক কোনোকিছুতে ত্রুটি রাখতে রাজি নন বোঝা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে আমি এও বুঝে যাই আজ আমি না পারলে কাল আরেকজনকে সায়রের পেছনে ঠিকই লেলিয়ে দেবে এই সুন্দর চেহারার বদমাশটা। আমার মনে হয় আমার সামনে এক ভীষণ কঠিন পাজল যা আমি কিছুতেই মেলাতে পারছি না।

খুব বেশি ভাববার সময় নেই। দ্রুত জায়গা বদলে আগের জায়গায় ফিরে আসি, হলরুমের বাঁ দিকের দরজাটার পাশে। মাথা এখনও ঝিমঝিম করছে। আমি সায়রের মুখের দিকে তাকাই। কী অপূর্ব সহজ সৌন্দর্য সেখানে ভর করেছে! সেই মুখের দিকে তাকিয়েই হঠাৎ করে আমার এই দুর্বোধ্য পাজলটা মিলে যায়! আমি বুঝে যাই আমার কর্তব্য। নিজেকে অনেকটাই নির্ভার লাগে এখন। আহ্ সায়র! তোমাকে এক জীবনে আর কতবার হারাতে পারি আমি?

ওরা দু’জন হাত ধরাধরি করে স্টেজের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে। আমিও প্ল্যান অনুযায়ী জ্যাকেটের লুকানো পকেটে হাত দিই। আমার প্ল্যানে এতটুকু কোনো বদল আসেনি, তবে চার বছরে এই প্রথম বদল হয়েছে আমার টার্গেট!

 

 

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>