| 19 এপ্রিল 2024
Categories
লোকসংস্কৃতি

লোকসংস্কৃতি: সতী পীঠ যোগাদ্যা মাতার মন্দির । সুকন্যা দত্ত

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট
বর্ধমান বহু প্রাচীন জনপদ। এখানকার সৌধ, মন্দির, মসজিদ, রাজবাড়ী সেকালের ইতিহাস কে বাঁচিয়ে রেখেছে। বৈষ্ণব, শাক্ত,শক্তির উপাসকদের কাছে বর্ধমান পুণ্যতীর্থ। বহু কবির লেখায় উঠে এসেছে বর্ধমানের কথা। রায় গুণাকর ভারতচন্দ্র লিখিত অষ্টাদশ শতকে ” বিদ্যাসুন্দর ” কাব্য থেকে জানা যায়,
” দেখি পুরী বর্ধমান সুন্দর চৌদিকে চান
ধন্য গৌড় যে দেশে এ দেশ
রাজা বড়ো ভাগ্যধর কাছে নদ দামোদর –
ভাল বটে জানিনু বিশেষ। “
 
রাঢ়বাংলার প্রখ্যাত স্থান বর্ধমান। বৃধ্ ধাতুর সাথে শানচ প্রত্যয় যোগে বর্ধমান শব্দের উৎপত্তি। প্রাচীন দেব- দেউলের সমারোহ এ জেলায় চোখে পড়ে। কোথাও জরাজীর্ণ মন্দির শেষ চিহ্নটুকু নিয়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। আমার আজকের লেখায় উঠে এসেছে সতী পীঠের কথা। পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়ার ক্ষীরগ্রামে অবস্থিত একান্ন সতীপীঠের একটি যোগাদ্যা বা যুগাদ্যা মায়ের মন্দির। কাটোয়া থেকে একুশ কিলোমিটার দূরে এবং বর্ধমান থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরত্বে কৈচরের কাছে মঙ্গলকোট থানার অন্তর্গত এই গ্রাম। কদিন আগেই ইতিহাসের টানে সেখানে ছুটে যাই।



 
সতীর ডান পায়ের বুড়ো আঙুল এখানে পড়েছিলো। “অন্নদামঙ্গল” এ ভারতচন্দ্র লেখেন,
 
” ক্ষীরগ্রামে ডানিপার অঙ্গুটবৈভব,
যোগাদ্যা দেবতা ক্ষীরকন্টক ভৈরব।”
 
মহাদেবের নামানুসারে গ্রামের সম্পূর্ণ নাম ক্ষীরকন্টক ভৈরব। ক্ষীরকন্টক ভৈরব ছাড়া ও ক্ষীরগ্রাম কে রক্ষা করেন চারজন ভৈরব। পূর্বে গিধগ্রামে গিধেশ্বর, পশ্চিমে নিগনে ” লিঙ্গেশ্বর”, উত্তরে শীতলা গ্রামে শীতলেশ্বর এবং দক্ষিণে পুইনী – পলাশীতে ” পাতালেশ্বর ” শিব। দেবী যোগাদ্যার পূজা মন্ত্র হলো,
 
“ভূতধাত্রী মহামায়া ভৈরবঃ ক্ষীরকন্টকঃ।
যোগাদ্যা সা মহাদেবী দক্ষিণাঙ্গুষ্ঠ পদে নমঃ। “
 
এই মন্দিরে মায়ের মূর্তি কষ্টি পাথরের। সাড়ে চার থেকে পাঁচ ফুট উচ্চতার মূর্তি সারাবছর মন্দির সংলগ্ন দীঘির জলের তলায় ডোবানো থাকে। কথায় আছে,
” জলে মা যোগাদ্যার বারোমাস বাস।”


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,devi-yogaydda-51-shakti-peeth


 
পাথরের তৈরি বিগ্রহটি দশভূজা, সিংহবাহিনী, মহিষমর্দ্দিনী। কেবল সাতটি দিন দেবী মূর্তি ক্ষীরদীঘির জল থেকে তোলা হয়। তার মধ্যে ভক্তরা দেবী দর্শন করতে পারে দু দিন। বৈশাখী সংক্রান্তি ও চৌঠা জৈষ্ঠ্য । অবশিষ্ট পাঁচদিন মায়ের মূর্তি জল থেকে ওঠানো হলে ও সাধারণ মানুষ দর্শনের সুযোগ পান না। এই পাঁচটি দিন কেবল ব্রাহ্মণ ও মায়ের সেবাইতদের জন্য নির্দিষ্ট।
বৈশাখ সংক্রান্তি উৎসব শুরু হয় পান সুপারী দিয়ে ” গুয়াডাকা”র মধ্য দিয়ে। সারা বৈশাখ ক্ষীরগ্রামের মানুষ ভাতের হাঁড়িতে কাঠি দেয় না, লাঙ্গল দেয় না,ধান থেকে চাল করে না, মাথায় ছাতা দেয় না, হলুদ বাঁটে না, উত্তর মুখী ঘরে বাস করে না। পূর্ণগর্ভা নারীদের অন্যত্র পাঠানো হয়। এইসময় গ্রামবাসীরা কালো কালিতে চিঠি লেখেন না, লেখার জন্য তারা লাল কালি ব্যবহার করেন। কালের নিয়মে যদি ও সেসব নিয়ম এখন হারাতে বসেছে। পনেরো থেকে তিরিশে বৈশাখ ভক্তরা মায়ের নামে গ্রাম প্রদক্ষিণ করেন। বৈশাখের সংক্রান্তির দিন “হল লাঙ্গল” অনুষ্ঠান হয়। এদিন সকলে চব্বিশ ঘন্টার জন্য দেবী মূর্তির দর্শনের সুযোগ পান । সেদিন দেবী মূর্তি স্পর্শ করে সকলে পুজো দিতে পারেন এমনকি মন্দির কক্ষে স্থাপিত রত্নবেদী প্রণামের অধিকার রয়েছে। পরদিন ভোরবেলা চারটের সময় মাকে দীঘির জলে নামিয়ে শয়ন করানো হয়। এইদিন ঢাকের বদলে মাদল বাজানো হয়। অনুষ্ঠানে ” ডোম চুয়ারি” ও ” নদের মশাল” প্রথা পালন হয়। বর্ধমান, নদীয়া, পাটুলীর রাজা ও জমিদাররা পূজার সাথে যুক্ত থাকেন।
 
জৈষ্ঠ্য মাসে সন্ধ্যে ছ’টা থেকে রাত বারোটা অবধি দেবী দর্শন করা যায়। রাত বারোটায় মাকে অভিষেক করে দীঘিতে নামানো হয়। এই মাতৃ অভিষেকের একটি বিশেষ কারণ রয়েছে। বৈশাখ এবং জৈষ্ঠ্য মাসে সকল বর্ণের মানুষ দেবী মূর্তি স্পর্শ করায় পঞ্চদ্রব্য দিয়ে মাকে স্নান করিয়ে বস্ত্র পরিধান করিয়ে , মালায় সাজিয়ে বলিদান করে অভিষেক পর্ব সমাধা হয়। এই দুটি দিন ভিন্ন যোগাদ্যা মাতার বিগ্রহ আর ও পাঁচটি দিন জল থেকে তোলা হয়। সেদিনগুলি হলো, আষাঢ় মাসের নবমী, আশ্বিন মাসের বিজয়া দশমীতে, পৌষ মাসের পনেরই পৌষ, মাঘ মাসের মাকুরী সপ্তমী অর্থাৎ সরস্বতী পুজার দুদিন আগে। মন্দিরের গর্ভগৃহে রত্নবেদীর পাশে রয়েছে নারায়ণ শিলা, মা লক্ষ্মী, জগদ্ধাত্রী এবং মনসা দেবীর মূর্তি। এই রত্নবেদীতে যোগাদ্যা মায়ের ডান পায়ের বৃদ্ধাংগুষ্ঠ আছে।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,devi-yogaydda-51-shakti-peeth

 

দেউলে নিত্য পুজো হয় সকাল সাড়ে নটা থেকে দশটা। দুপুর একটা থেকে দেড়টার মধ্যে ভাত, নবরত্ন , মাছ, পরমান্ন ব্যঞ্জন সাজিয়ে মায়ের আমিষ ভোগ নিবেদিত হয়। পরমান্ন নিবেদন হয় মহাদেবের উদ্দেশ্যে। কোনো দিন মাছের যোগান না হলে যে বটিতে মাছ কাটা হয়, সেটা ধুয়ে তার জল রান্নায় দেওয়া হয়। রান্নার পর কাঁসর বাজিয়ে রন্ধনশালা থেকেই মায়ের উদ্দেশ্যে ভোগ নিবেদনের পর সকলকে পরিবেশন করা হয়। যোগাদ্যা মায়ের মন্দিরে প্রতিদিন গ্রামের একশো কুড়ি থেকে একশো পঁচিশ জন লোক প্রসাদ খান। এছাড়া ও বাইরে থেকে ভক্তরা দেবী দর্শনে আসেন। সায়াহ্নে মাকে শীতল করা হয়। দেবীকে শীতলের সময় গ্রীষ্মকালে সন্ধ্যে সাড়ে ছটা থেকে সাতটা এবং শীতকালে সাড়ে পাঁচটা থেকে ছ’টা। এরপর মা মন্দিরের ভিতরের বিছানায় শয়ন করেন। পুরোহিত মশারী টাঙিয়ে চাদর বিছিয়ে মায়ের শয়নের ব্যবস্থা করেন দরজায় তালা দিয়ে চলে যান।শোনা যায় পরদিন সকালে পুরোহিত দরজা খুললে দেখেন, বিছানার উপরে মশারি গুটিয়ে রাখা।

স্থানীয়দের বিশ্বাস, যোগাদ্যা মা প্রতিদিন বিছানায় নিদ্রা যান।
পৌষ মাসের সংক্রান্তি থেকে মাঘ মাসের সংক্রান্তি পর্যন্ত প্রতিদিন নিশিধম্বল প্রথা পালিত হয়। রাতে ঢাক বাজিয়ে ঢাকি নিশিধম্বলে অংশ নেন। প্রতিবছর এই অনুষ্ঠানে একজনের পালা পড়ে। এই একমাস প্রতিরাতে বাদক চোখে বাঁধন জড়িয়ে রাত বারোটা থেকে সাড়ে বারোটা পর্যন্ত বাজনা বাজান। বাদ্য শেষে মন্দিরের বাইরে গিয়ে তিনি চোখের বাঁধন খোলেন। বাদকদের চোখে সাতটা কাপড় জড়িয়ে বাঁধন তৈরি হয়। এই এক মাস তিনি মায়ের ভোগ ছাড়া কিছু খান না, বাড়ীর কার ও সাথে তার কোনো সংযোগ থাকে না, সন্ন্যাসীর মতো সে জীবনযাপন করে।
 
যোগাদ্যা মাতার মন্দিরের সাথে মিশে আছে রামায়ণের কাহিনি। রাম লক্ষ্মণ কে যখন মহীরাবণ পাতালে হরণ করে নিয়ে গেলো তখন মায়াবী হনুমান মাছির বেশ ধরে পাতালে প্রবেশ করেন। পবনপুত্র সেখানে গিয়ে দেখেন মহীরাবণ রাম লক্ষ্মণকে ভদ্রকালীর কাছে বলি দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। হনুমান খবর সংগ্রহ করে জানতে পারেন, আগামীকাল সকালে সাগর থেকে স্নান করিয়ে রাম লক্ষ্মণকে বলি দেওয়া হবে। হনুমান এসে বলেন,
” কাল আপনাদের বলি দেওয়ার আগে মহীরাবণ ভদ্রকালীর মায়ের সামনে নত শিরে প্রণাম করতে বলবে। আপনারা তাকে জানাবেন, আপনারা রাজার ছেলে, কখন ও কাউকে প্রণাম করেননি। তাই মহীরাবণ যেন শিখিয়ে দেয়। মহী রাবণ মাথা নত করে প্রণাম করলে ভদ্রকালীর হাতের খাড়া নিয়ে তাকে বধ করবেন।”
রাম লক্ষ্মণ হনুমানের কথা পালন করেন। এই কাজ সমাধা হলে যখন তারা পৃথিবীতে ফিরে আসার প্রস্তুতি নেয়। সে মুহূর্তে দেবী ভদ্রকালী বলেন, আমার পুজারি মহীরাবণ মৃত, এখন আমার পুজা কে করবে? আমাকে ও সাথে নিয়ে চল। হনুমান তখন মা ভদ্রকালীকে মাথায় নিয়ে আর রাম লক্ষ্মণকে দুই কাঁধে বসিয়ে পৃথিবীর নাভিস্থল থেকে সুড়ঙ্গ পথে ক্ষীরগ্রামে আসেন।
একস্থানে পাওয়া যায়,
” মাথায় প্রতিমা করি আন্যা হনুমান
অবনি মন্ডল মধ্যে ক্ষীরগ্রাম নাম।”
সুড়ঙ্গটি আজ ও গর্ভগৃহে রয়েছে। তখন থেকে দেবী এখানে ভদ্রকালী নামে ও পূজিতা হন।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,devi-yogaydda-51-shakti-peeth


 
মন্দির গাত্রের খোদিত লাল পটচিত্রের স্থানটি এখন শূন্য। আগে সেখানে কষ্টি পাথরের মূর্তিটা থাকতো। কালাপাহাড় যখন একের পর এক মূর্তি ভাঙতে লাগলো তখন এখানকার ব্রাহ্মণরা মূর্তিকে জলের তলায় লুকিয়ে ফেলেন। বর্ধমানের মহারাজা মহাতাপ কীর্তিচাঁদের এই মূর্তি। উনি ১৭২২ খ্রিষ্টাব্দে আটবিঘা জমির উপর এই মন্দির নির্মাণ করেন। ব্রাহ্মণ, গায়ক, বাদক সকলকে জমি, বসতবাড়ি দান করে মন্দির সংলগ্ন গ্রাম নির্মাণ করেন। এই গ্রামে বলয়ের মতো প্রথমে ব্রাহ্মণ, তারপর ক্ষত্রিয় এবং শেষে শূদ্রদের বাস। মায়ের সেবায় নিয়োজিত পুরোহিতদের পৈতৃক পদবী যাই থাক, প্রাপ্ত উপাধি হলো রাজ চক্রবর্তী। সকল ব্রাহ্মণরা দায়িত্ব পান না। রাজা যে ব্রাহ্মণদের সেবাইত নিয়োগ করেন, তারই কেবল পুজার অধিকার পান। পুরোহিত বরুণ রাজ চক্রবর্তী জানান, দীঘি থেকে ও তিনবার মূর্তি চুরি হয়েছিলো। শেষবার কাটোয়ার একটি গ্রামের মাঠ থেকে মূর্তিটি উদ্ধার করা হয় । এরপর কাটোয়ার কোর্ট থেকে জামিন করিয়ে দেবী মূর্তি আনা হয়। দেবী বিগ্রহ সংরক্ষণের জন্য মূল মন্দিরের পিছনের সেই দীঘিতে দক্ষিণদিকে একটি সাদা রঙের মন্দির নির্মাণ করে সেখানেই জলের ভিতর মূর্তিটি রাখা হয়। পাশেই একটি লাল রঙের মন্দির আছে। সেখানে একটি বিকল্প মূর্তি স্থাপিত আছে। দীঘি সংস্কারের সময় সেখানে অপর একটি ভগ্ন মূর্তি পাওয়া গিয়েছিলো। হিন্দু ধর্মে ভগ্ন মূর্তি পূজিত হওয়া নিষিদ্ধ। তাই দাঁইহাটা থেকে শিল্পী নবীনচন্দ্র ভাস্কর কে এনে ঔ মূর্তিকে সম্পূর্ণ করে বিকল্প রূপে গড়া হয়। দূরদূরান্তের ভক্তদের দেবী দর্শনের এ এক বিকল্প ব্যবস্থা বলা যায়। দীঘির উপর নির্মিত মন্দিরে নিরামিষ ভোগ হয়। হিন্দু ধর্মের বিধবা রমনীদের আমিষ ভক্ষণের নিষেধাজ্ঞার কারণে এ ব্যবস্থার সূত্রপাত।
 
বাঙালি কবি তরু দত্তের ” Ancient Ballads and Legends of Hindustan ” বইয়ে ” Jogadya Uma ” কবিতায় এখানকার শাঁখারীর হাতে দেবীর শাখা পড়ানোর কাহিনী বর্ণনা করেছেন। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অনুবাদ অনুযায়ী,
“….. দেখি মা তোমার হাত,
কৌতুকভরে হস্ত বাড়াল নারী……..
সহসা শঙ্খবলয়িত কার পাণি
জাগিয়া উঠিল পদ্ম দীঘির বুকে”।
স্বয়ং যোগাদ্যা মাতার কথা এখানে বলা হয়েছে।
 
কথিত আছে, দেবীর রোষ থেকে রক্ষা পেতে রোজ নরবলির অঙ্গীকার করে দেবীকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া হয়েছিলো। প্রথমে রাজা হরিদত্তের সাতপুত্রের একে একে বলিদান হয়। তারপর আসে গ্ৰামের লোকেদের পালা। একবার এক অসহায় বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের পালা পড়লে প্রাণভয়ে সপরিবারে রাতের অন্ধকারে গ্ৰাম ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। ক্লান্ত দেহে গ্ৰামের প্রান্তে বিশ্রামলাভের জন্য ক্ষণিকের বিরতি নেওয়ার সময়এক বুড়ির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। বৃদ্ধা জিজ্ঞাসা করেন এত রাত্রে ব্রাহ্মণ কোথায় যাচ্ছে? ব্রাহ্মণ প্রত‍্যুত্তরে জানান, এ গ্ৰামে এক রাক্ষসী দেবী এসেছে। প্রত্যহ নরভক্ষণ ছাড়া তাঁর ক্ষুধার নিবৃত্তি হয়না। গোটা গ্ৰামের অনেক মানুষ ভক্ষণ করার পর এবার তাঁর পালা এসেছে। তাই একমাত্র পুত্র ও স্ত্রী সমেত প্রাণ রক্ষার্থে তিনি গ্ৰাম থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন। একথা শুনে বুড়ি বলেন,
“যে ভয়ে পালাও তুমি / সেই মহাদেবী আমি”।
 
এবারে ব্রাহ্মণ ভয়ে কেঁপে উঠেন। দেবী অভয় দিয়ে বলেন, তুমি নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে যাও, আজ থেকে আমার পূজায় নরবলি বন্ধ হল। ব্রাহ্মণ গ্ৰামে ফিরে দেবীর আদেশ রাজার কাছে জানান। সাথে সাথেই রাজার সাত পুত্র সহ বলিপ্রাপ্ত সকল মানুষ বেঁচে উঠে।
 
ক্ষীরগ্রামের সাথে যুক্ত রয়েছে আর ও একটি গল্প। একবার গ্ৰীষ্মের দাবদাহে দুপুরবেলা জনৈক শঙ্খ বণিক গ্ৰামের প্রান্তদেশে অবস্থিত ধামাচ দীঘির পাড় দিয়ে শাঁখা বিক্রির উদ্দেশ্যে ক্ষীরগ্রামে আসছিলেন। দীঘির ঘাটে স্নান করছিলেন এক ব্রাহ্মণকন্যা। তিনি শাঁখারির কাছ থেকে শাখা পরে বলেন যে তার পিতা ওই মন্দিরের পূজারি, শাঁখার মূল্য দেবেন পিতা। মন্দিরের কুলুঙ্গিতে পাঁচ টাকা রয়েছে। কন্যার কথায় শাঁখারি মন্দিরে এসে ব্রাহ্মণের কাছে শাঁখার মূল্য দাবি করেন। ব্রাহ্মণ অবাক হয়ে বলেন, তার কোন কন্যা নাই। নিশ্চয়ই শাঁখারিকে কেউ ঠকিয়েছে। তখন শাঁখারি মন্দিরের কুলুঙ্গিতে রাখা পাঁচ টাকার কথা বললেন। ব্রাহ্মণ জায়গা মতো পাঁচ টাকা পেয়ে হতভম্ব হয়ে যান। তার বুঝতে আর বাকি থাকেনা দেবীর মহিমা। মা যোগাদ্যা নিজেই শাঁখারির হাত থেকে শাঁখা পরেছেন একথা দুজনেরই বুঝতে পারেন। আনন্দাশ্রুর প্লাবন তখন ব্রাহ্মণের দু’চোখে। তিনি শাঁখারিকে বললেন, এতকাল ধরে নিষ্ঠা নিয়ে মায়ের মন্দিরে পূজা করে চলেছেন অথচ মা ব্রাহ্মণকে দেখা দিলেন না। ভাগ্যবান শাঁখারি অজান্তেই মায়ের স্পর্শ লাভ করেছে। আকুল হয়ে দেবীর দেখা পেতে বয়সের ভারে নুব্জ‍্য ব্রাহ্মণ শাঁখারির সঙ্গে প্রাণপণে দৌড়ে গেলেন ধামাচ দীঘির ঘাটে। কিন্তু সেখানে পৌঁছে দেখলেন স্নানের ঘাট জনশূন্য। ব্রাহ্মণ জ্ঞানশূন্য হয়ে মা…মা…শব্দে চারিদিক মুখরিত করে তুললেন। একটিবার দেবীর দেখা পাওয়ার জন্য কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তখনও দেবীর দয়া হল না দেখে তিনি বললেন – আমি আজীবন তোর পুজো নিষ্ঠাভরে করে এসেছি, আজ তুই আমাকে দেখা না দিলে এখানেই আমি মাথা ঠুকে প্রাণত্যাগ করবো, তোকে ব্রহ্মহত্যার জন্য দায়ী হতে হবে। এই বলে তিনি আত্মহত্যার সংকল্পে উন্মাদের ন্যায় দীঘির পাড়ে মাথা ঠুকতে লাগলেন। কয়েক মুহূর্ত পরেই দীঘির জলে মৃদু আলোড়ন উঠল, শঙ্খ পরিহিত অনিন্দ‍্য সুন্দর দুটি হাত জলের নীচ থেকে উপরে এসে ভক্ত ব্রাহ্মণকে পরম শান্তি দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্তর্হিত হল। গভীর শ্রদ্ধায় চিত্ত পূর্ণ করে শাঁখারিকে প্রতি বছর পুজোয় দেবীকে শঙ্খ পরিয়ে যাওয়ার কথা বললেন। সেই থেকে সেই শাঁখারির উত্তর পুরুষেরা আজও যোগাদ্যা পূজায় বিনামূল্যে শাঁখার যোগান দিয়ে যান।
ছবি: লেখকের নিজের তোলা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত