| 19 মার্চ 2024
Categories
গীতরঙ্গ

ঢাকার বিভিন্ন স্থানের নামকরণের ইতিহাস । জান্নাতুল নাঈম পিয়াল

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। রাজধানী হিসেবে এই শহরের রয়েছে ৪০০ বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস। শত ঝড়-ঝঞ্ঝা সহ্য করেও, মহীরুহের মতো টিকে আছে এ শহর। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এ শহরের জনসংখ্যা ১ কোটি ৭০ লক্ষ।

দেশের মফস্বল শহর কিংবা প্রত্যন্ত অঞ্চল, সব জায়গার মানুষেরই লক্ষ্য থাকে সুন্দর জীবন গড়তে ঢাকায় এসে পাড়ি জমানোর। এবং ঢাকাও কাউকে ফিরিয়ে দেয় না। ঢাকার বাতাসে টাকা ওড়ার খবর গুজব হলে কী হয়েছে, জীবিকা গড়ার তাগিদে শত কষ্ট সহ্য করে, কিংবা খড়কুটো আঁকড়ে ধরে হলেও, মানুষ আপ্রাণ চেষ্টা করে এ শহরেই ঘাঁটি গাড়ার।

বলাই বাহুল্য, এই লেখা যারা পড়ছেন, তাদের মধ্যে একটা বড় অংশই স্থায়ী কিংবা অস্থায়ীভাবে বাস করেন ঢাকায়। এবং বাকিরাও বিভিন্ন সময়ে, প্রয়োজনে কিংবা অপ্রয়োজনে পা রেখেছেন ঢাকায়। এবং ঢাকায় পা রাখার পর একটি অভিজ্ঞতা চেতনে বা অবচেতনে নিশ্চিতভাবেই হয়েছে আপনার। তা হলো: ঢাকার বিভিন্ন স্থানের আজব আজব সব নাম শুনে অবাক হয়েছেন আপনি।

কত বাহারি নামই না রয়েছে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার। বাগই তো আছে কত। শাহবাগ, পরীবাগ, গোপিবাগ, স্বামীবাগ, মালিবাগ ইত্যাদি। আবার নামের সাথে হাতি আছে এলিফ্যান্ট রোড, হাতিরঝিল কিংবা হাতিরপুলের। পুল আছে ফকিরাপুল, পাগলারপুলের নামেও। এছাড়া ধানমন্ডি, ফার্মগেট, পিলখানা, তোপখানার মতো বিচিত্র সব নামধারী এলাকারও দেখা মেলে এ শহরে।

কখনো কি জানতে ইচ্ছা হয়েছে, কীভাবে এসেছে এসব এলাকার নাম? হয়তো হয়েছে, কিংবা হয়তো হয়নি। তবে আজ আপনাদের সামনে তুলে ধরব নামকরণের মজাদার সেই ইতিহাসই। তাহলে আর দেরি নয়, চলুন শুরু করে দেয়া যাক।

ধানমণ্ডি

ধান কী জিনিস, তা তো জানেনই সকলে: যা থেকে চাল হয়। আর ‘মণ্ডি’ শব্দটি ফারসি, যার অর্থ হাটবাজার। ব্রিটিশ শাসনামলে ঢাকায় সবচেয়ে বড় ধানের হাট বসত যে জায়গাটিতে, স্থানীয়রা সেটিকে ডাকত ধানমণ্ডি নামে। আর সেখান থেকেই আজকের ধানমণ্ডি এলাকার নামকরণের উৎপত্তি।

পিলখানা

পিলখানা নামটিও এসেছে ফারসি ভাষা থেকে। ফারসি ভাষায় ‘পিল’ অর্থ হাতি আর ‘খানা’ অর্থ জায়গা। তাহলে বুঝতেই পারছেন, পিলখানা মানে হাতি রাখার জায়গা। মুঘল শাসকদের খুব পছন্দের একটি খেলা ছিল হাতির লড়াই। তাই সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে হাতি এনে রাখা হতো ধানমণ্ডির এক এলাকায়, যেটি লোকমুখে পরিচিতি পেয়ে যায় পিলখানা হিসেবে।

মাহুতটুলি

মাহুত অর্থ জানেন তো? হস্তিচালক। কিংবা যারা হাতির পোষ মানানো ও দেখাশোনার কাজ করে, তাদেরকেও বলা হয় মাহুত। মোগল শাসনামলে হাতির সাথে সাথে ঢাকায় এসেছিল বিপুল সংখ্যক মাহুতও। তারা নিজেদের বসবাসের জন্য যে এলাকাটি গড়ে তুলেছিল, সেটিই আজ পরিচিত মাহুতটুলি নামে।

ভাবা যায়, একসময় এই ঝিলে গোসল করত হাতি! Image Source: YouTube

হাতিরঝিল

হাতি না হয় আনা হলো, তাদের পোষও মানানো হলো। কিন্তু হাতি পালার যে আরো হাজারটা ঝক্কি আছে। সেসবের মধ্যে একটি হলো তাদের গোসল করানো, এবং তারপর রোদ পোহানোর ব্যবস্থা করে দেয়া। এজন্য হাতিগুলোকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হতো নিকটস্থ ঝিলে। হাতি গোসল করত বলে ঝিলের নাম হয়ে উঠেছিল হাতিরঝিল।

এলিফ্যান্ট রোড

হাতিরঝিল থেকে ভালো করে গোসল-টোসল করিয়ে হাতিদের নিয়ে যাওয়া হতো রমনা পার্কে রোদ পোহাতে। এরপর সন্ধে নামার মুখে রমনা পার্ক থেকে হাতিগুলোকে ফের নিয়ে যাওয়া হতো তাদের ডেরায়, অর্থাৎ পিলখানায়। তো হাতিদের নিয়ে রমনা থেকে পিলখানায় যাওয়ার জন্য যে রাস্তাটি ব্যবহৃত হতো, সেটিই আজ পরিচিত এলিফ্যান্ট রোড নামে।

হাতিরপুল

এলিফ্যান্ট রোডের মাঝে একটি খাল ছিল, যার উপর কাঠের পুল তৈরি করা হয়েছিল। হাতির পারাপারের জন্য নির্মিত হওয়ায় সেটিকে বলা হতো হাতিরপুল। তবে কেউ কেউ আবার বলে থাকেন, হাতিরা নাকি পুলের উপর দিয়ে নয়, বরং পুলের নিচ দিয়ে চলাচল করত। তবে সে যা-ই হোক না কেন, পুলের নাম তো হাতিরপুলই ছিল, এবং তার সুবাদেই আশপাশের পুরো এলাকাটিই আজ পরিচিত হাতিরপুল নামে।

মোগল শাসকদের প্রিয় খেলা ছিল হাতির লড়াই; Image Source: Achenbach Foundation for Graphic Arts

ভূতের গলি

এলিফ্যান্ট রোড ধরে হাতিরপুল আসার পথে একটু বামে সরলেই রয়েছে একটি বিখ্যাত এলাকা। এলাকাটি বিখ্যাত তার নামের কারণে। কারণ নামটি যে ভূতের গলি! তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। গলিটিতে ভূত নেই। এমনকি কোনো ভূতুড়ে বাড়িও নেই। আসল ব্যাপারটি হলো, ইংরেজ আমলে ওখানে বাস করতেন এক ইংরেজ সাহেব। নাম তার মিস্টার বুথ। ওই এলাকায় তিনিই ছিলেন প্রথম কোনো ইংরেজ সাহেব। তাই তার নামানুসারে জায়গাটির নাম হয়েছিল বুথের গলি। কিন্তু কালানুক্রমে বুথ যে শেষমেষ ভূত হয়ে গেল, তা বেশ অদ্ভুতুড়ে কান্ডই বটে।

গেণ্ডারিয়া

বুথের গলির ভূতের গলি হওয়াটা ছিল ইংরেজি শব্দের বিকৃত বাংলা রূপের বহিঃপ্রকাশ। এমন দৃষ্টান্ত কিন্তু আরো আছে। ঢাকা শহরের একসময়কার বিখ্যাত এলাকা ছিল গ্র্যান্ড এরিয়া। তৎকালীন জমিদার ও প্রভাবশালীদের বাস ছিল বলে ইংরেজরা দিয়েছিল এমন নাম। কিন্তু বাঙালদের মুখে কি আর এত কঠিন ইংরেজি আসে! তাই তো তারা গ্র্যান্ড এরিয়াকে নিজেদের মতো করে গেণ্ডারিয়া করে নিয়েছিল। তবে এ তত্ত্বের বিরুদ্ধমতও আছে। অনেক ইতিহাসবিদ বলেন, এলাকাটিতে নাকি একসময় প্রচুর গেণ্ডারি বা আখ জন্মাত। আর সেখান থেকেই এসেছে গেণ্ডারিয়া নামটি।

রমনা কালী মন্দির; Image Source: Wikimedia Commons

রমনা

শুরুতে বলছিলাম হাতিদের রোদ পোহানোর স্থান রমনা পার্কের কথা। মজার ব্যাপার হলো, এই রমনারও কিন্তু নিজস্ব নামকরণের ইতিহাস রয়েছে। ওই এলাকায় বাস করতেন রম নাথ বাবু নামে এক বিশাল ধনাঢ্য বাবু। তিনি নিজের নামানুসারে তৈরি করেছিলেন রমনা কালী মন্দির। আর সেই মন্দিরের পাশে ছিল ফুলের বাগান ও খেলাধুলার পার্ক। সময়ের স্রোতে গোটা এলাকাটির নামই হয়ে যায় রমনা, আর পার্কটির নাম হয় রমনা পার্ক।

কাকরাইল

আমাদের দেশে সম্মানিত ব্যক্তির নামানুসারে সড়কের নামকরণের চর্চাটি খুবই প্রচলিত। আর ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজরা তো বরাবরই সর্বোচ্চ সম্মান পেয়ে এসেছে। বিশেষত ইংরেজরা কমিশনারদের নামানুসারে সড়কের নামকরণের রেওয়াজটি ছিল খুবই জনপ্রিয়। তাই উনিশ শতকের শেষ দশকে ঢাকার কমিশনার হিসেবে যখন দায়িত্ব পালন করছিলেন মি. ককরেল, তাকে সম্মান জানিয়ে একটি রাস্তার নামকরণ করে ফেলা হয়। কালক্রমে সেই ককরেলই পরিণত হয়েছে কাকরাইলে, আর এখন একটি গোটা এলাকাই পরিচিত সে নামে।

আজিমপুর

আজিমপুরের নামকরণ নিয়ে কিছুটা বিতর্ক রয়েছে। ইতিহাসবিদদের এক পক্ষ মনে করেন, এলাকাটি প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র সুবাদার শাহজাদা আজমের শাসনামলে (১৬৭৭-১৬৭৯), এবং তার নাম আজম থেকেই এসেছে আজিমপুর নামটি। তবে অন্য আরেক পক্ষের অভিমত, আওরঙ্গজেবের পুত্র নন, বরং পৌত্র, সুবাদার আজিমুশশানের শাসনামলে (১৬৯৭-১৭০৩) উত্থান ঘটেছিল এলাকাটির, এবং তার নাম থেকেই এলাকার নামের সৃষ্টি।

কারওয়ান বাজার; Image Source: Dhaka Tribune

কারওয়ান বাজার

কারওয়ান নাকি কাওরান, এ নিয়ে রয়েছে প্রচুর বিতর্ক। তবে মজার ব্যাপার হলো, আসল শব্দটি হলো কারাবান, যার অর্থ সরাইখানা। দিল্লির সুলতান শেরশাহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিখ্যাত গ্রান্ড ট্রাংক রোড বা সড়ক-ই-আজম। পরবর্তীতে ঢাকার মুঘল সুবাদার শায়েস্তা খানের আমলে ঢাকা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত অংশটি নতুন করে নির্মিত হয়। তখন এ সড়কের কিছুদূর পরপর স্থাপিত হয়েছিল সরাইখানা বা কারাবান। ধারণা করা হয়ে থাকে, বর্তমান কারওয়ান বাজার এলাকায় ছিল এমনই একটি সুপরিচিত কারাবান, যা থেকে এলাকাটির নাম দাঁড়িয়েছিল কারাবান বাজার, এবং পরবর্তীতে কারওয়ান বাজার।

শাহবাগ

বর্তমান বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি রাজকীয় অবস্থান দখল করে রেখেছে শাহবাগ। এবং কী কাকতালীয় ঘটনা, শাহবাগের নিজের নামেও কিন্তু রাজকীয় শব্দটির উপস্থিতি রয়েছে। কারণ শাহবাগ শব্দের আভিধানিক অর্থ রাজকীয় বাগান। মুঘল সম্রাটরা যখন ঢাকাকে প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দেন, এরপর এই এলাকায় একটি বিশালাকার, দৃষ্টিনন্দন বাগানও গড়ে তোলেন তারা। আজ সেই বাগানের স্মৃতিচিহ্নটুকু পর্যন্ত চোখে পড়ে না। কিন্তু তবু সেটি রয়ে গেছে স্থানীয় মানুষের স্মৃতিতে, যারা রাজকীয় বাগানকে স্মরণ করে পুরো এলাকাকে শাহবাগ নামে ডাকার মাধ্যমে।

শাহবাগ; Image Source: Dhaka Tribune

পরীবাগ

শাহবাগের অদূরেই কিন্তু আজকের পরীবাগ। অনেকের মতে, নবাব সলিমুল্লাহর সৎ বোন ছিলেন পরীবানু। নবাব সলিমুল্লাহ এই এলাকায় তার সৎ বোনের জন্য একটি বাগানবাড়ি গড়ে তোলেন। সেই বাগানবাড়িতেই বসবাস করতে থাকেন পরীবানু, এবং তার নামানুসারেই এলাকাটির নাম দাঁড়িয়ে যায় পরীবাগ।

শ্যামলী

বাগানের কথা যখন হচ্ছেই, তখন একসময় শ্যামলিমায় ঢাকা ঢাকার আরেকটি স্থানের কথাও না বললেই নয়, যেটি আজ শ্যামলী নামে পরিচিত। এই এলাকার নামকরণের ইতিহাস অবশ্য খুব প্রাচীন নয়। পাকিস্তান আমলে, ১৯৫৭ সালে সমাজকর্মী আব্দুল গণি হায়দারসহ বেশ কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি মিলে এই এলাকায় বাড়ি করেন। তবে বাড়ি তো করেছেন, কিন্তু মনমতো নাম খুঁজে পাচ্ছিলেন না তারা। তখন সবাই মিলে আলোচনায় বসেন, এবং এলাকায় প্রচুর গাছপালা থাকার সুবাদে, এলাকাটির নাম তারা দেন শ্যামলী।

মগবাজার

মগবাজারের নামকরণ সম্পর্কিত সবচেয়ে প্রচলিত তত্ত্ব হলো, মগ তথা বর্মী বংশোদ্ভূত ব্যক্তিদের থেকে এসেছে এই এলাকার নাম। ঢাকায় মগরা এলো কোত্থেকে, তা জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৬২০ সালে, যখন মগ সাম্রাজ্য তৎকালীন মুঘল সুবা বাংলার কেন্দ্রস্থল ঢাকা শহরে আক্রমণ চালায়। এরপর মুঘল সুবাদার ইসলাম খান মগদের তখনকার ঘাঁটি ঘাঁটি চট্টগ্রাম এলাকা জয় করেন। সেখানকার মগ শাসক মুকুট রায় ও তার অনুসারীরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে, ইসলাম খান তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন, এবং ঢাকার একটি বিশেষ এলাকায় থাকার অনুমতিও প্রদান করেন, যা আজ পরিচিত মগবাজার নামে। ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুন অবশ্য এ তত্ত্ব মানেন না। বরং তার মতে, উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্তও এই এলাকাটি ছিল ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ। মুঘল শাসনামলের অনেক পরে, ব্রিটিশ শাসনামলে তৎকালীন বাংলায় আশ্রয় গ্রহণকারী মগ সর্দার কিং ব্রিং ও তার অনুসারীরা এসে বসবাস করতে শুরু করেছিল এই এলাকায়, যেখান থেকে মগবাজার নামের উৎপত্তি।

মগবাজারে ছিল মগদের বাস; Image Source: YouTube

ইস্কাটন

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে ঢাকার বেশ খ্যাতি ছিল ইউরোপীয়দের কাছে। ইউরোপীয় নানা দেশের, নানা জাতের বণিকেরা এসে ভিড় জমাত ঢাকায়, গড়ে তুলত নিজস্ব আস্তানা। বাদ যায়নি স্কটল্যান্ডের বণিকরাও। জেনে অবাক হবেন, একসময় ঢাকায় “সোনালী আঁশ” পাটের একচেটিয়া ব্যবসা ছিল এই স্কটিশদের হাতেই। তারা নিজেদের মতো করে একটি বসতিও গড়ে তুলেছিল ঢাকার বুকে, এবং আরো স্থাপন করেছিল একটি স্কটিশ চার্চও। কিন্তু স্থানীয়দের জিভে স্কটিশ শব্দটি আসত না, তাই স্কটিশদের বসতিকে তারা বিকৃতভাবে ইস্কাটন বানিয়ে নিয়েছিল!

চকবাজার

চকবাজারের নাম কে না শুনেছে! প্রতি বছর রমজান মাসে ইফতারির বিশাল বাজার বসায় এর খ্যাতি গোটা দেশজুড়ে। এছাড়া বছরের অন্যান্য সময়েও এখানে পাওয়া যায় দারুণ সব কাবাব। মজার ব্যাপার হলো, মুঘল আমলে গোড়াপত্তন ঘটা এ এলাকার পূর্বনাম আসলে চৌক বন্দর। তখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি ছিল এর। ১৭০২ সালে নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁর হাত ধরে এই পাদশাহী বাজারটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আধুনিক বাজারে পরিণত হয়। পরবর্তীতে আবারো নতুন করে এর সংস্কার ও পুনঃনির্মাণ করেন ওয়াল্টার সাহেব।

এককালে ঢাকা ছিল বাগানের শহর; Image Source: Wikimedia Commons

মালিবাগ

গত পর্বগুলোয় বলেছি, ঢাকা শহরে বাগ বা বাগানের কোনো অভাব নেই। কলাবাগান, কাঁঠালবাগান, সবজিবাগান থেকে শুরু করে শাগবাগ, পরীবাগ, স্বামীবাগ, মধুবাগ, টোলারবাগ ইত্যাদি এলাকাগুলোর নামকরণ তো হয়েছে সেসব জায়গায় অবস্থিত বাগানের কারণেই। এবং বুঝতেই পারছেন, বাগান করতে গেলে সেই বাগান দেখাশোনার জন্য প্রয়োজন মালিরও। ঢাকা শহরেও একসময় ছিল এমন প্রচুর মালি। সেই মালিরা নিজেদের বসতি গড়ে তুলেছিল যে এলাকায়, সেটিই আজ পরিচিত মালিবাগ নামে। এবং বলাই বাহুল্য, নিজেদের এলাকায়ও তারা বেশ জোরেশোরেই বাগান করত।

ইংলিশ রোড ও ফ্রেঞ্চ রোড

নাম শুনে মনে হওয়াই স্বাভাবিক, এই দুইটি সড়কের আশেপাশে বুঝি ইংরেজ ও ফরাসিদের আবাসস্থল ছিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, ইংলিশ ও ফ্রেঞ্চ দ্বারা আসলে কোনো জাতিবিশেষকে বোঝানো হয়নি। বরং এ দুটি আসলে দুজন ব্যক্তির নাম। ঢাকার একসময়কার বিভাগীয় কমিশনার ছিলেন মি. ইংলিশ। তার সম্মানার্থে ধোলাইখাল পাড়ের এই রাস্তাটির নামকরণ হয়েছে ইংলিশ রোড। একই রকম কাহিনী ফ্রেঞ্চ রোডের ক্ষেত্রেও। ঢাকার আরেক বিভাগীয় কমিশনারের নাম ছিল মি. এফসি ফ্রেঞ্চ। তার সম্মানে ১৯১৮ সালে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি এ রাস্তার নাম রাখে ফ্রেঞ্চ রোড।

ফরাশগঞ্জে ছিল ফরাসি বণিকদের আস্তানা; Image Source: Dhaka Tribune

ফরাশগঞ্জ

তবে ঢাকা শহরে ফরাসি জাতির নামানুসারে একটি এলাকা আসলেই আছে, যার নাম ফরাশগঞ্জ। বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর তীরে গড়ে উঠেছে ফরাসি বণিকদের স্মৃতিবিজড়িত এই এলাকা। ১৭৮০ সালে ঢাকার তৎকালীন নিমতলী কুঠির নায়েবে নাজিম নওয়াজিশ মোহাম্মদ খানের অনুমতি নিয়ে ফরাসি বণিকরা এখানে একটি গঞ্জ বা বাজার প্রতিষ্ঠা করে। সেখানে ছিল কাঁচা হলুদ, আদা, রসুন ও মরিচের পাইকারি আড়ৎ। শুরুতে এর নাম দেয়া হয়েছিল ফ্রেন্সগঞ্জ। কিন্তু সাধারণ মানুষের মুখে ফ্রেন্সগঞ্জ হয়ে উঠেছিল ফরাসিগঞ্জ। এবং কালক্রমে সেই ফরাসিগঞ্জের বর্তমান রূপ ফরাশগঞ্জ।

ওয়ারী

বর্তমানে ঢাকা শহরে রয়েছে গুলশান, বনানী, বারিধারার মতো অভিজাত সব এলাকা। অথচ উনিশ শতকের শেষার্ধ পর্যন্ত ঢাকা শহরে তেমন কোনো অভিজাত এলাকা ছিল না। তাই ১৮৮৪ সালে ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকায় একটি অভিজাত এলাকা গড়ে তুলতে হবে। যখন এই এলাকা গড়ে তোলার পরিকল্পনা হচ্ছিল, তখন ঢাকায় ম্যাজিস্ট্রেট পদে দায়িত্ব পালন করছিলেন মি. অয়্যার। পৌরসভা তার সম্মানে এলাকার একটি রাস্তার নাম করে অয়্যার স্ট্রিট, আর পুরো এলাকার নাম হয়ে যায় অয়্যার। কিন্তু স্থানীয়রা শুরুতে সেই অয়্যারকে বানিয়ে দিয়েছিল উয়ারী। এবং এখন সেই উয়ারীও আরো বেশি বিকৃত হয়ে পরিণত হয়েছে ওয়ারীতে।

বংশাল পুকুর; Image Source: Dhaka Tribune

বংশাল

ইংরেজি শব্দ কতটা বিকৃত হতে পারে, তার আরো একটি চরম নিদর্শন বংশাল। মেরামতের জন্য বিভিন্ন নৌযানকে নৌবন্দরের যে বিশেষ তীরে নোঙর করা হয়, ব্রিটিশ আমলে সেটির নাম ছিল ব্যাঙ্কশাল। ঢাকার ধোলাইখাল যখন বুড়িগঙ্গার সাথে যুক্ত ছিল, ইংরেজরা সেখানে গড়ে তুলেছিল একটি ব্যাঙ্কশাল। মেরামতের জন্য নৌযান খাল দিয়েই আনা নেয়া করা হতো। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, ব্যাঙ্কশাল কথাটা বেশিদিন টেকেনি। স্থানীয়রা ব্যাঙ্কশালের বাংলা সংস্করণ হিসেবে আবিষ্কার করে বসেছিল বংশাল শব্দটি।

মিরপুর

ঢাকায় রয়েছে পুরের ছড়াছড়ি। কল্যাণপুর, শাহজাহানপুর, সূত্রাপুর, মোহাম্মদপুর, নবাবপুর, কমলাপুর এবং আরো কত কত পুর। কিন্তু এই মুহূর্তে সবচেয়ে জনপ্রিয় যে পুর, তার নাম মিরপুর। এককালে এই এলাকায় বসত ছিল মীর সাহেবের। তার নামানুসারেই গোটা এলাকা পরিচিত হয়েছে মিরপুর নামে। তবে এখানে যে নদী বন্দর রয়েছে, মুঘল আমলে তা ছিল শাহ বন্দর নামে খ্যাত। আর পাক আমলে এলাকাটি অবাঙালি অধ্যুষিত ছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকা শত্রুমুক্ত হলেও, মিরপুর ছিল ব্যতিক্রম। সবার শেষে, ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি স্বাধীন হয় মিরপুর। তাই তো একে মুক্তিযুদ্ধের শেষ রণাঙ্গন হিসেবেও অভিহিত করা হয়।

মিরপুর ছিল মুক্তিযুদ্ধের শেষ রণাঙ্গন; Image Source: Dhaka Tribune

ফার্মগেট

ফার্মগেটের নাম কে না শুনেছেন! প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু যেসব শিক্ষার্থীরা কোচিং করতে ঢাকায় পাড়ি জমায়, তাদের বেশিরভাগেরই প্রধান গন্তব্য এই ফার্মগেট। এই এলাকার নামকরণের কারণও বেশ অদ্ভূত। ব্রিটিশ সরকার কৃষি উন্নয়ন, কৃষি ও পশুপালন গবেষণার নিমিত্তে একটি ফার্ম বা খামার নির্মাণ করেছিল এই এলাকায়। সেই ফার্মের গেট বা প্রধান ফটকের নামানুসারেই গোটা এলাকার নাম হয়ে যায় ফার্মগেট।

মোহাম্মদপুর

নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, আমাদের দেশে স্থাননামের ক্ষেত্রে ‘পুর’ শব্দটি খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু ঠিক কতটা জনপ্রিয়, তা হয়তো আন্দাজ করতে পারেননি এতদিন। দেশের মোট ৬৮টি উপজেলা ও ১২টি জেলার নামের শেষে রয়েছে ‘পুর’ শব্দটি! তেমনই ঢাকার অনেক এলাকার নামের শেষেও রয়েছে এ শব্দটি। তেমনই একটি এলাকা হলো মোহাম্মদপুর। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নামানুসারেই এসেছে এই মোহাম্মদ। ১৯৪৭ সালে যখন ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে গেল, অনেক উদ্বাস্তু মুসলিমই চলে আসে তৎকালীন পাকিস্তানে। তখন অনেক অবাঙালি মুসলিমও ভিড় জমায় ঢাকায়, এবং সবাই মিলে লালমাটিয়ার পাশে একটি এলাকায় বাস করতে থাকে। অবাঙালি মুসলিমদের এই আবাসিক এলাকারই নামকরণ হয় মোহাম্মদপুর হিসেবে, এবং ১৯৫৮ সালে এই এলাকায় তাদের স্থায়ী বন্দোবস্তের ব্যবস্থা হয়।

ভারত ভাগের পর বহু অবাঙালি মুসলিম এসে ভিড় জমিয়েছিল ঢাকায়; Image Source: The Guardian

জয়নাগ রোড

সম্মানিত বা প্রভাবশালী ব্যক্তির নামে রাস্তার নামকরণ তো হরহামেশাই হয়। কিন্তু টাকার বিনিময়ে রাস্তার নাম নিজের নামে করে নেয়ার কথা শুনেছেন কখনো? এমনই একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্তের নাম জয়নাগ রোড। বকশিবাজারের নিকটস্থ এই জায়গাটির পূর্ব নাম কিন্তু ছিল ভিন্ন কিছু। সবাই সেটিকে চিনত চুহার বাজার হিসেবে। কেননা এখানকার অনেকেই তখন বিলেতি সাদা ইঁদুর বা গিনিপিগ পালত, এবং দেদারসে সেগুলোর বিকিকিনিও হতো। ঢাকাইয়া ভাষায় ইঁদুরকেই ডাকা হয় ‘চুহা’ নামে, আর সেখান থেকে গোটা একটি এলাকার নামই দাঁড়িয়ে যায় চুহার বাজার নামে। কিন্তু স্থানীয় অনেকেই নিজ এলাকার এমন নামকরণ নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল না। তারা চাচ্ছিল সম্মানজনক ভিন্ন কোনো নামে হোক তাদের এলাকার নাম। এমনই এক প্রেক্ষাপটে, ১৯২১ সালে মাত্র ৩০০ টাকার বিনিময়ে জয়নাগ নামধারী এক স্থানীয় ধনবান ব্যক্তির নামে বদলে যায় রাস্তার নাম।

গোপীবাগ

ঢাকায় যে বাগের ছড়াছড়ি, এবং সেসব বাগের উৎপত্তি বাগান থেকে, সে আলাপ তো আগেই সেরে নিয়েছি। তবে বাগান ছাড়াও যে বাগ হতে পারে, এমন উদাহরণও কিন্তু রয়েছে। সেটি হলো গোপীবাগ। অন্তত ইতিহাস খুঁড়ে এই এলাকায় কোনো বাগানের উল্লেখ পাওয়া যায়নি। এলাকাটি ছিল গোপীনাথ সাহা নামক একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর নিজস্ব সম্পত্তি। তিনি এখানে স্থাপন করেছিলেন গোপীনাথ জিউর মন্দির। এবং সেই মন্দিরের (কিংবা তার নিজের) নামানুসারেই এলাকাটির নাম হয়ে যায় গোপীবাগ।

খিলগাঁও ফ্লাইওভার; Image Source: Flickr

খিলগাঁও

খিলগাঁওয়ের নামকরণের পেছনে যতটা না আছে ইতিহাস, তার থেকে বেশি আছে কিংবদন্তী। সেই কিংবদন্তী মতে, অনেক অনেক দিন আগে কোনো এক সময়ে এই জায়গার পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হতো পাণ্ডুনদী। সেই নদীর তীরেই পত্তন ঘটেছিল কূলগ্রাম নামক একটি গ্রামের। ধারণা করা হয়, কালক্রমে সেই কূলগ্রামেরই হয়তো বর্তমান রূপ খিলগাঁও। অবশ্য মুঘল নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, সেখানে খিলগাঁওকে উল্লেখ করা হয়েছে কেলগাঁও নামে। কে জানে, কেলগাঁও-ও হয়তো কূলগ্রামেরই অপভ্রংশ।

ইন্দিরা রোড

অনেকেরই ধারণা, ইন্দিরা রোডের নামকরণ বুঝি হয়েছে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নামে। কিন্তু সেটি সর্বৈব ভুল ধারণা। তাহলে সঠিক ধারণা কোনটি? বলছি, শুনুন। ১৯৩০ সালের দিকে এই এলাকায় থাকতেন দ্বিজদাস বাবু নামের এক বিত্তশালী ব্যক্তি। তার ছিল বিশাল বাড়ি, আর সেই বাড়ির পাশ দিয়েই গিয়েছিল রাস্তাটি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, দ্বিজবাবুর বড় মেয়ে ইন্দিরা অকালে মারা যায়। সেই মৃত মেয়ের নামানুসারেই দ্বিজবাবু রাস্তাটির নাম রাখেন ইন্দিরা রোড।

ধূপখোলা মাঠের পাশ দিয়েই গেছে ডিস্টিলারি রোড; Image Source: YouTube

ডিস্টিলারি রোড

চিনেছেন তো কোন সড়কের কথা বলছি? ওই যে, ধূপখোলার উপর দিয়ে যে লম্বা রাস্তাটি চলে গেছে। এমন নামকরণের কারণ, ব্রিটিশ আমলে সেখানে ছিল সরকারি ডিস্টিলারি বা মদ্য উৎপাদনকেন্দ্র ও শোধনাগার। সহজ বাংলায় যাকে বলে ভাটিখানা। ধোলাইখাল থেকে পানি উত্তোলন করে তাই দিয়ে মদ উৎপাদন করা হতো এই ভাটিখানায়।

জিগাতলা

এই এলাকার নামকরণের ইতিহাসও বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। সুবা বাংলার রাজধানী যখন ঢাকা থেকে স্থানান্তরিত করে মুর্শিদাবাদে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন কিছু সময়ের জন্য ঢাকায় লোকবসতি কমতির দিকে ছিল। অনেক মানুষই তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঢাকা ত্যাগ করছিল। বিশেষত বিদেশ থেকে আগত পেশাজীবী শ্রেণীর মানুষদের তো এই শহরে থাকার আর কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তাই তারা অন্য কোথাও পাড়ি জমায়। ফলে ঢাকা পরিণত হয় এক পরিত্যক্ত নগরীতে, যার জায়গায় জায়গায় জন্মায় বুনো গাছপালা, পরিণত হয় জঙ্গল। অভিন্ন দশা হয়েছিল আজকের ধানমণ্ডি এলাকারও। তখন এই এলাকার কিছু জায়গায় ‘জিগা’ নামক গাছের আধিক্য দেখা যায়। কিন্তু তারপর হঠাৎ করেই কিছু মানুষ সেখানে এসে জঙ্গল সাফ করে নিজেদের জন্য বাসস্থান তৈরি করতে শুরু করে। তাদের সেইসব বাসস্থানের নাম ছিল ‘টোলা’। ফলে ‘জিগা’ আর ‘টোলা’ মিলে জায়গাটির নাম হয়ে যায় জিগাটোলা। কালের প্রবাহে সেই জিগাটোলাই আজকের জিগাতলা।

হোসেনী দালানের অবস্থান বকশিবাজারে; Image Source: Flickr

বকশিবাজার

না, বকশিবাজারে বাক্স তৈরি করা হতো না। কিংবা এই এলাকার সাথে নেই বাঙালির প্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র ব্যোমকেশ বক্সীরও সুদূরতম সম্পর্ক। বকশি মূলত মুসলিমদের ব্যবহৃত একটি উপাধি বা পদবি বিশেষ। মুঘল আমলে যেসব রাজকর্মচারী বেতন বণ্টনের কাজে নিয়োজিত ছিল, তাদেরকে ডাকা হতো বকশি নামে। আর এই এলাকাতেই ছিল তাদের সরকারি বাসস্থান। তাছাড়া এখানে তারা একটি বাজারও প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই দুইয়ে মিলেই এলাকাটির নাম হয়েছে বকশিবাজার।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত