| 25 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

ঢাকাকে সর্বপ্রথম রাজধানীর মর্যাদা দিয়েছিলেন জাহাঙ্গীর

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

ড. মাহফুজ পারভেজ

 

ঢাকাকে সর্বপ্রথম রাজধানীর মর্যাদা দিয়েছিলেন শাহজাদা সেলিম নামে সমধিক পরিচিতি চতুর্থ মুঘল সম্রাট নূরউদ্দিন মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর (১৫৬৯-১৬২৭), যিনি আনারকলির সঙ্গে বিয়োগান্ত প্রেমের জন্য এবং পরবর্তীকালে শিয়া বিধবা রমণী নূরজাহানের সঙ্গে গভীর প্রণয়ের কারণে বহুলভাবে আলোচিত হয়েছিলেন। জাহাঙ্গীর ছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যে প্রতিষ্ঠাতা বাবরের প্রপৌত্র, হুমায়ূনের পৌত্র, আকবরের পুত্র এবং শাহজাহানের পিতা ও আওরঙ্গজেবের পিতামহ।

যদিও মুঘল সাম্রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক মহামতি আকবর সর্বপ্রথম মুঘল শাসনাধীন সমগ্র ভারতবর্ষকে বিভিন্ন সুবাহ বা প্রদেশে বিভক্ত করেন, কিন্তু তিনি বাংলা প্রদেশের রাজধানী ঢাকায় আনেন নি। বাংলা প্রদেশ বলতে সে সময় বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা তথা ভারতের বিশাল পূর্বাঞ্চলকে চিহ্নিত করা হয়েছিল, যা শাসিত হতো বিহারের রাজমহলে অবস্থিত রাজধানী থেকে। উল্লেখ্য,  প্রাচীন ও সমৃদ্ধ জনপদ ঢাকায় তারও আগে সোনারগাঁয়ে তুর্কি সুলতানি আমলের সমৃদ্ধ রাজধানী ছিল। কয়েক শত বছর পর ১৬১০ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীর  এক রাজকীয় ফরমানের মাধ্যমে মুঘল শাসনাধীনে অখ- বৃহত্তর বাংলার রাজধানী করেন ঢাকাকে। রাজধানী ঢাকার প্রতিষ্ঠাতা মুঘলরাজ জাহাঙ্গীরের জন্মদিন ৩০ আগস্ট, ১৫৬৯ সাল। 

সম্রাট হয়ে জাহাঙ্গীর বাংলা ও রাজস্থানের পুরোটা মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনস্থ করেন। তিনি ১৬০৮ সালে তার আত্মীয় ও বিশিষ্ট বন্ধু ইসলাম খান চিশতিকে বাংলার সুবাহদার নিযুক্ত করেন। ইসলাম খান প্রশাসনিক দক্ষতা ও রাজনৈতিক কৌশলে দুই বছরের মধ্যে তুর্কি ও আফগান বিদ্রোহী এবং স্থানীয় শাসক বারো ভুঁইয়াদের দমন করে  সমগ্র বাংলা মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনস্থ করেন এবং ১৬১০ সালে রাজমহল থেকে রাজধানী সরিয়ে ঢাকায় স্থাপন করেন। সম্রাটের নামানুসারে ঢাকাস্থ বাংলার রাজধানীর নামকরণ করা হয় জাহাঙ্গীরনগর।

ঢাকার সুবেদার ইসলাম খান চিশতি দলুয়া বা মতান্তরে ধোলাই নদীর (বর্তমানের ধোলাই খাল ও বুড়িগঙ্গা নদীর সম্মিলিত এলাকায় নদীটির অবস্থানের কথা জানা যায়) তীরে একটি দুর্গ প্রতিষ্ঠা করেন, যার নামকরণ করা হয়, কেল্লা-ই-জাহাঙ্গীর। এই কেল্লাতেই পরবর্তীকালে ঔপনিবেশিক দখলদার ইংরেজরা বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ উদ দৌলাহকে পলাশীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পরাজিত ও নিহত করে তার স্ত্রী, সন্তানদের বন্দি করে রাখে।

আকবরের রাজপুত পত্নী যোধাবাঈ-এর গর্ভে জাহাঙ্গীর জন্মগ্রহণ করেন করেন ৩০ আগস্ট ১৫৬৯ সালে। তৎকালীন মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী আগ্রার ফতেহপুর সিক্রিতে তার জন্ম হয়। জাহাঙ্গীর বা শাহজাদা সেলিম ছিলেন সম্রাট আকবরের সাধনার ধন। কারণ আকবরের প্রথম বয়সের সকল সন্তানই অকালে মারা যান। ফলে তিনি একটি পুত্র সন্তানের মাধ্যমে বংশ রক্ষার আশায় আল্লাহ কাছে প্রতিনিয়ত প্রার্থনা করতেন। আকবর সন্তান লাভের আশায় বিভিন্ন ফকির, দরবেশ, পির, আউলিয়ার মাজারেও গমন করেন। রাজধানী আগ্রার সন্নিকটবর্তী আজমিরে অবস্থিত প্রসিদ্ধ বুজুর্গ হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি (রহ.)-এর মাজারেও আকবর বহুবার মানত করেন ও উপস্থিত হন।

এমন সময় আগ্রাস্থ মুঘল রাজধানী ফতেহপুর সিক্রিতে খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন বিখ্যাত সাধক শেখ সেলিম চিশতি (রহ.)। সম্রাট আকবর প্রতি সপ্তাহে তার দরবারেও হাজির হতেন। অবশেষে পীর সাহের আশ্বাস দেন যে আকবরের ঔরসে তিনটি পুত্র সন্তান জন্ম নেবে। ১৫৬৯ সালের ৩০ আগস্ট আকবরের রাজপুত বংশীয় স্ত্রী যোধাবাঈ-এর গর্ভে শাহজাদা সেলিমের জন্ম হয়। পীর সাহেবের নামানুসারে আকবর সন্তানের নাম রাখেন সেলিম। মানত পূর্ণ হওয়ায় সম্রাট আকবর পায়ে হেঁটে আজমিরে হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি (রহ.)-এর মাজারেও শ্রদ্ধা জানাতে যান।

জাহাঙ্গীর মারা যান ১৬২৭ সালের ২৮ অক্টোবর কাশ্মীরে। সে সময় তিনি স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য প্রথমে কাবুল ও পরে কাশ্মীর ভ্রমণ করছিলেন। কিন্তু অতিরিক্ত ঠান্ডায় তিনি কোথাও স্থির হতে পারছিলেন না। এমতাবস্থায় তিনি কাশ্মীরের একটি এলাকায় মারা গেলে তাকে বাঘসর দুর্গে দাফন করা হয়। পরে সমাজ্ঞী নূরজাহানের নির্দেশে সেখান থেকে তার দেহাবশেষ তুলে পাঞ্জাবের লাহোরে এনে শাহদারা বাগে পুনরায় সমাহিত করা হয়। তার সমাধিক্ষেত্রে স্থাপন করা হয় একটি দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয় সমাধিসৌধ।

সম্রাট আকবর শেষ জীবনে তিনজন পুত্র সন্তানেরই পিতা হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যোগ্য উত্তরাধিকারী নির্বাচনের ক্ষেত্রে চিন্তিত ছিলেন। কারণ, তার প্রথম পুত্র সেলিম ছিলেন আয়েসী ও আমোদপ্রিয়। দ্বিতীয় পুত্র মুরাদ ছিলেন অত্যাধিক পানাসক্ত। তৃতীয় পুত্র দানিয়েল কিছুটা যোগ্য হলেও অকালে তার মৃত্যু ঘটে। মুরাদও অমিতচারিতার কারণে অকাল প্রয়াত হন। ফলে শাহজাদা সেলিম ছাড়া সম্রাট আকবরের উত্তরাধিকারী হওয়ার জন্য আর কোনও সন্তান ছিল না।

কিন্তু শাহজাদা সেলিম সম্রাট আকবরের জীবদ্দশাতেই একাধিক বার বিদ্রোহ করেন এবং ক্ষমতা দখল করতে উদ্যত হন। কিন্তু প্রতিবারই তিনি আকবর কর্তৃক পরাজিত ও ক্ষমাপ্রাপ্ত হন। শাহজাদা সেলিম শিখ ও রাজপুতদের নিয়ে আকবরের বিরুদ্ধে বিরাট বিদ্রোহী সেনাদলও গঠন করেন। মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে ক্ষমতার জন্য রক্ত ও পরিবারের মধ্যে সংঘর্ষের যে ইতিহাস দেখতে পাওয়া যায়, তা আকবর ও পুত্র সেলিমের মধ্যেও লক্ষ্য করা গেছে। তবে ১৬০৫ সালের ২৫ অক্টোবর সম্রাট আকবর মারা যাওয়ার আগে শাহজাদা সেলিমকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান।  

শাহজাদা সেলিম সম্রাট জাহাঙ্গীর নামে মুঘল ক্ষমতা পেয়ে আকবরের রাজ্য বিস্তার নীতি ও রাজনৈতিক কৌশল অব্যাহত রাখেন। তিনি উত্তর ভারতের মেবার, যোধপুর, উদয়পুর তথা পুরো রাজস্থান, গুজরাট দখল করেন এবং তার আমলেই বাংলায় মুঘল অধিকার নিশ্চিত হয়। তিনি আকবরের ধর্মীয় উদারতাবাদ অব্যাহত রাখেন। দরবারের শিয়া, সুন্নি সম্প্রদায়ের মুসলিমদের পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি তিনি হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের প্রতি উদারতা প্রদর্শন করেন। তার আমলে ইউরোপীয় শক্তি ক্রমে ক্রমে ভারতে এসে উপস্থিত হতে থাকে এবং তিনি খ্রিস্টান পাদ্রিদের পূর্ণ স্বাধীনতা ও রাজ-দরবারে স্থান দিয়েছিলেন।

বিরাট গৌরবের অধিকারী সম্রাট আকবরের পর অন্য যে কারো পক্ষেই ক্ষমতায় কৃতিত্ব রাখা সত্যিই ছিল কষ্টকর। তথাপি জাহাঙ্গীর মুঘল ঐতিহ্য ও ক্ষমতার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখেন। তবে আকবরের পর সম্রাট জাহাঙ্গীর অমিতাচার আত্মরতির মৌতাতে ডুবে থাকার ফাঁকেও ভুলে যান নি মুঘল সাংস্কৃতিক পরম্পরার ঐতিহ্যানুযায়ী ভারতের হাতে নিজের দুটি স্মরণীয় উপহার তুলে দিতে। প্রথমটি তাঁর আত্মচরিত সম্রাট জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী বা তুজকে জাহাঙ্গিরী আর দ্বিতীয়টি তাঁরই নির্দেশে এবং স্বতোৎসারিত আগ্রহে শিল্পীর তুলিতে আঁকা ভারতীয় জীবজন্তুর অ্যালবাম, পরে যেটি বিশ্বখ্যাত মুঘল মিনিয়েচার আর্ট ঘরানা নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে।

ব্যক্তিগতভাবে জাহাঙ্গীর অপরাপর মুঘল সম্রাটদের চেয়ে নানাদিক থেকে ব্যতিক্রমী। তিনি ছিলেন বিলাসী, সুরুচিবান, প্রথম তামাকসেবী সম্রাট। আকবরের শেষ জীবনের একমাত্র জীবিত সন্তানরূপে জাহাঙ্গীর আদর্শ মুঘল প্রিন্সের জীবনযাপন করেন। তাঁর সিংহাসন প্রাপ্তিও ঘটে বেশ দেরিতে, চল্লি¬শোর্ধ বয়সে। তাঁর যৌবন কাল কেটেছে কাব্য, সাহিত্য, চিত্রকলা, সঙ্গীত চর্চা, বিশেষত হিন্দি ভজন, নাচগান, শিকার, শরাব-কাবাব ও নৃত্যগীতের লীলা-লাস্যের মধ্য দিয়ে।

কিন্তু সিংহাসন লাভের পরই জাহাঙ্গীরের আচার-আচরণ বদলে যায়, জীবনধারায় আরামপ্রিয়তা ও শৈথিল্য হ্রাস পায়। তিনি বিচারপ্রার্থীদের সুবিধার্থে দরবারে ষাট মণ ওজনের সোনার জিঞ্জির বাঁধা ঘণ্টা লাগান এবং কতক গুরুত্বপূর্ণ শাহি বিধান জারি করেন। যেমন কোন বণিকের সম্মতি ছাড়া সরকারি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য তার বাক্সপেটরা, বস্তা, মালামাল খুলে তল্লাশি চালাতে পারবে না, কোন প্রজার বাসভবনে কোন ব্যক্তি বলপূর্বক অনুপ্রবেশ করতে পারবে না, কোন অপরাধের জন্য নাক কাটার প্রচলিত দ- দেওয়া যাবে না, কোন প্রজার জমি জবর দখল করা যাবে না, সরকারি কর্মচারি ব্যতিত সাধারণ নাগরিকের মৃত্যুর পর তার ত্যাজ্য সম্পত্তি ওয়ারিশগণ বিনাহস্তক্ষেপে প্রাপ্ত হবে ইত্যাদি।

তিনি পিতা আকবরের নতুন ধরনের ধর্মনীতি অব্যাহত রাখেন। অমলেন্দু দে মুঘল ইতিহাসের স্বচ্ছ ও অসচ্ছ পৃষ্ঠা (বইয়ের দেশ, জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১০, পৃ .১০৩) প্রবন্ধে জানান: তাঁর সময়ে আকবরের সময়কালের ধর্মীয় বহুত্ববাদ যে যথেষ্ট শিথিল হয়েছে, সে পরিচয় পাওয়া যায়। অন্যদিকে, এস এস রিগভি তাঁর দ্য ওয়ান্ডার দ্যাট ওয়াজ ইন্ডিয়া গ্রন্থে (পৃ. ১১৯) লিখেন: সম্রাট জাহাঙ্গীর সম্পর্কে ব্রিটিশ দূত স্যার টমাস রো এক পত্রে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম চার্লসকে জানান যে, সম্রাটের ধর্ম তাঁর নিজের আবিষ্কার; কারণ তিনি প্রফেট মুহাম্মদকে হিংসা করতেন এবং মনে করতেন তাঁর পক্ষে মুহাম্মদ-এর মতো একজন প্রফেট না-হওয়ার কোনো কারণ তিনি খুঁজে পান না।

প্রশাসনিক দক্ষতার সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক ও নান্দনিক জীবনে জাহাঙ্গীর ছিলেন অন্যান্য মুঘল সম্রাটের চেয়ে যথেষ্ট অগ্রসর। তাঁর বিবাহ-পূর্ব অনুরাগের কথা সর্বজনবিদিত। এদের একজন আনারকলি। অন্যজন নূরজাহান। যদিও নানা সময়ে জাহাঙ্গীর প্রায় দুই ডজন বিবাহ করেন, তথাপি তার জীবনের সঙ্গে মিশে আছে আনারকলি ও নূরজাহানের নাম। আনারকলির কাহিনি অবলম্বনে রচিত বিখ্যাত চলচ্চিত্র মুঘল-ই-আজম  ঐতিহাসিক মর্যাদা লাভ করেছে।

ইতিহাস জানাচ্ছে যে, নূরজাহানের প্রথম স্বামী বাংলার রাঢ়-বর্ধমান অঞ্চলের জায়গিরদার শের আফগান সম্রাট জাহাঙ্গীরের সঙ্গেই বিবাদের জেরে নিহত হন। বিধবা নূরজাহান বিজয়ী দিল্লির সৈন্যদল কর্তৃক আটক হয়ে একমাত্র কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে আগ্রার দূর্গে চার বৎসর বন্দিত্ব আর বৈধব্যময় জীবনযাপনকালে অকস্মাৎ সম্রাট জাহাঙ্গীর এক মিনাবাজারে নূরজাহানের রূপ-লাবণ্য দর্শনে মুগ্ধ হয়ে কেবল বিবাহ নয়, তাঁর প্রধান রাজমহিষীর মর্যাদা প্রদান করেন। তাঁর জীবনে তিনি নূরজাহানের অনেক প্রভাবকেও মেনে নিয়েছিলেন।

প্রসঙ্গত মুঘল রাজপরিবারের পরম্পরায় রোমান্টিক প্রেম বা স্ত্রী কিংবা প্রেমিকার প্রতি নিষ্ঠাবান নিবেদনের দৃষ্টান্ত বিরল নয়। হুমায়ুনের ভ্রাতা আসকারির পারিবারিক জীবনের একনিষ্ঠতা, জাহাঙ্গীরপুত্র হতভাগ্য খসরুর দাম্পত্য জীবন নানা কারণে আলোচিত বিষয়। শাহজাহান-মমতাজ প্রণয় কাহিনী ছাড়া তাঁর পুত্র ভাগ্যতাড়িত দারাশিকোহ ও স্ত্রী নাদিরার করুণ প্রেম, আওরঙ্গজেবপুত্র আজিমুশ্বান ও শাহ শুজাকন্যার দাম্পত্য প্রেম ইতিহাস প্রসিদ্ধ। ফলে তাজমহলের মতো বিশ্ববিশ্রুত প্রেমস্পর্শী স্থাপনার নির্মাণ কোনো আকস্মিক বা অস্বাভাবিক ঘটনা নয় মুঘল পরম্পরায়।

মুঘল পরম্পরাগত ঐতিহ্যে এটাও লক্ষ্যণীয় যে শত রক্তপাত আর অন্তঃদ্বন্দ্বের পরেও ভ্রাতৃবিরোধ ও হানাহানির আড়ালে ভ্রাতৃপ্রীতির চিহ্নও দুর্লক্ষ্য নয়। জাহাঙ্গীর তাঁর আত্মজীবনীতে জানিয়েছেন: আমি এক সুরাহি মদ ও দুর্লভ পাথরে মিনে করা একটি পানপাত্র আনবার নির্দেশ দিলাম। আমার চার ছেলে খসরু, খুররম, পারভেজ ও শাহরিয়ারকে একত্রে বসার নির্দেশ দিলাম এবং বললাম পানপাত্র পরস্পরকে দেওয়ার জন্য। আর আমি নিস্পৃহভাবে তাকিয়ে থেকে এই নতুন মিলন প্রত্যক্ষ করলাম। আমার পঞ্চম ও সর্বশেষ সন্তান সুলতান বখত সেই সময়ে বাংলাদেশে ছিল সেখানকার বিদ্রোহীদের দমনের জন্য। চার ভাই আমার কথা অনুযায়ী পানপাত্র পরস্পরকে হাতে তুলে দিল এবং খুশির আতিশয্যে পরস্পরকে আলিঙ্গন ও চুমা খেতে শুরু করে দিল।

জাহাঙ্গীর তাঁর আত্মজীবনীতে আরো জানাচ্ছেন যে, শাহজাহানের পনোর বৎসর বয়সে তাঁকে দস্তুরমত আনুষ্ঠানিকভাবে স্বহস্তে সুরাপাত্র তুলে দিয়ে সুরা পানের রাজকীয় ঐতিহ্যমণ্ডিত অভিষেক সম্পন্ন করেছিলেন। ফলে মুঘল সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও রীতির যে চিত্র পাওয়া যায়, তা অভিনব তো বটেই, অবাক করার মতো বিষয়ও।

সম্রাট জাহাঙ্গীর গৃহে হিন্দুস্তানি বা উর্দু ভাষায় কথা বলতেন। উর্দু বা হিন্দুস্তানি ভাষাকে তিনিই প্রথম মাতৃভাষা জ্ঞান করে ফারসি ও আরবির প্রচলন হ্রাস করেন। কোন বহিরাগত রাজদরবারে যোগ দিলে দেশজ ভাষা যতশীঘ্র শিখে নিতেন, ততই উত্তম মনে করা হত। সম্রাট জাহাঙ্গীর তুর্কি শাহাজাদা মির্যা শাহরুখের দেশজ ভাষা সম্বন্ধে অজ্ঞতার নিন্দা করে বলেছিলেন: এটা দুঃখজনক যে, তাতার জাতির স্বভাবসুলভ সরলতার দরুন ভারতে বিশ বছর থাকার পরেও তিনি (শাহাজাদা) হিন্দুস্তানি কথা মোটেই বলতে পারতেন না।

মুঘল পরম্পরার ঐতিহ্যানুযায়ী সম্রাট জাহাঙ্গীর চিত্রকলার পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াও ফুল আর সুগন্ধির ভক্ত ছিলেন। তাঁরই প্রণোদনায় সম্রাজ্ঞী নূরজাহান গোলাপের আতর আবিষ্কার করেন। মুঘল খানাপিনা, আচার-আচরণ, পোষাক-পরিচ্ছদেও বিকাশও ঘটে তার আমলে।

চিত্রকলায় জাহাঙ্গীরের অবদান প্রবাদপ্রতীম। মুঘল চিত্রকলা, যা মিনিয়েচার আর্ট নামে বিশ্বখ্যাত, তা প্রখর ব্যক্তিসত্তাবোধসম্পন্ন প্রতিকৃতি বা পোট্রেট চিত্রাঙ্কনের একটি আধুনিক ঘরানারূপে তৎকালীন জগতে বিস্ময়ের উদ্রেগ করে। ব্যক্তিত্ব ছাড়াও জীবনযাত্রা আর সমাজের বাস্তব দিক প্রতিফলিত হয় এতে। উপমহাদেশের অজন্তা গুহাচিত্র শিল্পের হাজার বছর পর মুঘলরা আবার ভারতীয় চিত্রকলাকে প্রবল নিরীক্ষার মাধ্যমে শ্রেষ্ঠরূপ দান করে আন্তর্জাতিক সম্ভ্রমের স্থরে পৌঁছে দেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের মাধ্যমে।

বস্তুতপক্ষে, চৈনিক চিত্রকলার শৈলী আফগানিস্তানের হিরাত অঞ্চলের বেহজাদ নামক চিত্রশিল্পীর হাতে স্থানীয় উপাদানের সংমিশ্রণে এক স্বাধীন, স্বতন্ত্র ও অপূর্ব শিল্পরূপ পরিগ্রহ করে। প্রাথমিক অবস্থায় বাদশাহ হুমায়ুন তাঁর নির্বাসিত জীবনে এই চিত্রকলার সংস্পর্শে আসেন। আকবরের রাজসভায় এই শিল্পের প্রাতিষ্ঠানিক সূচনা ঘটে। জাহাঙ্গীরের রাজত্বকাল মুঘল চিত্রকলার উৎকর্ষের যুগ। সম্রাট স্বয়ং ছিলেন চিত্ররসিক, প্রকৃতিপ্রেমিক ও পক্ষী পর্যবেক্ষক। শৈলবিহারী জাহাঙ্গীর কাশ্মীর ভ্রমণের সময় কেবল শিকারী নয়, একদল চিত্রকরকেও সঙ্গে নিয়ে যেতেন। কোন জীবজন্তু, পাখি ও ফুল সংগ্রহ করলে সঙ্গে সঙ্গে চিত্রকর দিয়ে আঁকিয়ে নিতেন।

চিত্রসংক্রান্ত বিষয়ের গুরুত্ব সম্রাটের কাছে এতোটাই ছিল যে, চিত্রশিল্পীদের রাজপ্রাসাদের আবাসিক এলাকায় বসবাসের সুযোগ প্রদান ছাড়াও উচ্চবৃত্তি ও খেতাব দিয়ে মর্যদাবান করা হয়। জাহাঙ্গীরের শিল্পজ্ঞান ও শিল্পবোধ ছিল প্রখর এবং উচ্চাঙ্গের। একটা চিত্রশিল্পকর্মে যদি একাধিক শিল্পীর সমবেত কাজ থাকত, তাহলে তিনি কোন অংশটি কার, সেটা অভ্রান্তভাবে বলে দিতে পারতেন।

আন্তর্জাতিক চিত্রকলা সম্পর্কেও সম্রাট জাহাঙ্গীরের সজাগ নজর ছিল। তিনি রেমব্রান্ট ও ইংরেজ চিত্রশিল্পীদের শিল্পকর্মের প্রতিও আগ্রহ প্রদর্শন করেন। জাহাঙ্গীরের নির্দেশে মুঘল চিত্রসমূহ উচ্চমানের কাগজে এবং গজদন্তের সূহ্ম পাতেও আঁকা হত। বাঁধাই করা হত শৈল্পিকভাবে, সোনারূপা, মণিমুক্তার কারুকার্য করা ফ্রেমে। ইউরোপের বিখ্যাত সম্রাজ্ঞী মারিয়া থেরেসা তাঁর একটি বিলাস কক্ষে সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে অঙ্কিত ষাটটিরও বেশি মুঘল চিত্র দিয়ে সাজিয়েছিলেন। ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট ভবনের অলিন্দে একটি সুবৃহৎ তৈলচিত্র রয়েছে, যেখানে রাজা জেমসের দূত স্যার টমাস রো তাঁর পরিচয়পত্র সম্রাট জাহাঙ্গীরের নিকট পেশ করছেন।

বিশেষজ্ঞগণ চিত্রকলার ক্ষেত্রে জাহাঙ্গীরের অবদানকে অপরাপর মুঘল নৃপতির চেয়ে অনেক উপরে স্থান দিয়েছেন। বলা হয়, চিত্রকলার ব্যাপারে তিনি ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন সমগ্র তৈমুর-তাতার-মোঙ্গল ট্র্যাডিশনকে। পারস্যের নাদির শাহের ভারত হামলাজনিত লুটপাটের সময় সম্রাট জাহাঙ্গীরের সুবিখ্যাত সুরৎখানার [চিত্র সংগ্রহশালা বা আর্ট গ্যালারি] অসামান্য চিত্রশিল্পচিহ্নরাজি তছনছ হয়ে যায়। পরে এগুলোর কিছুকিছু নানা হাত ঘুরে বিশ্বের বিভিন্ন সংগ্রহশালায় ও যাদুঘরে বিশ্বঐতিহ্যের মর্যাদায় স্থান পায়।

চিত্রশিল্প ছাড়াও সম্রাট জাহাঙ্গীরের ছিল এন্টিকপ্রীতি। সমকালের বিবেচনায় প্রাচীন ও আধুনিক রুচিসম্পন্ন  অভিনব দ্রব্যসামগ্রীর সমঝদার ছিলেন তিনি। তাঁর সংগ্রহের মধ্যে ছিল ইউরোপীয় বণিকদের নানা উপঢৌকন, ঘড়ি, চিত্রকলা, শিল্পকর্ম, আরশি, মিঙযুগের চীনের তৈজষপত্র, পশ্চিম এশিয়ার অস্ত্র ইত্যাদি।

জাহাঙ্গীর তাঁর রাজপ্রাসাদে চীনা মহল নামে একটি পৃথক চীনে মাটির সৌখিন পাত্রের দফতর স্থাপন করেন। সেখানে তৎকালের বিবেচনায় অত্যাধুনিক রকক্রিস্টাল কাটগ্লাসের সামগ্রী ছিল। জাহাঙ্গীরের সংগ্রহের মধ্যে আরো ছিল আইরিশ গ্রেহাউন্ড, ইংলিশ বুলডগ, ওয়াটার স্পেনিয়াম প্রভৃতি উঁচু জাতের কুকুর, বাফকোট হানটিং ব্রিচেস গালার কাজ করা জাপানি পাল্কি, মধ্যপ্রাচ্যের তামার কারুকার্য করা শামাদান, শিকারের ইউরোপীয় পোষাক ইত্যাদি। জাহাঙ্গীর সোনার বাঁশি পেয়ে মুগ্ধ কৌতুহলে আধ ঘণ্টা ধরে তা বাজাতে থাকেন।

পর্যটক তাভেনিয়ন তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে সম্রাট জাহাঙ্গীরের উপঢৌকন সংক্রান্ত তথ্য জানিয়েছেন: নবাব পুত্রকে উপহার দিলাম সোনার জলে মীনেকরা বাক্সে একটি ঘড়ি, রৌপ্যখচিত একজোড়া ছোট পিস্তল, অতি সুন্দর একখানা ম্যাগনিফাইং গ্লাস। সম্রাটকে আমি আরো দিয়েছিলাম স্ফটিক পাথরের যুদ্ধ-কুঠার, তাতে কিনারায় খচিত ছিল চুণী ও মরকত মণি। স্ফটিকের উপরে ছিল স্বর্ণাবরণ। তাঁকে আরো যা দেওয়া হয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তুর্কি রীতিতে তৈরি একটি ঘোড়ার জীণ। সেটার গায়ে ছিল ছোট ছোট চুণী, মুক্তাবালী ও হীরার অলঙ্করণ।

ইংরেজ দূত স্যার টমাস রো সম্রাট জাহাঙ্গীরকে বিখ্যাত ল্যান্ডো গাড়ি উপহার দেন, যা তিনি নূরজাহানের বিবাহ বার্ষিকীতে ব্যবহার করার মাধ্যমে উপমহাদেশের ইতিহাসে প্রথম মোটর গাড়ি ব্যবহারকারীর সম্মান লাভ করেন।

বিলাসী ও রসিক জাহাঙ্গীর নৃত্যকলার একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। তাঁর দরবারে নৃত্যাভিনয় লেগেই ছিল, যার মধ্যে প্রচ্ছন্নে ছিল অনেক নাট্যসাহিত্যের উপাদান। পর্যটক বার্নিয়ারের বর্ণনা থেকে জানা যায়: ডা. বার্নার্ড সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে থাকতেন তাঁর রাজত্বের শেষ দিকে। ভালো চিকিৎসক ও সার্জেন হিসাবে তাঁর বিশেষ খ্যাতি ও খাতির ছিল। তিনি মুঘল সম্রাটের বিশেষ প্রিয়পাত্র ছিলেন এবং প্রায়ই সম্রাটের সঙ্গে এক টেবিলে খানাপিনায় যোগদান করতেন। বার্নার্ডের দৈনিক তানখা (বেতন) ছিল দশ ক্রাউন। তাঁর গৃহে নৃত্যপটিয়সীরা নিয়মিত আসত, যাদেরকে বলা হত কাঞ্চনবালা।  তারা নৃত্যগীত করে তাঁকে খুশি করত। এইভাবে বার্নার্ডের দিন কেটে যায়। কিন্তু এরই মধ্যে একটি কা- ঘটে গেল। বার্নার্ড এক কাঞ্চনবালার প্রেমে পড়ে গেলেন। এবং সেই বালার পাণিপ্রার্থী হলেন। কিন্তু কাঞ্চনরা সাধারণত পেশার স্বার্থে কুমারী থাকে এবং তাদের অভিভাবকরাও তাদেরকে বিবাহ দিতে চায় না। পরে জাহাঙ্গীরের মধ্যস্থতায় দুজনের বিবাহ হয়।

পরিণত বয়সে শাসনকার্যে অধিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে যুবরাজরূপে অনেকটা আয়েসী ও কিছুটা ভোগবাদী জীবনে অভ্যস্থ শাহজাদা সেলিম তথা সম্রাট জাহাঙ্গীর প্রেম, প্রণয়, শিল্প, সংস্কৃতি, কলা, চিত্র, নৃত্য, গীতসহ বিভিন্ন সৃজনশীল ও মননশীল ক্ষেত্রে যে পরিমাণ সময়, সাধনা ও অর্থ ব্যয় করেছেন, অন্য কোন মুঘল নৃপতির পক্ষে তেমনটি করা রাজনৈতিক-সামরিক বান্তবতার কারণে সম্ভব হয় নি। সম্রাট জাহাঙ্গীর তার স্থিতিশীল সাম্রাজ্য এবং বিচিত্র রুচি ও জীবনাচারের জন্য মুঘল ঘরানার শাসক তালিকায় অনন্য বিশিষ্টজন রূপে চিহ্নিত হয়ে আছেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত