| 20 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

গীতরঙ্গ: গানে গানে ঢাকার রূপ । নুসরাত জাহান

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট
জাদুর শহর, মায়ানগরী, টাকার শহর, আশার শহর, স্বপ্নের শহর – কত কত খেতাব যে পেয়েছে তিলোত্তমা ঢাকা, তার ইয়ত্তা নেই! যাঁরা এখানে বাস করেন, তাঁদের কাছে কখনো শুধুই ইট-কাঠ-পাথরে ভরা জঞ্জালের একটা শহর এই ঢাকা। কিন্তু চোখে হাজার স্বপ্ন নিয়ে বহু দূরের পথ পাড়ি দিয়ে যাঁরা এই শহরে আসেন, তাঁদের কাঁধে থাকে আশার ঝুলি। এই আশা, এ শহর তাঁদের নিরাশ করবে না।
যে নামেই ঢাকাকে ডাকা হোক না কেন, এ শহর তার জৌলুস হারায় না কোনোভাবেই। হারাবেই বা কেন? বাংলাদেশের রাজধানী এই ঢাকা, চিত্তবিনোদনের সূতিকাগার এই ঢাকা, শিল্প-সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু এই ঢাকা। এ শহরকে ঘিরে আবর্তিত হয় কোটি মানুষের জীবন। আর সে কারণেই ঢাকা নগর এবং এর নাগরিক জীবন শিল্প-সাহিত্যে উঠে এসেছে বারবার।  উঠে এসেছে সঙ্গীতেও। 
প্রথমেই যে গানটার কথা না বললেই নয়, ভাষা আন্দোলনের প্রথম গান ‘রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনও করিলিরে বাঙ্গালী, তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি’। গানের রচয়িতা এবং সুরকার চারণ কবি শামসুদ্দীন। ভাষা আন্দোলনের প্রথম গানের রচয়িতা হিসেবে খুব বেশিদিন হয়নি এই নামটি আমাদের আলোচনায় এসেছে। 

২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ এর সন্ধ্যায় বাগেরহাটে শামসুদ্দীন স্ব-কন্ঠে এই গান গেয়েছিলেন এমন উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে গানের কথায় এবং সুরে কিছু পরিবর্তন করেছিলেন আলতাফ মাহমুদ। বর্তমানে যে গান শোনা যায়, সেটি আলতাফ মাহমুদ কর্তৃক ‘রাষ্ট্র ভাষা গান’-এর পরিবর্তিত রূপ।
অদ্ভুত সুন্দর এই গানের প্রতিটি লাইনে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের কথা, ভাষা শহীদদের কথা উঠে এসেছে। ঢাকার রাস্তা শহীদদের রক্তে কীভাবে ভিজে উঠেছিল, সে কথা উঠে এসেছে। 
প্রতি বছরই ২১শে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে নতুন করে গাওয়া হয় এ গানটি। তার অন্যথা ঘটেনি এ বছরও। বিটিভিতে প্রচারিত ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে এ বছর গানটি গেয়েছেন শাহীন, লাভলি, আরেফিন ও মরিয়াতুল জান্নাহ্। গানটি পেয়ে যাবেন বিটিভির ইউটিউব চ্যানেলে।

‘ঢাকা শহর আইসা আমার আশা পুরাইছে, 
লাল-নীল বাত্তি দেইখ্যা নয়ন জুড়াইছে
ঢাকা শহর আইসা আমার আশা পুরাইছে
মনের আশা পুরাইছে…’
আজিজুর রহমান পরিচালিত ‘অশিক্ষিত’ সিনেমার এই বিখ্যাত গানটি শোনেননি, এমন মানুষ সম্ভবত পাওয়া যাবে না (আর কেউ যদি এখনো শুনে না থাকে, তাহলে দ্রুত শুনে ফেলুন)। গ্রাম বা মফস্বল থেকে আসা মানুষ কী অনুভব করেন ঢাকায় এসে, তারই যেন প্রতিফলন গানটি। এ গান লিখেছেন বিখ্যাত গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার। সুর করেছেন আরেক কিংবদন্তি সুরকার সত্য সাহা। শিল্পী শাম্মী আখতার ও খন্দকার ফারুক আহমেদের কণ্ঠের জাদুতে গানটি জীবন্ত হয়ে উঠেছিল।
১৯৯৩ সালে প্রকাশ হওয়া জেমসের একটি জনপ্রিয় অ্যালবামের নাম ‘জেল থেকে বলছি’। তখন ব্যান্ডের নাম ছিল ফিলিংস। অ্যালবামের প্রায় সব গানই সাড়া ফেলেছিল খুব। তবে সেগুলোর মধ্যে একেবারেই অন্য রকম ছিল ‘ঢাকার প্রেম’ গানটি।

‘প্রেমে প্রেমে ভরা সুবাসে
অভিনব মেলামেশাতে
ঢাকা নগরীর আঁচলেতে
দুটি আবেগের শেকলে
ভালবাসাতে
যেখানে গোধূলিরা খেলা করে প্রেম ভরা জীবনে আমার
ও ঢাকার প্রেম…’
এমনই মোহনীয় লাইনের পর লাইন আছে গানটিতে। জেমস তাঁর সমস্ত আবেগ ঢেলে গেয়েছেন গানটি। গানের কথাগুলো লিখেছেন প্রখ্যাত গীতিকার বাপ্পী খান। জেমসের অসংখ্য জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা তিনি। ‘ঢাকার প্রেম’ গানটির সুর ও সঙ্গীত জেমস নিজেই করেছেন।
ঢাকা কি শুধুই সুন্দর? ঢাকা কিন্তু মানুষকে নিরাশা আর দুঃখও দিয়েছে! বিশেষ করে ঢাকার মেয়েরা যে প্রেমে প্রতারণা করে, তেমনটিই গানে তুলে এনেছিল সাবকনসাস ব্যান্ড। ২০০২ এ প্রকাশিত তাঁদের ‘মাটির দেহ’ অ্যালবামে রয়েছে ‘দুঃখ’ গানটি। এ গানেই এসেছে ঢাকার নারীদের সেই ছ্যাঁকা দেবার প্রসঙ্গ। গানটি কিন্তু বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল! এখনো না শুনে থাকলে শুনে ফেলতে পারেন ব্যান্ডের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে গিয়ে।

পপ গানের জন্য বেশ জনপ্রিয় ছিলেন মেহরীন। তাঁর গাওয়া ‘অবাক শহর ঢাকা’ আরেকটি চমৎকার গান ঢাকাকে নিয়ে। ল্যাটিনো পপ ফিউশন ধাঁচের এই গানটিতে ঢাকার নিত্যকার নানান ঘটনার কথা উল্লেখ আছে। জলাবদ্ধতা থেকে শুরু করে জ্যাম, রাস্তার বাজে অবস্থা থেকে বিখ্যাত জায়গা – সব স্থান পেয়েছে এই গানে। গানের কথা লিখেছেন মাহমুদ খুরশীদ। সুর ও সঙ্গীতায়োজন করেছেন মানাম আহমেদ। 
২০০৬ সালে প্রকাশ হওয়া ‘মনে পড়ে তোমায়’ অ্যালবামে আছে ‘অবাক শহর ঢাকা’ গানটি। শুনে দেখতে পারেন এ গানও। খুব সহজেই খুঁজে পাবেন ইউটিউবে। 

আধুনিকতা যেন এক সময় ভারি ম্লেচ্ছ বিষয় ছিল আমাদের দেশে। আধুনিক ঢাকার নারীদের আধুনিক পোশাক চক্ষুশূল হয়েছে সেই অতীত থেকেই। তার প্রভাব সঙ্গীতেও পড়েছিল। বিউটির গাওয়া ‘মডার্ন ঢাকা’ জুড়ে আছে নেতিবাচক কথা। ২০১৩ সালে প্রকাশিত ”কলেজ মেয়ে’ অ্যালবামে স্থান পেয়েছে এ গানটি। 

চলচ্চিত্রে ঘুরেফিরে প্রায়শই ঢাকার প্রসঙ্গ এসেছে গানে। অনন্ত জলিলের সেই ‘ঢাকার পোলা’ গানটার কথা মনে আছে নিশ্চয়ই? ২০১৩ সালের সিনেমা ‘নিঃস্বার্থ ভালোবাসা’র এই গান বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। গানটির কথা, সুর, সঙ্গীতায়োজন করেছেন আকাশ। গেয়েছেন জুবেন জর্জ।
বাংলাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি ব্যান্ড চিরকুট। জাদুর শহর ঢাকাকে নিয়ে একটা গান বেঁধেছেন তাঁরা। গানের নামও ‘জাদুর শহর’। জাদুবাস্তবতার শহর ঢাকা উঠে এসেছে সেই গানের কথায়।
‘কবি হাসে, টাকা ভাসে
গঙ্গাবুড়ির শহরে
আসমান তুই কাঁদিস কেন
অট্টালিকার পাহাড়ে
মিছে হাসি, মিছে কান্না
পথে পথের আড়ালে
গ্রিন সিগনাল, রেড ওয়াইন
দেওয়ালে, দেওয়ালে
এই শহর, যাদুর শহর
প্রানের শহর ঢাকারে…’ 
যে ঘোরে মানুষ আটকা পড়ে যায় এ শহরের মায়াজালে তা-ই যেন ঘুরেফিরে গেয়ে যান ব্যান্ডের সদস্যরা এই গানে। ২০১৩ সালে গানের নামেই প্রকাশ পায় চিরকুটের অ্যালবাম ‘জাদুর শহর’। গানের কথা, সুর ও শিল্পী – সবই চিরকুট ব্যান্ডের।

ঢাকার আরেকটি ব্যান্ড জালালি সেট। ২০১৬ সালে প্রকাশিত তাঁদের অ্যালবাম ‘লেভেল ১৩’ এ স্থান পায় ‘ঢাকা সিটি’ নামে একটা গান। হিপহপ ধাঁচের র‍্যাপ গানে তাঁরা তুলে নিয়ে আসেন আমাদের অতি পরিচিত ঢাকার এক অন্যরকম রূপ। জালালি সেটের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে পেয়ে যাবেন গানটি।
প্রেমিকার খোঁজে কোথায় যাবেন? ঢাকার কোন অলিগলি, রাস্তায় খুঁজবেন তাকে? আর যদি খুঁজে না পান কোথাও, সে বেদনার কথা আলাদা! এমনই এক গান ‘তুমি নাই’। অসংখ্য জনপ্রিয় গানের গীতিকার শেখ রানা তাঁর জাদু দেখিয়েছেন এই গানেও। ঢাকাকে হাতের তেলোয় নিয়ে প্রেমিকাকে খুঁজতে খুঁজতে যেন এ গান লিখেছেন তিনি। 
সুর ও সঙ্গীতায়োজন করেছেন বাপ্পা মজুমদার। গেয়েছেনও তিনি। প্রেমিকাকে খুঁজতে ঢাকা শহরের নানা জায়গা, রাস্তার কথা উঠে এসেছে গানে। আর বাপ্পার গায়কীতে প্রেমিকাকে খোঁজার সেই আকুতি যেন পূর্ণতা পেয়েছে।  
২০১৬ সালে এই একক গানটি মুক্তি পায়। শুনতে চাইলে পেয়ে যাবেন ইউটিউবে। 

আবার একটু আসা যাক চলচ্চিত্রে! ২০১৬ সালে মুক্তি পাওয়া ‘নিয়তি’ সিনেমার গানে আসে ঢাকার প্রসঙ্গ। ‘ঢাকাই শাড়ি’ নামে এ গানটি বেশ আলোচিত হয়। ঢাকাই শাড়িতে নায়িকাকে কেমন লাগছে, তা-ই গানে গানে জানিয়ে দেন নায়ক! এ গানের কথা, সুর ও সঙ্গীতায়োজন করেন স্যাভি। কণ্ঠ দেন স্যাভি ও লেমিস। 
ঢাকার কনে আর কলকাতার বরের সেই গল্প চলে আসছে সুদূর অতীত থেকে। সে গল্পই আরেকবার উঠে এসেছে ‘ঢাকাইয়া মাইয়া কলকাতার বাবু’ গানে। ২০১৮ সালে এই একক গানটি মুক্তি পায়। কথা ও সুর নাজির মাহমুদের৷ সঙ্গীতায়োজন করেছেন জাহিদ বাশার। কণ্ঠ দিয়েছেন আকাশ সেন ও কনা।

ঢাকাকে নিয়ে আরেকটি চমৎকার গান ‘এই ঢাকা’। প্রবাসী সঙ্গীতশিল্পী মালার গাওয়া এ গানটিতে ঢাকার তিলোত্তমা রূপটিই ফুটে উঠেছে। গানের কথা ও সুরও ছিল মালার। সঙ্গীতায়োজন করেছেন শাকের রানা। ২০১৮ সালে আরটিভির মিউজিক স্পেশালে গানটি মুক্তি পায়।
এবার একটু দেশের বাইরে যাই। ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড় ডোয়াইন ব্রাভো তাঁর ‘এশিয়া’ গানে বলেছেন ঢাকার সাকিব আল হাসানের কথা। এশিয়ার যেসব দেশের, যেসব খেলোয়াড় ব্রাভোর বন্ধু মানুষ, মূলত তাঁদের কথাই তিনি বলেছেন এই গানে। ২০১৯ এ ব্রাভো তাঁর ফেসবুক পেইজে গানটি শেয়ার করেন।
ঢাকাকে ভারি আপন করে পেয়েও ঢাকার প্রতি তীব্র অভিমান থাকে কারো কারো। এমন মানুষদেরই গান হলো ‘ঢাকার গান’।
‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ 
ভিড়ে ভরপুর বইমেলা,
রঙের মুখোশে বৈশাখ আনা
লাল সাদা শাড়ি চারুকলা, 
কদরের রাতে আজিমপুরে
গোরস্তান কি মাজারে,
পুরনো দিনের পোস্তগোলা 
কিংবা বাংলাবাজারে
ধানমন্ডি লেকের সন্ধ্যা 
চায়ের কাপে আড্ডা, 
শান্তিনগর মালিবাগ হয়ে
প্রগতি সরণি বাড্ডা;
আমি পেয়েছি তোমায় ঢাকা।
ঢাকা, আমার ঢাকা!
তোমার জন্য বহু অভিযোগ 
এ বুকে জমিয়ে রাখা।…’
পাওয়া-হারানোর ডামাডোলে ঢাকার বিখ্যাত জায়গা, বিখ্যাত ব্যক্তি আর ঐতিহাসিক ঘটনার জের উঠে এসেছে এ গানে। ঢাকাকে কাছ থেকে জানতে চাইলে এই গান শোনা আবশ্যক! 
‘আমার ঢাকা’ গানের কথা লিখেছেন ঔপন্যাসিক সুহান রিজওয়ান। সুর করেছেন ও গেয়েছেন শিল্পী জিল্লুর রহমান সোহাগ। সঙ্গীতায়োজন করেছেন মুকিত রহমান।
২০২০-এ করোনাকালে এই একক গানটি প্রকাশিত হয়। ইউটিউব থেকে সহজেই শুনে নিতে পারবেন গানটি।
এ বছর জলের গান ব্যান্ডের ‘ঢাকানামা’ গানটি বেশ হইচই ফেলে দেয়। ২০২১ এর জানুয়ারি থেকে প্রতি মাসেই জলের গান তাদের ফেসবুক পেইজ থেকে শেয়ার করে যাচ্ছে নতুন নতুন গান। তারই একটি হলো ‘ঢাকানামা’। সাড়া জাগানো এ গানটি ঢাকার জীবনকে তুলে এনেছে সুরে সুরে। গানের কথা ও সুর করেছেন রাহুল আনন্দ। গেয়েছেন মল্লিক ঐশ্বর্য। সাথে সঙ্গত দিয়েছেন ব্যান্ডের বাকি সদস্যরা।

এই গানগুলো ছাড়াও আরও বেশকিছু গান রয়েছে ঢাকাকে নিয়ে। যে নগরে বাস তাকে নিয়ে রোমান্টিসিজম যেমন আছে সেসব গানে, তেমনি আছে নৈরাশ্যের বিবমিষা। ভালবাসার গভীরতা যেমন আছে, তেমনি আছে ঘৃণার তীব্রতা। যা-ই থাকুক না কেন, তাতে আছে ঢাকার অনবদ্য হবার স্বীকৃতি। আছে ঢাকার অনন্য হবার প্রমাণ।
তিলোত্তমা ঢাকার বাঁধনে যাঁরাই জড়িয়েছেন, তাঁরাই তাঁদের কাজে-কথায়-গানে-লেখায় তুলে এনেছেন ঢাকাকে। ঢাকায় বাস করলেও ঢাকাকে জানা হয়ে ওঠেনি অনেকেরই। এই গল্প, কথা, গান ঢাকাকে চিনতে সাহায্য করবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত