| 28 মার্চ 2024
Categories
গীতরঙ্গ

হাওরের গান : ধামাইল, মালজোড়া ও সূর্যব্রত । সুমনকুমার দাশ

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

সুরমা নদীর ডাল–স্থানীয়রা এঁকেবেঁকে প্রবহমান সরু নদীটিকে এভাবেই চেনেন, জানেন। ডাল মানে শাখা। সুরমা নদীর এ শাখার পূর্বপাড়ে পূর্ব টাইলা গ্রামের অবস্থান, আর পশ্চিম দিকের বসতিগুলোকে বলা হয় পশ্চিম টাইলা। পশ্চিম টাইলার পুরোটাই মুসলিম বসতি, অন্যদিকে পূর্ব টাইলায় হিন্দু-মুসলিমের মিলিত বসবাস। এখানেই, মানে পূর্ব টাইলায় ১৯৪৫ সালে জন্ম নেন প্রতাপ রঞ্জন তালুকদার। এই প্রতাপ হচ্ছেন রাধারমণ দত্ত পুরকায়স্থ (১৮৩৪-১৯১৬)-এর সমগোত্রীয়। মানে ধামাইল গানের গীতিকার, ২০০৯ সালের ৭ অক্টোবর প্রয়াত। রাধারমণের মাধ্যমে গীতিনৃত্য ধামাইল গানের উদ্ভব, আর প্রতাপের হাত ধরে বিস্তৃতি–এমনটাই অনেকের অভিমত।

পূর্ব টাইলা গ্রামটি সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার পার্শ্ববর্তী দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। পূর্ব টাইলা থেকে রাধারমণের বাড়ি জগন্নাথপুরের কেশবপুর গ্রামের দূরত্ব খুব বেশি নয়। বড়জোর ‘আটাশ থেকে ত্রিশ’ কিলোমিটার হবে। নদী-নালা-খাল-বিল-প্রকৃতি-সংস্কৃতি পরিবেষ্টিত একই ভৌগলিক অঞ্চলের বাসিন্দা রাধারমণের রচিত গানের প্রভাবে প্রতাপ ধামাইলগান রচনায় মনোনিবেশ করেন। যদিও তাঁর মা অমূল্য বালা তালুকদারের অনুপ্রেরণাও ছিল। রাধারমণ-রচিত ‘সাপে খায় না, বাঘে খায় না, বাজ পড়ে না বুকে, কালো নারীর নাই গো  মরণ, চান-সুরুজ থাকিতে’ গানটা তাঁকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে। এরপর ধামাইল গান তো বটেই, একের পর এক লিখতে থাকেন সূর্যব্রত সংগীত, কীর্তন, গোষ্ঠ, মালসি, বারোমাসিসহ নানা ধরনের নারী সংগীত। ‘পদ্মপুরাণ’ লেখা শুরু করলেও মৃত্যুর আগে সেটি আর শেষ করে যেতে পারেননি।

চৌষট্টি বছরের জীবন পেয়েছিলেন প্রতাপ রঞ্জন তালুকদার। আর রাধারমণ বেঁচেছিলেন বিরাশি বছর। মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে রাধারমণ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছেন। রাধারমণের মৃত্যুর ঊনত্রিশ বছর পর জন্ম নিয়েছিলেন প্রতাপ। এরপর যখন তাঁর বয়স সাঁয়ত্রিশ–তখনই মূলত তাঁর ধামাইল গান রচনায় হাতেখড়ি। অবশ্য তখন রাধারমণ আর ধামাইল গান ছিল একে অপরের পরিপূরক। এখনও ধামাইল গানের পরিবেশনায় রাধারমণ-রচিত গানের প্রবল আধিপত্য থাকলেও প্রতাপ তাঁর নিজস্বতায় জীবদ্দশাতেই পেয়েছিলেন কিংবদন্তির মর্যাদা। তাঁর গান ‘প্রতাপবান্ধা’ হিসেবেই হাওরাঞ্চলে নারীদের কাছে পরিচিত।

রাধারমণ আর প্রতাপ ছাড়াও ধামাইলগানের গীতিকারদের মধ্যে মধুসূদন দাস, যতীন্দ্রমোহন রায় তালুকদার, সূর্যকান্ত বিশ্বাস, রুক্ষ্মিণী, চিত্রাঙ্গন মাস্টার, ভরত চন্দ্র সরকার, জীতেন্দ্র, নবকুমার, সন্ধ্যা রানী চন্দ, শিখা রানী দাস, রামজয় সরকার, শ্যামসুন্দর, মহেন্দ্র গোঁসাই, দুর্গাপ্রসাদ, মুকুল ঠাকুর প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এঁরা ছাড়াও অন্তত কয়েক শ গীতিকারের নাম উল্লেখ করা সম্ভব, যাঁদের রচিত ধামাইলগান নারীরা পরিবেশন করে থাকেন।

ধামাইল গান মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিয়ে উপলক্ষে আয়োজন করা হয়। এর বাইরে সাধভক্ষণ, অন্নপ্রশানসহ বিভিন্ন হিন্দু-ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও এ গানের পরিবেশনা দেখা যায়। মধ্যযুগের সাহিত্যে ‘ধামালী’ শব্দের ব্যবহার লক্ষ করা গেলেও রাধারমণের হাত ধরেই নৃত্যগীত হিসেবে ‘ধামাইল গান’ শীর্ষক পরিবেশনার উদ্ভব হয়েছে। ধীরে ধীরে এ পরিবেশনা সুনামগঞ্জ ছাড়িয়ে সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুরো হাওরাঞ্চলে ছড়িয়েছে। সময়ের পরিক্রমায় তা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলসহ ভারতের করিমগঞ্জ, শিলচর ও হাইলাকান্দিতেও বিস্তৃত হয়েছে।

বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত আমার সংগৃহীত ও সংকলিত ‘বাংলাদেশের ধামাইল গান’ (২০১০) বইয়ে ধামাইল শব্দের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সেখানে লিখেছি–

‘ধামাইল’ শব্দটির যথার্থ উৎস আজ পর্যন্ত কোনো গবেষক সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করতে পারেননি। তবে অনেকেই নানাভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। অনেকে ‘ধামালি’, ‘ধামান’, ‘দামান’, ‘ধামলী’, ‘ধামন’ শব্দ থেকে ধামাইল গানের উৎপত্তি হয়েছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।

[…] এসব গানের মধ্যে আবার বিভিন্ন পর্ব রয়েছে, যেমন–বন্দনা, আসর, বাঁশি, জলভরা, গৌররূপ, শ্যামরূপ, বিচ্ছেদ, কোকিল সংবাদ, কুঞ্জ সাজানো, স্বপন, চন্দ্রার কুঞ্জ, মান ভাঙানো, মিলন, সাক্ষাৎ খেদ, বিদায় প্রভৃতি।

[…] এই গান সমবেত সংগীত আকারে পরিবেশন করা হয়ে থাকে। শিল্পীরা চক্রাকারে নৃত্যের আঙ্গিকে ঘুরে ছন্দময় করতালির মাধ্যমে গেয়ে থাকেন। গানের সময় কোনো প্রকারের বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার না করলেও বর্তমান সময়ে কিছু কিছু জায়গায় ঢোল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে বাদ্যযন্ত্র মুখ্য বিষয় নয়। ধামাইল শিল্পীরা তাদের ছন্দময় করতালির মাধ্যমে সুর, তাল ও লয়ের সমন্বয় করে থাকেন। আবার এই গানের গায়নরীতিও অন্য গানের চেয়ে আলাদা। গানের শেষে লম্বা টানের রেশ পরিলক্ষিত হয়। […]  

প্রস্তুত মালজোড়াগানের আসর। ছবি: অসমিত নন্দী মজুমদার অভি

মালজোড়াগান

‘একজন গাইত আর একজন পিছেদিয়া জওয়াব দিত।’ মালজোড়াগান সম্পর্কে এভাবেই নিজের সহজ-সরল স্বীকারোক্তি দেন আমিরজান বেগম। এ বয়ান আছে মো. গোলাম মোস্তফা সংগৃহীত ও সম্পাদিত ‘রশিদ গীতিকা’য় (নভেম্বর ২০১৩)। আমিরজানদের বাড়িতে ‘দিনের বেলা কামরাঙ্গা গাছের তলে আর রাইতের বেলা বৈঠকখানা ঘরে আসর বইত’। সে আসরে গীত গান আমিরজানের কানে দিনে-রাতে পৌঁছত। রাতের বেলা গ্রামের আশপাশের বাড়ির নারীরাও মালজোড়াগান শুনতে ছুটে আসতেন। এ সাক্ষ্য যিনি দিয়েছেন, অর্থাৎ আমিরজান বেগম–তিনি ছিলেন বাউলসাধক রশিদ উদ্দিনের দ্বিতীয় স্ত্রী। ১৩৩৫ বঙ্গাব্দে (‘১৯২৮ অথবা ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দ’) নেত্রকোণার বাইশচাপড়া গ্রামের বাউলসাধক রশিদ উদ্দিন (২১ জানুয়ারি ১৮৮৯- ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৬৪)-এর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। এই রশিদ উদ্দিনই হচ্ছেন ‘তর্কধর্মী ও তথ্যমূলক’ মালজোড়াগানের প্রবর্তক।

‘রশিদ গীতিকা’য় মো. গোলাম মোস্তফা ‘স্থানীয়ভাবে তথ্যানুসন্ধান’ করে জানিয়েছেন, রশিদ উদ্দিন নেত্রকোণা শহরের তৎকালীন গরুহাট্টায় (বর্তমানে ওয়েসিস বিয়াম ল্যাবরেটরিজ ইংলিশ স্কুল মাঠ) প্রথম মালজোড়াগানের আসর বসিয়েছিলেন। যদিও নেত্রকোণা অঞ্চলের আরেক প্রখ্যাত গবেষক গোলাম এরশাদুর রহমানের মতে, ১৯৩০ সালে রশিদ উদ্দিনের হাত ধরে নেত্রকোনা অঞ্চলে মালজোড়াগানের প্রথম প্রচলন হয়। এ গানের প্রবর্তনে রশিদ উদ্দিনের সঙ্গী ছিলেন টকন মেস্ত্রী ও দিনমাঝি।  

তার মানে, আমিরজান বেগমের যে বয়ান ‘রশিদ গীতিকা’য় মুদ্রিত হয়েছে, সেটা  ১৯৩০ কিংবা ১৯৩৩ সালের পরের ঘটনা। আমিরজান বেগম রশিদ গীতিকায় আরও সাক্ষ্য দিচ্ছেন–

আমার যখন বেয়া অয় তহন রশিদ বাউলের বড় নাম-ডাক। বাড়িভর্ত্তি থাকত বাউলের সাগ্রেদরা। বেহের নাম মনে নাই। যাঁরা বেশি-বেশি বাড়িতে আইত তাঁরা অইল–জালাল খাঁ, আলী হোসেন, আবেদ আলী, তৈয়ব আলী, চান খাঁ, মিরাজ আলী, পিতাম্বর, কমল মিয়া, মজিদ, চান মিয়া, উকিল মুন্সী। এঁরা দিন-রাইত থাকত আর গান গাইত।

মালজোড়াগান পরিবেশন করছেন বাউল উমেদ আলী ফকির। ছবি: অসমিত নন্দী মজুমদার অভি

আমিরজান বেগমের উপর্যুক্ত বয়ান থেকে মালজোড়াগানের সঙ্গে সম্পৃক্তদের ছোটখাটো একটা নামের তালিকা পাওয়া যায়। একই রকম আরেকটি তালিকা পাওয়া যায় ‘রশিদ গীতিকা’য় মুদ্রিত মুখবন্ধেও। সেখানে মো. গোলাম মোস্তফা লিখেছেন–

নেত্রকোণার বাউল জগতের মধ্যমণি ছিলেন বাউল কবি রশিদ উদ্দিন আর তাঁর নিত্যসঙ্গী ছিলেন বাউল জালালউদ্দিন খাঁ, বাউল মিরাজ আলী, বাউল কমল মিয়া, বাউল উকিল মুন্সী, ইদ্রিস মিয়া, বাউল আব্দুল মজিদ তালুকদার, বাউল আলী হোসেন সরকার, বাউল আবেদ আলী, বাউল চান মিয়া, বাউল ইসরাফিল, বাউল খোর্শেদ মিয়া, বাউল প্রভাত, বাউল আলী হোসেন, বাউল পীতাম্বর নাথ, বাউল তৈয়ব আলী, বাউল মিয়াহুব, বাউল উমেদ আলী প্রমুখ এবং নেত্রকোণার বাইরের বাউলগণের মধ্যে বাউল আব্দুল বারেক, বাউল শাহ আব্দুল করিম, বাউল আবু তাহের, বাউল আব্বাছ উদ্দিন ও বাউল উপেন্দ্র সরকার প্রমুখ। এ বাউল গোষ্ঠী মূলত নেত্রকোণার বাউল জগতের ‘মালজোড়া’ বাউলগানের নির্মাতা। আর বাউল রশিদ উদ্দিন ছিলেন তাঁদের ঘরানার ওস্তাদ।

দেখা যাচ্ছে– মো. গোলাম মোস্তফা তাঁর ‘রশিদ গীতিকা’য় মালজোড়াগানকে বাউলগানের একটা অংশ বলে বারবার উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে কেউ কেউ মালজোড়াগানের ধারাকে বিচারগান এবং কবিগানের পরম্পরায় সৃষ্ট হয়েছে বলেও দাবি করেছেন। এ দাবির সপক্ষে যুক্তি হচ্ছে, রশিদ উদ্দিন একসময় হিন্দুধর্মীয় শাস্ত্রভিত্তিক ‘কবিগান’ এবং মুসলিম লোকায়ত-দর্শনভিত্তিক ‘জারি গান’ পরিবেশন করেও সুনাম অর্জন করেছেন। সেখান থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি মালজোড়াগানের প্রবর্তন করেন। এ প্রসঙ্গে মালজোড়াগানের প্রখ্যাত শিল্পী ও সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের উজানধলের বাউল-গীতিকার শাহ আবদুল করিম (১৯১৬-২০০৯) তাঁর আত্মস্মৃতিতে লিখেছেন–

যে কোনো এক বিষয়কে সামনে তুলে ধরে।
গাইতে হয় দুই জনে প্রশ্ন-উত্তর করে।।
বাউল প্রতিযোগিতা কবিগানের ধারা।
এলাকার জনগণ নাম দিল মালজোড়া।।

নেত্রকোণায় উদ্ভব হয়ে ধীরে ধীরে মালজোড়াগান সুনামগঞ্জ হয়ে পুরো হাওরাঞ্চলে বিস্তৃতি লাভ করে। তবে কেন গানের এ ধারাটির নাম মালজোড়া হলো কিংবা এ গানের বিষয়বস্তু কী–এমন আগ্রহের বিপরীতে একটা জবাব পাওয়া যায় ‘রশিদ গীতিকা’য়। সেখানে মো. গোলাম মোস্তফা লিখেছেন–

বাউল রশিদ উদ্দিনের মালজোড়া বাউল গানের ধারাটি এক ধরনের তর্কধর্মী সংগীতের উপস্থাপনা। আর এই ধারাটি গুরুবাদী ভাবধারার সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত। এ ধারায় সংগীত চর্চার ভেতর দিয়ে সাধকেরা তো বটেই, সাধারণ মানুষ দীক্ষিত হয় প্রকৃত জ্ঞানের পথে। তাঁর এই ধারার গানে ধর্মের কোনো গোঁড়ামি নেই। তিনি গানের মাধ্যমে পরিবেশন করেছেন তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব, জ্ঞানতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্বের বহুবিধ বিষয়। এ ধারার গানের আসরে আলোচনা-সমালোচনার ভেতর দিয়ে নিয়মানুযায়ী দুই প্রতিপক্ষ গায়ক এবং তাঁদের নিজস্ব বাদক ও সহকারী দোহারগণ থাকেন। প্রতিপক্ষ গায়ক সুনির্দিষ্ট কোনো একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে বাদক ও সহকারী-দোহারদের সহযোগিতায় হাসিদ-কোরআন, বেদ-বিজ্ঞান, বাইবেল, সমাজ ও সামাজিক রীতিনীতি ঘেঁটে ঘুঁটে এক ধরনের তর্ক-বিতর্ক নাটকীয়ভাবে উপস্থাপন করেন। এখানে থাকে মাল (যোদ্ধা), জোড়া (দুজন) অর্থাৎ গানে দু’মালের গানের লড়াই হলো ‘মালজোড়াগান’। […] এ ধারার গানের আসরের অগণিত ভক্ত-শ্রোতা দর্শক গায়কগণের উপস্থিত বুদ্ধির ঝলকানো, গানের কথায় বিস্মিত হতে হতে রাত পার করে দিতেন। সাথে সাথে এ গানে জারি, কবি, পুঁথিপাঠ, মারফতি, মুর্শিদি, বিচ্ছেদি, ভাটিয়ালি ইত্যাদি […] লোকগানের স্বাদ পেত। সাথে বিষয়বস্তু হিসেবে থাকত নবী-রাসূল, পীর-ফকির-দরবেশ, মুনি-ঋষি, জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের জীবন-কাহিনীর অনেক তথ্য ও তত্ত্ব, বিভিন্ন কিচ্ছা-কাহিনী, হিন্দু-মুসলমান শাস্ত্রীয় বর্ণনা, মুর্শিদী-মারফতি তত্ত্বের বিবরণ এবং ভাব-বিচ্ছেদিগীত ইত্যাদি বিষয়কে কেন্দ্র করে গাইতেন। […] মালজোড়া বাউলগান মূলত শিক্ষামূলক, এখানে প্রতিযোগিতাই প্রধান।


[…] অনেক সময় মালজোড়া গানে দোতরা বাজিয়ে দুপক্ষ গায়কগণ হালকা ও চটুল বিষয়ে দর্শকদের আনন্দ দিতেন। এ ধরনের গান সব সময় কঠিন তত্ত্বে বা ভাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো না। গানে যেভাবে হোক বিপক্ষের গায়ককে প্রশ্ন করে আটকানো হতো; আবার বিপক্ষের গায়কও পাল্টা প্রশ্ন করে তার জবাব দিতেন। এ ক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট বিষয়ের মধ্যে আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকত না, এমনকি এখন পর্যন্ত মালজোড়া গানের কোনো রীতিনীতি তৈরী হয় নি ও প্রচার হয় নি। গানের মাধ্যমে যিনি গানের প্রশ্নের জবাব দিতে পারেন, তিনিই বিজয়ী হন।     

‘মালজোড়া গানের উন্মেষলগ্নেই এটি অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করে’ বলে জানিয়েছেন সংগীতজ্ঞ রামকানাই দাশ (১৯৩৫-২০১৪)। সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের পেরুয়া গ্রামের বাসিন্দা, হাওরের প্রখ্যাত এই লোকসংগীতশিল্পী তাঁর আত্মজীবনী ‘সঙ্গীত ও আমার জীবন’ (২০১১) বইয়ে লিখেছেন–

যুগের এবং সমাজ জীবনের পরিবর্তনকে বিবেচনায় রেখে কবিগানের সঙ্গীতাংশের বেশির ভাগ পর্যায়গুলোকে বাদ দিয়ে কেবল দুই কবিয়ালের তর্কাতর্কি অংশটিকে […] কাজে লাগিয়েই মালজোড়া তৈরি হয়। […]

কবির সরকারগণ রাধাকৃষ্ণ-হরগৌরি প্রভৃতি প্রসঙ্গে তাঁদের প্রশ্ন সীমাবদ্ধ রাখত কিন্তু মালজোড়ায় মহানবীর জীবন, হাসরের মাঠ প্রভৃতি বিষয় যোগ করে গায়কগণ আরো ব্যাপক করে তোলেন এর পরিধি। […]

মালজোড়াগানকে সুনামগঞ্জ অঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন নেত্রকোণার বাউলশিল্পী আবদুস সাত্তার এবং সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের শাহ আবদুল করিম। এমনটা জানিয়ে রামকানাই দাশ তাঁর আত্মজীবনীতে করিম প্রসঙ্গে লিখেছেন–

আমার কাছে আশ্চর্যই ঠেকে, সব মালজোড়া আর বাউল গায়কদের গানের বিষয়বস্তু যেখানে ছিল প্রধানত ধর্মভিত্তিক, সেখানে করিম ভাই শোষিত-বঞ্চিত আর নিপীড়িত মানুষদের কথা আর শোষণমুক্ত সমাজের চিন্তা-চেতনার কথা জুড়ে দিয়ে মালজোড়াকে আরেক মহিমান্বিত রূপে প্রতিষ্ঠা করেন। দ্রুত তাঁর নাম দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। […]

[…] নেত্রকোণায় রশিদ উদ্দিনের আসরেই মালজোড়ায় তাঁর হাতেখড়ি।

মালজোড়া গানের রচনা, কাব্য প্রতিভা, বাচনভঙ্গি, সুর প্রয়োগ এবং ভাবগত আধুনিকতা মিলিয়ে করিম ভাইয়ের মতো কেউ জনপ্রিয় হতে পারেন নি। শুধু গায়ক হিসেবে সে সময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অমিয় ঠাকুরের অশেষ খ্যাতি ছিল। কিন্তু তাঁর কবিত্বটা অর্থাৎ সঙ্গে সঙ্গে রচনা করে প্রশ্নোত্তর পর্ব মোকাবেলা করার কৌশল খানিকটা দুর্বল ছিল। […]

শাহ আবদুল করিম ছাড়াও সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের ভাটিপাড়া গ্রামের বাউল-গীতিকার কামাল উদ্দিন (১৯০০-১৯৮৫) এবং ছাতকের নোয়ারাইয়ের বাসিন্দা বাউল-গীতিকার দুর্বিন শাহ (১৯২১-১৯৭৭) মালজোড়াগানের প্রখ্যাত শিল্পী ছিলেন। মূলত কামাল-করিম-দুর্বিনদের হাত ধরেই সুনামগঞ্জ ও সিলেটসহ পুরো হাওরাঞ্চলে মালজোড়াগানের নতুন জোয়ার তৈরি হয়। রামকানাই দাশ তাঁর আত্মজীবনীতে কামাল উদ্দিন ও দুর্বিন শাহ প্রসঙ্গে লিখেছেন–

কামালের বিরহের গান ছিল খুবই হৃদয় স্পর্শ করা। দুর্বিন শাহ ছিলেন ভাবসাগরের রাজা। তাঁর কণ্ঠ খুব ভালো ছিল না। কিন্তু তাঁর মালজোড়ার কৌশল শ্রোতাদের মুগ্ধ করত।

২০১৩ সালের মে মাসের শুরুতে প্রয়াত সংগীতজ্ঞ রামকানাই দাশ বর্তমান প্রবন্ধকারকে এক সাক্ষাৎকারে কামাল উদ্দিন, শাহ আবদুল করিম ও দুর্বিন শাহ প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করেছিলেন। সেটি সংকলিত হয়েছে ‘রামকানাই দাশের নন্দনভুবন : অন্তরঙ্গ আলাপ’ (২০১৪) বইয়ে। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন–

করিম-দুর্র্বিনের এক সঙ্গে দুজনের মালজোড়াগান শুনেছি। দুর্বিন শাহ শান্ত গম্ভীর মানুষ। তাঁর গলা ভালা আছিল না, রচনা ভালা। গলা ভালা আছিল কামাল উদ্দিনের, কিন্তু তিনি মানুষ সুবিধার ছিলেন না। একবার মনে আছে–কামাল উদ্দিন এক মালজোড়াগানের আসরে করিম ভাইকে বলছেন, ‘তুই করিম, তোর নাকে দিয়া হেঙ্গুস পড়ে। তোর বাপের সঙ্গে আমি চলি। আর তুই আইছস আমার সঙ্গে গান গাইতে।’ এই কথা শুনে করিম ভাই গাইঞ্জাত টান দিয়া মঞ্চে উঠছইন। করিম ভাই কইলা, ‘আমার চেয়ে কামাল ভাইয়ের বয়স কত বেশি অইব?’ উপস্থিত শ্রোতা-দর্শকেরা জানান, চার-পাঁচ বছর হবে। পুনরায় করিম ভাই বলেন, ‘তার মানে আমার বাপের সঙ্গে যেহেতু কামাল ভাই চলইন, সে সময় কামাল ভাইয়ের বয়স আট বা নয় অইব। আসলে আমার বাবার চরিত্রগত একটু দোষ আছিল।’ করিম ভাইয়ের ইঙ্গিত বুঝে সবাই হু হু করে হেসে ওঠেন। করিম ভাই হেসে হেসে বকা দিতাইন। আসলে করিম ভাই মালজোড়াগানে খুব নাম করছিলা। এই রকম মানুষ যুগে যুগে হয় না, এরা ক্ষণজন্মা। কামাল ভাইও মালজোড়া ভালা গাইতাইন, তবে করিম ভাইয়ের মতন না।

মালজোড়াগানের প্রসঙ্গে রামকানাই দাশ ‘সঙ্গীত ও আমার জীবন’ বইয়ে লিখেছেন–

সিলেটে মালজোড়া গানের জনপ্রিয় আরও তিনজন গায়ক দুর্বিন শাহের ছাত্র ক্বারী আমিরুদ্দিন, অন্নদারঞ্জন দাস এবং শাহ আবদুল করিমের শিষ্য রুহী ঠাকুরের নাম উল্লেখযোগ্য। প্রথমজন অর্থাৎ ক্বারী আমিরুদ্দিন জনপ্রিয়তার এমনই শীর্ষে আরোহন করেন যে একসময় অনুষ্ঠান পিছু তাঁর পারিশ্রমিক এক লাখ টাকায় উঠে যায়।

রামকানাই দাশ কামাল-করিম-দুর্বিন পরবর্তী মালজোড়াগানের যে তিনজন শিল্পী অর্থাৎ সুনামগঞ্জের ছাতকের কারি আমীর উদ্দিন আহমদ (১৯৪২), সিলেট সদর উপজেলার মিত্রীমহল গ্রামের অন্নদারঞ্জন দাস ও সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের উজানধল গ্রামের রোহী ঠাকুরের নাম উল্লেখ করেছেন, তাঁদের আগে-পরেও হাওরাঞ্চলের আরও বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মালজোড়াগানের শিল্পী রয়েছেন। এঁদের মধ্যে সুনামগঞ্জের ছাতকের গোবিন্দগঞ্জের মানউল্লাহ (প্রয়াত), তকিপুর গ্রামের আরশ আলী ও দোয়াবাজার উপজেলার বারিগাঁওয়ের ছইদ আলী, নেত্রকোণার মুজিব সরকার, সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার জগদলের মো. শফিকুন্নুর (১৯৪৩-১৯৯৬), উজানধলের সুনন্দ সাধু ও আয়লাবাজের তকবুল শাহ, সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারের কফিলউদ্দিন সরকার, জগন্নাথপুরের মকদ্দস আলম উদাসী, হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার জলসুখা গ্রামের আবদুর রহমান, সিলেটের বিরহী কালা মিয়া, নেত্রকোণার সুনীল কর্মকার, কলমাকান্দা উপজেলার বাবনী গ্রামের সিরাজ উদ্দিন খান পাঠান, ইসলাম উদ্দিন, আজাদ মিয়া ও শামছুন্নাহার, সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের গাজীপুর গ্রামের গোলাম মোস্তফা, ছাতকের চন্দন মিয়া (১৯৫১), দিরাইয়ের বশিরউদ্দিন সরকার ও সিরাজ উদ্দিন, জামালগঞ্জের সূর্যলাল দাস, ছাতকের মল্লিকপুর এলাকার সাবুল মিয়া ও গোবিন্দগঞ্জের আমির আলী, দোয়ারাবাজারের দোহালীর লাল মিয়া ও বাচ্চু মিয়া (প্রয়াত), জগন্নাথপুর উপজেলার বালিকান্দি গ্রামের শাহাব উদ্দিন, সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের পারুয়া গ্রামের উদাসী মুজিব, হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার জলসুখা গ্রামের শাহীনূর আলম সরকার, নেত্রকোণার সালাম সরকার, নেত্রকোণা সদর উপজেলার বাইদারকান্দা গ্রামের উমেদ আলী সরকার ও অঞ্জনা, সিলেট ও সুনামগঞ্জের দিলাল উদ্দিন সরকার, উদাসী মুজিব, শাহ মোহিত সরকার প্রমুখ রয়েছেন। তবে দুই দশক আগেও যেখানে গ্রামে গ্রামে মালজোড়াগানের আসর বসত, এখন সে ঐতিহ্যে ভাটা পড়েছে।

সূর্যব্রত-সংগীত

লোকসংগীত শিল্পী চন্দ্রাবতী রায়বর্মণ (১৯৩১-২৭ আগস্ট ২০১৪)-এর পৈতৃক বাড়ি সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামে। বৈবাহিক সূত্রে সিলেট শহরে পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু। মারা যাওয়ার মাস দুয়েক আগে তাঁর একটা দীর্ঘ সাক্ষাৎকার আমি নিয়েছিলাম। পরে, ওই সাক্ষাৎকারটি পুস্তিকা আকারে ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়, নাম ‘চন্দ্রাবতী রায়বর্মণের সঙ্গে’। তো, এই চন্দ্রাবতী যেমন প্রাচীন লোকগান গাইতেন, তেমনই সূর্যব্রত-সংগীতও প্রচুর জানতেন। হাওরাঞ্চলে হিন্দু সম্প্রদায়ের নারীদের কাছে সূর্যব্রত-সংগীত একটি প্রাণবান গানের ধারা। এ প্রসঙ্গে চন্দ্রাবতী রায়বর্মণ আমাকে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন–

আমাদের অনেক মেয়েরা আট-নয় বছর বয়সেই সূর্যব্রত পূজায় অংশ নিত। এই পূজায় গান তো অবধারিতভাবেই হাজির। সে পর্যায়ের গান সূর্যব্রতের গান বা সূর্যব্রতসংগীত নামে প্রচলিত। সূর্যব্রত গানের দুই ভাগ আছে। একটা ভাগ হলো সারা মাস ভোরবেলা স্নান করে পূজা করতে হয়। আর দ্বিতীয় ভাগটি হচ্ছে উঠোনে গান পরিবেশন। মাঘ মাসে এই পূজা হয়। সকালেই দলবেঁধে নদীতে গিয়ে স্নান করার রেওয়াজ রয়েছে। সব ব্রতীরা দলবেঁধে নদীতে হাজির হন। সেখানে এক ধরনের আচার-সংস্কৃতি রয়েছে। স্নানের সময় বলতে হয়–‘লও লও সুরজাই/লও লও পানি’। এইভাবে পুবদিকে মুখ করে নদীর জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে সূর্যকে উদ্দেশ্য করে পানি ছিটিয়ে দিতে হয়। স্নান শেষে ব্রতীরা পূজাস্থলে ফেরেন। সেখানে পূজাস্থল অর্থাৎ বাড়ির শুকনো উঠোনে ব্রতীরা জড়ো হন। এর আগে প্রত্যেক ব্রতীরা উঠোনে একটি করে মাটির বেদী বানান। এই বেদীতে চুলার মতো গর্ত তৈরি করা হয়। তারপর দূর্বাসহ নানা উপকরণ ওই গর্তে দিয়ে ব্রতীরা বলতে থাকেন–‘ছইলাম ছইলাম দূর্বা আগে…’। এরপর আরও কত কী বলে, এখন ততটা আর স্পষ্ট মনে নাই।


সূর্যব্রত পূজার সময় সারা উঠোনে ব্রতীরা আলপনা আঁকেন। পূজার মাসে প্রত্যেক রোববার ব্রতীরা নদীতে ভেলুয়া ভাসান। আবার ভোরবেলা স্নান শেষে আচার পালন করে উঠোনে ঘুরে ঘুরে অনেকটা ধামাইল গানের মতোই সূর্য পূজার গান পরিবেশন করে থাকেন ব্রতীরা। কেউবা হাততালি দিয়ে নৃত্য করে আবার কেউবা করতাল বাজিয়ে মহা উৎসাহে এই গান পরিবেশন করেন। কৃষ্ণের জন্মের গান, রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক গান–এইসব হয় আর কি। পুরা মাঘ মাস এইভাবে চলে। সূর্যকে ভক্তি-নিবেদন করে জলপানি দেওয়ার জন্যই মনে হয় এই পূজার উৎপত্তি। তবে আমার কাছে মনে হয়–নারীদের ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস তৈরি, তাঁদের কর্মঠ ও গৃহস্থালিতে অভ্যস্ত করতেই এই পূজার উদ্ভব হইছে।

সূর্যব্রতের আচার-সংস্কৃতি এবং সূর্যব্রত সংগীতের নিয়ম ও প্রচলনের বিষয়টি চন্দ্রবতী রায়বর্মণের প্রদত্ত সাক্ষাৎকার থেকেই অনেকটা ধারণা করা সম্ভব। তবে প্রাসঙ্গিকভাবে ‘সূর্যব্রত-সংগীত’ নামে আমার রচিত একটি প্রবন্ধের কিছু বক্তব্য এখানে উল্লেখ করা যায়। ‘লোকগানের বিচিত্র ধারা’ (২০২০) শীর্ষক আমার লেখা বইয়ে এ প্রবন্ধটি সংকলিত হয়েছে। সেখানে লিখেছি–

সূর্যপূজার রেওয়াজ মানবসভ্যতা শুরু হওয়ার পর থেকেই প্রচলিত রয়েছে। আদিম মানুষেরা এই সূর্যকে শক্তি হিসেবে কল্পনা করে তার পূজা-অর্চনা করত। তবে আলোচ্য রচনায় বিষয়বস্তু কিন্তু সেই সূর্যপূজাকে ঘিরে নয়। এখানে মূল আলোচনার বিষয় হলো সূর্যব্রত-সংগীত, গোপিনী কীর্তন কিংবা কৃষ্ণলীলা-গীতি প্রসঙ্গে। বাঙালি হিন্দু নারীরাই মূলত এ ধরনের সংগীত প্রচার ও বিস্তারকারী। ঠিক কবে থেকে এ গীতির প্রচলন সেটি গবেষকেরা বিস্তর অনুসন্ধান করেও বের করতে পারেননি। প্রসঙ্গক্রমে শ্রী সরোজ প্রভাদেবীর মন্তব্য এখানে স্মর্তব্য। তিনি তাঁর সংকলিত ‘শ্রীশ্রী সূর্য্যব্রত সঙ্গীত বা গোপিনী কীর্ত্তন’ (১৩৯০ বাংলা) বইয়ের ভূমিকায় লিখেছিলেন, ‘বহু শতাব্দী হইতে প্রতি বৎসর মাঘ মাসে রমণীগণ সূর্য্যব্রত করিয়া রাধাকৃষ্ণের লীলাকীর্ত্তন করিয়া থাকেন।’

‘বহু শতাব্দী’ হতে প্রচলিত সূর্যব্রত হাওরাঞ্চলের নারীদের এক প্রধান ধর্মীয় রেওয়াজেই পরিণত হয়ে গিয়েছে। তবে ধর্মীয় রীতি-রেওয়াজের পাশাপাশি পূজাকে কেন্দ্র করে নারীরা দিনভর যে গানের আসর বসান, সেটি বাংলা লোকসংস্কৃতির এক উর্বর ও অমূল্য অধ্যায় হিসেবেই পরিগণিত হচ্ছে। বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে সূর্যব্রতের প্রচলন থাকলেও বিশেষত বাংলাদেশের হাওরাঞ্চল অর্থাৎ সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের নারীরা এ পূজার সঙ্গে অত্যাবশ্যকভাবে কৃষ্ণের মহিমা-সংবলিত গান পরিবেশন করে থাকে। এসব গান সূর্যব্রত-সংগীত হিসেবেই বেশি পরিচিত, এর বাইরে কেউ কেউ এ ধারার গানকে গোপিনী কীর্তন এবং কৃষ্ণলীলা-গীতি হিসেবেও অভিহিত করে থাকে।

সূর্যব্রতের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তি ও অর্ঘ্য নিবেদন। তাই এ পূজায় গীত গানের মূল বিষয়বস্তুই হচ্ছে কৃষ্ণের মহিমা এবং প্রশংসাসূচক কর্মকা– বর্ণনা করা। কৃষ্ণের জন্ম থেকে শুরু করে যুগলমিলন–সব কাহিনিই সূর্যব্রত-সংগীতে স্থান পেয়েছে। এ ছাড়া কৃষ্ণ কর্তৃক রাক্ষসী পুতনা, তৃণাবর্ত, বকাসুর, অঘাসুর বধ এবং কালীনাগ দমনের কাহিনিও এসব গানের বিস্তৃত অংশ জুড়ে রয়েছে।

‘সূর্যব্রত-সংগীত’ শীর্ষক সে প্রবন্ধে আরও লিখেছি–

 […] খুব ভোরে সূর্যোদয়ের আগে প্রদীপ প্রজ্জ্বালন করে সেসব হাতে নিয়ে নারীরা দল বেঁধে পার্শ্ববর্তী পুকুর, নদী বা খালে  না করতে যান। এবং স্নান সেরে ভেজা কাপড়ে বাড়ির উঠোনে পূজা উপলক্ষে স্থাপিত অস্থায়ী কৃষ্ণ-মন্দিরে/কৃষ্ণ-ম-পে এসে সেই প্রদীপ এনে রাখেন। প্রদীপটি যেন কোনও অবস্থাতেই নিভে না যায় সেদিকে নজরদারি রাখতে হয়, সম্ভবত সে কারণেই অস্থায়ী মন্দিরটি টিন কিংবা খড়ের বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে রাখা হয়। প্রদীপটি মন্দিরে রেখে নারীরা মন্দিরের সামনের উঠোনে গোল হয়ে নেচে নেচে করতাল বাজিয়ে সূর্যব্রত-সংগীত পরিবেশন করেন।

পূজার রীতি অনুযায়ী যেহেতু সূর্যাস্তের আগে মাটি, খাট কিংবা অন্য কোথাও বসা যাবে না, তাই সারাদিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই অনেকটা ধামাইলগান পরিবেশনার মতোই করতাল ও করতালি-সহযোগে সূর্যব্রত-সংগীত পরিবেশন করেন নারীরা। পরিবেশিত এসব গান আবার বিভিন্ন পর্বে বিভক্ত। […]

কণ্ঠের সাময়িক বিশ্রামের জন্য মাঝে-মাঝে কিছু বিরতি ছাড়া গান পরিবেশনা চলে প্রায় একটানা। এ পর্ব শেষ হয় সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ আগে। সে-সময় নারীরা মন্দিরে রাখা সেই প্রদীপ হাতে নিয়ে সূর্যকে ভক্তি করে ওই দিনের মতো পূজাকার্য সমাপ্তি করে প্রসাদ বিতরণ করে ঘরে ফেরেন। এখানে উল্লেখ্য, যেসব নারী এ পূজায় অংশ নেন, তাঁরা সূর্যাস্তের আগে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতে পারবেন না এবং দিনভর বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে ও গান পরিবেশন করেই কাটাতে হবে বলে বিধান রয়েছে। এ ছাড়া পূজায় অংশগ্রহণকারী নারীরা এদিন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নির্জলা উপবাস থাকেন।

‘এই যে নারীরা সূর্যব্রত গান পরিবেশন করেন, এসব গানের গীতিকার কারা?’–এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলাম চন্দ্রাবতী রায়বর্মণকে। উত্তরে তিনি বলেছিলেন–

অনেক গানের কোনো গীতিকারের নাম জানা যায় না। মা-ঠাকুমা-দিদিমাদের মুখে মুখে গান প্রচলন হয়ে এসেছে। তবে মধুসুদন দাস অনেক সূর্যব্রত গান লিখেছেন। তিনিই মনে হয় এ গানের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রসারকারী। তাঁর বাড়ি কাঠুইর। তাঁর গানই বেশি গাই। বিয়ার গান, ধামাইল গান, কীর্তন গানও তিনি অনেক লিখেছেন। প্রতাপের গানও গাই। তিনিও সূর্যব্রত গান, ধামাইল গান লিখেছেন।

চন্দ্রাবতীর সঙ্গে আলাপের পর খোঁজ নিয়ে জেনেছি, সূর্যব্রতগানের গীতিকারদের মধ্যে সুনামগঞ্জের কাঠইড় গ্রামের মধুসূদন দাস, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার টাইলা গ্রামের প্রতাপরঞ্জন তালুকদার, জগন্নাথপুর উপজেলার কেশবপুর গ্রামের রাধারমণ দত্তপুরকায়স্থ ও মেঘারকান্দি গ্রামের কাশীনাথ দাশতালুকদার; সিলেটের টিলাগড় গোপালটিলা এলাকার সন্ধ্যা রানী চন্দের নাম উল্লেখযোগ্য। এর বাইরে সরোজ প্রভাদেবী, ধর্মদাস, ব্রজনাথ, বসুদেব ঘোষ, কৃষ্ণদাস, নরহরি, স্বরূপ দাস, রাধানাথ, শংকর দাস, দীনহীন, ব্রজমোহন, বৈষ্ণব দাস, কৃষ্ণচরণ দাস, অমূল্য, চৈতন্য চরণ, দুর্গাপ্রসাদ, ঘনশ্যাম দাস, কুসুম কুমারী, দীনবন্ধু দাস, কালীকিংকর, বলরাম দাস, জয়চন্দ্র প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। গানের ভণিতা থেকে এসব গীতিকারদের নাম জানা গেলেও অনেকেরই ব্যক্তিগত পরিচিতি ও ঠিঁকুজি বের করা সম্ভব হয়নি।     

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত