| 20 এপ্রিল 2024
Categories
এই দিনে খেলাধুলা ফুটবল

বিদায় ফুটবলের চে গুয়েভারা

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

ডিয়েগো ম্যারাডোনা শুধু ফুটবলের নন। অন্তহীন বিতর্ক, স্পর্ধা ও অস্বীকারের নাম। শিল্পের মানসমূর্তি, ফুটবলের চে গুয়েভারা!

প্রেমিকার গায়ে হাত তুলে গ্রেফতার হন।বন্দুক হাতে সংবাদিকদের ধাওয়া করেন। নিষিদ্ধ ড্রাগ নিয়ে ফুটবল থেকে নির্বাসিত হন। ফুটবল ইতিহাসে হ্যান্ড অব গড কিংবা গোল অব দ্য সেঞ্চুরি, দুটোরই কারিগর তিনি। কোকেন নিতে নিতে মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসেন। ফুটবলের সম্রাট পেলেকে নিয়েও যা-তা বলেন। মেয়ের দিব্যি দিয়ে মিথ্যা বলতে তার বুক কাঁপে না। বন্ধুর বাড়িতে মাতাল হয়ে নাচতে গিয়ে নিজের ট্রাউজার খুলে ফেলা।

ডিয়েগো ম্যারাডোনা মানে অন্তহীন ফুটবল-প্রেমও।

যিনি প্রায় একা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন আর্জেন্টিনাকে। হ্যান্ড অফ গড গোলের বিতর্ক সত্ত্বেও ৮৬’র মেক্সিকো বিশ্বকাপে তার ফুটবল-প্রেমে পাগল হয়েছিল অনুসারীরা। ইতালির নাপোলিকে আঁস্তাকুড় থেকে তুলে সিরি-আ চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন। নব্বইয়ের বিশ্বকাপেও আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে তুলেছিলেন তিনি। জেতাতে পারেননি। রুডি ফোলারের বিতর্কিত ফাউলে পেনাল্টি পেয়ে ১-০ গোলে জিতেছিল পশ্চিম জার্মানি। খেলেছিলেন ’৯৪ বিশ্বকাপেও। কিন্তু সেই টুর্নামেন্টে এসে এলোমেলো হয়ে যান ম্যারাডোনা। দুটি ম্যাচ খেলার পর ডোপ টেস্টে পজিটিভ হয়ে বলেছিলেন, ‘ওরা আমার পা কেটে নিয়েছে।’

১৫ মাসের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে আবার মাঠে ফিরেছিলেন কিন্তু আগের ম্যারাডোনাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ছোটবেলার ক্লাব বোকা জুনিয়র্সে কিছুদিন খেলে বুটজোড়া তুলে রাখেন। তারপর কোকেনের নেশায় ডুবে থাকতেন। এমন অবস্থা হয়েছিল যে শেষ পর্যন্ত রিহ্যাবে যেতে হয়। বন্ধু ফিদেল কাস্ত্রোর কিউবাতে গিয়ে নেশামুক্ত হন। পরে এক সাক্ষাৎকারে ম্যারাডোনা বলেন, ‘আমি যখন মাদক নিতাম, তখন পিছিয়ে থাকতাম। অথচ ফুটবলার হিসেবে আমার এক পা এগিয়ে থাকার কথা ছিল। অনেকেই অনেক কথা বলতে পারেন। কিন্তু আমি ১৫ বছর আগের ওই অসুস্থ নেশার জীবন কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। তাই এখন কেউ কেউ আমার বিরুদ্ধে মাদক ছেড়ে ডোপিং নিয়ে কথা বলেন। আমাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করান কিন্তু একটা কথা আমি বলতে চাই। আর্জেন্টিনায় অনেকে আছেন, যারা মুখোশ পরে চলেন। সেখানে বড়লোকরাও কোকেনে ডুবে থাকেন।’

ম্যারাডোনা নেশার খপ্পরে পড়েছিলেন ছোটবেলায়। বুয়েন্স আয়ার্সের বস্তিতে তার জন্ম। জায়গাটার নাম ভিলা ফিয়োরিতো। অপরাধের জন্য কুখ্যাত। দারিদ্র্যের জন্যও। ম্যারাডোনার বাবা খুব গরিব ছিলেন। চার মেয়ের পর ডিয়েগো দুনিয়াতে আসেন। পরে আরও দুটি ভাই তার সঙ্গী হয়। সংখ্যার সঙ্গে পারিবারিক দারিদ্র্যও সেই পরিমাণেই বেড়েছিল। ঠিক মতো খেতে পেতেন না। টিনের কৌটা নিয়ে সারা দিন রাস্তায় খেলতেন। তারপর আবর্জনার স্তুপের পাশেই ঘুমিয়ে পড়তেন। রাতে কাজ থেকে ফিরে বাবা ডাকতেন, ‘ডিয়েগো কোথায় আছিস, মাথাটা তোল।’

বুয়েন্স আয়ার্সের বস্তি থেকে আক্ষরিক অর্থেই মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলেন ম্যারাডোনা। ফুটবল তাকে সেই সাহস দিয়েছিল। মাত্র ৮ বছর বয়সে তাকে আবিষ্কার করেন ফ্রান্সিসকো কর্নেজো। জুনিয়র দলের কোচ হিসেবে তিনি তখন সারা দেশ ঘুরে প্রতিভা খুঁজছেন। খুদে ম্যারাডোনাকে প্রথম দেখার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে পরে বলেছিলেন, ‘আর্জেন্টিনা জুনিয়র দলের জন্য ট্রায়াল দিতে এসেছিল ম্যারাডোনা। দক্ষতা দেখে মনে হয়নি এ ছেলের বয়স মাত্র ৮। আমি নিশ্চিত হওয়ার জন্য পরিচয়পত্র দেখতে চাইলাম। সে কিছু দেখাতে পারেনি। তার ছোট্ট গড়ন দেখে অবশ্য মনে হয়েছিল মিথ্যা বলছে না। যদিও সে খেলছিল প্রাপ্তবয়স্কদের মতো। যা দেখে আমরা ওর ভক্ত হয়ে গেলাম।’

সেটা ১৯৬৮ সাল। ৮ বছর পর আর্জেন্টিনা জুনিয়র দলে অভিষেক ম্যারাডোনার। ১৯৭৭-এ জাতীয় দলে পা রাখেন। নিজেদের দেশে ১৯৭৮-র বিশ্বকাপ দলে তাকে নেওয়া নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। বলা হয়ে থাকে বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক ড্যানিয়েলে প্যাসারেলা ও কোচ সেজার মেনোত্তি বয়স কম বলে ম্যারাডোনাকে দলে নেননি। ম্যারাডোনার বিশ্বকাপ অভিষেক ’৮২-তে। ইতালি ও ব্রাজিলের কাছে হেরে বাদ পড়ে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই। ম্যারাডোনা কিছু করতে পারেননি। সব জমিয়ে রেখেছিলেন মেক্সিকোর জন্য। ছিয়াশির বিশ্বকাপেই তিনি ম্যারাডোনা হয়ে ওঠেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখান ‘হ্যান্ড অফ গড’ গোল দিয়ে। এরপর করেন শতাব্দী সেরা গোল। ইংল্যান্ড ছিটকে গিয়েছিল। তার আগে ম্যারাডোনার পায়ের জাদুতে সর্বনাশ হয়েছিল বেলজিয়ামের। ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির সর্বনাশের মূলেও ছিল তার দুটি পা। আত্মজীবনীতে ম্যারাডোনা বিশ্বকাপ জয়ের বর্ণনায় লিখেছিলেন, ‘অতিরিক্ত সময়ে জার্মানির অবসন্ন পা গুলো দেখে ভরসা পেয়ে সেন্টার স্পটে বল বসিয়ে সবাইকে চিৎকার করে বলেছিলাম, জিতব আমরাই। জিততেই হবে, ওরা আর পারছে না। শেষ চেষ্টা আর একবার, অতিরিক্ত সময়ের আগেই শেষ করব। নিজেদের অর্ধেই ছিলাম। মাথা তুলে দেখতে পাই বুরুচাগার সামনে সেই রাস্তা যেখান দিয়ে চলতে চলতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হব। নিরাশ করেনি বুরু। ৬ মিনিট বাকি তখনো। বিলার্দো চেঁচাচ্ছে, ডিয়েগো, ভালদানো, নেমে এসো, মার্ক করো। কোথায় কী। নামছিলাম ঠিকই, কিন্তু জানতাম, আর হবে না। রোমুয়ালদো আরপি ফিলোর বাঁশি, আর্জেন্টিনীয়দের উল্লাস আর আমার কেঁদে ফেলা সব একসঙ্গে।’

গৌরবের সেই কান্না থেকে আর্জেন্টিনার ফুটবল ঈশ্বর হয়ে ওঠেন ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা, মাঠের বাইরেও অনেক নাটক ছিলো ম্যারাডোনাকে ঘিরে। তখনকার বার্সেলোনা ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ‘লুইজ নুনেজের’ সঙ্গে ম্যারাডোনার দ্বন্দ্ব এবং সেই সাথে ড্রাগের সঙ্গে তার সম্পর্ক শুরু হওয়া। ব্যপারটা আরও খারাপ পর্যায়ে চলে যায় যখন তার ছোটবেলার বন্ধু এবং অর্থ উপদেষ্টা, জর্জ সাইটার্স্পাইলার কিছু হিসাবনিকাশ ভুল আন্দাজ করে ফেলেন তিনি। ইতিমধ্যে ম্যারাডোনা অনেক বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন। যখন তখন তিনি তার বন্ধু-পরিবার পরিজনদের ব্যাংকের চেক (cheque) লিখে দিয়ে দিতেন। যার কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই আর্থিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন তিনি। এই ব্যাপারে জর্জ বলেছিলেন, “আর্থিক পরিচালক হিসেবে আমার উচিত ছিল আরও কঠোর হওয়া। কিন্তু একজন বন্ধু হিসেবে, ওর টাকা-পয়সা নিয়ন্ত্রণ করার একটা সীমা ছিল এবং আমি সেটা পার করতে চাইনি। সবশেষে টাকাটা ছিল ওর। ও আমাকে বলত, ‘ওই বাড়ি কিনো, ওই গাড়ি কিনো, ইত্যাদি।’ আমার ওইটা কেনা ছাড়া আর কোন উপায়ই ছিল না। প্রচুর পরিমাণে খরচ করা ম্যারাডোনার জীবনের একটি অংশ ছিল।”

ম্যারাডোনা ও তার বন্ধু, দুজনে মিলে এই আর্থিক সংকট কাটিয়ে উঠার পরিকল্পনা করলেন। তারা চেয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট নুনেজ কে উত্তপ্ত করতে যাতে সে ম্যারাডোনাকে বেচে দেয়। অথচ, নুনেজ ম্যারাডোনাকে বেচার ব্যাপারে ছিলেন একদম অনিচ্ছুক। ম্যারাডোনা একজন তারকা ছিলেন এবং তাকে বেচে দেওয়া মানেই সেইসব সমালোচকদের কথা সাবুদ করা যারা প্রথমে বলেছিল ম্যারাডোনাকে না কিনতে। পরে অবশ্য নুনেজের বিবেচনা পালটে যায় যখন বার্সেলোনা ১-০ গোলে কোপা দেল রে’র ফাইনালে হেরে যায় এবং সেই ম্যাচে ম্যারাডোনাকে ঘিরে দুই পক্ষের খেলোয়াড়দের মধ্যে একটি ভয়ংকর মারামারি হয়। নুনেজের আর কোন পথ ছিলনা ম্যারাডোনাকে বেচে দেওয়া ছাড়া। এই ঘটনা ছিল ম্যারাডোনার বার্সেলোনা ক্যারিয়ারের শেষ অধ্যায়। ইউভেন্টাস ইচ্ছুক ছিল তাকে কেনার, তবে নাপোলিকে আরও বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখেন ম্যারাডোনা এবং সেখানে আর্থিক প্রণোদনাও বেশ ভালই ছিল। নাপোলিতে ট্র্যান্সফার সম্পূর্ণ করার পর, ট্র্যান্সফার ফির ১৫ শতাংশ ম্যারাডোনার পকেটে যায়, তবে তার ঋণ এতোটাই বেশি ছিল যে সে এক পয়সাও দেখেনি। একটি প্রোডাক্ট কতটা মূল্যবান, তার ব্যাপারে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় তার ‘মার্কেট ভ্যালু’ দেখে। ফুটবলারকে যদি প্রোডাক্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে ম্যারাডোনা ঠিক কতটা মূল্যবান ছিলেন, সেটা অনুমান করা সম্ভব না। তবে এরপরও যখন আপনি জানবেন যে, ম্যারাডোনা ফুটবল ইতিহাসের প্রথম খেলোয়াড়, যিনি কিনা দু’বার ট্রান্সফার ফির রেকর্ড গড়েছেন, তখন কিছুটা ধারণা করা হয়তো সম্ভব। ম্যারাডোনার পরে এই রেকর্ড আছে শুধুমাত্র আর একজনের, রোনালদো লিমার।

ম্যারাডোনাকে জানতে ‘ম্যারাডোনা কে ছিলেন?’- এই প্রশ্নটির চেয়ে জরুরি প্রশ্ন হওয়া উচিত, ‘ম্যারাডোনা কী ছিলেন?’

ম্যারাডোনা ছিল একটি বিশ্বাসের নাম। আজকের যুগের সেরা খেলোয়াড় মেসি অথবা রোনালদোকে যদি মালাগায় (স্প্যানিশ লিগের একটা দল) খেলতে দিয়ে বলা হয়, দলকে লিগ চ্যাম্পিয়ন করাতে হবে, তাহলে কি সেটা তাদের জন্য সম্ভব হবে? রিয়াল মাদ্রিদ কিংবা বার্সেলোনাকে টপকিয়ে কাজটা করা মোটামুটি অসম্ভবই বলা যায়। পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে মোটামুটি এ ধরনের অসম্ভব কাজকেই সম্ভব করেছিলেন ম্যারাডোনা।

ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সূত্রে অবিশ্বাস্য এবং অমোচনীয় বিভক্তি। এখানে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা বুঝি না, কোচ ম্যারাডোনাকে চিনি না। চিনি সেই তারুণ্যের ম্যারাডোনাকে, যে কাঁদায়-হাসায় আর জানায়, আমাকে দেখো। আমি তোমাদের জন্য ফুটবলের ভেতরে ভরে স্বর্গের আনন্দ বয়ে নিয়ে এসেছি। এই ম্যারাডোনাকে ভালো না বাসলে পাপ হয়।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত