‘বাঙ্গাল’ দীনেশচন্দ্র সেনের কৃতি ও নীতি
দীনেশচন্দ্র সেনের (১৮৬৬-১৯৩৯) ‘বাঙ্গাল’ পরিচয়টাই বড় হয়ে উঠেছিল উনিশ শতকের পশ্চিমবঙ্গের অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষের দৃষ্টিতেও। এমনকি প্রাতঃস্মরণীয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ‘সাহিত্যসম্রাট’ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো মনীষীর আচরণেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।
দীনেশচন্দ্র নিজেই সখেদে সে বিষয়টির উল্লেখ করেছেন তাঁর আত্মস্মৃতি ‘ঘরের কথা ও যুগসাহিত্য’-এ। ১৮৮৯ সালে ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ পাস করে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া স্কুলে তিনি কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। সে সময়েই তাঁর ইচ্ছা হয়েছিল যে কলকাতায় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মেট্রোপলিটন স্কুলে মাস্টারি করবেন। কিন্তু তাঁর সেই ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি। বিদ্যাসাগর তাঁকে বলেছিলেন, ‘তুই যে বাঙ্গাল…এখানকার ছাত্ররা ভিক্টোরিয়া স্কুলের ছাত্র নয় যে তুই অনার্স পাস শুনিয়া চমকিয়া উঠিবে…তোকে তো এক দিনে পাগল করিয়া ছাড়িবে।’
বঙ্কিমচন্দ্র ও দীনেশচন্দ্রের প্রতি অবজ্ঞার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। বঙ্কিমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দীনেশচন্দ্র সাহিত্য সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও মত বিনিময় করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্কিম তাঁকে সেই সুযোগ দেননি। পূর্ব বাংলার কোথায় কোন কোন শস্য জন্মে, সেখানকার জিনিসপত্রের দরদাম কেমন—এমন সব কথা জিজ্ঞাসাবাদ করেই তিনি দীনেশচন্দ্রকে বিদায় করে দেন, সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনার যোগ্যই মনে করেননি তাঁকে।
স্বভাবতই বাঙ্গাল দীনেশচন্দ্রের অন্তরে এতে ক্ষোভের সঞ্চার ঘটেছিল। সন্দেহ নেই, সেই ক্ষোভের প্রশমনও তিনি ঘটিয়েছিলেন সারস্বত সাধনায় অসাধারণ কৃতি অর্জন করে এবং বাঙ্গালদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে দেশ ও বিদেশের সুধীজনের সম্মুখে তুলে ধরে।
১৮৯৬ সালে দীনেশচন্দ্র সেনের ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থ রচনার সময়ই এ দেশের অনক্ষর জনগণের রচিত গ্রাম্য গাথা-গীতিকার প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। তিনি লক্ষ করেন যে বিশিষ্ট ভাষাতত্ত্ববিদ পণ্ডিত ও ইংরেজ রাজকর্মচারী স্যার জর্জ গ্রিয়ার্সনের হাতেই ‘বাঙ্গাল’দের রচিত গাথা সংগ্রহের সূচনা ঘটে। রংপুরে রাজকার্যে নিযুক্ত থাকার সময় গ্রিয়ার্সন সাহেব সেখানকার কৃষকদের কাছ থেকে একটি গ্রাম্য গাথা সংগ্রহ করেন এবং সেটিই ‘মানিকচন্দ্র রাজার গান’ নাম দিয়ে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে (প্রথম ভাগ ৩ নং) প্রকাশ করেন। সংগতভাবেই আমরা অনুমান করতে পারি যে গ্রিয়ার্সনের এই উদ্যোগের সঙ্গে পরিচিত হয়েই দীনেশচন্দ্র এ দেশের গ্রাম্য গাথা সংগ্রহের তাগিদ অনুভব করেন।
‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ (১৮৯৬) ও ‘বৃহৎ বঙ্গ’ (১৯৩৫)—শুধু এই দুটি গ্রন্থের প্রণেতা হলেও তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকতেন। তাঁর রচিত ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ বাংলা সাহিত্যের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনার ভিত্তি স্থাপন করেছে, আর ‘বৃহৎ বঙ্গ’ বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতির অনেক বিস্মৃত অধ্যায়কে স্মৃতির আলোতে নিয়ে এসেছে।
‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ প্রকাশিত হওয়ার পর পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এটিকে ‘দ্য ডিসকভারি অব আওয়ার লিটারেরি হেরিটেজ’ আখ্যা দিয়েছিলেন। বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ পাঠ করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—
“আমাদের সৌভাগ্যক্রমে দীনেশচন্দ্র বাবুর ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ গ্রন্থের ২য় সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে। এই উপলক্ষে পুস্তকখানি দ্বিতীয়বার পাঠ করিয়া আমরা দ্বিতীয়বার আনন্দ লাভ করিলাম। এই গ্রন্থের প্রথম সংস্করণ যখন বাহির হইয়াছিল তখন দীনেশবাবু আমাদিগকে বিস্মিত করিয়া দিয়াছিলেন। প্রাচীন বঙ্গসাহিত্য বলিয়া এত বড় একটা ব্যাপার যে আছে তাহা আমরা জানিতাম না, তখন সেই অপরিচিতের সহিত পরিচয় স্থাপনেই ব্যস্ত ছিলাম। দ্বিতীয়বার পাঠে গ্রন্থের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিবার সময় ও সুযোগ পাইয়াছি। এবার বাংলার প্রাচীন সাহিত্যকারদের স্বতন্ত্র ও ব্যক্তিগত পরিচয়ে বা তুলনামূলক সমালোচনায় আমাদের মন আকর্ষণ করে নাই, আমরা দীনেশবাবুর গ্রন্থের মধ্যে বাংলাদেশের বিচিত্র শাখা-প্রশাখাসম্পন্ন ইতিহাস বনস্পতির বৃহৎ আভাস দেখিতে পাইতেছি।”
‘বৃহৎ বঙ্গ’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের পুনর্মুদ্রণ করেন কলকাতার দে’জ পাবলিশিংয়ের সুধাংশু শেখর দে। ‘প্রকাশকের নিবেদন’-এ তাঁর বক্তব্য—
“আচার্য দীনেশচন্দ্র সেনের ‘বৃহৎ বঙ্গ’ বঙ্গ সংস্কৃতির মহাকোষ। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত বাঙালির কৃষ্টির এমন সর্বাঙ্গীণ সর্বেক্ষণ আর দ্বিতীয়টি নেই। এ দেশে দীনেশচন্দ্রই প্রথম, যিনি কেবলমাত্র রাজন্যবর্গের বংশপরিচয় ও অভিজাতবর্গের জীবনযাপন অবলম্বন করে ইতিহাস সংকলন করেননি, সাধারণ মানুষের ক্রিয়া-কর্ম-আচার-বিশ্বাস-সংস্কার মিলিয়ে রচনা করে তুলতে চেয়েছিলেন বাঙালিজীবনের এক অখণ্ড চলচ্চিত্র। বঙ্গ সংস্কৃতির প্রাচীন ও মধ্যযুগের চর্চায় এই গ্রন্থ আজও তাই অপরিহার্য।”
এই বক্তব্যের যথার্থতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করা হবে একেবারেই অযথার্থ।
শিকড়সন্ধানী মনীষী দীনেশচন্দ্র শিকড়ের সন্ধান করতে করতেই যেখানে চলে যান, কোনো বাঙালি বিদগ্ধজনই এর আগে সেখানে যাননি, যাওয়ার কথা ভাবেনইনি। সে সম্পর্কে অজ্ঞতাকেই বরং বিজ্ঞতার পরিচায়ক বলে ধরে নিয়ে আত্মপ্রসন্ন হয়ে থেকেছেন। এই আত্মপ্রসন্নতাকে মানসিক প্রতিবন্ধকতা ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না।
দীনেশচন্দ্র তাঁর সারস্বত জীবনের শুরু থেকেই এ রকম মানস প্রতিবন্ধ থেকে মুক্ত ছিলেন। পাশ্চাত্য শিক্ষায় একান্ত কৃতবিদ্য হয়েও তিনি পাশ্চাত্য-মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েননি। সেই শিক্ষা বরং তাঁকে নিজের ঘরের দিকে দৃষ্টি ফেরানোর প্রেরণা দিয়েছে। সেই ঘর বাংলার, বাঙালির। সেই ঘর বৃহৎ বঙ্গে অবস্থিত। ‘বৃহৎ বঙ্গ’ গ্রন্থের ভূমিকায় স্পষ্ট ভাষায় তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, ‘আমি বিশ্বপ্রেমিক নহি, আমি একান্তভাবে প্রাদেশিক; তাহাতে কেহ যদি মনে করেন আমি যুগোপযোগী নহি, আমি ক্রমবর্ধিষ্ণু অগ্রগতিশীল সভ্যতার পশ্চাত্ভাগে কূপমণ্ডূক হইয়া পড়িয়া আছি, তবে সেই অভিযোগের আমি প্রতিবাদ করিব না, আমি তাহাই।’
তবে বৃহৎ বঙ্গের অধিবাসী ‘বাঙালি’ হয়েও তিনি বিশেষভাবে ছিলেন ‘বাঙ্গাল’। তাঁর এই বাঙ্গাল পরিচয়টি তিনি এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে থাকেননি। কলকাতা নগরীকে কেন্দ্র করে উনিশ শতক থেকে বিশ্বের সঙ্গে যোগযুক্ত যে আধুনিক সাহিত্যের সৃষ্টি হয়েছে তাকে তিনি অস্বীকার বা অবমূল্যায়ন করেননি অবশ্যই, তবু তিনি বিশেষভাবে দৃষ্টি দিয়েছেন এবং সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন অনক্ষর গ্রামীণ বাঙ্গাল জনগণের সৃষ্ট সাহিত্যের দিকে। সেই সাহিত্য চিরকালীন আধুনিকতাকে ধারণ করে বহুকাল ধরে প্রবহমান থেকেছে। এখনো, এই একবিংশ শতাব্দীতেও, এর প্রবহমানতায় ছেদ পড়েনি। সেই মৌখিক সাহিত্যকেই তিনি লৈখিক রূপ দিয়ে ও ইংরেজিতে ভাষান্তরিত করে পাশ্চাত্যের বিদগ্ধজনের গোচরে নিয়ে এসেছেন। ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ ও ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’য় গ্রন্থিত গ্রাম্য গাথাগুলোর পরিচয় পেয়ে পাশ্চাত্যের অনেক বিদগ্ধজনই একান্ত অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। এ রকম কয়েকজনের বক্তব্য দীনেশচন্দ্র তাঁর ‘বৃহৎ বঙ্গ’ গ্রন্থের ‘ভূমিকা’ অংশেই স্মরণ করেছেন,
“…ডা. স্টেলা ক্র্যামরিস ‘মহুয়া’ পড়িয়া বলিয়াছিলেন, সমস্ত ভারতীয় সাহিত্যে এই গল্পের জোড়া নাই; ডা. সিলভ্যান লেভি লিখিয়াছেন, ফরাসী দেশের শীতপ্রধান আবহাওয়ার মধ্যে বাস করিয়া এই সকল গল্প পড়িবার সময়ে মনে করিয়াছেন, তিনি চিরবসন্তের রাজ্যে বিহার করিতেছেন, এবং সুপ্রসিদ্ধ শিল্পী রোদেনস্টাইন বলিয়াছেন, অজন্তা ও অমরাবতীর যে সকল অপূর্ব রমণীমূর্ত্তি তিনি দেখিয়াছেন, এই সকল গল্পের নায়িকারা যেন সেই রমণীদেরই জীবন্ত লেখমালা। শ্রীমতী হেগ এই সকল গল্পের যে প্রশংসা করিয়াছেন, তাহা মন্দিরে উচ্চারিত স্তবস্তুতির মতই শোনায়। তিনি ফরাসী দেশের সর্বপ্রধান লেখক মাদাম দি লাফায়েজি (Madame the Lafayette) এবং মেটারলিঙ্কের রচনার খুঁৎ বাহির করিয়া বলিয়াছেন, বাঙ্গলা কথাসাহিত্যের নায়িকারা একেবারে নিখুঁৎ এবং এই গল্পগুলির নায়িকারা শেকসপিয়ার ও রেসাইন-এর নারীচরিত্রের মত য়ুরোপের ঘরে ঘরে পঠিত হওয়ার যোগ্য।”
‘ময়মনসিংহের ইতিহাস’, ‘রামায়ণের সমাজ’, ‘বাঙ্গালা সাময়িক সাহিত্য’ প্রভৃতি গ্রন্থের লেখক কেদারনাথ মজুমদার (১৮৭০-১৯২৬) ময়মনসিংহ থেকে ‘সৌরভ’ নামে একটি উন্নতমানের মাসিক সাহিত্যপত্র প্রকাশ করেন বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে। ‘সৌরভ’-এর প্রথম সংখ্যাটির প্রকাশ ১৩১৯ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে। ১৩২০ সনের ‘সৌরভ’-এ চন্দ্রকুমার দে-র ‘মহিলা কবি চন্দ্রাবতী’ শীর্ষক প্রবন্ধটি পড়ে দীনেশচন্দ্র সেন কেমন মুগ্ধ হয়ে পড়েন ও কিভাবে তিনি চন্দ্রকুমারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন, সেসব কথা বিবৃত করে দীনেশচন্দ্র নিজেই জানিয়েছেন—
“১৯১৩ খৃঃ অব্দে মৈমনসিংহ জেলার ‘সৌরভ’ পত্রিকায় শ্রীযুক্ত চন্দ্রকুমার দে প্রাচীন মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত করেন। গ্রন্থকার চন্দ্রাবতীর কাহিনীর মর্ম্মাংশটি মাত্র দিয়াছিলেন। কিন্তু যেটুকু দিয়াছিলেন, তাহা একেবারে চৈত্র-বৈশাখী বাগানের ফুলের গন্ধে ভরপুর; সেই দিন কেনারামের উপাখ্যানের সারাংশের উপর আমার অনেক চোখের জল পড়িয়াছিল।
এই চন্দ্রকুমার দেকে এবং কেনারামের কবিতাটিই বা আমি কোথায় পাই, এই হইল আমার চিন্তার বিষয়। ‘সৌরভ’ সম্পাদক শ্রীযুক্ত কেদারনাথ মজুমদার আমার পুরাতন বন্ধু। আমি চন্দ্রকুমারের সম্বন্ধে তাঁহাকে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, চন্দ্রকুমার একটি দরিদ্র যুবক, ভাল লেখাপড়া শিখিতে পারেন নাই, কিন্তু নিজের চেষ্টায় বাঙ্গালা লিখিতে শিখিয়াছেন। আরও শুনিলাম, তাঁহার মস্তিষ্ক বিকৃতি হইয়াছে এবং তিনি একেবারে কাজের বাহিরে গিয়াছেন।
এই ছড়াটির কথা চন্দ্রকুমার এমনই মনোজ্ঞ ভাষায় লিখিয়াছিলেন যে, উহাতে আমি তাঁহার পল্লীকবিতার প্রতি উচ্ছ্বসিত ভালবাসার যথেষ্ট পরিচয় পাইয়াছিলাম। আমি মৈমনসিংহের অনেক লোকের নিকটে জিজ্ঞাসা করিলাম, কিন্তু কেহই তথাকার পল্লী গাথার আর কোন সংবাদ দিতে পারিলেন না। কেহ কেহ ইংরাজী শিক্ষার দর্পে উপেক্ষা করিয়া বলিলেন, ‘ছোটলোকেরা, বিশেষত মুসলমানেরা, ঐ সকল মাথামুণ্ডু গাহিয়া যায়, আর শত শত চাষা লাঙ্গলের উপর বাহু ভর করিয়া দাঁড়াইয়া শোনে। ঐ গানগুলির মধ্যে এমন কী থাকিতে পারে যে শিক্ষিত সমাজ তত্প্রতি আকৃষ্ট হইতে পারেন? আপনি এই ছেঁড়া পুথি ঘাঁটা দিন কয়েকের জন্য ছাড়িয়া দিন।’
কিন্তু আমি কোন অজানিত শুভ মুহূর্তের প্রতীক্ষায় রহিলাম। কোন দিন পল্লীদেবতা আমার উপর তাঁহার অনুগ্রহ-হাস্য বিতরণ করিবেন এবং কবে তাঁহার কৃপাকটাক্ষে মৈমনসিংহের এই অনাবিষ্কৃত রত্নখনির সন্ধান পাইব—ইহাই আমার আরাধনার বিষয় হইল।
ইহার দুই বৎসর পরে, হঠাৎ একদিন কেদারবাবুর চিঠি পাইলাম। তিনি লিখিলেন চন্দ্রকুমার অনেকটা ভাল হইয়াছেন এবং শীঘ্র কলিকাতায় আসিয়া আমার সঙ্গে দেখা করিবেন। তাঁহার আরও চিকিৎসার দরকার।”
দীনেশচন্দ্রই চন্দ্রকুমারের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সুস্থ চন্দ্রকুমারকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তিনিই পূর্ববঙ্গের গীতিকা সংগ্রহের কাজে নিযুক্ত করেন। পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলের আরো কয়েকজন সংগ্রাহক এ কাজের সঙ্গে যুক্ত হলেও মূলত চন্দ্রকুমারের হাতেই সর্বাধিকসংখ্যক গীতিকা সংগৃহীত হয়েছিল। বিশেষ করে ১৯২৩ সালে ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ নামে প্রকাশিত দশটি গীতিকার মাধ্যমেই পল্লীসাহিত্যের এই ধারাটি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। দীনেশচন্দ্রের সম্পাদনায়ই ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’সহ পূর্ববঙ্গের গীতিকাগুলো চার খণ্ডে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। এগুলোরই দীনেশচন্দ্র কৃত ইংরেজি অনুবাদ ‘Bengal Ballads’।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সুধীজন-নন্দিত হলেও নন্দগোপাল সেনগুপ্ত ও সুকুমার সেনের মতো কিছু বাঙালি সাহিত্য সমালোচক এই গীতিকাগুলোর প্রামাণিকতা সম্পর্কেই সন্দেহ প্রকাশ করে বসেছেন।
১৯৪০ সালে প্রকাশিত ‘বাংলা সাহিত্যের ভূমিকা’ শীর্ষক পুস্তকে নন্দগোপাল সেনগুপ্ত মৈমনসিংহ গীতিকায় বিধৃত অসাম্প্রদায়িক মানবিকতা ও কাব্যগুণের যথেষ্ট প্রশংসা করে লিখেছেন—
“উপধর্ম-কবলিত প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে দৌলৎ কাজী ও আলাওলের কাব্য দুটি যেমন বিস্ময়কর, তেমনি বা তার চেয়ে বিস্ময়কর মৈমনসিংহ গীতিকা। গীতিকাগুলিও ষোল আনা মানুষের কাহিনী। তার ভেতর দেবতার হস্তক্ষেপ নেই। এমন কি হিন্দু-মুসলমানের বা উঁচু-নীচুর ভেদও মানেননি কবিরা।
তারপর এদের রচনাপদ্ধতি। তাও আশ্চর্য রকম। মঙ্গলকাব্যে হক, বৈষ্ণবকাব্যে হক, সর্বত্র কবিরা পুরানো অলঙ্কারশাস্ত্রের বাঁধা ছক অনুসরণ করেছেন। সেই তিলফুল জিনি নাসা, আর খঞ্জন-গঞ্জন আঁখি ঘুরে ঘুরে আসে নানা কবির হাতে দিয়ে। গীতিকার কবিরা কিন্তু উপমা ও অলঙ্কারের ব্যবহারে আগাগোড়া মৌলিক। তাঁদের ভাষা যেমন সরল, ভঙ্গি তেমনি অনাড়ম্বর। যে কথাটি প্রথম আবেগেই মনে আসে, ঠিক সেই কথাটির প্রয়োগ, যে ছন্দটি যেখানে মানায়, সেটি ঠিক সেখানে নির্বাচন, কবিদের অদ্ভুত কৃতিত্বের নিদর্শন। মঙ্গলকাব্যের কবিরা পয়ার আর ত্রিপদীর চড়াই উত্রাতে গিয়ে মুহুর্মুহু চিৎ হয়ে পড়েছেন, মৈমনসিংহ গীতিকার কবিরা কিন্তু শ্লোকের পর শ্লোক দুনো মিল দিয়ে গেঁথে গেছেন, কোথাও হোঁচট খাবার বা হেঁচড়ে চলার চিহ্ন নেই। বরং স্থানে স্থানে এমন অনেক অংশ আছে, প্রকাশভঙ্গিতে যা আধুনিক কাব্যভাষার খুব কাছাকাছি।”
এ রকম প্রশংসাবাক্যের পরই তাঁর সংশয়সংকুল বক্তব্য—
“এই দুই কারণে সন্দেহ জাগে গীতিকার গল্পগুলি পুরাতন, কিছু কিছু অংশও পুরাতন, কিন্তু তাকে ঘষে-মেজে যথাসম্ভব প্রাচীন সাজে সাজিয়ে একালেই লেখা হয়েছে, একালের ব্যঞ্জনা দিয়ে।…
…সহজ স্বল্পতার গুণেই গীতিকা এত বড় সাহিত্য হতে পেরেছে। জীবনবোধের সার্থকতায় এর প্রত্যেকটি নরনারী যেমন বাস্তব, মনস্তত্ত্বজ্ঞানের পরিপাটিতায় প্রত্যেকটি কাহিনী তেমনি সজীব। এর তুলনা ফরাসি ত্রুবাদুর কাব্যে এবং স্কচ ব্যালাডে আছে।
এখন প্রশ্ন আসে, এ জীবন কাদের? এ দেশের পারিবারিক পরিবেশে স্বাধীন ভালোবাসা কোনো দিন প্রশ্রয় পায়নি, তাই পরকীয়াবাদকে এ দেশে ধর্ম বলে চালাতে হয়েছে। তাই বিদ্যাসুন্দরকেও শেষ পর্যন্ত কালী-মাহাত্ম্য দিয়ে বাঁচাতে হয়েছে। এই দেশে বর্ণাশ্রম-বিরুদ্ধ প্রেম এবং তার জন্যে সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ—এ সত্যই অদ্ভুত। আর এ থেকেই সন্দেহ জাগে গীতিকার প্রাচীনতা নিয়ে।” [বাংলা সাহিত্যের ভূমিকা (কলকাতা-১৩৬৫), পৃষ্ঠা ৪৫-৪৭]
নন্দগোপাল সেনগুপ্ত তাঁর সন্দেহের প্রকাশ ঘটাতে গিয়ে কিছুটা প্যাঁচের আশ্রয় নিয়েছেন, নিন্দা করেছেন নান্দীর মোড়কে ঢেকে। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত ইতিহাসকার ডক্টর সুকুমার সেন একেবারে সোজাসুজিই দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত চার খণ্ড গীতিকার প্রামাণিকতা অস্বীকার করেছেন এবং গীতিকাগুলোর প্রধান সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দে সম্পর্কে আপত্তিকর বক্রোক্তি করে বসেছেন। ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রথম খণ্ড, অপবার্ধ)’-এ তিনি লিখেছেন—
“উত্তরপূর্ব ও পূর্ববঙ্গে লোকমুখবাহিত অল্পবিস্তর খণ্ডিত অনেক গাথা ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ এবং ‘পূর্ববঙ্গগীতিকা’ নামে চারি খণ্ডে দীনেশচন্দ্র সেনের সম্পাদনায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত হইয়া সুপ্রসিদ্ধ হইয়াছে। এগুলি প্রায় সবই চন্দ্রকুমার দে-র সংগ্রহ। চন্দ্রকুমার দে সংগ্রহ করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই, গাথাগুলির ভাষায় ছন্দে কলম চালাইয়া সেগুলিকে ‘ভাল করিয়া সম্পাদন’ করিয়াছিলেন। কিন্তু সে কথা তিনি একবারও বলেন নাই। দীনেশ বাবু চন্দ্রকুমার দে-র কাছে প্রাপ্ত বস্তু সম্পূর্ণরূপে খাঁটি বলিয়া গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং সেইভাবে ছাপাইয়াছিলেন। তবুও মুদ্রিত গাথাগুলিতে স্থানীয় উপভাষার রূপ বজায় রাখিবার চেষ্টা সত্ত্বেও বাঙ্গালা সর্বজনীন সাধু ভাষার এবং কলকাতা অঞ্চলের চলিত কাব্যভাষার ছাপ মুছিয়া যায় নাই। মধ্যে মধ্যে আবার পশ্চিমবঙ্গের উপভাষার (এবং সাধু ভাষার) শব্দগুলিকে পূর্ববঙ্গীয় রূপ দিবার চেষ্টা স্পষ্ট হইয়া দেখা দিয়াছে। ভাষা বিচারে মুদ্রিত গাথাগুলি পুরোপুরি অকৃত্রিম নয়।
কোনো কোনো গাথায় অন্য গল্পের জোড়াতালি দিয়া অথবা অন্য উপায়ে কাহিনীকে পরিবর্ধিত ও পরিবর্তিত করিয়া আধুনিক কালোচিত রোমান্টিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা দেখা যায়। মহুয়া পালাটিতে এই প্রচেষ্টা বেশি স্পষ্ট। মহুয়ার আত্মহত্যা কখনোই মূল কাহিনীতে ছিল না। সন্ন্যাসীর ব্যাপারটি সংকলয়িতার স্বকপোলকল্পিত না হইলে অন্য কাহিনী হইতে গৃহীত হইয়াছে। দুই একটি কবিতা বহু পূর্বে ছাপা হইয়াছিল।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত গীতিকাগুলির মধ্যে যে কয়টি রোমান্টিক রচনা শিক্ষিত পাঠকের সর্বাধিক মনোহরণ করিয়াছে, সেগুলির কোনোটাকে সর্বাংশে অকৃত্রিম বলা যায় না। কোনো একজন গায়কের কাছেও যে পুরা একটি গাথা পাওয়া যায় নাই সে কথা সম্পাদক স্বীকার করিয়াছেন। সুতরাং মুদ্রিত গাথাগুলিকে লোকসাহিত্যের ভেজালহীন নিদর্শন বলিয়া নেওয়া চলে না।” [‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’ (প্রথম খণ্ড, অপরার্ধ) কলকাতা-১৩৬৫, পৃষ্ঠা ৫৮১-৮২]
যে সুকুমার সেনের কাছে বাংলার সারস্বত সমাজের ঋণের শেষ নেই, যাঁর হাত থেকেই আমরা বাংলা সাহিত্যের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস পেয়েছি, বাংলার লোকসাহিত্যের মর্মানুধাবনেও যিনি অসাধারণ কৃতির স্বাক্ষর রেখেছেন, স্মরণীয় যিনি ভাষার ইতিবৃত্ত উদ্ঘাটনে, সেই তিনিই কী করে এ রকম অসংগত বক্তব্য প্রকাশ করতে পারেন?
পারেন এ কারণে যে অসাধারণ গুণের অধিকারী হয়েও এই মানুষটি সারা জীবনই ‘বাঙ্গাল-বিদ্বেষ’-রূপ মানস প্রতিবন্ধে আক্রান্ত ছিলেন, বাঙ্গালদের কোনো গুণ বা কৃতিই তাঁর চোখে পড়ত না। এ রকম মানস প্রতিবন্ধের দরুনই তিনি ‘বাঙ্গাল মনীষী’ কেদারনাথ মজুমদারের কৃতির প্রতিও অবজ্ঞা ও উপেক্ষা প্রকাশ করেছেন। অথচ এই কেদারনাথ মজুমদারই তৎকালীন পূর্ব বাংলার জেলা শহর ময়মনসিংহে বসবাস করে সাহিত্য-পত্রিকা সম্পাদনায় ও সাহিত্যের ইতিহাসের উপকরণ সন্ধানে অনন্য কৃতির পরিচয় রেখেছিলেন।
এহেন বাঙ্গালবিদ্বেষী সুকুমার সেনের কন্যার বিয়ে হচ্ছে এক ‘বাঙ্গাল’ অধ্যাপকের সঙ্গে—এ খবর শুনে তাঁর শিক্ষক আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় উচ্চ হাস্য সহকারে বলে উঠেছিলেন, ‘একেই বলে প্রকৃতির প্রতিশোধ’।
যা-ই হোক, পশ্চিমবঙ্গের সব সাহিত্য সমালোচকই বাঙ্গালবিদ্বেষান্ধ ছিলেন না। চন্দ্রকুমারের আবিষ্কৃত গীতিকাগুলো যে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের একটি বৃহৎ শূন্যস্থান পূরণ করেছে, অনেক সুধী সমালোচকের বিশ্লেষণে এ বিষয়টি উঠে এসেছে। ডক্টর শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় খুব সংগতভাবেই গীতিকাগুলোর মধ্যে বাংলার ‘উপন্যাস সাহিত্যের পূর্ব সূচনা’ অবলোকন করেছেন। তিনি লিখেছেন—
“…(মৈমনসিংহ গীতিকার) আবিষ্কার আমাদের সাহিত্যিক ক্রমবিবর্তনের একটি লুপ্ত অধ্যায় পুনরুদ্ধার করিয়াছে। কৃত্তিবাস-কাশিদাস-মুকুন্দরামের যুগ ও ভারতচন্দ্রের যুগের মধ্যে যে একটি বৃহৎ ব্যবধান অনুভূত হয়, মৈমনসিংহ গীতিকা তাহা পূরণ করিয়াছে। বাস্তব রসপ্রধানতার দিক দিয়া মুকুন্দরামের নিঃসঙ্গ বৈশিষ্ট্য বিষয়ে আমাদের যে ধারণা, তাহা এই সমস্ত রচনার দ্বারা খণ্ডিত ও বিশেষভাবে পরিবর্তিত হইয়াছে। ধর্মগ্রন্থ প্রণয়নের ফাঁকে ফাঁকে মুকুন্দরাম যে বাস্তব রসধারা সঞ্চারিত করিয়াছেন, তাহাতে তিনি একেবারে একাকী নহেন, পরন্তু তিনি একটা নতুন সাহিত্যের ধারা প্রবর্তিত করেন এবং এই বাস্তবতা সৃষ্টিতে তাঁহার অনেক সহকর্মী ও অনুচর ছিল—এই তথ্য এই সমস্ত আখ্যায়িকার দ্বারা প্রমাণিত হইয়াছে। আমাদের শূন্যপ্রায় সাহিত্যিক মানচিত্রে ইহাদের দ্বারা অনেক নতুন নগর-গ্রামের অবস্থিতি চিহ্নিত হইয়াছে।
সুতরাং ইতিহাস সংগঠনের দিক দিয়া ইহাদের মূল্য সামান্য নহে। ইহারা মুকুন্দরাম ভারতচন্দ্রের ব্যবধানের উপর সংযোগ সেতু নির্মাণ করিয়াছে, মুকুন্দরামের একটা বৃহৎ জ্ঞাতি-গোষ্ঠী-পরিবারের সন্ধান দিয়াছে ও ভারতচন্দ্রের কৃত্রিম কারুকার্যপূর্ণ, তীব্রদ্যুতি ঝলসিত রাজপ্রাসাদের ভিত্তিমূলে যে বাস্তব জীবনের মৃত্তিকাস্তর বিদ্যমান তাহা উদ্ঘাটিত করিয়া দেখাইয়াছে। আবার রূপকথার সহিতও ইহাদের একটা নিকট আত্মীয়তা আশ্চর্যরূপে প্রতিভাত হইয়াছে।” [‘বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা’ (কলকাতা ১৩৬৯) পৃষ্ঠা ১৩]
শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের আলোচনায় গীতিকাগুলোর প্রামাণিকতা সম্পর্কে সংশয় পোষণকারীদের সম্পর্কে কোনো কথা উঠে আসেনি। প্রামাণিকতা স্বীকার করে নিয়েই তিনি গীতিকাগুলোর সাহিত্যিক মূল্যায়নে ব্রতী হয়েছেন।
তবে সুকুমার সেনের মতো পশ্চিমবঙ্গবাসী সুধীজনই নন শুধু, ‘বাঙ্গালদের’ ভেতর থেকে উঠে আসা আমাদের প্রাণের কবি জসীমউদ্দীনও যখন তাঁর ‘যাদের দেখেছি’ শীর্ষক স্মৃতিকথামূলক বইয়ে মৈমনসিংহ গীতিকার প্রামাণিকতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে বসেন, তখন আমরা একান্তই দুঃখভারাক্রান্ত না হয়ে পারি না। এ বিষয়ে ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন—
“বহু পূর্বে জসীমুদ্দিন এই পালাগানের প্রামাণিকতা সম্বন্ধে সন্দিহান হইলেও বিশেষ কোন গূঢ় কারণবশতঃ পালাগুলির প্রতি তাঁহার বিশ্বাস আবার ফিরিয়া আসে। কারণ তিনি ময়মনসিংহের গ্রামাঞ্চলে সেই সমস্ত গান শুনিয়া নাকি কাঁদিয়া বুক ভাসাইয়া দিয়াছিলেন। দীনেশচন্দ্রকে সেই মর্মেই তিনি চিঠি লিখিয়াছিলেন। কিন্তু কিছুকাল পূর্বে প্রকাশিত ‘যাদের দেখেছি’ গ্রন্থে তিনি আবার পুরাতন অভিযোগ জিয়াইয়া তুলিয়াছেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলোচনাতেও জসীমুদ্দিন সেই একই সন্দেহ প্রকাশ করিয়াছিলেন। উক্ত পালাগান প্রকাশিত হইবার পর তিনি ময়মনসিংহের নানা স্থানে ঘুরিয়াও ঐ পালাগান বা চন্দ্রকুমার উল্লিখিত কোন পালাগানের সন্ধান পাইলেন না। অবশ্য ঐ ধরনের পালাগান তখনও গ্রামাঞ্চলে চলিত বটে, কিন্তু তাহার ভাবধারা সম্পূর্ণ অন্য প্রকার—গ্রাম্য কবি ও শ্রোতার উপযুক্ত। তখন জসীমুদ্দিন সাহেবের ধারণা হইল, চন্দ্রকুমার দে পল্লীগীতিকাগুলি সংগ্রহ করিয়া গ্রাম্য কাঠামোর উপর নিজেই মেদমাংস সংযোজন করিয়া দীনেশচন্দ্রের নিকট উপস্থিত করেন। তাঁহার মতে চন্দ্রকুমার গ্রাম্য গাথার কিছু কিছু লইয়া নিজ ভাবভাষা দিয়া পালাগুলিকে সুসজ্জিত করিয়াছিলেন।” [ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়—‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (তৃতীয় খণ্ড)’, পৃষ্ঠা ১২৮২]
সুকুমার সেন থেকে জসীমউদ্দীন পর্যন্ত অনেক বাঙালি সুধী ব্যক্তিই মানস প্রতিবন্ধে আক্রান্ত হয়ে পড়লেও, একজন বিদেশি মনীষী কিন্তু একান্ত স্বচ্ছ ও বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে মৈমনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকায় গ্রথিত পালাগানগুলোর অকৃত্রিমতা সম্পর্কে নিঃসংশয় প্রমাণ উপস্থিত করেছিলেন। এই মনীষী চেকোস্লোভাকিয়ার দুশন জবাভিতেল। বিশ শতকের ষাটের দশকে কবি জসীমউদ্দীনকে সঙ্গে নিয়েই তিনি ময়মনসিংহের গ্রামাঞ্চলে অনেক ঘুরেছিলেন। সেসব স্থানের কোথাও তাঁরা চন্দ্রকুমার সংগৃহীত পালাগানগুলোর কিংবা চন্দ্রকুমার নির্দেশিত কোনো পালা-গায়কের সন্ধান না-পেয়েও দুশন কিন্তু হতাশ বা বিভ্রান্ত হননি। কারণ তিনি জানতেন যে চন্দ্রকুমারের সংগ্রহের ৩০-৪০ বছর পর কোনো গায়েনেরই জীবিত থাকা সম্ভব ছিল না এবং গায়েনদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই, স্বাভাবিকভাবেই, দীর্ঘ ছন্দোবদ্ধ গাথাগুলোও বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। আর ডক্টর সুকুমার সেনের মতো যাঁরা ভাষার প্রশ্ন তুলে মৈমনসিংহ গীতিকার প্রামাণিকতাকে নস্যাৎ করতে চেয়েছিলেন, সে সম্পর্কে দুশন জবাভিতেলের একান্ত সংগত বক্তব্য হলো—
‘Folk songs can hardly be use as reliable materials for dialoctological purposes’,
আর তাঁর দ্ব্যর্থহীন সিদ্ধান্ত—
Prof. S. Sen and others who share his objections on linguistic grounds are quite right in offerning that the language of the Mymensingh ballads does not represent a pure unmixed dialect of the district in question; but to suspect for this reason, the authenticity of the ballads sums to be unreasonable.
দুশন জবাভিতেল তাঁর সিদ্ধান্তগুলো বিবৃত করে ১৯৬৩ সালে প্রকাশ করেন Bengali folk-ballads from Mymensingh গ্রন্থটি। গ্রন্থটির উপক্রমণিকায়ই চন্দ্রকুমার দে সম্পর্কে তিনি লেখেন—
…however great the merits of the editor D. C. Sen, it is necessary to mention, with deep respect and admiration, the name of Chandra Kumar De, who is the real discoverer of this forgotten and neglected branch of Bengali literature…it was he who resened these songs, literally at the last minute from the thral of oblivion, let us hope that his merits will be acknowledged by his own countrymen, too, which so far has not been done.
আর গ্রন্থের উপসংহারে তাঁর বক্তব্য—
Though, due to various economic, political and cultural reasons, the Mymensingh ballads seem to have died out in the form in which thy are preserved D. C. Sen’s edition, their function has been taken over by the popular prints called the puthi, on the one hand, and by recitals of the ‘long songs’ (lamba git), on the other, but the letter have never reached the same artistic level as that of the ballads.
চন্দ্রকুমার ও দীনেশ চন্দ্রের অবদানের যথাযথ স্বরূপ নির্ধারণের জন্য এই বিদেশি মনীষীর প্রতি আমাদের চিরকৃতজ্ঞ থাকতে হবে।
এই সূত্র ধরেই দীনেশচন্দ্র সেনের আরো কিছু কৃতির কথা সানন্দে স্মর্তব্য। কোনোরূপ প্রতিবন্ধকতাই যে ‘বাঙ্গাল’ দীনেশচন্দ্রকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি কিংবা তাঁর কৃতিকে ম্লান করে দিতে পারেনি, তা দেখেও আমরা আনন্দিত না হয়ে পারি না। যে দীনেশচন্দ্র ‘বাঙ্গাল’ হওয়ার দরুনই মেট্রোপলিটন স্কুলের মাস্টার হতে পারেননি, সেই দীনেশচন্দ্রই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার সঙ্গে সংযুক্ত হলেন। বর্তমানে যা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’ বিভাগ রূপে পরিচিত, সেটিরই পূর্ব রূপ ‘ভারতীয় দেশজ ভাষা বিভাগ’। সেই বিভাগের সঙ্গে দীনেশচন্দ্রের সংযুক্তির বিষয়টি বিবৃত করে ডক্টর শশীভূষণ দাশগুপ্ত লিখেছেন—
“১৯২০ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ‘ভারতীয় দেশজ ভাষা বিভাগটি স্থাপন করা হয়। ইহার বহু পূর্ব হইতেও প্রস্তুতি চলিতেছিল এবং এই প্রস্তুতির কেন্দ্রে ছিলেন প্রাতঃস্মরণীয় দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া স্কুলে প্রধান শিক্ষক থাকিবার সময়ই তিনি তাঁহার ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ প্রকাশের দ্বারা বাঙলা সাহিত্যের বহুমূল্য সম্পদ সম্বন্ধে শিক্ষিত বাঙালীর সশ্রদ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। তিনি কলিকাতায় আসিয়া আশুতোষের উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ‘রামতনু লাহিড়ী নিধি’ স্থাপিত হয় তাহা হইতে দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়কে বাঙলা-সাহিত্যে গবেষণার জন্য প্রাচীন ও মধ্যযুগের সুপ্রসিদ্ধ বাঙলা গ্রন্থগুলি সম্পাদনা করিয়া প্রকাশিত করিবার জন্য ১৯১৩ সাল হইতে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত ‘রামতনু লাহিড়ী রিসার্চ ফেলো’ নিযুক্ত করা হইয়াছিল। ১৯২০ সালে ‘ভারতীয় দেশজ ভাষা বিভাগ’ স্থাপিত হইলে এই ‘রামতনু লাহিড়ী রিসার্চ ফেলো’ রূপেই কিছু বর্ধিত বেতনে দীনেশচন্দ্র বিভাগীয় অধ্যাপক রূপে কাজ করিয়া যান।” [‘আনন্দ সঙ্গী’ (কলকাতা ২০১৩) পৃষ্ঠা ২১৫]
বাঙ্গাল দীনেশচন্দ্রের উত্তরসূরিদের হাতে বাঙ্গালদের কৃতির যে অচিন্তিতপূর্ব সম্প্রসারণ ঘটেছে ও ঘটছে, এ কথা কে অস্বীকার করতে পারবে? বাঙ্গালরাই তো বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটিয়েছে। এই বাংলাদেশ রাষ্ট্রই তো ভবিষ্যতের সব বাঙালির জন্য অসাধারণ সব সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পঁয়তাল্লিশ বছর পর, ২০১৬ সালে, পালিত হলো দীনেশচন্দ্র সেনের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী। দীনেশচন্দ্রের কৃতির সদর্থক উত্তরাধিকার বহনের দায় আমাদের গ্রহণ করতেই হবে।
লেখক পরিচিতি
যতীন সরকার (জন্মঃ ১৮ আগস্ট ১৯৩৬), যিনি অধ্যাপক যতীন সরকার নামেই সমধিক পরিচিত, বাংলাদেশের একজন প্রগতিবাদী চিন্তাবিদ ও লেখক। আজীবন তিনি ময়মনসিংহে থেকেছেন এবং প্রধানত নাসিরাবাদ কলেজে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন।তার রচিত গ্রন্থসমূহ তার গভীর মননশীলতা ও মুক্তচিন্তার স্বাক্ষর বহন করে। ১৯৬০-এর দশক থেকে তিনি ময়মনসিংহ শহরের সকল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি অসাধারণ বাগ্মীতার জন্য জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে তাকে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার প্রদান করা হয়।
