Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

পদ্মগুলঞ্চ

Reading Time: 2 minutes



দক্ষিণ শহরের দক্ষিণে ছিল নদী। অবহেলায় নদীর জল স্বচ্ছ থেকে হল ঘোলা, তারপর হল গাঢ় বাদামী। আর যেদিন নদীর উপরিভাগ একটা অদ্রাব্য কলুষের স্তরে ঢাকা পড়ল, ঘন পুরু আলকাতরার মত স্তরের স্থানু জড়ত্বে সমস্ত জাহাজের গতি হল শ্লথ, সেদিন যাত্রীরা তাদের লঞ্চে উঠতে গিয়ে কী ভেবে যেন থেমে গেল, সারেং জলযান চালানোর যৌক্তিকতা বোঝার চেষ্টা করল। নদীবক্ষ থেকে বিবমিষা-সঞ্চারক গন্ধ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দূষণকণার সঙ্গে মিশে এক অন্ধকার ধোঁয়াশার রূপে ঢেকে দিল দক্ষিণ শহর। তখন সন্ধ্যা হচ্ছিল। দোকানিরা দোকানের ঝাঁপ ফেলে দিল, কিন্তু বাড়ি ফিরল না, দোকানের অন্ধকারে বসে রইল। কৃষ্ণকালো ধোঁয়াশায় নিমজ্জিত হয়ে দক্ষিণের অধিবাসীদের মনে নানা প্রশ্ন জাগল- আমাদের সন্তানরাই কী আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য, মৃত্যুই কি শেষ সীমান্ত? এ সব প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে তারা মুখে খাবার তোলার, স্নান করার, প্রেম করার ইচ্ছে হারাল। অলঙ্কারপাড়ার স্বর্ণকার একটা আংটির ভেতরের পিঠে একটা নাম খোদাই করছিল, নামটা শুরু হয়েছিল দিয়ে, কিন্তু র নিচে ু’ টা পুরো আর সে লিখে উঠতে পারল না। তার সূক্ষ্ণ যন্ত্রের দিকে তাকিয়ে সে ভাবল, আমার শ্রমের মূল্য কী? তাঁতিবাজারের তাঁতিরা কাপড়ের জটিল বুনট সৃষ্টি করতে গিয়ে আত্মহত্যার কথা ভাবল, কিন্তু আত্মহত্যাকে কার্যকরী করার মত ইচ্ছাশক্তি তাদের ছিল না।  

এমন একটা দিন আসবে শহরের উত্তর অংশ আগেই জানত, তাদের অধিবাসীরা ভাড়া-করা শ্রমিক দিয়ে উত্তর-দক্ষিণ সীমান্তে দেয়াল তুলে দিল যাতে দক্ষিণের বিকট ধোঁয়াশা উত্তরে ঢুকতে না পারে, যাতে সেই ধোঁয়াশা তাদের জীবন সংশয়ান্বিত না করে। ধীরে ধীরে দুর্ভেদ্য জঙ্গলে ঢেকে গেল দক্ষিণ, পাকানো পদ্মগুলঞ্চ লতা দক্ষিণ থেকে উঠে দেয়ালের উত্তর দিকে ঝুলতে থাকল। উত্তরের মানুষেরা সেই লতাকে ছেঁটে মনোহারী করল, দেয়ালের পাশে খোলা চত্বরে রকমারি দোকান আর রেস্তোঁরা বসাল। এরকম একদিন, পঞ্চাশ বছর পরে, এক বর্ষীয়ান দম্পতি শীতের অপরাহ্নের মৃদু আলোয় সেখানে কফি খাচ্ছিল। নারীটি দেখল দেয়ালের গা ঘেঁষে একটা পদ্মগুলঞ্চের শাখায় কী যেন চকচক করছে। সে উঠে গিয়ে শাখায় আটকানো জিনিসটি হাতে নিয়ে দেখল। একটা মলিন আংটি, সে আংটির ভেতরে সু লেখা, কিন্তু ু’ টা পুরোপুরি শেষ হয় নি। এই আংটিটি সে পঞ্চাশ বছর আগে দক্ষিণের স্যাকরা পাড়ায় এক তরুণ স্বর্ণকারকে বানাতে দিয়েছিল, সেই কারিগরের চেহারা ভেসে উঠল তার মনে। পদ্মগুলঞ্চের শাখার পাশে সে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ, দূর থেকে দেখে তার স্বামীকে। সু আদ্যাক্ষরের নারী ফিরে যায় না তার টেবিলে, দেয়াল ছেড়ে সে হাঁটতে থাকে উত্তরে।

সূর্য যখন ডুবছিল তার পড়ন্ত আলোয় একজন আবিষ্কার করল পদ্মগুলঞ্চের শাখায় আয়নার একটা ভাঙা অংশ, আয়না ও তার পেছনের শক্ত কার্ডবোর্ডের মধ্যে ছিল হাতে লেখা একটি কবিতার অংশ। পঞ্চাশ বছর আগে দক্ষিণের এক প্রেমিকাকে ঐ কবিতাটি সে লিখে দিয়েছিল। সেই কবির আর বাড়ি ফেরা হল না। তরুণরা, যাদের কাছে দক্ষিণের কোনো স্মৃতিই ছিল না, তারা পদ্মগুলঞ্চের শাখায় খুঁজে পেল পুরোনো গানের রেকর্ড, ভুলে যাওয়া বইয়ের ছেঁড়া পাতা, প্রাচীন ক্যামেরার অবশেষ। এসব জিনিস তাদের মনে এক বিশাল শ্বেতপ্রাসাদের শূন্য অভ্যন্তরের প্রতিধ্বনিত বিধুর আকুলতা সৃষ্টি করল। সেই আকুলতা তাদের স্বস্তি দিল না। এক আবিষ্ট বিহ্বলতায়, রাতের অবরোহী অন্ধকারে, তারা হাঁটতে থাকল। অতলের বিস্মরণকে মুছে দিয়ে পদ্মগুলঞ্চ অধিকার করে নিল শহরের উত্তর।

     

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>