| 24 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

গল্প: মেইনের বিষণ্ন ঋতুগুলি  । দীপেন ভট্টাচার্য

আনুমানিক পঠনকাল: 19 মিনিট

১.

এখানে তুষার পড়ার সময় পৃথিবীর তলকে আকাশ থেকে আলাদা করা যায় না। একটা শুভ্রতাপায়ের নিচ থেকে ছড়িয়ে যায়, জমাট বরফের হ্রদ পেরিয়ে দিগন্তের পত্রহীন ম্যাপেল আর বার্চবনে, তারপর গাছগুলো ছাড়িয়ে উঠে যায় আকাশে। কোথায় সেই সাদা রঙ পৃথিবী ছাড়িয়ে আকাশে ওঠে তা কারুর চোখেপড়ে না।মেইন রাজ্যের শীতের কথা আমার এইভাবেই মনে পড়ে। কত বছর হয়ে গেল!

আপনারা যাঁরা মেইনকে চেনেন না তাঁদের বলি – এই স্টেটটি রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একেবারে উত্তর-পূবে অতলান্তিক মহাসমুদ্রের পশ্চিম কোলঘেঁষে। এর উত্তরেই কানাডা। যুক্তরাষ্ট্রের এই অঞ্চলের মেইনসহ কয়েকটি স্টেটকে একসাথে বলে নিউ ইংল্যান্ড। এই তথ্যগুলো যে আপনার জন্য খুব জানা প্রয়োজন এমন নয়, তবু আপনি যদি কল্পনা করে নিতে পারেন মেইনের পূর্ব তীরের বিশাল খাড়া পাথরের ঢালের ওপর অশান্ত সমুদ্রের ঢেউয়ের আঘাত, হেমন্তে ধীর গতির কুয়াশায় উঁচু নিচু পাহাড়ের ওক, ম্যাপল আর এল্ম গাছের রঙীন পাতার ঢেকে যাওয়া, কিংবা শীতের তুষারের কথা প্রথমেই যা বললাম ­– এসব যদি কল্পনা করে নিতে পারেন তাহলে এই গল্পটির বহু অনুভূতি আপনি সহজেই আত্মস্থ করতে পারবেন। গল্পটি আপনারই হবে।

আমি যে শহরটিতে থাকতাম তার নাম মিলিনকেট, মানচিত্রে আপনারা সহজেই এই ছোট শহরটিকে খুঁজে নিতে পারেন। শহরটিকে ঘিরে রয়েছে কয়েকটি শীতল হ্রদ, ঘন পর্ণমোচী ও চির হরিতের বন, উত্তরে উঁচু গ্রানাইটের পাহাড়। একসময়ে কাঠআর কাগজের শিল্পে ছিল রমরমা, কিন্তু এখন যে ঠিক কীভাবে চলে তা বলতে পারব না। হয়তো কিছুটা পর্যটকদের দাক্ষিণ্যে, হয়তো কিছুটা নিতান্ত বাঁচার তাগিদে। আমি তখন কাজ করতাম শহরের ওয়াল মার্টের ভেতর একটা ফার্মাসিতে। যে দেশ ছেড়ে এসেছি সেখানে প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার ছিলাম, এখানে এসে জীবন যুদ্ধে নতুন করে সনদ অর্জনের পরীক্ষাগুলি আর দেয়া হয়ে উঠল না, তবু হাল না ছেড়ে, ফার্মাসির যাবতীয় শর্ত পূরণ করে, নানা ঘাটের জল খেয়ে মিলিনকেটে এসে ঠাঁই পেলাম।

নিরিবিলি শহরটার আরো নিরিবিলি একটা রাস্তার দুটি ছোট কক্ষ আর এক চিলতে রান্নাঘর নিয়ে ছিল আমার এক তলার বাড়িটি। আমার জীবনকে সরল থেকে সরলতর করার বাসনায় বাড়িটি ছিল ন্যূনতম আসবাবপত্রে সজ্জিত, জীবনযাত্রাও ছিল সেই পরিমাণ রৈখিক – বাড়ি থেকে ফার্মেসি, ফার্মেসি থেকে দোকান, দোকান থেকে বাড়ি। ছুটির দিনে উত্তরে পাহাড়ে, অথবা বাড়ির সামনের রাস্তাটা যেদিকে শেষ হয়েছে সেখানে যে হ্রদটা আছে তার চারদিকে হাঁটা। সরলীকরণ পদ্ধতিতে মানুষের সঙ্গ বর্জিত হয়েছিল, বন্ধুত্ব খুব কম মানুষের সাথেই হল।

আমার বাড়িটির উল্টোদিকে থাকত ডেভিড। আশির কাছাকাছি ছিল ডেভিডের বয়স, তার সাত কূলে কেউ ছিলনা, অথবা থাকলেও তারা খোঁজ নিত না। শহরকর্তৃপক্ষ ও বেসরকারি এক সাহায্য সংস্থা তাকে খাবার পৌঁছে দিত। সেই ডেভিড আমিশহরে আসার মাস ছয়েকের মধ্যে মারা গেল। এক সমাজকর্মী দিনে একবার আসত, সেই ডেভিডকে বসার ঘরে সোফায় মৃত অবস্থায় আবিষ্কার করেছিল, সামনে টেলিভিশন চলছিল।শহর থেকে তার সৎকারের ব্যবস্থা হল, কিন্তু শেষকৃত্য কোনো অনুষ্ঠান হল না, অনুষ্ঠান করার জন্য কাউকে পাওয়া গেল না। ডেভিডের বাড়িটি শহর কর্তৃপক্ষ অধিগ্রহণ করল।

ডেভিড বেঁচে থাকতে তার সম্বন্ধে তত ভাবি নি, তার চলে যাবার পরে তাকে নিয়ে ভেবেছি অনেক। মানুষের জীবনের অর্থ কী? মরে যাবার পরে তোমাকে কেউ মনে না রাখলেও কি তোমার কিছু এসে যাবে? তুমি তো নেই। কিন্তু যারা বেঁচে থাকে তাদের জন্য একটা শূন্যস্থান সৃষ্টি হয়। ডেভিডের অবর্তমানে তার বাড়িটা যেন এক ধরণের শূন্যতা পেল।সকালে বা দুপুরে কাজে যাবার সময় চোখ সেদিকে চলে যেত – দোতলা ছিমছাম নিউ ইংল্যান্ড ধাঁচের বাড়ি, ধীরেধীরে অযত্নে ভঙ্গুর হচ্ছে। তবে সময় বড় ধন্বন্তরী, মস্তিষ্কের নিউরনেরা নিজেদের পুনর্বিন্যাস করতে থাকে, শূন্যতার গহ্বর চলমান ঘটনায় পূর্ণ হতে থাকে। এরকম ভাবে মাস ছয়েক যাবার পরে একদিন এক শীতের সকালে কাজে যাব বলে তৈরি হচ্ছি – চোখে পড়ল ডেভিডের বাড়ির চিমনি থেকে ধোঁয়া উঠছে। বেরোনোর সময় দেখি সেই বাড়িটির ড্রাইভওয়েতে একটি লাল রঙের পিক-আপ ট্রাক পার্ক করা। নতুন প্রতিবেশী এসেছে, বাড়িটিকি শহর তাকে বিক্রি করেছে?

সেদিন রাতে কাজ শেষে ফার্মেসি থেকে বেরিয়ে দেখি তুষার পড়ছে, পেঁজা হালকা তুষার, বছরের দ্বিতীয় তুষারপাত। রাতের আকাশ আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ছিল। রাস্তায় তখনও বরফে পিছল হয়নি, বাড়ি ফিরে গাড়ি পার্ক করার সময় দেখলাম ডেভিডের বাড়ি অন্ধকার, কিন্তু বাইরে লাল গাড়িটি রয়েছে। ঘুমিয়ে পড়েছে কি আমার নতুন প্রতিবেশী! রাতের খাবার খেয়ে জানালার ধারে বসি, রাস্তার একটা বাতি আলোকিত করে পৃথিবীর বুকে হাল্কা তুষারের পতন, আলোকিত করে আমার বাড়ির ড্রাইভওয়ের ওপর ক্রমশ বর্ধমান তুষারের ঢিপি।তুষারের চলনকে বিষণ্ণ করে আমার কম্প্যুটারে চলে ফ্রেদেরিখ শোপাঁর নকটার্ন নামের বাজনাটির পিয়ানো।সোফার ওপরই ঘুমিয়ে পড়ি।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙে বেলচার শব্দে।খোলা জানালা দিয়ে দেখি এক দীর্ঘাঙ্গকৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ আমার ড্রাইভওয়ের তুষার পরিষ্কার করছে।দরজা খুলে বের হলে আমাকে দেখে তার মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, বলে, “সুপ্রভাত, প্রতিবেশী!” তার মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা, গালে ও চিবুকে হাল্কা দাড়ির আবরণ, জ্বলজ্বলে চোখে সারা পৃথিবীকে আপন করে নেবার আহ্বান।পাল্টা ‘সুপ্রভাত’ বলি, কিন্তু সকালের তার এই অনাহুত কিন্তু দরকারি কার্যক্রমকে কী ভাষায় তাকে বলা যাবে তা বুঝতে পারি না।কয়েক সেকেন্ড নিরাবতার পরে বলি, “ওহ, আপনি আমার ড্রাইভওয়ে পরিষ্কার করছেন!” এটি বলে অপ্রস্তুত হই।আমার হয়তো কোনো চালাক মন্তব্য করা উচিত ছিল।

সে বেলচাদিয়ে একগাদা তুষার রাস্তার পাশে ডাঁই করে, তারপর বেলচাটা নামিয়ে দস্তানা খুলেআমার দিকে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দেয়।বলে, “আমার নাম অ্যাব্রাহাম, আপনার নতুন প্রতিবেশী।” আমি তার করমর্দন করি, আমার নাম বলি। সে ডান হাত তুলে স্তূপীকৃত তুষার স্তুপের দিকে ইঙ্গিত করে বলে, “এটা নিয়ে চিন্তা করবেন না, আমার আজ কোনো কাজ নেই, ভাবলাম আপনার ড্রাইভ ওয়ে থেকে তুষার সরিয়ে দিই। লক্ষ করেছি আপনি বেশ সকাল সকাল কাজে যান।” এই বলে আমার প্রতিবেশী অ্যাব্রাহাম হাসে, উদার বিশ্বজয়ী হাসি, অথবা বিশ্বকে আপন করার হাসি।

আমি বলি, “আপনাকে এই পাড়ায় সুস্বাগতম!” কিন্তু সেই আগমনী সম্বোধনে যথেষ্ট জোর থাকে না।

অ্যাব্রাহাম মনে হল আমার বাকবিমূঢ়তাটা উপভোগ করে, বলে, “আমি নিউ ইয়র্কথেকে আসছি, শীতের সময় এলাম, এটাকে অ্যাডভেঞ্চার বলতে পারেন। নিউ ইয়র্কেও মাঝে মধ্যে তুষারপাত হয় বটে, তবে নিউ ইংল্যান্ডের সাথে তার তুলনা হয় না।”

আমি মাথা দুলিয়ে সায় দিই, তা বটে। বলি, “আপনাকে ধন্যবাদ, এই কাজের জন্য আপনাকে কিন্তু পারিশ্রমিক নিতে হবে।” অ্যাব্রাহাম হাসে, তার হাতদুটিদু’দিকে ছড়িয়ে দিয়ে বলে, “কী যে বলো, বন্ধু! তুমি বরং আমাকে বিয়ার খেতে নিয়ে যেও।” গভীর নীল আকাশ ছিল সেদিন, গত রাতের ঝঞ্ঝার লেশ মাত্র নেই, সূর্যের আলোয় অ্যাব্রাহামের দাড়ি আর ভুরুতে তুষার কণা চিকমিক করে।

২.

এই ছিল অ্যাব্রাহামের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ। নিউ ইয়র্ক শহরের হার্লেম এলাকায় তার বড় হওয়া।অ্যাব্রাহাম বলত সেই বড় হওয়া কঠিন ছিল, ১৯৭০’এর দশক ছিল মাদক হেরোইনের সময়, আর ১৯৮০’র দশক ছিল মাদক কোকেনের রাজত্ব, তরুণ সমাজসেই মাদক ব্যবসাও সন্ত্রাসে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।অ্যাব্রাহাম বলত, “সেখান থেকে পালিয়ে আমি দেশের নানা জায়গায় গিয়েছি, অবশেষে এখানে।” এই পালানোর প্রক্রিয়ায় অ্যাব্রাহাম হার্লেমের বাইরে যে পৃথিবী আছে তা বুঝেছে, নিজে বদলেছে। তার এই দিলখোলা স্বভাব সেই বদলানোরই ফলাফল।

অ্যাব্রাহামকে বিয়ার খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলাম ‘কাটাহ্-ডিন’ নামের একটি বারে। বারটির নাম মেইন রাজ্যের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়, প্রায় মাইল-উঁচু মাউন্ট কাটাহ্-ডিনের নামে হয়েছিল। কাটাহ্-ডিননামটি এসেছে আদিবাসী আবেনাকি-পেনবস্কট ভাষা থেকে যার মানেই হল শ্রেষ্ঠ পাহাড়। ‘কাটাহ্-ডিন’ শব্দটি আমার খুব পছন্দের ছিল, মন হত কথাটি কোনো প্রাচীন বনে পরিত্যক্ত রহস্যময় মন্দির বা রাজপ্রাসাদের সন্ধান দিচ্ছে। হাইকারদের জন্য প্রিয় ছিল এই পাহাড়, আমিও একবার হেঁটে উঠেছিলাম তার মাথায়।

কাটাহ্-ডিন বারটি মিলিনকেট আসার পর পরই আবিষ্কার করি। এই আবিষ্কার করতে যে খুব বেগ পেতে হয়েছে এমন নয় কারণ মিলিনকেট শহরে ইন্টারেস্টিং কিছু থাকলে তা সহজেই চোখে পড়বে। শহর বলছি, আসলে কিন্তু এটি বড় একটি গ্রাম, স্থায়ী লোকসংখ্যা পাঁচ হাজার মত হবে। সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকার যখন বুকে নিঃসঙ্গতার জগদ্দল পাথর নামাত তখন কাটাহ্-ডিন বারে যেতাম। প্রথম প্রথম খুব অস্বস্তি হত, তারপর ধীরে ধীরে দু একজন নিয়মিত খদ্দেরকে চিনলাম, আর পরিচয় হল বার-সেবিকা রেবেকার সাথে। রেবেকাকে সবাই বেকী বলে ডাকত। ঘন লালচুল, নীল চোখ আর টোল-পড়া চিবুকের বেকী খুব ছোট বয়সে মা হয়েছিল, তার সেরকমই ছোটবয়সী বয়ফ্রেন্ড কাটাহ্-ডিনে এক শেষ হেমন্তের দিনে হাইক করতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল। হাই স্কুলবা বারো গ্রেডের পরে বেকীর আর পড়াশোনা হলনা, বাচ্চাটিকে বড় করতে সংগ্রাম করতে হল। ছেলেটির নাম ছিল ব্রায়ান, বেকী বলত ব্রায়ানের অটিজম আছে।

অ্যাব্রাহামকে যেদিন বিয়ার খাওয়াতে বেকীর বারে নিয়ে গিয়েছিলাম সেদিন আয়ারল্যান্ড থেকে আসা এক ব্যান্ড বাজনা বাজাচ্ছিল। বেহেলা, বাঁশি, ব্যাঞ্জো, অ্যাকোর্ডিয়ান, গিটার নিয়ে এক তুলকালাম কাণ্ড। লোকজন নাচছিল, হল্লা করছিল। আইরিশ বাজনার শক্তি প্রচণ্ড – এনার্জি যাকে বলে। বেকীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলে বেকী অ্যাব্রাহামকে জিজ্ঞেস করে, “তা আপনি নিউ ইয়র্ক ছেড়ে এখানে?” অ্যাব্রাহাম উত্তর দেয়, “বড় শহর থেকে দূরে থাকতে চাই।বড় শহরের অভিজ্ঞতা আমার ভাল নয়।” বেকী অন্য খদ্দরদের পানীয় যোগান দিতে যায়। বিয়ারের মাগ হাতে নিয়ে অ্যাব্রাহাম আনমনা ভাবে বাজনার ব্যান্ডের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমাকে বলে, “আমি এরকম বাজনা সাধারণত শুনি না, কিন্তু এই বাজনার তাল এই জায়গার সাথে মেলে।”

বেকী মাঝে মধ্যে ফিরে এসে আমাদের সাথে দু একটা টুকটাক কথা বলে আবার চলে যায়।একবার এসেঅ্যাব্রাহামকেজিজ্ঞেসকরল, “আপনিতো প্রতিবেশী, অমলের স্ত্রীকে দেখেছেন?” অ্যাব্রাহাম অবাক হয়, বলে, “নাতো, অমলের কি স্ত্রী আছে নাকি, আমাদের এই নিয়ে কোনো কথা হয়নি।বেকী বলে, “অমল তার স্ত্রীকে এখানে আনতে চায় না।”

আমি অ্যাব্রাহাম কেবলি, “বেকীর কথায় কান দিও না, আমার স্ত্রীলস এঞ্জেলেসে থাকে, ওখানে আমার মেয়ে ইউসিএলএ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তো মা মেয়ের কাছ ছাড়া হয়ে থাকতে চায় না, তারা একটা অ্যাপার্টমেন্টে একসাথে থাকে।” অ্যাব্রাহাম বলে, “ম্যান, তুমি এরকম একটা খবর আমার কাছ থেকে চেপে রেখেছিলে।” বেকী জোরে হেসে ওঠে, বলে, “শুনুন অ্যাব্রাহাম, এই কথা সে আমাদের এক বছর হলে বলে আসছে, আমি ভাবলাম হয়তো বাড়িতেই লুকিয়ে রেখেছে, তাই আপনার চোখে পড়েছে কিনা জিজ্ঞেস করলাম।”অ্যাব্রাহাম হো হো করে হাসে, অমলিন হাসি, পেছনে ব্যাঞ্জোর তাল দ্রুত হয়। এর মধ্যে আমার ফোন বেজে ওঠে, ওদের বলি, “দেখো তোমাদের কথাতেই তার বোধহয় আমাকে ফোন করার কথা মনে এলো। আমি এই হট্টগোলের বাইরে যেয়ে কথাটা সেরে আসি।”

কথা শেষ করে ফিরে এসে দেখি বেকী আর অ্যাব্রাহাম বেশ জমিয়ে কথা বলছে। বেকী আমাকে বলল, “কথাশেষ হল তোমার স্ত্রীর সাথে? সে কবে আসছে মিলিনকেটে?” এই প্রশ্নটা আমার জন্য একটু অস্বস্তিকর, বেকী সেটা জানে, হয়তো অ্যাব্রাহামকে আমার অবস্থাটা আগেভাগে জানিয়ে দিতে চায়। বললাম, “এবার শীত কমলে আসবে বলেছে।”

ব্যান্ডের বাজনা শেষ হলে আমি বাড়ির দিকে রওনা দিলাম, অ্যাব্রাহাম থেকে গেল, দেখলাম বেকীর সঙ্গে বেশ খাতির হয়েছে। অ্যাব্রাহামকে বললাম, “গাড়ি চালিয়ে ফিরে আসতে পারবে তো? বেশি খেও না।”বেকী বলল, “তুমি যাও, ওকে আমি বেশি ঢালব না।”

৩.

পরের দিন সকালে দরজায় কলিং বেলের শব্দ। দরজায় অ্যাব্রাহাম দাঁড়িয়ে, বলল, “তুমি এখনও ঘুমাচ্ছ, তোমার তো আজ ছুটি, চল যাই, বেকীর সঙ্গে কাল কথা হয়েছে, আইস-ফিসিং করতে যাব।” এই সাত সকালে হ্রদে বরফ কেটে মাছ ধরার কোনো ইচ্ছেই আমার ছিল না, কিন্তু আমি মানুষের অনুরোধ ঠেলতে পারি না।তৈরি হয়ে অ্যাব্রাহামের লাল পিক-আপ ট্রাকে করে আমরা বেকী আর বেকীর ছেলে ব্রায়ানকে তুলে নিলাম।ব্রায়ানের বয়স বছর দশেক হবে, তাকে একা রাখা যায় না। অন্যসময়ে বেকীর মা বাবা তাকে দেখে, তারা শহরের কাছেই থাকে। আজ বোধহয় তারা নেই। বেকীর কাছে আইস-ফিসিংএর জন্য যাবতীয় সরঞ্জাম ছিল, প্যাঁচানো বড় একটি বরফ কাটার যন্ত্র, একদিক তীক্ষ্ণ এরকম একটি বড় বাটালি, তাঁবু ইত্যাদি।

শহরের পাশেই জেরি পন্ড বরফে জমাট।আমরা ছাড়া আর কেউ নেই, বেকীই আমাদের মধ্যে বিশেষজ্ঞ।তিনজনে মিলে বরফের নিচে জল পর্যন্ত পৌঁছাতে চারফুট মত লম্বা ফুটো করলাম, তার ওপরেই তাঁবুফেলা হল, তাঁবুর ভেতর খাবার দাবার, পানীয়। সূর্য যত ওপরে উঠল বরফ ফাটার কড়কড় শব্দ ভেসে আসতে থাকল পুরো হ্রদটা থেকে।তীরের পত্রহীন বন থেকে নাম না জানা পাখীর গান ভেসে আসে, আর মাথার ওপরে হাঁসেরা ত্রিভূজ আকারে দক্ষিণ দিকে উড়েযায়। ছিপ ফেলে আমরা তাঁবুর মধ্যে ফোল্ডিং চেয়ার খুলে বসলাম।মাথায় এক্রিলিক বিনি টুপি, হাতে মোটা চামড়ার দস্তানা, হাঁসের পালকের জ্যাকেট, পশমের লাইনার দেয়া বুট – এসব পরেও শীত আটকানো যাচ্ছিল না। বেকী সকালের নাস্তা তৈরি করে এনেছিল। অ্যাব্রাহাম দেখলাম ব্রায়ানের সঙ্গে বেশ সখ্যতা করে ফেলেছে যা কিনা আমার পক্ষে কখনই সম্ভব হয়নি। অ্যাব্রাহাম ব্রায়ানকে তার প্রিয় খেলা কী এসব জিজ্ঞেস করছে, ব্রায়ান ম্যাপেল সিরাপ দিয়ে প্যানকেক খেতে খেতে উত্তর দিচ্ছে।একটু ঈর্ষাই হল, এত সহজে অ্যাব্রাহাম ব্রায়ানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হল, কিন্তু ঈর্ষাটা স্থায়ী হল না, ব্রায়ান কথা বলার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে দূরে তাকিয়ে রইল। অ্যাব্রাহাম চুপ করে গেল, আমি দু একবার ব্রায়ানের নাম ধরে ডাকলাম, সারা দিল না। বেকী কাঁধ ঝাঁকালো, এখানে তার কিছু করার নেই। একটি চিকাডি পাখির মিষ্টি ডাক ভেসে আসে। তীরে পত্রহীন ম্যাপেল আর এল্মগাছগুলো হাওয়ায় দোলে। সূর্যের রশ্মি সরাসরি আমার চোখের ওপর পরে, সেটুকু চোখ শুষে নিয়ে শরীরটাকে অল্প গরম করতে পারে।

বড়শিতে মাছ ধরছে না। অ্যাব্রাহাম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “বরফের নিচে আর একটা সাম্রাজ্য, ওপর থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই।” চিকাডি পাখিটি চুপ হয়ে যায়।অ্যাব্রাহাম বলতে থাকে, “আর ছোট মাছেদের এই পুকুর ছেড়ে আর কোথাও যাবার নেই, তারা বড় মাছদের শিকার, আর বড় মাছেরা আমাদের শিকার।” বেকী আর আমি দুজনেই অ্যাব্রাহামের দিকে তাকাই।

বেকী জিজ্ঞেস করে, “তাহলে কার প্রতি তোমার বেশি সহানুভূতি – ছোট না বড় মাছের প্রতি?”

“দুজনের প্রতিই। কারুরই এখান থেকে পরিত্রাণ নেই।”

“তোমার অতীত কি এরকম ছিল?” প্রশ্ন করে বেকী।

অ্যাব্রাহাম হেসে ওঠে, এত জোরে যে দূর থেকে তার প্রতিধ্বনি ফিরে আসে, বলে, “এরকমই বলতে পার, হার্লেম ছিল এরকম একটা বরফ জমাট পুকুর, সেখান থেকে কেউবের হতে পারত না। সে সময়টা ছিল হেরোইনের যুগ, অস্থিরতার সময়।দুই কেনেডি ভাই, মার্টিন লুথার, ম্যালকম এক্স এরা সবাই নিহত হল, ওদিকে ভিয়েতনাম যুদ্ধ – সব কঠিন অবস্থা, এর মধ্যে সাদারা হার্লেম ছেড়ে পালালো।হার্লেম তখন যেন এক যুদ্ধক্ষেত্র, সেখানে কে থাকবে? কিন্তু আশির দশকে এল ক্র‍্যাক কোকেন, সেটার প্রভাব আরো এক ধাপ ওপরে। সেই প্রভাব থেকে কেউ বেরিয়ে আসতে পারেনি, হয় তুমি তা ভোগ করবে, নয় বিলি করবে।আর এগুলোর মধ্যে না থাকতে চাইলে মারা পড়বে কারণ তোমাকে রক্ষার জন্য কেউ নেই। রাস্তার বিক্রেতারা হল ছোট মাছ, আর তাদের সরাবরাহকারীরা হল বড় মাছ।” বেকীর মুখমণ্ডল দেখে মনে হল তার অস্বস্তিহচ্ছে একটু, বোধহয় ভাবছে ব্রায়ানের সামনে এই আলোচনাটা শুরু করা ঠিক হয়নি।

আমি বললাম, “ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছি, আজ আর মাছ ধরা পড়বে না, না বড়মাছ, না ছোট। চল শহরে ফিরে যাই। শহরে ফিরের লাঞ্চ খাওয়া যেতে পারে।”

অ্যাব্রাহাম বলল, “তোমরা যাও, আমাকে আজ নিউ ইয়র্ক যেতে হবে।” “নিউ ইয়র্ক?” আমরা দুজনেই আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করি। “হুম,” উত্তর দেয় অ্যাব্রাহাম, “এখন রওনা দিলে আজ রাতেই পৌঁছে যাব, ন’ ঘন্টা মতন লাগবে।”

“এখনই যেতে হবে তোমার নিউ ইয়র্ক?” আমি জিজ্ঞেস করি, “কাল সকালে উঠে যেও। বরফে রাস্তা পিছল।”

“না, আমি একজনকে কথা দিয়েছি আজই যাব, দু এক দিনের মধ্যেই ফিরে আসব।”

তাই হল। আমাদেরকে নামিয়ে দিয়ে অ্যাব্রাহাম নিউ ইয়র্ক চলে গেল।


আরো পড়ুন: দীপেন ভট্টাচার্যের গল্প: পৃথিবীর ছায়া


৪.

সেই শীতে আমরা চারজনে মিলে একবার মাউনটেন স্কি করতে গিয়েছিলাম। পাহাড়ের বরফ ঢাল দিয়ে স্কি করা আমার শখের কোনো কাজ ছিল না, কিন্তু সেই আইস ফিশিং-এর মতই অনুরোধে ঢেকি গেলা হল। সেই স্কি করতে গিয়ে কতবার যে আছাড় খেলাম তার হিসেব নেই। এরকম ব্যাপার, তো একদিন, বসন্তের শুরুতে, বরফ যখন গলছে, এক ভোরে জানালা দিয়ে দেখি বেকী অ্যাব্রাহামের বাড়ি থেকে সন্তর্পণে বের হচ্ছে। মনে মনে হাসলাম, কারণ বেকী যে অ্যাব্রাহামের প্রতি দুর্বল হয়েছিল সেটা লুকানোর কিছু ছিল না। নিজের মনে হাসলেও একটা চাপা ব্যাথা যে হয়নি সেটা অস্বীকার করব না।

ততদিনে অ্যাব্রাহাম স্থানীয় ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে একটি পর্যটন, চিত্তবিনোদন জাতীয় খেলা যেমন এটিভি গাড়ি, স্কি এসবের দোকান দিয়েছে। সেটাকে দেখাশোনা করার জন্য একজনকে নিয়োগও দিয়েছিল।

সেদিন কাজ শেষে কাটাহ্-ডিন বারে গিয়েছিলাম। ভাবলাম বেকীতে বলব, তোমাকে আমার পাড়ায় দেখেছি।কিন্তু বেকী আমাকে সুযোগ দিল না। প্রথমেই জিজ্ঞেস করল, “তুমি কোনোদিন তোমার স্ত্রী আর মেয়ের নাম আমাকে বল নি।”

বললাম, “এতদিন পরে জিজ্ঞেস করছ?”

“তাদের সঙ্গে কি তোমার আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে?” বেকীর জিজ্ঞাসা।

“সম্পর্ক আছে, দেখো না মাঝে মধ্যেই ফোন করে। তবে জিনিসটা যে জটিল তা তো তুমি জানই।”

“আমি এসব খুব ভাল বুঝি,” বেকী এক খদ্দেরকে পানীয় ঢালতে ঢালতে বলে, “জীবনের পথ আগে থেকে কী হবে বলা মুশকিল, আর সে জন্য মানুষকে সব না জেনে বিচার করতে নেই। কিন্তু তবুও বলি স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক না থাকতেই পারে, কিন্তু তোমার মেয়েকে তোমার দেখতে ইচ্ছা করে না।”

পানীয় যাকে ঢালা হল সেই খদ্দের আমার দিকে চায়। আমি চুপ করে থাকি। এর উত্তর আমার কাছে নেই।বেকী আমার সামনে এসে বলে, “অ্যাব্রাহামকে তোমার কেমন মনে হয়?”

বলি, “ভালই, তবে তোমার থেকে বয়সে বেশ বড়।”

“বয়সে কি তুমি ছোট?”

আমি হাসি, বলি, “তা বটে, তবে অ্যাব্রাহাম কি মিলিনকেটে স্থায়ীভাবে থাকবে?”

“তুমিও কি আর এখানে থাকবে? আর আমিই কি এখানে সারা জীবন পড়ে থাকব?”

“তা বটে,” আবার বলি আমি। আমার স্বতোৎসারিত দীর্ঘশ্বাস বেকীর অলক্ষিত থাকে না।

“আর অ্যাব্রাহাম ব্রায়ানের ভাব-ভঙ্গী স্বভাব ভাল বুঝতে পারে, মনে হয় আমার থেকে ভাল বোঝে। সবাই ব্রায়ানকে নিতে পারে না।”

আমি সায় দিয়ে মাথা নাড়াই। সেদিন বারে একতরুণ গিটার বাদক জেমস টেইলারের ‘আগুন ও বৃষ্টি’ গানটি গাইছিল –

কাল সকালে মাত্র ওরাজানাল আমায়, তুমি গেছ চলে।
তোমাকে ওরা, সুজান, একেবারে শেষ করে দিতে চায়।
আজ সকালে বেরিয়ে আমি লিখলাম এই গানটা,
শুধু পারছি না মনে করতে এটা পাঠাবো কার কাছে।
 
আমি দেখেছি আগুন আরা আমি দেখেছি বৃষ্টি,
আমি দেখেছি সূর্যস্নাত দিন ভেবেছিলাম যার নেই শেষ,
আমি দেখেছি নিঃসঙ্গ সময় যখন বন্ধু পাইনি কোনো,
কিন্তু ভেবেছি নিরন্তর তোমার দেখা পাবো আমি আবার।

৫.

বসন্ত শেষ হয়ে গেল সবুজ গ্রীষ্মে। সেই গ্রীষ্মটা ছিল গুমোট।অ্যাব্রাহামকে কাটাহ্-ডিন পাহাড়েনিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু তারজন্যপাহাড়ের চড়াইপথটি কঠিনছিল, মাঝপথে ফিরে এসেছিলাম।গ্রীষ্মপার হয়ে এল হেমন্ত।আগের মত অ্যাব্রাহামের সঙ্গে আর দেখা হয় না।সে অনেকটা সময় নিউ ইয়র্কে কাটায়, আর মিলিনকেটে যখন থাকে তখন দোকানে দেখে, রাতে বেকীর ওখানেই থাকে।ওর লাল ট্রাকটাকে আমি খুব কমই দেখি এখন।রাতে কাজ থেকে ফিরে প্যাকেটের খাবার মাইক্রোওয়েভে গরম করে খাই। কম্প্যুটারে ফেলে আসা দেশের খবর দেখি, সেগুলো ঠিক বুঝে উঠতে পারি না।সেই দেশের কারুর সাথে আমার যোগাযোগ নেই, এই যোগাযোগহীনতার জন্য হয়তো তারা একদিন আমাকে ধন্যবাদ দেবে। বাইরে ঝরা পাতার সঙ্গে শুনি পুচিনির লা বোয়েম সঙ্গীত অথবা বাঁশি কবিতার আবৃত্তি। অপেক্ষা করি কখন আমার রাস্তায় বেজে উঠবে সিন্ধু-বারোয়াঁ।

অনেকদিন পরে কাটাহ্-ডিন বারে যাই।

বেকী বলল, “এতদিন এলে না কেন?”

বললাম, “আসিনি তো খবর করলেই পারতে।”

বেকী হাসে, বারের অন্য কাজ সেরে এসে বলে, “আমার বাবা অসুস্থ, হাসপাতালে ছিলেন। ওদিকে ব্রায়ানের স্কুলে নানা ঝামেলা হচ্ছে, সহপাঠীদের সাথে হাতাহাতি হয়েছে, ব্যস্ত ছিলাম।”

শুনলাম অ্যাব্রাহাম নিউ ইয়র্ক গেছে। ইদানীং নিউ ইয়র্ক যেয়ে বেশ কিছুদিন করে থাকছে। ব্যবসার কাজেই নাকি। সে ব্রায়ানকে একটা সাইকেল কিনে দিয়েছে, তাতে ব্রায়ানকে তালিম দিচ্ছে। এই বয়সের ছেলেরা এখানে সাইকেল চালাতে পটু। ব্রায়ানকেই কেউ শেখায় নি আগে। আর অ্যাব্রাহামতার দোকান থেকে এখন মোটরসাইকেলও বিক্রি করছে, মাঝে মধ্যে সেগুলোর মধ্যে একটা নিয়ে এসে বেকীকে ঘোরায়। বেকীকে তা চালাতেও শেখাচ্ছে। এসব শুনে যে আমার একেবারেই ঈর্ষা হল না তা বলব না, কিন্তু এরকম জগৎ থেকে নিজেকে উঠিয়ে নিতে বহু বছর চেষ্টা করেছি। বিযুক্ত থেকে সবকিছু দেখার মধ্যে মুক্তির স্পর্শ আছে। বেকীকে বললাম, “শুনে খুব খুশী হলাম।” বাংলায় ‘শুনে খুব খুশী হলাম’ কথাটা খুব আনুষ্ঠানিক শোনায়, কিন্তু ইংরেজীতে ততটা নয়। বেকী যেন আমার কথায় ভরসা পেল। সেদিন বারে কেউ গাইছিল না।

সে রাতে বাড়ি ফিরে ভাবলাম অ্যাব্রাহামের সঙ্গে বন্ধুত্বটা সবে দানা বাঁধতে শুরু করেছিল, সেটি ঠিক পরিপক্ক হল না। আমার এরকমই ভাগ্য। ছোটবেলায় খুব বেশি বন্ধু ছিল না, যাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হত তারা হয় দেশ ছেড়ে চলে যত, অথবা অন্যস্কুলে, অথবা উধাও হয়ে যেত। আমি ভাবতাম আমাদের পরিবার ছাড়া আর সবাই এক রহস্যের জগতে বাস করে যেখানে দেশ,  শহর কি স্কুল বদল অনায়াসে সম্ভব।

পরদিন সকালবেলা বেকীর ফোনে ঘুম ভাঙে। বেকী চিৎকার করে, “অমল, অ্যাব্রাহামকে মেরে ফেলেছে।” বুঝতে পারি না বেকীর কথা, এ সময়েই দরজায় কলিং বেল বাজে। আমি বলি, “কী বলছ তুমি? মেরে ফেলেছে মানে কী?” বেকী কাঁদে ওদিকে, বলে, “ওকে গুলি করে মেরেছে। দু দিন আগে, হার্লেমে।” দরজার কলিং বেলটি বাজতেই থাকে। মনে হল এমন যেন পৃথিবীর শেষ সময় উপস্থিত, দরজায় শমন। ফোনটা হাতে নিয়েই দরজা খুলি। দুজন পুরুষ, একজন কৃষ্ণাঙ্গ, পরনে একটা বাদামী ওভারকোট, অন্যজন শ্বেতাঙ্গ, কালো ওভারকোট। দুজনেরই সাদা জামা, টাই। তারা তাদের পরিচয়পত্র দেখায় –ইউ.এস.মার্শাল সার্ভিসের এজেন্ট।এই প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে আমার সেরকম ধারণা ছিল না, এরা পুলিশও না, এফ.বি.আইও না। সন্ত্রস্ত হয়ে তাদের ভেতরে আসতে বললাম। ফোনটা তখনও হাতে ধরা ছিল। এদের মধ্যে একজন বলল, “আপনাকে বোধহয় রেবেকা কলিংওয়ার্থ ফোন করছেন, ওনাকে বলে দিন একটু পরে কথা বলবেন।”

ওদের দুজনকে বড় সোফাটায় বসিয়ে আমি একটা চেয়ার টেনে বসি। বাদামী ওভারকোট বলল, “আমরা রেবেকার বাড়ি থেকেই আসছি। ওর সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে।” আর একজন বলল, “আমরা জানতে চাইছি অ্যাব্রাহাম রিচার্ডসনের বাড়িতে বাইরের কাউকে আসতে দেখেছেন কিনা?” আমি তখনও ঘটনাটা বুঝে উঠতে পারিনি, বললাম, “আগে বলুন, অ্যাব্রাহাম কি সত্যি মারা গেছে?”

“হ্যাঁ,” বাদামী ওভারকোট বলে, “দু দিন আগে, রাতে, রিচার্ডসনকে মাথায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তার গাড়িতে পাওয়া গেছে হার্লেমের একটি রাস্তায়। এই মুহূর্তে আমাদের কাছে এই হত্যাকাণ্ডের কোনো সাক্ষী নেই।”

“ওর গাড়ি, মানে আপনারা একটা লাল পিকআপ ট্রাকের কথা বলছেন?” আমি জিজ্ঞাসা করি।

“হ্যাঁ,” বলে কালো ওভারকোট, “তাতে মেইনের লাইসেন্স প্লেট লাগানো।”

“আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে, অ্যাব্রাহাম মারা গেছে,” বলি আমি। আমার মনের বিক্ষিপ্ত অবস্থাটা এখন আমি বর্ণনা করতে পারব না।

“রিচার্ডসনকে কি আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলা যায়?” জিজ্ঞেস করে কালো ওভারকোট।

“মোটামুটি তা বলা যায়। আর ওর বাড়িতে বেকী, ব্রায়ান আর আমি ছাড়া কেউ যেত না। হ্যাঁ, আর একজন আসত, ওর দোকানের কর্মচারী জন। এছাড়া ডাক হরকরা, আমাজন এরকম কিছু লোক।”

“এর বাইরে কাউকে আসতে দেখেন নি?”

“না,” বলি আমি।

“রিচার্ডসন আপনাকে তার অতীত সম্পর্কে কিছু বলেছে?” জিজ্ঞেস করে বাদামী ওভারকোট।

“বলেছিল যে হার্লেমে বড় হয়েছে, কঠিন ছিল বড় হওয়া, হেরোইন আর কোকেনের সময় ছিল সেটা।”

“এটুকুই?”

“হ্যাঁ, এর বাইরে কিছু বলে নি, আমিও জানতে চাই নি।”

“আপনাকে তাহলে এটুকু বলি, অ্যাব্রাহাম রিচার্ডসনকে আপনারা যা মনে করতেন সে তা নয়। ইউ.এস. মার্শাল সারভিসের একটা বিশেষ প্রোগ্রাম আছে, যেখানে সরকারি সাক্ষীদের বিশেষ নিরাপত্তা দেয়া হয়। সেই নিরাপত্তা প্রোগ্রামে রিচার্ডসনকে আপনার এই সামনের বাড়িতে ঠাঁই দেয়া হয়। তার নাম অ্যাব্রাহাম রিচার্ডসন নয়, তার নাম আলপো টার্নার। সাক্ষী নিরাপত্তা প্রোগ্রামে তার নতুন নাম দেয়া হয় অ্যাব্রাহাম রিচার্ডসন। আর আলপো টার্নার তার অতীত জীবনে কী করেছে সেটা অন্তর্জাল ঘাঁটলেই পেয়ে যাবেন।”

এই দুই মার্শালের কথার সঙ্গে মিলিনকেটের অ্যাব্রাহামের জীবনকে মিলাতে পারছিলাম না। বললাম, “তাহলে সে কি মাদক বিক্রেতা ছিল? কিন্তু এখানে সে মোটামুটি সুস্থ জীবন যাপন করত, আমাকে সে প্রচুর সাহায্য করেছে।”

মার্শাল দুজনেই আমার কথায় হাসে। কালো ওভারকোট বলে, “শুধু বিক্রেতা ছিলনা, এক সময়ে সে পুরো হার্লেমের মাদক ব্যবসার পুরোধা ছিল, কিংপিন যাকে বলে। সেই সময়ে সে যে সব কাজ করেছে তা শুনলে আপনার রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। পরে সে অবশ্য সরকারি সাক্ষী হয়ে অনেককে ধরিয়ে দেয়, সেজন্যই তাকে নিরাপত্তা দিয়ে এখানে পুনর্বাসন করানো হয়েছিল। কিন্তু চিতাবাঘ তার ছোপ বদলাতে পারে না, আলপো তার পুরোনো স্বভাবত্যাগ করতে পারেনি, তার পুরোনো শিকারের জায়গায় ফিরে যেতে শুরু করে। মেইন থেকে নিউ ইয়র্ক যেত তার পুরনো মাদক ব্যবসাকে আবার চালু করা যায় কিনা তা দেখতে। কিন্তু বুঝতেই পারছেন তার মৃত্যু দেখার জন্য অনেকেই প্রস্তুত ছিল। আলপো তার পুনর্বাসনের শর্ত ভঙ্গ করেছিল, এখানে আমাদের আর করার কিছু ছিল না।”

বাদামী ওভারকোট যোগ করে, “আলপো টার্নারকে কে হত্যা করেছে বা নিউ ইয়র্কে তার ব্যবসা সম্পর্কে আপনি আমাদের তথ্য দিতে পারবেন সেই আশায় এখানে আসিনি। আমাদের উদ্দেশ্য হল আপনাকে কিছুটা সতর্ক করা, আলপোর সঙ্গে আপনার মেলামেশা ছিল, সেটি আলপোর শত্রুদের চোখে পড়তে পারে। সেজন্য আগামী কয়েক সপ্তাহ একটু সাবধানে থাকবেন। রেবেকা কলিংওয়ার্থকেও আমরা একই কথা বলেছি।”

মার্শাল দু’জন তাদের কার্ড দিয়ে বিদায় নিল। বেকীকে ফোন করে পেলাম না। ফোনে বোতাম চাপতে হাত কাঁপছিল। সেদিন আমার সকাল থেকে কাজ ছিল, তাই সাথে সাথেই বেকীর ওখানে যেতে পারলাম না।সন্ধ্যাবেলা বারে যেয়ে দেখি বেকী কাজে এসেছে। চোখে কালো চশমা। বললাম, “কাজে এসেছ কেন?” উত্তর দিল, “বাড়িতে থাকলে আরো খারাপ লাগত।” বেকী তার ফোনটা আমার হাতে দেয়। ফোনে দেখি একটা সংবাদ আলেখ্য, তাতে বড় শিরোনাম – “হার্লেম মাদক সম্রাটের কাছে কোনো কিছুই অসম্ভব ছিল না তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে খুন করা সহ।” পড়া শুরু করতে গিয়ে থেমে গেলাম, দ্বিতীয় লাইনেই লেখা –আলপো টার্নার সবাইকে যে নিজ হাতে খুন করেছে তা নয়, কয়েকটি সে তার অধস্তন কর্মীদের দিয়ে করিয়েছে, আর সব মিলিয়ে পুলিশ অন্তত দশটি খুনের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে রোমহর্ষক হল তার ছোটবেলার বন্ধুকে হত্যা করা। আলপো তাকে প্রতিদ্বন্দ্বী মাদক দলের সাথে যোগসাজসের জন্য সন্দেহ করেছিল…”

আমি আর পড়তে পারলাম না, হাত কাঁপছিল, বেকীকে ফোনটা ফিরিয়ে দিলাম। বেকী বলল, “অন্তর্জাল ভর্তি আলপোর কাহিনিতে।” বললাম, “তুমি আজ কেন কাজে এসেছ?” বেকীর উত্তর, “তুমি কি আমাকে বাড়িতে বসে থাকতে বলছ? আর ব্রায়ানকে আমি কী বলব?”

এরকম একটা ব্যাপার। বেকীর সঙ্গে কথা বলার জন্য উশখুশ করছিলাম, কিন্তু বারের ভিড়ে কথা বলা গেল না। এরপরে এক সপ্তাহ বেকীর সাথে দেখা হল না, ফোনেও কথা হল না। বেকীর বাড়িতে যাবার সাহসও হল না। আসলে আমরা দুজনেই এমন একটা গহ্বরে পড়েছিলাম তার থেকে সহজ উদ্ধারের পথ ছিল না, সময়ই মনে হয় একমাত্র সহায় সেখানে। অ্যাব্রাহামের বাড়িটি ডেভিড মারা যাবার পরে যেমন একটা শূন্যতা পেয়েছিলে সেরকমই এর একটি শূন্যতা পেল।এক সপ্তাহ পরে একদিন আমার ছুটি ছিল, বিকেল বিকেল বারে পৌঁছলাম যখন বেকী কাজে আসে। আমাকে দেখে বিমর্ষ হাসল, আমি ওকে কী বলব বুঝে পাচ্ছিলাম না।

কোনো কথা না বলে আমার প্রিয় পানীয়টি তৈরি করে আমাকে দিয়ে বলল, “আমি একটা স্বপ্নের সময় পার হলাম, সেটা সুখস্বপ্ন নাকি দুঃস্বপ্ন বলতে পারব না। এরকম একটি মানুষের সাথে আমি থেকেছি যাকে পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস করেছি, আস্থা রেখেছি। এখন ভাবি সেই আস্থা কতদিন স্থায়ী হত। মানুষ কেন তার অতীতকে ত্যাগ করতে পারে না?”

বেকী কথাগুলো বলে গুছিয়ে, মনে হল আমাকে বলার জন্য এতদিন অপেক্ষা করছে। নতুন খদ্দের বেকীকে পানীয়র অর্ডার দেয়।

ফিরে এসে বেকী বলে, “সে বেঁচে থাকলে কী হত? আমি কি তার অতীতকে মেনে নিতাম? বেঁচে থাকলে তার অতীত যদি আমাদের অধিকার করে নিত? ব্রায়ান আর আমি কি সেই ভয়াবহ খেলার অংশ হয়ে যেতাম?”

আজ বারে নতুন গায়ক এসেছে, সে তার গিটারের সুর ঠিক করছে।

বেকী বলতে থাকে, “সব মানুষেরই কিছু গোপন কথা থাকে যা কাউকেই বলা যায় না। সেই কথাটা এতই ধারালো এতই ধ্বংসাত্মক যে সেটা সে নিজেই স্বীকার করে না। এই ধর তোমার কথা – তোমার না আছে কন্যা, না আছে স্ত্রী – অথচ তুমি গত দু বছর ধরে আমাদের সামনে ভান করছ, এক অলীক পরিবার গড়েছ, কিসের জন্য তা আমি জানি না। না, অ্যাব্রাহামের সঙ্গে তুলনা করছি না, কিন্তু মানুষকে চেনা বড় দায়।”

বিড়বিড় করে বলি, “কী করে বুঝলে?”

বিষণ্ণ হাসি হাসে বেকী। বলে, “তুমি যদি শুধু স্ত্রীর কথা বলতে তাও হত, কিন্তু তুমি একটি কাল্পনিক কন্যা সন্তানও গড়লে, কিন্তু তোমার মধ্যে পিতৃত্বের কোনো ছায়া আমি দেখিনি। ভুল বুঝো না, ব্রায়ানের সঙ্গে তোমার সম্পর্কের কথা বলছি না। যার একটি কলেজে-যাওয়া মেয়ে আছে সেই মেয়ে সম্পর্কে তার অনুভূতিকে সে আটকে রাখতে পারে না, তার সঙ্গে সম্পর্ক যতই খারাপ হোক। তুমি মাঝে মাঝে স্ত্রীর কাছ থেকে ফোন এসেছে বলতে, সেগুলো বানানোই ছিল, আর মেয়ের থেকে তুমি কোনোদিন ফোন পাওনি।”

বেকীর কথা আমার আর কানে যায় না। আমার পানীয় থেকে বুদবুদ ওঠে। সেই ক্ষণস্থায়ী বুদবুদের ছোট জীবনটার কথা ভাবি। আমার ফাঁকা বুদবুদের জীবনকে অধরা পরিবারকে দিয়ে সাজাতে চেয়েছি, তাতে কারুর ক্ষতি হয়নি।

দূর থেকে বেকীর গলা ভেসে আসে, “অ্যাব্রাহামের মধ্যে পিতৃত্ববোধ ছিল, সেটা তো তুমি ভাল করে জানো।হয়তো তার ছেলেবেলায় সে যা পায়নি সেটা ব্রায়ানকে দিয়ে পূরণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু ব্রায়ান, আমি, আমাদের এই ছোট শহর অ্যাব্রাহামের জন্য যথেষ্ঠ ছিল না। তার জন্য আমরা ছিলাম এক অলীক পরিবার।”

নতুন খদ্দের আসে, বেকী তার জন্য পানীয় তৈরি করতে যায়। আমার পানীয় সামনে পড়ে থাকে, তার থেকে সব বুদবুদের ওঠা শেষ। আমি অস্ফূট কন্ঠে নিজেকে বলি, “প্রেম ছিল, আশা ছিল— জ্যোৎস্নায়– তবু সে দেখিল কোন্ ভূত?” জীবনানন্দের সৃষ্ট ভূত আমাদের তাড়া করে। সেই ভূত কে দেখেছিল? অ্যাব্রাহাম দেখেছিল। আমিও কি দেখেছিলাম?

৬.

হেমন্ত পার হয়ে শীত এল। সেবার শীতটা খুব কড়া ছিল। মাইনাস চল্লিশ, আমাদের ফার্মেসি দু দিন বন্ধ রাখতে হল। এক সপ্তাহ এরকম যাবার পরে আবহাওয়া বেশ ভাল হল, ঠাণ্ডা কমে এল। এক রাতে কাজ থেকে ফিরছি, দেখি অ্যাব্রাহামের বাড়িতে আলো, ড্রাইভওয়েতে একটা সাদা পিকআপ ট্রাক। ফেডেরাল মার্শালরা আবার কোন সাক্ষীকে এখানে জায়গা দিয়েছে? আর এক মাদক ব্যবসায়ী, আর এক খুনী?

পরদিন সকালে কাজে বের হবার সময় তাকে দেখি, তার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখে সুপ্রভাত বলল।কিছুটা বাধ্য হয়েই রাস্তা পার হয়ে তার সঙ্গে করমর্দন করতে যাই। ছ’ ফুটের ওপর লম্বা একটি মানুষ, বিশাল দেহ, বিরাট মাথা, কামানো। বলল, আমার নাম টনি। কিছুক্ষণ কথা হল – টনির পুরো নাম টনি বারাহাস, মনে মনে বললাম তোমার আসল নাম তো এটা নয়। নিউ ইয়র্কের শহরের ব্রংক্সে সে ছিল। এরকম কিছু প্রাথমিক কথাবার্তা বলে কাজে চলে গেলাম। কাজে ওষুধ প্যাকেটে ভরতে ভরতে টনি বারাহাসের বিশাল চেহারাকে মন থেকে সরাতে পারলাম না, সেই চেহারার পেছনে ক’টিহত্যাকাণ্ড আছে ভাবলাম। খেয়াল হল আমি অক্সিকোডন ভরছি প্যাকেটে। এটি ব্যথা যেমন লাঘব করতে পারে, আবার অভ্যাসে পরিণত হলে তেমন মাদকে পরিণত হয়।

তিন চারদিন পরে একটা বড় তুষার ঝড় হল। আমার ড্রাইভওয়ে পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখি টনির গাড়ি তুষারের নিচে চাপা পড়েছে।কী মনে হল কে জানে, রাস্তা পার হয়ে টনির গাড়ির ওপর তুষার সরালাম, আরো আধঘন্টা মত কাজ করে ওর ড্রাইভওয়ে পরিষ্কার দিলাম। ভাবলাম, এরকম মানুষকে একটু হাতে রাখাই ভাল।আমার কাজের শব্দে টনির ঘুম ভাঙলো না, অথবা ভাঙলেও বোধহয় ভান করল যেন কিছুই দেখে নি।

সে রাতে কাজ শেষ করে ফিরতে ফিরতে ন’টা বেজে গেল। ভেতরে ঢোকা মাত্র দরজায় কলিং বেল বাজল।খুলে দেখি টনি দাঁড়িয়ে, হাতে হুইস্কির একটা বোতল। ক্লান্ত ছিলাম খুব, এখন বসে হুইস্কি খাবার মত অবস্থা ছিল না, কিন্তু আর এক মাদক সম্রাটকে প্রত্যাখ্যান করার মত সাহস হল না। টনি ভেতরে ঢুকে বলল, “বোতলটা আপনার জন্য উপহার, আজ আমার ড্রাইভওয়ে পরিষ্কার করে দিয়েছেন।”

বললাম, “আমাকে কি কাজ করতে দেখেছেন?”

টনি বলল, “একেবারে শেষের দিকে।”

বুঝলাম না আমাকে কাজ করতে দেখেও সে কেন বাড়ির বাইরে বের হয়নি। টনিকে বসতে বললাম। বসা মাত্র জিজ্ঞেস করল, “আপনি একাই থাকেন?” এরকম প্রশ্ন এখানে সাধারণত কেউ করে না, অন্তত প্রথম সাক্ষাতে।একটু রাগই হল, যতটুকু শান্ত স্বর করা যায় ততটুকু করে বললাম, “হ্যাঁ।” তারপর বললাম, “আপনি কি সাক্ষী নিরাপত্তা প্রোগ্রামের আওতায় এখানে এসেছেন?”

টনি হা হা করে হেসে ওঠে, বলে, “আপনি অনেক ঘাটের জল খাওয়া মানুষ, আমি জানি আলপো টার্নার আপনার বন্ধু ছিল, তাই এই ব্যাপারটা সহজেই ধরতে পারলেন। তবে আলপোর মত আমি ভয়াবহ কেউ না, আলপো ছিল কিংবদন্তির মানুষ, লেজেন্ড যাকে বলে। খুবই ঘৃণীত লেজেন্ড অবশ্য। আমার ওপর ভরসা রাখতে পারেন, কিন্তু আপনার সাহায্যও আমার দরকার। আমি হিসপ্যানিক মানুষ, ব্রংক্সে বড় হওয়া, নিউ ইংল্যান্ড আমার জন্য একেবারে নতুন একটা পরিবেশ। আশা করি এখানে খাপ খাওয়াতে আপনি সাহায্য করবেন।”

মনে মনে বললাম, কে কাকে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করে।

টনি সেদিনের মত বিদায় নিল। কিন্তু এরপরেকাজ থেকে ফিরলে, সপ্তাহে একবার সে আসত, হুইস্কি খেত। তার সব গল্পই ছিল মাদক ব্যবসা সংক্রান্ত। এক সন্ধ্যায় জিজ্ঞেস করেছিলাম, “তুমি কাউকে হত্যা করেছ?” জড়তা ছাড়াই সে বলেছিল, “খুবনিকট একজনকে, কারণ সে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, তার কাছ থেকে আমি পঞ্চাশ হাজার ডলার পেতাম। টাকাটা দেবে বলে এক জায়গায় ডেকেছিল, কিন্তু আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দলকে খবর দিয়ে রেখেছিল যাতে আমাকে সেখানে মেরে ফেলা হয়। প্রাণে বেঁচে ফিরেছিলাম। এর পরের ঘটনা তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করো না।”

সুদূর মিলিনকেটে এসেছিলাম বড় শহরের ঝামেলা এড়াতে, কিন্তু সেটি আমাকে ছাড়ল না। প্রথম বছরটিতে ধীরে ধীরে নিউ ইংল্যান্ডের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছিলাম, দ্বিতীয় বছরে অ্যাব্রাহাম এসে সব ওলোটপালোট করে দিল। আর অ্যাব্রাহামের পথ ধরে এল টনি। টনিকেকাটাহ্-ডিনবারে নিয়ে গেলাম না, বেকীর সঙ্গে পরিচয়ও করালাম না। অ্যাব্রাহামের ঘটনার পরে কাটাহ্-ডিনে যাওয়াও প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলাম।তাই কাজ থেকে বাড়িতেই ফিরতাম, আর টনি যেন আমার বাড়িতে ফেরার অপেক্ষায় থাকত, ফিরলেই আমার এখানে আসত। হুইস্কি আমার পছন্দের পানীয় নয়, কিন্তু আর এক মাদক সম্রাটকে প্রত্যাখ্যান করার মত সাহস আমার ছিল না। টনির সঙ্গে বসেহুইস্কি খেতে হত। ধীরে ধীরে নিউ ইংল্যান্ডের উজ্জ্বল দিনগুলি আমার অপহৃত হল।

৭.

শীত শেষ হল। মার্চ থেকে বরফ গলতেশুরু করে। বাতাসে নতুন কুঁড়ির গন্ধ। এপ্রিল হল নিষ্ঠুরতম মাস, নিষ্প্রাণভূমি থেকে লাইলাককে জন্ম দিয়ে, স্মৃতি ও বাসনাকে মিশ্রিত করে, বসন্তের বৃষ্টি দিয়ে মলিন তৃণমূলকে জাগরিত করে – এমনটাই লিখেছিলেন এলিয়ট তাঁর The Waste Land-এর শুরুতে। যে ভূমি মৃতপ্রায়, যে জমি পরিত্যক্ততার কাছে সমস্ত অভিলাষও পরিত্যাজ্য, নতুন কুঁড়ির গন্ধ হল নির্মমতা। সেই বছর শীতকে আমার ধরে রাখা দরকার ছিল।

সেদিন কাজ থেকে একটু আগেই ফিরেছি। তাইসন্ধ্যাথেকেই টনি এখানে। আমাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কখনও বিয়ে করেছিলে?” এই কথার কী উত্তর দেবে ভেবে পাই না। এক ঢোঁক হুইস্কি গিলে বললাম, “করেছিলাম, আমার একটি কন্যাও আছে, তারা এখন লস এঞ্জেলেস থাকে, আমার সঙ্গে যোগাযোগ নেই।”

“ওহ,” বলে টনি, “তাই তোমার স্ত্রীর কোনো ছবি নেই এই ঘরে। কিন্তু তুমি তোমার মেয়ের ছবি কেন ঘরে রাখো না। স্ত্রীর সঙ্গে তোমার ছাড়াছাড়ি হয়েছে, কিন্তু তোমার মেয়ের সঙ্গে তোমার রক্তের সম্পর্ক। এই দেখো আমার দুটি সন্তানের ছবি।” টনি মানিব্যাগ খুলে দুটি ছেলে মেয়ের ছবি দেখায়, আট/দশ বছর হবে তাদের বয়স। বলে, “ওদের মা এখন আর এক জনের স্ত্রী। ভালই হয়েছে, আমি তো ওকে বা আমার সন্তানদের নিরাপত্তা দিতে পারতাম না।”

টনির কথাতে কেমন যেন কোণ-ঠাঁসাহয়ে পড়লাম। আমার পুরোনো নিস্তরঙ্গ জীবন ফিরে পেতে হবে। আর এই খুনীর উপদেশ-মার্কা কথার যথাযথ প্রত্যুত্তর দিতে হবে। খালি পেটে হুইস্কি ততক্ষণে কাজ করছে।অনেকটা ঘোরের মধ্যে বললাম, “তুমি কি অ্যাব্রাহামকে হত্যা করেছ? আর তার পুরস্কার হিসেবে তোমাকে এখানে মার্শালরা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছে?”

টনি আমার কথায় অপ্রস্তুত হয় না, রেগেও যায় না, কিছু বলেও না। আমার মনে হল সে মিটি মিটি হাসছে।বলে, “তুমি আলপোর কথা বলছ?” আর এক ঢোঁক হুইস্কি খাই,উত্তেজিত কন্ঠেবলি, “বাংলায় একটা কথা আছে, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা, মার্শালরা তোমাকে ভালই ব্যবহার করেছে।”

টনি এবার হো হো করে হেসে ওঠে, বলে, “স্প্যানিশে এরকম একটা প্রবচন আছে un clavosacaa otroclavo, এক পেরেক আর পেরেককে বের করে দেয়। কিন্তু এই কাজটা আমাকে মার্শালরা করায় নি। হার্লেমে আমার সহযোগী বন্ধুকে আলপো নিজ হাতেখুন করেছিল। তার বদলা নেবের জন্য আমি অপেক্ষা করছিলাম। আমি জানতাম আলপো মেইনে পুনর্বাসিত হয়েছিল, কিন্তু এখানে এই নির্জন জায়গায় এসে তাকে মারা খুব কঠিন হত। অপেক্ষা করছিলাম সে আবার কবে হার্লেমে ফিরে আসবে। আমার গণনা ভুল হয়নি, ঠিক ফিরে এসেছিল।”

“মার্শালরা কি জানে এই কথা?” কথা বলতে গিয়ে আমার জিভ জড়িয়ে যায়।

“না, তারা হয়তো আন্দাজ করছে, কিন্তু তাদের কাছে আমি এটা স্বীকার করিনি।”

হুইস্কি আমার মাথা ঘোরাতে থাকে। এর পরে আমি কী বলেছিলাম ঠিক স্মরণ নেই, হয়তো বলেছিলাম, “টনি, আমি একটা সরল জীবন গড়তে চেয়েছিলাম, অ্যাব্রাহাম আর তুমি সেটা নষ্ট করে দিলে। হয়তো বলেছিলাম, “টনি, তোমাকে ঘৃণা করি।” হয়তো এসবের কিছুই বলিনি। হয়তো আমার স্ত্রীর কথা বলেছিলাম, সেসব মনে নেই। সেই সন্ধ্যাটা এখনওএক ধোঁয়াশার মধ্যে বাস করে। সেই রাতে টনি কখন চলে গিয়েছিলে খেয়াল নেই, বাইরের ঘরে সোফার ওপর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে।

পরদিন সকালে বাইরের দরজায় কলিং বেলের আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায়। আমাকে উঠে দরজা খুলতে হয় না, দরজা খোলাই ছিল, রাতে বন্ধ করিনি। ঘরের ভেতর আধো অন্ধকার। প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না কোথায় আছি, এটা সকাল না সন্ধ্যা। প্রচণ্ড মাথা ব্যথায় সোফা থেকে মাথা তুলি। দেখি টনি ঘরের ভেতর। ও বলে, “সকাল সকাল তোমার ঘুম ভাঙালাম।”

শোয়া থেকে উঠে বসি, বলি, “কী হয়েছে?” তখনই দরজা ঠেলে ঢোকে আরো দুজন। ঘরের অল্প আলোতেও তাদের চিনতে পারলাম – সেই কালো আর বাদামী ওভারকোট, ফেডেরাল মার্শাল দুজন। মাথাটা ডান হাত দিয়ে টিপতে টিপতে বলি, “টনি তোমার জন্য পুলিশ এসেছে, ওরা সব জেনে গেছে। অ্যাব্রাহামকে তুমি…,”বলতে বলতে জিভ জড়িয়ে যায়, চোখ বন্ধ হয়ে আসে।

এরপরে অনেকক্ষণ কারুর কথা শুনি না, তারপর নিস্তব্ধতা ভেঙে দূর থেকে টনির কথা ভেসে আসে, “আমি দুঃখিত, অমল, এরা আমার জন্য আসেনি।”

বাদামী কোট আমার সামনে দাঁড়ায়, বলে, “আপনার স্ত্রীর দেহ আমরা খুঁজে পেয়েছি। এবার বরফ গলতে শুরু করলেই উন্মুক্ত কাদামাটির মধ্যেই সেটিকে পাওয়া যায়।”

টনি ওদের বলে, “ও মাটি খুঁড়তে তেমন অভ্যস্থ নয় মনে হয়, বেশি গভীরে যেতে পারেনি। ওর আমার ড্রাইভওয়ের তুষার পরিষ্কার করার স্টাইল দেখেই সেটা বুঝতে পেরেছিলাম।”

কাল রাতে টনিকে কী বলেছিলাম মনে করার চেষ্টা করি। বলি, “আমার খুব মাথা ব্যথা করছে, আমাকে একটু সময় দিন।”

শীত আমাদেরকে রেখেছিল উষ্ণ করে, পৃথিবীকে এক বিস্মৃতির তুষারের আবরণে ঢেকে –এলিয়ট আরো লিখেছিলেন। সেই আবরণটি আমার জন্য রইল না।

৮.

বহু বছর কেটে গেছে এর পরে। আমি এখন মরুভূমির মধ্যে একটি বিশাল দালানের একটি ছোট ঘরে থাকি।আমার একটি জানালা আছে, তাতে নিচের খেলার মাঠটি ছাড়িয়ে, একটা উঁচু কাঁটাতারের দেয়াল পার হয়ে দূরে কিছু যোশুয়া গাছ দেখা যায়। এখানে ঋতুর পরিবর্তন নেই। মেইনের ঋতুগুলিকে আমি খুব মিস করি।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত