| 28 মার্চ 2024
Categories
ইতিহাস

তাঁদের হাত ধরেই বাঙালি পেলো দর্জি । শুভাশিস মৈত্র

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

ঢাকার বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত আরবি, ফারসি উর্দু শব্দের অভিধান’-এর পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে মনে হচ্ছিল, সত্যি, বাংলা ভাষার গ্রহণ করার ক্ষমতা কী বিরাট। আবার এটাও ঠিক, গ্রহণ যতটা হচ্ছে, ব্যবহার কি ততটা হচ্ছে? নবারুণ ভট্টাচার্য একবার বলেছিলেন, বাংলাকে আমরা কলকাতাবাসীরা কিছুটা মিন মিনে করে ফেলেছি। আর তা করতে গিয়ে অনেক সম্পদ আমরা হারিয়েছি। যে অভিধানের কথা বললাম, তার পাতায় পাতায় চেনা শব্দ নিয়ে চমক। কয়েকটা আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দের নমুনা এখানে দিচ্ছি, যা আমরা নিয়মিত আমাদের কথায় ব্যবহার করি। যেমন, অংশীদার, অছিলা, অজুহাত, অদল-বদল, অরাজি, অন্দর-মহল, অম্বর, আস্তর(ণ), আইন মাফিক, আজব, আদল, আবহাওয়া, আমদানি, আমল, আলবোলা, আলখাল্লা, আলতু-ফালতু ইত্যাদি ইত্যাদি। বা ধরা যাক ইনকিলাব জিন্দাবাদ।

আজকাল যত নেতা-মন্ত্রীদের মুখে কথায় কথায় ভারতমাতা কি জয় স্লোগান শোন যায়, আগে ততটা যেত না।  হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির প্রধান স্লোগান জয়শ্রীরাম এবং ভারতমাতা কি জয়। ভারতমাতা কি জয়, সকলেই বলেন, মানে যারা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি করেন না, তাঁরাও বলেন। ভারতমাতার ছবিটা যিনি এঁকেছিলেন, সেই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁর ভাবনা ছিল, আজকের হিন্দুত্ববাদীদের রাজনীতি থেকে অনেক দূরে। যাঁরা ভারতমাতা কি জয় বলে স্লোগান দেন, তাঁরা আবার কিছুতেই ইনকিলাব জিন্দাবাদ বলেন না। ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদ, রামপ্রসাদ বিসমিল, আসফাকুল্লা খান, ভগত সিং, চন্দ্রশেখর আজাদ-দের সংগঠন ‘হিন্দুস্তান সোসালিস্ট রিপাবলিক অ্যাসোসিয়েশন’-এর স্লোগান ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। এই স্লোগানের জন্মদাতা স্বাধীনতা সংগ্রামী উর্দু কবি হসরত মোহানি।

ভারতমাতা কি জয় বলতে কারও কোনও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। হয়ও না। বিরোধী নেতা-নেত্রীদের অনেকেই বক্তৃতার শেষে বলেন, ভারতমাতা কি জয়। কিন্তু ভগত সিং-দের স্লোগান ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’, কোনও হিন্দুত্ববাদী নেতা-নেত্রীর মুখে প্রায় শোনাই যায় না। বোঝা যায় রাজনৈতিক অসুবিধে আছে। গোবলয়ের হিন্দুত্ববাদীদের দেশের বাইরে থেকে আসা শব্দ নিয়ে অঘোষিত আপত্তি আছে। অথচ এই বাংলায়, মুসলমান সংস্কৃতির সঙ্গে ভারতের সংস্কৃতি, হিন্দুদের সংস্কৃতি কী ভাবে মিশে রয়েছে একবার আসুন সেটা দেখে নিই। বিশিষ্ট পণ্ডিত ড: শহিদুল্লাহ তাঁর বইয়ে দেখিয়েছেন, কী ভাবে তখতপোষ, তোষক, তাকিয়া, বালিশ, এবং গালিচার ব্যবহার বাইরে থেকে আসা মুসলমানদের থেকে বাঙালিরা শিখেছে। মুসলমান ধর্ম আসার আগে বাঙলায় এগুলোর চল ছিল না।

মুসলমান আগমনের আগে হিন্দু বাঙালির পোশাক ছিল ধুতি, গায়ের কাপড় উড়ানি, জুতো এবং মহিলাদের শাড়ি। বাঙালি হিন্দু এবং বাঙালি মুসলমান সেলাই করা পোশাক পরা শেখে বাইরে থেকে আসা মুসলমানদের থেকে। মুসলমান আসার আগে বাঙালিদের মধ্যে দর্জি বলে কোনও পেশা ছিল না। যে কারণে এখনও পূজা-পার্বণে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হিন্দু বাঙালি সেলাই-ছাড়া পোশাক পরে। মুসলমানের কাছে হিন্দু বাঙালি জামা, মোজা, কামিজ, রুমালের ব্যবহার শিখেছে। আপনি গোটা রামায়ণ মহাভারত খুঁজে কোনও রুমাল পাবেন না। আতর, গোলাপজল, সাবান, চশমার ব্যবহার আমরা শিখেছি মুসলমানের থেকে। ঢোল (দহল), সেতার, তবল, রবাব নামের বাদ্যযন্ত্র মুসলমানের হাত ধরে ভারতে প্রবেশ করেছে। পোলাও, কোর্মা, কোফতা, কালিয়া, কাবাব, সিরকা, আচার, মোরোব্বা, শরবত, শিন্নি, পনির, চিনি, হালুয়া বাঙালি খেতে শিখেছে মুসলমানের কাছে। মুসলমানরাই এদেশে শালগম, তরমুজ, খরবুজ, নাশপাতি, তুত, পেস্তা, বাদাম, আঙুর, মুনাক্কা, এবং পুদিনা এনেছে।

আগে হাট বসত সপ্তাহে একদিন বা দু’দিন। এখনও অনেক জায়গায় সে নিয়ম আছে। সব সময় যেখানে জিনিসপত্র খরিদ করা যায়, এমন বন্দোবস্ত আগে বাংলায় ছিল না। মুসলমান আসার পর বাজার, দোকান, মুদিখানা যাত্রা শুরু হয়। আর হিন্দু বাঙালি শিখল নতুন শব্দ, পাল্লা, মুনাফা, লোকসান, নমুনা, বদল, রসিদ, বেবাক, বাকি, ফাজিল, জমা, খরচ, হিসাব, নিকাশ, তহবিল, ফর্দ, বায়না, সরবরাহ, মৌজুদ, দাদন,নগদ, মন, সের, গজ ইত্যাদি।

মনুস্মৃতিতে হিন্দুদের যে আইন ছিল, সেখানে একই দোষে একেক জনের ছিল একেক রকম সাজা। উঁচুজাত ব্রাহ্মণের জন্য একরকম নিদান, শূদ্রের জন্য ভিন্ন রকমের শাস্তি। ব্রাহ্মণ যদি একজন শূদ্রকে হত্যা করে শাস্তি সামান্য প্রায়শ্চিত্ত। সেটা নাকি একটা পেঁচা হত্যার সমান দোষ। আর শূদ্র যদি ব্রাহ্মণ হত্যা করে, তার শাস্তি মৃত্যুদন্ড। এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। সেই কারণেই যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যে হাথরাশে যখন দলিত মেয়েকে ধর্ষণ করে উঁচু বর্ণের অপরাধীরা তার জিভ কেটে নেয়, পুলিশকে দেখা যায়, দোষীদের ধরার থেকেও অতি ব্যস্ত হয়ে উঠতে মাঝরাত্তিরে গোপনে ধর্ষিতার মৃতদেহ পুড়িয়ে দিতে। যা কার্যত প্রমাণ লোপাটের সমান অপরাধ। মুসলমানরাই প্রথম এই দেশে ব্রাহ্মণ থেকে চণ্ডাল, সবার জন্য এক আইন চালু করে। সেই কারণেই উকিল, মোক্তার, আইন-কানুন, এগুলো একটাও সংস্কৃত শব্দ নয়। এই সব বৃত্তিও চালু হয় মুসলমান আমলে।

এভাবেই সাল, তারিখ,রোজ, ওজর, কর্জ, ক্রোক, স্তিহার, খাজনা, খুন, জখম, জবাব, জবানবন্দি, জমা, জমি, জায়গা, জল্লাদ, জাল, জোর, দখল, দফা, দাগি, দাঙ্গা, নকল, নাবালক (ফার্সি- বালেগ থেকে), নালিশ, পেশা, ফেশাদ, ফসল, ফেরেব, ফেরার, বাকি, বাতিল, বাবৎ, রায়ত, মাফ, মুনিব, রদ, রাজি, রফা, সাজা, সুদ, হক, হুকুম ইত্যাদি আরবি, ফার্সি শব্দ বাঙালির অস্থি-মজ্জাগত হয়ে ওঠে। মুসলমান বাদশা, নবাবদের দেওয়া উপাধি কানুনগো, সরখেল, মহলানবিশ, খাশনবিশ, মল্লিক, রায়, সরকার, খাঁ, মজুমদার, মুস্তফি, মুনশি প্রভৃতি আমাদের সবার পরিচিত। ড: শহীদুল্লাহ তাঁর প্রবন্ধে প্রশ্ন তুলেছেন, একটি বাইরে থেকে আসা শব্দ, অন্য ভাষা থেকে বাংলায় এসে, একটি দেশি শব্দের পাশে বসে,  যেমন নতুন মানে তৈরি করে,  যেমন, উদাহৃণ হিসেবে তিনি বলেছেন, ধন-দৌলত, গরিব-কাঙাল, হাট-বাজার, জিনিস-পত্র, লজ্জা-শরম, চালাক-চতুর, কাণ্ড-কারখানা, লোক-লস্কর, খানা-খন্দ, শাক-সবজি, ঝড়-তুফান, মুটে, মজুর, হাসি-খুশি, এরা একে অপরের গলা জড়িয়ে আমাদের বাংলা সংস্কৃতিতে জায়গা করে নিয়েছে, তেমন করে হিন্দু-মুসলমান কি গলা-গলি করে থাকতে পারবে না? ঝগড়া-ঝাঁটি কোথায় নেই! সর্বত্র আছে। কিন্তু শত শত বছরের এই মিলনের সংস্কৃতিকে আমরা ভুলে যাব? তাই কখনও হয়!

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত