অলৌকিক আলাপন
কলকাতার বেথুন স্কুল ও কলেজের মূল প্রবেশ দ্বারের সামনে বসে ডিউটিরত দারোয়ান বসে বসে নিশ্চিন্তে ঢুলছে। অনতিদূরে একটি গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছেন এক প্রৌঢা, মাথায় দীর্ঘ ঘোমটা। সামনে দিয়ে হনহনিয়ে হেঁটে যাওয়া আরেক বৃদ্ধ থমকে দাঁড়ান। সময় রাত্রি নটা থেকে সাড়ে নটা। মাত্র একদিন আগে ভয়ঙ্কর এক ঝড়ের তান্ডবে প্রাচীন অভিজাত কলেজটির অনেক অংশ ভেঙ্গে পড়েছে। ঝড় তখনো শান্ত হয়নি। বৃদ্ধের সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানের পরিচয় নিবিড়। তাঁর নাম পন্ডিত ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, প্রৌঢা রমনীটিও আদ্যন্ত শিক্ষাব্রতী। মারাঠী এই রমণীর নাম সাবিত্রীবাই ফুলে।
বিদ্যাসাগর : কে আপনি মা? এই ঝড় বাদলের রাত্রিতে একা একা এখানে দাঁড়িয়ে আছেন? আগে তো আপনাকে কখনো দেখিনি এ তল্লাটে?
সাবিত্রী : মহাত্মা, আমায় দয়া করে আপনি সম্বোধন করবেন না। আমি খুব নীচু জাতের মেয়ে, দলিত। আমার বাবা ছিলেন চাষী আর আমার শ্বশুর বাড়ির বংশে সবাই ফুলের কারবার করে, তারা মালি সম্প্রদায়ের।
বিদ্যাসাগর: তা হোক, কিন্তু এই দুর্যোগের রাতে কোথায় যাবেন মা? আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি বাঙ্গলা ভাষাটা ঠিক বলতে পারেন না। বাড়ি কোথায়? এখানে সঙ্গে কেউ আছে?
সাবিত্রী: না মহাত্মা। আমি কলকাতায় এসেছিলাম শুধুমাত্র আপনার সঙ্গে দেখা করব বলে। কিন্তু এমন ঝড়ে আটকা পড়ে যাব ভাবিনি। দারোয়ান বল্ল, রোজ রাতে আপনি নাকি একবার করে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসেন , তাই দেখা করার আশায় বসে ছিলাম।
বিদ্যাসাগর: সে কথা সত্য। আমার বন্ধু বিটন সাহেবের কত স্বপ্নের এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রথমে হল স্কুল , তারপরে কলেজ, এই জায়গার প্রতিটি কোনায় আমার ভালবাসা গাঁথা আছে। তাই রোজ একবার করে— কিন্তু আপনি আমার সঙ্গে বাড়িতে দেখা করলেন না কেন? আমার বাড়ি কাছেই, বাদুড়-বাগানে।
সাবিত্রী: সে কথা ভাবিনি যে তা নয়, কিন্তু লজ্জা করল। আসলে চিরকাল ব্রাহ্মণেরা আমাদের দেখলেই দূরদূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। মানুষ বলেই ভাবেনি। যদিও শুনেছি, আপনি ব্রাহ্মণ হলেও তেমন ধারার লোক নন ।আপনার কথা আমি লোক মুখে অনেক শুনেছি। তাই সাক্ষাত করার বড় লোভ ছিল। আর আমার সবামীও বলেছিলেন , এমন মানুষের সঙ্গে দেখা করতে হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে করাই ভাল।
বিদ্যাসাগর: রাম রাম। ছ্যা! এই বুড়ো বিটলে বামুনকে কেউ পছন্দ করেনা একথা বুঝি জানেন না? আমি মেয়েদের চোখ ফোটাতে উঠে পড়ে লেগেছি, তারা বই পত্তর পড়ে সব জেনে বুঝে ফেললে নাকি মহা প্রলয় ঘটে যাবে। আমি আবার বিধবাদের বিয়ে দিই , নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে। আমি কি কম পাজি লোক!
সাবিত্রী: কিন্তু মহাত্মা, আপনি মেয়েদের সামনে কত আলো ধরেছেন, সে কথা মেয়েরাই জানে, হয়তো তারা মুখ ফুটে সব সময় বলতে পারেনা। কিন্তু আমি তো আপনার কথা শুনেছি কতজনের মুখে। আপনি ব্রাহ্মণ হলেও সাক্ষাত ঈশ্বর, আপনার মনে সবার জন্য কত দয়া। আপনাকে একটা প্রণাম করতে পারি? তবে আমি কিন্তু অচ্ছ্যুত কন্যা।
বিদ্যাসাগর: তাহলে তো দেখছি, আপনি আমার সম্বন্ধে তেমন কিছু জানেন না। আমি মানুষকে জাত–পাত দিয়ে বিচার কখনই করিনা। তবে প্রণাম করার দরকার কি? আর অচেনা স্ত্রীলোকের প্রণাম আমি নেব কেন?
সাবিত্রী: চেনা নাই বা থাকল, না হয়, বয়সে অনেক ছোট, ভগিনীসমা এক কন্যা বলেই আমার প্রণাম গ্রহণ করুন মহাত্মা।
( সাবিত্রী প্রণত হয়)
বিদ্যাসাগর: থাক মা থাক, এত রাতে বারাঙ্গণা ছাড়া আর কোন কূলবধূ এই ঝড়জলের শহরে ঘরের বাইরে বেরোয় না। এখন কি দরকার তাই বলুন,ছেলের লেখাপড়ার খরচ চাই, না মেয়ের বিয়ের জন্য কিছু সাহায্য? নাকি মেয়ে বিধবা হয়েছে, তাই — লোক -লজ্জায় দিনের বেলায় সে কথা বলতে পারেন নি।
সাবিত্রী: না মহাত্মা, সে সব দরকার আমার নেই। আর আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, আমি বারাঙ্গণা নই। যদিও মেয়েরা একটু শিক্ষিত হলে তাদের বারাঙ্গণা বদনাম দিয়ে দমিয়ে রাখা যায়। আসলে আপনার কাছে আমার খুব জানার ইচ্ছে ছিল মেয়েদের কত দূর লেখাপড়া শেখাতে আপনি আন্তরিক ভাবে আগ্রহী ছিলেন। তারা লেখাপড়া শিখে শিক্ষয়িত্রী হোক, নিজের পায়ে দাঁড়াক সে কি আপনি চাননি?
বিদ্যাসাগর: কে বাপু আপনি রাত দুপুরে বিদ্যাসাগরের কাজের কৈফিয়ত চাইছেন? আমি সারাজীবন মেয়েদের ভাল-মন্দ নিয়ে ভেবে গেছি, নিজের পরিবারের দিকে তেমন করে তাকাইনি। শুনুন তাহলে, এ দেশে মেয়েরা পড়ুক এটাই এই সমাজের কেউ চায়নি। বিটন সাহেব চেয়েছিলেন , আমি চেয়েছিলাম। তাই তো মেয়েদের ইস্কুলে পড়ানোর জন্য তাদের বাড়ি থেকে আলাদা গাড়িতে যাতায়াতের ব্যবস্থা করে , সেই গাড়ির গায়ে মহানির্বাণতন্ত্রের মন্ত্র লিখে দিয়ে ছিলাম – কন্যাপেবং পালনীয়া- শিক্ষণীয়াতিযত্নত — বাঙ্গলা দেশের জেলায় জেলায় কত মেয়েদের ইস্কুল করেছি তা জা্নেন ? কত বিধবার চোখের জল মুছিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়েছি? লোকে গুণ্ডা লাগিয়ে আমায় মেরে ফেলতে চেয়েছে। তাও কাউকে খুশি করতে পারিনি, না পরিবারে, না স্বজাতীয় মানুষকে।
সাবিত্রী: মাপ চাইছি মহাত্মা, ওভাবে বলা আমার সত্যিই উচিত হয়নি। একটা কথা , আমায় আপনি বলবেন না। আমি আপনার থেকে বয়সে, শিক্ষা দীক্ষায় অনেক ছোট। আসলে আমি তো ছোট থেকেই জেনেছি, মেয়েরা মুখ বুজে সব সইবে, আলোর মুখ তারা দেখবেনা। তাহলেই তাদের পাপ হবে। আমার সবামী জ্যোতিরাও ফুলে আমায় কিন্তু সেই আলো চিনিয়েছিলেন। তাই ন বছরের অশিক্ষিত একটা মেয়েকে বিয়ে করে সতেরো বছরেই তাকে মেয়ে- ইস্কুলের হেড দিদিমণি করে দিয়েছেন, সেই ১৮৪৮ সালে, আপনাদের এই বেথুন ইস্কুল হওয়ার এক বছর আগে। দলিত পরিবারের মেয়ে হয়েও মহারাষ্ট্রের পুণায় একটা ইস্কুল তৈরি করে, ওই আপনার কথামত মেয়েদের চোখ ফোটানোর ব্যবস্থা করতে পেরেছিলাম।
বিদ্যাসাগর: তাই নাকি? বেশ! বেশ! ! কি নাম তোমার?
সাবিত্রী: আজ্ঞে সাবিত্রী! আমি সাবিত্রী, সাবিত্রী বাই ফুলে।
বিদ্যাসাগর: হ্যাঁ সাবিত্রী। তুমি কি জান শিক্ষিত মেয়েদের আমি কত পছন্দই করি? চন্দ্রমুখীর নাম শুনেছ? ভারতে মেয়েদের মধ্যে প্রথম গ্রাজুয়েট। আরেক জনও ছিল, কাদম্বিনী। সে গেল ডাক্তারি পড়তে। আর চন্দ্রমুখী ইংরেজিতে এম এ পাস করে এই বেথুন কলেজে পড়িয়েছে, পরে প্রিন্সিপ্যাল হয়েছে। তাকে আমি নিজের হাতে সেক্সপীয়রের রচনা উপহার দিয়েছি। তুমি তো বাপু শুনছি শুধু পড়াও না, ইস্কুল অবধি তৈরি করে ফেলেছ। তা তোমার সেই ইস্কুল এত সহজেই গড়ে উঠল? তোমাদের ওই মারাঠা দেশের মানুষ তাহলে বলতেই হয় বেশ ভদ্র সভ্য, আমাদের বাঙ্গলা দেশের মত নয়।
সাবিত্রী: না মহাত্মা, শুরুতে কাজটা তেমন সোজা ছিলনা। আমার জন্য তো মোটেই নয়। আমাদের দেশে দলিত ঘরের ছেলে – মেয়ে কেউ পড়ার সুযোগ পায়না। জানেন , ইস্কুল যাওয়ার পথে লোকে ঢিল ,পাথর, কাদা, গোবর ছুঁড়ে মারত। বেশ্যা বলে গালাগালি দিত। আমি ইস্কুলে পৌঁছে কাপড় বদল করে নিতাম ,তারপর মেয়েদের পড়াতাম। আবার ফেরার পথে সেই কাদা মাখা শাড়ি পরা —- অনেক যুদ্ধ করেছি। ব্রাহ্মণ , শূদ্র সবার চোখেই আমাদের এই শিক্ষা দেওয়ার কাজটাকে অপরাধ বলে ভাবা হোত।
বিদ্যাসাগর: তোমার সেই ইস্কুল এখনো —
সাবিত্রী: হ্যাঁ মহাত্মা। আমাদের সেই প্রথম ইস্কুল ছিল পুণের ভিডেওয়ারা অঞ্চলে— সমাজে ছোট জাতের তকমা পাওয়া মেয়েদের পড়ার জন্য ইস্কুল। সারা ভারতে প্রথম মেয়েদের ইস্কুল। তার জন্য আমার স্বামী এবং আমাকে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। আমরা কিন্তু হারিনি, ভেঙ্গে পড়িনি। আমরা এরকম আঠারোটা মেয়েদের ইস্কুল করেছি। আমরা ইস্কুলে পড়ানোর জন্য বেছে নিয়েছি অঙ্ক, বিজ্ঞান , সমাজ- বিদ্যার মত বিষয়। কিন্তু বেদ, শাস্ত্র-পাঠ পড়ানোতে আগ্রহ দেখাতে চাইনি।
বিদ্যাসাগর: বাহ! চমৎকার! আমি মেয়েদের কেন, ভিন্ন জাতের ছেলেদেরই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ করে দিতে পারিনি, এ যে আমার কত বড় আফসোস!
সাবিত্রী: আমি আমার স্বামীর কাছে শুনেছি আপনি অনেক চেষ্টা করেছিলেন , কিন্তু শুধু বেথুন স্কুল কেন , সংস্কৃত কলেজে অধ্যক্ষ হয়ে থেকেও আপনি সমাজের সবার জন্য শিক্ষার দরজা খুলে দিতে পারেন নি। অথচ আপনি কত বড় পন্ডিত, তার ওপর সমাজের উঁচু জাতের মানুষ। কত পরিশ্রম করেছেন , সরকারের কত প্রিয়পাত্র ছিলেন আপনি ।
বিদ্যাসাগর: শুরুতে বুঝিনি, অনেক আশা, উদ্যম নিয়ে এগিয়ে ছিলাম । পরে দেখলাম , সমাজ খুশি মত জাত-পাতের হিসেব বুঝে নেয়। এখানে ব্রাহ্মণ -পন্ডিত আর অচ্ছ্যুত কন্যার দাম একই রকম। আমার দেশের লোকেরা এত অসার আগে জানলে এমন কাজে এগোতাম না। কিংবা , পুরোটাই আমার আরেক ব্যর্থতা । জীবনে আমার অনেক কাজই পন্ড হয়েছে, এও তার মধ্যে একটি। মেয়েরা শক্তির আধার সেটা স্বীকার করতেই হয়। স্ত্রীলোকের বয়স জিজ্ঞাসা করতে নেই , তাও যদি বলি —
সাবিত্রী: না না, বলতে সংকোচ হবে কেন ? আমি আপনার থেকে এগার বছরের ছোট। জন্মেছি ১৮৩১ সালের ৩রা জানুয়ারি। আপনি তখন কলকাতায় সংস্কৃত কলেজের ছাত্র। ঠিক বলিনি?
বিদ্যাসাগর: না বাপু, সবীকার করতেই হয়, তুমি বেশ সপ্রতিভ। এবং কাজের মেয়ে। এরকম মেয়ে আমাদের দেশে খান কয়েক থাকলে আমিও মেয়েদের দিয়ে ট্রেনিং স্কুল খুলতে আপত্তি করতাম না। যে দেশে মেয়েদের সাত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে ইস্কুলের সঙ্গে সম্পর্ক ঘুচিয়ে দেওয়া হয়, তারা আবার ট্রেণিং ইস্কুলে কি করে যাবে? তাইতো মেরি কারপেন্টারের নর্মাল ইস্কুল করার প্রস্তাবে আমি সায় দিইনি। আসলে কি জান, একটা ডানায় ভর দিয়ে তো আর আকাশে ওড়া যায় না।
সাবিত্রী: হ্যাঁ মহাত্মা, আমার স্বামী আমায় খুব যত্ন করে বাড়িতেই পড়াশুনো শিখিয়েছিলেন। আপনার মত তিনিও মেয়েদের বাল্য –বিবাহের বিরোধিতা করেছেন, আর বিধবা –বিবাহকে সমর্থন করেছেন। আমাকে তিনি আমেদাবাদে মিশনারিদের ট্রেনিং ইস্কুলে আর পুণার নরমাল ট্রেনিং ইস্কুলে পড়িয়েছেন। আমাকে ওড়ার জন্য আকাশ আর ডানা দুটোই তৈরি করে দিয়েছিলেন। তাই তো সারা ভারতে আমিই সেই প্রথম মেয়ে যে লেখাপড়া শিখে শিক্ষকতাকে পেশা করেছে।
বিদ্যাসাগর: বাহ! এ তো অতি উত্তম সংবাদ। এখন মনে হচ্ছে হয়ত তোমার কথা আগে আমি কোন সংবাদ পত্রের মাধ্যমে জেনেছি। কিন্তু ঠিক স্মরন করতে পারছি না। তোমার স্বামী ভাগ্যবান, এমন একটি স্ত্রী- রত্ন তিনি পেয়েছেন । সবার ভাগ্যে এমন জোটেনা।
সাবিত্রী: ওকথা বলে আমায় লজ্জা দেবেন না। আমি ছিলাম নেহাত কাদার তাল। তিনি আমায় ধৈর্য ধরে তাঁর যোগ্য করে গড়ে তুলেছেন। নিজে লেখাপড়া শিখে আমাকেও পাশে টেনে নিয়েছেন। উৎসাহ দিয়েছেন মেয়েদের নিজের অধিকার বিষয়ে সচেতন করার জন্য মহিলা সেবা মন্ডল গড়ে তুলতে। তাঁরই নির্দেশে তৈরি হয়েছে অব্রাহ্মণদের জন্য সত্য শোধক সমাজ , যেখানে পণহীন, ব্রাহ্মণ পুরোহিতবিহীন, প্রথা বিহীন ভাবে নর-নারীর বিয়ে দেওয়া হয়েছে, এমনকি অসবর্ণ বিয়েও। আচ্ছা যদি অপরাধ না নেন, একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করে, এত শক্তি, উৎসাহ নিয়েও আপনি আপনার নিজের স্ত্রী অথবা কন্যাদের লেখাপড়া সেভাবে শেখাতে পারলেন না। কেন মহাত্মা?
বিদ্যাসাগর: হ্যাঁ! সবাই সে কথা বলে, আমায় দোষের ভাগী করে। সবার কথাই বা কেন, আমি নিজেও তো নিজেকে অপরাধী ভাবি। কিন্তু তুমি কি জান সংসারে ইচ্ছে থাকলেও অনেক কিছু করে ওঠা যায় না? আমার বাবা, মা অনেক বিষয়ে উদারমনা ছিলেন, কিন্তু এই জায়গায় তাঁদের বিরোধিতায় আমি বারবার বিচলিত হয়েছি, প্রতিকারের পথ খুঁজে পাইনি। কাকে বোঝাব এ লজ্জা আমায় শান্তি দেয়নি কোনদিন। আরেকটি কথাও হয়ত আছে, চেষ্টা কিছুটা করিনি তা নয়, কিন্তু স্বামীর সহ ধর্মে আমার স্ত্রীর আগ্রহ তেমন ছিল না। আমি সে খোঁজ তেমন করে নিইনি, ধৈর্য রাখিনি।
সাবিত্রী: ক্ষমা করবেন, আমার এত জানা ছিলনা। তাই নির্বোধের মত প্রশ্ন করেছি। কিন্তু, আরেকটা প্রশ্ন, আপনার লেখা কত প্রাইমার, কত যত্ন করে,কত যুক্তি দিয়ে , নিষ্ঠা দিয়ে লিখেছেন। সেই বইয়ের পাতায় পাতায় শুধু বালকদের কথা লিখলেন। বালিকারা? তারা কেন আপনার সেই অনুগ্রহ পেলনা? সেখানেও কি সমাজ এসে আপনার চোখ রাঙিয়েছিল ? নাকি বইএর বিক্রি কম পড়বে ভেবে ভয় পেয়েছিলেন?
বিদ্যাসাগর: ঠিক জানিনা, তবে মেয়েদের কথা একেবারে বাদ দিয়েছি তা কিন্তু নয়, কোন কোন জায়গায় বালকের বোনের কথাও লিখেছি। আসল কথা কি জান তো, সব প্রতিরোধ একসাথে গড়ে তুলতে নেই। মেয়েদের লেখাপড়া শেখা্নোর জন্য সমাজ তখন একেবারেই অপ্রস্তুত, তাই হয়ত ভয় পেয়েছি। আমার পরিবার ছিল অনেক বড়। কত ভাই বোন , মা , বাবা, স্ত্রী পুত্র-কন্যা, আত্মীয় – প্রতিবেশী। সবাই আমার মুখাপেক্ষী, কত দায় –দায়িত্ব—- আমি তো স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাড়ি ছেড়ে সমাজ সেবা করতে পারিনি। পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে স্ত্রীকে শিক্ষিত করতেও দ্বিধা বোধ করেছি। আমার কথা থাক, তোমার সন্তানরা লেখাপড়া শিখেছে তো? বিশেষতঃ তোমার মেয়েরা?
সাবিত্রী: মহাত্মা জৈবিক নিয়মে আমি নিঃসন্তান। এক ব্রাহ্মণের পুত্রকে দত্তক নিয়েছিলাম। সেই আমার সন্তান।
বিদ্যাসাগর: পুত্র সন্তান। বা বেশ! কিন্তু কন্যাসন্তান দত্তক নিতে কি তুমিও ভয় পেয়েছিলে?
সাবিত্রী: ছিঃ! তা কেন হবে ? আমার কত মেয়ে জানেন ? আপনি বিধবাদের বিয়ে দিয়েছেন, অনেক খরচ করে। তাদের সবার বিবাহিত জীবন সুখের হয়নি, সমাজের চোখ রাঙ্গানি থামেনি। কিন্তু আমি সেই সব হতভাগ্য মেয়েদের মা হয়ে উঠেছি।
বিদ্যাসাগর: বুঝলাম না বাপু, হেঁয়ালি কোরনা।
সাবিত্রী: আমার মত অচ্ছ্যুত শ্রেণির মেয়েদের জীবন তো আগা-গোড়া লড়াই দিয়ে ঘেরা। তবে এ্টা ঠিক, আমাদের দেশের সব জাতের মেয়েদেরই বড় দুর্দশা। ব্রাহ্মণের মেয়েরাও সেখানে পার পায় না। কত বিধবা মেয়েকে সমাজের উঁচু তলার লোকেরা ধর্ষণ করে গর্ভবতী করে ফেলে পালিয়ে যায়। সেই সব হতভাগিনীদের আমরা সমাজে জায়গা দিয়েছি, মানুষের মত বাঁচার অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছি। না বিয়ে দিইনি। বরং শিশু-সন্তান হত্যা বন্ধ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। আত্মমর্যাদা বজায় না থাকলে বিয়ে তো জীবনের শেষ কথা নাও হতে পারে। আমার স্বামী আর আমি তৈরি করেছি আশ্রম – বালহত্যা প্রতিবন্ধ গৃহ। সেই আশ্রমের সব হতভাগিনী বা তাদের কন্যা সন্তান দের একটাই পরিচয়, তারা সাবিত্রী বাই ফুলের সন্তান।
বিদ্যাসাগর: এবার মনে হচ্ছে মা, তোমার নাম আমি কোন কাগজের রিপোর্টে দেখেছি। আমি তো বিশ্বাস করি, মা শিক্ষিত না হলে সন্তান শিক্ষিত হয় না। মানবিক গুণ-ই বলো আর নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা-ই বলো, শিক্ষার আলো দিয়ে তাকে পালিশ না করলে ভাল কিছু গড়ে তোলা যায় না। তাই তো মেয়েদের ইস্কুলে পাঠানোর জন্য এত লড়াই করেছি। এ কাজে আমার পাশে একজন সত্যিকারের সাধন সঙ্গিনী থাকলে কতদূর যে এগিয়ে যেতে পারতাম। এ জীবনে তা আর হলনা।আমি বড়ই হতভাগা। সারাজীবন যাদের জন্য করলাম সেই বাবা, মা স্ত্রী, সন্তান কাউকে সুখী করতে পারলাম না। পারলাম না নিজের সাধনায় সফল হতে। বড়ই অভিশপ্ত মানুষ আমি—-
সাবিত্রী: মহাত্মা, আপনি কাঁদছেন? আপনি যা করেছেন, এক জীবনের জন্য তা ঢের বেশি। আপনিই তো আমাদের মত কত মানুষের প্রেরণা। আপনার চোখের জলের বিনিময়ে কত মেয়ে জেগে উঠবে, আমার মত কত দলিত মেয়ে স্বপ্ন দেখার সাহস করবে— বিচলিত হওয়া আপনাকে কি মানায়?
বিদ্যাসাগর: মাগো! তোমার কথা শুনলে বুকের ভেতরটা কেমন শীতল হয়ে যায় । শোন মা। , রাত বাড়ছে, ঝড় এখনো থামেনি। দেখেছ কত বড় গাছএর ডাল ভেঙ্গে পড়েছে । আজ দেখে গেলাম, কাল সকালেই মালিকে বলতে হবে এসবের গতি করতে হবে। এরপর আবার মেট্রপলিটন কলেজে গিয়ে দেখতে হবে তার কি অবস্থা। এরা সব আমার বুকের একেকটা পাঁজর। তোমার যা জানার সব কি হল? না হলে কাল আমার বাড়ি এস, তোমাকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াব। তোমার মত মেয়ের একটু সেবা না করলে হয়? কিন্তু তার আগে তুমি কোথায় যাবে বল, তোমাকে সেখানে পৌঁছে দিয়ে আসি। একা মেয়ের রাত করে পথে হাঁটা বড় বিপদের।
সাবিত্রী: বারে! আপনাকে আমি এই রাতে একা যেতে দেব নাকি? কষ্ট করার অভ্যেস আমার অনেক দিনের , আপনারই মত। আমি তো আপনার সঙ্গেই যাব, আপনার আরেক কীর্তির সামনে জীবনে একবার অন্তত দাঁড়াব না? পরাধীন দেশে সম্পূর্ণ বেসরকারি চেষ্টায় গড়ে তোলা মেট্রোপলিটন কলেজটা দেখবনা?
বিদ্যাসাগর: এতো ভারি বিপদ হল! তোমার স্বামী কোথায়? তিনি এই শহরে আছেন তো?
সাবিত্রী: আমার স্বামী মাত্র কিছুদিন আগে দেহ রেখেছেন। তাঁর বড় ইচ্ছে ছিল আপনার সঙ্গে একবার বসে দলিত মেয়েদের শিক্ষার পদ্ধতি নিয়ে কিছু আলোচনা করার। আমার ছেলে – সেও বল্ল, যাও ইচ্ছে যখন হয়েছে, তাঁকে একবার দেখে এসো।
বিদ্যাসাগর: বাপু , আমার ঢের বয়স হয়েছে। শরীরে সেই শক্তিও নেই আগেকার মত। এই শহরে আর তেমন থাকিও না। গরিব সাঁওতালদের সঙ্গে কারমাটরে থাকি বছরের বেশির ভাগ সময়। ওরাই এখন আমার সব। ওই সরল মানুষ গুলো আমায় অন্তত ঠকায় না। বেশ আছি। যে কদিন বাঁচব , ওদের নিয়েই, আর কিছু আশা করিনা—- তবে অনেক বই পড়া বাকি রয়ে গেল এই যা দুঃখ। সারজীবন সমাজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে পড়ার আর সময় পেলাম কই!
সাবিত্রী: মহাত্মা, আপনার সেবা, দয়া, মানবিকতার কত গল্প কতবার শুনেছি, তাই নিজের চোখে আপনাকে দেখার বড় সাধ আমারও ছিল। কিন্তু যা দেখব বলে ভেবে এসেছিলাম, দেখলাম, আপনি তার চেয়েও অনেক অনেক বড়। আমি আপনার পায়ের কাছে বসে আরও অনেক কিছু শিখতে চাই। আমার বয়স মোটে উনষাট। শেখাবেন আমায়? আমরা দুজনে নতুন কিছু ভাবতে পারি তো— আপনার কারমাটরের সাঁওতালদের নিয়ে আর বড় কিছু কাজ —একটি ব্রাহ্মণ শিক্ষাব্রতীর পাশে দাঁড়িয়ে একটি দলিত মেয়ে- শিক্ষাব্রতী যদি কাজের হাত বাড়িয়ে দেয়—- বিশ্বাস করুন মহাত্মা, একটা দলিত মেয়েই কিন্তু পারবে আপনাকে এই কাজে প্রান দিয়ে সাহায্য করতে, একটিবার সুযোগ দেবেন না আমায়?
হঠাৎ আবার প্রবল ঝড় ঊঠল ধুলোয় ভরে গেল চারদিক, গাছপালা ভীষণ দুলতে লাগল। আকাশের বুক চিরে ঘন ঘন বিদ্যুৎ রেখা —তীক্ষ্ণ নীল আলোয় ক্ষণ মুহূর্তের জন্য দেখা হল এক অসাধারণ পুরুষের সঙ্গে আরেক অতুলনীয় নারীর —পৃথিবী কাঁদল আকুল হয়ে—।
রাতভোর বৃষ্টির পর চরাচর আবার শুদ্ধ হল।
তথ্য সুত্রঃ
১। The life and times of Savitribai Phule . Kandukuri Divya . 11th January 2019. www.livemint .com .
২। পিঞ্জরে বসিয়াঃ কল্যাণী দত্ত , প্রকাশকঃ স্ত্রী, কলকাতাঃ ৭০০০২৬, ১৯৯৫।
৩। বিদ্যার ঈশ্বর বিদ্যাসাগর: অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য, আশাদীপ, কল কাতা ৭০০০৯, ২০২০।
৪। করুণা সাগর বিদ্যাসাগরঃ ইন্দ্র মিত্র , আনন্দ , কলকাতা ২০১২।
শিক্ষক,কথাসাহিত্যিক