মানব সভ্যতার ইতিহাসে কখনো কখনো এমন কিছু প্রতিভার আবির্ভাব ঘটে, জগতের আদর্শ বিনির্মাণে তাঁরা যে অবদান রাখেন তা অব্যাহত থাকে যুগ থেকে যুগান্তরে। সৃষ্টিশীল মানুষ মাত্রই সময় ও সমাজ প্রসূত চিন্তাজগতের অগ্রগামী মুখপাত্র। তাঁদের চিন্তা-চেতনা গতানুগতিক অচলায়তনে আবর্তিত হয় না। তাঁরা পার্থিবের সঙ্গে অবলীলায় যুক্ত করেন অপার্থিবকে, জীবনের সঙ্গে জগতকে, ক্ষণিকের সঙ্গে চিরন্তনকে। ফলে প্রাণচাঞ্চল্য যেখানে স্তিমিত, জীবনের গতিবেগ যেখানে স্তব্ধ সৃষ্টিশীল সত্তা সেখানে উচ্চারণ করে উজ্জীবন-সঙ্গীত। তাঁর সৃষ্টির অঙ্গে শোভা পায় দ্রোহের দুঃসাহসিক বার্তা। এই দ্রোহ সর্ববন্ধনমুক্ত ব্যক্তি-মানসের আত্মজাগরণ। আর আত্মজাগরণ ঘটলে মানুষ হয়ে ওঠে নির্ভীক, মুক্ত ও স্বাধীন। এ বিদ্রোহ ব্যক্তির খেয়াল মাত্র নয়, সমষ্টির মুক্তি আকাঙ্ক্ষারও অভিব্যক্তি। নিখিলের নিপীড়িত, বঞ্চিত ও অবহেলিত মানুষের জন্য যে বিদ্রোহ তা মানব-মুক্তির অঙ্গীকার নিয়ে চিরকালই বহমান। সভ্যতার ইতিহাসে গণমানুষের এই বিপ্লব তাই তার অস্তিত্বের মতোই মৌলিক ও চিরন্তন।
ফারসি সাহিত্যে চিন্তা-দর্শনের কাঠামোতে সবচেয়ে আলোচিত কবি ওমর খৈয়াম। বিশ্ববিশ্রুত এই দার্শনিক একাদশ শতকের শেষ ভাগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তৎকালীন পারস্য ছিল পৃথিবীর সাংস্কৃতিক কেন্দ্রবিন্দু। বিচিত্র ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী খৈয়াম তাঁর রুবাইয়াতে জীবন সম্পর্কে বিচিত্র অনুধ্যান, বিশ্বাস ও সুগভীর দৃষ্টিভঙ্গি বিভিন্ন ভাবধারায় অভিব্যক্ত করেছেন। তাঁর রুবাইয়াৎ মানব জীবনের চিরায়ত ভাবনা, জিজ্ঞাসা ও উদ্বেগের সাহসী উচ্চারণ। অপূর্ব অনলস জীবন্ময়তায় নানা অভিনব অথচ চিরপুরাতন জিজ্ঞাসা অভিব্যক্ত হয়েছে তাঁর কাব্যে। তন্মধ্যে তাঁর বিদ্রোহী সত্তা সর্বাধিক উজ্জ্বল; অনিন্দ্য বেদনার অসামান্য রক্তরাগে শিখান্বিত। তাঁর রুবাইয়ের কালজয়ী আবেদন এবং প্রবহমান প্রাসঙ্গিকতার বিচারে কেবল যুগন্ধরই নন, তিনি যুগোত্তীর্ণও বটে।
আলবোর্জ গিরিশ্রেণীর পাদদেশ থেকে আরব সাগরের তটদেশ পর্যন্ত প্রসারিত বিশাল পারস্যভূমি নানা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে একাদশ শতকের ক্রন্তিরেখা স্পর্শ করে। আর্যীয় শাসন, গ্রিক আধিপত্য, আরবীয় দখলদারিত্ব ও মোঙ্গলীয় আগ্রাসন পেরিয়ে পারস্য তখন নবীন স্বাধীনতার আলোকে উদ্ভাসিত। পরাধীনতার গ্লানিমুক্ত হয়ে তারা নিজেদের ভাষা, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এমনই এক সন্ধিলগ্নকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে ও অতিবাহিত হয়েছে খৈয়ামের সৃষ্টির কালসীমা। এই বৈনাশিক বাস্তবতায় খৈয়ামের কবিতার বীরত্ব ও আত্মোৎসর্গের উত্তেজনাময় গৈরিক স্রাব আর মানবতার সি্নগ্ধ পরিবেশনা পাঠককে যুগপৎ বিস্ময় ও তন্ময়তায় অভিভূত করে তোলে। তাঁর প্রত্যেকটি রুবাই হয়ে উঠেছে তাঁর নিজস্ব নিবিড় চিন্তা ও হতাশাজাত বিদ্রোহের বাণীরূপায়ণ। এ বিদ্রোহ শাসক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে, এ বিপ্লব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার বলিষ্ঠ মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ।
খৈয়ামের জীবনের সব চেয়ে দীপ্ত প্রেরণার উৎস হলো শোষণহীন এক সমাজ আর সুস্থ ও বলিষ্ঠ মানবতা সম্বন্ধে গভীর এক প্রত্যাশা আর তার জন্য ক্লান্তিহীন ও আপসহীন সংগ্রামের সংকল্প। সেই আত্মবিশ্বাস থেকেই বিপ্লবীর রক্তে জাগে প্রত্যয়। প্রকৃত ভক্তি ব্যতিরেকে কেবল আচারনিষ্ঠা প্রবল হলে খৈয়াম বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। ভ-ামি আর ফাঁকা ধর্মবোধকে তিনি চিরকাল ঘৃণা ও বিদ্রপ করেছেন। এক্ষেত্রে ওমরের শ্লেষমিশ্রিত সাহসী উচ্চারণ :
হে শহরের মুফতি! তুমি বিপথগামী কম ত নও,
পানোন্মত্ত আমার চেয়ে তুমিই বেুশ বেহুঁশ হও।
মানব-রক্ত শোষ তুমি, আমি শুষি আঙুর-খুন,
রক্ত-পিপাসু কে বেশি এই দু-জনের তুমিই কও।
খৈয়ামের বিদ্রোহ ও মানবপ্রেম অভিন্ন। একই উৎস থেকে এই দুয়ের উদ্ভব। মানবপ্রেমই তাঁর বিদ্রোহের সঞ্চালিকা শক্তি। বিদ্রোহ প্রতিকারের সন্ধান করে, প্রতিবিধানের পথ খোঁজে। গতানুগতিক ও প্রচলিত সংস্কার বিশ্বাসকে তিনি সজ্ঞানে আঘাত করেছেন। সকল অসাম্য বা আরোপিত ভেদাভেদের বিরুদ্ধে তিনি বিদ্রোহী হয়ে উঠেছেন। মানুষের ধর্মজীবন ও সমাজজীবনে যে গ্লানি জন্মে তার বিরুদ্ধেও খৈয়ামের বিদ্রোহ। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে ওমর খৈয়াম প্রত্যক্ষ করেছিলেন অনন্ত নৈরাশ্য। তাই তিনি উচ্চারণ করেছেন গতানুগতিকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বাণী :
এক সোরাহি সুরা দিও, একটু রুটির ছিলকে আর,
প্রিয় সাকি, তাহার সাথে একখানি বই কবিতার,
জীর্ণ আমার জীবন জুড়ে রইবে প্রিয়া আমার সাথ,
এই যদি পাই চাইব না কো তখ্ত আমি শাহানশার।
তাঁর কবিতার ভেতর দিয়ে মানবাত্মার এই আকুতি উপহাস ও বিদ্রোহের আকারে ফুটে উঠেছে। অনেক ক্ষেত্রে খৈয়ামের আস্তিক্য, অদৃষ্ট-নির্ভরতা, নৈরাশ্যবোধ ও জীবনবাদী মনোভাবের পরিচয় পাই। তিনি স্বর্গ-নরকের ব্যাপারে উদাসীন। তাঁর দৃষ্টিতে ইহকালের ক্ষণস্থায়ী জীবনকে পরিপূর্ণ ভোগ করে এই পৃথিবীতেই তিনি স্বর্গসুখ লাভের প্রয়াসী। পারলৌকিক স্বর্গ-নরকে তাঁর আস্থা নেই। তিনি নিজের বেছে নেয়া পথেই মুক্তি খুঁজেছেন এবং প্রচলিত উপদেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন :
দরিদ্রেরে যদি তুমি প্রাপ্য তাহার অংশ দাও
প্রাণে কারুর না দাও ব্যথা, মন্দ করার নাহি চাও
তখন তুমি শাস্ত্র মেনে নাই চললে তায় বা কি?
আমি তোমায় স্বর্গ দেব, আপাতত শারাব নাও।
ওমর খৈয়াম উপলব্ধি করেছেন এই জগতের মানুষের আসা-যাওয়া নিতান্তই অর্থহীন। কোনো এক অন্ধকার লোক থেকে মানুষ এ জগতে আবির্ভূত হয়, তারপর স্বল্প সময়ের জন্য বিরাজ করে আবার মহাকালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। সুন্দর এ পৃথিবীতে কবির আগমন-প্রস্থান কেমন এক অস্থিরতার মধ্যে কবিকে নিক্ষেপ করে। ওমর মানব জীবনের এই চিরপুরাতন ও চিরনতুন রহস্য উন্মোচন করার চেষ্টা করেছেন। সর্বদা জানতে চেয়েছেন নিজেকে, নিজের অস্তিত্ব ও চূড়ান্ত সত্যকে।
বিংশ শতাব্দীর বিধ্বস্ত পৃথিবীতে চিরায়ত বিপ্লবের ঝান্ডা উড়িয়ে কাজী নজরুল ইসলামের দীপ্র আবির্ভাব। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে বাংলার বিপ্লব বা সন্ত্রাসবাদের কাল পর্যন্ত তিনি একটা স্বতন্ত্র যুগের সূচনা করেন। যুদ্ধের কারণে পৃথিবীময় তখন আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট চলছে। পরাধীন ভারতবর্ষের নাগরিক নজরুল উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন পরাধীনতার গ্লানি। তাই তাঁর কবিতা পরাধীনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। শুধু পরাধীনতার বিরুদ্ধেই নয় নজরুল তাঁর কাব্যে সামাজিক রক্ষণশীলতা, দারিদ্র্য ও অসাম্যের বিরুদ্ধে আপসহীন লেখনী পরিচালনা করেছেন।
নতুন কবির বলিষ্ঠ প্রকাশভঙ্গি, বিপ্লব ও আশার বাণীর স্পর্শে উচ্চকিত জাতি নতুন প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়েছে। নজরুল কোন বিশেষ যুগ বা সম্প্রদায়ের কবি হয়ে থাকেননি, তিনি হয়ে উঠেছেন মানবতা ও অধিকারবঞ্চিত মানুষের কবি। আত্মসচেতন কবি তাই সাহসের সঙ্গে জানাতে পেরেছিলেন_ বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। এর অভিযান সেনাদলের তূর্য-বাদকের একজন আমি_ এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়। আমি জানি এই পথযাত্রার পাকে পাকে বাঁকে বাঁকে কুটিল ফণা ভূজঙ্গ প্রখর-দর্শন শার্দূল পশুরাজের ভ্রূকুটি। এবং তাদের নখর-দংশনের ক্ষত আজো আমার অঙ্গে অঙ্গে। তবু ওই আমার পথ, ওই আমার গতি, ওই আমার ধ্রুব।
ওমর খৈয়াম মায়াময় এ পৃথিবীকে ভালবেসেছেন। ভালবেসেছেন নিয়তির হাতে ক্রীড়নক পৃথিবীর সকল প্রাণিকে, জয়ধ্বনি করেছেন যৌবনের, প্রশস্তি গেয়েছেন স্রষ্টার। নিষ্ঠুর নিয়তিকে মেনে নিয়ে তিনি ধূলি-ধূসর ধরনীর জয়গান গেয়েছেন। নজরুল খৈয়ামের সংগ্রামী চেতনায় আত্মদর্শন করেছিলেন। খৈয়ামের প্রতি তাঁর এই চেতনাগত ঐক্য ওমর-কাব্য সম্পর্কে নজরুলের ঔৎসুক্য, আসক্তি বা পরিণামে তাঁর রুবাইয়াৎ অনুবাদের মূলে প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে খৈয়ামের জিজ্ঞাসামুখর বক্তব্য হলো_ আঙুরের রস পান যদি অপরাধ হয় তাহলে যারা মানুষের রক্ত পান করে তাদের অপরাধের পরিমাণ করবে কে? আর এক্ষেত্রে নজরুলের দৃঢ় প্রত্যয় যে বিশ্বমানবের জীবন সংগ্রামে নিপীড়িত মানবতার জয় অবশ্যম্ভাবী। নজরুল দিব্য চক্ষে দেখেছেন যে এই ন্যায়ের অভিযানে উৎপীড়িত ও ভোগবাদী যুগের অবসান হয়ে সাম্যের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে :
উৎপীড়িত আর ভোগীদের আসিতেছে কেয়ামত,
ধূলিরেণু হয়ে উড়ে যাবে সব ইহাদের নিয়ামত।
সামলাও মার মারওয়ালা, দেখো পয়মাল হবে সব,
ঊর্ধ্বে নিত্য শুনিতেছ না কি শকুনের কলরব?
যুগে যুগে সৃষ্টিশীল মানুষ স্বদেশকে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করার জন্য, ঔপনিবেশিক দুঃশাসন ও স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার হাত থেকে দেশের মর্যাদা রক্ষায় প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছেন। কাজী নজরুল ইসলাম মানবতার কবি, বঞ্চিত ও উৎপীড়িত জনতার কবি। প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের হতাশা, গ্লানি, নৈরাশ্য এবং স্বাদেশিকতাকে তাঁর কবিতা বলিষ্ঠভাবে ধারণ করেছিল। নজরুলের বিপ্লবী ভাবধারার অনেক কবিতা ও গান উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামী মানুষদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। কবিতার মধ্য দিয়ে নজরুল ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা, আচার সর্বস্বতা ও ভ-ামির মুখোশ উন্মোচন করতে চেয়েছেন। মানুষের ভেতর খুঁজে পেয়েছেন তিনি অপার সম্ভাবনা :
_মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ;_ গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।
প্রথাগত ধর্মাচরণ অনুমোদন ও ঈশ্বর বিশ্বাস এক নয়। ধর্মীয় অনুষ্ঠান সর্বস্বতাকে ওমর ঘৃণা করতেন, তাঁর অন্তরে ধর্মব্যবসায়ী অত্যাচারীদের প্রতি সহজাত অশ্রদ্ধা ছিল যেমনটি আমরা নজরুলেও পাই। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর উপন্যাসে সর্বশ্রেণীর ধর্মধ্বজীদের সংস্কারের মুখোশ খুলে দিয়েছেন। নজরুল কুহেলিকা উপন্যাসের অন্যতম বিপ্লবী চরিত্র প্রমত্তের মুখ দিয়ে প্রকাশ করেন_
আমার ভারত ও মানচিত্রের ভারতবর্ষ এক নয়রে আনিস। আমার ভারতবর্ষ ভারতের এই মূক দরিদ্র, নিরন্ন পলিত তেত্রিশ কোটি মানুষের ভারতবর্ষ।-আমার ভারতবর্ষ মানুষের যুগে যুগে পীড়িত মানবাত্মার ক্রন্দনতীর্থ- ওরে এ ভারতবর্ষ তোদের মন্দিরের ভারতবর্ষ নয়, মুসলমান মসজিদের ভারতবর্ষ নয়_ এ আমার মানুষের, মহামানুষের মহাভারত।
ওমর খৈয়াম ছিলেন জীবনবাদী শিল্পী। সর্বকালীন প্রাণিক সত্তা, গতিশীলতা আর জড়ত্বনাশী যৌবনের বন্দনা করেছেন তিনি। পুরাতনকে ভেঙে ফেলে তেমনি নতুন পৃথিবীর বন্দনাগীত রচিত হয়েছে নজরুলের ‘জীবন বন্দনা’ কবিতায়। প্রত্যেকের সম্মিলিত শ্রম না থাকলে পৃথিবীর কোনো কিছুই পরিপূর্ণ হতে পারতো না। কবিতাটিতে জীবন ও যৌবনের বন্দনার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ জীবনের স্বপ্ন প্রকাশিত। অন্যদিকে ‘সাম্যবাদী’ কবিতায় কবি সাম্যের আদর্শে মানুষকে দীক্ষিত হবার আহ্বান জানিয়েছেন। সাম্যবাদের চেতনায় অনুপ্রাণিত মানুষ অনুধাবন করে প্রকৃত অর্থে মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয় সে মানুষ। এক্ষেত্রে ধর্ম বা সম্প্রদায় মূল্যায়নের মাপকাঠি নয়। কবি বলেছেন:
গাহি সাম্যের গান_
যেখানে আসিয়া এক হ’য়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রিশ্চান।
সাকী প্রেমে বিভোর ও উন্মত্ত ওমর বিশ্ব মানবতার পরমাত্মীয়। তিনি সুফী হোন, ভোগবাদী কিংবা নৈরাশ্যবাদী হোন_ সহৃদয় হৃদসংবেদী হতে তাঁর কোনো বাধা নেই। একইভাবে ‘এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী/আর হাতে রণতূর্য’ নিয়ে কবি নজরুল একদিকে বাঁশের বাঁশরী ললিত সুরে চির সুন্দরের সাধনা, অপরদিকে স্বাধীনতা যুদ্ধের অগি্নসৈনিক রূপে রণতূর্য নিনাদ করেছেন। নর-নারীর হৃদয়লীলা তাঁকে বিহ্বল করেছে, তেমনি মানুষের শোষণ-শাসনের নির্মমতা তাঁকে বিক্ষুব্ধ ও বিদ্রোহী করে তুলেছে। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে বিপ্লব ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে সবার কণ্ঠে ধ্বনিত হয় :
লাথি মার ভাঙরে তালা।
যত সব বন্দী-শালায়_
আগুন জ্বালা,
আগুন জ্বালা, ফেল উপাড়ি।
নজরুল ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় বিপ্লবের যে বাণী উচ্চারণ করেন তাতে তিনি রাজরোষে পতিত হলেন। কারাগারে তাঁর ওপর চলল অকথ্য নির্যাতন। তিনি অনশন করলেন। কারাগার জীবনের দুঃসহ জ্বালা-যন্ত্রণা থেকে জন্ম নিল তাঁর কালজয়ী ‘ভাঙার গান’, ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে তাঁর শাণিত উচ্চারণ :
কারার ঐ লৌহ-কপাট
ভেঙে ফেল্, কররে লোপাট
রক্ত-জমাট
শিকল-পূজোর পাষাণ-বেদী!
শৃঙ্খলিত ভারতবর্ষ তখন বিদেশের কারা-প্রাচীরের অন্তরালে একান্তই নিরুপায়_ অধীনতায় ক্লিষ্ট, অত্যাচারে নিপীড়িত, জড়তা ও ক্লৈব্যে সমাহিত। জন্মের প্রথম প্রভাতেই নজরুল দেখতে পেলেন সাম্রাজ্যবাদী শাসনযন্ত্রের নির্মম নিষ্পেষণে মানুষের তিলে তিলে মরণ বরণের যন্ত্রণা। বিশ্বজোড়া বিপ্লবের আবাহন নজরুলই প্রথম ঘোষণা করেন। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামের বাণীমূর্তি হলেন তিনিই_
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ_রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
বল বীর _
আমি চির-উন্নত শির।
যুগের নিজস্ব প্রয়োজনে এবং মানুষের লাঞ্ছনা, বেদনা ও অবমাননায় বিদ্রোহী কবি নজরুল যে কবিতা লিখেছেন অনাগত কালে তা একই সংবেদনা নিয়ে উচ্চকিত হবে। কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য এদেশের মানুষকে তাঁদের আন্দোলন ও সংগ্রামে, কর্মে ও ভাবনায় উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করে আসছে। নজরুল ইসলাম বিদ্রোহ করেছেন অসত্য অন্যায় অকল্যাণ ও অমঙ্গলের বিরুদ্ধে। সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধ ও ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে।
অন্তরে অপরিমেয় প্রেমের সঞ্চয় যখন সংসারের অযুত অবিচার-অন্যায়-অনিশ্চয়তার দৃষ্টান্তে বিপর্যস্ত হবার উপক্রম হয়, তখন মনের ভেতর জাগে ঐসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বাসনা আর সেই প্রতিবাদের আবেগই মানুষকে বিদ্রোহের পথে ঠেলে দেয়। ওমর জন্মগ্রহণ করেছিলেন একাদশ শতাব্দীতে কিন্তু চেতনা ছিল তাঁর একুশ শতকের; আর নজরুল বিশ শতকের হলাহল পান করে হয়েছেন নীলকণ্ঠ।
নজরুলের সাম্যবাদের সঙ্গে যে রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক চেতনার সমাবেশ ঘটেছিল ওমরের তা ছিল সহজাত অনুভূতি। তবে মানুষের প্রতি প্রেম ও অনন্ত ভালবাসার প্রকাশে তাঁরা সমদর্শী।
নব্য সাম্রাজ্যবাদীদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ তৃতীয় বিশ্বের সাধারণ মানুষের ক্লিষ্ট, অত্যাচারে নিপীড়িত, জড়তা ও ক্লৈব্যে সমাহিত। শাসনযন্ত্রের নির্মম নিষ্পেষণে মানুষ তিলে তিলে ভোগ করছে মরণ যন্ত্রণা। এই দুঃসময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রাগ্রসর চেতনায় ধ্বনিত হয় খৈয়ামের সেই আপসহীন সংগ্রামের বাণী, নজরুলের বিপ্লবী আহ্বান। আজকের বাস্তবতায় খৈয়াম কিংবা নজরুলের দ্রোহ বড় বেশি প্রাসঙ্গিক। নবযুগের জাগ্রত চেতনায় অনুরণিত হয় তাঁদের নবজন্মের বার্তা। কারণ তাঁদের এই বিদ্রোহ সমস্ত সত্যানুসারীর চিরকালীন বিদ্রোহ।
.