পাবলিক লাইব্রেরি আজ খুলেছে প্রায় পাঁচ মাস পরে। উত্তরপূর্ব আমেরিকার এই ইউনিভার্সিটি টাউনে লাইব্রেরি মেলামেশার জায়গা। জ্যানেট ওর অফ সার্ভিস ডে‘তে বাচ্চাদের নিয়ে আসে। তাক থেকে পেড়ে পেড়ে একসঙ্গে বই ওল্টায় ওরা, কোনো বই চৌকো বোর্ডের মতো, কোনোটার মচমচে কভার। কিন্তু সবগুলোতেই চমৎকার সব ছবি, পাতার পর পাতা জুড়ে। বাইরে ঝুরঝুরে নারকেলকোরার মতো বরফ পড়া দেখতে দেখতে ওরা কার্পেটের ওপরে পা মুড়ে বসে গল্প শোনে। দেশবিদেশের গল্প পরে শোনায় মিস্টার জন, লাইব্রেরি‘র স্টাফ, ওরফে গল্পকাকু। এইরকম আসরেই জ্যানেট‘দের সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা হয়ে যায় ব্রেন্ডন কিংবা ড্রিস‘এর মা‘র সঙ্গে। সেই মার্চ মাসের গোড়ায় শেষ যেদিন লাইব্রেরি‘তে এসেছিলো ওরা, মিস্টার জন সেদিন পড়ে শুনিয়েছিলো জাপানী ছেলে তোত্ত চান‘এর গল্প। পরিত্যক্ত রেলগাড়ীতে যার ইস্কুল। টিফিনে রোজ হেডমাস্টারের নির্দেশে তোত্ত চান নিয়ে আসে “সামথিং ফ্রম দ্য ল্যান্ড, এন্ড সামথিং ফ্রম দ্য সী “। ফেরার সময় সেদিন ছোট বড় তিনটে ব্যাগ ভর্তি করে বই নিয়ে বাড়ি এসেছিলো ওরা।
পাঁচমাস বাদে আজ বই ফেরত দিতে এসেছে জ্যানেট লাইব্রেরি‘র ড্রপ বক্সে। একাই এসেছে। হাতে গ্লাভস, মুখে অভ্যস্ত এন–নাইনটি ফাইভ‘এর বদলে আজ সাধারণ তিন লেয়ারের মাস্ক। সাত আটটা গাড়ি ড্রাইভ থ্রু‘তে দাঁড়িয়ে। চালক বা সঙ্গী কোনো একজন নেমে গিয়ে বই ফেলে আসছে ড্রপ বক্সে। যতক্ষণ সে ফিরে না আসছে গাড়ীতে, ততক্ষন অন্য গাড়ী, অন্য মানুষ সবাই ধৈর্য ধরে সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং পালন করছে। যাদের বস্তা বস্তা বই জমে গিয়েছিলো এই পাঁচমাসে তারা কাঁধে, হাতে, পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে ড্রপ বক্সে যাচ্ছে।
জ্যানেট এখন গাড়ীর লাইনে তিন নম্বরে। গাড়ীর উইন্ডশিল্ড দিয়ে সোজাসুজি দেখতে পাচ্ছে ড্রপ বক্স। হঠাৎ বাঁ দিকের রিয়ার ভিউ মিরর‘এ চোখ পড়তেই বুকের মধ্যে ছ্যাৎ করে উঠলো। একজন মধ্যবয়সী পুরুষ আর বছর ষোলোর একটি ছেলে দু‘প্রান্তে ধরাধরি করে লম্বা সাদা একটা পলিয়েস্টারের ব্যাগ নিয়ে হেঁটে আসছে। ব্যাগটার পা থেকে মাথা অবধি টানা মোটা চেন। জ্যানেট‘এর গাড়ীর পাশ দিয়ে যেতে যেতে ছেলেটি বাবা‘কে বললো, “gosh, what have we been reading? this feels heavier than Timmy, and he is almost a teenager!”
স্টিয়ারিং হুইলে হাত দিয়ে বসে জ্যানেট এটকিনসন, এম. ডি., ইন্ফেক্টিয়াস ডিসিস স্পেশালিস্ট, হু হু করে কাঁদছে। ঠিক এইরকম দেখতে একটা বডি ব্যাগ‘এ ভরে ব্রনক্স হাসপাতালের কর্মীরা পনেরো বছরের ইমানুয়েল‘কে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো কোভিড ওয়ার্ড থেকে।
কবি ও কথাসাহিত্যিক
আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগানের বায়োস্ট্যাটিসটিক্স’র অধ্যাপক ড: মৌসুমী ব্যানার্জী, গবেষণার বিষয়বস্তু ক্যান্সার এবং ডাটা সায়েন্স । জন্ম এবং লেখাপড়া কলকাতায়। কর্মসূত্রে বিশ্বনাগরিক। লেখালেখির শুরু কলেজ জীবন থেকেই। কবিতার পাশাপাশি ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ লেখেন। বাতায়ন, পরবাস, বাংলা লাইভ, সুইনহো স্ট্রিট, কেয়াপাতা, সাহিত্য ক্যাফে, গল্পপাঠ, TechTouchটক, Antonym ইত্যাদি বহু পত্রিকায় নিয়মিত লেখেন।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: একলাঘর (যাপনচিত্র প্রকাশনী)।