আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্প দুধভাতে উৎপাত
একটু বেলা হলে বৃষ্টি ধরে এলো। তবে আবুল মাস্টারের উত্তরপাড়ার জমিতে পাট কাটা শুরু হয়েছে, শালার মাস্টার আজ আসবে না। ইস্কুলে গেলে জুত করে ভেলায় চাপা যায়। ইস্কুলের নিচে এবাদত মুন্সির বড় ভেলাটা বাঁধাই রয়েছে, লগির ১২-১৪টা ঠেলা দিলেই একেবারে ধলেশ্বরীর তীর। সাড়ে ১০টার লঞ্চে উঠে কাপড়ের গাঁটের ওপর বসে থাকা প্যাসেঞ্জারদের সামনে সুর করে ‘মা ফাতেমা কাইন্দা বলে বাপ কোথায় আমার/হায়রে নবীজির এন্তেকালে দুনিয়া জারজার’ গাইতে গাইতে বাঁ পাটা খুঁড়িয়ে হাঁটলে দুই-আড়াই টাকা জোগাড় করা এমন কিছু নয়। তারপর রামেশ্বরদী ঘাটে নেমে কদম আলীর দোকানে বসে চায়ে ভিজিয়ে বনরুটি খাও, পেয়ারা খাও, গাব খাও, পয়সা থাকলে চাই কি মেঘনা সিগ্রেটও একটা জুটে যায়। ১টা ৫০-এর লঞ্চে বাড়ি ফিরলে মায়ের সাধ্য কী ধরে যে ছেলে তার আধখানা পেটে জামিনের বন্দোবস্ত করে এসেছে।
কিন্তু ওদিকে আকাশ থামে তো জয়নাবের পাড়া ফাটানোর বিরতি নেই। এই মিনিট দশেক হলো একটু জিরান দিয়েছে। এটাই সুযোগ, জয়নাব ফের শুরু করলে তাকে বোঝানো যাবে না। ঝাঁপ তুলে উঠানের কোণে মানকচুর ঝোপ থেকে বড় দেখে একটা মানপাতা ছিঁড়ে মাথার ওপর ধরে এক হাতে স্লেট ও মলাট-ছেঁড়া ধারাপাত নিয়ে ওহিদুল্লা পা বাড়াল। অমনি অনেকক্ষণ একটানা চ্যাঁচানোর পর ক্লান্তিতে হাঁপাতে-থাকা জয়নাব কাতরায়, ‘ওইদুল্লা! ইস্কুলে যাইস না!’
‘আইজ আমাগো পরীক্ষা। না গেলে মাস্টারে মারবো!’
জয়নাব কথা না বলে হাত নাড়ে, এর মানে, মারে মারুক। একটু হাঁপিয়ে, ফের হাত নাড়ে, এর মানে, তবুও যাস না। তারপর হাজেরার হাত থেকে হাতপাখা নিয়ে কোঁকায়, ‘কাগজির পাতা লইয়া আয় তো মা। খালি বমি বমি লাগে। মরার বমি আয়ও না!’ বিছানা থেকে মুখ নামিয়ে সে বমি করার উদ্যোগ নেয়। কেবল শব্দই সার, এক ফোটা রসও বেরোয় না। তখন চিৎ হয়ে শুয়ে কাতরাতে থাকে। এখন হাজেরার পালা। এই ছেমড়িটা আরেক মুরবি্ব। ছনের চালের ফুটো দিয়ে ঝরা পানি সরাতে সরাতে সে ঘরময় কাদাকাদা করে ফেলে আর উপদেশ ঝাড়ে, ‘আম্মা বলে অহন-তহন, তুমি যাও বেড়াইতে?’
ওহিদুল্লাকে তাই মাচার ওপর বিছানায় মায়ের কাছে বসে থাকতে হয়। আম্মার পেট ব্যথা হলে তার কী করার আছে? ব্যথার সঙ্গে স্বর, জ্বরের সঙ্গে মাথাব্যথা, বুকের ভেতর হাঁসফাঁস, এর ওপর ২৪ ঘণ্টা বমি ভাব—না, তার কিছু করার নেই। তার বাবা গতবার এসে প্রায় দিন পনেরো বাড়ি ছিল। পেটব্যথা, বুকের হাঁসফাঁস তখন ছিল কোথায়? বাজানকে বলে তখন যদি এক বোতল পানি পড়িয়ে রাখে তো তাই দিয়েই একটা বছর শরীরটাকে দিব্যি হাতের মধ্যে রাখা যায়। বাবা তার মৌলবি সাহেব, হাফেজ না হলেও কোরান শরিফ পড়ে পাখির মতো। দোয়া-দরুদ যে কত জানে, তার লেখাজোকা নেই। গাছ লাগানোর সময় গাছ বাঁচিয়ে রাখার দোয়া, ধান-পাটের জমিতে পোকামাকড় মারার দোয়া, বাচ্চাদের পায়খানা হওয়ার দোয়া, পায়খানা বন্ধ করার দোয়া, বাঁজা মেয়েমানুষের বাচ্চা হওয়ার দোয়া, আবার শত্রুদুশমনের বিমারি করার দোয়া—এক দোয়া পড়ে দিলে দুশমন শালা রক্তবমি করতে করতে পাল্টা দোয়া জোগাড় করার সময় পাবে না—আর মায়ের এসব রোগ তো বাজানোর কাছে জলভাত। এখানে, এই বিল এলাকায়, কসিমুদ্দিনের দাম বোঝার মতো লোক কোথায়? বাজান ঠিকই বলে, যেখানে তিন দিন বৃষ্টি হলো তো ডাঙ্গা ও নদীর কোনো ভেদচিহ্ন রইল না, সেখানে মানুষ বাস করে? আর সেখানে? সেই উত্তরে, ইছামতি, ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র পেরিয়ে তিস্তাতীরের গ্রাম খোলামহাটি। গ্রামে আজমত আলী প্রধানের আটচালা টিনের ঘর, তার পাটের গুদাম, তামাকের চাষ। কসিমুদ্দিনের কত দাপট সেখানে। প্রধানের বাড়িতে থাকে, বাড়ির মক্তবে গ্রামের ছেলেমেয়েদের আমপারা-সেপারা পড়ায়, মসজিদে আজান দেয়, ইমাম সাহেব এদিক-ওদিক জেয়াফতে গেলে নামাজও পড়ায়। বকরি ঈদের সময় সেখানে ঘরে ঘরে কোরবানির ধুম, তার বারো আনা জবাই হয় কসিমুদ্দিনের হাতে। এক বছর পর বকরি ঈদের সপ্তাহখানেক বাদে কসিমুদ্দিন বাড়ি ফেরে তখন তার হাতে মস্ত বড় অ্যালুম্যুনিয়ামের ডেকচি বোঝাই জ্বাল-দেওয়া ৮-১০ সের খাসির গোস্ত, গোরুর গোস্ত। মৌলবি বাড়ি এলে জয়নাবের পায়ে পাখা গজায়, তখন খালি ওড়ে, খালি ওড়ে। একটু মনে করে তখন পানি-পড়া রেখে দিলে এত কষ্ট পায়? মা হাজার হলেও আস্ত মেয়েমানুষ, ডেকচি ভরা গোশ্ত দেখলে হুঁশ থাকে না। বছরের একটা মাস গোশ্তের ঝোলের, গোশ্তের ভুনার, কলেজি-গুর্দার সুবাসে এই ছনের ঘরে দালানের চেকনাই আসে। গোশ্তের মৌসুম তখন, গোশ্তের উৎসব! ওহিদুল্লা তার নিজের গোশ্ত-ঝরা চিমসে পেটে আদরে ও করুণায় হাত বুলাতে বুলাতে উঠে দাঁড়ায়। আদর পেয়ে বেতমিজ পেটের ভেতরটা ফোঁস ফোঁস করে।—নাঃ সাড়ে ১০টার লঞ্চ এখনো যায়নি। লঞ্চে ঠাসাঠাসি করে বসা কাপড়ের ব্যাপারিদের কাছ থেকে দুই টাকা-আড়াই টাকা না হোক এক টাকা-দেড় টাকা পেলেও বনরুটি-চা না হোক, এক হালি গাব কী আমড়া খেয়ে মুখ মুছে বাড়ি ফিরলে কেউ কী ধরতে পারে? কিন্তু দাঁড়ানোর সঙ্গে জয়নাবের চিঁহি চিঁহি স্বরে বল আসে, ‘যাইস না!’ ‘মাস্টারে আইজ পাট কাটবো, হ্যায় লগে থাকতে কইছিল!’
জয়নাব হাত নাড়ে, মানে, কউক।
‘না গেলে মাস্টারে মাইর দিব!’
‘মৌলবি মাইনষের পোলা তুই পাট কাটবি ক্যান?’ গোঙাতে গোঙাতে জয়নাব নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য মনোযোগী হয়। কয়েকদিন থেকে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ করতে তার খুব পরিশ্রম হচ্ছে। চেষ্টা না করলে নিঃশ্বাস নিতে পারে না। অনেকক্ষণের জন্য বাতাস টেনে নিয়ে কথা বলতে বলতে শ্বাস ছাড়ে, কথাও বলে মিনমিন করে, পাছে আবার বেশি বাতাস বেরিয়ে যায়; তখন ফের নতুন করে বুক ভরানোর মেহনত করবে কে?
‘ওইদুল্লা, বাবা আমার কালা গাইটা আনতে পারলি না? হাশমত মউরির পোলায় দড়ি ধইরা টাইনা লইয়া গেল, একডা বছর পার হইয়া গেল, একটা দিন দুগা ভাত মাখাইতে পারলাম না।’ এত কথা বলায় তার বাতাসের স্টক শেষ হয়ে যায়, সে ফের হাঁপায়। ওহিদুল্লা তার কথার জবাব দেয় না। এই তো মেয়েমানুষের বুদ্ধি! কাল থেকে শুরু হয়েছে দুধের বায়না। গরু বিক্রি করে দিয়েছে আজ এক বছরের ওপর, সেই গরুর শোক কাল থেকে নতুন করে উথলে উঠছে। এত হাহাকারের আছে কী? গরু যখন ছিল তখনি কী এই মা মাগী ওদের দুধভাত দিত? প্রত্যেক দিন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে হাশমত মুহরির বড় ছেলে ঢ্যাঙা আশরাফ বা তার ঘরজামাই বোনাই হারুন মৃধা এসে দুধ দুইয়ে নিয়ে গেছে। এর বদলে সাত দিন পর পর বাজারে হারুন মৃধার দোকান থেকে ওহিদুল্লা চাল-ডাল নিয়ে আসত। খালি বছরে একবার কসিমুদ্দিন বাড়ি এলে সেই কটা দিন পোয়া দেড়েক দুধ ঘরে রাখার রেওয়াজ ছিল। ‘হেইখানে কি দুধ পাও?’—স্বামীকে এই কথা বলে জয়নাব ওই কয়েকটা দিন রাতে দেড় পোয়া দুধের সঙ্গে দেড় সের চালের ভাত দিয়ে, গুড় দিয়ে ও একটা শবরি কলা দিয়ে মাখাতো, সেই মাখানো ভাত খেত বাপেবেটা-ঝিয়ে মিলে ছয়জনে। শেষ দুটো লোকমা বরাদ্দ ছিল জয়নাবের জন্য। দুধভাতের হাত ধুয়ে তার গোনাগুনতি ছাগলা দাড়ি কটায় হাত বুলাতে বুলাতে কসিমউদ্দিন মাঝেমধ্যে হাসত, ‘এই শ্যাষ দুইডা লোকমার মদ্যেই ব্যাক সোয়াদ। তুমি খাইতে চাও না, তুমি নিজে না খাইলে এত মজা কইরা মাখাইবা?’ দুধভাত খেয়ে বাজানের মুখ থেকে কী সুন্দর সুন্দর কথা বেরোয়, ‘আল্লাপাকে তোমার হাতের মইদ্যে বরকত দিছে! দেড় সের চাইলের ভাত তুমি দেড় পোয়া দুধ দিয়া মাখাইয়া ব্যাকটির জান ঠাণ্ডা করো! আলহামদোলিল্লা!’
সেই কত দিন আগে-খাওয়া দুধভাতের বাসি গন্ধ চোখা কঞ্চির মতো পেটে ঢুকে পাকস্থলীতে খোঁচাখুঁচি শুরু করলে সে ফের উঠে দাঁড়ায়। টিপটিপ পানি মাথায় করে ঘরে ঢোকে বড়আম্মা আর হাজেরা। এতক্ষণ ঘরে না থাকার জন্য হাজেরাকে কষে একটা চড় মারার সুযোগ ঘটে যাওয়ায় ওহিদুল্লার হাতের তালু খুশিতে নিশপিশ করে, পেটের মধ্যে কঞ্চির তৎপরতার বিরতি ঘটে। কিন্তু হামিদা বিবি এসে বসল জয়নাবের গা ঘেঁষে, তার পাশে হাজেরা। এ অবস্থায় মারধর করাটা মুশকিল। পেট ও হাতের চাপা তৎপরতা স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়ে ওহিদুল্লা নাক খুঁটতে শুরু করে।
জয়নাব কী ঘুমিয়ে পড়ল? হামিদা বিবি তার কপালে হাত রাখতেই সে বিড়বিড় করে দুধের কথা বলে। হামিদা বিবির হাত জয়নাবের কপালেই থাকে, ‘মাইজা বৌ, দুধ তো পাই না! তামান গাঁও তালাস কইরা আলার বাপে হপায় আইছে। উত্তরপাড়ার করিম সিকদারের গাইটা দুই একের মদ্যেই বিয়াইবো। নুইলা আমিনুদ্দির গাই বলে কয়দিন থাইকা খালি দাপায়, দানাপানি ছাড়ছে। আলার বাপে ঝাইড়া দিয়া আইল। কী করে, ধরছে, ঝাইড়া দিয়া যাও। তাই দেরি হইল।’
‘দাপাইবো না?’ আলার বাপ দরজার বাইরে দাঁড়িয়েই কথা বলে। সে হলো জয়নাবের ভাসুর, ঘরে ঢোকার নিয়ম নেই। ‘গাভীন গাই দিয়া কয়দিন হাল বোয়াইছে, অহন গাইয়ের কী দোষ? আল্লায় ক্যামনে সয়?’
ভাসুরের কণ্ঠস্বর শুনে জয়নাব গায়ের কাঁথা আরো জড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। তার পায়ের কাছে বৃষ্টির পানিতে ভেজা জায়গাটা আঙুলে লাগলে সমস্ত শরীর শিরশির করে ওঠে। এতে কথা বলার বল পাওয়া যায়, ‘অ বুজান, হাশমত মউরির গোয়ালের মইদ্যে আমাগো কালা গাইটা আছে!’
কিন্তু হাশমত মুহুরির বাড়িতে যাওয়া আলার বাপের পক্ষে অসম্ভব। গতবার খরার সময় হারুন মৃধার দোকান থেকে পাঁচ সের চাল নিয়েছিল, সেই ধার আজও শোধ হয়নি। সে তাই ওহিদুল্লাকে ডাকে, ‘ওইদুল্লা!’
ওহিদুল্লা বেরিয়ে দেখে তার জ্যাঠা টিপটিপ বৃষ্টির নিচে দাঁড়িয়ে ভিজছে আর পরনের গামছা বারবার নিঙড়ে নিচ্ছে।
‘ওইদুল্লা, কোষাখান লইয়া মালখাপাড়া যা, হাশমত মউরির তিনটা গাই, দুধ লইয়া বাজারে অহনো যায় নাই। মউরিরে হাতে-পায় ধইরা কইস, আমার মায়ের অহন-তহন অবস্থা, একখানা হাউস করছে, আপনের না কওন চলবো না!’
সারা পাড়ায় একটিমাত্র কোষা, সেটা নিয়ে গেল কে? ওহিদুল্লার ভেলাই ভালো। হাশমত মুহরির বাড়ির পৈঠায় ভেলা ঠেকানোর আগেই দেখা যায় পরিষ্কার জামাকাপড় পরা কয়েকটি ছেলেমেয়ে পানিতে কাগজের নৌকা ভাসিয়ে দিচ্ছে। সবাই এক সঙ্গে কথা বলে, দেখেই বোঝা যায় শহরের পয়দা, এদের কথা বোঝা যায় না। ওহিদুল্লা ভেলা ঠেকিয়ে ডাঙ্গায় নামে। হাশমত মুহুরির ঘর অনেক উঁচুতে, পা ঠেলে ঠেলে ওপরে উঠতে হয়।
হাশমত মুহুরি বাড়ি নেই, ভোরে উঠে বৃষ্টি মাথায় করে সে গেছে থানায়, কাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য তদবির করতে। হাশমত মুহুরির বড় ছেলে ঢ্যাঙা আশরাফ থাকলেও কাজ চলে, তো সে গেছে বাজারে। এই তো কোষা নিয়ে বেরোলো, অহিদুল্লার সঙ্গে তার দেখা হয়নি? হাশমত মুহুরির চাকরিজীবী প্রবাসী ছেলে আলতাফ অনেকদিন পর বাড়ি ফিরেছে, বাজারে না গিয়ে ঢ্যাঙা আশরাফের উপায় ছিল না। ওহিদুল্লা বাড়ির ভেতরে উঠানে দাঁড়ায়। ঘরের পাকা বারান্দায় শহরবাসী ছেলে মস্ত মুড়ির বাটি নিয়ে জলচৌকিতে বসেছে। খাঁটি সর্ষের তেলের ঝাঁজ বড় বারান্দা পেরিয়ে ওহিদুল্লার নাকে ঝাপটা মারে এবং সেই ধ্যাবড়া নাকের সুড়ঙ্গপথে পেটে ঢুকে সুড়সুড়ি দেয়। মুহুরির বৌ ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে একটা অ্যালুম্যুনিয়ামের থালা থেকে গম ছিটিয়ে দিচ্ছে উঠানে।
ওহিদুল্লার আবদার শুনে মুহুরির বৌ অবাক হলো, ‘হায়রে আল্লা!’ তর মায়ের না প্যাটের ব্যারাম? চিরকালের সুতিকার রুগী? হ্যারে তুই দুধ খাওয়াইবি? পাগলা হইছস?’ কিন্তু এই বিস্ময়বোধে তার গম ছড়ানোর কাজ একটুও ব্যাহত হয় না, দাঁতের গোড়ায় পানে-ভারী জিভ ঠেকিয়ে সে ‘টি টি টি টি’ আওয়াজ করলে এক পাল মুরগি এসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে গম খায়। মুরগির হাঁটা কি! পেটে দানা পড়ায় শালাদের দেমাক কত! ইচ্ছা হয় সব কটার ঠোঁট কামড়ে গমের টুকরা নিয়ে দাঁতে চিবিয়ে ফেলে। কিন্তু এই সাধ পূর্ণ করার জন্য কোনোরকম প্রস্তুতি নেওয়ার আগেই মুহুরির জামাই হারুন মৃধা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে জামার বোতাম লাগায় আর বলে, ‘তর মায়ের প্যাট খারাপ, তগো হইছে মাথা খারাপ!’
ওহিদুল্লা মিনমিন করে, ‘না, হ্যার হাউস হইছে দুধভাত খাইব, মায়ে বলে বাঁচবো না!’ তার গলা কাঁদো কাঁদো করার চেষ্টা করেও বিশেষ সুবিধা হয় না। মুহুরির শহরবাসী ছেলের কথা বরং সর্ষের তেলের ঝাঁঝে খোনা শোনায়, ‘দুধভাত খাইলে তর মায়ে ফাল পাইড়া উঠব, না?’
শহরবাসীর স্কুলে-পড়া ফ্রক-পরা কন্যা কামড়ে কামড়ে পেয়ারা খাচ্ছিল, মুখে পেয়ারা নিয়েই সে বলে, ‘দুধ আমার ভাল্লাগে না! দুধ আবার মানুষ সখ করে খেতে চায়? মাগো!’
মুহুরির জামাই তার দোকানে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে বাড়াতে বলে, ‘পয়সা লইয়া ডাক্তার দেখা। ওষুধ দে, ওষুধ দে! তর চাচা না? ওই যে আলোর বাপে তর চাচা লাগে না? আমার চাউলের দামটা অহনো দিল না। অর কাছে থাইকা ট্যাহা লইয়া ডাক্তার দেখা।’
গলাটা কাঁদো-কাঁদো করার জন্য ওহিদুল্লা আরেকবার প্রচেষ্টা চালায়, ‘মায়ের এ্যাট্টা হাউস হইছে, কালা গাইয়ের দুধ দিয়া, গুড় দিয়া, কলা দিয়া’—বলতে বলতে জিভ দিয়ে শব্দগুলো সে চাখে। কিন্তু হারুন মৃধা কালো গরুর কথায় চটে গেল; ‘যা যা! এক কথা!—প্যাচাল পাড়িস না!’ মুহুরির বৌ বলে, ‘কইলাম আমার মাইজা পোলায় আইছে, নাতিপুতিগুলি আইছে বলে দুই বচ্ছর বাদ, দুগা পিঠা করুম, দুধ লাগে আমার চাইর স্যার! আইজ বাজার থাইকা দুধ আরো খরিদ করা লাগে! তর মায়ে—বুইড়া মাগীটার ঢঙের হাউস হইছে দুধভাত খাইব!’ শহরের পয়দা মেয়েটি পেয়ারা কামড়ানো স্থগিত রেখে বেণী দুলিয়ে দুলিয়ে বলে, ‘নেই কোনো উৎপাত, খায় শুধু দুধভাত!’
শহরে থাকলে পোলাপান কত রঙই না শেখে! কথাবার্তা শুনে কে বলবে যে এরা হাশমত মুহুরির নাতিপুতি?
কালো গরুর কথাটা হারুন মৃধা ভুলতে পারে না, ‘এইগুলির উপকার করতে নাই। খাওন জোটে নাই, চাউলের দাম হইল আগুন, ভাইজানে গরুটা কেনে তয় হ্যাগো চাউল আসে! দানাপানি জোটে! হাটে-বাজারে অহন আলার বাপে কইয়া বেড়ায়, হ্যার ভাই বাড়িত থাকে না, মউরির পোলায় হ্যার গাইগরু লইয়া গেছে। গরু লইছে মাগনা? ক্যারে, গরু তর মায়ে মাগনা বেছছে?’
ওহিদুল্লা ফিরতে ফিরতে বৃষ্টি একেবারে থেমে গেল। আলার বাপ কাদার পাশে একটা কাঠের গুঁড়িতে হাঁটু ভেঙে বসে আরো দুজন জ্ঞাতির সঙ্গে ভ্রাতৃবধূর রোগ বিষয়ে গুরুগম্ভীর পরামর্শ করে। ওহিদুল্লাকে দেখে আলার বাপ চোখের প্রশ্নবোধক চিহ্ন তৈরি করলে ওহিদুল্লা বলে, ‘মউরি নাই।’
‘হারুন মিরধা আছিল?’
‘হ্যাগো ইষ্টি আইছে, দুধ লাগব।’ এই খবরে অবশ্য তাদের আলোচনা ব্যাহত হয় না। ‘ডাক্তার আছিলো আমাগো অমরেশ ডাক্তার। খালি জিগাইছে, কও সে বাবা তোমার রুইদ ভালা ঠ্যাহে, না ছ্যাওয়া ভালো ঠ্যাহে? কেউরে কইছে, রাইতে আরাম পাও, না দিনে আরাম পাও? জবাব শুনছে, শুইন্যা ওষুধ দিছে। কী দিছে? চাইরটা-পাঁচটা বড়ি, মধুর লাহান মিঠা, খাইতেও মজা, দুইবার-তিনবার খাও, জ্বরজারি কৈ যাইব, দিশা পায় নাই!’
শহরে-পয়দার পেয়ারা কামড়ানো দেখেও যা হয়নি হোমিওপ্যাথিক ওষুধের স্বাদের কথা শুনে ওহিদুল্লার পেটে ও বুকে কোলাহল শুরু হলো। জীবনে কোনোদিন মধু চেখেও দেখেনি, অথচ ফোঁটাফোঁটা মধু বা মধুর মতো মিষ্টি বড়ির এক-আধটা দানা শূন্য উদরে পড়ে, শব্দ করে পড়ে আর সেখানে ঘায়ের ওপর সুচের মতো বেঁধে।
একে এই সুচ-বেঁধার কষ্ট, আবার পাটখড়ির বেড়ার পাশ দিয়ে ঘরে ঢোকার মুখে ওখানে কে রে? —খাদিজা। দেখো, ভরা-বর্ষার বাড়ির মানুষ উপোস করে মরে, আর ছেমড়িটা কেমন তারিয়ে তারিয়ে শসা চিবায়। দেখতে এতটুকু হলে কী হবে, বাড়ে নাই বলে কী তার বয়স থেমে আছে? তার আক্কেলটা দেখো! কানের কাঠি-বেঁধা ও একটু পুঁজ-মাখা লতি ধরে ওহিদুল্লা তার গালে গোটা তিনেক চড় মারলো। ‘শয়তানী! চুন্নীটা! কচুর ঝোপে পলাইয়া শসা খাস? শরম নাই?’ একাগ্রচিত্তে ও নিবেদিত উদরে শসা খেতে খেতে মিঞাভায়ের এই অতর্কিত আক্রমণে বিচলিত হয়ে খাদিজা কাদার ওপর পড়ে যায়; তার পায়জামাটা ছেঁড়া, সেটা একেবারে ফাঁক হয়ে গেল। তবে সুখের বিষয় শসার অভুক্ত অংশের সবটাই তার আটা মুঠিতে অচঞ্চল বিরাজ করে।
জয়নাবের তখন খুব বাড়াবাড়ি। বড়আম্মা বসে আছে স্যাঁতসেঁতে বিছানায়। হাজেরা হাত দিয়ে মায়ের পায়ের পাতা ঘষে দিচ্ছে। জয়নাবের ছোট ছেলেটি আহমদউল্লা পাছা ও উরুতে পাতলা গু নিয়ে এদিক-ওদিক হেঁটে বেড়ায়, তার দিকে কারো নজর নেই। এর বড়টা কানা বয়তুল্লা মায়ের পাশে শুয়ে অসময়ে ঘুমাচ্ছিল, সে জেগে উঠে এক চোখে ফোঁৎ-ফোঁৎ করে কাঁদছে। হাজেরা কাঁদো-কাঁদো গলায় বলে, ‘ভাইজান, মায়ে তোমারে কত তালাশ করলো। মায়ে আর কথা কয় না, অ মা, তোমার জবান বন্ধ হইল ক্যান? অ মা!’ এসব দেখেশুনে ওহিদুল্লার পেটের কোলাহল মাথায় ওঠে। সমস্ত পেট মাথার ভেতর সেঁধে যাওয়ার খুলিটা ঘিঞ্জি ও ঝাপসা ঠেকে। বড়আম্মা বিড়বিড় করে কোরআন শরিফের আয়াত পড়ে। জয়নাব তার বন্ধ চোখ দিয়ে ওহিদুল্লার খোলা নোনা দুই চোখে অদৃশ্য সব ছবি এবং অনেক আগে সম্পন্ন গতিবিধি প্রকাশ করে দেয়। ওহিদুল্লা দেখতে পায়, প্রখর ঠাঠা রোদে জয়নাব মাখন ঘোষের পোড়ো-ভিটায় মেটে আলুর খোঁজে মাটি খুঁড়ছে। আবার এক বছর পর কসিমুদ্দিন বাড়ি ফিরেছে তাও দেখা যায়। বাপের হাতে গোশতের হাঁড়ি দেখে তারা সব কটা ভাইবোন অস্থির। কসিমুদ্দিন তার নবতম শিশুটিকে নিরীক্ষণ করছে। লাজুক লাজুক ও বোকা বোকা মুখে ঘোমটা দিয়ে জয়নাব হঠাৎ কত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বদনা ভরে পানি নিয়ে একবার উঠানে রাখে, পুরনো কাঠের তোরঙ্গ থেকে কবেকার পুরনো রঙ-জ্বলা পাতলা ফরসা গামছা বারান্দায় বিছিয়ে রাখে জায়নামাজের মতো। আবার সূর্যের দিকে তাকিয়ে তখনো নামাজের সময় হয়নি—এই খবর জেনে নিয়ে ফের জায়নামাজ গুটিয়ে রাখে। ঘরে তার ডেকচি ভরা গোশ্ত। সেই গোশ্ত ছোট ছোট মাটির হাঁড়িতে গুছিয়ে রাখতে হয়। সেসব জ্বাল দেওয়া, বেছে বেছে গুর্দা ও কলেজি আলাদা করা—তার কাজের কী হিসাব আছে? কসিমুদ্দিন বাড়ি এসেই কালো গরুটাকে নিয়ে মাখন ঘোষের ভিটা ও বিলের ধারের মাঠে একটুখানি চরিয়ে আসে। আবার স্বামীকে গরুর কাছে যেতে দেখে আড়চোখে সেদিকে দেখে আর মুখ টিপে হাসে। কসিমুদ্দিন বলে, ‘গাইয়ের প্যাট ওঠে না? গাই মনে হয় দুবলা হইয়া গেছে!’ মুখে আঁচল দিয়ে জয়নাব জবাব দিত, ‘আপনেরে না দেইখা! এইডো আমার হতীন তো!’ নিজের রসিকতায় সে নিজেই হেসে গড়িয়ে পড়ত। এই হাসিটা তার ঠোঁটজুড়ে চুপচাপ এলানো থাকে সারা পৌষ মাস। নতুন চাল উঠলে ছেলেমেয়েদের জয়নাব একদিন দুধভাত খাওয়ায়। কসিমুদ্দিন অবশ্য তখন তিস্তাতীরের গ্রামে। উঠানে ছেলেমেয়েদের সার করে বসিয়ে জয়নাব হাত দিয়ে মুখে মুখে ভাত তুলে দেয়। দুধ দিয়ে, ভাত দিয়ে, কলা দিয়ে, গুড় দিয়ে।
ওহিদুল্লা দুধভাতকলাগুড়ের মিলিত দৃশ্য ভালো করে দেখার আগেই জয়নাব চোখ মেলে। কালচে লাল চোখে সে হামিদা বিবির দিকে তাকায়। ডাকে, ‘বুবু!’ কথা শোনার জন্য হামিদা বিবি মাথা এগিয়ে দিলে জয়নাব বলে, ‘দুধভাত মাখছো?’ এই পর্যন্ত সবাই শুনতে পারে কারণ এটুকু তাদের আগে থেকেই জানা ছিল। কিন্তু পরবর্তী সব বাক্য অস্পষ্ট। বড়আম্মা তার মুখের কাছে মুখ নিয়ে সব শুনছে। তার চোখ ছলছল করে। ‘হায়রে, পোলাপানের দুধভাত খাওয়াইবার হাউস করছে!’ বলতে বলতে বড়আম্মার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। এসব দেখে ওহিদুল্লার একটু রাগমতো হয়।—এতে কান্নাকাটির কী হলো? জয়নাব এতক্ষণে বিবেচকের মতো কথা বলছে। গত কয়েকটা দিন তার কেবল পেট ব্যথা করে আর বমি বমি ভাব হয় আর বমি না হওয়া বুক হাঁসফাঁস করে আর পেটের ও বুকের ব্যথায় সে মাঝেমধ্যে তড়পায়। ছেলেমেয়েদের খাওয়া-দাওয়ার দিকে তার নজর নেই। দুই দিন থেকে কারো খাওয়া হয় না, ঘরে যা ছিল হাজেরা কোনোমতে কয়েকটা দিন চালিয়ে নিয়েছে। কাল থেকে ভরা বর্ষা, কোথায় কী পাওয়া যাবে? এ সময় মায়ের এই ইচ্ছাপ্রকাশে বড়আম্মার এত কান্নাকাটির কী হলো?
হামিদা বিবি বলে, ‘তরা বয়, আমি এট্টু আহি।’ জয়নাব তার চোখের কপাট বন্ধ করে বর্তমান থেকে নিজেকে আড়াল করে নিল। কলা-গাব, চা-বনরুটি, মধুর মতো হোমিওপ্যাথিক বড়ি ও দুধভাত বারবার ভাবতে ভাবতে ক্লান্তিতে ওহিদুল্লার চোখও ভারী হয়ে আসে। চোখ মেলে অদৃশ্য বস্তু দেখতে বড় খাটনি হয়। ঝিমুনিতে তার মাথা নুয়ে নুয়ে পড়ে। ঝিমুনির ছোট্ট একটি পলকে তার গায়ে আগুন ফোটে, ভরা-বাদলের আকাশ হঠাৎ করে খরায় ফেটে পড়ে। দেখা যায়, সেই খরায় কে একজন, তাকে চেনা যায় না, তাদের কালো গরুর দড়ি ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। লোকটা ঢ্যাঙা আশরাফ হতে পারে, হারুন মৃধাও হতে পারে। ওহিদুল্লা জয়নাবকে ডেকে বলছে, ‘মা, অ মা, আমাগো গাই লইয়া যায়, তুমি দেহো না?’ জয়নাব বলছে, ‘হ্যাগো কাছে রাখবার দিলাম। তর বাপে ট্যাহা পাঠাইলে চাইলের দাম শোধ কইরা গাই লইয়া আহুম!’ দুবার এই বাক্যের পুনরাবৃত্তি করতেই মায়ের চোখের খরা কেটে লোনা বাদল নামে, ‘তর বাপে কৈ থন ট্যাহা পাঠাইব? মোল্লায় খাইয়াদাইয়া প্যাটটিরে বানাইছে গোশ্তের কালাপাতলা, হ্যায় ট্যাহা পাঠাইব ক্যান?’
মাটির সানকি হাতে বড়আম্মা ঘরে ঢুকলে ওহিদুল্লার এই বাসি-ছবি দেখা শেষ হলো, শিথিল চোখ-কাল ফের চাঙা হয়ে উঠল।
‘বড়আম্মা দুধভাত লইয়া আইছো?’ প্রায় চিৎকার করে হাজেরা উঠে দাঁড়ায়, ‘বড়আম্মা, দুধভাত কই পাইলা?’
‘পাইছি! আল্লায় দিছে!’ ঈশ্বরের প্রদত্ত খাদ্য নিয়ে বড়আম্মা জয়নাবের শিয়রে বসল। জয়নাবের কপালে, গায়ে ও চুলে হাত বুলিয়ে হামিদা বিবি জিগ্যেস করে, ‘মাইজা বৌ, পোলাপানের মুখে দুধভাত দিবি না?’ কিন্তু জয়নাবের মুখচোখ অপরিবর্তিত। ‘অ মাইজা বৌ, পোলাপানের দুধভাত খাওয়াইতে চাইছিলি, অ বৌ?’
মায়ের পদসেবা ছেড়ে হাজেরা এসে দাঁড়িয়েছে হামিদা বিবির হাতের সানকির ধার ঘেঁষে। খাদিজা তার শসা সম্পূর্ণ খেয়ে বা অভুক্ত অংশটি কোনো ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে রেখে এখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। আহমদউল্লার মুখ থেকে অর্থহীন ধ্বনি ও লালা গড়িয়ে পড়ে, কিন্তু খাদিজার হাঁটুর পেছনে ছেঁড়া পায়জামার ঝুলে-পড়া কাপড় ধরে সেও মুখ তুলে গোল ও কালো সানকিটা দেখছে। স্যাঁতসেঁতে কাঁথার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে হামিদা বিবি জয়নাবের ডান হাত টেনে আনে। রোগা ও পাতলা এই হাত সানকিতে রাখলে আঙুলগুলোতে স্পন্দন বোঝা যায়। এক মুঠি দুধমাখা ভাত সেই হাতে পুরে দিলে হাতটা নিজে নিজেই ছেলেমেয়েদের দিকে এগিয়ে আসে। সবচেয়ে বেশি এগিয়ে সাড়া দিয়েছিল খাজিদার মুখ। কয়েক কামড় শসা তার পেটটাকে বড্ড খুঁচিয়ে দিয়েছিল। তবে হাঁ সবচেয়ে বড় হয়েছিল হাজেরার, যদিও একটু পিছিয়ে পড়ায় জয়নাবের হাত ঘেঁষে সে দাঁড়াতে পারেনি। এক চোখ কানা হলেও এবং মায়ের উল্টোদিকে থাকা সত্ত্বেও কানা রহমতউল্লা তার ভালো চোখটা দিয়ে সব দেখে ফেলেছে, সেও মায়ের কাছাকাছি বিছানার ওপর উঠে বসতে চেষ্টা করছিল। কনিষ্ঠটির আবোল-তাবোল বকা শেষ, তখন তার জিভে কোনো ধ্বনি নেই, কেবল লালা গড়িয়ে পড়ছে।
হামিদা বিবি নিজের ডান হাত দিয়ে জয়নাবের দুধভাত-ভরা হাতটা ধরে পঞ্চাননের মাঝখানে এনে একটু উঁচুতে শূন্যে স্থাপন করে। ভাতের গন্ধে, গুড়ের গন্ধে ওহিদুল্লার পেটের প্রসার এখন দ্বিগুণ। সে একেকটি শূন্য ঢোঁক গেলে আর উদরের মস্ত গহ্বরে তার ঢক ঢক প্রতিধ্বনি বাজে। মুখ বাড়িয়ে ভাতের প্রথম গ্রাসটি সে নিজেই তুলে নিতে পারত, তা আর হয়ে ওঠে না, তার, আগেই হাজেরা তার বসন্তের দাগ-ভরা মুখ এগিয়ে হলদে ছ্যাতলাওলা দাঁতে মায়ের হাত কামড়ে দুধ-ভাত তার নিজের জিভে চালান করে নিয়েছে। বেতমিজ আওরৎ! মেয়েমানুষের বুদ্ধি মানে ইবলিসের উস্কানি।
দেখতে দেখতে জয়নাবের হাত ধপাস করে পড়ে যায় বিছানার প্রান্তে। খাজিদা সেই হাত নিয়ে আঙুলগুলো চুষতে আরম্ভ করে। পারে তো আঙুল চুষে চুষে সবটাই খেয়ে ফেলবে। ধাড়ি ছুঁড়ির মায়ের আঙুলে স্তনচোষার কাণ্ড দেখে ওহিদুল্লার ইচ্ছা হয় ঠাস ঠাস করে দুটো চড় বসিয়ে দেয়। তা আর হয়ে ওঠে না। জয়নাবের মাথা কাঁপতে শুরু করে এবং তার গলা থেকে ওঁ ওঁ ওঁ ওঁ এই রকম গরুর গাড়ির চলন্ত চাকার আওয়াজ শোনা যায়। তার ঠোঁট জোড়াও এখন বেশ ফাঁক হয়েছে; মরচে ধরা গোঙানি, ফাঁক-করা ঠোঁট ও মাথার মৃদু কাঁপুনি দেখে হামিদা বিবি ভয় পায় এবং ‘লা ইলাহা ইল্লালাহু মুহম্মদুর রসুলাল্লাহ্! মাইজা বৌ, মাইজা বৌ!’ বলতে বলতে নিজের হাতে আর এক মুঠ দুধভাত তোলে হাজেরা, ওহিদুল্লা, খাজিদা, রহমতউল্লা ও আহমদউল্লাকে থ করে দিয়ে নিজের মুখের কাছে নিয়ে আসে এবং ঠোঁটে প্রায় ছুঁয়ে দারুণ থতমত খেয়ে জয়নাবের মুখের কাছে নিয়ে যায়। সৌভাগ্যক্রমে জয়নাবের গোঙানিরত মুখ হাঁ করাই ছিল, হামিদা বিবি অনায়াসে সেই হাঁর মধ্যে এক গ্রাস ভাত গুঁজে দেয়। ভাতের বেশ অনেকটা অংশ তার মুখের মধ্যে চলে গেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে খানিকটা তার কষ বেয়ে বাইরে গড়িয়ে পড়েছে।
তারপর পানিতে ডোবা মানুষের মতো জয়নাব কয়েকটা ঢোক গেলে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তার গলায় ও মুখে প্রবল রকম ঝাঁকুনি শুরু হলো। কালো চামড়ার নিচেও কাঁপনের মোটা ও চিকন কারুকাজগুলো স্পষ্ট ধরা পড়ে। গলায় মাংসপেশি তার কুঁচকে ওঠে; কপাল ও কপালের নিচে, চোখের পাতায় ও নাকের দুই উপত্যকায় প্রবল আলোড়ন ওঠে এবং সে ওয়াক ওয়াক করে বমি করতে শুরু করে। তার বমির আওয়াজ ও ভঙ্গি খুব জমজমাট, এই বিনীত ও ভাঙাচোরা ঘরে ঠিক মানায় না।
জয়নাব অবিরাম বমি করে। প্রথমে বের হলো ঘোলাটে সাদা ভাত ও পানি। তারপর কেবল পানি। বিবর্ণ পানির ধারা বেরিয়ে আসে প্রবল তোড়ে। মাঝেমধ্যে অল্পক্ষণের বিরতি দিচ্ছে। বিরতির পরপরই দ্বিগুণ বেগে বমি আসে। বমির পানিতে মেঝে ভেসে যাচ্ছে। ওহিদুল্লা অবাক হয়ে বমির পরিমাণ দেখে, মায়ের ভেতরকার সব কিছুই পানি হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে? জয়নাবকে যারা অনেকদিন থেকে চেনে তাদেরও এ রকম মনে হতে পারে। এ পর্যন্ত খাওয়া যাবতীয় খাদ্যদ্রব্য ছুড়ে ফেলে দেওয়ার জন্য সে কী পাগল হয়ে গেল? আজ থেকে ৩৬ বছর আগে তার আকিকার গোশ্ত থেকে শুরু করে কিছুই তার পেটে থাকছে না। বমির পরিমাণ দেখে মনে হয় তার বিয়ের আগে বাপের বাড়িতে যা খেয়েছে, নিজের বিয়ের খাবার, বিভিন্ন বকরি ঈদের পর তার স্বামীর নিজের হাতে হালাল করা কোরবানির গোশ্ত, কালো গরুর দুধ দিয়ে, কলা দিয়ে, গুড় দিয়ে মাখা মোটা ও রাঙা চালের ভাত, খরার সময় মাখন ঘোষের পোড়া ভিটা থেকে খুঁড়ে-আনা মেটে আলু, এমনকি কসিমুদ্দিনের পড়া-পানি পর্যন্ত উগরে দিয়ে সে নিঃশেষিত হচ্ছে। তার বমির মাঝেমধ্যে ১০-১২ সেকেন্ডের বিরতি থাকে। এ রকম একটি বিরতির সময় হামিদা বিবি জয়নাবের ছেলেমেয়েদের উদ্দেশে চিৎকার করে ওঠে, ‘আরে করস কী? বমি লাগতাছে তো!’
কে শোনে কার কথা? বিছানার ওপর থেকে মাটির সানকিটা কখন যে পাচার হয়ে গেছে ঘরের পূর্ব কোণে, এমনকি ওহিদুল্লাও টের পায়নি। কাদাকাদা মেঝেতে একমাত্র সে ছাড়া আর সবাই লেপ্টে বসে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে মাটির সানকির ওপর। হাজেরা তার ডান হাত দিয়ে খাচ্ছে বটে, কিন্তু সানকির সঙ্গে তার মুখের তফাত ২-৩ ইঞ্চির বেশি নয়। ইচ্ছা করলে সরাসরি মুখ দিয়েই সে ভাত তুলে নিতে পারে। খাদিজা বসেছে অর্ধেক সেজদার ভঙ্গিতে। বাপ-সোহাগী মেয়ে, বাপ এলে বাপের পেছনে তার নামাজ পড়া নকল করে, তার মহড়া চলছে এখন। হাত দিয়ে দুধ-ভাত টেনে টেনে নিজের মুখে তোলার ভঙ্গি থেকে মনে হয় যে মস্ত একটা কালো আরশোলা শুঁড় দিয়ে খাবার টেনে নিচ্ছে। কানা রহমতউল্লা এক চোখে যা দেখে, পুরো সানকিটা দৃষ্টির নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে তাই যথেষ্ট। এখান থেকে তার কানা চোখটা দেখা যায়। মনে হয় খাওয়ার সুখে চোখটা বুজে এসেছে। আর কনিষ্ঠ আহমদউল্লা দুই হাতে ভাত খাচ্ছে, তার নাকের প্রবাহিত সিকনি মিশে যাওয়ায় তার লোকমাগুলোর তরলতা বাড়ে। তার সমস্যা তার দুই বছর বয়সসুলভ মন্থরতা। একেকবারে দুটো হাত মুখে তোলে তো অনেকক্ষণ নামাতে পারে না।
ওহিদুল্লার সর্বশরীর এখন কেবল পেটেরই সম্প্রসারণ। এই সব জানোয়ারের ওপর রাগে তার সর্বশরীর অর্থাৎ সমস্ত পেট জ্বলে ওঠে, ইচ্ছা করে সানকিটা কেড়ে নিয়ে দুধভাতসমেত চিবিয়ে চিবিয়ে খায়। কিন্তু জয়নাবের গমকে গমকে নিঃসারণ, তার মুখচোখ কপালের শিরা-উপশিরায় ভাঙাচোরার দৃশ্য কঠিন হয়ে তার মাথায় দারুণভাবে চেপে বসেছে। এ অবস্থায় সানকি কেড়ে নেওয়া কী করে সম্ভব? মা মাগী বমি করার আর সময় পায় না!
জয়নাবের বমির ভেতরকার বিরতির সময় আস্তে আস্তে বাড়ে। বমির জন্যে মুখের, গলার, পেটের, এমনকি মাথার মাংসপেশি, হাড়হাড্ডি, রগ, শিরা-উপশিরার যথেচ্ছ ও প্রচণ্ড ব্যবহারের ফলে জয়নাব খুব ক্লান্ত হয়ে মাথা এলিয়ে শুয়ে রয়েছে। বমি বোধহয় শেষ হয়ে এলো। তাকে দেখে মনে হয় তার ভার অনেক কমে এসেছে, সে বোধহয় নিজের শরীরকে অনুভব করতে পারে, তার মুখের অভিব্যক্তি এখন আর তার ইচ্ছানিরপেক্ষ নয়। খুব ক্ষীণকণ্ঠে সে বিড় বিড় করে, ‘বুবু, পোলাপানরে তুমি কী খাওয়াইলা?’
হামিদা বিবি মাথা নিচু করে থাকে। হাত দুটো তার নিজের কোলের ওপর আলগোছে রাখা। ওই অবস্থায় আস্তে আস্তে বলে, ‘কী করি? পোলাপানের খালি দুধভাত খাওয়াইতে চাস। কী করি? চাইলের গুঁড়ি জ্বালা দিয়া দিলাম!’ বলতে বলতে তার গলা চড়ে এবং সরাসরি জয়নাবের দিকে তাকায়, ‘ক্যান বৌ? চাইলের গুঁড়ি পোলাপানের কুনোদিন খাওয়াস নাই? দুধ দিছস কয়দিন? দুধের স্বাদ তর পোলাপানে জানে কি?’ ঘুম কিংবা তন্দ্রা কিংবা আচ্ছন্নতার মধ্যে থেকে উঠে আসার জন্যে খাটতে খাটতে জয়নাব বিড়বিড় করে, ‘কালা গাইটারে ধইরা আনলে, কালা গাইটারে ধইরা আনলে—। হামিদা বিবি তার কথা শেষ করতে দেয় না, তার গলা আরো চড়ে, ‘গাই না তুই বেইচা দিছস বৌ! হারুন মিরধার দোকান থাইকা চাইল লইছিলি, মিরধায় আইয়া গাই লইয়া গেল, খালি গরুর প্যাচাল পাড়স!’
কিন্তু আধমণ চালের দাম শোধ না করা পর্যন্ত গরু পাওয়া যাবে না—হারুন মৃধার এই শর্তটিও কী জয়নাব তার বমির সঙ্গে উগরে ফেলল? বেড়ার দিকে তাকিয়ে সে হঠাৎ ফিক করে হাসে, বলে, ‘আপনে কী যে কন?’ জায়ের দিকে চোখ ফিরিয়ে বলে, ‘ওহিদুল্লার বাপের কথা শুনছেন? হ্যায় কয়, গরু বিদায় করছো? গরু আমার আরেক বিবি?—হার কথা হুইন্যা আমি বলে হাইস্যা মরি! কন সে, ঘরের মইদ্যে চিকার গাত, চিকায় বলে গরুর ব্যাক কয়টা ওলান খাইয়া হালাইল! অ ওহিদুল্লা!’—প্রলাপ বকতে বকতে জয়নাব ক্লান্ত হয়, আর কথা একবার চড়ায় ওঠে তো পরপরই খাদে নেমে আসে। তার বোধ হয় গরম লাগছে, শরীর থেকে কাঁথা সরে গেছে, গায়ের কাপড় শিথিল। চোখজোড়া ঢুলঢুলু। ঠোঁটের কোণে, চিবুকের ডৌলে বমির পানির লালচে ফোঁটা, নীলচে ফোঁটা। এরি মধ্যে ওহিদুল্লার দিকে ডান হাতের তর্জনী তুলে ইঙ্গিত করলে সে এক পা এগিয়ে আসে। কিন্তু মায়ের প্রলাপ ক্রমেই দুর্বোধ্য হয়ে আসছে। জয়নাবের উকুনভরা লালচে চুল মাথার চারদিকে ছড়ানো, ঘরে হাওয়া নেই, বাতাস নেই, তবু সেগুলো একটু একটু কাঁপে। ওহিদুল্লার বুক ছমছম করে, মা বোধহয় তাকে চিনতে পারছে না। মায়ের ভয়ে একবার ‘মা’ বলে চিৎকার করার জন্য ওহিদুল্লা শক্তি সঞ্চয় করছে, এমন সময় জয়নাব হুঙ্কার ছাড়ে ‘বুইড়া মরদটা! কী দেহস? গরু লইয়া যায়, খাড়াইয়া খাড়াইয়া কী দেহস!’—জয়নাবের শ্যাওলা-পড়া চোখজোড়া দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল, মনে হয় ঘরের স্যাঁতসেঁতে শূন্যতার হঠাৎ ভেসে-ওঠা কোনো দৃশ্য প্রাণভরে দেখবে বলে চোখজোড়া সম্পূর্ণ ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। ওহিদুল্লার গলা থেকে ফিসফিস আওয়াজ বেরোয়, ‘যাই মা।’ কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে জয়নাবের মাথা বালিশের পাশে ঢলে পড়ে এবং প্রথমে হামিদা বিবি এবং ক্রমান্বয়ে হাজেরা, খাজিদা, কানা রহমতউল্লা, এমনকি আহমদউল্লার এলোমেলো চিৎকার ও বিলাপের বৃষ্টিভেজা বেড়া নিয়ে খড়ের চালের হুমড়ি খেয়ে পড়ার দশা হয়। ওহিদুল্লার পায়ের পাতা বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য শিরশির করে। এত বমির পর নির্ভার মায়ের মুখের যে কঠিন চেহারা হয়েছে তাতে তা হুকুম তামিল না করে ওহিদুল্লার কি রেহাই আছে?
.