Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,Eating cannibalism in folklore

লোকসংস্কৃতি: লোককথায় নরমাংস ভক্ষণবাদ । সুকন্যা দত্ত

Reading Time: 8 minutes
২০১৯ সালের ৪ ঠা ফেব্রুয়ারী ভারতের একটি ঘটনা সকলকে চমকে দিয়েছিলো। তামিলনাড়ুর ৪৩ বছর বয়সী   T Ramanathapuram কে   তিরুনেলভেলি জেলার একটি শ্মশানে বসে  আধপোড়া মানুষের মাংস  খেতে দেখা যায়। ভীতিকর ঘটনায় সারা দেশে  আলোড়ন পড়ে।  কে  এই T Ramanathapuram? মানুষ নাকি পিশাচ?  বিশ্ব সাহিত্যের দিকে দৃকপাত করলে ক্যানিবাল  বা নর মাংস খাদকদের প্রসঙ্গ উঠে আসে।  ক্যানিবালিজম এর চর্চা পৃথিবীতে নতুন নয়। তবে এই বিষয়ে আলোচনার পূর্বে একটু পিছনে ফিরে দেখা যাক। 

ছেলেবেলার দোরগোড়া থেকেই আমার  লোককথা, লোকগল্প, উপকথার প্রতি টান। শৈশব থেকে লালিত সে সাধ আজ ও অতৃপ্ত। সমুদ্র  থেকে এক গন্ডুস জল পান করলে  যেমন জলরাশির ঘাটতি হয় না, তেমন বিশাল ভান্ডার থেকে কয়েকটি গল্পের বিশ্লেষণ বিশ্ব দরবারকে সামগ্রিকভাবে তুলে ধরতে অক্ষম। তবু ও আমার প্রয়াস সাহিত্যের বহু শাখার মাঝে ও কেবল শিশুপাঠ্য ভ্রমে ব্রাত্য লোককথা বা লোকগল্পের অস্বাভাবিক চরিত্রের  অনুসন্ধান।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,The Silence of the Lamb


লোককথা, উপকথা  একটি জাতির সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। আভিজাত্য বর্জিত সাধারণ মানুষের রোজকার আচার বিশ্বাস, সামাজিকতা, বীরত্ব, বুদ্ধি, সৃষ্টিতত্ত্ব,ভৌগোলিক উপাদান ফুটে ওঠে। এ জাতীয় লোকগল্পে বার বার আসে   দৈত্য, দানব,রাক্ষস,খোক্ষস, ভূত, পেত্নী, অপশক্তির   কথা। এককথায় যারা  মানব মাংসভোজী। আমাদের জগতের সমান্তরালে এদের জাগতিক অবস্থান। এরা   কোনো দেশে রুক্ষ পরিবেশে হিংস্র, কোথা ও আবার কোথা ও  পরোপকারী বা মূর্খ।  
” হাউ মাউ খাউ
 মানুষের গন্ধ পাউ।”
একথা মুখে মুখে প্রচলিত।  তবে এ প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে নরখাদক বা ক্যানিবালিজম নিয়ে একটু আলোকপাত করি। এই শব্দটি শুনলেই বুকের ভিতর চাবুক চলে, ভয়ে গা শিউরে ওঠে।  নরখাদক বা ক্যানিবাল  হলো মানুষ  যারা  মানুষের মাংস ভক্ষন করে। মানুষ যখন মানুষের মাংস খায় তখন কী তাকে আর মানুষের পর্যায়ে ফেলা যায়? সে সাধারণ মানুষের চোখে হয়ে ওঠে পিশাচ, দানব, ভয়ংকর  । রচনাকার তাদের কর্মকান্ড মাথায় রেখে  কল্পনার সুতোয় বুনে  এদের লোমহর্ষক  রূপ দান করে। পৌরাণিক পিশাচ, রাক্ষস কিংবা দানবের সাথে লোককথার এ জাতীয় চরিত্রের বিস্তর তফাৎ। গল্পের নরখাদক রা দেখতে কিছুটা মানুষের মতো। তাদের খাদ্যাভাসের এই বিকৃতিকে ফুটিয়ে তুলতে দানব রূপে চিত্রিত করা হয়েছে। তবে আমি আজ কেবল লোককথার আঙিনাতেই বিচরণ করবো।
“ক্যানিবালিজম”  শব্দটির ‘ক্যারিব ‘ নামের উপজাতির শব্দ থেকে এসেছে।  পশ্চিম এবং মধ্য আফ্রিকা,  মেলানেশিয়া বিশেষত ফিজি, নিউজিল্যান্ডের মাওরি,নিউ গিনি, অস্ট্রেলিয়ায় নরখাদকের আভাস পাওয়া যায়। ১৫ শ শতকে ইউরোপীয়রা একটি তথ্য সামনে আনলেন। সে সময় মৃগী, বমন, চর্মরোগ,রক্তক্ষরণ হলে রোগ নিরাময়ের জন্য  এক প্রকার  ধূসর গুড়ো জাতীয় পদার্থ তারা জলে গুলে সেবন করতো।  সেটি ছিলো মামিয়া। এই মামিয়া হলো,  মিশরের মমির দেহের শুকনো অংশ। শুধু খাওয়াই নয়, তারা মামিয়ার প্রলেপ তৈরি  করে ক্ষতস্থানে লাগাতো বা শরীরে ছিটিয়ে দিতো। তাদের বিশ্বাস, এর ফলে তারা সুস্থ হয়ে উঠবে। ফলস্বরূপ  মমিগুলো দ্রুত পিরামিড থেকে চুরি হতে শুরু করে।   সে শূন্যস্থান পূরণে ইউরোপীয় গোরস্থান থেকে মৃতদেহ তুলে এনে পিরামিড ভরাট করার কাজ চলতে থাকে।  আর ও শোনা যায়, প্রাচীন সময়ে ক্ষরা কিংবা দূর্ভিক্ষে খাদ্যের অভাবে স্থানীয়রা মৃত মানুষের কাঁচা মাংস ভক্ষণ করতো। কলম্বাসের অভিমতে, ক্যারিব উপজাতির মানুষ  তাদের বন্দীদের মাংস ভক্ষণ করতো। চীনের একটি তথ্যানুযায়ী,  সে সময় বাবা, মা মৃতপ্রায় হলে সন্তানরা তাদের অঙ্গদান করতো। উরুর মাংসল অংশ কিংবা আঙুল প্রদান করে সুস্থ করার এই প্রক্রিয়া বহুদিন অব্যাহত ছিলো। অস্ট্রেলিয়ার পাপুয়া নিউ গিনিতে, মৃতপ্রায় ব্যক্তি শেষ ইচ্ছা হিসেবে তার মাংস ভক্ষণের কথা লিখে জানিয়ে যেত। 
ভারতের উত্তর প্রদেশে অঘোরপন্থীদের বিষয়ে শোনা যায়, তারা নর মাংস ভক্ষক। শৈব সম্প্রদায়ের অঘোরপন্থীরা পূর্ণিমার রাতে মন্ত্র উচ্চারণের পর শিবকে পূজা নিবেদন করে নদীতে ভেসে যাওয়া মৃতদেহ ভুঞ্জন করে। তবে এরা সাধারণত মানব হত্যা করে নর মাংস ভক্ষণ করে না। 
আফ্রিকায় ধর্মীয় হত্যা এবং নরমাংসবাদের সাথে জাদুবিদ্যার সম্পর্ক আছে। এই মহাদেশে হেড হান্টর্সদের কথা পাওয়া যায়। এরা তাদের মৃত শত্রুদের মাথা সংগ্রহ করে জাদুবিদ্যার প্রয়োগ করে। এর উদ্দেশ্য হলো মৃত শত্রুর প্রতিশোধের স্পৃহা  হ্রাস করা।  মৃত্যুর পর ও যেন শবদেহে প্রতিহিংসা অবশিষ্ট  না থাকে, তারজন্য হেড হান্টার্স প্রথার প্রচলন। 
গল্প,কাহিনীতে বারংবার এসেছে ক্যানিবালদের কথা। এরা জীবিত না মৃত, সব জায়গায় সম্যক ধারণা পাওয়া যায়না। পূর্ব আফ্রিকার সোমালিয়ার মাটিতে নরখাদক ধেগধীরের গল্প  বেশ জনপ্রিয়।  আমাদের দেশে যেমন জুজুর কথা বলে  ছোটদের  ভয় দেখানো হয়, তেমন   আফ্রিকায় ধেগধীরের কথায় শিশুরা ভয় পায়। ধেগধীর শব্দের অর্থ “লম্বকর্ণ”। নিকষ কালো এই দানবীর বাম কানটি  লম্বা,   চোখে হিংস্রতা।     দানবীর গায়ে বিরাট শক্তি, তার গতি বাতাসের মত। ধেগধীরের শ্রবণ শক্তি অবিশ্বাস্য। এই দানবী  সর্বদা মানুষের মাংস খাওয়ার জন্য  হারগেগার বালুকাময় উপত্যকায়  বিচরণ করে। এমনকি তার ঘরে মাটির পাত্র ” বোওধীর” এ মানুষের শুকনো মাংস সংরক্ষণ করে রাখা থাকে।  
আফ্রিকার আরেকটি গল্পে আছে, একটি নরখাদক দানবীর কথা। সে রাতের অন্ধকারে মানুষের মাংসের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়।  একবার সেই গ্রামের একজন  স্ত্রীলোককে তার স্বামীর অনুপস্থিতিতে মেরে তার মাংস খেয়ে বাকী অংশ গর্তে পুঁতে দেওয়ার কথা জানা যায়।  চাগা উপজাতির একটি গল্পে আছে খাদক অতিথির  কথা। সে কিসোইয়ের বাড়ীতে লুকিয়ে পালিত মুরগীর কাঁচা মাংস খায় এমনকি গৃহকর্তার অনুপস্থিতিতে খিদের তাড়নায় বাড়ীর শিশুর ডান হাতে কামড় বসিয়ে দেয়। আফ্রিকার মাসাই উপজাতির যুবকদের মোরান( যোদ্ধা)  হয়ে ওঠার গল্পে ইকগু চরিত্রের উল্লেখ আছে। সে রাতের আঁধারে চুপিসারে মাসাই যোদ্ধাদের মেরে তার মাংস খায়। গং পাহাড়ি অঞ্চলের দানব সকল কে গিলে খেতো। সে সময় এক সুন্দরী মেয়ের বুদ্ধিমত্ত্বা রক্ষা পায় গ্রামবাসী।
আফ্রিকার অ্যাঙ্গোলার কুখ্যাত ভূত কিশির কথা জানা যায়।  এরা মানুষের মতো দেখতে হলে ও মাথার পিছনে হায়নার মতো আর একটি মুখ থাকে। এরা কোনো সময় হায়নার রূপ ধারণ করে। কিশিরা সুদর্শন যুবকের বেশে  কথার জাল বুনে নারীদের সম্মোহিত করে নির্জন স্থানে নিয়ে যায়। তারপর  তাদের মাংস ভক্ষণ করে। 
দক্ষিণ পশ্চিম আমেরিকার জুনি অধিবাসীদের মধ্যে একটি গল্প প্রচলিত আছে।  ” Atahsaia, the Cannibal Demon” গল্পে আতাহসাইয়া  একজন নরখাদক দানব।  এই দানব দুই তরুণী কে  তাদের বৃদ্ধ ঠাকুরদার পরিচয় দেয়। তরুণীরা তার কথা বিশ্বাস করে আতাহসাইয়ার বাড়ী অবধি পিছু পিছু আসে। দানব দুই তরুনীকে মানব শিশুর মাংস নির্মিত স্যুপ খাওয়াতে চাইলে তারা খাদ্য গ্রহণে অস্বীকার করে। শেষ পর্যন্ত  দুজন দেবতার আর্শীবাদে তারা সে যাত্রা আতাহসাইয়ার হাত থেকে রক্ষা পায়। 
আমেরিকার মহাদেশের অপর একটি গল্প থেকে জানা যায়, একজন রমনী এক  শয়তান দ্বারা প্ররোচিত হয়ে তার ছেলের শিরচ্ছেদ করে। তারপর একটি  আপলের ভিতর তার মাথা ঢুকিয়ে দেয়।  নিজের মেয়েকে প্রতারনা করে  ভাইয়ের হত্যার মিথ্যা দোষ স্বীকার করতে বাধ্য করে। এরপর  ছেলের মৃতদেহকে রন্ধন করা  ঝোলের মধ্যে ভিতর ডুবিয়ে দিতে বলে। রমনীর স্বামী এ বিষয়ে অবগত ছিলো না।  তাই ঘরে ফিরে ক্ষুধার্ত হয়ে  ঝোল খেতে বসে। স্বাদের জাদুতে মোহিত হয়ে আর ও খাবারের দাবি করে। নিজ সন্তানের মাংস নিজের অজান্তের ভক্ষনের কাহিনি এই গল্পে পাওয়া যায়। 
আমেরিকার দক্ষিন ডাকোটার আদিবাসীদের  একটি গল্পে  আছে,  একবার গ্রীষ্মের প্রচন্ড ঝড়ের রাতে আকাশের কালো মেঘের চেয়ে ও ভয়ানক এক বিরাট দানবের আগমন ঘটে। সে  এসেই গ্রামের মহিলা এবং যুবতী মেয়েদের গিলে গিলে খেতে থাকে। কেউ তাকে রুখতে পারে না।  তার শক্তি সূর্যের মতো।  তার পায়ের ছাপ বিরাট। সে অঞ্চলে নর মাংস লোভী মানব প্রলয় শুরু করে। 
আসি রাশিয়ার মাটিতে। মনে পড়ছে ডাইনী বাবা ইয়াগার কথা?
 ” খেংরা কাটি পা, দাঁত নেমেছে হেথা, নাক উঠেছে হোথা!”
সে থাকে মুরগীর পায়ের উপরে স্থাপিত  একটা কুঁড়ে ঘরে। বন বন করে সে বাড়ী ঘুরছে। “ব্যাঙ রাজকুমারী ” গল্পে দেখা যায়,  রাজপুত্র ইভান সে অদ্ভুত বাড়ীর সামনে এসে বলে, ” কুঁড়েঘর, ও কুঁড়েঘর, বনের দিকে পিঠ ফিরিয়ে আমার দিকে মুখ করে দাঁড়াও।”  এই গল্পে বাবা ইয়াগা  রাজপুত্র ইভানকে সাহায্য করলে ও ” রাজহাঁস আর ছোটো মেয়ে ” গল্পে পাওয়া যায়,   বাবা ইয়াগা চানের ঘরে আগুন জ্বেলে উনুনে  কড়াই বসায়। এর উদ্দেশ্য হলো, ছোটো মেয়েটিকে   ধুয়ে কড়াইকে ভেজে সে খাবে তারপর তার হাড়ে চড়ে ঘুরে বেড়াবে। ” আলিওনুশকা বোন আর ইভানুশকা ভাই ” গল্পে আর ও ডাইনীর কথা জানা যায়। সে  হঠাৎ এসে  আলিওনুশকাকে বিভ্রান্ত করে নদীতে স্নান করাতে নিয়ে যায়। তারপর তার   গলায় বড়ো পাথর বেঁধে নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। 
স্লাভিক উপকথার দিকে তাকালে পাওয়া যাবে,  রুসাল্কার কথা( বহুবচনে রুসাল্কি)। দানিয়ুব নদীর আশে পাশে জলে বস করে  এই দানবী। কুয়াশার মতো স্বচ্ছ পোশাক পরিহিতা , শৈবাল বর্ণ  কেশী, কমনীয়,   অসামান্য সুন্দরী রুসাল্কা মিষ্টি গান গেয়ে পথচারীদের মোহিত  করে। রুসাল্কি  কুমারী মেয়েদের বিদেহী আত্মা।  তবে উত্তর রাশিয়ার বর্ণানুযায়ী,  রুসাল্কিরা কুৎসিত, সদা নগ্ন। কোনো যুবক খ্রিষ্ট ধর্মের প্রতীক ‘ ক্রশ ‘  চিহ্ন পরিধান না করে নদী,দীঘি কিংবা জলাশয়ে স্নান করতে গেলে রুসাল্কি তাদের প্রাণ নেয়। স্লাভিক উপকথায় কিকিমোরার কথা জানা যায়। কিকিমোরা  নারী আত্মা,  এর পা দুটো মুরগীর মতো, দেখতে অসম্ভব  কুৎসিত।  এরা গৃহস্থ  বাড়ীর পিছনে খাল, ডোবা, উনুনের মধ্যে বাস করে। আবার  কোনো গল্প থেকে জানা যায়,  এদের বাস জলাভূমি এবং জঙ্গলে। সাধারনত গৃহপালিত পশু, বাড়ীর শিশুদের এরা আক্রমন করে। 

৬৫০ খ্রিষ্টাব্দের এক কাহিনি থেকে জানা যায়, গ্রীসের এম্পুসা হলো ইচ্ছাধারী প্রেত। সে  অসাধারণ সুন্দরী নারী তবে তার পা গুলোর  একটি তামার, একটি গাধার, একটি ষাঁড়ের এবং একটি ঘোড়ার। বলা হয়, এম্পুসা পুরুষদের নিজের রূপে ভুলিয়ে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায় তারপর রক্তপান করে ভক্ষণ করে। আর একটি গল্পে দেখা যায় অ্যালোলোনিয়াস যখন পারস্য থেকে ভারতের পথে যাওয়ার সময়   এম্পুসার সাথে তার সাক্ষাৎ ঘটে।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,The Silence of the Lamb


মালোশিয়ার হান্তু এয়ার প্রেতের কথা অনেকেই শুনেছেন। এরা  জলে বাস করে। কোনো ব্যক্তির জলে ডুবে মৃত্যু, বন্যা কিংবা জল ঘটিত মৃত্যুর জন্য এদের দায়ী করা হয়। এদের অবয়ব কিছুটা মানুষের মত হলে ও শরীর জল দ্বারা নির্মিত। মালয় উপকথা অনুসারে, বাদাং নামের এক ক্রীতদাস এক রাতে যখন নদীতে মাছ ধরতে যায় তখন তার জালে হান্তু এয়ার আটকা পড়ে। হান্তু এয়ারের   লাল চুল, অমসৃণ চামড়া,লম্বা দাঁড়ি নাভি পর্যন্ত বিন্যস্ত। স্থানীয়দের বিশ্বাস,  জাহাজ বা নৌকায় পাম গাছের ডাল রাখলে হান্তু এয়ার তাদের আক্রমন করবে না। 
এবার আসি নেপালের লোককথায়। নেপালের নারী আত্মা হলো কিচকান্ডি। হলুদ চামড়ার,   লম্বা কালো চুলের অধিকারী , হাতে বড়ো নখ, অপরূপ সুন্দরী এই  কিচকান্ডি। ক্ষুধার্ত এই প্রেত হতভাগ্য যুবকদের নির্জন৷ জায়গায় নিয়ে তাকের ভক্ষণ করে।  
জাপানের বরফ প্রেত হলো উকি- ওন্না। উকি শব্দের অর্থ বরফ এবং ওন্না হলো নারী। কথিত আছে, এরা বরফ ঢাকা পাহাড়ের উপর দিয়ে ভেসে বেড়ায়  আর একাকী  মানুষ দেখলে তাদের আক্রমন করে। স্থানীয় মতানুসারে কোনো নারী তুষার ঝড়ে প্রাণ হারালে মৃত হয়ে উকি ওন্নায় পরিণত হয়।  কবি সোগীর একটি গল্পে উকি ওন্নার উল্লেখ পাওয়া যায়।  এরা অসামান্য সুন্দরী। এদের  নীল ঠোঁট, বরফ শুভ্র গাত্র বর্ণ,  পরনে কিমোনো।  প্রয়োজনে উকি ওন্না কুয়াশার রূপ ধারণ করে মানুষদের বিভ্রান্ত করে। 
বাংলা লোককথার দিকে তাকালে নরখাদকদের বিশাল সম্ভার চোখে পড়ে।  ভূত, পিশাচ, রাক্ষস, খোক্ষস,  শিকল বুড়ী বা জল পিশাচ, গুদ্রো বঙ্গা, স্কন্দকাটা, মামদো, শাঁকচুন্নি, পেঁচাপেঁচি, পেত্নী সহ তালিকা নেহাত কম নয়। এরা সকলে মানুষ খেকো। বিবাহিত নারীর মৃত্যু হলে সে শাঁখচূর্ণী বা শাঁকচুন্নিতে পরিণত হয়। অবিবাহিত নারীর  অপূর্ণ ইচ্ছা নিয়ে মৃত্যু হলে সে পেত্নীর রূপ নেয়। পেত্নীরা পুরুষের রূপ ধরতে পারে। এরা  মানুষ রূপী হলে ও এদের পা হয় উল্টো।সংস্কৃত প্রেতাত্মা থেকে পেত্নী শব্দের উৎপত্তি হয়েছে ।  বাংলা গল্পে উচ্চবর্ণের ব্রহ্মদৈত্য হলেন পৈতাধারী।  তিনি দয়ালু, পরোপকারী।  একটি গল্পে পাওয়া যায়, একজন ব্রাহ্মণ একবার অশ্বত্থ গাছের ডাল কেটে দেশের রাজাকে দেখাতে চেয়েছিলো তখন ব্রহ্মদৈত্য ব্রাহ্মণ কে  সাহায্য করে।   বাংলার আরেকটি গল্পে দেখা যায়,  অতিথি সেবায় শাঁকচুন্নি নিজের পা উনুনের ভিতর  দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে রান্না করে, ঘর থেকে জানলার বাইরে হাত বাড়িয়ে লেবু গাছ থেকে লেবু পাড়ে।  বাংলা ভাষার লোককথায় ভূতেরা আয়নার নিজের রূপ দেখে বোকা বনে যায়, আবার চাষীর সেবায় ফলন্ত ফসল কেটে ঘরে তুলে দেয়। 
কেরালার একটি গল্পে দৈত্যকে অন্যরূপে দেখা যায়।  একবার একজন লোক ধোসা খাওয়ার প্রস্তুতির জন্য জ্বালানি সংগ্রহ করতে  বনে কাঠ কাটতে যায়। যে গাছে সে কুঠার মারে, সেখানে এক দৈত্য বাস করতো। গাছ হেলে পড়তেই  সেই  দৈত্য গাছ থেকে বেড়িয়ে আসে। ধোসা কথা শুনে দৈত্য লোভে পড়ে  খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে কিন্তু লোকটার বাড়ী এসে ধোসা  না পেয়ে মাটির বাসনপত্র ভাঙচুর করতে  শুরু করে। সে সময় একটি মাটির হাঁড়িতে রাখা লঙ্কা গুঁড়ো তার চোখে পড়লে দৈত্য দৌড়ে পালিয়ে যায়। ভারতে একটি প্রচলিত গল্প সোহনী এবং মহিওয়ালের কথা। সেখানে দেখা যায়, মহিওয়াল সোহনীর জন্য মাছ ধরতে অসমর্থ হলে খাদ্য সংকটে অস্থির হয়ে পড়ে। সে সময় তার উরু থেকে মাংস কেটে রান্না করে সোহনীর ক্ষুধা মেটায়। সিন্ধ মুলুকের একটি গল্পে পাওয়া যায়, দূর্ভিক্ষের জন্য পিতা এবং মাতা তার সন্তানের মাংস ভক্ষণের পরিকল্পনা করেছিলো।  

ক্যানিবালিজম এর কারণ হিসেবে কেউ বলেন মানসিক বিকার এর কথা।  kuru নামের একটি রোগের ক্ষেত্রে Prion প্রোটিনের সংক্রমনের ফলে একসময়  মানব মস্তিস্কে এই রোগের আগমন ঘটেছিলো।  নিউ গিনির উপজাতির মানুষের নর মাংস ভক্ষণের ফলে এই রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে।  মানসিক রোগের সূচনা হয় এখান থেকেই।   কার ও মতে শৈশবের হতাশা, আঘাতে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে নরখাদক হয়ে যায়। আবার কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, মানুষ কেবল নরমাংসই নয়, নিজের চুল, চামড়া,নখ খেতে পছন্দ করে। Dermatophagia য় মানুষ নিজের চামড়া ভক্ষণ করে।  Onychophagia য় তারা নখ খায় এবং Trichophogia বা Rapunzel syndrome এ চুলকে খাবার হিসেবে গ্রহণ করে।   ১৯৭৯ সালে নৃতত্ত্ববিদ উইলিয়াম অ্যারেন্স তার লেখা ” The Man Eating Myth ” বইয়ে  ক্যানিবালিজম এর বিপক্ষে কিছু যুক্তি তুলে ধরেন। তার মতে অভিযাত্রী, সৈনিক,  সীমান্ত টহলদার মানুষেরা কিছু দেশের জীবনাচরণে বিভ্রান্ত হয়ে ভুল তথ্য দিয়েছেন।  ক্যারিব জাতির অস্তিত্ব নিয়ে তিনি সহমত পোষণ করেননি। তার মতে  দক্ষিণ আমেরিকার ফ্রেঞ্চ গুয়েনা,  সুরিনামে দ্বীপপুঞ্জগুলিতে কেবল  আরাওয়াক ভাষা গোষ্ঠীর অস্তিত্ব ছিলো। হয়তো, তাদের রান্না ঘরের আশে পাশে হাড় পড়ে থাকায় কলম্বাস নরখাদকের দাবী করেছিলেন। কার ও মতে আফ্রিকা,  আমেরিকার যে সকল স্থান থেকে ক্যানিবালিজম চর্চার কথা উঠে আসে, সেখানকার মাটির বর্ণ ছিলো লোহিত।  ফলতে দূর থেকে ঔপনিবেশিকরা ক্ষিদের তাড়নায় মাটি ভক্ষণের ঘটনাকে মানুষের মাংস খাওয়ার সাথে মিলিয়ে ফেলেছিলেন। এই রোগের নাম Pica.   পিকা রোগে আক্রান্ত মানুষ শুধু যে মাটি খায় তা নয়, তার সাথে মাটিতে জমাট বাঁধা বরফ, কাদা এমনকি কাগজ পর্যন্ত খেয়ে ফেলে।     কার ও মতে ক্যানিবালিজম মানব মনে সেই দেশের প্রতি ঘৃণ্য ধারণা তৈরি করতে সাহায্য করে। জাতি বৈষম্য  তৈরি করার জন্য এমন ধারণার জন্ম হতে পারে।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,The Silence of the Lamb

ক্যানিবালিজম চর্চার আলোচনা স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। নরমাংসভক্ষণবাদের পক্ষে বিপক্ষে বহু যুক্তি আছে। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে ভুরি ভুরি তথ্য উঠে আসবে। The Silence of the Lamb” সিনেমায় ক্যানিবাল থমাস হ্যারির বিখ্যাত একটি বিখ্যাত সংলাপ ছিলো, “I ate his liver with some fava beans and a nice chianti.” ক্যানিবাল মানুষের প্রচুর তথ্য পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে আছে। আলেকজান্ডার পিয়ার্স কিংবা  জেফেরি লিওনেল ডাহমের এর নর মাংস ভক্ষণের সাক্ষ্য প্রমাণকে অস্বীকার করা যায় না।  বিকারগ্রস্ত মগজের চিকিৎসার পথ এড়িয়ে ক্যানিবালিজম পৃথিবীর ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি। প্রচলিত ধারণার বাইরে অস্বাভাবিক, অস্বস্তিকর, মানসিক অসুস্থ চরিত্রগুলো লোককথা, উপকথায় এইভাবে আসন চিহ্নিত করে আছে। ভালোর সাথে মন্দ, শুভ র সাথে অশুভের সহাবস্থানের মতোই দেবতার সাথে অপশক্তিকে লোকগল্পের আঙিনা থেকে বাদ দেওয়া কঠিন।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>