Categories
প্রাচীন ভারতে নারীর অর্থনৈতিক অধিকার ।। রানা চক্রবর্তী
আনুমানিক পঠনকাল: 21 মিনিট
বৈদিক সাহিত্য (বিশেষ করে ‘ঋগ্বেদ সংহিতা’) সাধারণ ভাবে সে যুগে ‘নারীর অর্থনৈতিক অবস্থা’ বিষয়ে নীরব। যদিও পুরুষের অর্থনৈতিক অবস্থান, তাঁদের জীবিকা ও সম্পদ সম্বন্ধে কিছু তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়, কিন্তু নারীর সম্বন্ধে অল্পই জানা যায়। আমরা জানি বৈদিক নারীরা ‘পশম পাকাত’ ও সম্ভবতঃ ‘বুনত’, ‘জল আনত’, ‘পশুপালন করত’, কিন্তু কেবলমাত্র ‘খোরপোষ’ বাদে তাঁরা এই সব কাজের জন্য কিছু উপাৰ্জন করত কি না তা জানতে পারা যায়না। নিঃসন্দেহে নারীরা ‘গৃহকর্ম’ করত; ‘রান্নাঘর’ ও ‘শিশুপালন’ তাঁদেরই এক্তিয়ারে ছিল, কিন্তু এখনও যেমন হয় তখনও সেই কাজগুলির অর্থনৈতিক দিক দিয়ে কোনও হিসেব হত না, ফলে কোনও মাইনে দেওয়া হত না। ‘কুমারী’র কোনও পৃথক সত্তা ছিল না; সে তা একভাবে পেত কেবল বিবাহের পরে। ব্রাহ্মণ সাহিত্যে স্পষ্ট ভাবে পুত্ৰকে ‘বর’ (আশীর্বাদ) এবং কন্যাসন্তানকে ‘অভিশাপ’ বলে অভিহিত করা হয়। তাই স্নেহশীল পিতামাতা বাদে অন্য সকলে কন্যাকে, খুব কম করে বললেও, ‘উৎপাত’ মনে করত। বিবাহের সময়ে ‘দান’ করে দেওয়ার আগে পর্যন্ত গৃহে তাঁর উপস্থিতি কোনও রকমে সহ্য করা হত।
পরবর্তী এক সংহিতায় কিন্তু ‘অত্রি’ বলেছেন – ‘পিতার, ভ্রাতার বা পুরুষানুক্রমিক সম্পত্তিতে কুমারীর অধিকার আছে।’ এই সম্পত্তি ‘বিক্রি করার’, ‘বাঁধা দেওয়ার’ বা ‘নিজের বলে ভোগ করার’ সম্পূর্ণ অধিকার তাঁর ছিল। অবশ্যই আমরা এখানে ‘প্রৌঢ়া কুমারী’–‘কুলপা কুমারী’, ‘আমাজু’ বা ‘অমাজুরা’র কথা চিন্তা করছি। ‘সাংকৃত্যায়নী’ বা ‘পণ্ডিত কৌশিকী’, উপনিষদের ‘ব্ৰহ্মবাদিনীর আধ্যাত্মিক মানসকন্যা’, যাঁদের কাছে ‘সম্পত্তির অধিকার’, ‘বিক্রয়’ বা ‘বন্ধকের’ কোনও ‘গুরুত্ব’ ছিল না তাঁরা সাহিত্যে উল্লিখিত। হয়তো আরও কোনও কোনও প্রৌঢ়া কুমারী থাকত, যাঁরা না ছিল পণ্ডিত, না করত ধ্যান, যাঁদের অর্থের প্রয়োজন ছিল জীবনধারণের জন্য, হয়তো ভাল ভাবে ও স্বাধীন ভাবে জীবনধারণের জন্য। এমনও হতে পারে যে কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে তাঁদের সম্পত্তির উপর অধিকার ছিল। কিন্তু ‘অত্ৰি’ও সম্পত্তি দান করার অধিকারের কথা কিছু বলেন না।
প্রাচীন শাস্ত্রে উল্লেখিত – ‘যে কুমারীকে বিক্রি করা বা কেনা হয়েছে, তাঁকে কখনও স্ত্রীরূপে গ্ৰহণ করা যায় না।’ এর থেকে প্রমাণ হয়, কুমারীদের ‘বেচা-কেনা’ চলত। কিছু শাস্ত্রগ্রন্থের মতে, ‘অত্যন্ত দুৰ্গতির অবস্থায়’ পিতামাতা উভয়ের সম্মতিতে তা সম্ভব হত। কুমারী হিসেবে যে স্ত্রী কেনা হয়েছে, তাঁর গর্ভস্থ পুত্রসন্তান পিতার শ্রদ্ধাদিকর্মের অনুষ্ঠান থেকে বঞ্চিত হত। শাস্ত্রে আরও উল্লেখিত হয়েছে যে, বিবাহের কারণে কুমারীর সতীত্ব, অর্থাৎ সামাজিক দৃষ্টিতে তাঁর কৌমার্যের অক্ষমতা, যথেচ্ছ ভাবে কলুষিত করা যেত না। ‘যে ঈর্ষাবশত তা করে তাঁকে ২২৫ পণ দণ্ড দিতে হয়।’ অতএব তাঁর সামাজিক মর্যাদার অর্থমূল্য ছিল। এছাড়াও, ‘যে দোষযুক্ত কন্যার দোষগুলি ঢাকা দিয়ে বিবাহ দেয়, তাঁর বরকে ৯৬ পণ দণ্ড দিতে হত।’ এই বিষয়ে শাস্ত্রের আরও একটি বিধান হল – ‘যে দ্বিজ তাঁর পত্নীর বান্ধবীকে (মনে হয় কুমারী) জানে… তাঁকে সাধারণ প্ৰায়শ্চিত্ত অনুষ্ঠান করতে হবে এবং একটি দুগ্ধবতী ধেনু দান করতে হবে।’
‘মনু’ অনুজ্ঞা দিয়েছিলেন, ব্রাহ্মণ ভাইয়েরা তাঁদের পৈতৃক সম্পত্তির তাঁদের যে ভাগ তার এক চতুর্থাংশ করে পৃথক পৃথক ভাবে তাঁদের অবিবাহিতা ভগ্নিকে দেবেন; তা না করলে তাঁদের সর্বনাশ হবে। ‘গৌতম’ বলেছিলেন, ‘অবিবাহিত কন্যারা যদি জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত না হয় তবে তাঁরা মায়ের মৃত স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে।’ অবিবাহিত কন্যার ভাইয়েরা মাতার মৃত্যুর পূর্বে না পরে তাঁর স্ত্রীধন দেবে, সে বিষয়ে মতভেদ আছে। কিন্তু ‘বৌধায়ন ধর্মসূত্র’ এবং তার বহু পূর্বে ‘তৈত্তিরীয় সংহিতা’ (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দী) অনুসারে – ‘ন্ত্রিয়ো নিরিন্দ্ৰিয়া আদায়াদীঃ’, অর্থাৎ সাধারণ ভাবে নারীরা (বিশেষ করে ভগ্নিরা) পারিবারিক সম্পত্তির ভাগে অনধিকারী।
কুমারীর ‘বাগদত্তা’ পতি মারা গেলে সে শুধু তাঁর পিতারই, অর্থাৎ তাঁর ভবিষ্যৎ তাঁর পিতাই স্থির করবেন। কুমারী যদি ‘বলপূর্বক অপহৃত’ হয় এবং অপহরণকারী তাঁকে বিবাহ না করে, তবে ‘আইনত অপরের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হতে পারে।’ ‘নববধূ কুমারী কন্যা, রুগ্না অন্তঃপুরিকা, গর্ভিণী-গৃহস্থ অতিথিকে ভোজন করাবার পূর্বে এঁদের ভোজন করাতে পারে।’ কন্যাদের কখনও কখনও কিছু শিক্ষা দেওয়া হত, যদিও বৈদিক শিক্ষা থেকে তাঁরা বঞ্চিত ছিল; ‘ভরদ্বাজ গৃহ্যসূত্ৰ’-তে কোনও কন্যাকে বিবাহ করার বিষয়ে চারটি আগ্রহের কারণ দেখানো হয়েছে – ‘ধন’, ‘রূপ’, ‘বুদ্ধি’ ও ‘বংশ’। বুদ্ধির পরিবর্তে ‘মানব গৃহসূত্রে’ ‘বিদ্যা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। ‘বৃহদারণাকোপনিষদ’-এ পণ্ডিত কন্যালাভের জন্য অনুষ্ঠানের নিয়ম আজও অনেক জায়গায় মানা হয়। এই সব শাস্ত্রগ্রন্থের থেকেই ‘গার্গী’, ‘সুলভা’ প্রমুখ বিদুষী নারীদের আবির্ভাবের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। কিন্তু যদিও, যে বৈয়াকরণ শিক্ষয়িত্রী ‘নারী’ বোঝাতে ‘স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ’ তৈরি করার নিয়ম করেছেন, তাঁরা শিক্ষার দ্বারা উপার্জন করতে পারতেন কি না তা জানবার কোনও উপায় নেই। গবেষকদের অনুমান খুব সম্ভবতঃ না, কিন্তু ব্যতিক্রম থাকতে পারে। কারণ একটি অত্যন্ত অর্বাচীন তান্ত্রিক গ্ৰন্থ বলে, ‘গৃহস্থের উচিত পুত্রের মতো কন্যাদেরও সমান শিক্ষা দেওয়া।’
‘আট ধরনের বিবাহের’ কয়েকটিতে বধূর পিতা বরের আত্মীয়দের অর্থ দিত; কেবলমাত্র ‘অসুর বিবাহে’ বরের পিতা মাতা পণ দিত। ‘অসুর বিবাহে’ বর নিজের কামনা চরিতার্থ করতে বধূর পিতাকে এবং বধূকেও পণ দিত। ‘ব্ৰাহ্ম’, ‘দৈব’ ও ‘আর্য’ বিবাহে বধূর পিতা নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী ‘ধন’, ‘অলংকার’, ‘একজোড়া বলদ’ এবং ‘অন্যান্য উপহার’ দিত। ‘ব্রাহ্ম বিবাহে’ ‘প্রসাধিতা ও সুসজ্জিত কন্যা’কে ‘দান’ করা হত, ‘আৰ্য বিবাহে’ বধূকে ‘সম্প্রদান’ করা হত বরকে ‘একটি বলদ ও একটি গরু’ বা ‘দুটি বলদ ও দুটি গরু’ দান করার পরে। এই প্রথার প্রতি তৎকালীন সামাজিক ‘জুগুপ্সা’র প্রকাশ হয় অসুর নামটায়। কিন্তু বিবাহের সময়ে যখন অর্থদান হত তখন বন্ধু বা তাঁর পিতামাতাই তার সুযোগ পেত। যাঁকে ‘স্ত্রীধন’ বলে, তা তিন প্রকারের – ‘পণ, যা দিয়ে বধূকে কেনা হত’; ‘যৌতুক, অর্থাৎ বিবাহের সময়ে আত্মীয়-বন্ধুরা বধূকে যে উপহার দিত’ এবং সৌদায়িক অর্থাৎ বধূ বা বরের গৃহে আত্মীয় বন্ধুদের বধূকে বা দম্পতিকে দেওয়া উপহার’। ‘যাজ্ঞবল্ক্য’ বলেছেন – নারীকে তাঁর বন্ধু, মাতা, স্বামী বা ভ্রাতা যা দেয়, তা হল স্ত্রীধন। তাঁর আত্মীয়স্বজন (অর্থাৎ তাঁর পিতামাতার সঙ্গে সম্বন্ধীয় ব্যক্তিরা) এবং তাঁর স্বামী অথবা পিতার পরিবার তাঁকে বিবাহের পর ‘শুষ্ক’ স্বরূপ যা দেয়, তাও ‘স্ত্রীধন’। স্পষ্টতই সে সময়ের সমাজ বরের কাছ থেকে বধূর পিতা যে অর্থ নেবে এটা পছন্দ করত না। ‘মনু’ বলেছেন – জ্ঞানী পিতা কখনওই ‘কন্যাশুষ্ক’ নেবে না, কারণ লোভাবশত কন্যাশুদ্ধ নিলে সে তাঁর সন্তানকে বিক্রি করছে। এমনকী ‘গোমিথুন’ বা ‘বলীবর্দযুগল’ (কন্যার পিতা বরের কাছ থেকে গ্ৰহণ করলে) তাও কোনও কোনও শাস্ত্রগ্রন্থে ‘পণ’ বলে গণ্য হয় (‘পণ গ্রহণ করা, তা বহুমূল্যই হোক বা অল্প মূল্যই হোক কন্যা বিক্রয়ের সমান’)। লক্ষ্য করা যায়, বরকে পণ দেওয়ার প্রথা ছিল – স্পষ্ট ভাবেই হোক বা গুঢ় ভাবেই হোক; কিন্তু বরের পিতার পণ নেওয়ার বিরুদ্ধে কোনও শাস্ত্র নেই, কেউ এই আদান-প্ৰদানকে বিক্রি বলে না, যদিও প্রকৃতপক্ষে তা বিক্রয়ই।
‘কন্যাশুষ্ক’-এর বিরুদ্ধে এই যে নির্দেশ, তার দ্বারা সূচিত হয় বরপণের সপক্ষে পুরোমাত্রায় পক্ষপাতিত্ব। এটা কুষাণ যুগের সংস্কৃতায়নের একটি অবশ্যম্ভাবী লক্ষণ – যে সময়ে মনুসংহিতার প্রথম সংস্করণ রচিত হয়েছিল। আধুনিক পণ সম্পূর্ণ ভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য কর্তৃক শৃঙ্খলমুক্ত শক্তিগুলির কার্য। পণপ্ৰথা অসাম্য, অনিশ্চয়তা ও আকস্মিকতার দ্বারা নিরূপিত। বরের জন্য পণ হল ‘hypergamy’ (উচ্চতর বিবাহ প্রথা), যা ক্রমিক স্তর বিশিষ্ট বর্ণগুলির মধ্যে ব্যাপক; উচ্চতর শ্রেণিগুলিতে প্রধানতঃ ‘পণ’ এবং নিম্নতর শ্রেণিগুলিতে প্রধানতঃ ‘কন্যাশুষ্ক’ এবং ‘পণ’ ও ‘কন্যাশুষ্ক’ দুটিই সামাজিক প্রতিষ্ঠাকামী মধ্যস্তরের পরিবারগুলিতে ব্যাপক।
‘পণ’ই হোক বা ‘কন্যাশুষ্ক’ই হোক – তা সমাজে সম্পন্নতার পরিচায়ক, কিন্তু বরপণ কন্যাশুষ্ক-এর চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু কন্যাশুষ্ক গ্রহণের এই যে অনিচ্ছা, তা মনে হয় অনেকগুলি সামাজিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। সম্পন্নতা যার ফলে বধূর পরিবার পণ দিতে পারে, তা তো বটেই, এটি ইঙ্গিত দিতে যায় কোন ব্যাপক যুদ্ধের অবসানের, যে যুদ্ধ পুরুষের সংখ্যা হ্রাস করছিল, উচ্চতর বিবাহ প্রথার কামনা, সম্পদ দিয়ে সামাজিক সিঁড়িতে উপরে ওঠা এবং শেষ পর্যন্ত এর ভিত্তি হয়তো এমন কোনও ধারণা, যাতে বধূর পিতা বুঝতে পারছিল যে সে যা পণ হিসেবে খরচ করেছে তা তার পুত্রের বিবাহের সময়ে আদায় করতে পারবে। এই প্ৰথা অবশ্যই ইঙ্গিত করে নারীর সামাজিক অবনমনের, কারণ যখন একজন পুরুষ একটি কুমারীকে বিবাহ করে এবং তাঁকে চিরকৌমার্যের লজ্জা থেকে উদ্ধার করে, তখন কন্যার পিতার তাঁকে কিছু ‘মূল্য’ দিতে হয় এই উপকারটুকুর জন্য। আড়ম্বর এবং জাকজমক দেখাবার বাসনাও এখানে ছিল। খ্ৰীস্টিয় প্রথম শতাব্দীগুলির সময়ে সমাজের উপর যাঁর প্রভাব ‘ভগবদগীতা’ এবং ‘বাৎস্যায়নের’ সঙ্গে সমান ভাবে প্রবল ছিল সেই ‘মনু’ দুই সহস্র বছর ধরে সমাজ নিয়ন্ত্রণ করেছেন। তিনি ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের বিবাহের বিবরণ দিয়েছেন, যার প্রথম তিনটিতে কন্যার পিতা পণ দেয়, বরকে উপহার দেয়; কেবলমাত্ৰ অসুর বিবাহে এর বিপরীতটাই ঘটে। এর নীচ অর্থে ব্যবহৃত নাম ‘অসুর’ হয়তো দ্রাবিড় অঞ্চলে এর উদ্ভবের সূচনা করে – যেখানে দুশো বছর পূর্ব পর্যন্তও এটি ব্যাপক প্রচলিত প্রথা ছিল।
কিন্তু ‘কন্যাশুষ্ক’ অর্বাচীন বৈদিক যুগ থেকে নিয়মিত প্রথা হিসেবে গৃহীত হয়ে এসেছে। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, ইন্দ্ৰ তুমি ঈষৎ ত্রুটিগ্রস্ত জামাতা বা শ্যালকের তুলনায় অনেক বড় দাতা; অতএব ত্রুটিযুক্ত বরেরা অর্থমূল্য ক্ষতিপূরণ দিত। ‘কন্যাশুষ্ক’-এর সঙ্গে ‘পণ’কে মেলানোর এক প্রচেষ্টা দেখা যায় ‘আপস্তম্ব ধর্মসূত্রে’ (২:৬:১৩:১০:১১)। সেখানে বলা হয়েছে, ‘এ বিষয়ে ক্রয়-বিক্রয় বলে কিছু নেই। বিবাহকালে একশত মহারথী দিতে হবে, এবং তারপর তাঁদের দাতার কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে।’ এখানে ক্রিয়া শুধুমাত্র প্রশংসার উক্তি; সম্বন্ধের মূল ধর্ম। ‘কৌটিল্য’ বলেছেন, ‘ম্লেচ্ছদের পক্ষে কন্যাবিক্রয় নিন্দনীয় নয়।’ ‘যাজ্ঞবল্ক্য’ খুব যুক্তিসঙ্গত ভাবেই বলেছেন, পুত্র বা কন্যা, কাউকেই বিক্রয় করা যায় না। এই অংশের উপর ‘মিতাক্ষরা টীকা’য় বলা হয়েছে ‘যদিও কেউ তাঁর পত্নী বা কন্যাকে বিক্রয় করতে পারে না, তবুও সে তাদের প্রভু।’
পণের ব্যাখ্যা করা হয়েছে, ‘বধূর ভরণপোষণের মূল্য’ হিসেবে। গবেষকদের মতে এই মত যুক্তিসঙ্গত নয়, কারণ বধূ তাঁর সংসারের কাজকর্মে সাহায্য করে এবং ভাগ্য সুপ্ৰসন্ন হলে পারিবারিক সম্পত্তির উত্তরাধিকারীও উৎপাদন করে। এ কথাও বলা হয়েছে যে, এটি ‘কন্যাদানের দক্ষিণা’। এ কথাও গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ তথাকথিত ‘দক্ষিণা’ সামাজিক অস্তিত্বহীন নারীর দানের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন। এসথার বোসরাপ বলেছেন যে, বাইরের জগতের উৎপাদনশীল শ্রমশক্তির থেকে নারীকে সরিয়ে নেওয়ার পর পণ এল ক্ষতিপূরণ হিসেবে, কারণ তাঁদের জায়গায় পুরুষদের পারিশ্রমিক দিয়ে আনতে হল। এর মধ্যে ঐতিহাসিক সত্যের কিছুটা উপাদান থাকতে পারে। পণ ‘স্ত্রীধন’ নয়, কারণ এটি বরের পিতার প্ররোচনায় দেওয়া হয়। এম এস শ্ৰীনিবাস বলেছেন, ‘ভারতীয় উপদ্বীপ ছিল ব্ৰাহ্মণদের নিয়ে কন্যাশুষ্ক এলাকা; সেখান থেকে তা উচ্চতর বিবাহ প্রথার প্রতি এবং সামাজিক উন্নতির প্রতি আকাঙ্ক্ষাবশত উত্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল।’
এখন বধূর পিতা যে পণ দিত তা বর ও তাঁর পিতাকে দেওয়া হত, ফলে তা স্ত্রীধনের অংশ কোনও মতেই হত না; তার ব্যবহার বা অপব্যবহার সম্বন্ধে স্ত্রী কোনও কথাই বলতে পারত না। যদি বর কন্যাশুষ্ক দেওয়ার পরে ভাবী বধূ মারা যেত, তাহলে সে যা দিয়েছে তা ফিরিয়ে নিত। ‘অপরার্কের’ একটি অর্বাচীন গ্রন্থে দ্ব্যর্থহীন ভাবে বলা হয়েছে ‘সৌদায়িকের উপর স্ত্রীর সম্পূর্ণ অধিকার’ – এমনকী স্থাবর সম্পত্তি হলেও সে তা বেচতে বা দান করতে পারে; সে তা অবিকৃত রাখতে পারে; তাঁর স্বামী, পুত্রেরা, তাঁর বা তাঁর স্বামীর ভাইয়েরা তা গ্রহণ করতে বা দান করতে পারে না; তার উপর নারীর সম্পূর্ণ অধিকার। কিন্তু তাঁর আত্মীয়-বন্ধুরা বিবাহের সময়ে তাঁর পিতৃগৃহে যা দেয় তা নির্বাচিত ভাবে ‘যৌতুক’, এক শ্রেণির স্ত্রীধন, এবং যা দম্পতিকে বধূ বা বরের গৃহে দেওয়া হয় তা ‘সৌদায়িক’ এবং তার অন্তত অর্ধেকের উপর বধূর অধিকার। ‘মনু’ আরও বলেছেন, ‘যে নারীর স্বামী দ্বিতীয় বার বিবাহ করে, তার সমান পরিমাণ ধন (প্রথমা স্ত্রীকে) উচ্ছিন্ন করার জন্য ক্ষতিপূরণ স্বরূপ দিতে হবে, যদি তাঁকে স্ত্রীধন না দেওয়া হয়ে থাকে। যদি দেওয়া হয়ে থাকে, তবে অর্ধেক দিতে হবে।’ কিন্তু ‘পুত্ৰহীনা পুত্রিকা’র মৃত্যুর পরে তাঁর স্বামী তাঁর সমস্ত সম্পত্তি বিনা দ্বিধায় গ্রহণ করবে। ‘বিষ্ণু’ কিন্তু বলেছেন যে অপুত্ৰক ব্যক্তির সম্পত্তি তাঁর স্ত্রীগামী হয়, তারপর তাঁর কন্যারা, তারপর তাঁর ভ্রাতারা এবং তারপর তাঁর ভ্রাতুষ্পপুত্রেরা তা পায়।
এই সব গ্রন্থে সামাজিক নিয়ম ও মনোভাবের নানা ‘স্থানীয়’, ‘আঞ্চলিক’ ও ‘কালিক’ ব্যতিক্রম পাওয়া যায়। কোনও কোনও শাস্ত্রকার অপরদের চেয়ে একটু বেশি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেন। কিন্তু সাধারণ চিত্রটা স্ত্রীদের পক্ষে ‘আশাহীন’ ও ‘নির্মম’। স্বামী তাঁর পরবর্তী বিবাহের সময়ে তাঁকে যা দেয় তা সম্পূর্ণ ভাবে তাঁর নিজস্ব। ‘নারদ’ বলেন, দ্বিতীয় বিবাহের সময়ে স্বামী তাঁর সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ তাঁর স্ত্রীকে দেবে এবং সেই সম্পত্তি তাঁর নিজের মতো ব্যবহার করার স্বাধীনতা স্ত্রীর আছে – অন্তত পুঁথিগত ভাবে। ‘যাজ্ঞবল্ক্য’ বলেছেন – দুৰ্ভিক্ষ, অবশ্য পালনীয় ধর্মীয় অনুষ্ঠান, রোগ বা তা নিজের কারারুদ্ধ থাকার সময়ে ছাড়া স্বামীর স্ত্রীধন স্পর্শ করার অধিকার নেই। যদিও ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিগুলি যথেষ্ট নিরীহ শোনায়, সেগুলি কিন্তু প্রকৃতপক্ষে স্বামীর সুবিধা মতো ব্যাখ্যা করার অনেক ফাঁকফোকর রেখে দেয়। আর এক জায়গায় ‘যাজ্ঞবল্ক্য’ বলেছেন – ‘স্বামী দুর্ভিক্ষের কালে, কর্তব্যপালনের জন্য, রোগে অথবা বন্দিদশায় যদি স্ত্রীধন ব্যবহার করে তবে তা ফেরত দিতে সে বাধ্য হবে না। অপর এক গ্রন্থে তিনি বলেছেন – ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য বা প্রজাপত্য বিবাহে নিঃসন্তান নারীর স্ত্রীধন তাঁর স্বামী পায়। তাই নারী তাঁর নিজস্ব সম্পত্তি ব্যবহার করবে, সমাজ এটা দেখতে পারত না বা মেনে নিতে পারত না। ‘বশিষ্ঠ’ খুব স্পষ্ট ভাবেই তা প্রকাশ করেছেন – ‘স্বামীর পুনর্বিবাহের সময়ে তাঁকে যা দেওয়া হয়েছে, যা তাঁকে তাঁর আত্মীয়স্বজন দিয়েছে (‘সৌদায়িক’ বা ‘যৌতুক’ হিসাবে) এবং তাঁর শুষ্ক অর্থাৎ যা তাঁকে বিবাহের পর দেওয়া হয়েছে, তা নারীর সম্পত্তি, তাঁর স্ত্রীধন। ‘মনু’ বলেন, মাতার স্ত্রীধন কন্যার প্রাপ্য এবং কন্যার পুত্ৰ অপুত্ৰক পুরুষের সমস্ত সম্পত্তি নেবে। কিন্তু ‘মনু’ আরও বলেছেন – ‘কোনও নারীর বন্ধু বা আত্মীয়েরা মূঢ়তা বা লোভাবশত যদি তাঁর সম্পত্তি ভোগ করে, বা সে সব পাপীরা তাঁর নিজের সম্পত্তি বস্ত্ৰাদির ভোগ থেকে তাঁকে বঞ্চিত করে, তাহলে তাঁরা নরকে যায়। প্রথমতঃ, পুঁথিগত ভাবে নারীর সম্পত্তি ‘বস্ত্ৰাদি’ ছাড়াও আরও অনেক বেশি কিছু বোঝাতে পারে। কেননা, গ্রন্থে যেমন বলা হয়েছে এ সম্পত্তি এমন হতে পারে, যা ‘বন্ধু এবং আত্মীয়েরা লোভবশত ভোগ করতে পারে।’ একটি খুব প্রাচীন গ্ৰন্থ, ‘মৈত্ৰায়ণী সংহিতা’, যা আনুমানিক খ্ৰীস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীর বৈদিক গ্ৰন্থ, সেখানে বলা হয়েছে – ‘নারীর যে আত্মীয়েরা তাঁর স্ত্রীধন গাড়ি, কাপড়-চোপড় এবং স্বৰ্ণালংকার বিক্রি করে জীবিকানির্বাহ করে, তাঁরা পাপ করছে এবং পরলোকে তাঁরা আরও দুর্ভাগ্যের অধিকারী হবে।’ সুতরাং ‘বস্ত্ৰাদি’ কেবলমাত্র চোখে ধুলো দেওয়া; শ্বশুরবাড়ির লোকেরা কখনও কখনও, খুব সম্ভব প্রায়শই নির্লজ্জ ভাবে নারী যে সম্পত্তি নিয়ে এসেছে তা ভোগ করত। তাই ধনী পিতার কন্যাও – যা তাঁর স্ত্রীধন থেকে স্পষ্টই প্রমাণিত হয় – শ্বশুরবাড়িতে সত্যকার কোনও নিরাপত্তা পেত না। শিক্ষা থেকে বঞ্চিত এবং সেই কারণে অর্থকরী জীবিকা থেকে বঞ্চিত, অসহায়, শ্বশুরবাড়ির প্রবল ভাবে সংখ্যাগুরু লোভী মানুষগুলির মধ্যে আশাহীন সংখ্যালঘু নারীর তাঁর নিজত্বের যা কিছু তা রক্ষণ করার সত্যিকারের কোনও উপায় ছিল না – তা ভোগ করা তো দূরস্থান। সুতরাং এ ধরনের ঘটনা ঘটত – শাস্ত্রকার শূন্য কল্পনা করছেন না, নিষ্পাপ মস্তিষ্কে কুবুদ্ধিও ঢোকাচ্ছেন না। নরকে যাওয়ার বা পরকালে গুরুতর দুর্ভাগ্য ভোগের ভয় সেই বেচারি মেয়েটির স্ত্রীধন ভোগ করা থেকে তাঁদের কতটা বাধা দিত সেটাই চিন্তনীয়। অনুপার্জিত ধন ভোগ করা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেশ লোভনীয়। ‘দেবল’ অবশ্য দাবি করেছেন যে, ‘কন্যাশুষ্ক’ এবং ‘সুন্দ’ থেকে পাওয়া লভ্যাংশ নারীর নিজস্ব সম্পত্তি, স্বামীর তাঁর উপরে কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। ‘জৈমিনি’ও বলেছেন, নারী বিশেষ কোনও কোনও ধরনের সম্পত্তির অধিকারিণী। কিন্তু ‘কাত্যায়ন’ বলেন – নারী তাঁর শিল্পকর্মের দ্বারা যা উপার্জন করে এবং যা আপরে ভালবেসে তাঁকে দেয়, স্বামী তাঁর অধিকারী; বাকি যা থাকে, তা স্ত্রীধন। এটা পরিষ্কার যে, বিশেষ কিছুই আর বাকি থাকে না, কারণ কাত্যায়নের নির্দেশ নারীর উপার্জন এবং উপহার স্বামীর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। অন্য কোনও রকম স্ত্রীধন কল্পনা করা দুষ্কর।
গৃহস্থলির অর্থ এবং সম্পত্তি ব্যবহারে স্ত্রীর ভূমিকা কী? ‘আপস্তম্ব’ বলেছে, ‘দম্পতি পারিবারিক ধন ব্যবহার করত।’ এমনকী দার্শনিক গ্ৰন্থ ‘পূর্বমীমাংসা’ও বলেছে: দম্পতি যৌথ ভাবে সম্পত্তির অধিকারী।’ সংস্কৃত ‘দম্পতি’ শব্দের ইন্দো-ইউরোপীয় মূল শব্দটি এসেছে ‘দোমোস + পতি’ = ‘গৃহস্বামী’ থেকে। স্পষ্টতই ‘আপস্তম্ব’ এবং ‘পূর্বমীমাংসা’ দুইয়েই শব্দের মূল অর্থের সূচনা আছে।
স্বামী যদি কাজের জন্য বাড়ি ছেড়ে যায়, তাঁকে আগে স্ত্রীর ভরণপোষণের ব্যবস্থা করে রেখে যেতে হবে। তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর স্ত্রী যদি ‘মদ্যপান’ করে বা প্রকাশ্য ‘নৃত্যানুষ্ঠানে’ যায়, তাঁকে ‘ছয় কৃষ্ণল দণ্ড’ দিতে হবে। কিন্তু স্বামী বা পুত্রের ‘ঋণ’ শোধ করতে নারী বাধ্য নয়। ‘গোয়ালা’, ‘সুরাবিক্রেতা’, ‘অভিনেতা’, ‘রজক’ ও ‘শিকারী’র স্ত্রী যে ঋণ করবে তা তাঁদের স্বামীরা শোধ করবে, কারণ তাঁদের জীবিকা তাঁদের স্ত্রীর উপার্জনের উপর নির্ভর করে। যে ঋণ সে নিজে শোধ করবে বলে প্রতিশ্রুত, যে ঋণ সে তাঁর স্বামীর সঙ্গে করেছে এবং যা সে নিজে নিয়েছে, এ সবই নারীকে শোধ করতে হবে: অন্য কিছু শোধ করতে সে বাধ্য নয়। ঋণী ব্যক্তির স্ত্রীকে নিলে তাঁর স্বামীর ঋণ শোধ করতে হবে। ঋণ শোধের প্রশ্নটিই নারীর শোধ করার ক্ষমতা উত্থাপিত করে। কিন্তু সে রকম ক্ষেত্রে শোধ করা হয় যৌথ পারিবারিক কোষ থেকে এবং যদি নারীর অধিকার না থাকে তাঁকে সম্ভবত তাঁর নিজস্ব স্ত্রীধন থেকেই শোধ করতে হবে। এই ধারণার পিছনে এই অনুমান কাজ করে যে, নারীর সম্পত্তিতে অধিকার থাকা উচিত নয়, তাই তা নেই। ‘মেধাতিথি’ বলেন – নারী যা উপার্জন করে তা তার স্বামীর। ‘আপস্তম্ব’ বলে, ‘কোনও কোনও পূর্বাচার্য মনে করেন, অলংকারগুলি স্ত্রীর নিজস্ব এবং যে সম্পত্তি তাঁর পিতৃকুল থেকে লব্ধ তাও তাঁর নিজস্ব।’ মনে হয় স্ত্রীর অলংকারের উপরেও তাঁর স্বত্ব বিষয়ে মতভেদ ছিল – যে অলংকার সে তাঁর পিতৃগৃহ থেকে এনেছে! ‘বৌধায়ন’ বলেছেন, ‘কন্যা মাতার অলংকার ও আর যা নিয়মসঙ্গত, তা পেয়ে থাকে।’ ‘মনু’ স্ত্রীধনের একটি ঊর্ধ্বসীমা ধাৰ্য করেছেন – ‘২০০০ পণ পর্যন্ত’। কিন্তু ভূমি বা গৃহ স্ত্রীধন হতে পারে না। এই শাস্ত্রকাররা এটা বলেন, সম্ভবত এই কারণে যে, সেগুলি শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যাওয়া যায় না। ‘জৈমিনি’ এ বিষয়ে একমত যে নারী কিছু কিছু সম্পত্তির অধিকারিণী হতে পারে এবং হয়ও। ‘মনু’ বলেছেন স্ত্রীধনের উৎস দুটি – বিবাহের সময়ে, যাত্রার সময়ে, প্রীতির কারণে দান, ভ্ৰাতা ও পিতামাতার দান। ‘কাত্যায়ন’ একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় যোগ করেছেন: যা সে শিল্পকার্য দ্বারা উপার্জন করে এবং যা তাঁকে ভালবেসে দেওয়া হয় তা তাঁর স্বামীর অধীন, বাকিটুকু স্ত্রীধন। এক নিষ্ঠুর উপলব্ধি হয় যে, তাঁর নিজস্ব উপার্জন তাঁর নিজের নয়। ‘যৌতুক’ শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ, যা একত্ৰ উপবিষ্ট যুগলকে (‘যুতক’) দেওয়া হয়। দুষ্টা অমিতব্যয়িনী স্ত্রীর স্ত্রীধনের উপর অধিকার নেই। দুষ্ট ও লোভী শ্বশুরবাড়ির লোকেদের পক্ষে স্ত্রী যে ‘অমিতব্যয়িনী’ এ কথা প্রমাণ করা এবং যা আইনত তাঁর নিজের তা কেড়ে নেওয়া খুব কঠিন ছিল না। স্বামীর প্রতিশ্রুত স্ত্রীধন স্ত্রীকে অবশ্যই দিতে হবে – এ কথা বলার পরও আইনের ফাঁক খুঁজে নেওয়াটা সমস্যা ছিল না।
কন্যাশুষ্ক দেওয়া স্ত্রীর উপরে একটা বোঝা চাপানো, কারণ সে এবং অন্য সকলে তাঁকে পণ্যদ্রব্য বলে মনে করত। প্রাচীন গ্ৰন্থ ‘মৈত্ৰায়ণী সংহিতা’য় বলা হয়েছে – ‘স্বামী যে স্ত্রীকে ক্রয় করেছে, সে যখন অপরের সঙ্গে ব্যভিচার করে, তা মিথ্যাচার।’ কিন্তু মনে রাখতে হবে, যখন পণপ্রথার প্রচলন ঘটল, তখন বর কখনওই নিজেকে পণ্যদ্রব্য মনে করত না, যদিও সে স্ত্রীর তুলনায় অনেক বেশি পণ্যদ্রব্য কারণ পণের তুলনায় কন্যাশুষ্ক প্রায় কিছুই না, পণ হল সামাজিক প্রতিষ্ঠার লক্ষণ ও অন্যায্য এবং নির্লজ ভাবে অর্থ আদায়।
‘মনু’ বলেন – স্ত্রীকে জোর করে বশে রাখা যায় না; নিম্নোক্ত উপায়গুলি প্রয়োগ করে তাঁকে বশে রাখতে হয়। স্ত্রীদের নিযুক্ত করতে হবে অর্থ সঞ্চয় ও ব্যয় করার কাজে (অর্থাৎ পরিবারের অর্থ রক্ষণাবেক্ষণে) এবং নিজেদের ‘দেহ’, ‘গৃহ’, ‘বিছানাপত্ৰ’, ‘বস্ত্র’, ‘আসবাবপত্র পরিচ্ছন্ন’ রাখার কাজে। গৃহে বন্দি থাকলে এবং পুরুষ আত্মীয়দের পাহারায় থাকলেও (দুষ্ট) নারী যথেষ্ট রক্ষিত নয়। তাহলে স্ত্রীকে বশে রাখা, যা কি না বৈধ পুত্রসন্তান লাভে আবশ্যিক, তার একটি উপায় হল, তাঁকে নানা রকম গৃহকর্মে নিযুক্ত রাখা, যেগুলি আর্থিক মূল্যে কখনওই রূপান্তরিত করা যায় না, যার ফলে সর্বদাই তাঁর নিজেকে পরিবারের আর্থিক বোঝা বলে মনে হত।
স্বামী হারাবার পর সমাজ তাঁকে দেখতে শুরু করত আর্থিক বিপদ এবং ভার হিসেবে। কৃষিপ্রধান সমাজে যৌথ পরিবার ছিল মূল, সেখানে পরিবারের সম্পত্তি কর্ষণীয় ভূমি ভাগ করার আশঙ্কা খুবই বাস্তব ছিল। এ ব্যাপার ঘটতে পারত যদি স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী ভূমি পেত এবং সে পুনর্বিবাহ করলে তাঁর নতুন স্বামী তাঁর ভূমির ভাগ পেত। দু-একজন বাদে পরবর্তী বৈদিক স্মৃতিকারেরা নিয়ম করলেন যে, বিধবাকে স্বামীর শবদেহের সঙ্গে দাহ করা হবে; অথবা তাঁকে যদি আদৌ বেঁচে থাকতে দেওয়া হয়, তাহলে স্মৃতিকারেরা তাঁর জীবনকে জীবনমৃত্যুতে পরিণত করেছিলেন – তাঁর যে কোনও অর্থনৈতিক আশ্রয় নেই এ বিষয়ে তাঁর দৈনন্দিন জীবনে সহস্ৰ খোঁচা দিয়ে।
‘যাজ্ঞবল্ক্য’ বলেন, ‘যে নারীর স্বামী নেই তাঁর দেখাশোনা করবে তাঁর পিতা, মাতা, পুত্র, ভ্ৰাতা, শ্বশুর বা শাশুড়ি; না হলে সে নিন্দার ভাজন হবে।’ তাঁর অভিভাবকের তালিকায় শেষ দুজন বাদে বাকি সকলে তাঁর নিজের পরিবারেরই সদস্য, যাঁরা তাঁর রক্ষণাবেক্ষণ করবে বলে প্রত্যাশা করা হয়। ‘আপস্তম্ব’, ‘মনু’ এবং ‘নারদ’ একমত যে অপুত্ৰক স্বামীর বিধবা স্ত্রী সম্পত্তির উত্তরাধিকার পায় না। কিন্তু ‘গৌতম’ বলেছেন, সে তাঁর সপিণ্ড ও সগোত্রদের সঙ্গে সমান ভাবে উত্তরাধিকারী। অন্যত্র যাজ্ঞবল্ক্য নিয়ম করেছেন যে, অপুত্ৰক ব্যক্তির বিধবা প্ৰথম উত্তরাধিকারিণী। এ ব্যাপারে ‘বিষ্ণু’ ও ‘কাত্যায়ন’ও যোগ দিয়েছেন। কোনও নারীর স্বামীর যদি আট থেকে দশ বছর কোনও সংবাদ না পাওয়া যায়। তবে সে পুনর্বিবাহ করতে পারে। স্বামীর যদি পৃথক ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকে এবং এক বা একাধিক পুত্ৰ থাকে তাহলে বিধবার শুধু ভরণপোষণের অধিকার আছে। ‘নিয়োগ প্রথা’য় পরপুরুষের বিধবা নারীতে পুত্রোৎপাদন বিষয়ে ‘মনু’ খুব স্পষ্ট নন। তিনি এর নিন্দা করেন। ‘বিধবা’, এমনকী সাধারণ ভাবে নারী নিজে সন্তান পোষ্য নিতে পারে না, কারণ তাঁরা প্রয়োজনীয় বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করতে পারে না। তাই তাঁরা স্বাধীন ভাবে এমন সন্তান পোষ্য নিতে পারত না যাঁর উপরে তাঁরা অর্থনৈতিক ভাবে নির্ভর করতে পারত।
‘নারদ’ বিধবার যে সাত রকম ব্যবস্থার কথা কল্পনা করেছেন, তার মধ্যে অন্যতম বিদেশির দ্বার ক্রীত হওয়া। ‘পরাশর’ নারীর বিষয়ে যে পুনর্বিবাহের বিধান করেছেন তাঁর ফলে সে ‘পুনর্ভুব’ হয় এবং স্বামীর সম্পত্তির অধিকার হারায়। স্মরণ করা যেতে পারে, ‘দায়ভাগ নিয়ম’ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে বিধবা স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকার পেত, যা ‘মিতাক্ষরা’ নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে সম্ভব ছিল না। ফলে দায়ভাগ নিয়ন্ত্রিত বাংলায় ১৮১৫ থেকে ১৮৮০-র মধ্যে সামগ্রিক ভাবে ২৩৬৬ জন বিধবাকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, যার মধ্যে শুধু কলকাতাতেই এ রকম নৃশংসতা ঘটে ১৮৫৮টি। ঋগ্বেদের সময়েও বিধবা করুণার পাত্রীই ছিল, নচেৎ আমরা অবৈধব্যের প্রার্থনা পেতাম না। কিন্তু মহাকাব্যে এবং এমনকী ‘মনু’ও তাঁদের মৃত্যুর বিধান দেননি। ‘কুন্তী’ ও ‘গান্ধারী’ এবং ‘দশরথের তিন মহিষী’ এবং ‘বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যে বিধবারা’ বেঁচেই ছিল এবং সম্মানের সঙ্গেই বেঁচে ছিল। নিম্নতর শ্রেণির মধ্যে, যতদিন না সংস্কৃতায়নের দুৰ্ভাগ্যজনক মিশ্রণ ঘটেছিল, ততদিন পর্যন্ত ‘সতীদাহ’ ছিল না; তা শুরু হয় সংস্কৃতায়নের সঙ্গে সঙ্গেই। তথাকথিত নিম্নতর শ্রেণিতে বিধবাদের উদাহরণ সাহিত্যে পাওয়া যায় না।
বিধবাদের অর্থনৈতিক সমস্যা আরও জটিল হয়েছিল বহু বিবাহ এবং পুত্রের মাতার বিষয়ে সামাজিক গুরুত্বের কারণে। শুধু কন্যা আছে যার এ রকম বা নিঃসন্তান বিধবারা অর্থনৈতিক ভাবে উৎপীড়িত ছিল এবং সাধারণ ভাবে তাঁদের পিতামাতা বা ভ্রাতার উপর নির্ভরশীল ছিল। শ্বশুরবাড়িতে তাঁদের আরোপিত দায়িত্ব হিসেবে দেখা হত। তাছাড়া যে পুরুষের বিভিন্ন বর্ণের পত্নী থাকত, সে তাঁর বিষয় সম্পত্তি আরও জটিল পরিস্থিতিতে রেখে যেত, কারণ বিধবাদের ভাগ্য বিষয়ে স্মৃতিকারদের পরস্পর মতভেদ ছিল। কেউ ভরণপোষণে বিধবার দাবি সমর্থন করতেন, কেউ আবার নামমাত্র ভূতির পক্ষপাতী ছিলেন। কখনও কখনও আবার শাস্ত্রের বিধি এবং সমাজব্যবহার, যা সাহিত্যে পাওয়া যায়, এই দুইয়ের মধ্যে বিরোধ দেখা যায়। ‘গৌতম’ বলেছেন, ‘নিঃসন্তান ব্যক্তির সম্পত্তি তার স্ত্রীগামী।’ কিন্তু ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম’-এ আমরা শুনি এ রকম একটি বিষয় দুষ্মন্তের কাছে বিজ্ঞাপিত হলে তিনি বলেন যে, শাস্ত্ৰমতে এই সম্পত্তি রাজকোষে বাজেয়াপ্ত হবে। সম্ভবত অন্য কোনও শাস্ত্রগ্রন্থ বা আঞ্চলিক ব্যবহার দ্বারা তিনি উপদিষ্ট ছিলেন।
‘বিবাহ বিচ্ছেদ’ পাশ্চাত্য অর্থে স্বীকৃত ছিল না। যদিও এমন শাস্ত্রগ্রন্থও আছে, যেখানে নিয়ম আছে যে, প্রতিকুল পত্নীকেও ত্যাগ করা যাবে না। কিন্তু পারস্পরিক দ্বেষ থাকলে দম্পতি বিচ্ছিন্ন হতে পারে। ‘অর্থশাস্ত্র’-তে আছে – ‘স্বামী যদি স্ত্রীর দোষে বিচ্ছেদ চায়, তবে সে স্ত্রীর কাছ থেকে যা পেয়েছে তা ফেরত দেবে। যদি অনুরূপ কারণে স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে মুক্তি চায়। তবে স্বামী তার কাছ থেকে যা পেয়েছে তা ফেরত দেবে না। ধর্মবিবাহে বিবাহ বিচ্ছেদ নেই।’ এই গ্রন্থে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিদ্বেষের কারণে উভয়পক্ষকে বিচ্ছেদের অধিকার দিয়েছে, কিন্তু বিচ্ছেদের বিষয়ে পুরুষের স্বাধীনতা সম্মান পেলেও নারীকে অর্থনৈতিক দণ্ড ভোগ করতে হয়েছে, কারণ সে তাঁর স্ত্রীধন হারাচ্ছে।
সব সমাজেই সাধারণ ধর্ষণ কতকটা ক্ষমার চোখে দেখা হয়েছে। ‘যাজ্ঞবল্ক্য’ বলেছেন – দাসীকে ধর্ষণ করলে পুরুষের ‘দশ পণ’ দণ্ড হবে; সে যদি ভিক্ষুণীকে ধর্ষণ করে তবে তাঁর দণ্ড ‘২৪ পণ’। প্ৰভু দাসীকে ধর্ষণ করার বিষয়ে প্রথমেই যে প্রশ্ন মনে আসে, তা হল, সে কি করে পুরুষকে দণ্ড দিতে বাধ্য করবে? কে তাঁকে বিশ্বাস করবে, কে তাঁর পক্ষ নেবে? বরং ভিক্ষুণীর কথা অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য এবং সে হয়তো জোর করলে অর্থ পাবে, কিন্তু গোটা বাস্তাবটাই কতকটা অবাস্তব শোনায়।
সাহিত্যে ধর্ষণকারীর ‘বেকসুর খালাস’ পাওয়ার অসংখ্য উদাহরণ আছে। তাছাড়া আইন ও সামাজিক প্রথা উচ্চবর্ণের পুরুষের প্রতি এতটাই ক্ষমাশীল ছিল যে, তথাকথিত নিম্নবর্ণের নারীরা তাঁদের কাছে বিনামূল্যেই সহজলভ্য ছিল। সুতরাং শাস্ত্র বাধা দেবে এমন প্রত্যাশা ছিল না। সমাজে নারীর অতি নিম্নস্তরের অবস্থানের কারণে সে পুরুষের লালসার কাছে অত্যন্ত অসহায় ছিল এবং সেই পুরুষেরা ধর্মশাস্ত্রকারদের সাহায্যে সামাজিক স্বীকৃতি নিয়ে বিনা শাস্তিতে এই আচরণ করত।
অসতী স্ত্রীদের ভয়াবহ রকম নিষ্ঠুর ভাবে শাস্তি দেওয়া হত; যে সব ধর্মশাস্ত্ৰে এই শাস্তির বিধান আছে, সেগুলি ধর্ষকাম লেখকদের রচনার মতো লাগে। অন্যান্য শাস্ত্ৰে বিধান আছে: অসতী স্ত্রীকে তাঁর সব অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে হবে এবং তাঁকে কষ্টে থাকতে বাধ্য করতে হবে, এক গ্ৰাস মাত্র অন্ন দিয়ে। তাঁকে সব সময়ে তিরস্কার করতে হবে, মাটিতে শুতে হবে, কিন্তু তাঁর স্বামীর বাড়িতেই থাকতে হবে (যাতে সে তাঁর পপকর্ম থেকে বিরত হয়)।
এখন প্রশ্ন হল, সে যখন তাঁর কার্যকলাপ সংশোধন করবে, তখন কী হবে? তখন কি তাঁকে ভরপেট খেতে ও স্বামীর শয্যায় শুতে অনুমতি দেওয়া হবে? যদি স্বামী তাঁর ‘আজ্ঞানুবর্তিনী স্ত্রী’কে ত্যাগ করে, যে স্ত্রী কর্মপটু এবং বীর পুত্রের জননী, তাহলে সেই স্ত্রীকে (স্বামীর) সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ এবং ভরণপোষণ দিতে হবে। স্ত্রীর জীবনে অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাব ঘটায় এই নিয়মে নির্দোষ স্ত্রীকেও শুধুমাত্র স্বামীর সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ দিয়ে ত্যাগ করা যায়। সমাজে শুধু পুরুষ ও নারীর জন্য দ্বিমুখী বিচারব্যবস্থা ছিল তাই নয়, যে স্ত্রী তাঁর স্বামীর অপ্রিয়, তাঁর পক্ষে তাঁর আইনত যে অধিকার তা পাওয়ার সম্ভাবনাও দেখা যায় না। অসতী স্ত্রীকে দৈনন্দিন আহাৰ্যটুকু দিয়ে ঘরে বন্দি করে রাখতে হবে। সতীত্বের কর্তব্য যে লঙ্ঘন করেছে, সেই স্ত্রীকে ‘প্ৰায়শ্চিত্ত’ করতে হবে। তাঁকে বন্দি করে রাখতে হবে এবং খেতে দিতে হবে। ‘ব্যভিচারিণী নারী’কে তাঁর অধিকার (ভূত্যাদির উপরে) থেকে বঞ্চিত করতে হবে, ময়লা কাপড় পরতে দিতে হবে, নামমাত্র খেতে দিতে হবে। যদি সে পরপুরুষের দ্বারা গর্ভবতী হয়, তবে তাঁকে তাড়িয়ে দিতে হবে। ‘বশিষ্ঠ’ বলেন – ‘উচ্চতর তিন বর্ণের স্ত্রীরা শূদ্রের সঙ্গে ব্যভিচার করলে তাঁকে তাড়িয়ে দিতে হবে। স্ত্রী যদি স্বামী বা গুরুকে হত্যা করতে চেষ্টা করে, তবে তাঁকে তাড়িয়ে দিতে হবে।’ ‘গৌতম’ বলেছেন, ‘যদি উচ্চতর তিন বর্ণের স্ত্রী নিম্নবর্ণের পুরুষের সঙ্গে ব্যভিচার করে তবে তাঁকে কুকুর দিয়ে খাওয়ানো হবে।’
অপর দিকে ‘আপস্তম্ব’ ও ‘বৌধায়ন’ দু’জনেই বলেন মা যদি গুরুতর অপরাধের জন্য সমাজে একঘরে হয়, তাহলেও পুত্র তাঁর সঙ্গে কথা না বলে তাঁর সেবা করবে। একঘরে পিতাকে ত্যাগ করা যায়, সম্ভবত সে নিজের ব্যবস্থা নিজে করতে পারে এবং সে-ই পরিবারের সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণ করে বলে, কিন্তু মায়ের পতন ঘটলেও পুত্র তাঁকে কখনওই ত্যাগ করতে পারে না। অসতী স্ত্রীর জন্য কঠোর শাস্তির বিধান এবং পুত্রের মাকে ত্যাগ না করার মধ্যে মৌলিক ও নৃত্যুনতম মানবিকতার নিষ্কৰ্য, এই শাস্ত্রবিধানের মধ্যে স্বাভাবিক স্ববিরোধিতা আছে। সাহিত্যে কিন্তু ভিন্ন চিত্র পাওয়া যায়, ‘পতিতা’ নারীদের অভিশাপ দেওয়া হয়, শাস্তি দেওয়া হয়, এমনকী মেরেও ফেলা হয় (যথা – ‘সীতা’, ‘অহল্যা’ ও ‘রেণুকা’)।
বৈদিক যুগ থেকেই ভারতবর্ষে ‘গণিকাবৃত্তি’র পরিচয় পাওয়া যায়। নানা প্রতিশব্দ সম্ভবত নন শ্রেণি বা স্তর বোঝায়, তার মধ্যে সর্বোচ্চ ‘গণিকা’, যাঁকে সরকারি ব্যয়ে নানা কলায় শিক্ষণ দেওয়া হত; তাঁর মূল্যও সর্বাপেক্ষা অধিক। বৌদ্ধগ্রন্থে বলা হয়েছে, রাজগৃহে ‘সালাবতী’ প্রতি রাত্রে ‘একশত কার্যাপণ’ দাবি করত, এবং ‘আম্রপালী’র দক্ষিণা নিয়ে ‘রাজগৃহ’ ও ‘বৈশালী’র মধ্যে বিবাদ হয়েছিল। ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকে ‘ঋগ্বেদ’-এর গণিকার অনুগ্রহের জন্য সহস্ৰ সুবর্ণমুদ্রা পাঠানোর বিবরণ পাওয়া যায়; ‘অর্ধকাশী’র কাহিনী তো সুপরিচিত। গণিকা থাকত প্রাসাদে প্রাচুর্যের মধ্যে; তাঁর বহু ‘দাসদাসী’, ‘কুট্টনি’, ‘বিট’, ‘পীঠমর্দ’, ‘পুরুষ সেবক’ ও ‘সঙ্গীতকারী’ থাকত। ‘কৌটিল্য’ বলেন, গণিকা রাজকোষ থেকে ‘মাসোহরা’ পেত এবং তাঁর প্রতিনিধি ‘প্ৰতিগণিকা’ তাঁর অর্ধেক বেতন পেত। সম্ভবত গণিকার ‘প্রাসাদ’, ‘দাসদাসী’, ‘সংসার’ সবই ছিল রাষ্ট্রের সম্পত্তি। এর অর্থ হল, গণিকার যে শুধু ‘স্বত্ব’ ছিল না তাই নয়, তা ‘বেচবার’, ‘বাঁধা দেওয়ার’ বা ‘দান করার’ও তাঁর অধিকার ছিল না। এই নিয়ম ‘গণিকালয়ে’ যাঁরা থাকত তাঁদের জন্য কার্যকর ছিল। কিন্তু ‘অবরুদ্ধা’, অর্থাৎ ‘যাঁরা কিছু সময়ের জন্য পুরুষের রক্ষিতা হত, এবং নিজেই গৃহ পরিচালনা করত’, গবেষকরা অনুমান করেন – এই নারীরা যা উপার্জন করত, তা রাজকোষে প্রয়োজনীয় করা দেওয়ার পরে তাঁদের নিজস্ব সম্পত্তি হয়ে যেত।
রাজকোষ থেকে গণিকাদের ‘১৫০০ থেকে ২০০০ পণ বার্ষিক বেতন’ দেওয়া হত। যদি কেউ কোনও গণিকার নিষ্ক্রয় দিয়ে তাঁকে ‘মুক্ত’ করতে চাইত বা ‘বিবাহ’ করতে চাইত, তাঁর রাজকোষে ‘২৪০০০ পণ’ ‘নিষ্ক্রয় মূল্য’ দিতে হত। এ অনেক টাকা, কিন্তু গণিকার বেতনও অনেক টাকা। রাষ্ট্র যে গণিকার শিক্ষার ভার নিত, তার একটা কারণ হল, রাজা এবং তাঁর সভাসদরা অনেক সময়েই বিনোদনের জন্য যুবতী ও সুন্দরী গণিকাদের ডাকতেন। আর একটা কারণ হল, গণিকারা সুকৌশলে তাঁদের খদ্দেরদের কাছ থেকে নানান রাজনৈতিক ভাবে প্রাসঙ্গিক সংবাদ আদায় করত। সেগুলি সংগ্ৰহ করার জন্যই অধিকাংশ সময়ে ‘গণিকাধ্যক্ষ’ নিযুক্ত হত।
কিন্তু গণিকারা প্ৰায় স্বাধীন ভাবেই ধনী হত; অধিকাংশ নগরে তাঁদের মধ্যে যাঁরা শ্রেষ্ঠ তাঁদের ‘নগরশোভিনী’ বলা হত এবং তাঁরা ধনী নাগরদের আকর্ষণ করতে পারত। ‘ধৰ্ম্মপদের টীকা’য় সালাবতীর কন্যা ‘সিরিমা’র প্রতি রাত্রে ‘১০০০ পণ’ উপাৰ্জন করার বিবরণ পাওয়া যায়। গণিকার তুলনায় সামাজিক ও পরিশীলনের দিক থেকে নিকৃষ্ট ‘রূপাজীবী’, ‘যে সাধারণত মদ মাংস ব্যবসায়ীর সঙ্গে বাস করত’, তাঁর উপার্জন ছিল মাত্ৰ ‘৪৮ পণ’। কোনও পুরুষ গণিকার কন্যাকে ধর্ষণ করলে তাঁর ‘৫৪ পণ’ দণ্ড হত এবং মায়ের প্রাপ্যের ‘১৬ গুণ দণ্ড’ও দিতে হত, হয়তো তাঁর বিবাহের সময়ে ‘মুখবন্ধ’ করার উপায় হিসাবে। ‘পুংশচলী’ ছিল এই উপজীবিকার একেবারে শেষ ধাপে, তাঁর কোনও বাঁধা প্রাপ্য ছিল না। ‘কৌটিল্য’ বলেছেন – বৃদ্ধা ও অবসরপ্রাপ্তা বেশ্যাদের ‘রাঁধুনি’, ‘ভাণ্ডারী’, ‘পশম ও তসর বয়নকারিণীরূপে’ এবং ‘অন্যান্য কায়িক শ্রমের কাজে’ নিয়োগ করতে হবে। তাঁদের ‘ধাত্রী’ বা ‘মাতৃকারূপে’ ‘বেশ্যালয়ে’ অথবা ‘বেশ্যাদের শিক্ষা দেওয়া কাজে’ও নিযুক্ত করা যেত, যাতে তাঁরা কিছু উপাৰ্জন করতে পারে। কিন্তু কৌটিল্য ‘অর্থশাস্ত্র’-তে তাঁদের যে ‘অবসর ভাতা’র প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা অন্য ভাবে অসহায় এই নারীদের খুব অল্পই নিরাপত্তার আশ্বাস দিত। বেশ্যাকে তাঁর আয়-ব্যয় বিষয়ে ‘বেশ্যালয়ের রক্ষক’কে জানাতে হত।
‘দেবদাসী’ বা ‘মন্দিরের গণিকাদের’ ‘শস্যে বেতন’ দেওয়া হত – অন্যান্য কিছু রাষ্ট্রীয় কর্মচারীর মতো। দেবদাসীদের উপার্জন কোথাও স্পষ্ট ভাবে বলা হয়নি এবং তাঁদের বিশেষ কর্তব্যও উল্লিখিত হয়নি। যে সব ধনী পৃষ্ঠপোষক পরলোকে পুণ্য অর্জনের জন্য মন্দিরে দাসী কিনতেন, তাঁদের সদিচ্ছাতেই এঁদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বেশ্যালয়েই হোক বা মন্দিরেই হোক, কোনও বারাঙ্গনাই নিজস্ব নিরাপত্তা পায়নি; ‘গৌতম ধর্মসূত্র’-তে স্পষ্টই বলা হয়েছে, ‘বেশ্যার হত্যা অপরাধ নয়।’
দেখা যাচ্ছে, সাধারণ ভাবে নারীর উপার্জন বা সম্পত্তির অধিকার ছিল না। প্ৰাচীন গ্রন্থ ‘শতপথ ব্রাহ্মণ’-এ (সম্ভবত অষ্টম-সপ্তম খ্ৰীস্টপূর্ব শতক) বলা হয়েছে পত্নীর সম্পত্তির উপরে কোনও অধিকার নেই, এমনকী নিজের শরীরের উপরেও নয় (৪:৪:২:১৩)। ‘শতপথ ব্রাহ্মণ’-এ এর আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে – ‘যজ্ঞে লাঠি দিয়ে হবিকে পেটানো হয় যেমন তেমনি স্বামীও স্ত্রীকে পেটাবে, যাতে তাঁর নিজের শরীর বা সম্পত্তির উপরে কোনও অধিকার না থাকে।’ কিন্তু সমাজে দানকর্ত্রীর বহু নিদর্শন রয়েছে, শুধু রাণীরা নয়, শ্রদ্ধেয় ‘জয়সেনের জৈন শিষ্যা’, অথবা ‘সীহমিত্রের জৈনধর্মাবলম্বনকারিণী শিষ্যা’, ‘সথিসিহ ও পুষ্যমিত্রের শিষ্যা’ ইত্যাদি উদাহরণ আছে। ‘সার্থিবাহপত্নী ধর্মসোমা’ বা শ্ৰমণদের গৃহস্থ শিষ্যা ‘কোচ্ছা’ ধাৰ্মিক জৈন ভ্রাতৃগণকে নানা উপহার দিয়েছিলেন। ‘বৃহৎকল্পভাষ্যসূত্ৰ’-তে গণিকা ‘আম্রপালী’র উদ্যান দানের কথা আছে। ‘অনাথাপিণ্ডদের কন্যা’ বুদ্ধ ও তাঁর হাজার শিষ্যকে আহার দিয়েছিলেন। এ ছাড়া গণিকা ও অন্যান্য বৌদ্ধ নারীদের ‘মঠ’, ‘চৈত্য’, ‘বিহার’, ‘উদ্যান’, ‘সেতু’, ‘কুপ’, ‘জলাধার’ ও ‘অর্থ’ দানের কথা জানা যায়। খ্ৰীস্টিয় পঞ্চম শতাব্দীতে ‘দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কন্যা মহিষী প্ৰভাবতী’ নানা মূল্যবান উপহার দিয়েছিলেন। উড়িষ্যার ‘ভৌমিক রাজবংশে’ সতেরো জন রাজার মধ্যে ছ’ জন মহিষীর বিবরণ পাওয়া যায়। ‘রাজতরঙ্গিনী’তে ‘দিদা খেমা’ প্ৰথমে ‘রাজপ্রতিভূ’ হিসেবে এবং পরে স্বয়ং ‘রাণী’ হিসেবে রাজত্ব করেন। একই গ্রন্থে মহিষী ‘চুদা’ ও ‘ডামারী’ যুদ্ধে সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। নিঃসন্দেহে এই মহিষীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতাও ছিল। কিন্তু এর অধিকাংশই তন্ত্র পরবর্তী কালের প্রমাণ, যখন ব্যাপক ভাবে নারীকে ‘দেবী’ ভাবে দেখা হয়েছিল। নিঃসন্দেহে রাণীদের মান্য করা হত, অতিমানবিক শক্তির নিয়ন্তা হিসেবে, যেমন রাজাদেরও মনে করা হত – তাঁরাও ইতিহাসে আগাগোড়াই সম্মানিত হয়েছেন। তেমনি ভাবে যে রানি তাঁর নিজ ক্ষমতায় অর্থের নিয়ন্ত্রণ করেছেন, তিনিও সম্মানিতা।
প্রথম যে প্রশ্নটা আমাদের মনে জাগে, তা হল – নারীর যদি অর্থ না থাকে, তবে তারা এমন মূল্যবান দান করতে কি করে পারত? একটি উত্তর হল, যে সব ধনী গণিকা নিজেদের গৃহ পরিচালনা করত, তাঁদের রাজকোষে কর দিয়ে বাকি উপার্জনের অর্থের উপর স্বত্ব ছিল। অনেক সময়েই পাপবোধের কারণে তাঁরা তাঁদের অর্থের একটা বড় অংশ ধর্মকর্মে ব্যয় করত। দ্বিতীয়তঃ, সমাজে সবাই শাস্ত্রের অনুশাসন হুবহু পালন করত না, কিছু নারীর স্ত্রীধনের উপর অধিকার ছিলই। বিশেষ করে যদি তাঁরা রাজ পরিবার বা সম্রান্ত পরিবার বা বণিক পরিবারের নারী হত, তাহলে তা বেশ ভাল পরিমাণ হতে পারত, এবং প্রায়ই তাঁর নিন্দা বা তিরস্কারকে নীরব করিয়ে দেওয়ার অবস্থায় থাকত, কারণ টাকা কথা বলে। তাই তাঁরা দান করতে পারত এবং করতও। তৃতীয়তঃ, পাশাপাশি ভিন্ন ভিন্ন অনুশাসনের আইন সমান্তরাল ভাবে থাকত, বিশেষ করে মাতৃতান্ত্রিক অঞ্চলগুলিতে। চতুর্থতঃ, ‘নারী’, ‘সন্ন্যাসী’, ‘পত্নী’, ‘বিধবা’ অথবা ‘গণিকা’র দান বলে যেগুলি লিপিবদ্ধ আছে, তা সব সময়ে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করা ঠিক নয়, প্রায়ই ভক্ত বা শিষ্যেরা ‘ধাৰ্মিক’, ‘ক্ষমতাশালিনী’ বা ‘খ্যাতনামা নারী’র নামে দান করত। তাছাড়া দাতা স্বামীরাও এ রকম দানে উৎসাহ দিত, যদিও ‘আপস্তম্ব’ বলেছে, ‘স্বামী গৃহে না থাকলে স্ত্রী সাধারণ ব্যয়াদি করবে; তা চৌর্য বলে গণ্য হবে না।’ এর থেকে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত হয় যে, সে যদি অসাধারণ ব্যয় করে তবে সে স্বামীর অর্থ চুরি করছে বলে মনে করতে হবে! কিন্তু সমাজ যথেষ্ট পরিমাণে ফাঁক রেখেছিল যার সাহায্যে অসাধারণ পরিস্থিতিতে নারীরা তাঁদের নিজের ধন দান করতে বা ব্যয় করতে পারত।
তৃতীয়-চতুর্থ খ্রিস্টপূর্ব শতকে স্পার্টার সম্বন্ধে শুনতে পাওয়া যায় যে, ‘সমগ্র দেশের প্রায় দুই-পঞ্চমাংশ নারীদের অধীন; এটা এই জন্য যে অনেক ধনী উত্তরাধিকারিণী আছেন, এবং প্রচুর যৌতুক দেওয়া হয়।’ এথেন্সে যৌতুক দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনে বলত যে, বিবাহ শেষ হয়ে গেলে সেটা ফেরত দিতে হবে। রোমান আইনে বধু কেনা যেত। স্বামী যদি (ব্যভিচার ছাড়া) অন্য কোনও কারণে স্ত্রীকে ত্যাগ করত, তাহলে তাঁকে তাঁর সম্পত্তির অর্ধাংশ দিতে হত, বাকিটা ‘দেবী সেরেস’-এর কাছে বাজেয়াপ্ত হত। এই ‘পিকিউলিয়াম’ তাঁরা নিজেদের মতো ব্যবহার করতে পারত, যদিও প্রকৃতপক্ষে তা পিতার সম্পত্তি ‘ভোকেনিয়ান আইন’ অনুসারে আদমসুমারির প্রথম শ্রেণিতে যে ব্যক্তি আসে, অর্থাৎ যে সম্পন্নতম, সে নারী উত্তরাধিকারিণী নিয়োগ করতে পারে না। ‘ক্রীট’-এ ‘পিতার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা না করেই কন্যাকে তার ভাগ দেওয়া যাবে’। পুত্ৰহীন পিতার সম্পত্তি কন্যাগামী হত, তার নাম ‘প্যাট্রিওখস’ (অথবা ‘এপিক্লোরস’)। তাই দেখা যায়, ‘ভোকেনিয়ান আইন’, যা সমাজের সর্বাপেক্ষা ধনী অংশের জন্য নিয়ম করেছে, তা বাদে গ্রিস ও রোমে বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন আইন অনুসারে নারী সম্পত্তির উত্তরাধিকার পেতে পারত এবং পেতও।
‘গর্তিন আইন’ অনুযায়ী ‘বিবাহিত ক্রীতদাসীর নিজস্ব সম্পত্তি থাকতে পারে, কারণ বিবাহ বিচ্ছেদের নিয়মে বলা হয়, সে তার অস্থাবর সম্পত্তি (সম্ভবত নিজের জিনিসপত্র) এবং ছোটখাটো প্ৰাণী সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে।’ ফলে উদার গর্তিন আইন অনুসারে দাসেরও সম্পত্তির অধিকার ছিল। কিন্তু গ্রিস ও রোমেও সাধারণ চিত্রটা খুবই হতাশাব্যঞ্জক–পুরুষের সম্পত্তির স্বত্ব ও ব্যবহারের পরিপ্রেক্ষিতে, যদিও ভারতবর্ষের তুলনায় আইন অনেক বেশি উদার। নারীর সম্পত্তির উপর পুরুষের নিয়ন্ত্রণ তাঁর উপরে সার্বিক নিয়ন্ত্রণের একটা অঙ্গ। মানুষের প্রজননের উপায় নিয়ন্ত্রণ করতে এবং এই উপায়গুলি তৎকালে কার্যকরী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার স্বার্থে প্রয়োগ করতে রাষ্ট্র বাধ্য হয় তার নিয়ন্ত্রণ ও অধিকার নারীর নিজের দেহের উপরে বিস্তুত করতে। সুতরাং, সে তাঁর দেহের উপর সত্যকার স্বত্ব হারায়।’ মনে পড়ে যজ্ঞের ঘি-কে লাঠি দিয়ে মারার যে আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা ব্ৰাহ্মাণে দেওয়া হয়েছে, তা হল ‘এই ভাবে মারলে স্ত্রী তার নিজের দেহ ও সম্পত্তির উপর অধিকার হারায়।’ দেহ ও সম্পত্তির পারস্পরিক স্থানপরিবর্তন তাৎপর্যপূর্ণ দেহও সম্পত্তির অংশ।
আমাদের মনে রাখতে হবে, দ্রৌপদীকে সর্বসমক্ষে অপমান করতে সভায় টেনে নিয়ে যাওয়ার সময়ে দুঃশাসনের প্রতি তাঁর প্রশ্ন ছিল – ‘রাজা যুধিষ্ঠির কি আমাকে জুয়ায় বাজি রেখে হেরে যাওয়ার আগে নিজেকে বাজি রেখেছিলেন?’ প্রশ্নটা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তিনি ইঙ্গিত করছেন যে, যুধিষ্ঠির যদি আগে নিজেকে হারিয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর দ্ৰৌপদীকে বাজি রাখার কোনও অধিকার নেই। অর্থাৎ তিনি মুখে না বলেও স্বীকার করছেন, তিনি কৌরবদের অধিকারভুক্ত, তাঁর মানে, তিনি প্রকৃতপক্ষে তাঁর স্বামীর সম্পত্তি, এবং স্বামী তাঁকে বাজি রাখতে পারেন। এর বহু পূর্বে ঋগ্বেদের জুয়াড়ি আক্ষেপ করে যে, সে তাঁর স্ত্রীকে বাজিতে হেরেছে। সুতরাং স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তি হিসেবেই ব্যবহৃত হত। ‘শৰ্মিষ্ঠা’ দেবযানীর যৌতুকের অংশবিশেষ ছিলেন; কিন্তু ‘যযাতি’ দেবযানীকে বিবাহ করে গোপনে শর্মিষ্ঠা উপভোগ করেন এবং তাঁর গর্ভে ‘অনু’, ‘পুরু’ ও ‘দ্রুতু’র জন্ম দেন। সুতরাং যৌতুকের অচেতন অংশ যেমন স্বামী দখল করতে পারত। তেমনই বধূর মানুষ সহচরদেরও সে তা করতে পারত।
প্রাচীন ভারতের নারীদের ‘অর্থ উপার্জন, ‘অধিকার বা ‘ব্যয় করার’ থেকে এবং ‘অর্থ বা অন্য সম্পত্তি বিক্রি’, ‘বাধা দেওয়া’, ‘গচ্ছিত রাখা বা দান করা থেকে বঞ্চিত করা’র ব্যবস্থাকে বিশ্লেষণ করলে আমরা কয়েকটি কারণ দেখতে পাই। আর্যরা উত্তর ভারতীয় ভূখণ্ডের অধিকাংশ দখল করে নেওয়ার পর তাঁদের অল্প মূল্যের দাসের এক সরবরাহ ছিল। পূর্বে পরিবারের মেয়েরা বাইরের অর্থনৈতিক কার্যকলাপে পুরুষের সহায়তা করত এবং তাই তাঁরা উৎপাদন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃত হত। তাঁরা উপার্জনকারী বা উপার্জনকারীর সহায়ক হিসেবে কিছুটা মানবিক সম্মান পেত। কিন্তু যখন বিশাল এক দাস শ্রেণি আৰ্যদের ব্যবহারে লাগল তখন নারীদের আর বাইরের শ্রমসাধ্য কাজে যোগ দিতে হত না। ততদিনে দেশের ভিতরে এবং সাগরপারে উৎপাদন ও বাণিজ্যের উদ্ধৃত্তি সঞ্চিত হয়েছে শ্রেণিবিভক্ত এক সমাজে অল্পসংখ্যক সুবিধাভোগীর হাতে। ব্রাহ্মণ সাহিত্য থেকে শুরু করে আমরা সমাজের উপরের স্তরে মুষ্টিমেয় কিছু পরিবারের পরিস্ফুট ভোগের উল্লেখ পাই। সেই সময়ে আইনসঙ্গত উত্তরাধিকারীর হাতে সম্পত্তি রেখে যাওয়ার উৎকণ্ঠায় অন্তঃপুরেও পুরুষের আরও সজাগ পাহারায় নারীর আরও কঠিন বন্দিত্ব উপস্থিত হল। তাছাড়া এই ভাবে ঘরে থাকায় নারীর রূপের সৌকুমাৰ্য বজায় রইল, যা সম্পত্তির পুরুষ অধিকারীদের কাছে প্রিয়। তখন এ কথা স্পষ্ট হল যে নারীরা, যাদের মধ্যে অধিকাংশই প্রকৃতপক্ষে ‘নিরক্ষর’ এবং কেবলমাত্র গৃহকর্মে ‘নিপুণা’, তারা অর্থনৈতিক ভাবে তাদের স্বামীদের উপর বোঝা এবং এই থেকেই তাঁদের ভোগ্যবস্তু হিসেবে গণ্য করার পদ্ধতি সহজ হল। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে ‘বাৎস্যায়ন’ নারীর সম্বন্ধে দুই পরিপ্রেক্ষিতে – ‘কুমারী হিসেবে’ ও ‘গণিকা হিসেবে’ – পরিষ্কার বলেছেন, ‘তাঁদের সমৃদ্ধ ও আকর্ষণীয় ভাবে সাজগোজ করতে হবে, কারণ নারী পণ্য।’
এখন নারীদেরই যদি পণ্য বলে মনে করা হয়, সম্পত্তি বা পদার্থ হিসেবে, তাহলে তাঁদের সম্পত্তি বা ঐশ্বর্য ব্যবহার করার স্বাধীনতা কেউ আশা করে না। সমাজ তাঁদের ব্যক্তি মানব হিসেবে স্বীকার করতে ভয় পেত।
গৃহকর্মে নারীর অবদান কখনও অর্থের নিরিখে পরিমাপ করা হয়নি, তাই যদিও তাদের মধ্যে অনেকেই অনেক ‘গৃহকর্ম’ করত, তাঁদের ‘খাদ্য’, ‘বস্ত্ৰ’, ‘আশ্রয়’ ও ‘জীবনের অন্যান্য প্রয়োজনীয় বস্তু’র জন্য পুরুষের উপরে অর্থনৈতিক ভাবে নির্ভরশীল বলেই মনে করা হত। উৎপাদনের কাজে যুক্ত থাকলেও তা যথেষ্ট নয়, তাঁকে তবুও বোঝা বলেই গণ্য করা হয় এবং প্রত্যাশা করা হয়। সে তাঁর ‘পিতা’, ‘ভ্রাতা’, ‘স্বামী’ বা ‘পুত্রের’ অধীনে থাকবে। যখন তাঁর হাতে টাকা এবং সত্যিকারের সম্পত্তি আছে, যা সে নিজের ইচ্ছা মতো ব্যবহার করতে পারবে, তখনই তাঁর অর্থনৈতিক সত্তা স্বীকৃত হয়েছে। আইনেই স্বীকৃতি এবং ‘ব্যয়’, ‘সঞ্চয়’ বা ‘যথেচ্ছ ভাবে নিজের অর্থ ব্যবহার করার সচেতন স্বাধীনতা’ই তাঁকে সম্পন্ন নারীর স্থান দিয়েছে। ‘স্ত্রীধন’ বা ‘সৌদায়িক’ বা ‘যৌতুক’ পুঁথিগত ভাবে একান্তই তাঁর নিজস্ব; কিন্তু সমাজের অনুভূতি ও তাঁর নিজের অনুভতি হল যে, সে ‘ভাৰ্যা’ বা ‘ভরণীয়া’, অর্থাৎ যাঁকে ‘ভরণ’ করতে হয় এবং সেই কারণেই ভরণপোষণের জন্য স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকেদের অধীন, যেমন ‘ভৃত্য’, ‘দাস’ তেমনই এবং এতে স্ত্রীধন লুঠ করায় শ্বশুরবাড়ির লোকেদের সুবিধা হয়। কেবলমাত্র খুব ধনী নারীরা, যেমন রাণী, যাদের ঐশ্বর্য রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বারা বুদ্ধিপ্রাপ্ত, তাঁরাই সত্যি করে নিজেদের অর্থের উপরে নিয়ন্ত্রণ রাখত; অথবা যে গণিকা তার নিজের অর্থ ‘উপার্জন’ করে করা দেয় এবং কখনও এতই সম্পন্ন হয় যে রাজা এবং বণিকরাও তাঁর ক্ষমতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়, সে-ই সময়বিশেষে সমাজে অর্থবল প্রয়োগ করার স্বাধীনতা পায়। তাছাড়া সর্বত্রই ধনী দাতারা সম্মানিত হয় এবং লোভী প্রার্থীদের কাছে অর্থে কোনও কলঙ্ক নেই। ধর্মকর্ম সর্বত্র এবং সর্বকালে অর্থের পাপ স্খলন করে।
কিন্তু এই ব্যতিক্রমগুলি বাদ দিলে সাধারণ ভাবে ‘দাসী’, ‘গৃহবধূ’ বা ‘বিধবারা’ পুরুষ ও তাঁর পরিবারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকত, কারণ গৃহে তাঁদের শ্রম যতই গুরুতর হোক না কেন, উৎপাদনমূলক বলে গণ্য হত না। তাঁদের একমাত্র মূল্য তাঁদের প্রজননের ভুমিকায়। কিন্তু সেখানেও তাঁদের ‘ক্ষেত্র’ হিসাবে দেখা হত, ফসল হল বপনকারীর নিজের। দীর্ঘ শতাব্দী ধরে সমাজ ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিত ভাবে নারীর পায়ের তলা থেকে তাঁর আত্মসম্মানের শেষ অবলম্বনটুকু সরিয়ে নিয়েছে, তাঁকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে এবং গৃহে তাঁকে এমন এক নিশ্চেতন ভূমিকা দিয়ে যাতেতাঁর সাধারণ বুদ্ধি ‘সীমাবদ্ধ’ হয়ে যায় এবং পুরুষ ঘোষণা করতে পারে যে, নারীর অর্থের প্রয়োজন নেই এবং অর্থ পেলেও তাঁর উপরে ‘নির্ভর’ করা যায় না।
(তথ্যসূত্র:
১- প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ, সুকুমারী ভট্টাচার্য।
২- Position of Women in Hindu Civilization: From Prehistoric Time to the Present Day, A. S. Altekar, Motilal Banarsidass (২০১৬)।
৩- Woman in Ancient India (Vedic To Vatsyayana), Dr. S. N. Sinha & Dr. N. K. Basu, Khama Publishers (২০১৮)।)
কনটেন্ট রাইটার, ইতিহাস নিয়ে লিখতে ভালবাসেন।