| 23 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ইরাবতী গল্প: এই শীতের আগে । রাসেল সাইদ

আনুমানিক পঠনকাল: 12 মিনিট

তখনও ঠিক সকাল হয়নি। ভোর। আবছা আলো ছড়িয়ে আছে বাইরে। চারপাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে সবেমাত্র। কী এক কোমল আলো বাইরে তখন!

ঘরের ছোট দেয়ালঘড়িতে সেই সময় সাড়ে পাঁচ। সুরমা বেগমের ঘুম ভেঙেছে কিছুক্ষণ আগে। সে শুয়ে আছে বিছানায়। তার মাথার কাছের এক পার্ট খোলা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।

কাল মাঝরাতে কারেন্ট চলে গিয়েছিল। ঘরের ভিতরে ভ্যাপসা এক গরমে তখন তার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল হঠাৎ। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে মাথার কাছের জানালাটার একটা পার্ট হাত বাড়িয়ে খুলে দিয়েছিল তখনই।

কাল রাতে তার ভাল ঘুম হয়নি। বার বার ঘুম ভেঙেছে। কিন্তু এখন যে একটু বেশি সময় পর্যন্ত ঘুমাবে সেই উপায় নেই। এক্ষুণি তাকে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়তে হবে। আজ তার অনেক কাজ।

সুরমা বেগম বালিশে রাখা মাথাটা সামান্য কাত করে তাকিয়ে আছে জানালার দিকে। ঘুম ঘুম চোখ তার। জানালার বাইরে তার দেখার মতো অবশ্য তেমন কিছু নেই। দৃষ্টির সীমানায় দ্রষ্টব্য বলতে এক নম্র আলো। এই আলো রহস্যময়ও কিছুটা যেন।

এখনও শীত পড়া শুরু হয়নি এখানে। তবে শীত পড়বে। আর কিছু দিন পর থেকেই হয়তো। এখন কার্তিক মাস চলছে। আজ সাত তারিখ। এই মাসের শেষ দিক থেকেই শীত পড়তে শুরু করবে। তারপর অগ্রহায়ণপৌষ পুরোদমে শীত।

শীতকালের কিছু ভাল দিক যেমন আছেতেমন কিছু খারাপ দিকও আছে। সবচেয়ে খারাপ দিক হচ্ছেশীতে গায়ের চামড়া খসখসে হয়ে যায় এবং পায়ের গোড়ালি বিচ্ছিরি রকম ফেটে যায়।

জানালায় তাকিয়ে– বিছানায় শুয়েশুয়ে এই সব সাতপাঁচ কথাই ভাবছে সুরমা বেগম। এমন সময় মনে মনে সে একটা প্রার্থনা করে বসল হঠাৎ -“আজকের দিনটা ভালোয় ভালোয় পার করে দিয়ো খোদা।” সঙ্গে সঙ্গে তার দু’চোখের কোণা ভিজে উঠল।

জানালা থেকে চোখ সরিয়ে সুরমা বেগম তাকাল বিছানার পাশে। সেখানে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে তার ছোট মেয়ে শিলা। কী গভীর ঘুমে আছন্ন হয়ে আছে মেয়েটা। কাত হয়ে একটা হাত গালের তলায় রেখে আরামে ঘুমাচ্ছে। ফুসফাস করে ছোটছোট নিঃশ্বাস পড়ছে তার– টের পাওয়া যায়।

আর শিলা ওপাশে খাটের অন্য দিকে আছে সুরমা বেগমের মেজ মেয়ে নিলা। সেও তখন গভীর ঘুমে। চিত হয়ে ঘুমাচ্ছে। কাঁথাটা পা থেকে মাথা পর্যন্ত জড়িয়ে।

খাটের ওপরে শুয়ে থাকা এই তিনজন প্রাণী ছাড়াও এঘরে আরএকজন আছে। ওই যেখাটের কাছে– নিচে বিছানা একটা পেতে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। কী জোরে জোরে নাক ডাকাচ্ছে লোকটা। তবে অনবরত নামাঝেমাঝে। এই লোকটা হচ্ছেসুরমা বেগমের স্বামীমেরাজউদ্দিন।

আগে সুরমা বেগমেরও ঘুমানোর জায়গা ছিল এই নিচের পাতানো বিছানায়। মেরাজউদ্দিনের পাশে। চাপাচাপি করে দু’টি বালিশ পড়ত সেখানে প্রতি রাতে। ঘুমাবার আয়োজনেজীবনের প্রয়োজনে।

এখন অবশ্য নিচে প্রতি রাতে বিছানা পাতা হয় ঠিকইতবে সেখানে বালিশ পড়ে একটা। সেটা মেরাজউদ্দিনের। আর সুরমা বেগমের ঘুমানোর জায়গা নিচের বিছানা থেকে এখন হয়েছে খাটের ওপর। তাদের বড় মেয়ে মিলার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর থেকেই ঘুমানোর জায়গার এই বিরাট পরিবর্তন। তা প্রায় আড়াই মাস হয়ে গেল।

সুরমা বেগম আলতো করে হাত রাখল শিলার মাথায়। আদরে আদরে হাত বুলাল মাথায়। গায়ের কাঁথাটা একটু সরে গিয়েছিলসেটা তার বুক পর্যন্ত টেনে দিল আস্তে করে।

শিলা এবছর ফেব্রুয়ারিতে ছয়এ পড়ল। বাড়ির কাছেই একটা স্কুলে তাকে জানুয়ারিতে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করানো হয়েছে। এখন তাকে অবশ্য স্কুলে যেতে হচ্ছে না। অনেক দিন হল স্কুল ছুটি হয়ে আছে। স্কুল থেকে বলা হয়েছেকরোনা মহামারির প্রকোপ কমলে যথাসময় আবার স্কুল খুলবে। কাজেই শিলার এখন পড়ার চাপ বেশি নেই। সকাল আর সন্ধ্যায় তার নিলা আপার কাছে কিছুটা সময় বইখাতা নিয়ে বসে। ব্যসএই পর্যন্তই।

কাল দিনভর ঘরে– মায়ের সঙ্গে থেকে শিলা অনেক কাজ করেছে। বিকেলে ছাদে খেলতে পর্যন্ত যায়নি। মায়ের মতো অত কীবা করতে পারে সে। তবুও নিজের মতো করে ছোট ছোট হাতে কাজ করে গিয়েছে।

গতকাল এ বাসায় কয়েক রকম পিঠা বানানো হয়েছিল। শিলা– এই একটু হাড়িকুড়ি এগিয়ে দিয়েছে মায়ের হাতের কাছে। চামচখুন্তি এনে দিয়েছে। খালি হওয়া জগবাটিবোল এখান থেকে ওখানে সরিয়ে রেখেছে মায়ের কথামতো। ময়দাচালের গুড়োচিনিনারকেলগুড়এসবের ওপর যেন মাছি নাবসে– তীক্ষ্ণ খেয়ালও রেখেছে সেই দিকে। ছোটছোট হাত নেড়েছে অনবরত। আর এর ফাঁকে মাকে এটাওটা নিয়ে নানান প্রশ্ন করেছে। সুরমা বেগম ভীষণ ব্যস্ততার মাঝে তার সকল প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। দু’একটা কথার জবাব দিয়েছে হয়তো। বেশিরভাগ সময় নীরব থেকে সমানে কাজ করে গিয়েছে। তবুও শিলা খুব উৎফুল্ল ছিল। আনন্দিত ছিল। মা তার সঙ্গে সবকথা বলুক বা নাবলুকসরু সরু ছোট দাঁত বের করে সে হেসেহেসে কথা বলেছে প্রায় সারাক্ষণ। তার খুশি হওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে। রাত পোহালে মা আর বাবার সঙ্গে পিঠা নিয়ে বড় আপার শ্বশুরবাড়ি সেও যাবে। বাবা তার জন্য একটা নতুন ফ্রক কিনে এনে রেখেছে। সেটা পরেই সে আপার কাছে যাবে। আজ কত দিন হয়ে গেল আপাকে সে দেখেনি।

পিঠা বানানো হয়েছিল মোটামুটি বেশ কয়েক রকমের। পোয়া পিঠাপুলি পিঠাতেলের পিঠাভাপা পিঠাতালের বড়াসেমাইচিতই পিঠা। কাজ কম নয়অনেক কাজ। একা এইসব কাজ সুন্দর ভাবে সমাধা করা সহজ কথা নয়। কাজ শেষ করতেকরতে অনেক রাত হয়েছিল। সুরমা বেগম একবার ভেবেছিলবাড়ির কাছে তার এক ‍দূরসম্পর্কের বোন থাকেতাকে ডেকে পাঠাবে পিঠা তৈরির কাজে সাহায্যের জন্য। আরও দু’একজনের হাত লাগলে কাজটা তাড়াতাড়ি হয়। পরিশ্রম কম হয়। ঝামেলাও কম হয়। কিন্তু পরে সে তার এ ভাবনা বাতিল করে দিয়েছে। একাএকা সে যতটুকু– যেভাবে পারবেতাই করবে। বাইরে থেকে কাউকে খবর দিয়ে আনার কোনো দরকার নেই। ছোট এই বাসায় বরং লোকজনের ঝামেলা বাড়বে। বাড়তি চেঁচামেচি হবে। বাড়িওয়ালা এসে দাঁড়াবে তার দুয়ারে নিশ্চয়ই। এই বাড়িতে হঠাৎ এত লোকজনের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে কেন?-এর কারণ জানতে চাইবে। এসবের কোনাটাই তার পছন্দ নয়।

পিঠা তৈরি হচ্ছিল তার বড় মেয়ে মিলার শ্বশুরবাড়ি পাঠানো হবে। নতুন মেয়েজামাইকে পিঠা খাওয়ানো হবে বলে। অবশ্য শখ করে এখন পিঠা পাঠানো হচ্ছে তাও নয়। পিঠা নিয়ে কথা উঠেছে। কথা নাকি উঠিয়েছে মিলার শাশুড়ি।

যে মহিলা এ বিয়ের সম্বন্ধ করিয়েছিলসে মহিলা এসেছিল কিছুদিন আগে। এসে সুরমা বেগমকে বলল, “আসলাম দেখতেতোমরা আছ কেমন?”

মধ্যবয়স্কা এই মহিলার কাছে সুরমা বেগম ঋণী হয়ে আছে বলে মনে করে। আর মনে করবে না কেনমহিলা খুব খাটাখাটুনি করেছে মিলার এই বিয়ের ব্যাপারে। হ্যাঁএটা সত্যি যেবিয়ের ঘটকালির জন্য সে কিছু টাকা নিয়েছে বটেকিন্তু কাজ করেছে। বিশেষ করে মিলাদের বাড়ির হয়ে। ছেলের বাড়ির তুলনায় মেয়ের বাড়ির পক্ষেই সে কাজ করেছে বেশি। তার এই পক্ষপাতিত্ব অবশ্য করো কারো চোখে যে পড়েনিতা নয়। অনেকের চোখেই পড়েছে। তা পড়ুক। বিয়ের আয়োজনেঅনুষ্ঠানে অনেক কিছুই হয়। অনেক কর্মকান্ড চোখে পড়ে। সেসময় সবকিছু ধরতে নেই। ধরলে চলে না। এই ঘটকমহিলাও তাই কোনো দিকে তাকায়নি। নিজের মতো করে কাজ করে গিয়েছে বিয়ের দিন পর্যন্ত।

বিয়ের দিন বাড়ি ভর্তি মানুষের মাঝে– কিছুটা ভিড়ের একফাঁকে ঘটকমহিলা হাত ধরে সুরমা বেগমকে একসাইডে ডেকে নিয়ে কানের কাছে মুখ রেখে ফিসিফিস করে বলেছিল, “দেখেছকী সুন্দর এক ফ্যামিলিতে মিলার বিয়ের ব্যবস্থা করলাম। খানদানি পরিবার এরা। টাকাপয়সাও আছে অনেক। অন্তুত তোমাদের চেয়ে এদের অবস্থা তো অনেক ভাল। এই কথাটায় আবার মনে কিছু কোরো না।”

নাসেই দিন ঘটকমহিলার ওই কথায় সুরমা বেগম সত্যিই কিছু মনে করেনি। বরং সন্তুষ্ট চিত্তে এবং কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল ঘটকমহিলার মুখের দিকে সেই মুহূর্তে।

এই বিয়ের অনুষ্ঠানে ঝাকঝমকভাবে তেমন কিছুই করা হয়নি। বিয়ের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে দুই পরিবারেরই কিছু ইচ্ছে ছিলকিন্তু সেসব আর করা হয়নি। করোনা মহামারির এ কঠিন সময়ে ইচ্ছে হলেই সব কাজ করা যায় না। দুই পরিবারের নিকট আত্মীয়স্বজনকিছু ঘনিষ্ঠ লোকজনের উপস্থিতিতে ঘরোয়াভাবেই বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছিল শেষ পর্যন্ত।

যাই হোকঘটকমহিলা কিছুদিন আগে একবার কী মনে করে এল এই বাড়িতে। মিলার বিয়ের পর আর এদিকে আসেনি। সেদিনে এল হঠাৎ করে। এসেই সুরমা বেগমকে বলল, “আসলাম দেখতেতোমরা আছ কেমন?” সুরমা বেগম অল্প হেসে মাথা নেড়ে জানালতারা ভালই আছে। শুধু ঘরটা তাদের যেন খালি খালি লাগে এখনও। মিলার কথা প্রায় সবসময় তাদের মনে পড়ে। বড় মায়া লাগে মেয়েটার জন্য।

একটু থেমে ইতস্তত করে তারপর সে বলল, “কাকিএকটা কথা জিগ্যেস করি আপনাকেজামাইয়ের কি কোনো বদ অভ্যসটভ্যাস আছে না কিনেশাটেশা করে না তো?”

ঘটকমহিলা মিলার মায়ের মুখের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে কিছুটা থমথমে গলায় বলল, “এ কথা হঠাৎ!” ‘নামানেমিলার বাবা কী জানি জামাই সম্পর্কে কার কাছ থেকে কী শুনে এসেছে সেদিনতারপর বাড়িতে এসে বলল আমাকে।”– কথাগুলো ঘটকমহিলার কাছে বলতে যেন চাইছে না। একটা সঙ্কোচ ভাব। মনে দ্বিধা কাজ করেছে। এ প্রসঙ্গ তুলেই যেন সে একটা ভুল কাজ করে ফেলেছে।

ঘটকমহিলা চেয়ারে বসা– মাথা নিচু করে শরীর দুলিয়েদুলিয়ে নিঃশব্দে কিছুক্ষণ হাসল। তার পর মিলার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ধীরেধীরে বলল, “শোনো মাএইসব হাবিজাবি কথায় কোনো কান দিবে না। দশ জন দশ কথা বলবে। বেশিরভাগই আজগুবি কথা। ছেলে খারাপ হলে এটা কি আমি আগে জানতাম না!”

আমিও তাই বলি।”

মিলা আমার নাতনির মতন। আমি কি জেনেশুনে তোমাদের এমন বিপদে ফেলতে পারি!”

হ্যাঁতাই তো।” মিলার মায়ের সব সঙ্কোচ যেন দূর হয়ে গেছে এক দমকা বাতাসে। কন্ঠম্বরে এখন তার বেশ স্বস্তির একটা ভাব।

ঘটকমহিলা দৃঢ় স্বরে বলল, “ছেলে হান্ডেড পারসেন্ট ভাল। ভদ্র ছেলেএকটু-আধটু সিগারেট খেলে তা হয়তো খেতেও পারে। সেটা আজকাল প্রায় সব ছেলেই খায়। এটা কিছু দোষের না।”

মিলার মা খুশি মনে একফাঁকে রান্নাঘরে ঢুকে চুলায় চায়ের পানি বসাল। ঘটকমহিলা নিলা আর শিলার সঙ্গে টুকটাক কথা বলছিল। মেরাজউদ্দিন বাড়িতে ছিল না তখন।

মিলাদের এখানে আলাদা কোনো বসার ঘর নেই এই একটাই মোটামুটি বড় ঘর।– এর লাগোয়া একটা ছোট রান্নাঘর। ঘরের ভিতর– কোণার দিকে এ্যাটাচড বাথরুম। সব মিলিয়ে এতেই প্রতি মাসে সাড়ে চার হাজার টাকা গুনে দিতে হয় বাড়িওয়ালার হাতে। এ বাড়িতে তারা ভাড়া এসেছে তা প্রায় অনেক দিন হল। দুই হাজার টাকায় এসে ঢুকেছিল প্রথমে। দফায় দফায় পাঁচশো করে বেড়ে এখন সাড়ে চারএ গিয়ে ঠেকেছে। শোনা যাচ্ছেসামনের জানুয়ারি থেকে এই ঘরের ভাড়া আরও পাঁচশো বাড়বে। বাড়িওয়ালার কথা– এতে যার যার পোষাবেতারা থাকবে। আর যার পোষাবে নাসে ঘর ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে পারে। কোনো অসুবিধা নেই। শুধু এর জন্য এই বাড়ির মেন গেইটে টিনের একটা ছোট সাইনবোর্ড ঝুলাতে হবে– টুলেট। ব্যসমামলা ডিশমিশ।

মিলার মায়ের কাছে অবশ্য তাদের বাড়িওয়ালার চেয়ে বাড়িওয়ালি বেশি ভাল। অত্যন্ত স্বজ্জন মানুষ। সবসময় বাড়ির ভাড়াটিয়াদের খোঁজখবর করে। তাদের ভালমন্দ দ্যাখে। মিলার মাবাবা তাকে বেশ ভক্তি শ্রদ্ধ করে। বাড়িওয়ালা লোকটা একটু উগ্র মেজাজের। তার বাড়িতে একটু উনিশবিশ দেখেলেই খিটমিট শুরু করে। কারো ঘরে যেদিন লোকজন একটু বেশি দেখবেসেদিন সেই ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কারণ জানতে চাইবে। সন্তেষজনক জবাব পেলে ভাল। আর না পেলে শুরু হয় তার হাউকাউ। লোক হিসেবে তাকে একেবারে খারাপও বলা যায় না মিলার মাবাবা তাকেও বেশ ভক্তি শ্রদ্ধা করে। শুধু এলাকার দুষ্টু ছেলেপিলে তাকে আড়ালে ডাকে ‘বুইড়া খাটাস মোল্লা’ বলে। অত্র এলাকায় এই বাড়ির আর এক নাম– ‘খাটাস মোল্লার বাড়ি’।

সেদিন ঘটকমহিলা অনেক কথার্বাতাই বলেছিল। একসময় চা শেষ করে মুদৃ হাসতে হাসতে বলেছিল, “শোনো ঘর খালিখালি লাগলেও মেয়ে বড় হলে তাকে বিয়েশাদি দিতে হয়। শুধু মায়া করে বসিয়ে রাখলে তো চলবে না। নিয়মনীতি বলেও একটা ব্যাপার আছে। আমি তো বলবএবার নিলাকে বিয়ে দিয়ে দাও।”

মিলার মা সহজ সরল মানুষ। অত প্যাচগোচ বোঝে না ঘটকমহিলার ওই শেষ কথাটা যে মজা করে বলাসে বুঝতে পারেনি। সে চমকে উঠল কিছুটা। উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল তাকে হঠাৎ। বিচলিত কন্ঠে বলল, “নানাকাকি। আমার এতুটুকু মেয়ে। মাত্র ক্লাস টেনে পড়ছে। পনেরো বছরে পড়ল এই। ওকে এখন আমি বিয়ে দিব না।”

ঘটকমহিলা এইবার নিলার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ ইশারা করল।

নিলার বয়স কম হলেও সে তার মায়ের মতো অত সরল বোকসোকা নয়। ঘটকমহিলা যে মজা করে কথাটা বলেছেসে এটা ঠিকই বুঝতে পারল। ঘটকমহিলাকে ইঙ্গিত করে সে তৎক্ষণাৎ বলল, “বুড়ির খুব শখ হয়েছে মনে হয় বিয়ে করার। বুড়ি নিজেই একটা বিয়ে করে না কেন?”- এ কথা বলেই নিলা বুড়ির দিকে তাকিয়ে জিভ বের করে মুখ ভেংচি দিল।

মিলার মা যেন কিছুই বুঝতে পারছিল না। তার মেজ মেয়ে আর ঘটকমহিলার দিকে তাকিয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। তার পাশেই বসা ছিল শিলা। কী বুঝল কে জানে। সে মুখে হাত দিয়ে ফিচফিচ করে হাসতে ছিল। যেন অনেক মজার কথা শুনেছে।

শিলার মতো নিলারও এখন পড়ার চাপ বেশি নেই। তারও স্কুল বন্ধ। বাসায় কোনো কাজকর্মে মাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে না সে। এজন্য মায়ের কাছে প্রায়ই তাকে গালমন্দ শুনতে হয়। অবশ্য মায়ের এসব দুর্বল রাগারাগিকে সে ধর্তব্যের মধ্যে নেয় না। এসব কথা তার এক কানে দিয়ে ঢুকে আর অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যায়। সে আছে টিভি নিয়ে। আর বিয়ের সময় বোনের রেখে যাওয়া মোবাইল ফোন যেটা সে ওই সময় দখল করে নিয়েছিলসেই ফোন নিয়ে। কাজের মধ্যে তার এখন কাজ– সকাল আর সন্ধ্যায় কিছুটা সময় নিজের বইপত্র নিয়ে বসা। সঙ্গে ছোট বোনটাকে নিয়ে পড়াতে বসানো।

সুরমা বেগমের তিন মেয়ের মধ্যে তার এই মেজ মেয়েটার পড়ার মাথা সবচেয়ে ভাল। বরাবর পরীক্ষায় সে ভাল রেজাল্ট করছে। আর সত্যি বলতে কীদিনদিন এই মেয়েটা যেন আরও সুন্দরী রূপসী হয়ে উঠছে। সুরমা বেগমের কাছে এটা একটা চিন্তার কারণ। তার ধারণামেয়ে মানুষের রূপগুণ যত কমঝামেলাও তত কম। বেশি রূপের এবং গুণের হলে বরং ঝামেলা বেশি। নানা দিক থেকে ঝামেলা। একশো একটা ঝামেলা এইসব নিয়েও ঘটকমহিলার সঙ্গে একটু আগে তার কথা হচ্ছিল। একথা ওকথা অনেক কথাই হয়েছিল সেদিন। যাওয়ার আগে ঘটকমহিলা আরও বলে গেল– “শোনো মিলার মাযে জন্য তোমাদের বাড়িতে আজ আসা। আসল কথাটা এইবার বলি। মিলার বিয়ে তা আজ প্রায় দু’মাস হয়ে গেল।”

মিলার মা বলল “দু’মাসের একটু বেশি। আজ দু’মাস বারো দিন।”

যাই হোক। এ দু’মাসের মধ্যে ওই বাড়ির কেউ এই বাড়িতে আসেনি। সোজা কথাআসবার নিমন্ত্রণ পায়নি। অবশ্য তোমাদেরও কারো এর মধ্যে যাওয়া হয়নি ওই বাড়িতে। একটু আসাযাওয়ার দরকার কি ছিল নানতুন জামাই-বউকে নিয়ে সেই যে একটু নিয়মরীতি পালন করলেওই তো বিয়ের আড়াই দিনের দিন একবার আর অষ্টম দিনে আরএকবার।  এই মোট দুই বার ওরা এলগেল। ব্যসতার পর হাত ধুয়ে ফেললে না কি একেবারেকাজটা ঠিক হয়নি।” মুখ নিচু করে নাসূচক মাথা নাড়তে লাগল ঘটক মহিলা।

মিলার মা যেন কোনো কথাই ঠিক খুঁজে পাচ্ছিল না তখন। হতবিহব্বল একটা ভাব তার চোখেমুখে। অস্ফূটস্বরে বলল, “কেনএ নিয়ে কোনো সমস্যা কি হয়েছে কাকি?”

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ঘটকমহিলা বললনাসেরকম কিছু না।”

আমি কিন্তু মোবাইলে সকালসন্ধ্যা দুই বেলা মেয়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলি। জামাইয়ের কথা জিগ্যেস করি। জামাইয়ের সঙ্গে কথাও বলেছি কয়েকদিন। বেয়াইবেয়াইনের সঙ্গে প্রায়ই কথা হয়।” এক নিঃস্বাসে কথাগুলো বলে গেল মিলার মা।

খুব ভাল করো। নতুন কুটুম। আত্মীস্বজনের একটু তথ্যতালাশ নেয়াই তো উচিত।”

মিলার মা এবার আগের চেয়ে কিছুটা উচ্চ স্বরে একই সঙ্গে অভিযোগের স্বরে বলল, “আমরা তথ্যতালাশ নিলে কী হবেতারা তো একদিনও নিজে থেকে ফোন দিল না। বিয়ের পর থেকে আমরাই ফোন দিই। নামিথ্যে বলব নাজামাই মাঝেমধ্যে ফোন করে। কিন্তু বেয়াই আর বেয়াইন আজ পর্যন্ত একটা ফোন করেনি।”

ঘটকমহিলা যেন মিলার মায়ের এই কথাগুলো ঠিক শুনতে পায়নিএমন একটা ভাবভঙ্গি নিয়ে বলল, “তোমাদের বাড়িতে অনেক দিন পর আসলাম। আর আসবইবা কীকরোনার ভিতরে কে যায় কার বাড়ি। সবাই আছে ভয়েভয়েসাবধানে। এরকম একটা কথাও আমি বলেছি কিন্তু তোমার বেয়াইন– মানেমিলার শাশুড়িকে। আমি বাবা কাউকে ছাড়ি না। যা বলার সোজা মুখের ওপর বলে দিই।”

ঘটকমহিলা একটু থামতেই– মিলার মা এই সুযোগে তাড়াতাড়ি বলল, “ঠিকই তোমুখে এক রকম আর মনে অন্য রকম কথা রেখে কী লাভমন সাফ রাখাটাই আসল।”

তোমার বেয়াইন– এই মহিলা বড় চালাকচতুর। বড় সেয়ানা।” ঘটকমহিলা ঢোক গিলে তার পর আবার বলল, “গিয়েছিলাম ওই বাড়িতে গতকাল। বিয়ের পরে ওই কালই গেলাম। ভাবলামঅনেক দিন যাওয়া হয় না। দেখি ওরা আছে কেমন। আর ওদের ছোট ছেলেটা– মানেমিলার দেবরের বিয়ের জন্যও একটু কথা বলব। কিন্তু মা গো।”

মিলার মা ঘটকমহিলার মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই বলে ফেলল, “মিলা কেমন আছে?” সেই ফাঁকে শিলাও তার বোনের কথা খুব আগ্রহের সঙ্গে জানতে চাইল, “নানিবড় আপা আমার কথা কি বলেছে?” তার মুখে ছোট এক চিলতে হাসি।

মিলা ভাল আছে। আরও সুন্দর হয়েছে দেখতে। বেশ হাসিখুশিতেই আছে দেখে মনে হল।”

এসব শুনতেও ভাল লাগে কাকি।” মিলার মায়ের চোখে আনন্দ।

ঘটকমহিলা কপট বিরক্ত স্বরে বলল, “আঃআমাকে বলতে দাও। তোমরা পরে কথা বোলো।”

শিলার দিকে তাকিয়ে বলল, “অ্যাই একদম কোনো কথা বলবি না। চুপচাপ বসে থাক।”

তার পর গোলগোল চোখ করে বলল, “মিলার মাতোমার বেয়াইন আমাকে কী বলেছে জানোযদিও কথাগুলো সে হাসতেহাসতে বলেছে। তবুও বলেছে তো। কী বলেছে শোনোআমি নাকি কোনো কাজের না। তাদের ছোট ছেলের বিয়ের ঘটকালি আমাকে করতে হবে না। ছোট ছেলের বিয়ের সম্বন্ধের ব্যাপারে তারা অন্য ব্যবস্থা দেখবে। অথচ শুরুতে কিন্তু তারাই বলেছিল– এক ছেলের পর অন্য ছেলের বিয়ের জন্যও আমাকেই মেয়ে দেখে দিতে হবে। এখন দ্যাখো– তাদের কথার সুর বদলে গেছে। মিলার শাশুড়িটা বড় হারামি। মহিলাটাই আবার ওই পরিবারের সব। তার কথাই ফাইনাল কথা। সমস্যা এখানেই।” এবার অকপট এক বিরক্ত ভাব ফুটে উঠেছে তার চেহারায়।

মিলার মা ঘটকমহিলার কথামতো এতক্ষণ কোনো কথা বলেনি। এখন আস্তে করে বলল, “কেন তারা আপনার সঙ্গে এমন কথা বলছেআপনি আবার কী করলেন?”

বুঝলে নাতারা তো আমার ওপর আগে থেকেই রাগ করে আছে। তাদের পুষে রাখা সেই রাগটা– আমাকে দেখতে পেয়ে নতুন করে উঠল আবার। ওই বাড়ির তারা তো মনে করেবিয়ের সময় আমি এই বাড়ির পক্ষে বেশি কাজ করেছি। ছেলের দিকটা থেকে মিলার দিকটা নাকি আমি বেশি দেখেছি। বলএসব কোনো ভাল কথাআল্লাহ জানেনযা উচিতন্যায্য তাই আমি বিয়েতে করেছি। অন্যায় কিছু করিনি। হারাম কাজ করে টাকা নেইনি। বুকে আমার বল আছে।”

ঘটকমহিলা কথা বলতেবলতে কিছুটা হাঁপিয়ে উঠেছিল তখন। নিজে থেকেই একটু থামল ঘরের ভিতর নীরবতা। মিলার মা ঘটকমহিলার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে। কোনো কথা বলছে না। আর বলবেইবা কী। কোনো কথাও যেন সে খুঁজে পাচ্ছে না।

ঘটকমহিলার শক্ত করে রাখা চোয়াল হঠাৎ নরম হল। ঠোঁটের কোণে কোমল এক হাসির রেখা ফুটে উঠল। স্বভাবসুলভ হাসিহাসি মুখে এবার সে বলল, “আমিও বলে এসেছি তোমার বেয়াইনকেছাড়িনি। বলেছিআমাকে দিয়ে বিয়ের কাজ না করালে না করাবেন। অত ঠেকা পড়েনি আমার।”

মিলার মা সঙ্গে সঙ্গে বলল, “ঠিক কথা বলেছেন। উচিত কথা।”– এই এতক্ষণে সে যেন মুখের কথা খুঁজে পেল।

শোনো মিলার মাওই বাড়ির দুটো ভালমন্দ কথা তোমাদের এখানে এসে বললাম। মনের দুঃখেই বললাম। তোমাকে মেয়ের মতো দেখি। শোনো মাএইসব কথা তোমার বেয়াইনের কানে আবার লাগিয়ে দিয়ো না যেন আর মিলাকেও এসব কথা বলার কোনো দরকার নেই। দেখা যাবে তোমার কাছ থেকে কিছু শুনে ওই বাড়িতে আবার কী বলতে কী বলে দেয়। কমবয়সী মেয়েদের এই এক সমস্যা।”

আমার মেয়ে ওইরকম না। ঝগড়াবিবাদ থেকে দূরে থাকে। কোনো ঝুটঝামেলায় নেই।”

এটা জানি। তোমার তিন মেয়েই ভাল। তুমি নিজেও ভাল। যে মা ভালসেই সংসারে মেয়েও ভাল। এটা দেখেছি আমি।”

নিজের সম্পর্কে একটু প্রশংসা শুনেই মিলার মা খুব লজ্জা পেয়ে গেল। এই প্রসঙ্গ রেখে তাই সে বলল, “চারটা ভাত খেয়ে যান। দুপুরের খাওয়ার সময় তো প্রায় হয়েই গেল। আমাদের সঙ্গে বসে খান আজ।”

ঘটকমহিলা আনন্দিত গলায় বলল, “নানামা,- আমি খুব খুশি হয়েছি তোমার এই কথায়। আরএকদিন এসে ভাত খাব। আজ না। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে কিছুটা। বাড়ি চলে যাই এখন।”

মিলার মা একফাঁকে ঘরের এক কোণের আলমারিটা থেকে একটা হাতব্যাগ বের করল। এবং সেখান থেকে একশো টাকা নিয়ে ঘটকমহিলার হাতে চট করে গুঁজে দিল। মুখে শুধু বললএই টাকাটা দিয়ে কাকি আপনি পান কিনে খেয়েন।”

মিলার মায়ের এই কর্মকান্ডে ঘটকমহিলা যে আরও খুশি হয়ে উঠলসেটা তার ভাবভঙ্গি এবং মুখের দিকে তাকাতেই বুঝা গেল। প্রসন্ন একদৃষ্টিতে মিলার মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল সে। তার পর হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “ওই দ্যাখোআসল কথাটা না বলেই চলে যাচ্ছিবয়স বাড়ছে– বুড়ি হচ্ছি। বয়স বাড়লে যা হয় আর কী। কাজের কথাটাই এতক্ষণ ভুলে বসে আছি। অথচ আগড়ুমবাগড়ুম কত কথাই না বললাম।”

মিলার মা ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল, “কী কথা?”

কী আরমেয়ে বিয়ে দিয়েছ– এখন তো অনেককিছুই করা লাগে তোমাদের। না করলে চলে না মা।”

মিলার মা কথাগুলো ঠিক বুঝতে পারছে না। হাঁ করে তাকিয়ে রইল।

ঘটমহিলা বলতে লাগল, “মেয়ের বিয়ে হয়েছে নতুন। সবেমাত্র দুইআড়াই মাস। পরে আর কেউ অত কিছু দেখতে আসবে না। নতুননতুন এখনই যা দেখার সবাই তা দেখবে। জামাইবাড়িতে পিঠাটিঠা পাঠাতে হবে না?”

মিলার মা যেন ঘটকমহিলার কথা এখনও ঠিক বুঝতে পারছে না। সে হাঁ করেই তাকিয়ে থাকল।

ঘটকমহিলা একটু থেমে আবার বলতে লাগল, “জানি তোমাদের হাতে এখন টাকাপয়সা নেই। মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে ধারদেনা করে ডুবে আছ। তবু আমাকে বলতে হয় বলেই বলছিবিয়ের পর শীতকাল প্রথম এটা। প্রথম সিজনে তাদের পিঠা না খাওয়ালে কি চলেতোমার বেয়াইন কাল পিঠার কথাও তুলল। এ নিয়ে অনেক কিছু বলল। থাকসেসব কথা এখন আর এখানে বলতে চাই না। সব কথা বলার দরকার নেই।”

তবে আমরা জাতিতে মানুষ কিনা– তাই হয়তো সবটা সব সময় নাজানতে পারলেও তার কিছুটা কল্পনা করে নিতে পারি। অনুমানআন্দাজ করতে পারি।

পিঠা প্রসঙ্গে ঘটকমহিলার কথার ধরনেই অনুমান যা করার তা করে নিয়েছে সুরমা বেগম। তার নতুন কুটুমবেয়াইনপিঠা পাঠানো নিয়ে যে কীভাবে কী বলতে পারেসেটা ঠিকই আন্দাজ করে নিয়েছে সে।

ওই বাড়ির মানুষ তাদের প্রাপ্য মনে করে এটাওটা সবই পেতে চায়। কিন্তু এই বাড়ির মানুষও যে তা হলে তাদের কাছে কিছু প্রাপ্য– এটা কেন বুঝতে চায় নাতারা শুধু কিছু নেয়ার জন্য দু’হাত বাড়িয়ে আছেকিন্তু কিছু দেয়ার কোনো নামগন্ধ নেই। এইসব কথা ঘটকমহিলাকে শুনিয়ে কোনো কাজ নেই ভেবে সেদিন সুরমা বেগম কেবল একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেছিল। আর কোনো কথা বলেনি তখন।

সেই দিন ঘটকমহিলা এসব কথাবার্তা বলে একসময় ঠিকই চলে গেল। আর চলে যাওয়ার আগে এঘরে ফেলে রেখে গেল একরাশ চিন্তা। চিন্তার প্রথম ও প্রধান কারণ– এখন টাকা কোথায় পাই?

তারপর প্রায় এক সপ্তাহ ধরে এই চিন্তায় ব্যতিব্যস্ত ছিল সুরমা বেগম এবং মেরাজউদ্দিন। যেভাবে হোক কিছু টাকা তাদের জোগাড় করতে হবে। মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে পিঠাপুলি নিয়ে একবার যেতে হয়। কথা যেহেতু উঠেছেনা গেলে এখন আর চলে না। এটা একদিক থেকে সম্মানেরও ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কিন্তু টাকার জোগার হয় না সহজে। যার বা যাদের কাছ থেকে টাকা ধার পাওয়ার আশাতার বা তাদের কাছ থেকে আগে থেকেই টাকা ধার নেয়া। ওই তোবিয়ের সময় সাধ্যমতো টাকা খরচ করতে হয়েছে তাদের। গরীব বলে কোনো মেয়ের পরিবার বিয়ের সময় একেবারে ছাড় পায় না কি। খরচ করতেই হয় কমবেশি। তখন টাকাপয়সা লাগে।

মেরাজউদ্দিন যে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করেকিছু টাকার জন্য সেখানেও চেষ্টা করেছে লোকটা পায়নি। আর পাবেইবা কীফ্যাক্টরির অবস্থা ভাল না এখন। করোনা কালে ব্যবসা মন্দ। এর মধ্যে তার সঙ্গীসাথীদের– অনেকেরই চাকরি গেছে। তা ছাড়া মেয়ের বিয়ের কথা বলে মালিক পক্ষকে ধরে কয়ে কিছু টাকা সে আগাম নিয়েছিল তখন। মাসেমাসে বেতনের টাকা থেকে সেই টাকা কেটে রাখা হচ্ছে। সেখানে নতুন করে আবার টাকা চাওয়াতার যে চাকরিটা এখনও টিকে আছে– এটাই চোদ্দ পুরুষের ভাগ্য।

ক’দিন অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে টাকার ব্যবস্থা হয়েছে। বাড়িওয়ালি সেই ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তার পরিচিত একজনের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার পাওয়া গেছে। তবে চড়া সুদে।

সেই টাকা হাতে পেয়েই সুরমা বেগম পিঠা তৈরির জোগাড়যন্ত্র শুরু করেছে। গতকাল দিনভর– একেবারে অনেক রাত পর্যন্ত পিঠা নিয়ে কাজ করতে হয়েছে তাকে।

শুয়েশুয়ে কী ভেবে হঠাৎ সুরমা বেগম একটা দীর্ঘনিঃস্বাস ফেলল আজ তারা এঘরের সবাই যাবে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি। নাআর শুয়ে থেকে সময় কাটানো যাবে না। এইবার তাকে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়তে হবে। আজ তার অনেক কাজ।

জানালার দিকে তাকাল সে একবার। এক স্বচ্ছ আলো তখন ছড়িয়ে পড়েছে বাইরে। চারপাশ ফর্সা হয়ে গেছে, কিন্তু সামনের সবকিছু ঝাপসা দেখছে সে এখন। তার দু’চোখে টলমল করছে অশ্রু– হয়তো তাই।

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত