| 18 এপ্রিল 2024
Categories
ঈদ সংখ্যা ২০২১

প্রবন্ধ:  ভাষার মৃত্যু ঘন্টাধ্বনি ।  গৌতম গুহ রায়

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

                  

”একটা ভাষা যদি তার পরিচয় থেকে বাদ চলে যায় তা হলে কী ক্ষতি হয় মানুষের? একজন  বাঙালি যদি সারাটা দিন কোনো বাংলা অক্ষর না লিখে, না দেখের, না শুনে কাটিয়ে দিতে পারেন তো কী ক্ষতি হয় তাঁর?

এমন কোনো ক্ষতি হয় না, যা দেখা যায় ।

‘এমন কোনো ক্ষতি হয় না, যা দেখা যায় –’

মেফিস্টোফেলাস এই কথা বলেই ফাউস্টের আত্মাটা নিয়ে নিয়েছিল।”

এই কথাগুলো দেবেশ রায় লিখেছেন ‘দ্যোতনা’র ভাষা সংখ্যার আলোচনায়। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, যেটি বাস্তবিক সত্য, একজন বাংলাভাষী মানুষ যদি সারাদিনের শেষে হিসাব করেন, তিনি সেই দিনটিতে সারা দিনে একটিও অক্ষর বাংলায় লিখেছেন কি না; দেখবেন, লেখেননি, সারাদিনে একটিও বাংলা হরফ লেখেননি, কিন্তু পাতার পর পাতা লিখেছেন। আবার  অনেকেই আছেন যিনি সারা দিনে একটিও বাংলা অক্ষর লিখেন নি, পড়েনওনি। কারণ তিনি যে কাজ করেন, আদালতে, সরকারি দপ্তরে, সর্বত্র ইংরেজিতে লেখেন, পড়েন, সই করেন। নব্য শিক্ষিতদের অনেকেই তার উত্তর প্রজন্ম যাতে ইংরেজিতে পটু হয় তাই বাড়িতে বাংলা কথা বলা পরিহার করার নির্দেশ জারি করেছেন। বাংলার ‘গৃহস্থ’ ব্যবহার সেখানে কাজের মেয়ে বা বৃদ্ধ বাবা মা ঠাকুমায় আটকে আছে,  আগামী একদিন তাও ভোকাট্টা হয়ে যাবে। তবে মাতৃভাষার কি তেমন প্রয়োজন? “আগে আমার ধারণা ছিলো, মাতৃভাষা ছাড়া বুঝি প্রেমের কথা বলা যাবে না। রাস্তাঘাটে বাসে-ট্রামে চলাফেরা করতে করতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে ঘুরতে-ঘুরতে সে ভুল আমার বহুদিন  ভেঙ্গে গেছে । আগে ধারণা ছিল, মাতৃভাষা ছাড়া বুঝি মৃত্যুতে চোখের জল ফেলা যায় না। সে ভুলও আমার ভেঙ্গে গেছে।” (দেবেশ রায়/আত্মাহীন, মাতৃভাষাহীন)

গোটা বিশ্বেই আজ সবচেয়ে বড় আতঙ্ক এই মেফিস্টোফেলিসের রক্তবীজেরা। মানুষকে আত্মাহীন, চেতনাহীন, দেশহীন করার বিশ্বব্যাপী যে কর্মযজ্ঞ চলছে তাতে শুধু সে শেকড়চ্যুত হচ্ছে তাই নয় হারিয়ে যাচ্ছে তার ‘মাতৃভাষা’টাও। মাতৃভাষা বাদ দিয়ে সংস্কৃতি বিবর্জিত শিক্ষাগ্রহণ করতে গিয়ে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠির শিশুদের অবস্থা শেকরচ্যুত গাছের মতো। এই প্রবণতায় বিপন্ন হচ্ছে তার মাতৃভাষা, লুপ্ত হচ্ছে তার জনগোষ্টির নিজস্ব সংস্কৃতি।

মাতৃভাষার অধিকার মানুষের জন্মগত। সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান ও বাহন হচ্ছে মানুষের ভাষা, এর সংগে জড়িয়ে রয়েছে একটি জনগোষ্টির জাতীয় পরিচয় ও অধিকার। এখানেই আঘাত হানা হচ্ছে,  বিশ্বসাম্রাজ্যবাদের এক মুখ্য এজেন্ডা এটা। কিছুদিন আগে ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক তথ্যে জানা যাচ্ছে যে, আগামী একশো বছরে প্রায় ৩০০০ ভাষা পৃথিবী থেকে লুপ্ত হয়ে যবে। গত শতাব্দীর শেষ পর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘সামার ইন্সটিটিউট অব লিঙ্গুইস্টিক্স’-এর এক সমীক্ষায় প্রকাশ, বিশ্বে তখন ৫১টি ভাষা ছিলো যার সর্বশেষ মাত্র একজন জীবিত, লুপ্ত হয়েছে । একশো জনের কম লোক জানেন এমন ভাষা আছে প্রায় ৫০০টি। এক হাজার জন বলতে পারেন এমন ভাষার সংখ্যা এখন ১৫০০। ১০,০০০ জনের কম সংখ্যক মানুষ কথা বলতে পারে এমন ভাষার সংখ্যা এখন ৩,০০০টির মতো। বিশ্বের ৯৬% মানুষ  কথা বলেন মাত্র ৪% ভাষায়। ২০০০ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে নেওয়া সমীক্ষার উপর প্রকাশিত জাতিসঙ্ঘের বিপন্ন ভাষার মানচিত্রে (Atlas of Endangered Language) ১৯৯টি অতি বিপন্ন ভাষার পরিচিতি প্রকাশ করেছিল । সে সব ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যা একশ’র কম। এর মধ্যে আবার বিপন্নতম ভাষার সংখ্যা ১৮ (এই সমীক্ষার পর এদের দুটি ভাষাজন প্রয়াত হয়ে ভাষাটি জনলুপ্তির হিসাবে লুপ্ত হয়েছে।) এই হিসাব দেখাচ্ছে এক দশকেই কতটা ক্ষয় হয়েছে ভাষাজনের সংখ্যায়। এই ১৮টি ভাষার প্রত্যেকটির ব্যবহারকা্রীর সংখ্যা একজন করে । এই ভাষাগুলো হল, আপাইওকা (ব্রাজিল), বিকিয়া(ক্যামেরুণ), চানা(আর্জেন্টিনা), ডাম্পাল (ইন্দোনেশিয়া), দিয়াহই (ব্রাজিল), কাইজানা (ব্রাজিল, সম্প্রতি মারা গেছেন), লাওয়া (পাপুয়া নিঊগিনি), প্যাটুইন (আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র), পাজেহ (তাইয়য়ান), পেমোনো (ভেনেজুয়ালা), তাজে (ইন্দোনেশিয়া), তাওশিরো ( পেরু), তিনিগুয়া (কম্বোডিয়া), তলোয়া (ক্যালির্ফোনিয়া), ভোলো ( অষ্ট্রেলিয়া), উইনতু-নোমলাকি (ক্যালিফোর্নিয়া), ইয়াখান (চিলি), ইয়ারভি (পাপুয়া নিউগিনি)। এই উল্লিখিত ১৮টি ভাষার অনেকগুলো  ইতোমধ্যেই লুপ্ত হয়ে গেছে। ভারতের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতা উত্তর দেশে ২৫০টি ভাষার মৃত্যু হয়েছে, যার অধিকাংশ প্রান্তিক জনের ভাষা। ২০১৩ সালের পিপলস লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়ার তথ্য একথা বলছে ।

২০১০ সালে ইউনেস্কো একতি ‘বিপন্ন ভাষার মানচিত্র’ প্রকাশ করে। সেই সুত্র ইউনেস্কো থেকে বিবৃতিতে বলা হয়েছিলো যে জীববৈচিত্র্য রক্ষার মতো ভাষাবোইচিত্র টিকিয়ে রাখা প্রয়োজন।“ একটি ভাষা মানে একটা স্বতন্ত্র চিন্তন-কাঠামো । তার নিজস্ব অনুষঙ্গ , রূপক, শব্দ, ধ্বনি সব মিলিয়ে একতা স্থাপত্য কীর্তি যেন ।” আমরা জানি জীবের টিকে থাকার সংগে সম্পর্ক রয়েছে ‘খাদ্য ও খাদকের’ সম্পর্ক। ইউনেস্কো তার পর্যবেক্ষ্ণে বলেছে যে অর্থনোইতিক পালাবদসলই ভাষা-মানচিত্র বদলে সবচেয়ে বেশি দায়ী। আমরা যদি বিপন্ন ভাষার মাঞ্চিত্রের দিকে তাকাই তবে দেখবো সেই ভাষার ভূমিদেশগুলির উপনিবেশ হয়ে ওঠার রাজনোইতিক ইতিহাস আমাদের কমবেশি মনে পড়বে । তালিকার একনম্বরে আছে মাদের দেশ, ভারত। বিপন্ন ভাষা সবচেয়ে বেশি এই দেশে । একসময়ের বিশ্বব্যাংকের অর্থনৈতিক উপদেষ্ঠা জোসেফ স্টিগ্লিটজ তাঁর দুটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ The Roaring Nineties এবং Globalization and its Discontents-এ সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করে তুলে ধরেছিলেন যে এই শতাব্দী উপনিবেশিক শাসনের নয়া চেহারায় প্রত্যবর্তনের শতাব্দী। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের শাখা UNESCO-র মহাসচিব কোউচিরো মাতসুরা বিশ্বায়নের এই দাপটে ভাষা কিভাবে বিপন্ন হচ্ছে তা তুলে ধরতে গিয়ে বলেছিলেন যে heritage of tradition কে অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে দেশে দেশে স্থানীয় ভাষা সমূহকে রক্ষা করা শুধু নয়, তাকে বিভিন্ন কাজে ব্যাবহার করার উদ্যোগ নিতে হবে।

ভারতবর্ষের বঙ্গোপসাগরস্থিত দ্বীপ আন্দামানের বো ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যা আজ শূন্য । তিন দশক ধরে একাই প্রতিনিধিত্ব করে ৮৫ বছর বয়সে সিনিয়য়ার বো, বো ভাষা ব্যবহারকারিণী মহিলার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে লুপ্ত হয় ভাষাটি। আলাস্কার মেরু অঞ্চলের ইয়ক ভাষার শেষ প্রতিনিধি মেরি স্মিথ ১৮ জানুয়ারি ২০০৮এ প্রয়াত হন, ভাষাটিও লুপ্ত হয় । একটি ভাষার মৃত্যু মানে অভিধান থেকে তার অবলুপ্তি মাত্র নয়, সেই ভাষাটির মধ্যে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা একটি সমাজের সংস্কৃতির ইতিহাস এবং সমাজের আহরিত মূল্যবান জ্ঞান লুপ্ত হয়ে যার এর সঙ্গে সঙ্গে। ভাষাকে নিয়ে চর্চা তাই ক্রমশ আরো বিস্তৃত হচ্ছে, সমাজবিজ্ঞানচর্চায় ভাষা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আজ। ‘সমাজ ভাষাবিজ্ঞান’ বা sociolinguistics সমাজে ভাষার অবস্থান ও সম্পৃক্ততা নিয়ে নানা মতের সমন্বয়ে চর্চা প্রসারিত হচ্ছে । সমাজ সংগঠনের সঙ্গে সামাজিক মানুষের ভাষজা ব্যবহার সম্পর্ক যাবতীয় দিক আজ আলোচনায় আসছে,  আগামী দিনের ভাষা অস্তিত্বর পক্ষে গুরুত্বপুর্ণ ।

এঙ্গুলি ওয়া থিয়ংগ ও আলোচনা প্রসঙ্গে লিখেছেন যে, ‘ভাষা যেহেতু যোগাযোগের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম, সুতরাং ভাষার মাধ্যমেই মানুষের কল্পনাকে উপনিবেশে নিয়ে আসা সবচেয়ে সহজ । আফ্রিকার নিজস্ব ভাষাকে গোড়াতেই এমনভাবে লুট ও বিস্মৃত করা হয়েছে যে আফ্রিকাবাসীদের এখন ভাব প্রকাশের জন্য তাকিয়ে থাকতে হয় ইংরেজি, ফরাসি বা পর্তুগিজ ভাষার দিকে । বলা যায়, আফ্রিকার উপর ইউরোপের ভাষা আধিপত্য সম্পূর্ণ হয়েছে’। এ শুধু আফ্রিকার ক্ষেত্রেই ঘটেছে তাই নয়, গোটা ল্যাটিন আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এর উদাহরণ। আমাদের দেশেও আমাদের নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতি এতো সমৃদ্ধ তবুও ঔপনিবেশিক শাসক তার ভাষার আদলে গড়ে নিয়েছে আমার ভাষা-সংস্কৃতিকেও । আমাদের লোকনাটক, লোককথা ক্রমশ প্রান্তিক হয়ে পরেছে । যে সাম্রাজ্যবাদী শাসকেরা শাসনকে নিরঙ্কুশ করার জন্য ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ মুঠিতে নিয়ে আসতে চায়, ভাষার মাধ্যমে মানুষের সৃষ্টিশীলতাকে পরাধীন করার ফলে শেকড়ের মানুষ তার নিজস্ব মনন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তার ফলে তার কল্পনা ক্রমশ ইংরেজি, ফরাসি বা স্প্যানীশ, পর্তুগিজ ভাষাপ্রকোষ্ঠে বন্দী হয়ে যায় । ‘পাশ্চাত্য বা ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে এশিয়া-আফ্রিকার গত চারশো বছরের দ্বন্দ্বের ইতিহাস সমৃদ্ধ হয়ে আছে আরও অনেক কিছুর সঙ্গে কল্পনা ও আত্মানুভূতির চরম বিকৃতি, যা এশিয়া আফ্রিকার সমস্ত উৎপাদন, বন্টন ও সম্পদের ওপর চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণের ফলে ঘটাতে পেরেছে ওরা’। ভারতের ভাষা কমিশনের ভূমিকা নিয়ে সরব হয়েছিলেন প্রখ্যাত কবি ও অধ্যাপক বুদ্ধদেব বসু । তিনি লিখেছিলেন যে ভাষা- কেবলমাত্র একটি উপায় বা বাহন রূপে দেখাবারও অপচেষ্টা করা হয়েছে । ফলে, এমন একটি ধারনা সৃষ্টি হতে পারে যে, যে-কোন ভাষা দিয়েই, অর্থাৎ পরভাষার সাহায্যেও আমাদের যাবতীয় কাজকর্ম নির্বাহ হতে পারে । তাঁর প্রতিবাদের মূল যায়গাটা এখানেই, পরভাষা দিয়ে সমস্ত কাজ সাধিত হলেও, সাহিত্যসৃষ্টি সম্ভব নয়, কবিতায়, গানে, সৃজনে মাতৃভাষা আবশ্যিক। শাষকের ভাষা অনেক সময়ই জন-এর ভাষা হয় নি, মানুষ তাদের সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটিয়েছে মাতৃভাষাতেই। যেমন ল্যাটিন ভাষা নিয়ন্ত্রণের যুগে ইটালিতে অভেলিতের মুখের ভাষায় ‘ডিভাইন কমেডি’ রচিত হয়েছে। উনিশ শতকে ফরাসি ভাষা কর্তিত্বকে উপেক্ষাকরে রুশ ভাষায় সাহিত্য রচিত হয়েছে। ভারতবর্ষেও মোগল আমলে ফারসি, কিংবা ব্রিটিশ আমলে ইংরাজি শাষকের অনুগ্রহের ছাতার তলে থাকলেও বাইরে থাকা বাংলায়, তামিল তেলেগু বা লোকভাষায় সাহিত্য ও কথা রচিত হয়েছে । কিন্তু আজকের সময়ে গ্লোবালাইজেশানের কালে ভাষার বিপন্নতা ক্রমশ বাড়ছে। কাজের ভাষা না হলে বিলুপ্তির অবধারিত খাঁদে গড়িয়ে পড়বেই বিপন্ন ছোট ছোট ভাষা গুলো ।

উদাহরণ হিসাবে আমরা উত্তরের হিমালয় সন্নিহিত বাংলার দিকে তাকাতে পারি। হিমালয় সন্নিহিত বাংলায় এই ভাষা বিপন্নতার চেহারাটা এই সামগ্রিক চিত্র থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। Anthropological Survey Of India’র তথ্যানুযায়ী ভারতীয় উপমহাদেশে ৩২৫টি ভাষাগোষ্ঠি  ১২ টি পৃথক ভাষা পরিবারে বিভক্ত, যাদের নিয়ে আবার তৈরি হয়েছে বৃহৎ ভাষা-পরিবার। ভারতীয় উপমহাদেশে চারটি বৃহৎ ভাষা পরিবার রয়েছে, ভারতীয় আর্য, দ্রাবিড়ীয়, অস্ট্রিক ও ভোট-চিনীয়। এই চারটি ভাষাগোষ্ঠিরই উপস্থিতি রয়েছে হিমালয় সন্নিহিত এই বাংলায় । আমারা দেখতে পাই যে ভারতবর্ষের সংবিধানের ২৯(২) এবং ৩৫০ (ক) ও (খ) ধারায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ভাষা মূলত আদিবাসীদের সমাজের মাতৃভাষাগুলোকে উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে । সংবিধানের ভিত্তি যে মৌলিক অধিকার সেখানে ২৯নং ধারায় লেখা আছে, “Any section of the citizens residing in the territory of India or any part therof having a distinct language, script or culture of its own shall have the right to conserve the same”। কিন্তু বাস্তবের চেহারাটা অনেকটাই ভিন্ন । ভারতবর্ষে কোনো নির্দিষ্ট ভাষানীতি নেই বা ‘ভারতের ভাষানীতি’ বলে কোনো দস্তাবেজ  তৈরি  হয়নি। ১৯৯২তে আমরা যে সংশোধিত শিক্ষা নীতি পাই সেখানে উল্লেখ আছে যে, অল্প-সংখ্যক গোষ্ঠির সদস্যদের নিজস্ব শিক্ষা প্রতিষ্টান চালানোর এবং নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতির সংরক্ষণের বিশেষ অধিকার থাকবে। হিমালয় সন্নিহিত বাংলায় চিত্রটা ভাষা-আধিপত্যের এক চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে স্বাধীনতউত্তর সময় থেকেই। নব্বয়ের সময়েও এই অঞ্চলের পাঁচটি জেলায় ১৫টি সংবিধান স্বীকৃত তপশিলি ভাষা ছাড়াও ৩৯টি অ-তপশিলি ভাষার অস্তিত্ব ছিলো। ভৌগোলিক অবস্থান জনিত কারণে এই অঞ্চলে নানা প্রান্তের মানুষ এসেছেন, মহা প্রব্রজনের এই স্রোত এখানে জন বৈচিত্র ও ভাষা বৈচিত্র তৈরি করেছে । কিন্তু উপযুক্ত যত্নের অভাবে ও বৃহৎ ভাষাগোষ্ঠির আগ্রাসী আচরণে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাষাগোষ্ঠিগুলো বিপন্ন হয়নি শুধু, অধিকাংশে লুপ্তির পথে আজ। ১৮৭৬ বা সেই সময় থেকে চা শিল্পের কারণে এই অঞ্চলে ছোটনাগপুর, উড়িষ্যা, অন্ধ্র প্রভৃতি অঞ্চল থেকে মানুষেরা শ্রমিক হয়ে আসেন। এদের একটা বড় অংশের মাতৃভাষা আজ তাদের দৈনন্দিন ব্যবহারের ভাষা নয়, লিখবার পড়বার ভাষা নয়। বিড়াট একটা জনতা তার মাতৃভাষা থেকে চ্যুত হয়ে গেছেন গত ৫০ বছরে। এই অঞ্চলে ‘কুরুখ’ ভাষীর সংখ্যা ১৯৮০তেও ছিলো ১৩%, বিগত জনগননায় তা নেমে এসেছে ২% এর কাছে । হিন্দী এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠির মাতৃভাষা নয়, এমনকি যে ভাষিক গোষ্ঠির তারা প্রতিনিধি সেটাও হিন্দির থেকে ভিন্ন। কিন্তু এই অঞ্চলে প্রাথমিক থেকে স্নাতক পর্যন্ত হিন্দির প্রসার, রাষ্ট্রের উদ্যোগে, পাশাপাশি এই ভাষাগুলো চর্চা ও ব্যবহার কমে যাওয়া এই ক্ষুদ্র ভাষিক গোষ্ঠিগুলোকে লুপ্ত হওয়ার পথে নিয়ে যাচ্ছে। আগে উল্লেখ করা হয়েছে যে ক্ষুদ্র ভাষিক গোষ্ঠির লুপ্ত হওয়ার অন্যতম কারণ সেই ভাষিকগোষ্টীর উচ্চ স্তরে থাকা ভাষার প্রতি  আকর্ষণ বা ঝোঁক। এই ঝোঁক এবং সরকারের সুনির্দিষ্ট ভাষানীতির অনুপস্থিতি, পাশাপাশি বৃহৎ ভাষাগোষ্ঠির আগ্রাসী ভূমিকায় আজ বিপন্ন এই অঞ্চলের মোঙ্গোলিয় গোষ্ঠির বা ভোট-বর্মী/ভোট-চিনিয় ভাষাগোষ্ঠির মেচ, রাভা, গারো, লেপচা, ডুকপা, টোটো, এবং  অ-মঙ্গোলীয় বা অস্ট্রিক, দ্রাবিড় প্রভৃতি ভাষাগোষ্ঠী থেকে আসা সাঁওতালি, কুরুখ, মুন্ডা বা মুন্ডারি, খরিয়া প্রভৃতি ভাষা। নিজের মাতৃভাষায় আজ এদের অধিকাংশ মানুষই কথা বলেন না আর । উদাহরণ তুলে আনলে চমকে যেতে হয়, যা নিয়ে স্বতন্ত্র আলোচনার অবকাশ আছে, এই পরিসরে তা সম্ভব নয় । তবুও হিমালয় ও সন্নিহিত অঞ্চলের দুটো ভাষা গোষ্টির উদাহরণ নিলে দেখা যাবে ভাষা আগ্রাসনের চেহারাটা কতটা গভীর । লেপচা এই এলাকার প্রাচীনতম জনগোষ্টী, ১৯৭১এর হিসাবে দেখা যায় যে এই জনগোষ্টির মধ্যে মাত্র ১৫.৩২% লেপচা ভাষা লিখতে পড়তে জানেন । ব্রহ্মপুত্র ও সন্নিহিত পাহাড়ি অঞ্চলের জনজাতি গারো, ডুয়ার্স অঞ্চলেও তাদের আবাস আছে। গারো দের ২৬.৪০% তাদের মাতৃভাষা হিসাবে গারো ভাষা উল্লেখ করেছিলেন সেই জনগণনায়। তরাই ডুয়ার্সে চলে আসা সাঁওতালিদের মধ্যে ৪৭.০৬% তাদের মাতৃভাষা হিসাবে অন্য ভাষার উল্লেখ করেছিলেন। এই তথ্য নিছক ভাষা বিষয়ক তথ্য নয়,  একটা জাতিসত্ত্বার সংস্কৃতির মৃত্যু ঘণ্টার ধ্বনি।

ভাষার মৃত্যুর ধ্বনি আসলে একটি জাতিসত্বারও মৃত্যুর ধ্বনি। এই সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাই সামাজিক রাজনৈতিক প্রক্ষাপটের চর্চাও প্রাসঙ্গিক। একবিংশ শতাব্দী ডিজিটাল প্রযুক্তির শতক শুধু নয়। বিশ্বায়নের উপর ভর করে উপনিবেশিক শাসনের প্রত্যাবর্তনের শতাব্দীও এটি। আধিপত্যকামী শ্রেণী চায় সমস্থ ক্ষমতা কুক্ষিগত করে তাদের শ্রেণীস্বার্থ বিস্তৃত ও রক্ষা করতে। ফলে সমাজে নানারকমের বিভাজন সৃষ্টি হয় – গ্রাম-শহরে, ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধর্মের পরিচয়ে, জাতির পরিচয়ে এবং ভাষার পরিচয়ে। পরপষ্পরের মধ্যে দেওয়াল তৈরি করাই এদের কৌশল। এই প্রাচীর নির্মানের জন্য দরকার হয় সবধরনের মানুষের চিন্তার জগতকে প্রভাবিত করা ও নিয়ন্ত্রণে আনা। মানুষের আশা-আকাংখা, কর্ম পরিকল্পনা। বৃত্তি নির্বাচন, রুচি-মূল্যবোধ- সবকিছুই শোষণ ব্যাবস্থার সহায়ক করে তুলতে চায় এই আধিপত্যাবাদী ক্ষমতা। এই ব্যবস্থার জাঁতাকলে থাকা ব্যাক্তি মানুষ ক্রমশ একক হয়ে পরে। সমাজ হারিয়ে যায়। আত্মসর্বস্ব ভোগবাদের দর্শণ মানবিক মূল্যবোধকে অপ্রাসঙ্গিক করে তোলে। এই ক্ষমতা এমন একতা ব্যবস্থা কায়েমকরে যাতে তাদের সংস্কৃতি, তাদের প্রশ্রয়পুষ্ঠ ভাষাওকেই সর্বসাধারণের আত্মোন্নতির একমাত্র অবলম্বন বলে গ্রহণ করতে বাধ্য থাকে। দেশে দেশে মানুষের সাংস্কৃতিক মগজ ধোলাই করে মুনাফা বারাবার তাগিদে যারা এই প্রক্রিয়া চালাচ্ছে টাড়া মহাপরাক্রমী শক্তি। উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশ সমুহের সাধারণ মানুষের চিন্তা-চেতনা, আশা-আকাংখাকে প্রভাবিত করার অভিযাজে তারা ক্রমশ সক্ষম হচ্ছেন। এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার হচ্ছেন সর্বস্থরের মানুষ। সাংস্কৃতিক আগ্রসনের সবচেয়ে বড় অবলম্বন হচ্ছে ভাষা। ক্ষমতা, বিশেষত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অনুগৃহীত ভাষাই একমাত্র ভাষা হিসাবে তুলে ধরা হয় শিক্ষার, দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত ভাষা বলে। ওইপনিবেশিক যুগে তাদের ভাষা ইংরাজিওই ছিলো আমাদের শিক্ষার প্রধান ভাষা, যা উত্তর-ঔপনিবেশীক কালেও বহাল আছে। শিক্ষার প্রকৃত মাধ্যম শিশুর মাতৃভাষা সে বিষয়ে শিক্ষাবিদেরা সহমত, কিন্তু আমাদের এই পর নির্ভরতায় ভুক্তভোগী হয়েছে জনশিক্ষা প্রসারের মতো নানা কাজ। প্রান্তজনের মুখ থেকে মাতৃভাষার অধিকার লুপ্ত হলে সামাজিক ভাবেও সে শিক্ষিত হতে পারে না।  ভারতের জাতীয় শিক্ষা ও গবেষণা ও প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত সংস্থ এন সি ই আর টি তার প্রতিবেদনে মাতৃভাষার শিক্ষার উপর আবার গুরুত্ব আরোপ করেছেন। শিক্ষার মাধ্যম সংক্রান্ত আলোচনায় এন সি ই আর টি তার দলিলে সংবিধানের ৩৫০(ক) ধারার উল্লেখ করে লিখেছে, “ It shall be the endeavor of every state and of every local authority within the state to provide equate facilities for instructions in the mother-tongue at the primary stage of education to children belonging to linguistic minority group.”।  অথচ এই নির্দেশিকার প্রতি উপেক্ষা আসলে মৃত্যু ঘন্টা ধ্বনি হয়ে উঠছে।

UNESCO যখন ছোটো ছোটো ভাষাগুলোকে রক্ষার কথা বলেছে, ভাষার বিপন্নতার কথা তুলে ধরছে, তখনো একের পর এক ছোটো ভাষাগুলোর মৃত্যুর ঘন্টার ধ্বনি বেজেই চলছে। এই অবস্থার মধ্যে আশার খবর যে কোথাও কোথাও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ যুক্ত হয়েছে মৃত ভাষাওগুলোকে রক্ষার বা পুনঃপ্রানসঞ্চারের । যদিও এর পেছনে  রাজনৈতিক অভিপ্সা মুখ্যত কাজ করছে, জাতীয়তাবোধার আবেগ কাজ করছে। ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল উল্লেখ ‘হিব্রু ভাষা, আজ থেকে ২ হাজার বছর আগে এই ভাষার মৃত্যু ঘটেছিলো। আজ ইস্রায়েল সেই মৃত ভাষাকে আবার প্রাণ সঞ্চারের উদ্যোগ নিয়েছে, দেশের রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে হিব্রু ভাষাওকে স্বীকৃতি দিয়েছে। আয়ারল্যান্ডেও মৃত ভাষাকে পুনরুদ্ধারের সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ১৮১৪ সালে ডেনমার্ক মুক্ত হয়, ১৮৪০ নাগাদ সেখানে একটি নতুন ভাষা ‘ল্যান্ডসমল’ বা দেশের ভাষা নামে একটি নতুন ভাষা তৈরি করা হয়। দেড় হাজার বছর আগে ব্যবহৃত ভাষাকে আবার ব্যবহারযোগ্য করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে মিশরে। ভারতবর্ষেও সংস্কৃত ভাষাকে আরো ব্যবহারের প্রতি মনোযোগী হয়েছে সরকার, কারণ যদিও সেই জাতীয়তাবোধার আবেগ উসকে দেওয়া।  এই নিয়ে সমালোচকেরা আমাদের দেশে ধর্মীয় আগ্রাসী এজেন্দার সম্পর্ক দেখতে পাচ্ছেম, যা বাস্তবিক সত্য। এর সমান্তরাল ভাবেই চলছে শক্তিশালী ও প্রভাবশালী ভাষার বিস্তার, যার দাপটে লুপ্ত হচ্ছে ছোটছোট ভাষা সমূহ । ভারত, বাংলাদেশে যেভাবে ইংরাজির দাপটের অক্ষুণ্ণ বিস্তার ঘটছে, কোনঠাসা হয়ে পড়ছে বৃহত্তরের মাতৃভাষা বাংলা, ক্ষদ্র-ক্ষুদ্র ভাষাসমূহের আবস্থা তো আরো করুণ । বিশ্বায়নের এই যুগে ইংরাজির গুরুত্ব নিশ্চই রয়েছে, কিন্তু তা মাতৃভাষার শহদেহর বিকপ্ল নয়। প্রাসঙ্গিক বলে উল্লেখ করা যায় নোয়াম চমস্কির কথা । ১৯৫৫তে পেনসিল্ভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার যে গবেষণা পত্রটি তার পি এইচ ডি সন্দর্ভ হিসাবে দাখিল হয়েছিলো সেটির বিষয় ছিলো শিক্ষায় মাতৃ ভাষার ভূমিকা, ‘TRANSFORMATIONAL ANALYSIS’। এর পর ১৯৬৮তে তাঁর প্রবন্ধ ‘language and Mind’ এবং ১৯৭৫এ প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থ ‘Reflection on Language’ তে মাতৃভাষার গুরুত্ব তুলে ধরেছিলেন।  কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে কোলোনিয়াল হ্যাঙ্গোভার নিয়ে আজো মুখ্য ভাষা হিসাবে ইংরাজির ব্যবহার ও প্রসার প্রথমে ও সর্বস্তরে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমুহ এই ক্ষাত্রে অগ্রগামী ভূমিকা নিয়েছে । পুঁজিবাদী বিশ্বায়ণ সবকিছুকে একটাই ছাঁচে আনতে চায়, তাদের বাজারের সঙ্কটকে মোকাবিলা করতে চায় ভাষা ও সংস্কৃতির উপর দহল কায়েম করার মধ্য দিয়ে । নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত সেনের কথা এখানে উল্লেখ করা যায়, ‘… the tendency towards homogenization of cultures, particularly in uniform western mode,’ . দেশবাসীর খাদ্য-পানীয় কী হবে, তার পরিধেয় কী হবে, সে কিসে আনন্দ পাবে কোন ভাষায় কথা বলবে সবতাই নয়ন্ত্রণ করতে চায় এই পুঁজি । মহাপরাক্রমী পূজির বিপনন ইজ্ঞাপনের সামনে ব্যান্তি মানুষ অসহায়। এরাই চায় একতাই ভাষা হোক শিক্ষার মাধ্যম, যোগাযোগের মাধ্যম, দৈনন্দিন ব্যবহারের ভাষা । এটা অবশ্যই হতে হবে ইংরাজি। প্রান্তিক মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষের, প্রথম প্রজন্মের শিক্ষিত পরিবারের ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে এই  ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত প্রজন্মের মঝে ফারাক তৈরি হয়ে যায়। ব্যায়সাধ্য একটি সমান্তরাল শিক্ষা ব্যবস্থা কায়েম হয়। এই ফারাকটা আসলে উল্লিখিত নিয়ন্ত্রণকামীদেরই পথকে প্রশস্থ করে । আমরা এই প্রসঙ্গে আমাদের ভাষার অহংকার রবীন্দ্রনাথঅকে উদ্ধিত করতে পারি, তাঁর ভাষায়, ‘অধিকাংশ জ্ঞান-বিজ্ঞান ইংরাজি ভাষার কড়া পাহারার মধ্যে সীমাবদ্ধ’। কিন্তু আমরা গভীর উদবেগের সঙ্গে লখ্য করি যে ভারতে নিযুক্ত জাতীয় নলেজ কমিশান ২০০৭এর জানুয়ারিতে যে সুপারিশ করেছিলো দেশের প্রতিটি প্রাথমিক স্কুলে ইংরাজীতে শিক্ষা চালু করার। উল্লেখ থাকে যে যেই কমিশনের এক সময়ে চেয়ারপার্সন ছিলেন রাধাকৃষ্ণান, যশপাল বা কোঠারির মত শিক্ষা জগতের মানুষ সেখানে উল্লিখিত কমিশনের প্রধান হন তর‍্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ স্যাম পিত্রোদা, যিনি মার্কিন ও ব্রিটেনের অনেকগুলো বাণিজ্য সংগঠনের পরিচালক ছিলেন । তবে এই সুপারিশ সর্বত্র গৃহীত হয় নি। বাংলার বিশীষ্ঠ শিক্ষাবিদ ও প্রাক্তন উপাচার্য ড রঞ্জুগোপাল মুখোপাধ্যায় আলোচনা  প্রসঙ্গে লিখেছিলেন যে, ‘নিজের ভাষাওকে হারিয়ে ফেললে স্বভাবতই নিজের সংস্কৃতিকে বর্জন করতে হয়, সমাজ সম্পর্কে নিঃস্পৃহতা আসে যা আজকের প্রতিযোগিতা কন্ঠকিত ভোগবাদী জীবনদর্শনের মূলমন্ত্র । বিদ্যালয় শিক্ষায়, বিশেষত প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষা কেবল্মাত্র অন্য বিষয় শিক্ষার সার্থক বাওহন নয়, শিশূর সামগ্রিক বিকাশের অবলম্বন – একথা ভুলে যাওয়া আত্মঘাতী হবে।” (ঐক্যতান গবেষণা পত্র/আক্রান্ত মাতৃভাষা.২৬পৃষ্ঠা)

ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস বহুবর্ণ ও দর্শনে বৈচিত্রপূর্ণ। সেই জন্য এই অঞ্চল বহুভাষিক। ১৯৯১এর জনগননার হিসাবে দেখা যায় যে সেই সময়ে দেশে প্রচলিত ভাষার সংখ্যা ৩,৩৭২ টি। এর মধ্যে ১০ হাজার বা তার অধিক মানুষের মাতৃভাষার সংখ্যা ১,৫৭৬ টি। বিশ্বের তথ্যের নিরিখে বর্তমানে প্রায় ৬ হাজার ভাষা প্রচলিত রয়েছে, এর মধ্যে ২৫০০ ভাষা বিপন্ন ভাষা হিসাবে স্বীকৃত। এই অবস্থার মাঝে আশার কথা যে, বিপন্ন বা লুপ্তপ্রায় ভাষাকে রক্ষার নানা  উদ্যোগ আজ গোটা বিশ্বে চলছে। যা আমাদের আশা দেখায়, কিন্তু ছোটো ছোট জনজাতির ভাষা গুলোকে রক্ষার উদ্যোগ এর পাশাপাশি প্রয়োজন, সেই জনজাতীর , শতফুল বিকশিত হোক এই বিশ্বে, মানবের বহুবর্ণ সাংস্কৃতিক সম্পদ সুরক্ষিত থাকুক।  

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত