| 29 নভেম্বর 2024
Categories
ঈদ সংখ্যা ২০২১

দীপেন ভট্টাচার্যের গল্প : বোধ ও পরিসরের আশ্চর্য নির্মাণ

আনুমানিক পঠনকাল: 16 মিনিট

 

অমর মিত্রের ’৫১ গল্প’ (মিত্র ও ঘোষ) গ্রন্থের উৎসর্গ পত্রে দেখি দুটি নাম—“দূর পরবাসের দুই লেখক বন্ধু শ্রী কুলদা রায়, শ্রী দীপেন ভট্টাচার্য করকমলেষু’। এই আমার দীপেন ভট্টাচার্যের (১৯৫৯) নাম ছাপার অক্ষরে প্রথম দেখা। সাদিক হোসেনের ‘হারুর মহাভারত’ গল্পটি পড়ার পর মনে হল দীপেন ভট্টাচার্যের ‘নিস্তার মোল্লার মহাভারত’ গল্পটি পড়ে ফেলি। গল্পপাঠ থেকে পড়লাম। দুজন লেখককে (সাদিক হোসেন, দীপেন ভট্টাচার্য) কোনভাবেই মেলাতে পারলাম না। না মেলাই তো স্বাভাবিক। দুজন পৃথক দৃষ্টিকোন থেকে গল্পদুটি নির্মাণ করেছেন। অনেক দিন থেকেই ভাবছি দীপেন ভট্টাচার্যের ‘নিস্তার মোল্লার মহাভারত’ বইখানা পড়ব। কিন্তু বইয়ের প্রকাশক তো ভিন্ন দেশ, বাংলাদেশ। নিরুপায় হলাম। কিন্তু উপায় তো আছে। সেই উপায়ের পথিকৃৎ হলেন কুলদা রায়। তিনি আমাকে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের খোঁজ খবর দেন। কুলদা রায়কে জানালাম। তিনি বললেন লেখকের কাছ থেকে পিডিএফ নিয়ে দেবেন। কিছুদিন অপেক্ষা করলাম। কিন্তু আমি তো ধৈর্যহীন মানুষ। একদিন লেখককেই সরাসরি বললাম। তিনি উপায় করে দিলেন।

পাঠকের জ্ঞাতার্থে দীপেন ভট্টাচার্যের সামান্য পরিচয় দেই। লেখকের জন্ম ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে ওপার বাংলার টাঙ্গাইলে। ওপার বাংলার পাঠ সমাপ্ত করে রাশিয়ার মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পদার্থবিদ্যায় মাস্টার্স এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ নিউ হ্যাম্পশায়ার থেকে জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যায় পিএইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন। নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট ইনস্টিটিউটে বেশকিছুদিন গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন। বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়ার মরেনো ভ্যালি কলেজের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। বাংলাদেশের ভূতত্ত্বের ইতিহাস নিয়ে লিখেছেন—‘বঙ্গীয় বদ্বীপের অতীত ও ভবিষ্যৎ’ গ্রন্থ। তাঁর ফিকশান গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে—‘নিওলিথ স্বপ্ন’, ‘দিতার বাড়ি’, ‘অভিজিৎ নক্ষত্রের আলো’, ‘নক্ষত্রের ঝড় ও বার্ট কোমেনের ডান হাত’ ইত্যাদি। ‘নিস্তার মোল্লার মহাভারত’ গ্রন্থটি ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে (দ্যু প্রকাশন, ঢাকা) থেকে প্রকাশিত হয়। গল্পে প্রবেশের আগে গল্পকার সম্পর্কে আরেক গল্পকারের (কুলদা রায়) অভিমত শুনে নেওয়া যাক। পাঠকের জ্ঞাতার্থে অভিমতটি জরুরি মনে হল বলে তুলে ধরলাম—

“সব আখ্যান গল্প হয় না। বহু যত্নে কেটে ছেটে আমাদের জীবন ও ভাবনার অন্তর্গত আখ্যানের ভেতর থেকে বের করে আনতে হয় ভাস্কর্যের মতো অনন্য গল্পকে। এরকম নিখুঁত গল্পের শৈলী আয়ত্ত করেই গল্প লিখতে শুরু করেছেন দীপেন ভট্টাচার্য। তাঁর শব্দ স্নিগ্ধ, বাক্য সুষমামাখা, আখ্যান মানবিক। একই গল্পের মধ্যে বহু গল্পের ইশারা বুনে রাখেন। এবং প্রতিটি ইশারাতেই তিনি এমনভাবে বাঁক নির্মাণ করেন যে পাঠকের কোনো পূর্ব-অনুমানই ধূলিস্মাৎ হয়ে যেতে বাধ্য। তাঁর গল্পে বিজ্ঞান, পুরাণ, কল্পনা, ইতিহাস, দার্শনিকতার অসামান্য সম্মিলন থাকে। থাকে সময় থেকে সময়ান্তরে যাত্রা। বাস্তব জগতকে অনায়াসে টেনে নিয়ে যান যাদুবাস্তবতায়। এর সঙ্গে সহজে মিশিয়ে দেন ফ্যান্টাসি ও সাইফাই কল্প বিজ্ঞানকে। এবং তাঁর উদ্দেশ্য থাকে যে কোনো গল্পকেই সত্যি করে তোলা। এ সত্যি করে তোলার পাশাপাশি তিনি গল্পের পাঠককে তাঁর গল্পের স্থান ও সময় থেকে মাঝে মাঝেই বেটোল্ট ব্রেশটের এলিয়েনেশন তত্ত্বের মতো করে বিচ্ছিন্ন করে আনেন। তাঁকে ভাবনার পরিসর যোগান। পাঠককে নতুন ভাবনায় উস্কে দেন। সেখানে গল্পকার ও পাঠক দুজনেই এই গল্পের প্রকৃত নির্মাতা হয়ে ওঠে। তাঁর যে কোনো গল্পই বহু গল্পের জননী।“

এক দীর্ঘ যাত্রার গল্প ‘নিস্তার মোল্লার মহাভারত’। গল্পের অবয়বে তিনি পাঠককে সঙ্গে নিয়েছেন। পাঠককে সঙ্গে নিয়েই তিনি গল্প পদচারণা করে আখ্যান শেষে পাঠককেই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন। পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক দীপেন ভট্টাচার্য ‘আলোর ভাষা’ যেমন ব্যবহার করেছেন তেমনি ইতিহাস, বাঙালির ইতিহাস ভুলে যাওয়া, কালে কালে প্রকৃত সত্য ভুলে গিয়ে বিকৃত সত্যকে সামনে রেখে ইতিহাস রচনা করা গল্পের অবয়বে উঁকি দিয়েছে। পৃথিবী ক্রমাগত পাল্টে যাচ্ছে। পৃথিবীর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষও নিজেকে পাল্টে নিচ্ছে। আর বাঙালি তো বরাবর ইতিহাস বিস্মৃত জাতি। নিজের প্রয়োজনে একটা ইতিহাস গড়ে নেয়। বঙ্কিমচন্দ্রের মনে হয়েছিল বাঙালির ইতিহাস নেই। আসলে বাঙালি নিজের ইতিহাস সৃষ্টি করতে, বহন করতে অক্ষম। মনে পড়ে যাচ্ছে মধুময় পালের ‘ধনপতির কথাপালা’ গল্পে ধনপতির কথা। যিনি গাছের তলায় বসে বাঙালির ইতিহাস, বাংলার ইতিহাস লিখে রাখতে চেয়েছেন। মনে পড়ছে প্রফুল্লকুমার চক্রবর্তীর কথা, যিনি ‘প্রান্তিক মানব’ গ্রন্থ লিখেছেন। সামান্য বেতনে, ঘুরে ঘুরে বহু তথ্য সংগ্রহ করে, স্টেশনে স্টেশনে রাত্রি কাটিয়ে, নিজের টাকায় উদ্বাস্তু বাঙালির ইতিহাস রচনা করেছেন। সরকার বা এলিট শ্রেণির বাঙালি কোনো খোঁজ রাখেনি, প্রয়োজন উপলব্ধি করেনি। এই গল্পেও মহাভারতের থেকেও বড় পাণ্ডুলিপি যা নিস্তার মোল্লা রচনা করেছিলেন তা হারিয়ে গেছে। পরিত্যক্ত কাগজ হিসেবে বিক্রি কেজি দরে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। যেখানে ছিল হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাস। গোপালের আমল থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত আবহমান কাল ধরে ঘটে যাওয়া বাঙালির বিক্ষিপ্ত ইতিহাস। ভবিষ্যতের বৃত্তান্তও তিনি জানতেন। ভবিষ্যতের বাংলা কোনপথে যাবে সে ইতিবৃত্তও মাথায় খেলছিল কিন্তু সৃষ্টির আগেই সব ওলট পালট হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালীন বাংলাদেশের জঘন্য পরিস্থিতি সেজন্য দায়ী। নিস্তার মোল্লার রচিত ইতিহাসে অনেক অংসগতি রয়েছে, কেউ কেউ বুজরুকি ভাবতে পারেন কিন্তু সবটাই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। গল্প শুরু হয়েছে সাধারণভাবে, পাঠকের সঙ্গে আপাত আলাপচারিতায়—

“যদি আপনি সময় ও ধৈর্য নিয়ে এই গল্পের পুরোটাই পড়েন, তাহলে জীবনের যে শত শত গল্প পড়েছেন সেই তালিকায় এটি যুক্ত হবে মাত্র, এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। তবু গল্পটা শুরু করার আগে পাঠকের কাছে আমার একটা অনুরোধ থাকবে। পড়া শুরু করার আগে পাঠককে বলব তাঁর নিজের নামটি উচ্চারণ করতে।“ (নিস্তার মোল্লার মহাভারত, প্রথম প্রকাশ ২০১৯, দ্যু প্রকাশন, ঢাকা-১২০৫, পৃ. ৯)

 এবার গল্পের শেষ পরিচ্ছেদটি পড়ে নেওয়া যাক—

“এই কাহিনির শেষ এখানেই। আপনি যদি ধৈর্য নিয়ে এতখানি পড়েছেন তাহলে বলব এখন সময় হয়েছে আপনার নামটি আবার উচ্চারণ করার। করুন, লজ্জা পাবেন না! করলেন? এখন বলুন এই কাহিনির শুরুতে আপনার নামটি কানে যে ভাবে স্পন্দিত হয়েছিল, এবারো কি সেভাবে হল? যদি না হয়ে থাকে তবে এই কাহিনির মাঝে, কোনো এক সময়ে আপনার পৃথিবী বদলে গেছে, আপনি আজ এটা ভালো খেয়াল করতে পারবেন না, কিন্তু আজ থেকে বহু পরে, হয়ত দশ বছর পরে পৃথিবীটাকে অচেনা মনে হলে এই মুহূর্তটা স্মরণ করবেন, হয়ত (আমি এটা গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারব না) আপনার পৃথিবী তখন থেকে বদলে গিয়েছিল।“ (তদেব, পৃ. ৩৮)

পৃথিবী ক্রমাগত বদলে যাচ্ছে। ব্যক্তি মানুষের, সমষ্টির ইতিহাস ক্রমাগত পাল্টে যাচ্ছে। ইতিহাস রচনার ঢঙ বিবর্তিত হচ্ছে। মানুষ নিজের প্রয়োজনে ইতিহাস সৃষ্টি করছে, পাল্টে নিচ্ছে। বীথির বাড়িতে আজ খনার বচন বলে যা লেখা আছে তার সঙ্গে পূর্বের মিল নেই। তেমনি অমল নিস্তার মোল্লার পাণ্ডুলিপির ৫,৮৮৯ পৃষ্ঠা যা কুড়ি বছর আগে পড়েছিলেন তা আজ কিছুটা পাল্টে গেছে। আসলে সময় ইতিহাস পাল্টে নেয়, বিকৃত করে নেয়। গল্প শুরু হচ্ছে ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে। গল্পের কাহিনি এমন—নিস্তার মোল্লার বাড়িতে টেলিভিশন কিনতে এসেছিল অমল। সেইসূত্রেই পরিচিত হয়ে এই বাড়িতে নিস্তার মোল্লার পুত্র, কন্যাদের (আকাশ, বীথি) গৃহশিক্ষক হয়েছে সে। কাহিনি বৃত্তান্তে রয়েছে দেশভাগ, দাঙ্গা, মুক্তিযুদ্ধে অত্যাচার ও হিন্দুদের দেশত্যাগের কথা। নিস্তার মোল্লার বন্ধু অচিন্ত্যকুমার রায়চৌধুরী দেশত্যাগ করেছেন। তাঁর বাড়ি থেকে নিস্তার মোল্লা চারটি আয়না পেয়েছিল। এই আয়নাকে আমরা সময়ের দর্পণ হিসেবে ধরতে পারি। কেননা আয়নায় পড়া সূর্যের প্রতিফলিত রশ্মিই নিস্তার মোল্লাকে দিয়ে বিপুল পরিমাণে ইতিহাস রচনা করিয়ে নিয়েছে। কেমনভাবে সেই ইতিহাস লেখা শুরু হয়েছিল? একটি বাংলা বাক্য লিখে। সেই বাক্যকে ইংরেজিতে অনুবাদ করতে গিয়ে দুটি বাক্য হয়। সেই দুটি বাক্যকে আবার বাংলায় অনুবাদ করতে গিয়ে চারটি বাক্য দাঁড়ায়। শুরু হয়ে যায় ইতিহাস। আপাত অর্থে পাঠক একে গল্প ভাবতে পারেন। বাঙালির ইতিহাস এমনই। চারজন লেখকের চারটি গ্রন্থ পাশাপাশি রাখলে দেখবেন বিস্তর ফারাক। কিন্তু প্রশ্ন হল যিনি এই মহৎ ইতিহাস রচনা করছেন তিনি কন্যার বিবাহ ষোলো বছর বয়সে দেবেন কেন? আসলে সামাজিক ইতিহাস কিছু এগিয়ে যায়নি। আমাদের জ্ঞানচর্চা পাঠ্যপুস্তক নির্ভর, ব্যবহারিক জীবনে তা আমরা প্রয়োগ করিনি। কন্যা বীথির বিবাহ দিতে অচিন্ত্যকুমার রায়চৌধুরীর আয়নাগুলি বিক্রি করতে হয়েছিল নিস্তার মোল্লাকে। আয়না বিক্রির পর তিনি আর ইতিহাস লিখতে পারেননি, এমনকি কিছুদিন পরেই মারা যান। আসলে আয়নাই ছিল তাঁর বাঙালির ইতিহাসের প্রতিবিম্ব। প্রতিবিম্বই যেন বিম্ব রচনা করে চলেছিল। তিনি শেষ পর্যন্ত ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে এসেছিলেন। তিনি ভবিষ্যৎ জানতেন। সে ভবিষ্যৎ সে অত্যাচারের ইতিহাস তাও জানতেন। ১৯৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থান সহজেই অনুমেয়। তারপর কাহিনি কুড়ি বছর পরে এসেছে। বীথি ও অমল দুজনেই বিদেশে চলে গেছে। বীথির কাছে অমল শুনেছে বিবাহ পরবর্তী ঘটনা ও নিস্তার মোল্লার বৃত্তান্ত। অমল নিজেই ইতিহাস সম্পর্কে ভেবেছে। নিস্তার মোল্লা সম্পর্কে নিজেই মূল্যায়নে গেছে। আসলে পৃথিবীর সময় অনেকটা এগিয়ে গেছে। দীর্ঘ পরিসরে, বহু ঘটনার মধ্য দিয়ে তিনি কাহিনি এগিয়ে নিয়ে গেছেন। নিস্তার মোল্লার কর্মকাণ্ড আপাত অর্থে অদ্ভুত মনে হতে পারে কিন্তু একটি সত্য আছে। খণ্ড খণ্ড ইতিহাসের মধ্য দিয়ে দেশভাগ পরবর্তী বাংলাদেশের বিধ্বস্ত চিত্রমালা উঁকি দিয়েছে। অমল অতি সাধারণভাবে কাহিনিতে প্রবেশ করে কাহিনির ধারক বাহক হয়ে উঠেছে। কখনো সামান্য আকারে ঘটনা বলে, কোথাও চরিত্রের সূত্র ধরে দিয়ে লেখক এগিয়ে গেছেন। আসলে লেখককে একটা বড় সময় আবিষ্কার করতে হয়েছে।

দীপেন ভট্টাচার্য আখ্যানকে বড় পরিসরে উপস্থাপন করেন। এমনকি নিবিড়ি ডেটেলিং এ অগ্রসর হন। ঘটনার পরতে পরতে জড়িয়ে থাকে বিজ্ঞানের নানা  অনুষঙ্গ। তেমনি সময়পর্ব তার আখ্যানে বড় ভূমিকা পালন করে। একটা সময়ের কথা দিয়ে কাহিনি শুরু করেন, কিন্তু শেষে যেখানে এসে উপস্থিত হন তার ব্যবধান অনেক বছরের। ইতিমধ্যেই পৃথিবীর অগ্রগতি ঘটেছে, বিজ্ঞানের নানা রহস্য উন্মোচন হয়েছে। তেমনি কাহিনির শুরুতে যে চরিত্রটি বালক ছিল সে আজ পরিণত বয়সে পৌঁছেছে। ফলে সেদিনের রহস্যগুলি আজ সে বিজ্ঞানের অনুষঙ্গ দিয়ে বিচার করতে শিখেছে। ফলে সেদিনের রহস্য আজ তার কাছে উন্মোচিত হয়েছে। ‘পৃথিবীর ছায়া’ গল্পেও রয়েছে অমল নামে একটি চরিত্র। সে মহাবিশ্বের যাবতীয় ঘটনাগুলি ধীরে ধীরে বুঝেছে, পরিণত বয়সে পৌঁছে সঠিক রহস্য উন্মোচন করেছে। কাহিনিতে রয়েছে তিনটি পরিবার—অমলদের পরিবার, আবদুল্লাহ সাহেবের পরিবার ও রোকেয়া খালার পরিবার। আখ্যানের সূচনা দেশভাগ পরবর্তী সময়ে। দেশভাগ হলেও অমলদের পরিবার ওপারে থেকে গিয়েছিল। এমনকি এক ভাড়া বাড়িতে এই তিন পরিবারের অবস্থান। একসময় স্থানীয় কিছু যুবকরা চাঁদার নামে আক্রমণ চালিয়েছিল। কিন্তু উনপা অদৃশ্য দেওয়ালে বায়ুর ঘূর্ণি সৃষ্টি করে তা থেকে রক্ষা করেছিল। অমল ছোটবেলায় চন্দ্রগ্রহণের রহস্য উপলব্ধি করেছে। একদিন সালমা ও রোকেয়ারা বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু অমলের জন্য দুটি বই রেখে গিয়েছিল—‘Chicago Exposition World Fair 1933’, ‘Leonardo Da Vinci’। বেশ কিছুদিন পরে অমলরাও সে বাড়ি ত্যাগ করে। অমল পরিণত বয়সে বিবাহ করেছে। স্ত্রী অমলা। পৃথিবীর সময় ত্রিশ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। স্ত্রী আসার পর বই দুটির গুরুত্ব সে উপলব্ধি করতে পেরেছে। স্বাতী নক্ষত্রের গুরুত্ব বুঝেছে। এক হিসেবে এই গল্প অমলের জীবনবৃত্তান্তের সময়পর্বের আখ্যান। গল্প সূচনায় অমলের বয়স ছিল নয়/দশ। এখন সে বিবাহিত ও পরিণত বয়সে পৌঁছেছে। বাল্যকালে নানা বিষয় সম্পর্কে যে বিস্ময় ছিল তা বিজ্ঞান দ্বারা সে বুঝতে শিখেছে, আমাদের কাছেও রহস্যগুলো ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়েছে।

দীপেন ভট্টাচার্য অতি সহজভাবে গল্প শুরু করেন। গল্পকে বিস্তৃতি দান করেন। দেশের পটভূমিকায় গল্প শুরু করে বিদেশে পৌঁছে যান। বেশিরভাগ গল্পেই নায়ক নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের জন্যই সমস্ত ত্যাগ করতে হয় বা তাঁকে সবাই ত্যাগ করে যায়। এই ত্যাগ বা নিঃসঙ্গতার জন্য কোন বেদনাবোধ নেই, তিনি জানেন সত্যের খোঁজ। সেই সত্যই চলার প্রেরণা সঞ্চার করে চলে। ‘অসিতোপল কিংবদন্তী’ গল্পে সেই সত্য, শান্তির খোঁজ আছে। শুরু করা যাক গল্প শেষে লেখকের মন্তব্য দিয়ে—

“শেষ একটি কথা বলে এই নীল দর্পণ শেষ করছি। আপনি—পাঠক—কোনোদিন হয়ত ‘অসিতোপল রঙ’ বইটি আবিষ্কার করতে পারেন। আমি—লেখক—আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি সেই বইয়ের নীল পাতায় নিশ্চিন্তে আপনার চোখের দৃষ্টি রাখতে পারেন, নীলের গভীরে আত্মসমর্পন করতে পারেন, সেই নীল আপনাকে উন্মাদ করবে না, সেই অসিতোপল নীল আপনাকে বস্তুজগতের বাইরে নিয়ে যাবে।“ (অসিতোপল কিংবদন্তী, তদেব, পৃ. ৬৮)

বাস্তবিক জগতের লোভ, হিংসা থেকে দূরে যেতে তিনি অসিতোপল রং বা নীলকান্তমণি আবিষ্কারে মত্ত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিঃসঙ্গ হয়েছেন। স্ত্রী, কন্যা চলে গেছে।  সেই রং বৃত্তান্ত নিয়ে দশটি বই ছাপিয়েছিলেন। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে তা চুরি হয়ে গেছে। এমনকি প্রচারিত হয়েছে সেই বই পড়লে মানুষ উন্মাদ হয়ে যাবে। এই নীল সাদা রং আবিষ্কারে তার দশটি বছর কেটে গেছে। বাড়িও ছিনিয়ে নিয়েছে স্থানীয় মাতব্বররা। সব হারিয়ে পাড়ি দিয়েছেন বিদেশে। এক মহিলাকে তিনি দেখেছিলেন ট্রামে সেই বই নিয়ে। দীর্ঘদিন খুঁজেছেন। কিন্তু পাননি। অবশেষে একদিন পেয়েছিলেন, দেখেছিলেন তিনি শান্ত সুন্দর জীবন কাটাচ্ছেন, উন্মাদ হননি। এবার কথক নিজের আবিষ্কার সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পান ও  লাল রং নিয়ে গবেষণার কথা ভাবেন। আসলে আমাদের কিংবদন্তি ধারণাগুলো এভাবেই গড়ে ওঠে। তেমনি কোন বিষয়কে সহজে গ্রহণ করতে আমাদের মন চায় না। এক সন্দেহ বাতিক মন নিয়ে আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনের বেঁচেবর্তে থাকা। কিন্তু যিনি সত্যের সন্ধান পেয়েছেন তাঁকে আর ঠেকিয়ে রাখে কে? সমস্ত বাধা অতিক্রম করেও তিনি লক্ষ্যে অবিচল। কখনো নায়কের মনে হয়েছে—“যুদ্ধ-পূর্ববর্তী জীবনকে সাদা ও নীল পর্বে ভাগ করেছিলাম। পরবর্তীকালে ভেবেছিলাম পৃথিবীতে আমার উপস্থিতির সময়কাল যুদ্ধ-পূর্ববর্তী ও যুদ্ধোত্তর এই দুটি ভাগে বিভক্ত। সেটাও যে ভুল ছিল এই ঘটনার পর ধীরে ধীরে বুঝলাম।“ (তদেব, পৃ. ৬৬) আসলে ভুলে ভরা আমাদের জীবন। সেই ভুলভুলাইয়ার মধ্যেও মিশে থাকে সত্যের খোঁজ। সাদা পর্ব মানে শান্ত সমাহিত জীবন আর নীল পর্ব মানে অশান্ত বিপর্যস্ত সময়। কিন্তু এই ধারণা টিকিয়ে রাখা যায়নি। সেই কিংবদন্তির ভুল ভাঙতে পাঠককে বসে থাকতে হয় গল্পের শেষ পর্যন্ত। যেখানে রয়েছে শান্তি ও আত্মশুদ্ধির জগৎ। কথক নিজেই খুঁজে নিয়েছেন সে সত্য। বাহ্যিক জগতের কোন রহস্য, সুন্দর, জীবনের হাতছানি আর ডাক দেয়নি। এই যে নিজের মধ্যেই শান্তি খোঁজা সেটাই ধ্রুব সত্য হয়ে উঠেছে। আসলে নিঃসঙ্গ মানুষ তো একটু শান্তিই চায়। যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে যে সত্য বড় হয়ে উঠেছিল।

দীপনে ভট্টাচার্য গল্পকে বারবার বিরাট পরিসরে বুনে চলেন। অতীত, বর্তমান হয়ে ভবিষ্যতের দিকে যাত্রার ছবি আঁকেন। গল্পের ক্যানভাসে ঘটনার পরম্পরার সঙ্গে দার্শনিক সত্য, সময়, রাজনীতির আশ্চর্য মেলবন্ধন গড়ে তোলেন। ‘লৌহশকট’ গল্পটিকে বিরাট পরিসরে বুনেছেন। সোভিয়েত বিপ্লবের দিন থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ঘটনাবলি এগিয়ে এসেছে। সমাজতান্ত্রিক রাশিরার উত্থানের মধ্যেই যে তার পতনের বীজ স্পষ্ট ছিল তা লেখক দেখিয়েছেন। জার শাসনের পতনের মধ্য দিয়ে যে সমাজান্ত্রিক রাশিয়ার জন্ম হয়েছিল সেখানেও নানা ভুল ছিল। লেনিনের তত্ত্ব ও চেতনায় বেশ কিছু ভুল ছিল। সেই ভুলের সূত্র ধরেই আবার স্বৈরাতন্ত্রের উত্থান ঘটেছিল। লেনিনের শিষ্য স্তালিন সব সত্য, আদর্শ ভুলে গিয়ে ক্ষমতার দম্ভে একক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল এবং করেছিল। আখ্যানটি বৃহৎ পটভূমিকায় লেখা। লেনিনের চিন্তা, চেতনা থেকে নির্বাসন, রাশিয়ায় ফিরে যাওয়া, যুদ্ধ, সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, নতুন সরকারের গঠন, জার্মানির সঙ্গে সমঝোতা, নতুন সরকার কর্তৃক নানা অত্যাচার, লেনিনের নির্বাসন, মৃত্যু, ত্রৎস্কির মৃত্যু, লেনিন, ত্রৎস্কির বিপ্লব, বিপ্লবের কর্মপ্রন্থা নিয়ে নানা চিন্তা চেতনা, পথ-পথের ভুল, স্বপ্ন-স্বপ্নহীনতা, জীবন অপেক্ষা বিপ্লব না বিপ্লব অপেক্ষা জীবন উপভোগ সব নিয়ে ইতিহাসের সত্যের পাশাপাশি জীবনের এক ঘটমান সত্য আবিষ্কারে লেখক মত্ত। বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার পরিস্থিতি, চিন্তা-চেতনা, কর্মপদ্ধতি, ভুল বোঝাতে লেখক জাদুবাস্তবের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। ১৯২৬ সালে মৃত লেনিন ১৯৩৮ সালে ত্রৎস্কির সঙ্গে নিজেদের কর্মপদ্ধতি, বিপ্লব, যুদ্ধ, প্রয়োগ, ট্রেড ইউনিয়ান, বামপ্রন্থা নিয়ে নানা আলোচনা করেছে। ইতিহাস, ঐতিহাসিক তথ্য ও সত্যের পাশাপাশি বিপ্লবীদের (লেনিন, ত্রৎস্কি) ব্যক্তিগত জীবন, চিন্তা-চেতনা, স্বপ্ন-স্বপ্নভঙ্গ নিয়ে লেখক ইতিহাসের সময়-রং-রূপের আশ্চর্য মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। বিদেশী জনজীবন, জনপথ, ভৌগোলিক বিবরণ সবমিলিয়ে লেখকের অনন্ত শক্তি ব্যবহৃত হয়েছে। পাঁচটি অধ্যায়ে আখ্যানটি বিন্যাস্ত। প্রথম তিনটি পরিচ্ছেদ ১৯১৭ এর মার্চ থেকে নভেম্বরের পটভূমি, চতুর্থ পরিচ্ছেদ ১৯৪০ সালে মেক্সিকো শহরের পটভূমি আর পঞ্চম পরিচ্ছেদে আবার ১৯১৭ সালের পটভূমি। চতুর্থ পরিচ্ছেদটি জাদুবাস্তবের পটভূমিকায় লেখা। মেক্সিকো শহরে পালিয়ে গেছে ত্রৎস্কি। জাদুবাস্তবতার মধ্য দিয়ে সে লেনিনের সঙ্গে সমাজতন্ত্র, রাষ্ট্র, যুদ্ধ, ক্ষমতা নিয়ে আলোচনা করেছে। এমনকি শেষে স্তালিনের চর দ্বারা মৃত্যু ঘটেছে। আসলে ভালো পৃথিবীর মধ্যেও যে মন্দ লুকিয়ে আছে তাই উপস্থাপিত হয়। একটি মানুষ বা বুদ্ধিজীবী যতই ভালো ভাবুক বা দেশের উন্নতির কথা চিন্তা করুক অশুভ শক্তি বারবার তাঁকে আঘাত করে। সময়ের মধ্যে, পরিসরের মধ্যে অশুভ বোধ কীভাবে লুকিয়ে থাকে, সুযোগ পেলেই রাক্ষুসি গ্রাসের মতো সব ধ্বংস করতে উদ্যত হয় তাই বড় হয়ে ওঠে। অশুভ বোধ লেনিন, ত্রৎস্কিকে পাঠিয়ে দিয়েছে নির্বাসনে। তবুও তারা শুভ পৃথিবীর কথা চিন্তা করে গেছে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্রের মধ্য দিয়েই যে পৃথিবীর ক্রমমুক্তি ঘটবে সে স্বপ্ন তারা দেখে গেছে। মেক্সিকো নতুন সূর্য দেখবে। কিন্তু সেখানেও ক্রমমুক্তি নেই। অশুভ শক্তির রাক্ষস বাহু সর্বত্র বিরজমান। ধ্বংস করে দিয়েছে ত্রৎস্কিকে। এই বুদ্ধিজীবীদের মৃত্যু যে পৃথিবীর পক্ষে কতবড় ক্ষতি তা রমা রোঁলা বুঝেছিল। স্তালিনের কাছে সে হাত জোর করে ভিক্ষা চেয়েছিল বুখারিনের জন্য। কিন্তু স্তালিন শোনেনি। বুখারিনের মৃত্যু পৃথিবীর পক্ষে যে কতবড় ক্ষতি তা রোঁলাই উপলব্ধি করতে পেরেছিল। রাশিয়া বড় বড় সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীর জন্ম দিয়েছে, গোটা পৃথিবীকে পথ দেখিয়েছে অথচ সেই রাশিয়ার ভাঙন ঘটে গেল আসলে সেইসব চিন্তা-চেতনা, তত্ত্ব কেউ মনে রাখেনি। ক্ষমতার দম্ভে, সমস্ত গ্রাস করে নেওয়ার চক্রান্তে বর্বর হিংসায় মেতে উঠেছে। গল্প শুরু হয়েছে এইভাবে—

“আমাদের প্রটাগনিস্ট ছিল এক বিপ্লবী। সে রুশি বিপ্লবী। এই কাহিনি পুরোপুরিই একটি রুশ কাহিনি, একে হয়ত আর একটু সহজভাবে বলা যেত, হয়ত একজন গুণী লেখক সেটা করতে পারেন, কারণ ইতিহাসের ঘটনাকে নানাভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব, গুণী লেখকের হাতে সেটা ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক হয়ে ওঠে না, হয়ে ওঠে নাটক। আমি সেই লেখক নই।“ (লৌহশকট, তদেব, ১০৯)

 আসলে তিনি নাটক লিখতে চাননি, তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছেন আখ্যান। রাশিয়াকে পটভূমি করে লেনিনের তত্ত্ব, ধারণা ও জীবনাদর্শের সূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণ। ঐতিহাসিক চরিত্রের পাশাপাশি রয়েছে কিছু কাল্পনিক চরিত্র। সেজন্য লেখক জানিয়েছেন—“গল্পটি ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহের প্রেক্ষাপটে লেখা, কিন্তু কাল্পনিক।“ গল্প সূচনা হয়েছে জার শাসনের পতনের মধ্য দিয়ে। সবে গণতান্ত্রিক রাশিয়া গড়ে উঠেছে। অথচ জার্মানির সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ চলছে। লেনিন নির্বাসনে। সুইজারল্যান্ডে বসে লেনিন সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র নিয়ে নতুন বই লিখে ফেলেছেন। লেনিন গ্রিশা নামে এক চিত্রকরের সঙ্গে নানা আলাপ আলোচনা করেন। এই গ্রিশা আগে ছিল শ্রমিক। আসলে বিশ্ব পাল্টে যাচ্ছে। সময় এগিয়ে যাচ্ছে। লেনিন সেদিন রাশিরায় সময় পটভূমিকায় যে চিন্তা চেতনাগুলি করেছিলেন সেগুলি পরবর্তী সময়েও কার্যকর হবে তা তিনি ভেবেছিলেন। কিন্তু সেগুলি অচল হয়ে যাবে। তাই গ্রিশ জানিয়েছিল—

“আমার বেঁচে থাকার জন্য আমি মানুষের সাহায্য পেয়েছি, তাদের কাছে আমি ঋণী। আমি তাদের জন্য সবকিছু করতে পারি, কিন্তু সারা পৃথিবীর শ্রমিকের কাছে আমার কোনো ঋণ নেই। আমি এক সময় শ্রমিক ছিলাম, আজও এক ধরনের শ্রমিক, আমার শ্রমের ফসল যদি কোনো শ্রমিককে আনন্দ দিতে পারে সেটুকুই হবে আমার দান। সেটুকুই আমার দায়িত্ব। আর আপনি যে দায়িত্বের কথা বলছেন সেটা হল আপনার মোহ, মেগালোম্যানিয়া, পৃথিবীকে আরোগ্য করার বদলে সেটা পৃথিবীকে অস্থির করে দেবে।“ (তদেব, ১১৮)

জারের পতনে যে নতুন সরকারের জন্ম হয়েছিল সেখানে ছিল পঁজিবাদের প্রাধান্য। কিন্তু লেনিন তা সমর্থন জানায়নি। একজন সমাজতন্ত্রের চিন্তা ধারক বাহকের পক্ষে সেই সরকারকে সমর্থন সম্ভব নয়। লেনিনের মতে—“এই বিপ্লব নকল বিপ্লব, আসল বিপ্লব সমাগত।“ আসলে বিপ্লবও এসেছিল। সমাজতন্ত্রের পথ ধরে নতুনভাবে রাশিয়া এগিয়ে চলেছিল। পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, সমাজতন্ত্র নিয়ে জিনোভিয়েভের সঙ্গে নানা আলোচনা হয়েছে লেনিনের। লেনিনের সব বক্তব্য মেনে নিতে পারেনি জিনোভিয়েভ। শেষে লেনিন স্বীকার করেছিল ‘আমাদের থিসিস বদলাতে হবে’। তাঁর মূল কাজ ছিল রাষ্ট্রের চরিত্র বদলানো। এক্ষেত্রে বলা চলে লেনিনের স্বপ্ন ব্যর্থ হয়েছে। সেই ব্যর্থ চিত্রের ভয়ংকর বিবরণ অঙ্কিত হয়েছে চতুর্থ অথ্যায় ‘মেক্সিকো শহর, ২০ অগস্ট ১৯৪০’ এ। মেক্সিকোর কোয়াকানে নির্বাসিত ত্রৎস্কি। তাঁর মনে হয়েছিল—“যে কোনো বিপ্লবের ফলাফল হয়ত এরকমই, এরকমই একনায়কের উত্থান হয়ত বিপ্লবের নকশার মধ্যে নিহিত।“ বর্তমান উপভোগ না ভবিষ্যতের পথ সুগম করে দেওয়া কোনটা ব্যক্তি মানুষের কাজ তা ভাবিয়েছে ত্রৎস্কিকে। বুদ্ধিজীবী থেকে লেনিন সংগ্রামরত ভূমিতে নেমেছিল, শেষে নির্বাসনে গেছে। পৃথিবীকে বদলাতে এসে নিজেদেরই বদল ঘটে গেছে। নিজ দেশ ছেড়েও রক্ষা পায়নি ত্রৎস্কি। ক্ষমতাতন্ত্র, পুঁজিবাদ ভয় পায় বুদ্ধিজীবীদের। তাই স্তালিন শেষ চিহ্নকেও মুছে দিয়েছে। লেনিনের মৃত্যু আগেই ঘটেছিল, ত্রৎস্কি তবুও স্বপ্ন দেখে চলেছিল। কিন্তু সব ভুল প্রতিপন্ন হয়েছে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। স্তালিন সবাইকে হত্যা করেছে লেনিন থেকে ত্রৎস্কি, জিনোভিয়েভ, কামেনেভ, সকলনিকভ ও বুবনভকে। এই স্বৈরাচারী শাসনের বীজ স্তালিন কোথা থেকে পেলেন? ত্রৎস্কির মতে লেনিনের কাছ থেকে। আখ্যানের কিছু অংশ তুলে ধরা যাক—

“আপনি মনে করলেন আপনিই সব জানেন, মানুষের মঙ্গলের জন্য আপনার পথই সবচেয়ে উত্তম। মানুষ যখন নেই তখন থেকেই স্বৈরাচারের শুরু হয়। আপনি তো সমস্ত বামপন্থি দলগুলোর রাজনীতি করার অধিকার ধীরে ধীরে কেড়ে নিলেন। স্তালিন আপনার কাছে থেকেই শিখল বিপ্লবের পথে কোনো বাধা রাখা যাবে না। আমি লাল বাহিনীতে জারের সময়কার সাময়িক অফিসারদের নিয়োগ দিয়েছিলাম, স্তালিন তাদের একের পর এক হত্যা করল।“ (তদেব, পৃ. ১৪৩)

দীর্ঘ আখ্যানে বিপ্লব, বিপ্লবের পথ ও কর্মপ্রন্থা নিয়ে নানা আলোচনা হয়েছে। স্বপ্ন সফল হয়নি লেনিন, ত্রৎস্কিদের। ত্রৎস্কি আজও স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্ন দেখার মধ্যেই মানুষের বেঁচে থাকা, নতুন চিন্তা করা। নবীন প্রজন্ম সেই পথ ধরেই সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করবে। গল্প হিসেবে ‘লৌহশকট’ অনবদ্য। সময় ও পরিসরের এমন যুগলবন্দিতে লেখক কাহিনিকে উপস্থাপন করেছেন যা মুন্সিয়ানার দাবি করে। চরিত্রের পারস্পরিক সংলাপের মধ্য দিয়ে ইতিহাস ও লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি এমনভাবে ফুটে উঠেছে যা ক্লাসিকতার দাবি করে।

দীপেন ভট্টচার্য গল্পে বহু স্তর আবিষ্কার করেন। গল্পের মধ্যে এক মৃদু স্নেহময়ভাব বিরাজ করে। ভাষার জাদুতে গল্পে ডুবে যেতে হয়। কোনো গভীর শব্দ নয়, আটপৌর শব্দের মনোরম আলোকোজ্জ্বল ব্যবহারে গল্প এক মাধুর্য সুষমা লাভ করে। বহু প্রবণতা ও বিবিধ প্রবৃত্তি নিয়ে মানুষের জীবন। তেমনি মানুষ অবস্থার দাস। আবার সমস্ত নিয়ন্ত্রণরেখা মানুষের হাতে নেই। মনের নানা গতিবিধি। মানুষ কখন কী করে নিজেই সে উপলব্ধি করতে পারে না। বহু ঘটনা বোধের বাইরে চলে যায়। সেইসব ঘটনার তাৎপর্য পরে উপলব্ধি করা যায়। অনবদ্য গল্প ‘করুণাধারা’। মানুষকে করুণা করতে গিয়ে যেমন বহু জীবনের পতন ঘটেছে তেমনি নিজেও ক্ষতবিক্ষত হতে হয়েছে। তেমনি মানুষকে করুণা না করে অসহিষ্ণু ব্যবহার করে পরক্ষণেই হীনমন্যতায় ভুগতে হয়েছে। আসলে মূল্যবোধহীন এক সময়ের মধ্যে আমাদের বসবাস। বন্ধুর মধ্যেই লুকিয়ে আছে শত্রুর ছদ্মবেশ। এই পরিস্থিতিতে মানুষ কাকে সাহায্য করে? সাহায্য করে বারবার ডুবে যেতে হয়েছে চোরবালিতে। আবার সাহায্য না করেও বিবেক দংশনে ক্ষত-বিক্ষত হতে হয়েছে। গল্প শুরু হয়েছে এইভাবে—“জানো, অমল, আমি খুব ঈশ্বরভক্ত ছিলাম”। এই ঈশ্বর কোন দেবতা নয় ব্যক্তি ঈশ্বর। ঈশ্বর পাল। মুক্তিযুদ্ধের সময় সকলেই সন্দেহ করেছিল মাস্টার ইসহাক মাস্টারকে। ঈশ্বর পাল করুণার দৃষ্টিতে দেখে ইসহাক মাস্টারকে ছেড়ে দিতে বলেছিল। পরের দিনই ইসহাক মাস্টারের নেতৃত্বে পাক বাহিনী গোটা গ্রাম ধ্বংস করেছিল। হারিয়ে গেছে প্রেমিকা করুণা। নিরঞ্জনের কাছে রয়ে গেছে একগুচ্ছ চিঠি। নিরঞ্জন আজ মৃত্যুমুখে। মৃত্যুর পর পিসিমাকে অমিতাকে অমল রেখে এসেছে গ্রামের বাড়িতে। সেখানে স্থান হয়নি কুকুর কানুর। অমলের পক্ষে কুকুরকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সেও কুকুরকে রাস্তায় ছেড়ে দেয়। যে অমল গল্পের শুরু থেকে বিবেক বোধের কথা, করুণার কথা বলে এসেছে সেও কুকুরকে পরিত্যাগ করে। আবার যে ড্রাইভারকে সকলে পথ দুর্ঘটনার সম্মুখীন করার জন্য ভৎর্সনা করেছিল সেই ড্রাইভারই রাতে অমলের সুবিধার জন্য আলো জ্বালিয়ে রেখেছে। আসলে মানব চরিত্রে এই দ্বিবিধ রূপ। ভালো-মন্দ, করুণা- হিংসা, স্বার্থ-স্বার্থহীনতা নিয়েই মানুষ। তেমনি অনেক সময় ঘটনা ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ রেখার বাইরে চলে যায়। পরে কুকুর কালুর জন্য অমল অনুতপ্ত হয়েছে। একদিকে প্রেমিকা করুণা, অন্যদিকে মানুষকে করুণা করা দুই মিলিয়ে গড়ে উঠেছে করুণাধারা। বিবেকবান, হৃদয়বান মানুষ বহন করে চলেছে করুণাস্রোত। সেই স্রোতকে নিষ্ঠুর আঘাত ভেঙে দিচ্ছে আরকেদল হিংস্র মনুষ্যরূপ পশু। আরেক দলের অবস্থান দুইয়ের মধ্যে। তবুও পৃথিবী চলমান। ঈশ্বর পালরা তবুও শান্তি খুঁজে চলেছে, শান্তির লীলাভূমি গড়ে চলেছে। গল্পের বয়ানে পাই—

“আমি শান্ত হই, হয়ত ক্রোধ ও শেষের অর্থহীনতা বুঝতে পেরেই। হয়ত এই কাহিনিতে আমার অংশগ্রহণের সীমাকে অনুধাবন করে, হয়ত পৃথিবীর কাজে আমার অক্ষমতাকে স্বীকার করে। নিরঞ্জনদা অসীমতার মাঝে ঈশ্বরের করুণা খুঁজতে গিয়েছিলেন, কিন্তু মানুষের জীবনে করুণাকে সংখ্যা দিয়ে গড়া অসাধ্য। ঈশ্বর পাল শেষপর্যন্ত সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। আমি পকেট থেকে এক তোড়া চিঠির বান্ডিল বের করে টেবিলে রাখি। করুণার হাতের লেখা ভিজে গেছে বৃষ্টিতে। দেরি হয়ে গেছে অনেক, আমাকে যেতে হবে। ঘরের বাইরে যখন বের হয়ে আসি তখন বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশের তারা দেখা যাচ্ছিল।“ (করুণাধারা, তদেব, পৃ. ৮৯)

হারিয়ে গেছে প্রেমিকা করুণা। একটি করুণা করার ভুল বিপর্যস্ত করে দিয়েছে একটা গ্রামকে, একটা সময়কে, একটা প্রজন্মকে। তবুও মানুষ করুণা করে। শত ধ্বংসের মধ্যেও নতুন ফুল ফুটে ওঠে। শত অন্ধকারের মধ্যেও জোনাকি ক্ষুদ্র সাধ্য নিয়ে পথিককে সাহায্য করতে চায়। রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল ‘মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ’। শত ধ্বংসের মধ্যে, শত অত্যাচারের মধ্যেও মানুষের বিবেক আবার জেগে ওঠে। বিবেকহীনও একটা মুহূর্তে চেতনায় ফিরে যায়। পৃথিবীতে বয়ে চলে করুণাধারা।

দীপেন ভট্টচার্যের গল্প পড়তে গিয়ে মনে এক বেদনাবোধ অনুভব করি। তেমনি আশ্চর্য শান্তি পাই। এমন অনুভব গদ্যে তিনি কাহিনিতে পাঠককে এমনভাবে ডুবিয়ে দেন যেখানে শুধু আনন্দ-বেদনার মণিমুক্তা ভেসে ওঠে। পরম প্রাপ্তি বা চরম তৃপ্তি অপেক্ষা জীবনের এমন এক বোধের কথা, এমন এক মুহূর্তের কথা যে ভাষায় তিনি নির্মাণ করেন তা অনবদ্য। লোকাচার, কুসংস্কার, ব্যক্তি মানুষের আবেগকে সামনে রেখে আখ্যান এগিয়ে গেলেও শেষে তিনি বিজ্ঞানের সত্য জানিয়ে দেন। পাঠক হিসেবে গল্প পড়তে পড়তে যখন একটা বোধ বা বিশ্বাসকে মাথার ভেতর বড় করে তুলছি বা গল্পের লীলাভূমিকে মাথায় বহন করে চলেছি তখনই তিনি বিশ্বাস ভেঙে দেন। প্রচলিত সত্য থেকে বৈজ্ঞানিক সত্যের মুখোমুখি পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেন। অনবদ্য গল্প ‘নীলাকান্তমণি’। বঙ্গদেশের মানুষ এক লোকাচার বিশ্বাস ও লোকায়ত ধ্যান ধারণাকে সামনে রেখে আজও বেঁচে আছি। মুক্তির স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু সময় তো এগিয়ে চলছে। সময়ের পরিবর্তনে লোকবিশ্বাস গুলি খণ্ডিত হয়ে যাচ্ছে বৈজ্ঞানিক সত্য দ্বারা। সেই সত্যের মুখোমুখি পাঠককে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গল্পকার আখ্যান থেকে বিদায় নেন। গল্প শুরু হয়েছে এইভাবে—“মানুষগুলো সব চলে যায়, কোথায় যায়?” আপাতভাবে এই বাক্যটি পড়ে পাঠকের জগদীশ চন্দ্র বসুর ‘ভগীরথীর উৎস সন্ধানে’ গদ্যাংশের কথা মনে হতে পারে। দীপেন ভট্টাচার্য গল্পকে কখনোই জটিল করেন না। তাঁর আখ্যানভূমি সরলরৈখিক বিন্যাসের মতো সম্পর্কযুক্ত। তেমনি গল্পের আখ্যানভূমির জন্য তিনি একটা পটভূমি গড়ে তোলেন। কখনো ‘ভূমিকা’ বা একটা পরিচ্ছেদ রচনা করেন। তারপর ঘটনার সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে চলেন। বলা ভালো পাঠককের মনভূমি গড়ে তুলতে তুলতেই গল্পের রহস্য উন্মোচন করেন।

‘নীলকান্তমণি’ গল্পে সুনন্দ গ্রামের বাড়িতে ফিরবে পিতার বাৎসরিক অনুষ্ঠান করতে। সেজন্য খবর দেওয়া হয়েছে পুরোহিত তীর্থংকর চক্রবর্তীকে। পরের সমগ্র ঘটনা তীর্থংকর চক্রবর্তীকে নিয়ে। তিনি তারাশঙ্কেরের ‘অগ্রদানী’ গল্পের পূর্ণ চক্রবর্তী নন। আসলে দীপেন ভট্টাচার্যের উদ্দেশ্য তো বৈজ্ঞানিক রহস্য ব্যাখ্যা করা। তীর্থংকর চক্রবর্তীর স্ত্রী কমলার মৃত্যু হয়েছে চৌদ্দো বছর। কমলার ছিল একটা নীলকান্তমণি মালা। এটিও বধূ হিসেবে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। তিনি পুত্রবধূকে সেটি দিয়ে যেতে চেয়েছেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যু আগেই ঘটেছে। দীপেন ভট্টাচার্য গল্প বলতে বলতেই একটু সময়ের আভাস দিয়ে দেন। সময়সরণি যেন তাঁর আখ্যানে তীব্র বিদ্যুৎ ছটার মতো ঝলক দিয়ে ওঠে। আছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় অত্যাচারের কথা। তেমনি কাহিনিতে পাই সমবায় ব্যাংক গড়ে ওঠার কথা। তবে সেইসব অতীত বা ভবিষ্যতের বৃত্তান্ত মনে রেখে লাভ নেই। ব্যক্তি মানুষের কার্যকলাপ বর্তমান সময় নিয়ে। ডাক্তার সুনন্দের ভাবনায় তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে—“সময়ের স্রোত নদীর জলের মতো, ভাবে সুনন্দ। অতীত হল ভাটায়, ভবিষ্যৎ উজানে, কিন্তু মানুষ ভাটায় বা উজানে কোনোদিকেই হাঁটতে পারবে না।“ (নীলকান্তমণি, তদেব, পৃ. ১৫২) স্ত্রী মারা যাবার পর তীর্থংকর চক্রবর্তীর সংসার সন্তান মিহির ও পরিচারিকা লক্ষ্মীকে নিয়ে। সন্তান বড় হয়েছে। একদিন ঘুরতে গেছে পাথালিয়া গ্রামে বন্ধু মুজিবুরের বাড়িতে। মুজিবের মাতা শানাজ এক কন্যার (পুষ্পা) সন্ধান দেয়। যে নাকি মিহিরের মাতার মতো দেখতে। এমনকি কমলা যে বছর মৃত হন পুষ্পার জন্ম সেই বছর। মিহিরের মনে সন্দেহ জাগে। সে নিজে গিয়ে দেখে সেই কন্যাকে। এমনকি পিতাকে দেখানোর জন্য বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে। সেদিনই পুষ্পা তাদের নীলকান্তমণি হারটি চুরি করে। তীর্থংকর তা ফিরিয়ে আনতে যায়। ভাবে এই পুষ্পই বুঝি কমলা। কিন্তু পুষ্পার গলায় নীলকান্তমণি হারটি পড়িয়ে দিলে তীর্থংকরের ভুল ভাঙে। পুষ্পা যে কমলার উত্তরাধিকারী নয় তা বুঝতে পারে। পরের পরিচ্ছেদে আবার সুনন্দ ফিরে এসেছে পিতার বাৎসরিক কার্য উপলক্ষে। পুরোহিত তীর্থংকর চক্রবর্তী বাৎসরিক শ্রাদ্ধ করাচ্ছে সুনন্দকে দিয়ে। সুনন্দ লোকাচার বিশ্বাস নিয়ে নানা প্রশ্ন করে তীর্থংকর চক্রবর্তীকে। তিনিও প্রচলিত মতে উত্তর দেন। কিন্তু ডাক্তার সুনন্দের মনে নানা সংশয় জাগে। সে তো জানে এইসব বিশ্বাস ও লোকাচারের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই—

“সুনন্দ যেন নিজের মনেই বলতে থাকে, ‘হয়ত আগের জন্মে বা তার আগের জন্মে তিনি পিতা বা মাতা ছিলেন, সেই জন্মের সন্তানরাও তাঁর উদ্দেশে মন্ত্র পড়েছে, আগামী জন্মের পুত্ররাও পড়বে, আমার পিতাও পড়বেন। আমার মাতারও একই দশা হবে, আমারও। তাহলে তো সব ঘেঁটে যাবে কাকাবাবু, হয়ত আগামী কালের কন্যা আগের জন্মে আমার পিতা। তাহলে আমার পিতার বা কন্যার বৈশিষ্ট্য থাকল কোথায়?” (তদেব, পৃ. ১৬৬)

পরজন্ম বলে কিছু নেই। মানুষের জীবন একটাই। সে সত্য তীর্থংকর চক্রবর্তী উপলব্ধি করতে পেরেছে। আত্মার পুনারাগমন ঘটে না। তা মহাবিশ্বের অণু-পরমাণুতে মিশে যায়। এই আত্মতত্ত্ব অপেক্ষা পৃথিবীর চন্দ্র-সূর্যের সৌন্দর্য উপলব্ধি গুরুত্বপূর্ণ। সুনন্দের পিতা সুপ্রিয় সেন তো জীবনের শেষ বেলায় সূর্য ভালোবাসতেন। তীর্থংকর চক্রবর্তীও ফিরে গেছেন মহাবিশ্বের সৌন্দর্যের কাছে—“পড়ন্ত সূর্যে পশ্চিমের আকাশ যত লাল হল বাদবাকি আকাশ তত নীল হতে লাগল। গাঢ় নীল। এই আমার নীলকান্তমণি, ভাবেন তীর্থংকর।“ (তদেব, পৃ. ১৬৮) মহাবিশ্ব, পৃথিবীর নানা রহস্য ও বৈজ্ঞানিক সত্যের কার্যকারণ সম্পর্কের জানান তিনি দিয়ে যান। আর সেই সূত্রমালা গাঁথতে তিনি আখ্যানে অবগত হন। কোনো আকস্মিক ঘটনা বা জটিলতা নয়, বিচ্ছিন্নতাও নয়, তিনি যেন মালার একটি একটি ফুলের বর্ণনা দিতে দিতে গোটা মালাটিকেই আমাদের সামনে উপস্থাপিত করেন। মালা থেকে চারিদিকে সৌন্দর্য বিচ্ছুরিত হয়। সেই মালার কেন্দ্রে যেন বিজ্ঞান ঘাপটি মেরে বসে থাকে। অর্থাৎ চারিদিকে ঘুরে সেই বিজ্ঞানের কাছে আসতেই হবে। এখানেই দীপেন ভট্টাচার্যের স্বতন্ত্রতা। অন্য গল্পকারদের থেকে সহজেই তিনি পৃথক হয়ে যান।

বিদেশকে পটভূমি করে দীপেন ভট্টাচার্য যেমন গল্প লেখেন তেমনি তাঁর গল্প ভীষণভাবে বাংলাদেশকেন্দ্রিক। বাংলাদেশের জনজীবন, মুক্তিযুদ্ধ, মানুষের সংগ্রাম,  পরিবর্তনশীল সমাজ ব্যবস্থা বারবার প্রাধান্য পেয়েছে। ‘সিনেস্থেশিয়া’ গল্পও বিরাট পরিসরে লেখা। গল্পের সূচনা ১৯৮০ সালে। গল্পের আখ্যান ফিরে গেছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। আখ্যান শেষ হয়েছে ১৯৮৭ সালে। গল্পে প্রবেশের আগে ‘সিনেস্থেশিয়া’য় অর্থ স্পষ্ট করা প্রয়োজন। গল্প থেকেই তুলে দেওয়া যাক—“সিনেস্থেশিয়া মানেই হল একটি বোধ দিয়ে আর একটি বোধের জাগরণ। দেখলাম শব্দ থেকে আলো সঞ্চারণ সিনেস্থেশিয়ারই একটা অংশ, সেটাকে ক্রোমেন্থেশিয়া বলে। অনেক বড় বড় ক্ল্যাসিকাল সুরকারদেরও নাকি এই বোধটা ছিল। সঙ্গীত শুনলে, বাজনা শুনলে, গান শুনলে একটা নির্দিষ্ট রঙ মনে সঞ্চারিত হতে পারে।“ (সিনেস্থেশিয়া, তদেব, পৃ. ৯৫) আখ্যানটি ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় লেখা। আরো ভালোভাবে বলতে গেলে সাহানা নামে একটি নারীর ট্র্যাজিক বেদনার ইতিহাস। সে ইতিবৃত্ত অর্ধেক কথিত হয়েছে কন্যা রেবার মুখে, অর্ধেক বন্ধু (পরে সতীন) সালেহার মুখে। মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহত আখ্যানে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শত শত পরিবার, নারী কীভাবে ধর্ষিত হয়েছিল সেই সত্য বহন করে চলেছে গল্পটি। সাইকিয়াট্রিক ডাক্তার আবদুল মতিনের চেম্বারে একদিন এসেছে সালেহা। কিন্তু নিজেকে সে পরিচয় দেহ সাহানা বলে। সে বলেছিল—“আমি শব্দের সঙ্গে রঙ দেখতে পাই।“ আবু মূর্তজার স্ত্রী ছিল সাহানা। সাহানা মুক্তিযুদ্ধে মৃত হলে আবু মূর্তজা বিবাহ করে সালেহাকে। সাহানার প্রতি আবু মূর্তজার অগাধ ভালোবাসা ছিল। তেমনি সালেহার বন্ধু ছিল সাহানা। সে নিজেও সাহানাকে খুব ভালোবাসতো। আজ বিবাহিত সালেহা মাঝেমাঝেই মিলিয়ে ফেলে সাহানার সঙ্গে। নিজেকে যেন সাহানার রূপকভাবে, দ্বৈত সত্তা হিসেবে কল্পনা করে। কেননা সে নিজেও মুক্তিযুদ্ধে অত্যাচারিত হয়েছে, ধর্ষিত হয়েছে। তবুও বেঁচে গিয়েছিল মনে মনে একটি গানের কথা ভাবতে ভাবতে। গোটা গল্প জুড়েই রয়েছে রাজকারদের অত্যাচারের ভয়াবহ চিত্র। তেমনি এই রাজাকাররাই পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের আবার ক্ষমতা ভোগ করছে। লেখক বাংলাদেশের সত্য জীবনচিত্রের ওপর জোর দিয়েছেন। মাঝে থেকে বহু নরনারী প্রাণ দিয়েছে। আজও কি বাংলাদেশে সুস্থ সামাজিক জীবন কাটানোর উপযোগী? হয়ত নয়। লেখকের বয়ানে সে সত্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে—

“রেবার কথা আমি অবিশ্বাস করি না। যে কিশোরী নিঃশঙ্কচিত্তে একটি অপরিচিত পুরুষকে তার পরিচয় দেয় শুধুমাত্র সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, নির্দ্বিধায় সেই পুরুষের হাত ধরে তাকে নর্দমার দুর্ভোগ থেকে বাঁচায়, তার আত্মবিশ্বাস, পৃথিবীকে মুক্ত চোখে দেখার ক্ষমতা ঈর্ষণীয়। ভাবি, এই শহর কি রেবার জন্য প্রস্তুত, বনগ্রামের এই অন্ধকার গলি সইতে পারবে কি তার ছন্দময় গতি ?” (তদেব, পৃ. ১০০)

ডাক্তারের কাছে সাহানা (প্রকৃতপক্ষে সালেহা) শব্দ ও রঙের খেলার উত্তর পায়নি। তবে ডাক্তার জানিয়েছিল জানলে জানাবে। জানাতে গিয়ে সালেহা, সাহানার প্রকৃত রহস্য উদ্ধার হয়। তারপর কেটে গেছে অনেকদিন। ১৯৮৭ সালে চেম্বারে আবার সালেহা এসেছে। সেদিনের গোপন সত্য আজ স্পষ্ট করেছে। দীপেন ভট্টাচার্যের গল্পপাঠ এক সত্য আবিষ্কার। তিনি ধীরে ধীরে আখ্যানের শেষ সত্যে পৌঁছান। গল্পের বাতাবরণে এক রহস্য বিচারণ করে। তবে তা অলৌকিক নয়। লেখক নিজেও যেন পাঠককে সঙ্গে নেন। ঘুরতে ঘুরতেই ঘটনার চোরাবালি আবিষ্কার করেন। পাঠককে সে সত্যের চিত্র উপলব্ধি করান, তারপর বিদায় নেন। ‘রান বয় রান’ গল্পেও সময়ের বিধ্বস্ততার চিত্র আছে। আছে অতীতে ফিরে যাবার চেষ্টা। রান বয় অমল আজ বুঝেছে সেদিন পিতামাতাদের ক্ষেত্রেও ‘রান’ বা দৌড় শব্দটি প্রযোজ্য ছিল। কিন্তু পিতামাতা নিজেদের বিসর্জন দিয়ে অমলকে বাঁচিয়েছে। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ কীভাবে মানুষকে ক্ষত-বিক্ষত করেছিল তা লেখক বিভিন্ন গল্প ভিন্ন ভিন্ন পরিসরে দেখিয়েছেন। তেমনি বহু গল্পের কথক অমল। এ রবীন্দ্রনাথের বন্দি অমল নয়। অমল যেন কথকঠাকুর। তাঁকে সামনে রেখেই লেখক সময়ের সুতো গাঁথতে চান।

আলোর খেলা, রঙের খেলা নিয়ে দীপেন ভট্টাচার্যের কথাজগৎ গড়ে ওঠে। বিধ্বস্ত বাংলাদেশের সময় যন্ত্রণাকে তিনি সূক্ষ্মভাবে বুনতে চান। সেখানে টেকনিক হিসেবে বিজ্ঞানের অনুষঙ্গ ব্যবহার করেন। গল্পকে ক্ষুদ্র পরিসর অপেক্ষা বৃহৎ পরিসরে উপস্থাপন করেন। নিবিড় ডেটেলিং এর মধ্য দিয়ে জীবনের পরতে পরতে যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সত্য তার যেমন আভাস দেন তেমনি বৃহৎ জগতের ভিতর ডুব দেন। তথাকথিত ছোটোগল্পের প্লট বা সমাপ্তিতে তিনি বিশ্বাসী নন। তিনি ছোটোগল্পকে পূর্ণতার মধ্য দিয়ে সমাপ্ত করেন। যাবতীয় রহস্যের দ্বার উন্মোচন করেই বিদায় নেন।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত