| 19 এপ্রিল 2024
Categories
ঈদ সংখ্যা ২০২১

গদ্য : অভিশপ্ত কুড়ির সেই রাত । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

তখন গোদের ওপর বিষফোঁড়া। অতিমারির মোকাবিলায় বুক বেঁধে নিজের স্বপ্ন সাম্পানে ভেসে করোনার সাগর সাঁতরাচ্ছি। তার মধ্যেই এক কালজ্যৈষ্ঠের বিকেলে আমপানের ধেয়ে আসার কথা রটেছে। ঝড়ের নাম নিয়ে বিস্তর আর অ্যান্ড ডি করছি আমিও। আমবাঙালীর মত আমিও ভেবেছিলাম মিডিয়া যত গরজেছে ততটা বর্ষাবে না। ঠিক প্রথম দিকে করোনার খবর যখন হোয়াটস্যাপে আসছিল তখন ভেবেছিলাম, আমাদের গরমের দেশে এমন হবে না, ওসব ঠান্ডা বিদেশের রোগ।

আমপানের আসন্ন সেই থমথমে দুপুরে ঘন মেঘে ঢেকে গেল চরাচর। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হল। ঝড়ের টেনশন, করোনার আতংক কাটাতে একবার রবি-নজরুল নিয়ে লিখতে বসছি তো আরেকবার বহুদিনের পুরনো গ্লাস পেন্টিং কিট খুলে হাতের কাছে যা পাচ্ছি তাই রঙ করতে বসছি। বন্ধুবান্ধব হোয়াটস্যাপ গ্রুপে সতর্ক বাণী প্রেরণ করলে তাদের হালকা চালে বলছি, লেখো রম্যরচনা। টপিক: করোনাসুর ভার্সেস উম্পুনাসুরের দ্বৈত যুদ্ধ। হাসো বাঙালী হাসো। জিও জি ভরকে। বুড়ো মায়ের হোয়াটস্যাপ এলে মা কে সাহস যুগিয়ে বলছি, রবীন্দ্রনাথ কি বলেছেন? ঝড়কে আমি করব মিতে, ডরব না তার ভ্রুকুটিতে ।

টেলিভিশন শুনছেন শাশুড়ি মা। কানে আসছে। সুন্দরবনের মানুষজন, নীচু এলাকার প্রত্যন্ত গ্রামের লোকজন, হতদরিদ্র সেই মানুষগুলো যাদের ঘরের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে ফলন্ত সবেদা গাছ দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম সেবার। গাছ থেকে সবেদা পেড়ে দিয়েছিল হাফ প্যান্ট পরা এক ছেলে। তাকে কুড়িটা মোটে টাকা দিতে পেরে কি আনন্দ হয়েছিল। তার ঠাকুমা ঘরের ভেতর থেকে দিশী মুরগীর ডিম এনে দিয়েছিল গোটা আষ্টেক। বিক্রি করতে পেরে ধন্য হয়েছিল বুড়ি।

গ্লাস পেন্টিং করতে করতে টিভির খবরে কান রেখে ভাবছিলাম এদের কথাই। ওরা যদি আয়লার পরেও বেঁচে থাকতে পারে তবে এহেন শহুরে আমি এত চিন্তা কিসের? বরং করোনা আরও মারাত্মক। তবে এই করোনা কালে এমন ঝড় আসাটাও কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে বৈকি। ভাবছিলাম তাদের কথা যেসব পরিযায়ী শ্রমিকদের কোয়ারেন্টাইনে রেখেছে কিম্বা ঝড় আসবে বলে যাদের উপদ্রুত এলাকা থেকে সরিয়ে এক ছাদের নীচে কোনও আশ্রয়ে রাখা হয়েছে তাদের কথা।

সেদিন দুপুর থেকেই ফ্ল্যাটবাড়ির জানলা দরজার সূক্ষ্ম ছিদ্র দিয়ে বাতাসের সোঁ সোঁ করে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়াটা যেন বেশ করুণ আবহ তৈরী করেছিল। কাল ঝঞ্ঝা প্রবেশের সতর্কবার্তা যেন। কালঘূর্ণি তার কক্ষপথ রচনা করতে করতে যেন ধেয়ে আসছিল ক্রমশঃ।

বৃষ্টির দমক বাড়ছে সঙ্গে হাওয়ায় শান । উত্তরের ছাদ বাগানের নালীর মুখ ছাতা মাথায় পরিষ্কার করে আসি বারেবারে। ছাতা উল্টে গেল আমার সাততলার ছাদে। বুঝলাম ঝড়ের গতিবেগ বাড়ছে ক্রমশঃ।

আমরা দুজনে টেনশন কমানোর জন্য ব্ল্যাক কফি খেয়েই চলেছি তখন। কেমন অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম এক টুকরো সুখী  গৃহকোণে বন্দী থাকতে থাকতে। হাতে হাতে সব কাজ করে নিতে নিতে। কোত্থেকে আবার এই আপদ আমপান এসে জুটল এর মধ্যে। কফির পেয়ালা হাতে নিয়ে আটতলা থেকে নীচে শাশুড়ি মা কে চেঁচিয়ে বলি টিভি বন্ধ করে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়তে। ঝড়ের গতিবেগ ভালো নয়। ওদিকে নীচে নেমে দেখছি ছাদের কাঁচের স্লাইডিং দরজা দিয়ে বন্যার মত বৃষ্টির জল ঢুকে লিভিং রুম ভাসিয়ে দিচ্ছে। এ ঘটনা নতুন নয়। জোরে জল পড়লে এমনি হয়। ছাদের জল পাথরের চৌকাঠ উপচে ঘরে ঢুকে পড়ে। ছাদে গেলেই ভিজে যাচ্ছি দুজনে। নালির মুখে পাতার স্রোত। মনে পড়ছে উপনিষদের ঋষি ধৌম্যর  শিষ্য আরুণির গুরুভক্তির কথা। অতি বৃষ্টিতে বন্যা রুখতে ধানক্ষেতের আলের ওপর সারারাত শুয়ে বাঁধ দেওয়ার সেই গল্প। আর আমাদের তখন শুরু নর্দমার মুখে পাতার বাঁধ ভাঙার গল্প। ভিজতে ভয় করছে। যদি জ্বর এসে রেজিস্টেন্স কমে করোনা হয়? ঘরে ঢুকে ৮৩ বছরের শাশুড়ি মাকে শোবার ঘরে বিছানায় ঢুকিয়ে আবারো আটতলায় উঠি। সেখানও ছোট্ট ব্যালকনি থৈ থৈ করে উপচে জল আসতে শুরু করেছে বৃষ্টির দাপটে। সেই জল কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নীচে পড়ছে। পড়ুক। আমাদের চিন্তা অন্যদিকে। আমার সাধের ডুপ্লেক্সের সিঁড়ির কাঁচের স্টেয়ার কারটেন ওয়াল। সাততলা থেকে আটতলা যাবার ঘরের মধ্যেকার সিঁড়ি।

সারাজীবন পড়াশুনো করে, চাকরীর সঞ্চিত পয়সায় আমরা অনেকদিনের শখের প্রিমিয়াম ডুপ্লেক্স কিনেছি। চুরি, জোচ্চুরি, ঘুষ বা কাটমানি বা নিদেন দালালির টাকায় হলে নয় ভয় পেতাম মনে মনে। লোকের অভিসম্পাত লাগবে এই ভেবে। কিন্তু আমরা জোর গলায় তখনও বলে যাচ্ছি, আমাদের ঈশ্বর এমন কোনও ক্ষতি করবে না। উনি পৈতে ছুঁয়ে ইষ্টমন্ত্র জপে। আমি ঠাকুর ঘরে একবার আদ্যাস্তোত্র তো আরেকবার অপরাজিতা মন্ত্র। কিন্তু মন বসাতে পারছিলাম কই? আর পারবোই বা কি করে? আগুনে হাত দিয়ে যদি ঈশ্বর কে বলি বাঁচাতে? উনি কি পারবেন? পারবেন না। এ বাড়িতে ঢোকার পর থেকে এতগুলো  মনসুন পেরোচ্ছিলাম  খুব টেনশনে। কাঁচের দেওয়াল ঠিকঠাক প্রযুক্তিতে বানায়নি অত নামীদামী প্রোমোটার।

সামান্য কালবৈশাখীতে ২০ ফুট বাই ১৬ ফুটের দেওয়ালের প্রচণ্ড কম্পন আর শব্দ দেখে আমার হার্টবিট বেড়েছেই বিগত ৭-৮ বছর ধরে। তাদের বলে কোনও লাভ হয়নি। ওরা কেউ কথা রাখেনি। ওপর থেকে বৃষ্টির জল পড়েইছে অনবরত। আমরা পুরনো ফ্লেক্স, বালতি, গামলা, ন্যাতা পেতে রেখেছি সারা বর্ষাকাল। কেউ কথা শোনেনি। ওরা এসে সিলেইন লাগিয়ে গেছে একবার মোটে। স্তোক দিয়েছে, আর জল পড়বে না। বৃষ্টি ওদের কথায় পেচ্ছাপ করে দিয়ে ভাসিয়েছে আমার শখের ড্রয়িং রুম প্রতি বর্ষায়। ওরা ফোন ধরেনি। এমতবস্থায় কোন ভগবান আমায় রক্ষে করবে? যেখানে প্রযুক্তির গোড়াতেই গলদ? অত উঁচুতে হাওয়ার ধার কেন সামলাতে পারবে সেই লম্বাচওড়া পেল্লায় কাঁচের দেওয়াল?

তাই ঈশ্বর সেদিন  আমাদের দুজনের কথায় কর্ণপাত করছেন না বুঝতেই পারছিলাম। উনি চেয়ে রয়েছেন আটতলার স্টাডি থেকে সেই প্রকাণ্ড দেওয়ালের দিকে। আমি ভয় পেয়ে ঘরে ঢুকে শুনছি সেই বিকট শব্দ। দুটো কাচ মচমচ করছে। ঠিক ফ্ল্যাপের মত। দুটো কাচ ভি এর আকৃতিতে নড়তে নড়তে বাইরে বেরিয়ে পড়ছে। আবার ভেতরে। হ্যাঁ, এইবার পড়বেই। হ্যাঁ, হল  ঠিক তাই। এদ্দিন সিঁড়ি ওঠানামা করতে করতে যে জয়েন্টটায় ফুটোর মধ্যে দিয়ে এক টুকরো নীল আকাশ দেখতাম সেখান দিয়েই হাওয়াটা ঢুকে প্রথম ফাটল ধরল তবে, ঠিক এটাই আশঙ্কা করেছিলাম আমরা। এবার? কি হবে তবে? এর মধ্যে পাওয়ার আসছে যাচ্ছে।

এবার চিন্তা, যদি পাওয়ার না থাকে তখন নীচে নামব  কিভাবে? ভাবলাম মোবাইলের আলো আছে। সব মোবাইল, পাওয়ার প্যাক ফুল চার্জ দেওয়া আছে। অসুবিধে নেই। আগেভাগেই দুটো ল্যাপটপ বন্ধ করে দিয়েছি পাওয়ার আসা যাওয়া দেখে। অনেক আগেই শখের গ্লাস পেন্টিংয়ে ইতি টেনেছি। ঝড়ের গতি ক্রম বর্ধমান। দুকানে আঙুল দিয়ে বসে রইলাম শব্দ যাবে না কানে। নাহ! পারলাম না। এ শব্দ রোখে কার সাধ্যি? এ তাণ্ডব শুনতেই হবে আমাদের। ঝড়ের আস্ফালন এত কাছ থেকে চোখের সামনে দেখিনি আগে। জানলা বন্ধ করে কাচের মধ্যে দিয়ে দেখেছি। চোখের সামনে ঝনঝন করে ভেঙ্গে পড়ল প্রথম কাচ । কি ভাগ্যি বাইরে পড়ল। তারপরেই আরেক খণ্ড। দুমড়ে মুচড়ে এবার বাকী গুলো। আলগা হয়ে গেছে স্ট্রাকচার। বুঝলাম পরে। অতবড় কাঁচের স্ট্রাকচার। কংক্রিটের সঙ্গে কোনও লোহার গজালে আটকানো নেই? এবার আরেকটা বিশাল কাচ গিয়ে পড়ল নীচের দুই ফ্ল্যাটের কাচের সার্সিতে আর ফাটিয়ে চুরমার করে দিল। ঝনঝন শব্দ হল। শেষ হল কাচের দেওয়ালের জান্তব উল্লাস।

হায় নতুন যুগের ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তি! এরা কি মানুষ মারার কল করেছে? একি ওয়ার্ক এডুকেশনের পুতুলের ঘর? আমরা জানি সমুদ্রের ধারে টিনের চাল, মাটির বাড়ি, শহরের অ্যাসবেস্টসের ছাদ উড়ে  যায় তাই বলে কলকাতার বুকে আধুনিক প্রযুক্তিতে বানানো কেতাদুরস্ত আরকিটেকচর? মাত্র চারটে চার ইঞ্চি স্ক্রু দিয়ে আটকানো ছিল পেল্লায় সেই কাচের ফ্রেম? ঘরের মধ্যে সেই স্ক্রু দেখে বুঝতে পারি। ঈশ্বর যেন পাশ থেকে বলে উঠলেন, ঠিক করোনার মত। রাজার ঘরে যে রোগ, টুনির ঘরেও সেই রোগ। ফ্ল্যাট তো ভদ্রলোকেদের বস্তি, মনে নেই মহাশ্বতা দেবী সেই কবেই বলেছিলেন শান্তিনিকেতনের দ্রুত শহরায়ন দেখে? আজ বস্তিতে সস্তার ঘর ভেঙে পড়েছে একের পর এক। ভদ্রলোকেদের নামীদামী বস্তিতে এমন হল!  অতএব দুয়ে দুয়ে চার উপেন্দ্রকিশোর! হ্যাটস অফ!

তবে সেদিন প্রাণপণে ঈশ্বর কে ডাকার ফলে ছুঁচ হয়ে বিপদ কাটল তবে। ফাল হয়ে বেরুলো না। রামকৃষ্ণ বলতেন। সম্পূর্ণ কাঁচের সেই স্ট্রাকচার পাতলা ফ্রেম সমেত এক নিমেষে উড়ে গিয়ে ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল অত উঁচু থেকে। ঘরের মধ্যেও পড়লে আরও বিপদ হত, সেই ভেবে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালাম। বাড়ির ভেতরে তখন অবাধ গতিতে জলের প্রবেশ শুরু হয়ে গেছে। বাঁচলাম এতদিনে। আর সিঁড়িতে জল পড়বে না। ঘটিবাটি পাততে হবে না। পৌনে ছটা থেকে সাতটা অবধি এমন পাশব তাণ্ডবের সঙ্গে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছি। এবার হঠাত করেই শুনশান। সব শান্ত। এই  বুঝি সাইক্লোনের আই। হ্যাঁ। এবারেই নীচে নামা সমীচীন আমাদের। আবারো আসবে তার লেজ। তখন আর পারবও না নামতে। কিন্তু নামব কিভাবে? ডানদিকে খোলা। যদি পড়ে যাই? সিঁড়ি তো জলমগ্ন। পা স্লিপ করতে কতক্ষণ?

ডিসাস্টার ম্যানেজমেন্ট এবার। সামলাতে হবে আমাদের। আটতলার দেওয়ালের ক্যালেন্ডার ঝড়ের তাণ্ডবে ছিঁড়ে খুঁড়ে একাকার দেখে দেওয়ালের সব ছবি নামিয়ে ভেতরের ঘরে রাখি। তারপরেই ল্যাপটপ, প্রিন্টার, হারমোনিয়াম… সব বয়ে আনি  মাথা ঠাণ্ডা করে। কিন্তু বৃষ্টির অপর্যাপ্ত ছাঁটে ভিজে দুজনে একশা। জামাকাপড় বদলাবার সময় নেই। এবার ওপরের ঘরে জল সজোরে আছড়ে পড়ছে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছিল এতদিন। এবার আকাশের গায়ে। বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস। ওপরের বেডরুম দুটো সিল করলাম চৌকাঠে কাপড় গুঁজে। ব্যাগের মধ্যে আলমারির চাবি, চার্জার,  দুসেট জামাকাপড় নিয়ে এবার সেই উন্মুক্ত সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে নামতে হবে আমাদের। না জানি নীচের ঘরে শাশুড়ি মা কি করছেন তখন। তাঁকে ওপর থেকে ফোনে যোগাযোগ করে পাচ্ছি  না। কি ভাগ্যি সিঁড়ির আলোটা ঈশ্বর জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। ধীর পায়ে জিনিসপত্র নিয়ে নীচে নেমে দেখি বসবার ঘরে সোফা, টেবিল, সব আসবাব, বাহারি কুশন, আপহোলস্ট্রি জলে টইটুম্বুর। দেওয়ালের শখের অয়েল পেন্টিং সব জলে জলাকার। পায়ে গোড়ালি অবধি জল রান্নাঘর, মায়ের বেডরুম সব বন্যার মত। উনি আমার দিকে চেয়ে বললেন, ভেঙে গেল শেষমেশ। বললাম, চুলোয় যাক কাঁচের দেওয়াল। মায়া বাড়িও না। এখন যা করার তাই করতে হবে আমাদের। ডাইনিং রুমে টেনে নিয়ে এলাম সোফাগুলো। লক ডাউনে খবরের কাগজও নেই যে বিছিয়ে দেব। ফুল স্পিডে সব ফ্যান চালিয়ে রাখলাম। সিঁড়ির দেওয়ালের শখের ছবি উড়ে গেছে ততক্ষণে মাটিতে। হাওয়ার দাপটে ছিটকে পড়েছে শখের সব কিউরিও। কাচ ছিলনা তাই রক্ষে। বাইরে চলে যায়নি তাই রক্ষে। মেইন দরজা খুলে স্কুইজি দিয়ে জল ঠেলে বাইরে পাঠাই । আধুনিক ফ্ল্যাটে ঘরে নর্দমা নেই। এক বাথরুম, দুই বাইরের সিঁড়ি একমাত্র জল নির্গমনের পথ।

সে রাতের মত এক গাল করে মুড়ি। তারপর ঢকঢক করে খানিকটা জল আর মনে করে অ্যান্টি অ্যালারজিক। প্রচুর জল ঘেঁটেছি। রাত বারোটা অবধি জল ছেঁচেছি বটে অভিশপ্ত সে রাতে। ঝড় এসেছিল অভিসারে। তার অহঙ্কারী রূপ দেখিয়ে নেত্য করতে। আবারো তার লেজের প্রকাণ্ড ঝাপটা মেরে দাপট দেখাতে।

নাহ! আর ভয় পাইনি। কাচের দেওয়াল নিয়েই চিন্তা ছিল। তারপর সব শুনশান। সব ঝড় থেমে গেল সে রাতের মত। ঘরে তখন থৈ থৈ জল। 

আমার আর একটুও দুঃখ নেই সাধের কাচের দেওয়াল উড়ে গেছে বলে। আমরা বেঁচে আছি ঠিকমত সেটাই আসল। রাতে শুয়ে সেদিন থেকে এখনও সেই আকাশের গায়ে খোলা আটতলার সিঁড়ি দিয়ে নামা ওঠা করছি ভাবলেই স্বপ্নের ঘোরে মনে হচ্ছে এবার বুঝি ধপ করে নীচে পড়ে যাব। একটা ঘোরের মধ্যে আছি এখনও তবে কাচের দেওয়ালের মায়া চিরজন্মের মত ত্যাগ করে ফেলেছি মহাপুরুষদের মত।

ছেলে বলল, থ্যাঙ্ক গড! মা তোমাদের গায়ে যদি কাঁচের টুকরো ফুটত তাহলে বুলেটের মত ঢুকে, গেঁথে যেত চামড়ায়। সেটুকুনিই আমাদের পরম সৌভাগ্য। ভাগ্যিস আমার বইয়ের তাকগুলো অন্য ঘরে ছিল তাই সব বেঁচে গেছে সেটাই রক্ষে। 

পরদিন ভোরে ছাদবাগানে দাঁড়িয়ে মনে হল দ্বিতীয় বিভীষিকা। ছাদের মেঝে চিড়  খাওয়া ছিল। তার ওপরে সজোরে উড়ে এসে পড়েছে সেই কাচগুলো। লণ্ডভণ্ড সারা ছাদ তখন কাচের কুচিময়। হাউজ কিপিং স্টাফ এসে ছাদ পরিষ্কার করে দিল। তারপর থেকে রোজ ঘরের আনাচকানাচ থেকে ঝাড়ু দিয়ে বের করে আনছি অভ্রের মত চকচকে সূক্ষ্ম কাচের কুচি। আমার অন্দরমহলে রোদের আলো, ধুলো, গাছের পাতা, পাখীদের সবার এখন অবারিত দ্বার সেই পুবের খোলা আকাশের হাওদাখানা দিয়ে। আমরা তো ভালোই আছি। মাথার ওপর ছাদ তো তবু আছে। জল, ইলেকট্রিকও আছে। শুধু কেবল আর ইন্টারনেট বিহীন।  মুঠোফোনে চোখ রাখলেই নিউজ রোল ভীড় করছে। কারোর ভেঙ্গেছে পাঁচিল, কারোর জানলার সার্সি, কারোর গাছ পড়ে গাড়ী তুবড়েছে আর আমার ভেঙেছে আস্ত একটা মস্ত কাচের দেওয়াল! আবারো মন শক্ত করে কাচের জিনিষ রঙ করতে করতে বলছি, বি পজিটিভ। কাচের সঙ্গে ঘর বেঁধে শিক্ষা হলনা এ জীবনে। যত্ন করে গ্লাস পেন্টিং করতে করতে কাচ কে বলে উঠি, ক্যান ফরগিভ, বাট কান্ট ফরগেট!

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত