ঈদ সংখ্যার গল্প: অমীমাংসিত। সালমা সিদ্দিকী
আভাস…
আমির হোসেন রিক্সার সিটের পেছন দিক দিয়ে হাত বাড়িয়ে স্ত্রীর কোমর আকড়ে ধরে আছেন। শ্যামলী, টেকনিক্যাল মোড় ছাড়িয়ে রিক্সা চলেছে মিরপুর মাজার রোডের দিকে।শুক্রবার বলে নির্বিঘ্নে যাওয়া যাচ্ছে অথচ অফিস ডে তে এপথে রিক্সা দেখলেই ট্রাফিক পুলিশ হামলে পড়ে। তখন টাকা পয়সা দিয়ে রফা করা গেলে ভাল নয়তো হাওয়া ছেড়ে দেয়, গাড়ি জব্দ করে কিংবা রিক্সাওয়ালাকে কিল, চড় মারার মত বিছছিরি ঘটনার অবতারণা হয়। হরহামেশা পথেঘাটে বিচিত্র কান্ড কারখানা দেখে অভ্যস্ত নগরবাসীর জন্য এগুলো কোন বিশেষ কিছু না। কিন্তু রোজিনা ব্যতিক্রম। চোখের সামনে অন্যায়, অমানবিক কোনকিছু দেখলে সহ্য হয় না তার। তৎক্ষণাৎ যা করনীয় মনে হয় তাই সে করে বসে। ফলে অনেক সময় অহেতুক সিনক্রিয়েটও হয়ে যায়।
সেই ভয় থেকে স্ত্রীকে নিয়ে এদিকে আসতে ছুটির দিনকেই বেছে নিয়েছেন আমির হোসেন। ঝুটঝামেলা যত এড়িয়ে চলা যায় ততই মঙ্গল। আর পারা যাচ্ছে না। এমনিতেই গত সাত বছরে অনাকাংখিত ঘটনা যেন তাদের শরীরের একটা অতিরিক্ত অঙ্গ হয়ে দেখা দিয়েছে, যে বাড়তি অঙ্গের ভার না বইতে পারছে না অপসারনের পথ খুঁজে পাচ্ছে। বিশ্রীরকম অস্বস্তিতে নির্মল সুখী দিনগুলো ক্রমশ দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে। অদ্ভুতুড়ে,অযৌক্তিক অথচ অস্তিত্বশীল এই সমস্যার জট খুলতে কোথায় কোথায় গেছে তারা সে নিকেস করার চেয়ে বরং কোথায় যায় নাই সে হিসেব করা সহজ। মাজার রোডে ঢুকে করাত কলগুলো বাঁয়ে রেখে কবরস্থানের কাছাকাছি আসতেই আমির হোসেন স্ত্রীকে আরো শক্ত করে ধরে বসেন। বাম হাতে পেছন দিক থেকে কোমড় জড়িয়ে ডানহাতের মুঠোয় ভরে নেন রোজিনার একটা হাত। দোয়া পড়ে ঘনঘন ফুঁ দিতে থাকেন। প্রচলিত বিশ্বাসে কবরস্থান নিয়ে যেসব শংকার কথা শোনা যায় সেসব থেকে নিরাপদ থাকতেই তার এই বাড়তি সর্তকতা। যদিও হঠাৎ দেখায় যে কেউ এমন বসার ভঙ্গির ভুল তর্জমা করে বসতে পারে। মনে করতে পারে অসময়ে বৃষ্টি নেমে হেমন্তের এই ছুটির বিকেলকে এতটাই রোম্যান্টিক করে তুলেছে যে ষাটোর্ধ দম্পতিও আবেগে উথলে উঠে জড়াজড়ি করে রিক্সা ভ্রমণে বেরিয়েছে অথবা ইতিবাচক চিন্তায় এরকম ভাবনাও উঁকি দিতে পারে যে, সত্যিকার অর্থেই এই দম্পতি বুঝি বয়সকে সংখ্যা ভেবে নিয়েছে তাই এভাবে বেড়াতে পারছে অথবা…নাহ, আর কোন অথবা নিয়ে ভাবতে চান না তিনি। যার যা খুশি ভাবুক। তার ভাবনায় ঘুরপাক খাচ্ছে অন্য দুশ্চিন্তা যার কাছে যাচ্ছেন সে লোক পারবে তো সমাধান দিতে? আর কোন নতুন ঠিকানার খোঁজে বের হতে হবে না তো ফের? শ্যামলী থেকে মাজার রোড এইটুকু পথকেই তার অনেক দূর বলে মনে হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের জয়েন্ট ডিরেক্টর পদ থেকে সদ্য অবসরে যাওয়া আমির হেসেন রিং রোডের বাসিন্দা হয়েছেন বছর আটেক প্রায়। ব্যাংক লোনের সুবিধা থাকায় আরো আগেই ফ্ল্যাট কেনা যেত কিন্তু রোজিনার পুব-দক্ষিন খোলা বাসার আবদার রক্ষা করতে গিয়ে বাছাবাছিতেই অনেকটা সময় গড়িয়ে যায়। বিল্ডিং এর জংগলে পরিণত হওয়া ঢাকা শহরে খোলামেলা বাসা পাওয়ার চেয়ে আমেরিকার পাসপোর্ট পাওয়াও সহজ কাজ। কিন্তু নাছোরবান্দা রোজিনাকে সেকথা বোঝায় সাধ্য কার? ফলে বন্ধু,পরিচিতজনদের একে একে জমি, ফ্ল্যাট হয়ে গেলেও আমির হোসেন পুব-দক্ষিন খোলার খোঁজে নিয়োজিত থাকেন দীর্ঘদিন। অবশেষে শ্যামলী রিং রোডের এই বাসার সন্ধান মেলে। এক সহকর্মীর কাছে খবর পেয়ে লোকেশন দেখতে আসতে আসতেই পুব দক্ষিনের পাঁচটা ফ্ল্যাটের চারটা বুকিং সারা! নির্মাণাধীন বিল্ডিং এর নীচতলায় দাঁড়িয়ে প্রজেক্টের উপর ব্রিফিং শেষে বিক্রয় প্রতিনিধি ছেলেটা সেদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিল,
স্যার, নিতে চাইলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন। পরে হয়তো আফশোস করবেন। কারণ ঢাকা শহরে দূর্লভ হল নিঃশ্বাস নেওয়ার মত খোলা হাওয়া আর সবচেয়ে সস্তা হল টাকা! খোঁজ নিলে দেখবেন আপনার অফিসের পিয়নেরও নামে-বেনামে ফ্ল্যাট আছে।
সত্যিই তাই! সেকারণে সময় নষ্ট না করে তিনি অবশিষ্ট ফ্ল্যাটই বুকিং দিয়ে দেন। ছয় তলা বিল্ডিং এর ছয় তলার পুব দক্ষিন কর্নার। টপ ফ্লোর। লিফট সুবিধা আছে তাছাড়া দুই’পা দূরত্বে বলে ছাদের সুবিধা ভোগ করা যাবে। রিটায়ারমেন্টের পর জমিয়ে ছাদ বাগান করে সময়-মন ভরানো যাবে বিবেচনায় তিনি বেশ খুশিই হয়েছিলেন। আর ‘ড্রীম আনলিমিটেড’ ডেভেলপার কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি আলী করিম খুশি হয়েছিল তার চাকুরি জীবনে সবচেয়ে কম কথায় টপ ফ্লোর বিক্রির অভিঙ্গতা অর্জন করে।
তবে অখ্যাত হলেও ডেভলপার কোম্পানি কথা রেখেছিল। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিয়েছিল তারা। অতঃপর শুরু হয় রোজিনার ব্যস্ততা। দিনমান ছুটোছুটিতে যেন চপলা কিশোরী বনে যায় সে। পাখি যেমন ঠোঁটে করে নখে করে বিভিন্ন জায়গা থেকে খড়কুটা এনে জড়ো করে, আপন খুশিমত রচনা করে তার নীড়, রোজিনাও ঠিক তাই করছে। পুবের বারান্দায় মাটির মালসায় পানি রেখে দেয়, তপ্ত রোদে তৃষ্ণার্ত কাক, শালিখ উড়ে এসে সে পানির খোঁজ পেয়ে পরিতৃিপ্ত নিয়ে উড়ে যায়। পাহাড়ী মেয়েদের হাতে বোনা মোটা কাপড়ের ফোল্ডিং ইজি চেয়ারটা পাতে মাষ্টারবেড লাগোয়া দখিনের বারান্দায়। রাতের বেলা বাতি নিভিয়ে আরাম করে বসে থাকার ইচ্ছায় আড়ং থেকে কেনা শখের চেয়ারটা যুৎসই জায়গার অভাবে এতদিন ভাঁজকরে তোলা ছিল আলমারিতে। এই ফ্ল্যটে এসে ওটার একটা হিল্লে করতে পেরে দারুণ খুশি সে। আমির হোসেন স্ত্রীর কর্মকান্ড দেখেন আর মনেমনে হাসেন। বেডরুম থেকে বাথরুম, কিচেন থেকে লিভিং ফ্ল্যাটের প্রতিটি কোণা সে সাজাচ্ছে গোছাচ্ছে নিজের ইচ্ছা-শখ-প্রয়োজন মনে রেখে। বারান্দার গাছ কিংবা জানালার পর্দা নিয়েও কত চিন্তা,পরিকল্পনা! গুচ্ছের টাকা বেরিয়ে গেলেও তিনি কিছু বলছেন না বরং এসব দেখে আনন্দ পাচ্ছেন। দেরীতে হলেও মনমতো ফ্ল্যাট কিনে দিতে পারায় স্ত্রীর কাছে ক্রেডিট দাবী করে হাসি ঠাট্টায় সময়গুলো উপভোগ করছেন।
দেখতে দেখতে শুকনো পাতার মত যেন উড়ে যায় একটা বছর! ‘রাসেলড্রীম’ বাড়ির বাসিন্দাদের ফ্ল্যাটে ওঠার বর্ষপূর্তিতে ‘রাসেলড্রীম ওনার্স এ্যাসোসিয়েশন’ থেকে ছাদের কমিউনিটি হলে আড্ডা খাওয়ার আয়োজন করা হয়। নাগরিক ব্যস্ততায় একটা কোন অনুষ্ঠান-উপলক্ষ ছাড়া তো আজকাল মানুষের দেখা সাক্ষাৎ মেলাই ভার। এক বছর যাবৎ একই বিল্ডিং বাস করলেও এখন পর্যন্ত বিশজন ফ্ল্যাট মালিকের সবাইকে চেনেন না আমির হোসেন। পরিচয়ই হয় নাই। নিজের মুখোমুখি ফ্ল্যাটটা শুরু থেকেই তালাবন্ধ দেখে কৌতুহলী হয়ে দিন কয়েক আগে জানতে পেরেছেন ওটার মালিক প্রবাসী। ছুটি ছাটায় দেশে এসে থাকবেন বলে কিনে রেখেছেন। হুটকরে এসে কিছুিদন থেকে আবার চলে যাবেন বলে ভাড়াও দেন নাই। ওনার্স এসোসিয়েশনের আজকের অনুষ্ঠান সন্ধ্যা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত হলেও পরিচিতি পর্বের জন্য রাত নয়টা থেকে দশটা সবাইকে উপস্তিত থাকতে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়েছে। খাবার বুফে। যার যখন সুবিধা এসে খেয়ে নিলেই হল কিন্তু ঐ একঘন্টা সবাইকে থাকতে হবে। আমির হোসেনদের কলেজ পড়ুয়া ছেলে-মেয়ে রিয়াদ, রিনি ঘনঘন ছাদে যায় আর এটা ওটা দেখে এসে মা বাবাকে শোনায়, ‘উপরে এলাহি কান্ড!’, ‘তিন তলার মটুটা সেই থেকে গাপুসগুপুস খেয়েই যাচ্ছে …’, ‘পাঁচতলার আঙ্কেল আন্টি কী সুন্দর ম্যাচিং করে কাপড় পরেছে, তোমরাই খালি পরতে চাও না…।’ বিল্ডিংয়ের উৎসবের আমেজ তাদের পরিবারেও লেগেছে তাই ছেলেমেয়েদের মুখে মধুর অভিযোগ শুনে স্ত্রীর দিকে আড়চোখে তাকান আমির হোসেন, রোজিনাও মজা পায় তবে মুখে কপট রাগ দেখিয়ে বাচ্চাদের সরিয়ে উঠে যায়। রেডি হতে।
সেদিন রাতে অনুষ্ঠান থেকে ফিরে খুঁটিনাটি কথার মাঝে সবার একটা কমন অবজার্ভেশন মিলে যায়, তা হল প্রত্যেকেই মুখোমুখি ফ্ল্যাটের ভদ্রলোককে দেখে অবাক। এই ভদ্রলোক এলেন কখন? দিনে রাতে বহুবার ছাদে আসা-যাওয়া হয়েছে, দরজা তো বলতে গেলে খোলাই ছিল সারাদিন। মুখোমুখি ফ্ল্যাট, কেউ এলে চোখে পড়ারই কথা। তাও যদি না হয় অন্তত শব্দ তো পাওয়া যাবে! সেসব কিচ্ছুটি নেই, অবাক কান্ড! লোকটার চেহারা-সুরতও কেমন যেন! উচ্চতা বিশ্রীরকমের বেশি,গায়ের রঙ ফ্যটকা সাদা। মিনমিনে মেয়েলি গলায় টেনে টেনে কথা বলেন। ‘আচ্ছা উনি কোন এলাকার মানুষ?’-রোজিনা জানতে চায়, ‘কথার টানটা ধরতে পারলাম না। আবার দেখা হলে জিজ্ঞেস করে নিবা। লোকটার বৌ, বাচ্চাও তো দেখলাম না! নাকি ছিল, আমরাই দেখি নাই? আজ আমাদের সবার চোখ-কান আন্ধা-কালা হইছে মনে হয়’, বলতে বলতে মেইন দরজায় সিটকিনি আটকাতে উঠে যায় সে। লোকজনের ওঠানামার আওয়াজ বন্ধ হয়েছে অনেকক্ষণ। দরজার বাইরে কোন জুতা স্যান্ডেল আছে কিনা দেখার জন্য উঁকি দিতেই ‘রিয়াদ…’ বলে চিৎকার দিয়ে পড়ে যায়। ধরাধরি করে খাটে এনে শুইয়ে মাথায় পানি ঢেলে সেবা শশ্রুষা করায় কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফেরে তবে কেমন যেন চুপচাপ হয়ে যায়। কথা বলে কম, হঠাৎ হঠাৎ চমকে ওঠে। হাসিখুশি মানুষটার এমন গুমোট আচরণে পুরো পরিবারের মন মরা লাগে। অনেক জোরাজুরিতেও জানা যায় না সেদিন রাতে ঠিক কী হয়েছিল। এর মধ্যে আরেক উপদ্রব গভীর রাতে ছাদে চেয়ার টেবিল ছ্যাচড়ানোর শব্দ! বেশ কয়েকজন মানুষ এক জায়গায় হলে যেমন চেয়ার টেনে সরিয়ে নড়িয়ে বসার আয়োজন করে, অনেকটা তেমন। সেই সাথে ধাপধুপ পা ফেলার আওয়াজ। মাঝে মাঝেই বিরক্তি নিয়ে ঘুম ভেঙে উঠে বসে রোজিনা অথচ ছাদে গেলে দেখা যায় কিছুই নেই। ফাঁকা। আমির হোসেন একবার ভাবেন প্রতিবেশীদের বিষয়টা বলবেন কিনা! পরে মনে হয় তা ঠিক হবে না। এরকম আজগুবি কথা কেউ বিশ্বাস করবে না, খামোখা একটা হাসির খোরাক হওয়া। অগত্যা আত্মীয় বন্ধুদের সহযোগিতায় টোটকা-তদবীর চালিয়ে যেতে থাকেন। বিভিন্ন মাজার থেকে পড়া পানি এনে ঘরময় ছিটিয়ে দেন। ছাদেও ছিটান। নোয়াখালীর এক হুজুরের খুব নামডাক শুনে তার কাছ থেকে চড়া হাদিয়া দিয়ে পাটপড়া কিনে আনেন। সেই পাটে চিকন দড়ি পাকিয়ে রোজিনার কোমরে বেঁধে দেন আর খানিক ঘরের প্রবেশমুখে ঝুলিয়ে রাখেন। হুজুরের নির্দেশমত লবন গোলা পানি দিয়ে ঘর মোছাও শুরু হয়। এক বালতি পানিতে একমুঠ লবণ। এভাবে যতবার পানি বদলাবে ততবার মুঠ মুঠ লবন গুলতে হবে। দুই হাজার স্কয়ারফিটের বাসা মুছতে প্রতি দুইদিনে এককেজি করে লবন জলে যায়! কিন্তু এর অন্যথা করা যাবে না। হুজুরের কড়া নির্দেশ! অনর্থক খরচে মেজাজ কুটকুট করলেও ক্ষণিকের জন্য মনে হয় আপদ বুঝি কেটে গেছে! কদিন কোন শব্দ টব্দ না পেয়ে যেই একটা স্বস্তির ভাব আসি আসি করছে ওমনি একদিন হঠাৎ ঘুম থেকে লাফিয়ে ওঠে রোজিনা, বলে,
কে নাচে? এত জোরে নূপুরের আওয়াজ হচ্ছে কেউ শুনতে পাও না?
সবাই কানখাড়া করে কিন্তু রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে প্রতিবেশীর কুকুরের ঘেউ আর মোড়ের পাহারাদারের হুইসেল ভিন্ন কিছুই কানে আসে না। এর ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে দুহাতে মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে সে,‘আমি কি তবে পাগল হয়ে যাচ্ছি? এসব কী হচ্ছে আমার সাথে?’ এরপর বছর দুই সাইক্রীয়াটিস্টের কাছে যাতায়াত করে। ওষুধ, কাউন্সেলিং দুটোই চলেছে কিন্তু ফলাফল তথৈবচ!
নিরুপায় হয়ে আমির হোসেন ফ্ল্যাট বিক্রিরও উদ্যোগ নিয়েছিলেন। জীবনে শান্তিই যদি না থাকে তো কিসের ফ্ল্যাট আর কিসের কী! রোজিনার বান্ধবীর মাধ্যমে খোঁজ পেয়ে নড়াইল মাষ্টারপাড়ার এক ফকিরের কাছে তদবীর চাইতে গেলে বাবা বলেছিলেন ,‘ওডা দোষা বাড়ি। রক্তের খেইল আছে ওহানে। বাড়ি বদলালিপারে সব ঠিক হবেনে। ’এই ‘দোষা’ তত্ত্বের তালাশ করে জানা যায় নির্মাণাধীন অবস্থায় এ বাড়ির ছাদে মৃত নবজাতক পাওয়ার ঘটনায় থানা পুলিশ, বহু হাঙ্গামা হয়েছিল। পরে ডিভলাপার কোম্পানি টাকা পয়সা খরচ করে সেসব মেটায়। ফকির বাবার কথা তো তাহলে মিলেই গেল বিবেচনায় ফ্ল্যাট বিক্রির সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলে এককান দুইকান করে বিল্ডিং এর সবাই সবকিছু জেনে যায়। কেউ বলে বুজরুকি পাত্তা দেওয়ার কিছু নাই। কেউ আবার মানসিক রোগ বলে আরো ভালো কোন সাইক্রীয়াটিষ্ট দেখানোর পরামর্শ দেয়। কেবল মালেক সাহেব সিরিয়াসলি নিয়েছিলেন বিষয়টা। দোতলার এই ভদ্রলোক ফ্ল্যাট ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি, পেশায় আইনজীবী। সব শুনে তিনি কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন, ঘাবড়াবেন না আমির ভাই। পৃথিবীতে যুক্তির বাইরেও অনেক কিছু ঘটে, তারমানে এইনা যে সেসব মিথ্যা। ভাবির সমস্যাটা তেমন কিছু-ই হবে হয়তো। তবে কারণ খুঁজে না পেলেও সমাধান খুঁজে দেখি চলেন। ফ্ল্যাট বিক্রি কোন ভাল সমাধান না। আসেন আমার সাথে।
সেদিন নিজ থেকেই বাসায় এসে তিনি অনেকগুলো ঘটনা শোনান। বলেন, ওকালতি পেশায় আছি বলে যুক্তি দিয়েই মানুষের মুসকিল আসান করা আমাদের কাজ কিন্তু কীভাবে বললে বিশ্বাস করবেন জানি না আমি এখন যতগুলো কথা বলবো তার সবই অযৌক্তিক অথচ সত্য। আমার নিজের চোখে দেখা। একবার আমার সিনিয়রের বাড়িতে রাজকীয় খানার আয়োজন করা হয়। কি উপলক্ষে, কারা মেহমান কিছুই জানি না। শুধু নির্দেশমত আমরা দুইজন জুনিয়র মিলে যাবতীয় বন্দোবস্ত করে তিন তলায় সব পরিবেশন শেষে নীচতলায় বসেছিলাম। কাউকে আসতেও দেখলাম না অথচ ঘন্টাখানেক পর গিয়ে দেখি শুধু থালাবাসন পরে আছে। খাবার নাই। এইতো আদাবরেই সেই বাড়ি। সিনিয়রের হঠাৎ মৃত্যুর পর ম্যাডাম সব বিক্রি করে বিদেশে চলে যাওয়ায় এখন আর যাতায়াত নাই।
আরেকবার কী হয়েছিল শোনেন, সিনিয়রের শাশুড়ীর হার্টের সমস্যায় ডাক্তার দেবী শেঠী জবাব দিয়ে দেন। কিন্তু সিনিয়র কোথা থেকে এক আংটি জোগাড় করে তাকে পরান ,তারপর আবার নিয়ে যান ডাক্তারের কাছে। এবার সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করে চোখ কপালে তুলে দেবী শেঠী বলেন ‘জাষ্ট মিরাকল!’ আরো কি হয়েছিল জানেন? এই ঘটনার বছর দশেক পরে যখন খালাম্মা মারা যান তখন সিনিয়র দেশের বাইরে। তো হঠাৎ অসুস্থ হওয়ায় খালাম্মাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে কিছুতেই কিছু কাজে দিচ্ছিল না। আই সি উ তে রাখা হয় চারদিন। খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। পরে সিনিয়র ফোনে ভাবিকে বলেন উনার হাতের আংটিটা খুলে দিতে। ভাবি তাই করেন আর সেই দিনই খালাম্মা মারা যান। শুনেছি আংটি দেওয়ার সময় নাকি বলা ছিল যে, মৃত্যুকালে এই আংটি খুলে না ফেললে অনেক যন্ত্রণা হবে। জান বের হবেনা। বিশ্বাস হয়? নিজের চোখে দেখা। হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি, লাশ দাফন সবকিছুতে ছিলাম আমি। এজন্যই বললাম সবখানে যুক্তি খুঁজে লাভ নাই। আপনাকে একজনের ঠিকানা দিচ্ছি, উনার কাছে ভাবিকে নিয়ে যান। অনেক তো ঘুরেছেন, এইবার সমাধান মিলবে আশা করি। সবশুনে রোজিনা স্বামীর দিকে তাকায়। আমতা আমতা করে বলে, সেদিন রাতে দরজা খুলে বাইরে উঁকি দিতেই দেখে মুখোমুখি ফ্ল্যাটের ভদ্রলোক সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে কাক হয়ে উড়ে গেলেন আর চিৎকার করে রিয়াদকে ডাকার মুহূর্তে একটা শীতল স্পর্শে সে জ্ঞান হারায়। মালেক সাহেব মাথা নাড়েন, আচ্ছা…আচ্ছা..বুঝতে পেরেছি, মনে সাহস রাখুন। সমস্যা কেটে যাবে। আমির ভাই… যান একবার ওখানে।
সংক্রান্তি…
ঢাকা শহরে গলি ঘুপসির ঠিকানা খুঁজে বের করা বিরাট যন্ত্রণার কাজ। তারউপর হুট করে নেমে পড়া সন্ধ্যাটা আরেক বিপত্তি ঘটায়। মাজার রোডে রিক্সা ছেড়ে দিয়ে বেশ খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরির পর আমির হোসেন লালকুঠি এলাকার এমন এক সরুগলির মধ্যে এসে পড়েন যেখানে দুজন মানুষ পাশাপাশি হাঁটলেও গায়ে গা লেগে যায়।বড় রাস্তার সড়কবাতির আলো এখানে এসে পৌঁছায় না বলে এলোমেলো তার টেনে জ্বালানো সস্তা লাইটের টিমটিমে আলোয় সন্ধ্যার আঁধারকে আরো খানিকটা গাঢ় লাগে! সবকিছু পরিস্কার দেখা না গেলেও ছোট ছোট ঘিঞ্জি ঘর আর চারদিকের অবস্থা দেখে সহজেই এখানে বসবাসকারী মানুষদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে অনুমান করা যায়। এগুলোর মধ্য থেকেই একটা ঘরকে হাত উঁচু করে দেখিয়ে দেয় গলিতে খেলতে থাকা ছিন্নবস্ত্রের দুই বালক।তারা দূর থেকে দেখিয়ে দিয়ে চলে যায়।
হেমন্ত কালে সন্ধ্যা নামে ঝুপ করে। অবিবেচক অতিথির মতো কোন আগাম প্রস্তুতির সুযোগ না দিয়েই হুট করে নেমে পড়ে। নিস্তেজ ভাব নিয়ে একচিলতে বিকেলটা যেন সুরুৎ করে সন্ধ্যার পেটে সেঁধিয়ে যায় আর অমনি চারদিকে ছোপ ছোপ আঁধার ঘনায়।এত স্বল্পায়ুর বিকেল যে খেলতে নামা শিশুদেরও মন ভরে না। পোষায় না আসলে। লালকুঠির বালকদ্বয়ের চোখেমুখে যেন সেই আক্ষেপের ছায়া। সন্ধ্যার আজান পড়ে যাওয়ায় অনিচ্ছা সত্বেও ওরা ঘরে ফিরে যাচ্ছিল তখনই আমির হোসেনদের সাথে দেখা। ঠিকানাটা জিজ্ঞেস করায় পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করে তারা আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয়, সাথে আসে না। এইবার ওদের চোখে অতৃপ্তি ছাপিয়ে আরো কিছু দেখেন আমির হোসেন। ভয় নাকি কৌতূহল? ঠিক বোঝা যায় না।
অতঃপর কাংক্ষিত ঘরের টিনের দরজায় শব্দ করলে সামনে বেরিয়ে আসা লোকটাকে দেখে তারা চমকে যান। তার দৈহিক গড়ন গড়পরতা বাঙালির সাথে মেলে না। উচ্চতা, রঙ এমনকি কন্ঠস্বরও অদ্ভুত! ঢ্যাঙা লোকটা মিনমিনে গলায় তাদের ভিতরে আসতে বলে। তার আপ্যায়নের ভঙ্গিটি এমন যেন কত দিনের চেনা অথচ খটকা মেটাতে আমির হোসেন বেশকয়েক বার নিজের নাম এবং মালেক সাহেবের পরিচয় বলে ঠিক জায়গায় এসেছেন কিনা নিশ্চিত হয়ে নেন। তাদের দোনো-মনো দেখে গৃহকর্তা নির্ভয় দিয়ে বলে,‘আমি সব জানি’। কন্ঠের এমন মিনমিনে স্বরের সাথে বক্তব্যের এই দৃঢ়ভাব বড্ড বেখাপ্পা লাগে। কিছুক্ষণ একথা সেকথা পেরিয়ে আমির হোসেন মূল আলাপ পাড়তে চান। তার আসলে কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল। ক’বছরে কম তো ঘোরাঘুরি হয় নাই; বহু ফকির, সাধু, হুজুরের কাছে গেছেন কিন্তু এখানে আসার পর থেকেই অন্যরকম বোধ করছেন। মনে হচ্ছে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলেই বাঁচেন।
সমস্যার কথা শুরু থেকে বলতে গেলে লোকটা আবারও বাধা দিয়ে বলে,‘আমি জানি তো সব।’ অতঃপর ঘরের ভেতর বারকয়েক চক্কর মেরে আচমকা বাতি নিভিয়ে দিলে রোজিনা স্বামীর গা ঘেঁষে শক্ত হয়ে বসে। মিনমিনে স্বর কথা বলে ওঠে, মনেহয় যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসা কোন অলৌকিক শব্দমালা! অন্ধকার, কন্ঠস্বর মিলে ঘরটাতে এক অতিপ্রাকৃত আবহ তৈরি হলে রোজিনা ফিসফিসিয়ে বলে, ‘চলো চলে যাই, ভাল্লাগছে না।’ ওমনি শোনা যায়, ‘ভয় পাবেন না। এক্ষুণি যাবেন। আমার হাতটা একটু ছুঁয়ে দেখুন তো…’ সঙ্গে সঙ্গে আমির হোসেন বাতি জ্বালাতে বলেন। হঠাৎ মনেপরে তিনি ভদ্রলোকের নাম জানেন না। মালেক সাহেব ঠিকানার সাথে কোথাও নাম লিখে দেন নাই। অগত্যা নিজেই উঠে গিয়ে সুইচ খুঁজতে থাকেন। পান না। যেখানে বসে ছিলেন সেখানে ফেরত আসেন দ্রুত, দেখেন পাশের চেয়ারটা খালি! স্ত্রীর নাম ধরে ডাকেন, ঘরময় হাতড়ে চলেন। সাড়া মেলে না। অকস্মাৎ দরজা খুলে যায়। দুটো কাক উড়ে বেরিয়ে যেতে যেতে ডাকে….কা..কা..
আমির হোসেন মাথা ঘুরে পরে যান। সব অন্ধকার…।
গল্পকার
জন্মশহর মানিকগঞ্জ ।বসবাস করেন ঢাকা,বাংলাদেশ । গ্রন্থ:প্রলাপ কিংবা পঙক্তিমালা (বইমেলা, ২০২০)